ফিরে আসা২ পর্ব-৩০+৩১

0
350

#ফিরে_আসা২
৩০+৩১ (ক)
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

“জানি আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। বাধ্য হয়ে ভুল করেছি। তুমি আমাকে বাধ্য করেছো।”

“আমি বাধ্য করেছি? আমি তোমাকে ভালোবেসেছি নওশীন। আর এই তোমার ভালবাসার মর্যাদা?”

“ভালো আমি বাসিনি? বেসেছি, এখনও বাসি, আজীবন বাসবো। তুমি মর্যাদা দিয়েছ আমার ভালোবাসার? আমার থেকেও তুমি তোমার কাজকে বেশি ভালোবাসো।”

“তাই বলে এত বড় একটা শাস্তি দিতে হবে?”

“আমি কোনো শাস্তি দিইনি তোমাকে। ভুল করেছি, ছোট্ট একটা ভুল।”

অতীতে ফেলে আসা ভয়ংকরতম দিনগুলোর একটির ঝলক মনের মাঝে দেখতে পেলো আরশাদ। অতীতকে ভুলে মানুষ কি বাঁচতে পারে? পারে তো অবশ্যই। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ যদি কেবল অতীত আঁকড়ে পড়ে থাকতো, তবে মানবসভ্যতা আজ এতদূর এগিয়ে আসতে পারতো না। মানুষ অতীত ভুলে যায়। তবে পুরোপুরিই কী ভুলে যায়? হয়তো না। মানুষ তার অতীতকে ভুলে গেলেও অতীত তাকে ভুলে যায় না। অতীতে ঘটে যাওয়া প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ঘটনা মানুষের বর্তমানকে প্রভাবিত করে। বর্তমানে মানুষ যা করে, তা তার অতীতেই প্রতিচ্ছবি মাত্র।

বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। এমনিতেই শীতকাল, তার ওপরে আবার বৃষ্টি। ভালোই শীত লাগছে আরশাদের। গলা পর্যন্ত ব্ল্যাঙ্কেট টেনে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে। অন্ধকার ঘর, বৃষ্টির শব্দ, তন্দ্রার ভাব – সবকিছুই তাকে টেনে নিয়ে গেল অতীতে। কত বছর হয়ে গেল ওই ঘটনার? সাত-আট বছর তো প্রায় হবেই। না-কি আরও বেশি? হিসাব করতে পারছে না আরশাদ। তার মনে সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ভেসে উঠছে অতীতে ঘটে যাওয়া একের পর এক দৃশ্য।

ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচটি সিনেমা দুই বছরের ব্যবধানে মুক্তি পায়। পরপরই পাঁচটি সিনেমাই হয় ব্লকবাস্টার। দুই বছরের মধ্যে আরশাদ হক নবাগত থেকে ইন্ডাস্ট্রির উজ্জ্বলতম তারকায় পরিণত হয়। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি তখন খোঁজ করছিল তার পরবর্তী সুপারস্টারের। আর আরশাদ এদিকে একের পর এক ব্যবসাসফল সিনেমা উপহার দিচ্ছে দর্শকদের। এই মানুষটাই যে খুব শীঘ্রই ইন্ডাস্ট্রির সবথেকে বড় সুপারস্টারে পরিণত হতে যাচ্ছে, এ সত্য তখন সকলেরই জানা।

একদিকে আরশাদের ক্যারিয়ারের শুরু যতটা জাকজমকপূর্ণ, ততটাই নিষ্প্রভভাবে শুরু হয় ইন্ডাস্ট্রির আরেক অভিনেত্রীর পথচলা। নওশীন, ইন্ডাস্ট্রিতে প্রথমবারের মতো সুযোগ সে পায় তার সৌন্দর্যের জন্যে। সামনাসামনি দেখলে কেউ নির্ঘাত দেবীমূর্তির সঙ্গে তুলনা করে ফেলতে পারে। তবে সিনেমা হিট করানোর জন্যে সৌন্দর্য যথেষ্ট নয়। ফলত নওশীনের ক্যারিয়ারের প্রথম তিনটা সিনেমাই হয় ফ্লপ।

পরিবারের মতের বিরুদ্ধে অভিনয়জগতে পা রেখেছিল নওশীন। তার বাবা তো চেয়েছিল বড়লোক এক প্রবাসীর সঙ্গে তাকে বিয়ে দিয়ে দিতে। বাবার সেই ইচ্ছা অপূর্ণ রেখে, একপ্রকার জেদ করেই সিনেমায় নাম লেখায় নওশীন। তবে প্রথম তিনটি সিনেমাই ভরাডুবির মুখ দেখার পর তার মনে হয় জেদ ছেড়ে দিয়ে আবারও বাবার কাছেই ফিরে যেতে হবে। বাবার চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তটাকেই মেনে নিতে হবে।

তখন আঁধারের আলোর মতো তার কাছে প্রস্তাব আসে ‘আয়না’ নামের সিনেমার। সেই সিনেমার সঙ্গে আগে থেকেই চুক্তিবদ্ধ ছিল আরশাদ। নওশীন তার নামটা দেখেই লুফে নেয় সিনেমাটি।

শুটিং সেটে আরশাদ বিন্দুমাত্র পাত্তা দেয়নি নওশীনকে। সে বেশ টের পেতো নওশীন হা করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেধে সেধে কথা বলতে আসে। আরশাদের পছন্দগুলোকে জোরপূর্বক নিজের পছন্দ বানানোর চেষ্টা করে।

এই যেমন শুটিংয়ের অবসরে আরশাদ গল্প করছিল পরিচালকের সঙ্গে। গল্পের ফাঁকে সে বলে বসে, “আমি একবার কোরিয়ায় গিয়েছিলাম, সেখানকার ট্র্যাডিশনাল খাবার আমার দারুণ লেগেছে।”

যদিও নওশীন সেই গল্পের অংশ ছিল না। তবুও কোথা থেকে যেন এসে ফাঁপিয়ে পড়ে বলে, “আরে! কী আশ্চর্য! আমারও তো কোরিয়ান খাবার পছন্দের। আচ্ছা, আপনি কবে কোরিয়ায় গিয়েছিলেন?”

আরশাদ বেশ বুঝতে পারতো এই মেয়ে কোনোদিন কোরিয়ার আশেপাশেও যায়নি। তার মূল উদ্দেশ্য যে করেই হোক আরশাদকে মুগ্ধ করা। তার পাত্তা পাওয়া। পাত্তা আরশাদ মোটেও দেয়নি, এড়িয়ে গেছে বারবার।

‘আয়না’ মুক্তি পেলো। প্রথমবারের ব্লকবাস্টারের স্বাদ পেলো নওশীন। সেই সঙ্গে তার সৌন্দর্যে পাগল হলো গোটা দেশের তারুণ্য। সে যাকে পাগল করতে চেয়েছিল, সে পাগল হয়নি কেবল। তবে সিনেমা মুক্তির পর আর আগের মতো নওশীনকে অগ্রাহ্য করতে পারেনি আরশাদ। অন্যেরা নওশীনের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলেও, আরশাদকে মুগ্ধ করেছিল তার গুণ। অভিনয়ের গুণ।

শুটিংয়ের পুরোটা সময়ে যে আরশাদ নওশীনের দিকে চোখ তুলে পর্যন্ত তাকায়নি, সেই আরশাদ ‘আয়না’র প্রিমিয়ারের দিন নিজে তার কাছে এসে বলে, “You did a pretty good job.”

