ফিরে আসা পর্ব-২১+২২

0
722

#ফিরে_আসা
২১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

দুদিন হয়ে গেল কথা পাড়ি দিয়েছে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে। এই দুদিন ধরে আরশাদের মনের অবস্থা কেমন কে জানে? নির্ঘাত তার মনের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলে যাচ্ছে প্রবল কালবৈশাখীর ঝড়। অবশ্য তা নাও হতে পারে। এই ছয়টা মাস যে সে একেবারেই মেয়েকে দেখে থাকবে তা নয়। আরশাদ কানাডার ভিসার জন্য আবেদন করেছে। সময় সুযোগ পেলে সে ছুটে যাবে মেয়ের কাছে। নওশীনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ঠিক করা হয়েছে কথা বাংলাদেশে থাকতে যেমন বাবার কাছে এসে থাকতো, এখনও তাই করবে। অরা গিয়ে নিয়ে আসবে তাকে। চিন্তার বিষয় এখন একটাই, এতটা পথ একা একা কী করে যাবে অরা? এর আগে অনেকবার বিদেশে যাওয়া হয়েছে তার। প্রতিবারই আরশাদের শুটিংয়ের কাজে। একা একা যাওয়া হয়নি। এবার কী করে যাবে কে জানে?

আপাতত সেসব নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। অরার আজ ব্যস্ততার শেষ নেই। আজ আরশাদের নতুন সিনেমা ‘কানামাছি’র শুটিং। কথা চলে যাওয়ার পর অশান্ত মনটাকে ব্যস্ত রাখতেই হয়তো আরশাদ হন্তদন্ত হয়ে শুটিংয়ে ফিরেছে। কোনো সিনেমার শুটিংয়ের প্রথম দিনটা সবসময়ই ভয়ে ভয়ে কাটে অরার। আরশাদকে তার বিন্দুমাত্র ভরসা নেই। দেখা গেল যেকোনো মুহূর্তে সে রেগেমেগে সেট থেকে বেরিয়ে গেল। এর আগের সিনেমার শুটিংয়ের প্রথম দিন তার রাগের ঝাঁঝে নায়িকাই বদলে গেল। অবশ্য নায়িকা বদলে যাওয়ার যথাযথ কারণও ছিল।

আজ সেটের অবস্থা অতটা উত্তপ্ত নয়। আরশাদ যথারীতি চুপচাপ নিজের গ্রীন রুমে বসে থাকলেও, শট দিতে আসার সময় স্বাভাবিক থেকেছে। তার থেকেও বড় কথা এই সিনেমার নায়িকার চরিত্রে কোনো দোষ নেই।

নতুন এই সিনেমাটা থ্রিলার ধাঁচের। যদিও ভক্তরা রোমান্টিক চরিত্রে আরশাদকে দেখে অভ্যস্ত, কিন্তু থ্রিলার গল্পেই তাকে সবথেকে বেশি মানায়। এই সিনেমার গল্পটাও দারুন। গল্পে আরশাদ তার কয়েকজন কাছের বন্ধুদের নিয়ে সিলেটে বেড়াতে যায়। রাতের বেলা সবাই মিলে যখন আড্ডা দিচ্ছিল, তখনই আরশাদের সঙ্গে তার এক বন্ধুর বেঁধে যায় তুমুল ঝগড়া। ঝগড়ার প্রবলতা এতটাই বেশি ছিল যে শেষমেশ তা ধাক্কাধাক্কিতে গিয়ে গড়ায়।

ওই রাতে তাদের ঝগড়া থেমে গেলেও, পরদিন সকালে ঘটে যায় এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। সকল বন্ধুরা হতবিহ্বল হয়ে খুঁজে পায় আরশাদের সঙ্গে যার ঝগড়া হয়েছিল তার রক্তাক্ত লাশ। সিনেমার স্ক্রিপ্টটা এমন, আরশাদের চরিত্রকে কখনো মনে হবে ভালো আবার কখনো খারাপ। এ ধরনের চরিত্রে আরশাদ ছাড়া কাউকে মানাবে বলে মনে হয় না।

