#ফিরে_আসা২
৫৫
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
অরার মস্তিষ্ক এখন স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকলে তার মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খেত। এই যেমন, সুজানা মেয়েটা আরশাদের সঙ্গে তার ওই কুৎসিত ছবিগুলো ইন্টারনেটে ছেড়ে দিলো কেন? যদিও নিজের অবয়বটা ঘোলাটে করে দিয়েছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে তার উদ্দেশ্য আরশাদের ইমেজ নষ্ট করা। কিন্তু কেন? আরশাদকে অপদস্থ করে এই মেয়েটার লাভ কী? এমন তো নয় যে গত রাতে যা হয়েছে তাতে সুজানার মত ছিল না। আরশাদ জোর করেছে তার ওপরে। দুজনের সম্মতিতেই তো সবটা হয়েছে। তবে কেন সে চাইছে আরশাদকে টেনে-হিঁচড়ে নিচে নামাতে?
আজ সন্ধ্যায় নিজের ফেকবুক পেইজ থেকে কয়েকটা ছবি পোস্ট করে সুজানা। আর সঙ্গে কয়েকটা অডিও ক্লিপও। যদিও মিনিট খানেকের মধ্যেই তা ডিলিট করে দিয়েছিল। তবে ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে। তুষের আগুনের মতো সেগুলো ছড়িয়ে পড়ে ইন্টারনেট জুড়ে। সিনেমার গ্রুপ আর পেইজে পেইজে এই ছবিগুলোই ঘোরাফেরা করছে। লোকের মুখে কেবল একটাই কথা, “আরশাদ হক একজন চরিত্রহীন মানুষ!”
সুজানা যে অডিও ক্লিপ গুলো পোস্ট করেছিল সেগুলো মূলত কল রেকর্ডিং। রেকর্ডিং শুনে অরা ধারণা করে নিচ্ছে, আজ সন্ধ্যায় আরশাদ বারবার চাচ্ছিল সুজানার সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু সুজানা নিজেই মানা করে যাচ্ছে অনবরত।
মোবাইলের স্পিকার কানের কাছে ধরে নিঃশব্দে কল রেকর্ডিংটা শুনছে অরা। তার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
আরশাদের কণ্ঠ শোনা গেল, “প্লিজ একবার দেখা করো!”
সুজানা ভীত কণ্ঠে বলল, “আমি পারবো না। এটা সম্ভব না।”
“কাল রাতে অনেক কিছুই তো সম্ভব হয়েছিল। সব ভুলে গেছ না-কি?”
অরার সমস্ত শরীরের কম্পন ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে। চোখদুটো বেয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রাগের মাত্রা। বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই আরশাদের মাঝে! অরা তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ওই মেয়েটার সাথে আবারও দেখা করতে চাইছে সে? তার মানে তো একটাই। আরশাদের জীবনে অরার সামান্যতম মূল্য নেই। ইচ্ছা করছে এই মোবাইলটাও আছাড় মেরে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলতে। নেহায়েত সীমার মোবাইল বলে নিজেকে সংযত রেখেছে সে।
এতক্ষণে মোবাইলের মালিকের আগমন ঘটলো ঘরে। অরার এই আকস্মিক আগমন সীমাকে কিঞ্চিৎ বিপদেই ফেলে দিয়েছে। তার শাশুড়ি উদ্যোগে এতদিন, শ্বশুর-শাশুড়ির ফ্ল্যাটের নিচের ফ্ল্যাটে আলাদা সংসার পেতেছিল সে এবং এনায়েত। প্রত্যেকটা মেয়েরই না-কি নিজের একটা সংসারের আকাঙ্ক্ষা থাকে। সীমারও তার ব্যক্তিক্রম নয়। তার শাশুড়ি সাবিহা বেগম পুত্রবধূর মনের কথাটা বুঝতে এই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
মাস কয়েক আলাদা সংসারের স্বাদ নিয়ে শখ মিটে গেছে সীমার। শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ সবার সঙ্গে মিলে মিশে থাকাটাই তার জন্যে স্বাচ্ছন্দ্যের। আগামীকাল তাদের এই ভাড়া করা ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিয়ে আবারও পুরনো ফ্ল্যাটে ফিরে যাওয়ার দিন ছিল। সে অনুযায়ী সব গোছগাছও করে রেখেছিল সীমা এবং এনায়েত। পুরো ফ্ল্যাট গিজগিজ করে ছোট-বড় কার্টুনে।