নওশীনের চোখদুটো দেখে তখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, আরশাদের বলা এই একটা বাক্যই আগামী কয়েক রাতের জন্যে তার চোখ থেকে ঘুম ছিনিয়ে নিতে চলেছে।

আমাদের দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির একটা অলিখিত নিয়ম হলো কোনো জুটির একটা সিনেমা হিট হলে তাদের নিয়ে পরবর্তীতে আবারও সিনেমা তৈরি হবে। ‘আয়না’র প্রযোজকও আরশাদ-নওশীনকে নিয়ে তার পরবর্তী সিনেমার ঘোষণা দিলেন – ‘প্রহর’।

এই সিনেমার শুটিংয়ের শুরুর দিকেও আরশাদ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে চেয়েছিল নওশীনকে। তবে নওশীনের মাঝে লক্ষ্য অদ্ভুত এক পরিবর্তন। যে নওশীন আগে সুযোগ পেলেই তাকে চোরাচোখে দেখতো, সে এখন দেখছে নিঃসংকোচে। আরশাদের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেলেও চোখ সরিয়ে নিচ্ছে না। মিষ্টি হেসে দৃষ্টি তার দিকেই আটকে রাখছে।

ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামালো না আরশাদ। মনোযোগ দিলো তার অভিনয়ে। ‘প্রহর’ সিনেমায় এমন একটা দৃশ্য ছিল, নায়ক-নায়িকার মাঝে মনোমালিন্য চলছে। নায়িকার করা কোনো একটা ভুলের কারণেই মূলত নায়ক রেগে থাকে। নায়িকা নানাভাবে তার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করে। শেষমেশ উপায় না পেয়ে চট করে নায়কের গালে চুমু খেয়ে দৌড়ে পালায় সে।

এমন দৃশ্যে অভিনয়ের ক্ষেত্রে কোনো বাড়তি চাপ অনুভব করে না আরশাদ। এর থেকেও ঘনিষ্ট দৃশ্যে এর আগেও অভিনয় করেছে সে। অভিনয়টাকে অভিনয়ের মতোই নেয় সে। সেদিনও স্বাভাবিকভাবেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়ায় সে। পরিচালক “অ্যাকশন!” বলার সঙ্গে সঙ্গে অভিনয়ের জগতে ডুব দেয় আরশাদ। তবে নিজের অজান্তেই নওশীনের ঠোঁটের স্পর্শ অভিনয়ের জগৎ থেকে বের করে আনে তাকে। সমস্ত শরীরে তার যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। এমনটা আগে তো কখনো হয়নি!

নিজের এই অহেতুক অনুভূতিগুলোকে একেবারেই প্রশয় দিলো না আরশাদ। আগের মতোই অগ্রাহ্য করতে থাকলো মেয়েটাকে। এর দিন কয়েক পরের ঘটনা। আরশাদ বা নওশীন কারোর শট চলছে না তখন। তারা যে শুটিং হাউজে শুটিং করছিল, তার পেছনে একটা পরিত্যাক্ত বাগানের মতো আছে। অবসরে সেখানে দাঁড়িয়েই সিগারেট টানছিল আরশাদ। হুট করে নওশীন এসে উপস্থিত হয় সেখানে।

মেয়েরা সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। তাই একজন জেন্টেলম্যান হিসেবে আরশাদ উচিত সিগারেটটা হাত থেকে ফেলে দেওয়া। কিন্তু আরশাদ ফেলল না। মেয়েটা তো আগ বাড়িয়ে তার কাছে আসছে, সে তো আর নওশীনকে বলেনি এখানে আসতে। নওশীন এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে হালকাভাবে গল্প করতে লাগলো। আরশাদ তার কথায় “হুঁ” এর থেকে বেশি কিছু জবাব দিচ্ছিল না।

এক কথা দু কথা করতে করতে এক পর্যায়ে নওশীন হঠাৎ বলল, “সেদিন শটের মধ্যে আপনাকে যে চুমু খেলাম, আপনার সেটা ভালো লেগেছিল তাই না?”

অবাক হয়ে মেয়েটার কথা শুনলো আরশাদ। কোনো সংকোচ নেই, কোনো ভনিতা নেই। হাসি হাসি মুখে কথাটা বলল নওশীন। তবে অবাক করার বিষয় হলো, আরশাদের যে চুমুটা ভালো লেগেছিল এটা নওশীন জানলো কী করে? অন্তর্যামী না-কি এই মেয়ে?

আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “ভালো লাগতে যাবে কেন? তাছাড়া শটের মধ্যে আমি কোনো কিছুই ফিল করি না।”

নওশীন তখন অসম্ভব দুঃসাহসিকতার এক কাজ করলো। অবিকল সেই দৃশ্যের মতো চুমু খেয়ে বসলো আরশাদের গালে। সেই দৃশ্যে অভিনয়ের সময়ে যদিও চুমু খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল নওশীন। আজ পালালো না।

আরশাদের চোখে চোখ রেখে বলল, “এই যে শটের বাইরে চুমু খেলাম, নিশ্চয়ই ফিল করেছেন। ভালো লাগেনি?”

মেয়েটার কান্ডে একেবারেই হতবাক বনে গেল আরশাদ। ক্যামেরার বাইরে এই প্রথম কোনো মেয়ে তার এতটা কাছাকাছি। এমন গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়ে আরশাদ এ জীবনে দেখেনি। নওশীনের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে, কিছুটা রাগ দেখিয়েই সেখান থেকে চলে যায় আরশাদ।

দিন কয়েক পরের ঘটনা। সেদিন শুটিং ছিল না। পুরোটা দিন বাড়িতেই ছিল আরশাদ। হঠাৎ খবর এলো রাস্তা পাড় করতে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করেছে নওশীন। পা ভেঙে হসপিটালে ভর্তি। মেয়েটাকে সহ্য করতে না পারলেও এই খবরে বেশ খারাপই লেগেছিল আরশাদের। যতই হোক, তারা সহশিল্পী। একসঙ্গে একটা ব্লকবাস্টার সিনেমা উপহার দিয়েছে দর্শকদের, আরও একটা দিতে যাচ্ছে। মেয়েটা এত বড় একটা অ্যাকসিডেন্ট করেছে, তাকে হসপিটালে দেখতে যাওয়া নিতান্তই কর্তব্য মনে করলো আরশাদ।

ভাবনা অনুযায়ী পরদিন ফুলের তোড়া নিয়ে আরশাদ হাজির হসপিটালে। তাকে দেখেই নওশীনের অসুস্থতা অর্ধেক সেরে গেল। হসপিটালে অনেকটা সময় গল্প করলো দুজনে। নওশীন বর্ণনা করলো, কী করে বোকার মতো রাস্তা পাড় হতে গিয়ে একটা মোটরসাইকেলের সামনে পড়ে যায় সে।

গল্পের এক পর্যায়ে নওশীন হাসি হাসি মুখে বলে উঠলো, “আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না যে?”

“কোন প্রশ্ন?”

আরশাদ সত্যিই ভুলে গিয়েছিল সেদিন শুটিং হাউজের পেছনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি।

নওশীন লাজুক হাসি হেসে বলল, “ভালো লেগেছিল আমার চুমু?”

আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “পা ভেঙে হসপিটালে পড়ে আছো, তাও আমার সাথে ফ্লার্ট করতে হবে?”

নওশীন হেসে ফেলে বলল, “আমি ফ্লার্ট করছি না-কি?”

আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “হ্যাঁ। আর যেটা একদমই ঠিক না। আমাদের প্রফেশনাল সম্পর্কের সাথে এটা মানায় না।”

নওশীন অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, “আমাদের সম্পর্ক প্রফেশনাল হলে তো আপনি আমাকে হসপিটালে দেখতে আসতেন না।”

এই কথাটা ঠিকই বলেছিল নওশীন। ততদিনে একটু একটু করে আরশাদের মনটা দখল করতে শুরু করেছে সে। আরামে-অবসরে মনের অজান্তেই আরশাদ তাকে নিয়ে ভাবে। মেয়েটার দুরন্তপনা, নির্ভীকতা, খিলখিল করে হেসে ওঠা – এ সব কিছুই যেন প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে আরশাদের মাঝে।

কাজের মাঝে প্রেমে জড়িয়ে পড়াকে যে আরশাদ নিতান্তই হাস্যকর বলে মনে করতো, সে নিজেই শেষমেশ প্রেমে পড়ে গেল নওশীনের। আবারও শুটিং শুরু হলো। এবার আরশাদ অজুহাত খুঁজতো, চোরা চোখে নওশীনকে দেখবার। শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে এটা সেটা নিয়ে গল্প মেতে উঠতো তারা। আরশাদের বলা কোনো একটা কথায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়তো নওশীন। যে হাসি ক্রমেই বাড়িয়ে তুলতো তার হৃদস্পন্দন।

শুটিং থেকে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত সময়টুকু যেন তর সইতো না। উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষায় থাকতো আরশাদ, বাড়ি ফিরে কখন নওশীনের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারবে। কতগুলো রাত যে তারা ফোনে গল্প করেই কাটিয়ে দিয়েছে তার হিসাব কারও কাছেই নেই। সেই কথোপকথনগুলো যে খুব প্রেমের আলাপে ভরপুর ছিল, এমনটাও নয়। বন্ধুর সঙ্গে বন্ধু যেসব বিষয় নিয়ে কথা বলে, কখনো নিতান্তই তুচ্ছ, কখনো একেবারে ব্যক্তিগত – এসবই ছিল তাদের কথোপকথনের বিষয়।

একটা সময় এলো, নওশীনকে না দেখে একটা দিন কাটানোও কঠিন হয়ে পড়লো আরশাদের কাছে। যেসব দিনগুলোতে শুটিং থাকতো না, সেই দিনে তারা ঘুরে বেড়াতো। অসম্ভব সুন্দর এই সম্পর্কের কোনো নাম ছিল না তাদের কাছে। কখনো প্রেমের স্বীকৃতিও দেয়নি তারা। আবার একে অপরকে কেবল বন্ধু ভাবতেও নারাজ। নামহীন সম্পর্কের বোঝা মাথায় বয়ে দিনগুলো কাটতে লাগলো তাদের।

একবার তাদের শখ হলো নৌকায় করে ঘুরে বেড়াবে। চলে গেল সুদূর বিরুলিয়ায়। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় সারাটাদিন কাটাবে তারা।

নৌকা যখন ঠিক মাঝনদীতে তখন নওশীন হঠাৎ বলে উঠলো, “আমাকে একটা গিফট দাও!”

এই মেয়েটা যে কিঞ্চিৎ পাগল প্রকৃতির, এই সত্যি স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছিল আরশাদ। প্রথম প্রথম তার পাগলামিগুলো বিরক্তিকর লাগলেও, যতই দিন যায় ততই এগুলো ভালো লাগতে শুরু করে আরশাদের কাছে।

আরশাদ হালকা হেসে বলল, “এই মাঝনদীতে গিফট পাবো কোথায়?”

নওশীন গাল ফুলিয়ে বলল, “সেটা আমি কীভাবে জানবো? আমার ঠিক এখনই গিফট পেতে ইচ্ছা করছে, আর তুমি এখনই আমাকে গিফট দিবে।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো আরশাদ। অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে হালকা গলায় বলল, “I love you. এই কথাটা আমি আগে কাউকে বলিনি। তোমাকেই প্রথম বললাম। আপাতত এটাকেই গিফট হিসেবে ধরে নাও।”

চমকে উঠে আরশাদের দিকে তাকালো নওশীনের। বিস্ময়ে তার চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। মুহূর্তের জন্যে যেন সে ভুলেই গেছে নিঃশ্বাস কী করে নিতে হয়। এমন ভয়ঙ্কর সুন্দর একটা কথা বলার আগে বিন্দুমাত্র পূর্বাভাস দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না ছেলেটা? বিস্ময়ে, আনন্দে রীতিমত হাত-পা কাঁপছে নওশীনের।

আরশাদ মজার ছলে বলল, “এত হাত-পা কাঁপাকাঁপির কী আছে? নিজে তো সুযোগ পেলেই আমার সাথে ফ্লার্ট করে বেড়াও। আর আমি করলেই দোষ?”

দিনভর পাগলামি করে বেড়ানো নওশীন এবার একেবারেই স্থির হয়ে গেল। তার চোখদুটো বেয়ে অঝোরে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। কান্না যে এত সুখময় হতে পারে, কে জানত?

নওশীন চোখের জল মোছার কোনো চেষ্টা না করেই বলল, “I love you too Shad.”

শাদ, ভালোবেসে আরশাদকে এই নামটা দিয়েছিল নওশীন। যে নামে আরশাদকে ডাকার অধিকার একমাত্র তার। অবশেষে তার নামহীন সম্পর্ক একটা নাম পেলো, ভালোবাসা। তবে ভালোবাসার সম্পর্কটাকে সকলের আড়ালেই রেখেছিল তারা। ক্যারিয়ারের কথা ভেবে ভালোবাসাকে লুকিয়ে রাখার মতো মানুষ আরশাদ নয়। সে চেয়েছিল সম্পর্কের আরও সুন্দর একটা নাম দিয়ে তবেই প্রকাশ্যে আনতে।

‘প্রহর’ এর শুটিং বহু আগেই শেষ। সিনেমার শুটিং শেষ হয়ে যাওয়ার পরও হাজার জটিলতা থাকে। এডিটিং, ডাবিং, সেন্সরবোর্ডে জমা দেওয়া, ডিস্ট্রিবিউটরদের সঙ্গে যোগাযোগ করা, সিনেমার প্রচার-প্রচারণা। এসব মিলিয়ে শুটিংয়ের পরেও মুক্তির জন্যে প্রস্তুতি নিতে নিতে এক বছর লেগে গেল সিনেমাটার। এই এক বছরে যেন সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে আরশাদ আর নওশীনের প্রেম। দুজনে যতই ব্যস্ত থাকুক না কেন, দিনে অন্তত একবার দেখা করা চাই। ছুটির দিনগুলোতে ছদ্মবেশে কোনো একটা লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে থাকে তারা। ঘন্টার পর ঘন্টা নওশীনকে বই পড়ে শোনায় আরশাদ।

কাজের মাঝে ডুবে থাকতে থাকতে কেমন যান্ত্রিক হয়ে উঠেছিল আরশাদ। তাকে যান্ত্রিকতার মাঝ থেকে একপ্রকার টেনে তুলেছে নওশীন। কাজের বাইরেও যে মানুষের একটা জীবন হতে পারে, নতুন করে শেখালো তাকে।

ঘনিয়ে এলো ‘প্রহর’ সিনেমার মুক্তির তারিখ। সিনেমা মুক্তির আগের বেশ কয়েক দিন থেকেই প্রচারণায় ব্যস্ত দুজনে। সারাটাদিন তাদের কাটছে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল আর পত্র-পত্রিকায় ইন্টারভিউ দিয়ে। খারাপ লাগছিল না আরশাদের। নওশীন সারাটাদিন তার চোখের সামনে। মন চাইলেই চোখের তৃষ্ণা মেটানো যাচ্ছে। তবুও যেন স্বস্তি পাচ্ছে না আরশাদ। পৃথিবীর কাছে তো তারা কেবলই একে অপরের সহশিল্পী। ইন্টারভিউতেও তার থেকে বেশি কিছু নয় তারা। অথচ আরশাদের যে চিৎকার করে পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দিতে ইচ্ছা করছিল, “নওশীন আমার!” মনের ভেতরে তীব্র এক জ্বালাপোড়ার সৃষ্টি হয়।

সেই জ্বালাপোড়া আরও তীব্রতর হতে শুরু করে তেরোই এপ্রিল। ‘প্রহর’ মুক্তির ঠিক আগের দিন। প্রচার-প্রচারণায় দুজনে এতটাই ব্যস্ত যে সারাদিন নিজেদের মধ্যে কোনো কথা বলারও সময় পায়নি। একান্তে সময় কাটানোর কথা তো দূরেই থাক। নওশীন কয়েকবার সকলের অগোচরে তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি নিক্ষেপ করেছে। তবে সেই হাসি ভেতরকার জ্বালাপোড়া কমাবার জন্যে যথেষ্ট নয়।

দিন পেরিয়ে রাত হয়ে গেল। নওশীন পুরোটা দিন তার চোখের সামনে, তবুও তাকে নিজের মতো করে পেতে পারলো না আরশাদ। সেদিনের শেষ ইন্টারভিউটা শেষ করে যে যার বাড়ি ফিরে গেল। দিনভর ধকল সামলেও বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না আরশাদ। তার মন তখন ফুঁসছে রাগে, আক্ষেপে। এত বড় একটা দিন, এত এত মুহূর্ত, সেখান থেকে কিছুটা হলেও সময়ের জন্যে সে পাবে না নওশীনকে?