আজ তাদের শুটিং গাজীপুরের এক রিসোর্ট। সিনেমায় নায়ক-নায়িকাদের বাড়ি বলতে আমরা যা দেখি, তা মূলত সুন্দর সুন্দর এসব রিসোর্ট। রিসোর্ট আর ঢাকার খানিক শুটিংপর্ব শেষে, শুটিংয়ের মূলপর্ব শুরু হবে সিলেটে। সিলেটে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তেমন একটা চাপ নেই। এই যেমন আজকে, ধারণ করা হয়েছে মাত্র তিনটি দৃশ্য। অন্যান্য সময় একদিন ধারণ করা হয় পাঁচ থেকে সাতটি দৃশ্য।

এই রিসোর্টের ছাদটা অনিন্দ্য সুন্দর। ছাদের একপাশ জুড়ে দেশি-বিদেশি নানা ফুলের গাছ। প্রায় সবগুলো গাছেই ফুটে আছে রং-বেরংয়ের ফুল। এতসব ফুল একসঙ্গে দেখে মনটাই ভালো হয়ে যায়। ফুল গাছগুলোর পাশে প্রকান্ড এক দোলনা। আজ পূর্ণিমা। অরা ঠিক করে রেখেছিল আজ শুটিং শেষে ছাদে গিয়ে দোলনায় বসে চাঁদ দেখবে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ছাদে প্রবেশ করলো অরা। অন্যমনস্ক থাকার কারণে খেয়াল করেনি রেলিংয়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে। আরশাদ সিগারেট ধরিয়ে রেলিংয়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে খেয়াল করার সঙ্গে সঙ্গে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো অরার। একা একা নিজের মতো সময় কাটাচ্ছিল আরশাদ। এমন সময়ে তাকে বিরক্ত করার কোনো মানে হয় না। কিন্তু অরা তো আর ইচ্ছা করে বিরক্ত করেনি। ছাদে আসার পরিকল্পনা তারই আগে ছিল। অরা ভয়ে আছে এক্ষুনি প্রচন্ড এক ধমক খাবে আরশাদের। যদিও আরশাদ চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে না সে রেগে গেছে।

অরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “I’m sorry sir.”

আরশাদ স্বাভাবিক গলায় বলল, “সমস্যা নেই অরা, ভালোই হয়েছে এসেছ। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।”

আরশাদের ভাবসাব মোটেই ভালো ঠেকছে না। তাকে বিরক্ত করার মতো গুরুতর অপরাধ করা সত্ত্বেও অরাকে কোনপ্রকার ধমক দিলো না আরশাদ? ব্যাপারটা কী?

অরা আরশাদের কাছে গিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “কী কথা স্যার?”

আরশাদ সিগারেটে টান দিয়ে বলল, “তুমি না-কি নতুন জবের জন্য ট্রাই করছো?”

অরা আঁতকে উঠে বলল, “না স্যার, কখনোই না। কে বলেছে আপনাকে এমন কথা?”

“মেহেদী। ও বলল, তুমি না-কি বেটার স্যালারির জন্য অন্য জব খুঁজছো?”

“স্যার মেহেদী এক নম্বরের একটা ফাজিল, ওর কোনো কথা বিশ্বাস করবেন না। সেই কবে থেকে একটা হেডফোন চাচ্ছে, আমি এখনো দিইনি বলে ভেবেছে স্যালারি কম পড়ে যাচ্ছে। আসলে সেরকম কিছুই না স্যার। সময় করে উঠতে পারছি না বলে ওর হেডফোন কেনা হয়নি।”

“আমিও এরকমটাই ধারণা করেছিলাম। মেহেদী সারাক্ষণ তোমার নামে এ ধরনের উল্টাপাল্টা কথা বলতেই থাকে।”

অরা ব্যস্ত-উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “কী সর্বনাশ! I’m so sorry sir, আমি জানতামই না ও এভাবে আপনাকে বিরক্ত করে।”

আরশাদ শান্ত গলায় বলল, “আমার তো ভালোই লাগে। তোমাদের দুজনের এই বন্ড অনেক স্পেশাল।”

অরা হাসিমুখে বলল, “ওকে দেখলেই আমার ভাইদের কথা মনে পড়ে।”

“তোমার ভাই আছে?”

“সৎ ভাই।”

“ওহ!”