কলিংবেল শুনে অরাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সীমা বুঝে যায় মেয়েটা অস্বাভাবিকভাবে বিধ্বস্ত। এই মুহূর্তে তার সীমাকে প্রয়োজন। অরাকে নিয়ে শশুর-শাশুড়ির বাড়িতে কাল যাওয়াই যেত। তারা যথেষ্ট আন্তরিক মানুষ। তবে সীমা চাইছে অরার এই অবস্থায় তাকে অধিক সংখ্যক মানুষের মুখোমুখি করতে।
ভাগ্যিস এই ফ্ল্যাটের মালিক লোকটা নিতান্তই ভালো মানুষ। এনায়েত তাকে ইমার্জেন্সির কথা বলে কয়েকদিন সময় চাইতেই বিনা বাক্য ব্যয়ে রাজি হয়ে যায় সে। জিনিসপত্র শিফট করতে সাহায্য করার জন্যে যে ছেলেগুলোর আসার কথা ছিল, তাদেরকেও নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে।
সীমা ধীর ভঙ্গিতে অরার পাশে বিছানায় বসলো। পুরো ফ্ল্যাট এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই সীমার। তার সকল ব্যস্ততা কেবল প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর অস্থির মনটা শান্ত করায়। অরার কাছে ঘটনার সবটাই শুনেছে সে। তবুও মনের মাঝে তীব্র খচখচানি। আরশাদের মতো একটা মানুষ অরাকে ঠকিয়েছে? কিছু কিছু সত্যি বিশ্বাস করা খুব কঠিন। এটাও ঠিক তাই।
পুরো দেশ এই ঘটনায় উত্তপ্ত। টিভিতে নিউজ দেখাচ্ছে। টিভি বন্ধ করে রেখেছে সীমা। এসব নিউজ দেখতে অরা আরও অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। যার কারণে টিভি বন্ধ করে রাখা, সে তার মোবাইলটা নিয়ে এসব নিউজ অনবরত দেখেই যাচ্ছে।
সীমা বিরক্ত ভঙ্গিতে অরার হাত থেকে কেড়ে নিলো তার মোবাইলটা।
অরা আঁতকে উঠে বলল, “সীমা! আমি শুনছিলাম তো।”
সীমা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “শুনতে হবে না।”
অরা প্রতিবাদের সুরে কিছু একটা বলতে গিয়েও বললে না। অতিরিক্ত ক্লান্ত সে। বিকেল থেকে যা যা তার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে, তার পর নিজেকে স্বাভাবিক রাখা সম্ভব নয়। প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে শক্ত রাখার। যা হয়েছে, তাতে তার দোষটা কোথায়? সে কেন কষ্ট পেতে যাবে শুধু শুধু? এসব চিন্তা করে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করেও পারছে না অরা। একটু পর পর ভেঙে পড়ছে।
এই যেমন ঠিক এই মুহূর্তে, আবারও ভেঙে পড়লো অরা। দুহাতে মুখটা লুকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে সে। এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীতে তার থেকে অসহায় হয়তো কেউ নেই। যে মানুষটা তার একমাত্র আশ্রয়, সেই তার সঙ্গে এত বড় অন্যায়টা করলো। আর কখনো কি কাউকে ভরসা করতে পারবে অরা?
সীমা অরার কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলল, “আর কত কাঁদবি? কাঁদতে কাঁদতে চোখের সব জল ফুরিয়ে যাচ্ছে তো!”
অরা কান্না থামানোর কোনপ্রকার চেষ্টা না করেই আক্ষেপের সুরে বলল, “কী চমৎকার অভিনেতা না আরশাদ? আমার সঙ্গে একই ঘরে থেকে আরেকটা মেয়ের সাথে দিব্যি প্রেম করে গেল। অথচ আমি কিছুই বুঝলাম না। তুই জানিস? কাল রাতে বাড়ি ফিরে আমাকে কত কেয়ার করলো! ওকে ওভাবে দেখলে কে বলবে, একটু আগে আরেকটা মেয়ের সাথে…”
কথাটা শেষ করতে পারলো না অরা। কোনো মেয়ের পক্ষেই সম্ভব নয় এই কথা শেষ করা।
সীমা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “অরা? কত বছর হলো আরশাদ ভাইয়াকে চিনিস তুই?”