রাগ নওশীনের ওপরে হচ্ছে না। বেচারির তো কোনো দোষ নেই। তার সমস্ত রাগ বাস্তবতার ওপরে। কেন তাকে আর নওশীনকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে? তারা একে অপরকে ভালোবেসেছে। অন্যায় কিছু তো আর করেনি।

ঝোঁকের মাথায় আরশাদ আবারও বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। গাড়ি নিয়ে সোজা থামলো নওশীনের বাড়ির সামনে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে নওশীনের নম্বরে ডায়াল করলো।

নওশীন ফোনটা রিসিভ করতেই আরশাদ হড়বড় করে বলে, “এই তুমি আমাকে বিয়ে করবে?”

এমনিতেই বেচারি সারাদিন সিনেমার প্রচার করে ক্লান্ত। তার ওপরে এমন কথা শুনে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে পড়ে নওশীন।

কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “মানে?”

“মানে বলতে পারবো না। বিয়ে করতে চাইলে হ্যাঁ বলো, না করতে চাইলে না বলো। করবে?”

আরশাদের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে ঝোঁকের মাথায় নওশীন বলে দেয়, “হ্যাঁ করবো।”

“তাহলে বাইরে এসো। আমি তোমার বাসার নিচে ওয়েট করছি।”

আরশাদের পাগলামির শেষ নেই। নওশীন ভেবেছিল এটাও হয়তো তেমনই কোনো পাগলামির অংশ। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে উঠে বসে আরশাদের গাড়িতে। আরশাদের মুখে কোনো কথা নেই। ব্যস্ততার সঙ্গে গাড়ি স্টার্ট দেয় সে। গাড়ি গিয়ে থামে কাজী অফিসের সামনে।

মাত্র আধ ঘন্টার ব্যবধানে নওশীন হয়ে গেল আরশাদের স্ত্রী। বিয়ের কাগজে সই করে বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটে। বাস্তবতার সাথে অদৃশ্য এক খেলায় জিতে গেছে সে। বাস্তবতা তার ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গে তাকে কিছুটা সময় কাটাতে দেয়নি। ভালোবাসার মানুষটাকেই চব্বিশ ঘন্টার জন্যে নিজের করে নিলো আরশাদ।

বিয়ের পরের দিনগুলো কাটলো স্বপ্নের মতো। আরশাদের দিনটা শুরু হয় নওশীনকে দেখে, দিনের শেষটাও হয় তার মুখটা দেখে। এমন একটা জীবনের জন্যেই যেন চিরকাল অপেক্ষা করে ছিল সে। পৃথিবীর কাছে এখন আর তার ভালোবাসাকে গোপন রাখার প্রয়োজন নেই। তার সম্পর্কের নতুন এই সুন্দর নামটা আজ সকলেরই জানা।

বিয়ের ঠিক পর পরই নওশীন ঘোষণা করলো, সে আর বেশি একটা সিনেমা করবে না। তার সকল মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু এখন থেকে তার সংসার আর আরশাদ। বিয়ের একবছরের মাথায় নতুন বাড়ি কিনলো আরশাদ। ইন্ডাস্ট্রির তারকাদের মাঝে সবথেকে বড় এবং বিলাসবহুল বাড়ি। নিজের হাতে পুরো সংসারটাকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো নওশীন। দেয়ালে দেয়ালে তার পছন্দের সব আর্টওয়ার্ক আর লিভিং রুম জুড়ে অ্যান্টিক শোপিস।

বিয়ের এক বছর পর থেকেই নওশীনের মধ্যে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম পরিবর্তন লক্ষ্য করতে শুরু করে আরশাদ। এই পরিবর্তনগুলো চোখে দেখা যায় না, কেবল অনুভব করা যায়। আর আগের মতো পাগলামি রেশ নেই তার মাঝে। আরশাদের সঙ্গে দূর-দূরান্তে ঘুরে বেড়াতে তার অনাগ্রহের শেষ নেই। আগের মতো ধৈর্য ধরে আরশাদ পড়ে শোনানো বইয়ে মনোযোগ দিতে পারে না নওশীন।

বিয়ের পর একটা মেয়ের মাঝে কিছুটা হলেও পরিবর্তন না এসে পারে না। নওশীনের মাঝেও এসেছে। আর এই পরিবর্তন খুব একটা বিচলিত করলো না আরশাদকে। দিনভর সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকার পর কারই বা ইচ্ছা করবে বই শুনতে।

নতুন করে আরও এক পরিবর্তনের দেখা তার মাঝে পেলো আরশাদ। নওশীনের সকল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এখন ইন্ডাস্ট্রি। দিনভর কর্মব্যস্ততার পর অবশেষে দুজনে যখন একান্তে কিছুটা সময় পায়, সেই সময়েও নওশীনের মুখে কেবল ইন্ডাস্ট্রির কথা। অমুক পরিচালক কাকে নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছে, অমুক প্রোডাকশন হাউজের সিনেমায় কোন কোন অভিনয়শিল্পী কাজ করছে, এসব প্রশ্নে অতিষ্ট করে তোলে আরশাদকে।

নওশীন বদলে গেলেও বদলে গেলো না তাদের ভালোবাসা। আরশাদ তার পরিবর্তনে বিরক্ত না হয়ে বরং সেই পরিবর্তনের মাঝেই নিজেকে অভ্যস্ত করে নেওয়ার চেষ্টা করে। সে বেশ বুঝতে পারছিল নওশীন নিজ ইচ্ছায় সিনেমা কম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঠিকই, তবে অভিনয়ের ইচ্ছা তার মধ্যে থেকে ফুরিয়ে যায়নি। বিয়ের পর তাই নওশীনের সঙ্গে আরও একটি সিনেমায় অভিনয় করে আরশাদ। বলাই বাহুল্য যে সিনেমাটিও হয় ব্লকবাস্টার।

বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রিতে একজন নায়ক বছরের পর বছর নিজের একই অবস্থান ধরে রাখতে পারে। একই জৌলুসে অভিনয় করে যেতে পারে। বরং সময়ের সাথে সাথে তার খ্যাতি যেন আরও বাড়তেই থাকে। তবে একটা মেয়ের ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। মেয়েদের ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ছয়-সাত বছর তুঙ্গে থাকতে। এরপর ধীরে ধীরে তা তলানির দিকে গিয়ে ঠেকে। নতুন নতুন নায়িকার আগমন ঘটে ইন্ডাস্ট্রিতে। ফলে পুরনো নায়িকার প্রতি আর সেরকম কোনো আকর্ষণ অনুভব করে না দর্শকেরা।

ঠিক এমনটাই হয়েছিল নওশীনের ক্ষেত্রে। বিয়ের পর আরশাদের সঙ্গে ওই সিনেমায় অভিনয়ের পরও আরও দুয়েকটা নারীকেন্দ্রিক সিনেমায় অভিনয় করেছিল সে। সেই সিনেমাগুলো হিট হলেও আগের মতো ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল না। ক্যারিয়ার নিয়ে মনে মনে বেশ চিন্তিত থাকলেও তা খুব একটা প্রকাশ করতো না নওশীন।

বিয়ের দুবছর তখন পেরিয়ে গেছে। আরশাদ রাত দুটো পর্যন্ত শুটিং করে বাড়ি ফিরেছে। বেচারা এতটাই ক্লান্ত ছিল যে ঘরে পা রাখতেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ভোরের আলো ফুটে উঠতে না উঠতেই শুরু হয়ে গেল নওশীনের ডাকাডাকি।

“শাদ! শাদ! ওঠো না!”