“ওই ছোট ছোট তিনজনকে আমিই সমলাতাম। ছোটবেলা নিয়ে আমার কোনো সুখকর স্মৃতি নেই, কিন্তু যতটুকু আছে সবটাই ওদের ঘিরে। বাবা আর সৎ মা যদিও আমাকে ভালোবাসতো না, কিন্তু ওরা বাসতো খুব।”

“তোমার কষ্টটা আমি বুঝি। It’s not easy to live with childhood trauma.”

অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “চাইল্ডহুড ট্রমা এখন আর আমার নেই স্যার। একটা সময়ে ছিল, কিন্তু এখন কাজে এতটাই ব্যস্ত হয়ে গেছি যে ওসব কথা আর মনে পড়ে না।”

অনেকটা সময় চুপ করে থেকে আরশাদ বলল, “আমার ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছিল। একটা সময় আমার ছোটবেলাটা খুব ভাবাতো আমাকে। মনে হতো আমার কারণেই বাবা আমাদের ফেলে চলে গেছে। ইন ফ্যাক্ট, বাবা চলে যাওয়ার কয়েক বছর পরও এই চিন্তা আমার মধ্যে স্থির হয়েছিল।”

“নিজেকে সামলালেন কী করে স্যার?”

“কাজের মধ্যে ডুব দিয়ে। আমার জীবনের প্রথম সিনেমাটা পাওয়ার জন্য কম কষ্ট করতে হয়নি আমাকে। একটার পর একটা অডিশন দিতাম, ডিরেক্টরদের সঙ্গে দেখা করতাম। এতসব কাজের ভীড়ে ওই স্মৃতিগুলো মন থেকে একেবারেই মুছে গেছে।”

মন খুলে কথা বলার চেষ্টা করলেও শেষমেশ দুজনেই একটা সত্য গোপন করে গেল একে অপরের কাছ থেকে। ছোটবেলার ওই বিস্মৃতিগুলো এখনো একেবারে অদৃশ্য হয়ে যায়নি তাদের মন থেকে। অরা মাঝেমধ্যেই দুঃস্বপ্নে দেখে, তার নতুন মা হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই দিয়ে অনবরত মেরে যাচ্ছে তাকে। সে হাত-পা ছুঁড়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।

আরশাদের ক্ষেত্রেও তাই। সারাজীবন বাবার চলে যাওয়ার জন্যে যেমন নিজেকে দুষেছে, তেমনই আজ ছোট-বড় যেকোনো সমস্যায় নিজেকে দোষী মনে করে সে। এজন্যেই হয়তো ডিভোর্সের সেই ভয়ানক স্মৃতিগুলো মনে পড়লে সব দোষ নিজের ঘাড়েই এনে ফেলে আরশাদ।

শৈশবে মানুষের মন নরম কাদামাটির মতো থাকে। তাকে যে আকৃতি দেওয়া হোক না কেন, সে সারাজীবনের জন্যে সেই আকৃতি ধারণ করে। শৈশবে সেই নরম মন যদি কোনপ্রকার আঘাত পায়, তবে তাকে সারাজীবনের জন্যে এই আঘাত বয়ে বেড়াতে হয়।

কানাডার ঘড়িটা বাংলাদেশের থেকে দশ ঘন্টা পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশে এখন রাত এগারোটার কাছাকাছি, আর ওখানে বেলা একটা। হালকা বেগুনি রঙের জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল নওশীন। এই বাড়িটা তার বাবার করা। নওশীনের অভিনয়জীবন নিয়ে তার আপত্তির শেষ ছিল না। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে কেউ মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করলেই তিনি অস্বস্তিতে পড়ে যেতেন। মনে হতো যেন, এখনই মেয়ের কারণে তাকে হেও-প্রতিপন্ন হতে হবে।

নওশীনের প্রতি একপ্রকার রাগ নিয়েই তিনি মেয়ের থেকে দূরে সরে যান। চলে আসেন কানাডায়। যদিও শেষমেশ বাবা-মেয়ের মধ্যকার শীতলতা উবে যায়। বাবার জীবনের শেষ দিনগুলো নওশীন তার পাশেই ছিল। বাবার চলে যাওয়ায় পর নওশীনের মা এই বাড়িটা নিয়েই একাই থাকেন। নওশীন যদিও অনেকবার বলেছে দেশে গিয়ে তার কাছে থাকাতে, তিনি শোনেনি।