অরা অস্থির ভঙ্গিতে বলল, “জানি না।”
সীমা মৃদু ধমক দিয়ে বলল, “আহ্ শান্ত হয়ে উত্তরটা দে তো!”
অরা টেনে টেনে কয়েক আর শ্বাস নিয়ে বলল, “বিয়ের আগে চার বছর, আর বিয়ে পর তিন বছর।”
“এই সাত বছরে কখনো কি তোর মনে হয়েছে সে এতটা খারাপ হতে পারে?”
চুপ করে রইলো না। এক মুহূর্তের জন্যেও তার মনে হয়নি আরশাদ এতটা খারাপ হতে পারে, এতটা খারাপ কাজ করতে পারে। কিন্তু সে করেছে।
সীমা আবারও বলল, “বিয়ের আগে তো তুই কেবলই তার ম্যানেজার ছিলি। তখন তোর কাছে লুকানোর মতো কিছু ছিলও না। তখনও কি কখনো দেখেছিস তাকে খারাপ কোনো সম্পর্কে জড়াতে।”
“না।”
“তাহলে এত সহজেই অবিশ্বাস করছিস কী করে?”
অরা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “চোখের সামনে সত্যিটা দেখার পরও কী করে বিশ্বাস করে যাবো? আমি এতগুলো বছরে একবারের জন্যেও ওকে অবিশ্বাস করিনি, সন্দেহ করিনি। কিছুদিন আগেও ওর শার্টে আমি লিপস্টিকের দাগ দেখেছিলাম। তাও সন্দেহ করিনি। ও আমাকে বুঝিয়েছে ওটা গেটআপের দাগ, আমিও সরল মনে তাই বিশ্বাস করেছি। কিন্তু সত্যিটা দেখার পরেও কী করে চুপ করে থাকি? আমার একটাই দোষ, আমি ওকে ভালোবেসেছি।”
সীমা মলিন হাসি হেসে বলল, “ভালো তো আরশাদ ভাইয়াও বেসেছে। মনে আছে ওই সাবের বদটা তোকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেল? ভাইয়াকে খুব কাছ থেকে দেখেছি তখন। পাগল হয়ে গিয়েছিল তোকে ফিরে পাওয়ার জন্যে। যে মানুষটার ভালোবাসা এতটা নিখুঁত, সে এমন কাজ কী করে করতে পারে?”
অরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সব ওর অভিনয়!”
সীমা বুঝতে পারছে না কী বলে স্বান্তনা দেবে।
বন্ধুরা সত্যি-মিথ্যার বিচার না করেই একে অপরের মতামতে সায় দেয়। এটাকে প্রকৃত বন্ধুত্ব বলে কিনা কে জানে! তবে সীমা সবসময় নিজের মতামতটাই অরাকে জানায়। অরা কোথায় ভুল করলে তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে সেই ভুলটা ধরিয়ে দিতেও কার্পণ্য বোধ করে না সে।
অরা কোমল স্বরে বলল, “অরা, তোর ভেঙে পড়াটাই স্বাভাবিক। যা দেখেছিস, তা দেখার পর কোনো মেয়েই ঠিক থাকতে পারে না। তোকে তাই দোষও দিচ্ছি। তোর মস্তিষ্ক এখন স্বাভাবিক চিন্তাভাবনার পর্যায়ে নেই। কিন্তু যখন স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করতে পারবি, তখন প্লিজ একটা বারের জন্যে ভেবে দেখিস, যে আরশাদ ভাইয়াকে তুই চিনিস সে এমনটা করতে পারে কিনা।”
অরা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “কী বলতে চাইছিস তুই?”