আরশাদ ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল, “হুঁ?”

নওশীন উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “ওঠো তো! জরুরি কথা আছে তোমার সঙ্গে।”

আরশাদ চোখদুটো বুজে দেখেই বলল, “বলো।”

নওশীন মজার ছলে বলল, “আগে ওঠো তো। না হলে কিন্তু ইলেকট্রিক শক দিবো!”

আরশাদ ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “দাও।”

নওশীন হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বলল, “I’m pregnant!”

কথাটা যেন সত্যিই ইলেকট্রিকের শকের মতো কাজ করলো আরশাদের কাছে। তড়িৎ গতিতে উঠে বসলো সে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো নওশীনের দিকে।

আরশাদ বিস্মিত গলায় বলল, “সত্যি?”

নওশীন হাসি হাসি গলায় বলল, “মিথ্যা কথা বলার জন্যে এত সুন্দর একটা ঘুম থেকে ডেকে তুলি তোমাকে?”

(চলবে)

#ফিরে_আসা২
৩০+৩১ (খ)
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

আরশাদের জীবনের সবথেকে সুন্দর দিনটি বাইশে মার্চ। প্রথমবারের মতো এই দিনটাতে সে কোলে নেয় তার রাজকন্যাকে। নার্স যখন গোলাপী তোয়ালেতে মুড়িয়ে তাকে এনে আরশাদের কোলে তুলে দেয়, বিশ্বাসই হচ্ছিল না এই ফুটফুটে পদ্মফুলটা না-কি তার! বাবা হওয়ার অনুভূতি যে এত সুন্দর হতে পারে, আগে কখনো কল্পনাই করেনি আরশাদ।

নওশীনের প্রেগন্যান্সির খবর মিডিয়ায় জানানো হয়নি। তার ইচ্ছাতেই খবরটিকে আড়ালে রাখা হয়েছিল। কথা পৃথিবীতে আসার কয়েক দিন পর নওশীন বলল, “বাবুকে কয়েক বছর আড়ালে রাখি। তোমার ক্যারিয়ারের ওপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে।”

নওশীনের সঙ্গে এ নিয়ে আরশাদের তুমুল মতের বিরোধিতা হয়। সন্তানকে সমাজে নিজের পরিচিতি দেওয়ার থেকে ক্যারিয়ার কখনোই মুখ্য হতে পারে না। তাছাড়া আরশাদ হকের খ্যাতি এতটাই ঠুনকো নয় যে, তার সন্তান আসার খবরে তা হারিয়ে যাবে।

শেষমেশ আরশাদের জেদের সঙ্গে পেরে ওঠে না নওশীন। পুরো পৃথিবী জানতে পারে আরশাদ বাবা হয়েছে আর সে মা হয়েছে। এই সুসংবাদ পৃথিবীর সামনে আসায় আরশাদের ক্যারিয়ারের ওপর কোনপ্রকার খারাপ প্রভাব তো পড়েই না, বরং ভক্তকুলের অভিনন্দনে ভাসতে থাকে সে।

কথার দেখাশোনায় নওশীনকে সর্বোচ্চ সাহায্য করার চেষ্টা করে আরশাদ। কথার এক বদভ্যাস ছিল সারা রাত জেগে থেকে ভোর রাতে ঘুমানো। যতক্ষণ কথা জেগে থাকবে, ততক্ষণ নওশীনকেও জেগে থাকতে হয়। তবে তাকে একা জেগে থাকতে দেয়নি কখনো আরশাদ। সেও জেগে থাকে নওশীনের সঙ্গে।

পরিবারে নতুন সদস্যের আগমনের পর আমরা তাকে নিয়ে এতটাই ভুলে যাই যে মায়ের দিকে তেমনভাবে নজর দিতে পারি না। আরশাদও কথার উপস্থিতিতে একটু বেশিই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তাই তার চোখ এড়িয়ে যায় নওশীনের মধ্যকার পরিবর্তন।

সন্তান জন্মদানের পরপর প্রায় বেশির ভাগ মায়েরই শিকার হয় পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের। জীবনের এই আকস্মিক পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগে তাদের। কারো কারো ক্ষেত্রে সেই সময়টা খুবই কম, কারও কারও ক্ষেত্রে বেশি।

নওশীনের ভেতরটা পুরোপুরি বদলে গেল। মিষ্টভাষী নওশীন আজকাল বাড়ির সকল স্টাফদের সঙ্গে চড়া গলায় কথা বলে, তারা সামান্যতম ভুল করলেও চেঁচামেচি করে পুরো বাড়ি মাথায় তোলে। তার থেকেও বড় কথা, ছোট ছোট যে কোনো কারণেই হোক আরশাদের সঙ্গে ঝগড়ায় জড়াতে হবে তাকে। ঝগড়ার জন্যে কারণ খুঁজে বের করাই হয়ে উঠলো নওশীনের সারাদিনকার প্রধান কাজ।

নওশীনের একটাই অভিযোগ – আরশাদ সময় দেয় না তাকে। দেশের সবথেকে বড় সুপারস্টার আরশাদ। সারা মাসেই তাকে কোনো না কোনো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। কখনো শুটিং, কখনো ডাবিং, কখনো বিজ্ঞাপনের শুটিং, সেটার ডাবিং, নতুন সিনেমার সাইনিং, সাইনিংয়ের আগে পরিচালকের সঙ্গে মিটিং, শুটিংয়ের আগের রিহার্সেল। কাজের শেষ নেই আরশাদের। নওশীন যেহেতু একই পেশার মানুষ, আরশাদের পরিস্থিতিটা তার থেকে ভালো করে কারও বোঝার কথা নয়। কিন্তু নওশীন বোঝেনি। দিন দিন তার অভিযোগের পাল্লা ভারী হতেই থাকে।

ঝগড়া-ঝাটি যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাই করে আরশাদ। সে বেশ বুঝতে পারছিল নওশীন এখন ভালো নেই, স্বাভাবিক নেই। তাই আরশাদও তাকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্যে কিছুটা সময় দিচ্ছিল। সময়ের আবর্তনে স্বাভাবিকতার লেশমাত্র এলো না। বরং বেড়ে গেল অস্বাভাবিকতা।

আরশাদকে বিস্ময়ের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে দিয়ে নওশীন ড্রাগ নিতে শুরু করে। শুধু ড্রাগ নিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি সে। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সাংবাদিকদের ফোন করে বলেছে, “আপনারা নিউজ করুন যে আমি ড্রাগস নিচ্ছি!”

সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি শক্ত হাতে সামাল দিয়েছে আরশাদ। পত্র-পত্রিকায় যাতে এই ব্যাপারটা নিয়ে লেখালিখি না হয়, সেজন্যে মোটা অংকের টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে সাংবাদিকদের। নওশীন যাতে তার ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, সেজন্যে দীর্ঘদিন বন্ধ রাখে সব শুটিং।

নওশীন আর কথাকে নিয়ে আরশাদ ঘুরতে যায়, যে সময় নওশীন তার কাছ থেকে চেয়েছিল সেই সময় তাকে দেয়। ধীরে ধীরে সবটা আগের মতো হয়ে গেলেও, কেমন যেন একটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। নওশীন আর সেই আগের নওশীন নেই। সম্পর্কের শুরুর দিনগুলোতে আরশাদের কাজই ছিল তার গর্ব। কিন্তু আজকাল সেই কাজটাই যেন আর সহ্য করতে পারে না সে।

নতুন কোনো সিনেমার প্রস্তাব পেলে আরশাদের অভ্যাস সেই সিনেমার গল্প নিয়ে নওশীনের সঙ্গে আলোচনা করা। গল্পের প্রতি নিজের প্রকৃত মতটাই এতদিন দিয়ে এসেছে নওশীন। কিন্তু আজকাল তার কাছে সব গল্পই খারাপ। এই গল্পে আরশাদের একেবারেই অভিনয় করা উচিত নয়।

নওশীন মূলত চাইতো আরশাদ কাজ কমিয়ে দিয়ে তার কাছে বেশি সময়জুড়ে থাকে। আরশাদের কাজকে ঈর্ষা করতে শুরু করে সে। তবে এমনটা নয় যে ছুটির দিনগুলোতে আরশাদের সঙ্গে খুব আনন্দে থাকতো। ছুটির দিনে, আরশাদ যখন পুরোটা দিন বাড়িতে, তখনো কোনো না কোনো একটা অজুহাতে তার সঙ্গে ঝগড়া করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নওশীন।

আরশাদের জায়গায় অন্য কোনো ছেলে থাকলে এতদিনে বিতৃষ্ণা জন্মে যেন নওশীনের প্রতি। তবে আরশাদ তো আর অন্য ছেলেদের মতো না। সে নওশীনকে ভালোবেসেছে। তার ভালোবাসা ক্ষণঃস্থায়ী নয়। আমৃত্যু নওশীনকে নিজের করে পাবে বলেই তো ভালোবেসেছিল তাকে।

সম্পর্কের শুরুর দিকে কাটানো ওই মোহনীয় দিনগুলো ভালোবাসা নয়। দূর-দূরান্তে ঘুরতে যাওয়া, সারারাত জেগে ফোনে কথা বলা, আগ্রহ নিয়ে একে অপরের কথা শোনা – এসবই মানুষের মনের মাঝে একপ্রকার মোহের সৃষ্টি করে ঠিকই। তবে এটি ভালোবাসা নয়। একটা মানুষ যখন চিরকালের জন্যে নিজের হয়ে যায়, তার দোষ-গুণ সবটাই যখন নিজের হয়ে ওঠে – তখনই সেটা ভালোবাসা।

নওশীনকে ভুল না বুঝে তার সঙ্গে মানিয়ে চলার চেষ্টা করতে শুরু করে আরশাদ। তার অভিযোগ মোতাবেক কাজও একটু একটু করে কমিয়ে আনতে শুরু করে। তবুও সম্পর্কটা আগের মতো হয়ে উঠতে পারে না।

নওশীনকে ঢাকায় রেখে বহুবার ঢাকার বাইরে কিংবা দেশের বাইরে শুটিংয়ে গিয়েছে আরশাদ। কখনোই তাকে অবিশ্বাস করার কথা তার মনে আসেনি। যে মানুষটাকে সে সবথেকে বেশি ভালোবাসে, খুব স্বাভাবিকভাবেই তার ওপর বিশ্বাসটাও বেশি। সেই মানুষকে অবিশ্বাস করে কী করে?

তেমনই একবার শুটিংয়ের জন্যে আরশাদ যায় ভারতে। সেখানের বিভিন্ন রাজ্যে শুটিং চলে প্রায় পঁচিশ দিন ধরে। দীর্ঘদিন পর ঢাকায় ফিরে এলো আরশাদ। খুব আশ্চর্যজনকভাবে খেয়াল করলো, নওশীন আর অস্বাভাবিক নেই। সেই আগের মতো হাসছে, গল্প করছে, বাড়ি ফিরতে দেরি হলে ঝগড়া করছে না।

আরশাদ ভাবলো, এই দূরত্বের বোধ হয় প্রয়োজন ছিল। দূরত্বটাই তাদেরকে আরও কাছাকাছি এনেছে। নওশীনের মাঝে এনেছে এই ইতিবাচক পরিবর্তন।

স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক সময় বেশ ভালোই কাটছিল। কথা এরই মাঝে পা রাখে দুইয়ে। কথার দ্বিতীয় জন্মদিনে আরশাদ জানতে পারে দ্বিতীয়বারের মতো বাবা হতে যাচ্ছে সে। জীবনটা যেন ঠিক আগের মতো হয়ে উঠলো। স্বপ্নের মতো সুন্দর।

একটা ফোনকল, কতগুলো ছবি – সেই স্বপ্নটা যেন দুঃস্বপ্নের মতো বদলে দিলো। নওশীনের মামাতো ভাই কবিরের সঙ্গে ফোনে সেই কয়েক মিনিটের কথোপকথন দুঃস্বপ্নের মতো ধরা দিলো আরশাদের কাছে। লোকটা বেশ স্বাভাবিকভাবেই বলল, “আপনার স্ত্রীর গর্ভে যে সন্তান বেড়ে উঠছে, সে আমার। তাকে প্লিজ নিজের বলে পরিচয় দেবেন না।”

নিজের ভালোবাসার ওপরে এতটাই জোর ছিল যে, লোকটার কথাগুলো রীতিমত অবিশ্বাস করে আরশাদ। কিন্তু নওশীনকে অবিশ্বাস করে না। তার বিশ্বাস ভাঙ্গে কবিরের পাঠানো ওই ছবিগুলো দেখে।

নিজের ভালোবাসার মানুষকে আরেক পুরুষের গায়ে ঢলে পড়ার দৃশ্য সহ্য করতে পারেনি আরশাদ। মনে হচ্ছিল এর থেকে মৃত্যু বহুগুণ কম যন্ত্রণাদায়ক। এমন তো নয়, জীবনে এক মুহূর্তের জন্যেও সে অবহেলা করেছে নওশীনকে। তার সকল চিন্তাভাবনার কেন্দ্রেই তো নওশীন। নিয়মিত শোবিজ অঙ্গনে পদচারণা আরশাদের, চারদিকে গিজগিজ করছে সুন্দরী নারী। কারো দিকে চোখ তুলে পর্যন্ত তাকায়নি আরশাদ। কারণ সে জানে, পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর মেয়েটা তার। আর সেই মেয়েটাই কিনা তার সঙ্গে এমনটা করলো? তার বিশ্বাস ভেঙে চুরমার করে ফেললো নির্দ্বিধায়?

যারা ভালোবাসে, তাদের থেকে বড় বোকা না-কি কেউ হয় না। আরশাদের ক্ষেত্রেও এ সত্য প্রযোজ্য। ভালোবাসা তাকে এতটাই আঁকড়ে ধরেছিল যে তার সঙ্গে হয়ে যাওয়া এই অন্যায়টাও প্রভাবিত করতে পারেনি তাকে। ক্ষমা করতে চেয়েছিল নওশীনকে সে। ডিভোর্সের কথাটা নওশীনই প্রথম তোলে। আরশাদের অবহেলা না-কি তার আর সহ্য হচ্ছে না।

কাজকে একটু বেশি সময় দেওয়াই যদি অবহেলা হয়, তাহলে সত্যিকারের অবহেলা পেলে কী করতো নওশীন? ভালোবাসা কোনো পরিমাপের স্কেল নয়। এটি কমতে বাড়তে পারে না। ভালোবাসা হয় থাকে, না হয় চিরতরে চলে যায়। যে মুহূর্তে নওশীন ডিভোর্সের কথা বলল, ঠিক সেই মুহূর্তেই আরশাদের ভালোবাসা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।

এতকাল মনের মাঝে যত্নে গড়ে তোলা ভালোবাসা, চোখের পলকেই ভেঙে একাকার। বাস্তবতাকে বিশ্বাস করতে পারছিল না আরশাদ। মনে হচ্ছিল কোনো এক ঘোরের মধ্যে আছে সে। সময়ের সাথে সাথে ঘোর কেটে যাবে। কিন্তু না, যা সে অনুভব করছিল তা ঘোর ছিল না। তার ভালোবাসা প্রথমত তার বিশ্বাস ভেঙেছে, দ্বিতীয়ত নির্দ্বিধায় তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলছে। ডিভোর্স নিয়ে কোনো প্রকার বাঁধা দেয়নি আরশাদ। ভালোবাসাই যেখানে নেই, সেখানে একই সঙ্গে থাকার তো কোনো মানে হয় না।

