ফিরে আসা২ পর্ব-৩২+৩৩+৩৪

0
390

#ফিরে_আসা২
৩২+৩৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

গেস্টরুমের ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চোখে কাজল পড়ছে অরা। গত কয়েক রাতে ঠিকমত ঘুম না হওয়ার কারণে চোখদুটো অস্বাভাবিকভাবে রুগ্ন লাগছে। কাল রাতেও যথেষ্ট ঘুম হলো না। আজ মিটিংয়ে বেশ কয়েকটা প্রজেক্ট প্রেজেন্ট করা হবে। সবগুলো প্রজেক্টই কে ফিল্মসের ভবিষ্যতকে ঘিরে। রাত একটা পর্যন্ত ল্যাপটপে সেই প্রজেক্টগুলো দেখছে অরা। কোনো ভুল-ত্রুটি চোখে পড়লে সাথে সাথে জানিয়ে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট টিমকে। আজ মিটিং শুরু হবে দুপুর দুইটায়। তার আগে আগে নিশ্চয়ই ভুল-ভ্রান্তিগুলো শুধরে ফেলবে তারা।

প্রজেক্ট রিভিউ শেষে ক্লান্ত হয়ে কথার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে অরা। তবুও ঘুম নেমে আসে না দুটো চোখে। শারীরিক ক্লান্তিতে মানুষ ঘুমাতে পারে, কিন্তু মানসিক ক্লান্তিতে পারে না।

মনের কালো মেঘগুলো একটু একটু করে কাটতে শুরু করেছে। চিন্তা-ভাবনাগুলো আরও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। সারা রাত জেগে অরা ভাবলো, তার সঙ্গে যা ঘটেছে তাতে তার দোষটা কোথায়? সে তো তার কাজ করতেই গিয়েছিল ঢাকার বাইরে। সন্দেহ করলো আরশাদ, তার ঘরে স্পাই ক্যামেরা লুকিয়ে রাখলো আরশাদ, তাকে ওই বিশ্রী কথাগুলো বলল আরশাদ।

অরার জায়গায় অরা তো ঠিকই আছে। আরশাদ ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের কথা সে কল্পনাতেও আনতে পারে না এবং এটাই সত্যি। তার সত্যি একমাত্র সে ছাড়া কারও জানা কথা নয়। কাউকে জানতেও হবে না। অরা নিজে জানে এটাই অনেক। আরশাদ তাকে সন্দেহ করছে, এতে তার তো কোনো দোষ নেই। এমনকি সন্দেহ করার মতো কোনো কাজও সে করেনি।

অরা দৃঢ়ভাবে ঠিক করেছে, সে আর কষ্ট পাবে না। আরশাদের বলা ওই কথাগুলোর জন্যে নিজেকে দোষারোপ করবে না, নিজেকে ঘৃণা করবে না। আরশাদ তাকে অবহেলা করছে বলে কষ্টে ভেঙেও পড়বে না। আজকের দুনিয়ায় একটা মেয়ের আত্মসম্মান না থাকলে, কঠিন বাস্তবতার সামনে টিকে থাকতে পারে সে। অরা নিজেকে সম্মান করবে। নিজেকে কষ্ট দেওয়ার মানে হলো আরশাদের ওই বাজে কথাগুলোকে স্বীকার করে নেওয়া। কিন্তু না, অরা স্বীকার করবে কেন? সে তো কোনো দোষই করেনি।

অফিসের জন্যে তৈরি হয়ে গেস্টরুম থেকে বেরিয়ে এলো অরা। কথা ডাইনিং টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করছে।

অরা মেয়ের কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে কোমল স্বরে বলল, “তাড়াতাড়ি শেষ কর সোনা! স্কুলে দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।”

কথা দুধের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “তুমি ব্রেকফাস্ট করবে না অরা?”

গর্বের হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁটে। মেয়েটা ছোট হলে কী হবে, বড়দের নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই।

অরা কথার গাল টিপে দিয়ে বলল, “আমি অফিসে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করবো। কথা শোন, আজ কিন্তু আমি তোকে স্কুল থেকে পিক করতে যাবো না। পায়েল আন্টি যাবে। লক্ষ্মী মেয়ের মতো তার সাথে চলে আসবি।”

কথা হতাশ গলায় বলল, “তুমি যাবে না কেন?”

“আমার যে আজ অফিসে একটু জরুরি কাজ আছে সোনা। কাল থেকে আবারও পিক করতে যাবো, প্রমিজ!”

কথা হুমকির ভঙ্গিতে বলল, “মনে থাকে যেন!”

অরা মিষ্টি একটা হাসি তার দিকে নিক্ষেপ করে বসার ঘরের দিকে তাকিয়ে ডাকলো, “পায়েল?”

কথার গভর্নেন্স পায়েল বসার ঘর থেকে ছুটে এসে বলল, “জি ম্যাম?”

“কথাকে সাবধানে নিয়ে আসবে। ড্রাইভারকে বলা আছে, ঠিক সময়মতো বাড়িতে চলে আসবে।”

পায়েল তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “আপনি কোনো চিন্তা করবেন না ম্যাম।”

পায়েল চলে যেতেই আনমনে অরা তাকালো দোতলায় আরশাদের ঘরের দিকে। যে ঘরটা কিছুদিন আগেও তাদের দুজনের ছিল, আজ সেটা আরশাদের একার। ঘরের দরজা বন্ধ, হয়তো এখনো ঘুম থেকে জেগে ওঠেনি সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরশাদের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল অরা। ভাববে না সে আরশাদকে নিয়ে। রাগ আরশাদ হক একাই করতে পারে না। এবার সে দেখবে অরার রাগ কতটা প্রখর হতে পারে।

কথাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল অরা। আরশাদ এখনো ঘুমাচ্ছে না, এখনো জেগে রয়েছে। সারা রাত সে ঘুমায়নি। গত রাত থেকে যে কতগুলো সিগারেট খেয়েছে তার কোনোই হিসাব নেই। আরশাদের হাতে এখনো জ্বলন্ত সিগারেট। সে বসে আছে ঘরের পূর্ব দিকে থাকা বিশাল সাদা সোফাটার ওপরে। ঘরের বাতিগুলো সব নেভানো। ভারী পর্দাগুলোও টেনে রাখা। পর্দার ফাঁক-ফোকর দিয়ে আলো উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে ঘরে। আলোর স্বল্পতাই তো স্বাভাবিক, ঘরটা যে ভরে গেছে অরার সঙ্গে তার করা দুর্ব্যবহারের ছায়ায়।

আবারও সিগারেটে লম্বা একটা টান দিলো আরশাদ। ধোঁয়া ছাড়তেই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। ধোঁয়াগুলো যেন আরশাদের চিন্তা-ভাবনার প্রতিচ্ছবি। অস্পষ্ট, ঘোলাটে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে বুকের ওপরে কেউ ভারী পাথর চেপে ধরে রেখেছে। পাথর নয় অবশ্য। তার সন্দেহ, অরার প্রতি করা অন্যায়ের ভার এটি। আরশাদ এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না, এত বড় একটা ভুল সে করে ফেলেছে। সে তো সন্দেহ করতে চায়নি অরাকে। অতীতে বিশ্বাসঘাতকতা থেকে পাওয়া ট্রমা তার তার এই অহেতুক সন্দেহের আগুনে যেন ঘি ঢালার কাজ করেছে।

অরার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে আরশাদের। সেদিন তার বলা প্রতিটা শব্দই যেন একটু একটু করে ভেঙে ফেলে মেয়েটাকে। অরার চোখদুটোতে পরিষ্কার ফুটে উঠছিল তার ভেতরকার ব্যথা। জীবনে কোনদিন এতটা বিধ্বস্ত হতে দেখেনি সে মেয়েটাকে। অরাকে কিনা তার কারণেই শেষমেশ বিধ্বস্ত হতে হলো?