“আমার মনে হচ্ছে ওই সুজানা মেয়েটা আরশাদ ভাইয়াকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।”
অরা বিভ্রান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই তাকিয়ে রইলো সীমার দিকে।
সীমা পরিষ্কার গলায় বলল, “তুই একবার নিজেই ভেবে দেখ, ঘটনা যদি সত্যিই হতো তাহলে একদিনের মাথায় সে আরশাদ ভাইয়ার বউকে সব সত্যি বলে দিলো কেন? চালিয়ে যেত সুপারস্টারের সাথে প্রেম। এতে তো ওর লাভটাই বেশি।”
অরা চুপ করে রইলো। তার চোখদুটো বেয়ে এখনো অঝোরে অশ্রু বয়ে যাচ্ছে। তবে তার চোখদুটো এই একই প্রশ্ন উঁকি দিয়ে বেড়াচ্ছে।
সীমা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “তার ওপরে আবার ইন্টারনেটে ছবি, কল রেকর্ডিং সব ছেড়ে দিয়েছে। এসব করে কী প্রমাণ করতে চাইছ ও?”
অরা শীতল গলায় বলল, “প্রমাণ করতে চাইছে যে আরশাদের জোরাজুরিতেই এই সম্পর্কটা শুরু হয়েছে।”
“হতে পারে। কে জানে! একটা কথা মনে রাখিস অরা।”
অরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো সীমার দিকে।
সীমা মলিন কণ্ঠে বলল, “এমন কিছু করিস না যার জন্যে তোকে আজীবন অপরাধবোধে ভুগতে হয়। ভুল তো আমিও এনায়েতকে বুঝেছিলাম। যদিও সে আমার ওপরে বিন্দুমাত্র রাগ করেনি। তবুও আজও আমার মাঝে অপরাধবোধের শেষ নেই।”
অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “তোর ধারণা আমি আরশাদকে ভুল বুঝছি?”
“কী বুঝছিস কে জানে? তবে ভাইয়াকে একটু বোঝার চেষ্টা কর।”
(চলবে)
#ফিরে_আসা২
৫৬ (বোনাস পর্ব)
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
“সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা আমাকে মানসিকভাবে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। আমি খুবই সাধারণ একটা মেয়ে। সাধারণ জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখেছিলাম। এই চাওয়াটুকু কি খুব বেশি কিছু? আমার জীবনে যা ঘটে গেছে তার পর সমাজে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ছবিগুলো আমি নিজেই পোস্ট করেছি, ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা খারাপ মানুষকে সকলের সামনে আনার জন্যে। আজ থেকে এই ইন্ডাস্ট্রি আমি ছেড়ে দিচ্ছি। যে কয়েকটা কাজ করেছি, তার মধ্য দিয়েই আপনাদের ভালোবাসায় থাকতে চাই। আশা করি দোয়ায় রাখবেন আমাকে।”
রাত দশটা চুয়ান্ন মিনিটে সুজানার ফেসবুক পেইজ থেকে করা সর্বশেষ পোস্ট। যে মেয়েটা গত রাতেও শুটিং শেষে হাস্যোজ্বল ভঙ্গিতে ইন্টারভিউতে বলেছিল, “অভিনয় নিয়ে বহুদূর এগিয়ে যেতে চাই” – আজ সে ক্যারিয়ারের ইতি টানছে। কিংবা টানতে বাধ্য হচ্ছে। মেয়েটার পক্ষেই মানুষের সমর্থন বেশি। যার কারণে সুজানার এত বড় ক্ষতি হলো, তার দিকেই তীক্ষ্ণ তীর নিক্ষেপ করতে ব্যস্ত নেট দুনিয়ার মানুষেরা।
কয়েক ঘন্টার ব্যবধানেই আরশাদের দুই লাখ ফলোয়ার কমে গেছে। গ্রুপে গ্রুপে তার সমালোচনা হচ্ছে। তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। ভার্চুয়াল কাঠগড়ায় ইতোমধ্যেই দাঁড়িয়ে গেছে আরশাদ হক। একপক্ষ তো তাকে আবার বয়কট করার ডাকও দিয়েছে। আরশাদের সিনেমা দেশের কোনো হলে চলতে দেবে না তারা।
আরশাদের অধঃপতন ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। ইন্ডাস্ট্রির সবথেকে বড় তারকা আজ সকলের চোখের বিষ। এমনকি ভক্তকূলও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আরশাদের দিক থেকে।
ঢাকা থেকে বেনাপোলগামী বাস চলছে রাতের আধারে। রাতের যাত্রা কোনোকালেই স্বস্তিদায়ক বলে মনে হয় না সুজানার কাছে। এ সময়টায় বড় বড় ট্রাকের আধিপত্য ঢাকার
রাজপথে। অন্ধকারে একটা ট্রাক এসে বাসকে ধাক্কা দিয়ে গেলেই তো সর্বনাশ!