নওশীনের সঙ্গে এতটা বছর আরশাদ সুখী ছিল। সুখী মানুষের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। মুহূর্তেই তাদের হৃদয় হাহাকারে ভরে ওঠে না। নিঃশ্বাসগুলো অপূর্ণ বলে মনে হয় না। প্রতি সকালে ঘুম ভাঙলে আনমনেই ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি ফুটে ওঠে। এই সুখী মানুষটা নিমেষেই বদলে গেল। একটা জায়গায় আটকে রইলো আরশাদের মস্তিষ্ক। কিছুই ভাবতে পারছিল না সে। অথচ ভাবনা-চিন্তা করার মতো বিষয়ের অভাব তার নেই। নওশীন কেন এমনটা করলো? কেন তার ভালোবাসাকে অবজ্ঞা করলো? কী করে পারলো তার বিশ্বাস ভেঙে অন্য কারও সঙ্গে রাত্রিযাপন করতে? কী করে পারলো অন্য কারও সন্তানের মা হতে?

কোনো চিন্তাই করতে পারছিল না সে। তার মস্তিষ্কে কেবল ওই দিনের দৃশ্যটা ঘুরপাক খায়।

নওশীন একপ্রকার জোর দিয়েই সেদিন বলেছে, “জানি আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। বাধ্য হয়ে ভুল করেছি। তুমি আমাকে বাধ্য করেছো।”

এ পৃথিবীতে রোজ হাজারো সম্পর্ক ভাঙে গড়ে। মানুষ তার ভালোবাসার মানুষের বিশ্বাস ভেঙে চুরমার করে দেয় অবলীলায়। কিন্তু বিশ্বাস ভাঙার পেছনে তো একটা কারণ থাকে! আরশাদ নওশীনকে সময় দিতে পারে না, এতটুকুই দীর্ঘদিনের এই সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার কারণ? আর এদিকে যে আরশাদ নিজের সবটা দিয়ে তাকে ভালোবাসলো? নওশীনকে নিয়ে এলো নিজের পৃথিবীর কেন্দ্রে? এসবের কোনোই মূল্য নেই? ভালোবাসার মানে তাহলে কেবলই সময় আদান-প্রদান?

কষ্ট হচ্ছিল আরশাদের তখন। এতটা কষ্ট এ জীবনে তার কোনোদিন হয়েছে কিনা কে জানে? নওশীনের জন্যে কষ্ট হচ্ছিল না, কষ্ট হচ্ছিল নিজের জন্যে। ফেলে আসা দিনগুলোর জন্যে, মূল্যবান ওই সকল অনুভূতির জন্যে। যে মানুষটা তার বিশ্বাস ভঙ্গ করলো, তার জন্যেই একদিন আরশাদ অনুভব করেছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম অনুভূতিগুলো। ভাবতেই ঘৃণা ধরে যায় নিজের প্রতি।

যেদিন কোর্টে তারা ডিভোর্স পেপার সাইন করতে গেল, সেদিন নওশীন তার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে বলেছিল, “তুমি আমাকে মিস করবে না?”

সে প্রশ্নের জবাব দেয়নি আরশাদ। জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। মিস সে করবে ঠিকই, তবে সেই নওশীনকে যাকে সে ভালোবেসেছিল। যার সঙ্গে অগণিত সুন্দর মুহূর্ত কাটিয়েছিল। কিন্তু তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, তার সঙ্গে সেই আগের নওশীনের কোনোই মিল নেই। এই নওশীনের অন্তরাত্মা বিশ্বাসঘাতকতায় পরিপূর্ণ।

ডিভোর্সের পর দিনগুলো ছিল অসম্ভব যন্ত্রণাদায়ক। একদিকে নওশীনের বিশ্বাসঘাতকতার স্বাদ এখনো ভুলে উঠতে পারেনি আরশাদ। আরেকদিকে পত্র-পত্রিকায় তার দিকে আঙুল তুলেই হচ্ছে লেখালিখি। আরশাদ না-কি কোনো এক মডেলের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে যায়, সেকারণেই তাদের এই ডিভোর্স।

বড্ড অসহায় লাগতে শুরু করে আরশাদের। নিজেকে অতি তুচ্ছ বলে মনে হয়। এই পৃথিবীতে যে কেউ তার অনুভূতি নিয়ে খেলতে পারে। তার দিকে আঙুল তুলতে পারে। নিজের অস্তিত্বকে নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে শুরু করে আরশাদ। যে মানুষটা দিনরাত কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, আজকাল সে সমস্ত কাজকর্ম বাদ দিয়ে সিগারেট আর ড্রিংকসের বোতলে ডুবে আছে।

নাহ্! দোষ কারোরই নয়। নওশীনের কোনো দোষ নেই। তার যার সঙ্গে খুশি তার সঙ্গেই রাত্রিযাপন করতে পারে। পত্র-পত্রিকায় ওই সাংবাদিকদেরও কোনো দোষ নেই। তাদের পত্রিকা, তাদের কলম – যা ইচ্ছা তাই লেখার অধিকার তাদের আছে। সব দোষ নিজেকে দিতে লাগলো আরশাদ। নিজের দোষেই এতটা যন্ত্রণা পেতে হচ্ছে তাকে। কী দরকার ছিল নওশীনকে এতটা ভালোবাসার? কী দরকার ছিল সম্পর্কটাকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে প্রাধান্য দেওয়ার?

দিনশেষে আরশাদ বুঝতে পারলো, এই ভালোবাসা শব্দটাই মিথ্যা। ভালোবাসা বলতে পৃথিবীতে আসলে কিছু নেই। যাকে আমরা ভালোবাসা বলে ভুল করি, তা কেবলই মোহ। কারও মোহ আগে কাটে, কারও দেরিতে। ভালোবাসা নামক এই বিশৃঙ্খলায় কখনো নিজেকে জড়াবে না বলে ঠিক করলো আরশাদ। জড়াবে কী করে? এই শব্দটার ওপর থেকে তার সকল প্রকার বিশ্বাস উঠে গেল।

এতটা সময় অতীতে ডুবে থেকে মনটা কেমন স্যাঁতস্যাতে হয়ে উঠেছে। মাইগ্রেনের ব্যাথাটাও হয়তো উঠেছে। যে অস্বাভাবিক মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে সে গেছে, তা ভাবতেই হৃদয়টা বারবার মোচড় দিয়ে উঠছে।

আচমকা চোখ মেলে তাকালো আরশাদ। ঘরজুড়ে অন্ধকার, তবুও তার চোখ জ্বালাপোড়া করছে। যতটা ধীর গতিতে এই স্মৃতিগুলো মনের মাঝ দিয়ে বয়ে গেল, ততটাই ঝড়ো গতিতে বয়ে গেল অন্য আরেক স্মৃতি। অরার স্মৃতি। পরিস্থিতির চাপে নিজের ম্যানেজারকে বিয়ে করা, একটু একটু করে অরাকে জানতে শেখা, নিজের সব সিক্রেটগুলো নির্দ্বিধায় তাকে বলে দেওয়া, লাল শাড়িতে অরাকে দেখে ধাক্কা খাওয়া, একটু একটু করে মেয়েটার প্রেমে পড়ে যাওয়া, রাঙামাটিতে ওই পাহাড়ঘেরা রিসোর্টে তাকে ভালোবাসার কথা জানিয়ে দেওয়া, অরার হারিয়ে যাওয়া, অরার ফিরে আসা, তাকে একদমই নিজের করে পাওয়া। এ সবগুলো দৃশ্য একসঙ্গে ঝড়ের গতিতে আঁচড়ে পড়লো আরশাদের মনে।