আরশাদ আঘাত করতে চায়নি অরাকে, কখনোই না। অতীতের মতো আবারও যন্ত্রণা পাবার আশঙ্কায় ডুবে গিয়েছিল সে। নিজেকে যন্ত্রণা থেকে বাঁচানোর ব্যাকুল চেষ্টায় কষ্ট দিয়ে ফেলল তার সবথেকে কাছের মানুষটাকে।

ঘরটার দিকে ক্লান্ত দৃষ্টিতে চোখ বুলালো আরশাদ। এই ঘরটাতেই তো অরার সঙ্গে তার কত সুখস্মৃতি। অরার জ্বর হলে তাকে বুকের মাঝে আগলে রাখা, দুজনে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে টিভিতে সিনেমা দেখা, নীরবতার মাঝে বৃষ্টির শব্দ শোনা – সবগুলো স্মৃতিই যেন জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠলো চোখের সামনে। যে ঘরটাতে এক সময়ে স্বর্গসুখ খুঁজে পেত আরশাদ, সেই একই ঘরকে আজ মনে হচ্ছে একটি খাঁচা। যে খাঁচায় আরশাদ এবং তার যন্ত্রণাগুলো বন্দী। নিজের ভেতরকার অনুতাপে নিজেই একটু একটু করে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে সে।

সিগারেট শেষ হয়ে গেছে তবুও শেষাংশটুকু দুই আঙ্গুলের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরলো আরশাদ। যে মানুষটার চোখদুটো সবসময় স্টারডমের চাকচিক্যে জ্বলজ্বল করে, তার চোখদুটো আজ ম্লান হয়ে আছে। যে অন্ধকার তাকে ভয়াবহভাবে ঘ্রাস করে রেখেছে, সেই অন্ধকার যেন ফুটে উঠছে ওই চোখদুটোর মাঝে।

তর্জনী কপালে চেপে ধরলো আরশাদ। যে জানে তার ডিপ্রেশন আছে। বহুদিন ধরেই আছে। আজকাল ডিপ্রেশন শব্দটা বড্ড সস্তা হয়ে গেছে। পান থেকে চুন খসলেই ব্যবহৃত হয় শব্দটি। যারা সত্যিকার অর্থে ডিপ্রেশনের শিকার হয়, শুধুমাত্র তারাই জানে এ ব্যাধি কতটা ভয়াবহ।

ডিপ্রেশন থেকে কখনো বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেনি আরশাদ। কারো কাছে সাহায্যও চায়নি। ভাবতো তার সমস্যা একান্তই তার। এই সমস্যাগুলোর সমাধান করার সাধ্য পৃথিবীতে আর কারো নেই। আসলে তো, আরশাদকে ডিপ্রেশন থেকে উদ্ধারের সাধ্য তার নিজেরও ছিল না। নিজের অজান্তেই এই ভয়াবহতা থেকে তাকে বাঁচিয়েছে অরা।অতীতে ডিপ্রেশন থেকে পাওয়া ট্রমার কারণে সেই অরার সঙ্গেই এতটা খারাপ আচরণ করে ফেলল আরশাদ?

ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। বিরক্ত ভঙ্গিতে সোফার সামনে থাকা টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা হাতে নিলো আরশাদ। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে তার ম্যানেজার অয়নের। কারও সঙ্গে কথা বলার মানসিকতায় আরশাদ নেই। কলটা তাই কেটে আবারও নতুন একটা সিগারেট ধরালো।

খানিকক্ষণ বাদে নোটিফিকেশনের শব্দ কানে ভেসে এলো। আরশাদের একবার ইচ্ছা হলো ফোনটাকে আছাড় মেরে ফেলে দিতে। পৃথিবীর সবগুলো মানুষকে কেন আজই তাকে বিরক্ত করতে হবে।

বিরক্ত হলেও কী যেন মনে করে ফোনটা হাতে নিলো আরশাদ। অয়ন ম্যাসেজ পাঠিয়েছে, “স্যার আজকের মিটিং দুপুর দুইটায় শুরু হবে।”

সঙ্গে সঙ্গে আরশাদের মনে পড়ে গেল আজকের অ্যানুয়াল মিটিংয়ের কথা। মনের মাঝে বয়ে চলা এই জোরালো ঝড়ের ধাক্কায় সে তো ভুলেই গিয়েছিল আজ অফিসে এত গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে। এই মিটিংয়ে তার সর্বোচ্চ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। আজ সে কতটুকু মনোযোগ দিতে পারবে তা নিয়ে অবশ্য অগাধ সংশয় রয়েছে।

অসুস্থতার অজুহাতে মিটিংটা ক্যান্সেল করতে ইচ্ছা করছে। সে যে একেবারে সুস্থ তা তো নয়। মানসিক অসুস্থতাও এক ধরনের অসুখ। মিটিংয়ে না যাওয়ার ইচ্ছাটাই তার মাঝে বেশি। মিটিংয়ে গেলেই তো অরার মুখোমুখি হতে হবে। অরার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর কোনপ্রকার সাহস কিংবা মনের জোর আরশাদের নেই।

তার তো উচিত এই মুহূর্তে অরার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাওয়া। সে চাইছেও তাই। তবে মন থেকে কোনপ্রকার জোর পাচ্ছে না। অরা কি পারবে কোনোদিন তাকে ক্ষমা করতে দিতে? নির্ঘাত পারবে না। হৃদয়টা অদ্ভুতভাবে মোচড় দিয়ে উঠলো। আচ্ছা তার প্রতি অরার সকল ভালোবাসা কি উধাও হয়ে গেছে? আরশাদ নিজেই দোষেই কি হারিয়ে ফেলল তার সবথেকে মূল্যবান জিনিসটা?

হাজারো দোনমনো শেষে অফিসে যাবে বলে ঠিক করলো আরশাদ। রূপকথার মতো এই জীবনে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি যেহেতু সেই করেছে, তাই সবটা আগের মতো তাকেই করে তুলতে হবে। অরার থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে থেকে তা তো আর সম্ভব নয়।

হট শাওয়ার নিয়ে এসে অফিসের জন্যে তৈরি হলো আরশাদ। সাদা শার্ট, কালো জিন্স, কালো স্যুটে তাকে বরাবরের মতোই হ্যান্ডসাম লাগছে। নিখুঁত অভিনেতা বটে আরশাদ। নিজের ভেতরে ফুটতে থাকা আগ্নেয়গিরির লাভা সুকৌশলে গোপন করে রাখছে। তাকে দেখে যেন বোঝার উপায় নেই তার ভেতরে সব তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।

আরশাদ অফিসে পা রাখতেই একপ্রকার হইচই পড়ে গেল। অফিসের বস এসেছে বলে কথা। মেইন গেট থেকে লিফট পর্যন্ত বিভিন্ন টিমের স্টাফরা দাঁড়িয়ে আছে তাকে স্বাগত জানাবে বলে। বিরক্ত না হয়ে পারলো না আরশাদ। সে কি এই অফিসে প্রথমবারের মতো আসছে না-কি? যেই আরশাদের সামনে পড়ছে, সেই বিনীত ভঙ্গিতে বলছে, “Good Afternoon Sir.”