তবুও মনের ভয়গুলোকে ধামাচাপা দিয়ে বাসে চড়ে বসেছে সুজানা। আর কোনো উপায়ও তো নেই তার কাছে। কোনো মতে বেনাপোলে পৌঁছাতে পারলেই সে নিশ্চিন্ত।
সুজানা ওড়না দিয়ে মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে বসে আছে পেছনের দিকে। শুটিংয়ে ব্যবহৃত মেকআপ দিয়ে নিজের চেহারাকে কয়েক স্তর কালচে করেছে। এক নজরে তাকে চেনার কোনো উপায় নেই।
কয়েক সারি সামনে চার বন্ধুর একটা দল বসে আছে। যাত্রার শুরু থেকেই অনবরত গল্পে মেতে আছে তারা। তাদের গল্পের বিষয়, আরশাদ হকের স্ক্যান্ডাল।
সেই দল থেকে একটা ছেলে জোর গলায় বলে উঠলো, “আরশাদ হকের চরিত্রে আসলেই সমস্যা আছে। শুধু শুধু কি আগের বিয়েটা ভাঙ্গছে?”
একটা মেয়ের থমথমে গলা শোনা গেল, “আগের বিয়েটা তো ভাঙলো নওশীনের কারণে!”
আরেকটা ছেলে বলে উঠলো, “আরে না! ওরই দোষ ছিল। নিজের দোষ চলা দেওয়ার জন্য নওশীনরে কলঙ্কিত করছে।”
আরেকটা মেয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,“ধুর! আমার বিশ্বাস হয় না। নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে।”
প্রথম ছেলেটা আবারও মজার ছলে বলে উঠলো, “তোমরা মেয়েমানুষরা মামা ডেঞ্জারাস। হ্যান্ডসাম ছেলে চরিত্রহীন হইলেও দোষ দেখো না।”
মনে মনে ক্ষীণ আনন্দিত না হয়ে পারলো না সুজানা। তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। তার উদ্দেশ্য ছিল আরশাদের সংসার ভাঙা। তার ক্যারিয়ার ধ্বংস করা। নিশ্চয়ই আরশাদের স্ত্রী ওই কথাগুলো শোনার পর ধ্বংসযজ্ঞ বাঁধিয়ে বসেছে। আর আরশাদের ক্যারিয়ার যে ভেঙে পড়েছে, এটা তো চোখের সম্মুখেই প্রমাণিত।
মনে মনে নিজেকে সামলে নিলো সুজানা। এতটা নিশ্চিন্ত হলে চলবে না। গন্তব্যে পৌঁছাবার আগ পর্যন্ত সজাগ থাকতে হবে। চারিদিকে কেবলই বিপদ।
পদ্মা সেতু পাড় করে বাসটা উঠে গেল যশোর মুখী দুই লেনের রাস্তায়। সুজানা তার ব্যাগ থেকে ছোট্ট বাটন ফোনটা বের করে কল করলো কাঙ্ক্ষিত নম্বরটায়। দুটো রিং বাজতেই অপরপ্রান্ত থেকে রিসিভ হলো কল।
সুজানা শুকনো ঢোক গিলে বলল,“আমি ঢাকা ক্রস করলাম।”
অপরপ্রান্তে থাকা মানুষটা বলল, “Very good. তোমার আগের সিম কই?”
“নষ্ট করে ফেলেছি।”
“মানে কী? তোমাকে না বললাম, আগের সিমসহ মোবাইল তোমার হোস্টেল রুমে রেখে আসতে? পুলিশ নম্বর ট্রাক করতে করতে ওখানে গিয়ে দেখতো মোবাইল ওখানেই। তার মানে তোমার স্ট্যাটাসই সত্যি। এখন তো ট্রাক করে পাবে না, সন্দেহটা বাড়বে।”
সুজানা ভীত গলায় বলল, “পুলিশ কি আসলেই সত্যিই আমাকে খুঁজতে আসবে?”