এতটা সময় অতীতে আটকে ছিল সে। তার মনে হচ্ছিল, আবারও সেই সময়টায় ফিরে গেছে যে সময়টায় ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস উঠে গেছিল তার। ভালোবাসাকে নিতান্তই ছেলেখেলা ছাড়া আর কিছুই মনে হতো না তার। কিন্তু না, সে তো আর সেই সময়টায় নেই। আরশাদ আবারও নতুন করে ভালোবাসায় বিশ্বাস করতে শিখেছে, নতুন করে ভালোবাসতে শিখেছে। সবটাই অরার জন্যে।

অনেকেরই বিশ্বাস, সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে সকলের জন্যেই কাউকে না কাউকে পাঠিয়ে থাকে। মানুষ জীবনে তার ভালোবাসাকে খুঁজে পাওয়ার পরও যদি সে চলে যায়, তাহলে বুঝতে হবে সেই মানুষটা সৃষ্টিকর্তার পাঠানো নির্দিষ্ট মানুষটা নয়। সৃষ্টিকর্তা নওশীনকে আরশাদের জন্যে পাঠাননি। সেজন্যেই সম্পর্কটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। এতগুলো দিনের সম্পর্কের অবসান হলো অত্যন্ত তিক্ততার সঙ্গে। ক্ষণিকের জন্যে মনে হয়েছিল
জীবনের শেষ এখানেই। ভালোবাসা বলতে আদতে কিছুই নেই।

কিন্তু না, ভালোবাসা আছে। যে ভালোবাসা আরশাদকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নতুন জীবন দান করেছে। নওশীনের কাছ থেকে ওই আঘাতগুলো পাওয়ার পর যে আরশাদ যন্ত্রের মতো অনুভূতিহীন হয়ে উঠেছিল, তাকে নতুন করে হাসতে শেখালো এই ভালোবাসা। সৃষ্টিকর্তা আরশাদের জন্যে যে মানুষটিকে পাঠিয়েছে, সে অরা। অরা আছে বলেই আজকাল প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে শূন্যতা অনুভব করে না আরশাদ।

উঠে বসলো আরশাদ। অন্ধকারের মাঝেই হাতড়ে বেডসাইড টেবিলে রাখা সিগারেটের কেস থেকে একটা সিগারেট বের করলো। লাইটার ধরাতে গিয়ে তার হাতদুটো যেন একটু কেঁপে উঠলো। সমস্ত শরীরে তার কাঁটা দিয়ে উঠছে। এতক্ষণে সে বুঝতে পারলো কী ভয়াবহ কান্ড সে ঘটিয়েছে!

অরা এই মুহূর্ত তার পাশে নেই কেন? দুদিন ধরে অন্য ঘরে ঘুমাচ্ছে কেন? সবটাই তো তার জন্যে। সিগারেটে লম্বা একটা টান দিলো আরশাদ। নিজেকে শান্ত করতে চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না। এত বড় একটা ভুল কী করে করতে পারলো সে?

অরা কালিয়াকৈরে চলে যাওয়ার পর দিনরাত অতীতের এই ঘটনাগুলো ঘুরপাক খেতে থাকে আরশাদের মস্তিষ্ক জুড়ে। দূরত্বের কারণেই তো নওশীন তার বিশ্বাস ভাঙার সুযোগ পায়। অরার চলে যাওয়ার পর দূরত্বটা তাই অসহনীয় হয়ে ওঠে।

আরশাদ জানে, অরা নওশীনের মতো নয়। তাকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তবুও আরশাদের ভয় হচ্ছিল, অরাকে হারানোর ভয় নয়। নিজের মন ভাঙার ভয়। সেবার নওশীন তার মনটাকে কয়েক কোটি টুকরোয় ভেঙে চুরমার করে ফেলেছিল। ধৈর্য ধরে সেই ভাঙা টুকরোগুলো জোড়া লাগায় অরা। কিন্তু আবারও যদি মনটা ভেঙে যায়? এবার তো আর সেই একই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারবে না আরশাদ।

ঝোঁকের মাথায়, নিজেকে যন্ত্রণা থেকে বাঁচানোর তাগিদে হোটেলের ম্যানেজারকে দিয়ে অরার ঘরে ফিট করায় ওই স্পাই ক্যামেরা। যাতে ঢাকায় বসে নিজের ফোনের মাধ্যমে সর্বক্ষণ নজর রাখা যায় তার ওপরে। আরশাদ জানত, সে যা করছে তা ঠিক নয়। অরা জানতে পারলে অসম্ভব রাগ করবে। তবুও যতটা সময় মোবাইলে অরাকে দেখতে পাচ্ছিল, ততটা সময়েই স্বস্তিতে ছিল সে।

আরশাদের মনে পড়ে গেল সেদিন অরাকে বলা প্রতিটি কথা, প্রতিটি শব্দ।

“ওই রাতে তোমার ঘরে কারোর আসার প্ল্যান ছিল। আমার স্পাই ক্যামেরা খুঁজে পাওয়ায় তুমি সতর্ক হয়ে যাও আর তোমার প্ল্যানটাও ভেস্তে যায়। সেজন্যেই এত রিয়্যাক্ট করছো, তাই না?”

দুহাতে নিজের মাথা চেপে ধরলো আরশাদ। সে এটা কী করে ফেলেছে? নিজেকে যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে যন্ত্রণা দিয়ে ফেলেছে তার সবথেকে কাছের মানুষটাকে? কী করে পারলো সে এমনটা করতে?

নিজের ওপরে সেদিন একফোঁটাও নিয়ন্ত্রণ ছিল না আরশাদের। সে যা বলেছে, কিছুই জেনেবুঝে বলেনি। মস্তিষ্ক তাকে বারবার টেনে নিয়ে যাচ্ছিল অতীতে। বারবার মনে হচ্ছিল অরা আর নওশীনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। একটা সময় সে ভাবতো, পৃথিবীর সব মেয়েরাই হয়তো নওশীনের মতো চরিত্রহীন। যাদের কাছে ভালোবাসার বিন্দুমাত্র মূল্য নেই। অরা যখন তার ঘরে ক্যামেরা লুকিয়ে রাখার প্রতিবাদ করছিল, বারবার তখন নওশীনের মুখটা ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। নওশীন যেমন দোষী হওয়ার পরও নিঃসংকোচে আত্মপক্ষ সমর্থনে ব্যস্ত ছিল, মনে হচ্ছিল অরাও ঠিক একই কাজ করছে।

সেদিন বারান্দায় নওশীনকে কড়া ভাষায় অনেক কঠিন কঠিন কথা শোনাতে চেয়েছিল, পারেনি। ভালোবাসা হারানোর শোকে সে পাথর হয়ে গিয়েছিল। অরার প্রতিবাদ যখন তাকে নওশীনের কথা মনে করিয়ে দেয়, আরশাদ তখন মনের অজান্তে সেই ইচ্ছাটা পূরণ করে। যে ভঙ্গিতে সে নওশীনকে কঠিন কথা শোনাতে চেয়েছিল, একই ভঙ্গিতে সেই কথাগুলো শোনায় অরাকে।

আরশাদ স্বাভাবিক নেই। অতীত-বর্তমান সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে তার কাছে। অরার সঙ্গে ওরকম জঘন্য আচরণ করার আগে একবারের জন্যেই নিজেকে প্রশ্ন করেনি সে। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই তো ইচ্ছা করে করেনি আরশাদ। অরাকে কষ্ট দেওয়ার কথা সে কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেনি।

নওশীনের সঙ্গে ডিভোর্সের পর অস্বাভাবিক মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যায় আরশাদ। যে ট্রমা তাকে বহুদিন আঁকড়ে ধরে ছিল, সেই ট্রমা আবারও ফিরে এসেছে। আরশাদ সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছে।

(চলবে)