তারকারা চাইলেই সকলের চোখের আড়ালে চলে যেতে পারে না। সারা বছরই তাদের থাকতে হয় সাধারণ দর্শকের আগ্রহের কেন্দ্রে। মানুষের অ্যাটেনশন পেয়ে অভ্যস্ত আরশাদ। তবুও আজ সকলের অহেতুক এই অ্যাটেনশন অসহ্যকর লাগছে। ইচ্ছা করছে অদৃশ্য হয়ে যেতে।

ফাইন্যান্স টিমের প্রধান রিয়াজসহ অন্যান্য টিমের প্রধানরা এসেছে আরশাদকে রিসিভ করে নিতে। এও এক বিরক্তি। আরশাদ এই অফিসে কম আসে বলে কী অফিসটা তার কাছে অজানা? সে খুব ভালো করেই জানে মিটিং হল কোথায়। তাকে আবার রিসিভ করে নিয়ে যেতে হবে কেন?

পাঁচতলায় অফিসের বিশাল মিটিং রুম। কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ মিটিংগুলো এখানেই হয়ে থাকে। ঘরটির একটি দেয়ালজুড়ে প্রকান্ড চৌষট্টি ইঞ্চির টিভি। মিটিংয়ের প্রজেক্টগুলো এই টিভিতেই প্রদর্শন করা হয়। ঘরের পুরোটা জুড়েই বিশাল টেবিল এবং আঠারোটি চেয়ার একের পর এক সাজানো। ঘরের ওপরের দেয়ালে চমৎকার আলোকসজ্জা।

ঘরের ভেতরে পা রাখতেই শীতল হাওয়া বয়ে গেল আরশাদের গা বেয়ে। টিভির সবথেকে কাছাকাছি চেয়ারটায় বসে আছে অরা। বরাবরই মতোই অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাকে। এই শাড়িতে একরকম ভালো লাগে আবাদ এখন সাদা শার্ট, হালকা মেরুন স্যুট আর কালো লেগিংসে আরেক রকম ভালো লাগছে। তবে অরা যেন অদৃশ্য এক চাদরে নিজেকে আড়াল করে রেখেছ। তার চোখদুটো আটকে সমানে থাকা ল্যাপটপে দিকে। আরশাদের উপস্থিতি কি সে টের পাচ্ছে না? পাচ্ছে তো বটেই। মিটিং রুমে উপস্থিত সকলেই তাকে স্বাগত জানাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। অথচ কারও সঙ্গেই কথা বলতে ইচ্ছা করছে না, কারোর প্রশ্নেরই জবাব দিতে ইচ্ছা করছে না। আরশাদ চাইছে, শুধুমাত্র একবার, এক মুহূর্তের জন্যে অরা চোখ তুলে তাকাক তার দিকে। কিন্তু অরা তাকালো না। আগের মতোই দৃষ্টি আটকে রাখলে ল্যাপটপে।

আরশাদ গিয়ে বসলো অরার মুখোমুখি থাকা চেয়ারে। এমন না যে সে ইচ্ছা করে, অরার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে করলো এমনটা। অফিসে যেকোনো মিটিংয়ে অরার মুখোমুখি বসাটাই তার অভ্যাস। মানুষ কি চাইলেই তার অভ্যাস ছেড়ে দিতে পারে?

অরা ঠিকই তার অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছে। যে অরা কদিন আগেও আরশাদের থেকে চোখ সরাতে পারতো না, সেই অরাই আজ এক পলকের জন্যে দেখতে চাইছে না তাকে। রূপকথার মতো জীবনটাকে নিজ হাতে ভেঙে চুরমার করে ফেলল আরশাদ। যে অসহনীয় কষ্ট সে অরাকে দিয়েছে, সেই একই কষ্টে নিজেকে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস আটকে আসছে আরশাদের। আচ্ছা, অরা কি তাকে ঘৃণা করে?

মিটিং শুরু হলো। প্রথম এক ঘন্টা কাটলো ফাইল-পত্র ঘেঁটে। ফাইন্যান্স হেড রিয়াজ টিভিতে তার তৈরি করা প্রজেক্টের মাধ্যমে এ বছরের ফাইনাল রিপোর্টটা বিশ্লেষণ করছে। আরশাদ বারবার চেষ্টা করছে তার কথাগুলোতে মন দিতে। কিছুতেই পারছে না। তার চোখদুটো বারবার ফিরে যাচ্ছে অরার দিকে। এখনো তার দিকে একটাবার তাকায়নি অরা, আড়চোখেও না। অরা মন দিয়ে প্রজেক্ট দেখছে। তার চোখদুটোর মাঝে বিচিত্র এক কঠোরতা। যে কঠোরতা অন্য কারো চোখে না পড়লেও, এড়িয়ে যায়নি আরশাদের চোখ।

অরাকে দেখার মাঝে এতটাই ডুবে ছিল সে প্রজেক্টের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশে সে মনযোগ দিতে পারেনি।

রিয়াজের প্রেজেন্টেশনের মাঝে আরশাদ হঠাৎ বাঁধা সৃষ্টি করে বলল, “Sorry, can you repeat that?”

আরশাদ বেশ টের পাচ্ছে এই মিটিং হলে থাকা সবগুলো চোখ কয়েক মুহূর্তের জন্যে হলেও তার দিকে পড়েছে। সেসব চোখের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই তার। তার ভেতরটায় প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে অরাও তার দিকে তাকালো। কতক্ষণের জন্যে হবে? এক সেকেন্ডের জন্যে? কিংবা হয়তো তার থেকেও সময়ের জন্যে।

অরার আকস্মিক দৃষ্টিপাতে একেবারেই খুশি হতে পারলো না আরশাদ। কারণ এই দৃষ্টি বিরক্তি এবং ঘৃণায় পরিপূর্ণ। অস্বাভাবিকভাবে
ধরফর করে আরশাদের হৃদয়টা। রিয়াজ বলা কথাগুলো এবারও তার মনোযোগ এড়িয়ে গেল।

আরশাদ প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে সামলে, স্বাভাবিক রেখে মিটিংয়ে মনোযোগ দিতে। কিন্তু কিছুতেই পারছে না। তার সকল মনোযোগ আটকে আছে তার বিপরীতে বসে থাকা মানুষটার দিকে। অরার অবহেলা একেবারেই অসহনীয় বলে মনে হচ্ছে তার কাছে।