অপরপ্রান্তের মানুষটা চিন্তিত গলায় বলল, “আসবে তো অবশ্যই। আরশাদ হক কথায় কথায় থানা-পুলিশ ডাকে। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, আর সে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে।”
“আমার না খুব ভয় লাগছে।”
“আরে ভয়ের কিছু নেই তো। বেনাপোলে দুই-তিনদিন থাকবে, তারপরেই তো ওপারে।”
সুজানা ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, “কালকেই ইন্ডিয়ায় চলে যাই না!”
“আরে পাগল না-কি তুমি? পুলিশ এখন এয়ারপোর্ট আর বর্ডারে নজর রাখবে। তোমার খোঁজ করবে সবদিকে। দুয়েকদিন পর পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে চলে যাবে। আর পাসপোর্টেও তো তোমার নাম সুজানা না। ধরা পড়ে যাওয়ার কোনো সুযোগই নেই।”
“তবুও, যদি ধরা পড়ে যাই?”
অপরপ্রান্তে থাকা মানুষটা এবার রাগে ধৈর্যহারা হয়ে ধমক দিয়ে বলল, “কু ডাক ডাকবে না তো! ফোন রাখো!”
মোবাইলটা ব্যাগের মধ্যে ভরে জানালা ঘেঁষে বসে রইলো সুজানা। বাকিটা পথ ভালোয় ভালোয় পাড় করতে পারলেই হলো। যদিও তার ধরা পড়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। তবুও আরশাদ হককে বিশ্বাস নেই। সজাগ থাকাটাই ভালো।
পথ চলতে চলতে কখন সে সুজানার চোখদুটো লেগে এলো সে নিজেও জানে না। খোলা জানালা দিয়ে মিষ্টি বাতাস বয়ে আসছে। বাতাসটাকে ঘুমের জন্যে অতিরিক্ত সহায়ক বলে মনে হচ্ছে।
সুজানার কাঁচা ঘুম ভাঙলো বাসের মানুষের সোরগোলে। চোখ মেলে সোজা হয়ে বসতেই আত্মা কেঁপে উঠলো তার। লোকের কথায় যা বুঝলো, তা হলো কোনো একটা বাসের পথ আটকে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি থেকে কেউ নেমেও আসছে না, আবারও বাসকে রাস্তা ছেড়েও দিচ্ছে না।
সুজানার হৃদস্পন্দন ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। পুলিশ কি খোঁজ পেয়ে গেছে তার? কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? সুজানার সাথে তো ফোন নেই যে তাকে ট্রাক করে এতদূর এগিয়ে আসবে।
অভিনেত্রী হওয়ার সুবাদে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ বেশ ভালোই রপ্ত আছে সুজানার। তার সমানের সারিতে বসে থাকা এক লোককে আঞ্চলিক টানে বলল, “ভাইজান? বাস আটকায় রাখছে কে? পুলিশ?”
লোকটা বিরক্ত গলায় বলল, “না, না! পেরাইভট কার।”
সুজানার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। পুলিশের গাড়ি হলে চিন্তার কিছু ছিল না। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো, কোর্টে চালান করে দেওয়া হতো। কয়েক মাসের জেল, তার পর জামিনে মুক্তি!
কিন্তু না। সে মুক্তির পথ খুঁজে নেবে বলেই পুলিশের ওপর ভরসা রাখতে পারেনি আরশাদ। নিজেই স্বয়ং এসে গেছে? ভয়ে বরফের ন্যায় জমে রইলো সুজানা। বারবার নিজেকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করছে, সে যা ভাবছে তা ভুলও হতে পারে। হয়তো ডাকাত-টাকাত হবে। আরশাদ কী করে খোঁজ পাবে তার?
সাদা প্রাইভেট কার থেকে নেমে এলো দুটো বিশালদেহী লোক। তাদের অবয়ব দেখেই ভয়ে মোটামুটি তথস্ট হয়ে গেল সুজানাসহ বাসের অন্যান্য যাত্রীরা। বাসের যাত্রীদের ভয়ের কারণ তাদের বিশাল দেহ আর সুজানার ভয়ের কারণ তাদের পরিচয়। এরা আরশাদের বন্দুকধারী বডিগার্ড ঝড় এবং তুফান।
তাদেরকে বাসের দিকে এগিয়ে আসতে দেখেই বাসের হেল্পার কিছুটা সাহস করে বলে উঠলো, “আরে ভাই! কী চান আপনেরা?”