রিয়াজের প্রেজেন্টেশন শেষ হতেই শুরু হলো ক্রিয়েটিভ টিমের প্রেজেন্টেশন। ক্রিয়েটিভ টিমের হেড যুথী তার প্রজেক্টের মাধ্যমে নতুন বছরে কোম্পানির যে ধরনের সিনেমায় বিনিয়োগ করা উচিত, তার প্রস্তাবনা দিচ্ছে।

সোশ্যাল ইস্যুর ওপর ভিত্তি করে সিনেমা আমাদের দেশে নির্মাণ করা হয় না বললেই চলে। সোশ্যাল ইস্যুর ওপর ভিত্তি করে যে সিনেমাগুলো তৈরি করা হয় তার সবগুলোর মধ্যেই সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। এসব সিনেমায় অনেকগুলো চরিত্র থাকে, সমাজকে বদলে দেওয়ার মতো একটা চিত্রনাট্য থাকে এবং সিনেমার শেষে প্রভাবশালী একটি বার্তা থাকে। কে ফিল্ম নতুন বছরে এ ধরনের সিনেমায় বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে। প্রাথমিক একটা বাজেটও পেশ করা হলো।

যুথী বাজেটটা অরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ম্যাম, আপনি স্যারকে বাজেটটা বুঝিয়ে বলুন প্লিজ।”

অরার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে কথা বলতে হবে বলে সে ভীষণ বিরক্ত। আরশাদকে উদ্দেশ্য করে কোনো কথা বলার আগ্রহই তার নেই। অরার এই প্রতিক্রিয়া আরশাদের হৃদয়ে জ্বলতে থাকা আগুনকে সারা শরীরে ছড়িয়ে দিলো।

অরা বাজেটের কাগজটায় একবার চোখ বুলিয়ে শীতল গলায় বলল, “আমরা লম্বা সময়ের জন্যে এই প্রজেক্টটা শুরু করতে চাচ্ছি। আগামী দুই থেকে তিন বছরে কে ফিল্মস পাঁচটা সোশ্যাল ইস্যু নিয়ে নির্মিত সিনেমা রিলিজ করবে। এই পাঁচটা সিনেমারই শুটিং নতুন বছরের বিভিন্ন সময়ে শুরু হবে। প্রাইমারি বাজেট হিসেবে আমরা ধরেছি আট কোটি টাকা। প্রজেক্টটা পাশ হলে আমাদের প্রোডাকশন টিম আরও বিস্তারিতভাবে বাজেট তৈরি করবে।”

যন্ত্রের মতো কথাগুলো বলে গেল অরা। একফোঁটাও অনুভূতি নেই তার কণ্ঠস্বরে। চোখদুটোতেও একরাশ যান্ত্রিকতা। তবুও ভেতরে ভেতরে যে আগুন আরশাদকে জ্বালিয়ে ছারখার করছিল, অরার কণ্ঠের শীতলতা সেই আগুনকে রুখতে সফল হলো।

আচমকাই স্বস্তি অনুভব হচ্ছে আরশাদের মাঝে। কারণ সেও এখন অরাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলতে পারবে, অরাও বিরক্তি নিয়ে হলেও তার কথাগুলো শুনবে।

আরশাদ কম্পিত স্বরে বলল, “পাঁচটা সিনেমার জন্য আট কোটি?”

অরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, প্রত্যেকটা সিনেমার জন্যে প্রায় দেড় কোটি বাজেট ধরা হয়েছে।”

সোশ্যাল ইস্যুর সিনেমাগুলোতে খুব একটা খরচ হয় না। তাই বাজেটও মোটামুটি কম থাকে।

আরশাদ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “আমার মনে হয় এই প্রজেক্টটা খুবই রিস্কি। সোশ্যাল ইস্যুর সিনেমা নিয়ে আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। দর্শক কীভাবে এ ধরনের সিনেমাগুলো গ্রহণ করবে সেটাও আমরা জানি না। শুরুতেই পাঁচটা সিনেমায় এত বড় একটা অ্যামাউন্ট ইনভেস্ট করা কতটা যৌক্তিক হবে?”

অরা কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই প্রোডাকশন টিমের হেড সাদিক সাহেব বললেন, “অন্যান্য প্রোডাকশন হাউজ তো এ ধরনের সিনেমা করে অনেক লাভবান হচ্ছে স্যার।”

বিরক্তিতে গা জ্বলে গেল আরশাদের। তার আর অরার কথোপকথনের মাঝে অন্য কেউ ব্যাঘাত ঘটাবে কেন? ওই সেই কথোপকথন যান্ত্রিক, প্রাণহীন – তবুও অরার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ তো হলো। যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি আরশাদ করেছে, তারপর রোজ রোজ এই সুযোগ আর পেয়ে ওঠা হবে না।

কণ্ঠে বিরক্তির রেশ রেখেই আরশাদ বলল, “অন্যান্য প্রোডাকশন হাউজের সঙ্গে আমরা নিজেদের তুলনা করবো কেন? তাছাড়া আমাদের আলাদা একটা অডিয়েন্স আছে, তাদের এ ধরনের সিনেমা যে পছন্দ হবে তারও তো কোনো নিশ্চয়তা নেই।”

অরা হয়তো মনে মনে একমত হলো আরশাদের সঙ্গে। কী যেন ভেবে সে বলল, “তাহলে আপাতত এই প্রজেক্টটা হোল্ডে রাখি। আমরা যেহেতু দর্শকদের জন্যে নতুন ধরনের সিনেমা তৈরি করতে চাচ্ছি, তাই আপাতত সোশ্যাল ইস্যু নিয়ে একটা সিনেমা তৈরি করি। যদি ভালোভাবে দর্শকের সাড়া পাই, সিনেমাটা ব্যবসাসফল হয় তবেই এই প্রজেক্টটা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা যাবে।”

অরার দিকে তাকিয়ে থেকে আরশাদ বলল, “হুঁ।”

মুখে “হুঁ।” বললেও মনে মনে অরার সঙ্গে আরও বেশি কথা বলতে চাইছে আরশাদ। অরাকে বোঝাতে চাইছে তার ভেতর দিয়ে কতটা প্রবল ঝর বয়ে যাচ্ছে। কতটা যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে তার। কতটা অসহায় লাগছে নিজেকে। আরশাদ সেসবের কিছুই বলতে পারলো না। অরার কাছে ক্ষমা চাওয়ার ভাষা তার কাছে নেই। সে কি আসলেই ক্ষমার যোগ্য?

আরও কয়েক ঘন্টা চলল মিটিং। পুরোটা সময়ই কাজের বাইরে একটাও কথা বলেনি করা। কণ্ঠে সেই একই যান্ত্রিকতা ধরে রেখে কাজের কথা বলে গেল। মিটিং শেষ হলো অবশেষে। এ বছরের ফাইনাল রিপোর্ট বিশ্লেষণ ও পরবর্তী বছরের গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। সোশ্যাল ইস্যুর প্রজেক্ট পাস না করলেও, অন্যান্য অনেকগুলো প্রজেক্টে সাইন করলো আরশাদ।

এক মুহুর্তও মিটিং হলে রইলো না অরা। সঙ্গে সঙ্গে পা বাড়ালো নিজের কেবিনের উদ্দেশ্যে। অরার এই অবহেলা আর এক সেকেন্ডের জন্যেও সহ্য হচ্ছে না। তার অবহেলা অরাকে যতটা কষ্ট দিয়েছে, ঠিক ততটাই কষ্ট অরার অবহেলা তাকে দিচ্ছে। হয়তো এই কষ্টটাই তার প্রাপ্য।

কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে ফাইন্যান্স টিমের সঙ্গে প্রতি দুমাসে একবার মিটিং করে আরশাদ। সেই মিটিংয়ের জন্যেও আজকেই সময় দিয়েছে আরশাদ। অ্যানুয়াল মিটিং শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো সেই মিটিং। শেষ হতে হতে বেজে গেল সন্ধ্যা সাতটা।

আরশাদ আর অরা একসঙ্গে অফিসে এলে ফিরেও যায় একই সঙ্গে। এটা তাদের বহুদিনের পুরনো অলিখিত নিয়ম। আরশাদের অবচেতন মনের ছোট্ট এক অংশ আশা করেছিল, অরা হয়তো তার জন্যে অপেক্ষা করবে। একসঙ্গে ফিরে যাবে তারা। কিন্তু না, সে তো ভুলেই গিয়েছিল পরিস্থিতি আর আগে মতো নেই। আরশাদের কারণেই নেই।

মিটিং শেষে আরশাদ জানতে পারলো অরা বহু আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। আরেকদফা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল তার হৃদয়টা। আরশাদের ধারণাই ঠিক, অরা তাকে ঘৃণা করে। প্রবলভাবে, ঘৃণা করে।

(চলবে)

#ফিরে_আসা২
৩৪
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

পাঁচতারকা হোটেলের বিলাসবহুল কক্ষ। চারপাশে উজ্জ্বল আলোর ছড়াছড়ি। তবুও যে অন্ধকার আরশাদকে ডুবিয়ে রেখেছে, সেই অন্ধকার দূর করতে ব্যর্থ এই উজ্জ্বলতা। ড্রিংকসের বোতলে আরও একবার চুমুক দিলো আরশাদ। কটু স্বাদে মুখ বিকৃত করে ফেলল। এই জিনিসে আসক্ত ছিল সে একটা সময়ে। ভেতরের যন্ত্রণাগুলো ভুলে থাকার জন্যে ড্রিংকসের বোতলে আশ্রয় খুঁজে বেড়াতো।

শেষবার সে ড্রিংক করেছিল তিন বছর আগে। এই হোটেলের এই ঘরটায় বসেই। মনে পড়ে গেল সে দিনটির কথা। নওশীনের দেওয়া ওই আঘাতের ক্ষত তখনও তাকে ভেতরে ভেতরে শেষ করে দিচ্ছে। হোটেলে বসে ড্রিংক করছে আর নিজেকে অনবরত প্রশ্ন করে যাচ্ছে আরশাদ। কেন তার সঙ্গেই এমনটা হলো? কেন তাকেই এতটা অসহায় হতে হলো? আরশাদকে সেদিন এই পরিস্থিতি থেকে বের করে নিয়ে আসার জন্যে ঝড়ের গতিতে সেদিন উপস্থিত হয় অরা। সেদিনই তো প্রথমবারের মতো অরাকে নিজের সবথেকে বড় সিক্রেটটা বলেছিল আরশাদ। সেদিনের পর থেকে মেয়েটা আর কখনোই অসহায় মনে করতে দেয়নি তাকে।

আজ আবারও একই পরিস্থিতির সম্মুখীন আরশাদ। যন্ত্রণায় পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে তার ভেতরটা। ঘৃণা হচ্ছে নিজের প্রতি। অসম্ভব অসহায় লাগছে আজ। আর আজ তাকে এই যন্ত্রণা থেকে বাঁচাতে অরাও আসবে না।

আচ্ছা, ওই ঘটনার পর থেকে অরার মনের ওপর দিয়ে কী চলছে? আরশাদ বুঝতে পারছে, মেয়েটা অকল্পনীয় কষ্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। আরশাদের কাছ থেকে অমন ব্যবহার সে কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেনি। নিশ্চয়ই অরা নিজেকে প্রশ্ন করছে, “আরশাদ কি সত্যিই আমাকে কোনোদিন ভালোবেসেছিল, না-কি পুরোটাই ছিল তার অভিনয়?”

অরাকে সে কী করে বোঝাবে তার ভালোবাসায় কোনো ত্রুটি নেই, কোনোদিন ছিলও না। যত ত্রুটি সব তার মাঝে। অতীত আর বর্তমানকে মস্তিষ্কের মাঝে মিশিয়ে একাকার করে ফেলেছে সে। অরাকে সেদিন বলা ওই তিক্ত কথাগুলোর একটা শব্দও সে মন থেকে বলেনি। ওই মুহূর্তে নিজের প্রতি বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল না তার। মনে হচ্ছিল তার মনের নিয়ন্ত্রণ অন্য কারো কাছে।

নিজেকে নিজেরই সহ্য হচ্ছে না আর। অরাকে এত বড় একটা আঘাত দিয়েছে সে। নিজের ভুল বুঝতে এতটা সময় নিয়েছে। ঠিক এই মুহূর্তেই তার উচিত অরার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাওয়া। কিন্তু সে হোটেলে বসে ড্রিংক করছে। আবারও, আরেকদফায় ঘৃণা ধরে গেল নিজের প্রতি।

আরশাদ হাত থেকে বোতলটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো ফ্লোরে। ঝনঝন শব্দ করছে অগণিত কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে পড়লো ফ্লোরে। দুহাতে মাথা চেপে ধরলো আরশাদ। শুধুমাত্র সে নিজেই নিজেকে ঘৃণা করে না। অরাও তাকে তার থেকেও বেশি ঘৃণা করে। যে মানুষটার ভালোবাসা আরশাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন, তার ঘৃণা নিয়ে কী করে বাঁচবে সে?

সোফার সামনে থাকা টেবিলে পড়ে আছে আরও অসংখ্য বোতল। সেখান থেকে আরেক বোতল নিয়ে তাতে ঠোঁট স্পর্শ করালো আরশাদ। চোখদুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে তার। কী করে ফিরে পাবে তার অরাকে সে? অরা কি আদৌ কোনোদিন তার কাছে ফিরে আসবে?

ভবিষ্যতের কথা ভাবতেই হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল তার। অজানা এক ভয় ঝেঁকে ধরলো তাকে। অরা যদি তাকে ছেড়ে চলে যায়?
অরার চলে যাওয়ার কথা ভাবতেই বেড়ে গেল আরশাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি। মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল। চোখদুটো আবছা হয়ে আসছে। নিজেকে কেমন পাগল পাগল বলে মনে হচ্ছে তার।

পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কাঁপা কাঁপা হাতে ডায়াল করলো তার আপার নম্বরে। আশফিয়া ফোন রিসিভ করতেই আরশাদ অসহায় কণ্ঠে বলল, “আপা তুমি কোথায়?”

ভাইয়ের কণ্ঠস্বর শুনেই ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে আঁতকে উঠলো আশফিয়া। যে আরশাদের কণ্ঠে সর্বক্ষণ এক ধরনের দৃঢ়তা ভর করে, তার কণ্ঠে এই আকস্মিক অসহায়ত্বে আঁতকে ওঠারই তো কথা।

আশফিয়া বিস্মিত গলায় বলল, “আরশাদ? তোর গলাটা এমন শোনাচ্ছে কেন? ঠিক আছিস তুই?”