তুফান শীতল কণ্ঠে বলল, “আওয়াজ নিচে মিয়া! এই জিনিস দেখছো?”
ঝড় আর তুফানের কাঁধে ঝুলছে দেশের সবথেকে বড় সুপারস্টারের আত্মরক্ষার জন্যে লাইসেন্স করা দুটো বন্দুক। বন্দুকদুটো দেখেই রীতিমত দমে গেল হেল্পার। তার মুখ দিয়ে যেন কথাই বের হচ্ছে না।
তুফান দৃপ্ত পায়ে হেঁটে উঠে গেল বাসের ওপরে। ঝড় সিঁড়ির ওপরে দৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো।
বাসের ড্রাইভার ভীত কণ্ঠে বলল, “ভাই? কোনো সমস্যা?”
তুফান শান্ত কণ্ঠে বলল, “লাইনগুলা জ্বালান।”
মুহূর্তেই জ্বেলে গেল বাসের সব লাইটগুলো। সুজানা আগে থেকেই ওড়না দিয়ে মুখটা ঢেকে ফেলেছে। চোখদুটো ঢাকার জন্যে ব্যবহার করেছে চক্ষু রোগীদের কালো চশমা। তার মুখ যে ইতোমধ্যে পাংশুবর্ণ ধারণ করছে, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তুফান শান্ত গলায় বাসের যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলল, “আসসালামুয়ালাইকুম ভাই ও বোনেরা। আপনাদের যাত্রা পথে বিঘ্ন ঘটানোর জন্য দুঃখিত। বেশি সময় নষ্ট করবো না। আপনাদের মাঝে এক বদ মেয়ে মানুষ লুকায় বসে আছে। তাকে ধরে নিয়েই চলে যাবো।”
ওই বন্ধুদের দল থেকে একটা ছেলে বিস্মিত গলায় বলল, “কী বলেন ভাই?”
সামনের দিকের সারি থেকে এক প্রতিবাদী বৃদ্ধ কঠিন গলায় বলে উঠলেন, “কী আশ্চর্য! চলন্ত বাস থেকে একটা মেয়েকে তুলে নিয়ে যাবেন? মগের মুল্লুক না-কি?”
তুফান বাঁকা হাসি হেসে বলল, “চাচামিয়া, বললাম তো কোনো ভদ্র মেয়েকে তুলে নিয়ে যাবো না। নিয়ে যাবো এক বদ মেয়েকে। যে মেয়ে সমাজের ক্যান্সার। সে সমাজ থেকে পালায় যাওয়ার চেষ্টা করতেছে। তাকে সমাজে ফিরায় নিয়ে শাস্তি দিতে হবে তো।”
পকেট থেকে সুজানার একটা ছবি বের করে সকলকে দেখালো তুফান। আজকের ঘটনার পর সুজানাকে চিনতে বাকি নেই দেশের কারোর। তাই এক দেখায় অবাক মনে গেল বাসের যাত্রীরা।
তুফান বলল, “এই মেয়েকে কেউ দেখছেন বাসে?”
কয়েকজন একসঙ্গে বলে উঠলো, “না।”
তুফান শীতল গলায় বলল, “আমার প্রিয় বোনেরা। আপনাদের একটু কষ্ট দিবো। আপনাদের সবাইকে এখন চেক করা হবে।”
লালচে নেকাবের আড়াল থেকে এক নারী বলে উঠলো, “মানে কী? পর্দাশীল মহিলাদের এখন আপনাকে চেহারা দেখাতে হবে?”
“আপনার পর্দা আমরা সম্মান করি আপু। অন্য একজন আপু না হয় আপনাদের চেক করবে। তাতে তো আর সমস্যা নাই?”
বন্ধুদের দলের মধ্যে যে মেয়েটা আরশাদের পক্ষ নিচ্ছিল, সে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে আগ্রহ নিয়ে বলল, “আমি চেক করি ভাই?”
“করেন।”
ঝড় সিঁড়ির কাছ থেকে উঁচু স্বরে বলল, “সব পুরুষ মানুষ বাসের বাইরে!”
পুরুষ যাত্রীরা এক এক করে বাস থেকে নামছে। ঝড় জুহুরি নজরে প্রত্যেকের চেহারা একবার দেখে নিলো। বলা তো যায় না, সুজানা ছেলের ছদ্মবেশ ধরে বাসে বসে আছে।
মেয়েটা সকলের চেহারা পর্যবেক্ষণ করছে। তুফান বাস থেকে নামেনি, অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। সুজানা মনে মনে প্রার্থনা করছে যেন মেয়েটা তাকে চিনতে না পারে। মেকআপের ওপরে তার অগাধ আস্থা আছে। তবে সব আস্থাই যেন ধুলোয় মিশে যাচ্ছে এই মুহূর্তে।
মেয়েটা সবার চেহারা পর্যবেক্ষণ করে একটু
একটু করে এগিয়ে আসছে সুজানার দিকে। সুজানার হৃদয়টা সর্বোচ্চ গতিতে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে।
মেয়েটা শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আপু ওড়নাটা সরান।”
সুজানা আঞ্চলিক টান অক্ষত রেখে বলল, “আমি সরামু না।”
“সরান না আপু। আপনি ওড়না সরালেই তো ঝামেলা শেষ হয়ে যায়।”
“না, না। উনি ওইখানে দাঁড়ায় আছে।”
“উনি তো ওদিক ফিরে আছেন।”
সুজানা বেশ বুঝতে পারছে এই মেয়ে ঝামেলা বাড়াবে। বাধ্য হয়ে মুখের থেকে অল্প করে ওড়নাটা সরালো। যদিও চোখের ওপর কালো চশমাটা রেখে দিয়েছে।
মেয়েটা বলল, “সানগ্লাসটা সরান!”
“সরান যাইবে না, আমার চোখ উঠছে।”
“না সরালে বোঝা যাচ্ছে না তো!”
সুজানা এবার ধৈর্যহারা হয়ে বলল, “বিরক্ত করেন ক্যান? আমি কুনো নায়িকা-ফায়িকা না!”
তুফান ধীর-স্থির ভাবে ঘুরে দাঁড়ালো। আঁতকে উঠে ওড়নার আঁড়ালে মুখটা লুকিয়ে ফেলল সুজানা।
তুফান এগিয়ে এসে শীতল কণ্ঠে বলল, “চোখ উঠছে, তাও এত দূর থেকে দেখে ফেললেন নায়িকার ছবি?”
সুজানা প্রতিবাদের সুরে কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই তুফান এক টানে তার মুখের ওপর থেকে ওড়নাটা সরিয়ে ফেলল।
কালচে মেকআপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কলঙ্কিত নায়িকাকে চিনতে অসুবিধা হলো না কারও। সুজানার মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন ভূত দেখলো মাত্র।
তুফান বিজয়ীর হাসি হেসে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলল, “পাইছি ঝড়!”
সুজানাকে টেনে-হিঁচড়ে বাসের বাইরে নিয়ে এলো তুফান। সুজানা আর্তনাদ করছে, যাত্রীদের কাছে বাঁচানোর আকুতি জানাচ্ছে। বন্দুকের ভয়ে কেউই এগিয়ে এলো না। সুজানাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হলো সাদা প্রাইভেট কারের ভেতরে।
অনবরত চিৎকার করেই যাচ্ছে সুজানা। সে জানে, বাঁচার আর কোনো উপায়ই নেই তার কাছে। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে একটা কথা ছিল, সে ধরা পড়েছে আরশাদের হকের হাতে।আরশাদ তাকে শেষ করে দেবে, এতটুকু বুঝতে তার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছে না। তবুও শেষ চেষ্টা হিসেবে অনবরত চিৎকার করেই যাচ্ছ। রাস্তায় চলতে থাকা গাড়িগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। চিৎকারে রীতিমত বিরক্ত হয়েই ক্লোরোফর্মমাখা রুমাল তার মুখে চেপে ধরলো ঝড়।
সুজানার সজাগ থাকা আর হলো না। একটু একটু করে চেতনা হারাচ্ছে সে।
(চলবে)