আরশাদ ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “না আমি ঠিক নেই। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। I need help.”

আশফিয়া ভীত কণ্ঠে বলল, “কী হয়েছে আরশাদ?”

আরশাদ অধৈর্য গলায় বলল, “বললাম তো আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমাকে হেল্প করো প্লিজ!”

“কোথায় তুই?”

“লুক্স হাভেনে।”

“আচ্ছা আমি আসছি।”

সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল আশফিয়া। না জানি কী গুরুতর বিপদে পড়েছে ছেলেটা। আরশাদ কখনো তার কাছে এভাবে সাহায্য চায়নি। নিজের সমস্যারগুলোর সমাধান নিজেই করেছে। সমাধান না করতে পারলেও অবহেলায় ফেলে রেখেছে সমস্যাগুলোকে। তবুও কারও কাছে সাহায্য চায়নি। নির্ঘাত এবারের সমস্যাটা বেশ গুরুতর।

আশফিয়ার গাড়ি এসে থামলো হোটেল লুক্স হাভানের সামনে। আরশাদ তার রুম নম্বর আগেই ম্যাসেজ করে রেখেছিল। তাই রুমটা খুঁজে পেতে তার অসুবিধা হলো না। এবার কলিংবেল বাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই ভেতর থেকে দরজা খোলার আওয়াজ কানে এলো। যেন এতক্ষণ ধরে আরশাদ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল আশফিয়ার জন্যে।

দরজা খুলতেই আরেকদফা আঁতকে উঠলো আশফিয়া। অস্বাভাবিক রকমের লাল আরশাদের চোখদুটো। চুলগুলো এলোমেলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন প্রকান্ড কোনো ঝড় বয়ে গেছে তার ওপর দিয়ে।

নিঃশব্দে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো আশফিয়া। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে একরাশ কাচের টুকরো আর এক তরল পদার্থ। টেবিলের দিকে চোখ পড়লো তার। সেখানেও সাজিয়ে রাখা সারি সারি বোতল।

আশফিয়া অবাক গলায় বলল, “আরশাদ? তুই ড্রিংক করেছিস?”

দরজাটা বন্ধ করতে করতে আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ।”

আশফিয়া ক্রুদ্ধ গলায় বলল, “মানে কী এসবের আরশাদ? কষে একটা চর মারতে ইচ্ছা করছে তোকে! এই দৃশ্য দেখার জন্যে এখানে টেনে এনেছিস আমাকে?”

বোনের রাগের প্রতি কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখালো না আরশাদ। ক্লান্ত পায়ে হেঁটে এসে আবারও বসলো সেই সোফাটার ওপর।

আশফিয়া হেঁটে এসে তার পাশে বসতে বসতে বলল, “Aura hates me.”

আশফিয়া অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ? কী যা তা বলছিস এসব?”

আরশাদ কম্পিত স্বরে বলল, “অরা আমাকে ঘৃণা করে আপা। আমি নিজে ওর চোখে আমার জন্যে ঘৃণা দেখেছি।”

“অরা তোকে কেন ঘৃণা করতে যাবে কেন?”

“কারণ আমিই ওকে ঘৃণা করতে বাধ্য করেছি।”

আরশাদের চোখদুটো বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। হ্যাঁ ছেলেরাও কাঁদে। সৃষ্টিকর্তা যেহেতু তাদের মানুষ হিসেবেই তৈরি করেছেন, তাই তাদের কান্না কোনো অষ্টম আশ্চর্য নয়। আরশাদের মুষ্টিবদ্ধ হাত তার কপালে ঠেকানো।

আশফিয়া হতভম্ব হয়ে ফিসফিস করে বলল,
“মানে?”

“তুমি আমাকে বলেছিলে না অরাকে কোনো কষ্ট না দিতে। আমি তো কথা রাখতে পারলাম না। তুমি ভাবতেও পারবে না কতটা কষ্ট দিয়েছি আমি ওকে।”

আরশাদের কণ্ঠে লুকিয়ে আছে বিচিত্র এক ধরনের ব্যথা। যে ব্যথা তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে তাকে।

“কী করেছিস তুই?”

আশফিয়া প্রশ্নের জবাব দিলো না আরশাদ। ক্ষতবিক্ষত গলায় সে বলল, “আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে আপা।”

আশফিয়া আরশাদের বাহু চেপে ধরে ভরসার যোগান দিয়ে বলল, “এই বোকা ছেলে! খবরদার এসব কথা বলবি না। তোর আপা আছে না? কিচ্ছু হবে না তোর।”

যে ঝড় আরশাদের ভেতরটাকে তছনছ করে দিচ্ছে, সেই ঝড় নির্ঘাত অরাকে কেন্দ্র করে। আশফিয়া বুঝতে পারছে ভয়ানক কোনো সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তারা দুজনে। সেই সমস্যা নিয়ে এখনই কোনো প্রশ্ন করলো না আশফিয়া। এমনিতেই বেচারা অনেক কষ্ট পাচ্ছে। এর মধ্যে তার ওপরে কোনপ্রকার চাপ সৃষ্টি করার অর্থ নেই।

আশফিয়া উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “চল আমার সাথে।”

“কোথায় যাবো?”

আরশাদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আশফিয়া বলল, “গাড়ি এনেছিস?”

“হ্যাঁ।”

“তোর গাড়িটা এখানেই থাক। আমার গাড়িতে করে চল।”

আশফিয়া আরশাদকে নিয়ে এলো তার বাড়িতে। এত বড় বাড়িতে সে একা থাকে না। তার ডিজাইনার হাউজের একটা মেয়েও তার সঙ্গে থাকে। ভাগ্যিস আজ ওই মেয়েটা বাড়িতে নেই। কিছুদিনের জন্যে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছে।

আরশাদকে বসার ঘরে বসিয়ে রেখে রান্নাঘর থেকে এক গ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে আনলো আশফিয়া। যদিও আরশাদ বেশি ড্রিংক করেনি, আর অল্পতে তার নেশাও হয় না। তবুও ভেতরকার ঘোলাটে ভাবটা দূর করবার জন্যেই এ ব্যবস্থা। আরশাদ বিনা বাক্য ব্যয়ে বাধ্য ছেলের মতো চুমুক দিলো শরবতের গ্লাসে।

আশফিয়া সোফায় তার পাশে বসতে বসতে মোবাইলটা হাতে নিলো। কল করলো অরার নম্বরে।

স্ক্রিনে অরার নামটা ভেসে উঠতে দেখেই আরশাদ চমকে উঠে বলল, “ওকে ফোন করছো কেন?”

আশফিয়া থমথমে ভঙ্গিতে বলল, “তুই বুঝবি না।”

আরশাদ আরও কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফোন রিসিভ করলো অরা।

কল লাউডস্পিকারে রেখে আশফিয়া যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলল, “কী খবর অরা? কেমন আছো?”

অরা অপরপ্রান্ত থেকে হাসিমুখে বলল, “এইতো আপা। আপনি কেমন আছেন?”

অরার কণ্ঠস্বর শুনতেই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল আরশাদের ভেতরটা। যতবারই নিজেকে গোছানোর চেষ্টা করে, ততবার অরাকে দেওয়া ওই কষ্টগুলোর কথা মনে করে এলোমেলো হয়ে যায় সে।

আশফিয়া দৃঢ়কন্ঠে বলল, “আমি তো সবসময় ভালোই থাকি। কথা কী করছে?”

অরা বিস্ময় নিয়ে বলল, “উনি আজ অনেক ব্যস্ত। কাল স্কুলে সায়েন্স প্রজেক্ট সাবমিট করতে হবে।”

“দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাচ্ছে বাচ্চাটা!”

“হুঁ!”

“আচ্ছা অরা, তোমাকে যে কারণে ফোন করা। আরশাদ আমার এখানে এসেছে। আমার ডিজাইনার হাউজ নিয়ে ওর সাথে কিছু আলোচনা ছিল। আরশাদের ফোনে চার্জ শেষ হয়ে গেছে তো, তাই আমাকে বলল যেন তোমাকে ফোন করে বলে দিই ওর ফিরতে দেরি হবে।”

নিমিষেই কেমন ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো অরার উজ্জ্বলতায় পূর্ণ কণ্ঠস্বর। অরা থমথমে ভঙ্গিতে বলল, “ঠিক আছে আপা, সমস্যা নেই।”

আশফিয়া ফোন রেখে দিতেই আরশাদ ব্যস্ত হয়ে বলল, “তুমি দেখলে আপা?”

“কী?”

আরশাদ হতাশামাখা কণ্ঠে বলল, “আমার নাম শুনতেই ওর হাসি থেমে গেল! গলার স্বর কেমন গম্ভীর হয়ে গেল! ও আমাকে আর সহ্য করতে পারে না আপা।”

আশফিয়া ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “তুই কী করেছিস আরশাদ?”

আরশাদ কোনো কিছুই গোপন করলো না আপার কাছে। সবটাই শুরু থেকে বলল। কাজের সূত্রে অরার ঢাকার বাইরে যাওয়া, আরশাদের সন্দেহ, অরার ঘরে স্পাই ক্যামেরা লুকিয়ে রাখা, অরা ঢাকায় ফেরার পর তাদের মধ্যে হওয়া সেই ঝাঁঝালো কথোপকথন – সবটা। নিজের দোষগুলো ঢেকে পুরো ঘটনা বর্ণনা করেনি আরশাদ। যা সত্যি, সে তাই বলেছ। আরশাদ জানে সে কত বড় ভুল করেছে।

পুরো ঘটনা শুনে আশফিয়া স্তব্ধ হয়ে বলল, “তুই কী পাগল?”

আরশাদ চুপ করে রইলো। আসলেই সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। পাগলামির বশে এতটা গভীর আঘাত দিয়ে ফেলেছে তার সবথেকে প্রিয় মানুষটাকে। অরা যতটা কষ্ট পাচ্ছে, ঠিক ততটাই কষ্ট সেও পাচ্ছে। এসব পাগলামি ছাড়া আর কী?

আশফিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুই অরাকে সন্দেহ করেছিস? অরাকে?”

আরশাদ ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “বিশ্বাস করো আপা আমি ওকে সন্দেহ করতে চাইনি।”

আশফিয়া ধমকের সুরে বলল, “বাজে কথা বলবি না তো! সন্দেহ করতে না চাইলে সন্দেহ করলি কেন?”

আরশাদ আহত গলায় বলল, “তুমি আমাকে বিশ্বাস করছো না কেন আপা? আমি সত্যিই অরাকে সন্দেহ করতে চাইনি! আমার মনে হচ্ছিল আমি সেই সময়টায় ফিরে গেছি, যে সময়ে নওশীনকে ঢাকায় রেখে আমি দেশের বাইরে শুটিং করে বেড়াতাম।”

আশফিয়া অবাক গলায় বলল, “নওশীন? এর মধ্যে আবার নওশীন এলো কোথা থেকে?”

“শুনবে তো আগে!”

“আচ্ছা বল।”

আরশাদ লম্বা শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো, “আমি যখন নওশীনকে ঢাকায় একা রেখে গিয়েছিলাম, তখনই তো ও…”

কথাটা আর শেষ করতে পারলো না আরশাদ। অবলীলায় বলেই দেওয়া যায়, “তখনই তো ও আমার ওপর চিট করেছিল।” কিন্তু কখনোই বলতে পারে না আরশাদ। যতবারই বলে, ততবারই তার দেহমন ডুবে যায় অতীতের সেই ঘটনায়।

আরশাদ আবারও বলল, “আমার মনে হচ্ছিল অরাও একই কাজ করবে। আমার থেকে দূরে গিয়ে আমার বিশ্বাস ভাঙবে।”

“অরা আর নওশীন এক হলো?”

আরশাদ আঁতকে উঠে বলল, “না!”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো আরশাদ। আশফিয়াও সময় দিলো তাকে।

আরশাদ কপালের ওপর বাম হাত ঠেকিয়ে বলল, “আপা তুমি কখনোই বুঝবে না আমার মনের ওপর দিয়ে তখন কী যাচ্ছিল। অরা যখন ওই স্পাই ক্যামেরা খুঁজে পেয়ে বারবার নিজেকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছিল, আমার মনে পড়ছিল নওশীনও কীভাবে ধরা পড়ে যাওয়ার পরেও নিজেকে জাস্টিফাই করছিল। নিজের বিশ্বাসঘাতকতার দোষ আমার ওপরে চাপানোর চেষ্টা করছিল।”

আশফিয়া কিছুটা নরম গলায় বলল, “অরা এর আগেও তো ঢাকার বাইরে গেছে। তুইও তো ওকে রেখে কতবার দূর-দূরান্তে গিয়েছিস শুটিংয়ের জন্যে। তখন এমনটা মনে হয়নি।”

“না।”

আরশাদকে দেখে, তার কথাবার্তা শুনে আশফিয়া বেশ বুঝতে পারছে স্বাভাবিক নেই। গত কয়েকদিন ধরে কঠিন যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। শরীরের যন্ত্রণা হলে মানুষ হসপিটালে ভর্তি হয়। তাকে দেখে রাজ্যের সব মানুষজন ছুটে যায় সেখানে। কিন্তু মনের যন্ত্রণার জন্যে কোনো হসপিটাল থাকে না। তাকে বোঝার মতো কোনো মানুষও থাকে না।

আরশাদ অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, “কয়েকমাস আগে আমি স্কুলের রিউনিয়নে গিয়েছিলাম না?”

“হুঁ।”

“সেখানে আমার রাশেদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তোমার রাশেদকে মনে আছে?”

“আছে। হঠাৎ এসব বলছিস কেন?”

“রাশেদ আমাকে সেদিন বলল, আবার কোনো মেয়ে মানুষকে বিশ্বাস করতে পারবি তো? অরা ঢাকার বাইরে যাওয়ার পর থেকে এই লাইনটা আমাকে ট্রিগার করে।”

আশফিয়া বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “উফ! কতবার বলেছি এসব ফালতু মানুষ-জনের সাথে মিশবি না!”

আরশাদ নিজের পক্ষ নিয়ে বলল, “ফালতু মানুষ কোথায় হলো?”

আশফিয়া তাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল, “আচ্ছা বুঝেছি।”

আবারও চুপ করে রইলো আরশাদ। একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো আশফিয়া। মানুষ ভাবে সেলিব্রিটিদের চাকচিক্যময় জীবনে সুখের ছড়াছড়ি। দুঃখ তাদের স্পর্শই করতে পারে না। অথচ তারা কেউই জানলো না, কী ভয়ঙ্কর কষ্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রিয় সেলিব্রিটি।

আরশাদের হাতের ওপরে নিজের হাতটা রাখলো আশফিয়া, তাকে ভরসা দেওয়ার জন্যে। কতটুকু ভরসা আরশাদ পাচ্ছে, কে জানে? এর আগেও ঠিক একই ভাবে মানসিক যন্ত্রণা শেষ করে দিয়েছিল ছেলেটা। বহুকষ্টে স্বাভাবিক হয়েছিল আরশাদ। কিন্তু আবারও ফিরে এলো ওই মানসিক যন্ত্রণাগুলো। এবার আর তাকে একা কষ্ট পেতে দেবে না আশফিয়া।

অরার সঙ্গে আরশাদ যা করেছে, তার জন্যে প্রচন্ড কয়েকটা ধমক দিতে ইচ্ছা করছে তাকে। কিন্তু আপাতত সেই ইচ্ছাটা দমিয়ে রাখলো আশফিয়া। সে বেশ বুঝতে পারছে, তার ভাই ইচ্ছা করে অরাকে কষ্ট দেয়নি। একটা মানুষকে কেউ ইচ্ছা করে কষ্ট দিলে, তার জন্যে উল্টো নিজেই কষ্ট পায় না।

“আরশাদ?”

“হুঁ?”

আশফিয়া কোমল স্বরে বলল, “ভাই তুই বুঝতে পারছিস যে তুই ট্রমাটাইজ?”

আপার প্রশ্নটাকে একেবারে অগ্রাহ্য করে আরশাদ বিড়বিড় করে বলল, “অরা আমাকে ঘৃণা করে। ও আর কখনোই আমার দিকে আগের মতো করে তাকাবে না। আর কখনোই আমাকে আগের মতো ভালোবাসবে না।”

“আরশাদ! আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি।”

আরশাদ ভয়ার্ত গলায় বলল, “আমি কীভাবে সবকিছু আগের মতো করে ফেলবো? কীভাবে অরার কাছে ক্ষমা চাইবো, কিছুই বুঝতে পারছি না। আর তুমি বলছো নিজেকে নিয়ে ভাবতে? I don’t care about myself.”

আশফিয়া উঁচু গলায় বলল, “But I care about you! নিজের দিকটাই দেখিস শুধু। তোর কোনো ধারণাই নেই কতগুলো মানুষের চিন্তা হয় তোকে নিয়ে। এখানে বসে বসে খুব প্রলাপ বকছিস, অরা তোকে ঘৃণা। অরাও তোকে নিয়ে চিন্তা করে আরশাদ। তুই কী ভেবেছিস শুধু শুধু ওকে ফোন করে জানিয়েছি তোর ফিরতে দেরি হবে?”

চুপ করে রইলো আরশাদ।

আশফিয়া আবারও বলল, “তুই কী ভেবেছিস, যা করেছিস তার পরও অরা তোকে সহজে ক্ষমা করে দেবে? তোর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকবে? হেসে হেসে কথা বলবে?”

আরশাদ অনুতাপমাখা কণ্ঠে বলল, “না।”

“অভিমান বুঝিস?”

হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো আরশাদ।

আশফিয়া জোর গলায় বলল, “অরা যেটা করছে সেটা অভিমান। অভিমানে তোকে এড়িয়ে যাচ্ছে। আর তুই গাধা ভাবছিস, অরা তোকে ঘৃণা করে। তুই খুব লাকি আরশাদ, কারণ অভিমান শুধু ভালোবাসার মানুষদের ওপরেই করা যায়।”

আরশাদ অসহায় ভঙ্গিতে বলল, “আমি কী করবো আপা?”

প্রশ্নটা করতে করতেই টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়লো তার দুচোখ বেয়ে। পৃথিবীতে আজ তার থেকে বড় অসহায় আর কেউ নেই।
আশফিয়ার চোখেও জল চলে এল। তবুও সে ভেঙে পড়লো না। নিজেকে শক্ত রাখলো আরশাদের জন্যে।

আশফিয়া চোখভর্তি জল নিয়েই এক ধমক দিয়ে বলল, “আবারও কাঁদছিস বোকার মতো! আমি কিছুই বলবো না তোকে। অরার সঙ্গে কীভাবে সবকিছু আগের মতো করবি সেটা তোর ব্যাপার। এই বিশৃঙ্খলা তুই শুরু করেছিস, শেষও তুই করবি। আমি তোকে এ ব্যাপারে কোনো হেল্প করবো না।”

আরশাদ অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো আশফিয়ার দিকে।

আশফিয়া আবারও বলল, “কিন্তু যে বিষয়ে হেল্প করবো সেটা বলছি। তোকে বুঝতে হবে যে তুই ট্রমাটাইজ। আঘাত পেলে ব্যথা তো কিছুদিনই থাকে, ক্ষতচিহ্ন রয়ে যায় দীর্ঘসময়। তোর ক্ষেত্রেও তাই। আগের ট্রমাগুলো এখনো তোর সাথে রয়ে গেছে। এতদিন লুকিয়ে ছিল, ওই রাশেদ না ফাশেদ কার কথায় ট্রিগার হয়ে আবারও বেরিয়ে এসেছে।”

আবারও সেই একই প্রশ্ন, একই ভঙ্গিতে করলো আরশাদ, “আমি কী করবো আপা?”

“মনটার যত্ন নে প্লিজ। মনকে বোঝানোর চেষ্টা কর কোনটা অতীত কোনটা বর্তমান। অতীত আর বর্তমান গুলিয়ে ফেললে তো চলবে না ভাই। আগে নিজেকে ঠিক কর, তুই নিজে ঠিক না থাকলে এই সম্পর্কটাকে ঠিক করবি কীভাবে?”

আরশাদ চুপ করে আশফিয়ার কথাগুলোর গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করছে। আসলেই তো, নিজে এলোমেলো থাকলে এই সম্পর্কটাকে আবারও জোড়া লাগাবে কী করে সে?

আশফিয়া আরশাদের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “আর যখনই হেল্পলেস লাগবে, তখন চুপ করে বসে থাকবি না। আজ যেটা করেছিস, সেটাই করবি। কাছের মানুষগুলোর কাছে হেল্প চাবি। সবাই আছে তোর জন্যে। মা আছে, আমি আছি, অরা আছে।”

অরার নামটা শুনেই চমকে উঠে আপার দিকে তাকালো আরশাদ। সত্যিই কি অরা আছে তার জন্যে?

আশফিয়া আরশাদকে জড়িয়ে ধরে ভরসা দিয়ে বলল, “আছে তো!”

(চলবে)