এতদিন পর নওশীন কানাডায় এসেছে মূলত মায়ের সেবা করতে। বহুদিন হলো তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। একটা বয়সের পর নিজের শরীর নিজের কাছেই কেমন অচেনা হয়ে ওঠে। সামান্য সর্দি-কাশি হলেও সেরে উঠতে অনেক সময় লাগে। সেখানে তার মায়ের একটার পর একটা অসুস্থতা লেগেই রয়েছে।

মাকে দেখতে আসার পাশাপাশি তার আগমনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য রয়েছে। নওশীন বহুকাল পর দেখা করতে এসেছে একজনের সঙ্গে। যে মানুষটা তার জীবনে না এলে হয়তো আজ অন্য এক মোড়ে থাকতো তার জীবন। যে মানুষটার কারণেই তার জীবনে এসেছে ভয়ঙ্কর প্রলয়। কবির।

কবির কানাডায় স্থায়ী হয়েছে দু বছর হলো। নওশীনের ধারণা, একপ্রকার পালিয়ে এসেছে সে। কবিরের সঙ্গে তার হিসাব-নিকাশ বাকি আছে এখনো। সেই অপূর্ণ হিসাব পূরণ করার ভয়েই হয়তো পালিয়ে এসেছে সে। নওশীনও এর মাঝে আর যোগাযোগ করেনি তার সঙ্গে। যে মানুষটা তার এত বড় ক্ষতি করে দিলো, তার সঙ্গে আবার যোগাযোগ কীসের?

কফি শপে প্রবেশ করতেই নওশীন দেখা পেল কাঙ্ক্ষিত মানুষটার। কবিরকে এক পলক দেখেই বিষিয়ে গেল তার মনটা। মনে পড়ে গেল তার সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তের কথা।

নওশীন টেবিলের কাছে এগিয়ে যেতেই কবির উঠে দাঁড়িয়ে আহ্লাদী গলায় বলল, “নওশীন হক! কতদিন পর তোমাকে দেখার সৌভাগ্য হলো।”

নওশীন কোনো জবাব দিলো না তার কথার। চুপচাপ গিয়ে বসলো কবিরের মুখোমুখি থাকা চেয়ারটায়।

কবির বসতে বসতে কৌতূহলী গলায় বলল, “আচ্ছা? ডিভোর্সের পরেও নামের সাথে হকটা রেখে দিয়েছ কেন?”

নওশীন কঠিন গলায় বলল, “That’s none of your business.”

নওশীন মোটেও হাসির কোনো কথা বলেনি। তবুও সশব্দে হেসে উঠলো কবির। হাসি প্রখরতা এতটাই বেশি যে আশেপাশের টেবিল থেকে সকলে ঘাড় ঘুরিয়ে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

নওশীন ভ্রু কুঁচকে বলল, “হাসছো কেন?”

“তুমি আসলেও তুখর অভিনেত্রী। তোমার মতো ভালো অভিনেত্রী বাংলাদেশে দ্বিতীয়টা আছে কিনা সন্দেহ।”

“মানে কী?”

“তোমার ইন্টারভিউ দেখি আমি। সবসময় শাড়ি পড়বে, চুলগুলো পরিপাটি করে রাখবে, ঠোঁটে সর্বক্ষণ একটা হাসি লেগে থাকবে – যাকে বলে আদর্শ ভদ্র মেয়ে। অথচ ভদ্রতার আড়ালে যে কী ভয়ঙ্কর একটা মানুষ পুষে রেখেছ তুমি, সেটা যদি কেউ জানতো!”

নওশীন বিরক্ত গলায় বলল, “কবির দেখো, তোমার ফালতু কথা শোনার মতো সময় বা ইচ্ছা কোনোটাই আমার নেই। আমি একটা জরুরি কথা বলতে এসেছি।”

“তাই তো দেখছি। আমার প্রতি তোমার টান এখনো কমলো না। সেই টানেই তো বাংলাদেশ থেকে কানাডায় চলে এলে!”

নওশীন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোমার সাথে আমার যা ছিল তা শুধুই একটা ভুল।”

কবির শীতল গলায় বলল, “ভুল? তাই না-কি? কিন্তু ভুলটা করার সময় তো একবারের জন্য মনে হয়নি ভুল করছো।”

“চুপ করো কবির।”

“তুমি ঠিক আগের মতোই আছ নওশীন। সেই একই তেজ, একই চোখ, একই ঠোঁট।”

“তুমি কিন্তু এবার লিমিট ক্রস করছো কবির।”

কবির অদ্ভুত হাসি হেসে বলল, “লিমিট তো সেই কবেই ক্রস করেছি। ভুলে গেছ?”

নওশীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “দেখো আমি আবারও বলছি, তোমার সাথে আমার যা ছিল তা কেবলই ভুল। মানুষ ইচ্ছা করে ভুল করে না, আমিও করিনি।”

“আচ্ছা, মানলাম। কই? তোমার জরুরি কথাটা বলো শুনি।”

নওশীন পরিষ্কার গলায় বলল, “আমি আমার শাদকে ফিরে পেতে চাই, যেকোনো মূল্যে হোক। যেহেতু তুমি আমার সংসারটা ভেঙেছো, তাই জোড়া লাগাতে আমার তোমার হেল্প চাই।”

কবির কৃত্রিম হাসি হেসে কঠিন স্বরে বলল, “আমি তোমার সংসার ভাঙ্গিনি সুইটহার্ট! তুমি নিজেই নিজের সংসার ভেঙেছো।”

নওশীন তেজী গলায় বলল, “আচ্ছা? যে কথাটা শাদ কোনোদিনও জানতে পারতো না, সেটা তো তোমার কারণেই জেনেছিল।”

“আমার কাছে যা ঠিক মনে হয়েছিল আমি তাই করেছি। আফটার অল, আমিও আরশাদ হকের অনেক বড় ফ্যান। আমার চোখের সামনে, আমার সুপারস্টারকে কেউ ঠকাবে আর আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবো তা তো হয় না।”

নওশীন তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “সবই তোমার বাজে কথা। তুমি চেয়েছিলে আমি যেন আমার সংসার ছেড়ে তোমার কাছে চলে যাই, তোমাকে বিয়ে করি। যখন দেখলে আমি কিছুতেই তোমাকে বিয়ে করবো না, তখনই সব বলে দিলে শাদকে।”

“তোমার যা ইচ্ছা তাই ভাবতে পারো, আমার কিছুই যায় আসে না।”

“আমারও যায় আসে না। কাজের কথায় আসি। আমাকে ছোট্ট একটা হেল্প করে দাও, জীবনে কোনদিন আর তোমাকে বিরক্ত করবো না।”

“কী হেল্প?”

“তুমি আমার সাথে বাংলাদেশে ফিরে যাবে। শাদকে গিয়ে বলবে যখন আমি তোমার সাথে ইনভলভড ছিলাম, তখন আমি স্বাভাবিক ছিলাম না। I was on drugs. আর আমাকে ড্রাগ নিতে বাধ্য করেছিলে তুমি।”

কিছুটা সময় চুপ করে থেকে কবির অবাক গলায় বলল, “আর কত একটা মানুষের ভালো মানুষীর সুযোগ নেবে নওশীন? তোমার ধারণা আমি গিয়ে আরশাদের কাছে সত্যের মতো করে কতগুলো মিথ্যা কথা বলে দিলেই ও মন গলতে শুরু করবে। হয়তো করবেও।”

চুপ করে রইল নওশীন। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা সে নিজেও বুঝতে পারছে না। কঠিন সত্যির মুখোমুখি হওয়ার সাহস নেই বলেই হয়তো সবসময় মিথ্যাকে আপন করে নিয়েছে সে।

“খালার কাছে শুনেছি তুমিই না-কি আগ বাড়িয়ে ডিভোর্সের কথা বলেছো? তাহলে এখন আবার এক হতে চাইছো কেন?”

নওশীন বলল, “ওই সময়ে আমার মাথা কাজ করছিল না। ভেবেছিলাম শাদকে আমার একটু স্পেস দেওয়া দরকার। কিন্তু আমার মন থেকে ওর নাম কখনোই মুছে যায়। আমি আজও ওকে প্রথম দিনের মতো ভালোবাসি।”

“ভালোবাসার মানুষকে স্পেস দিতে হলে ডিভোর্স নিতে হয় না-কি? আমার ধারণা তুমি কোনোদিন তাকে ভালোই বাসনি। আরশাদ তোমার সিঁড়ি। যে সিঁড়ি ব্যবহার করে তুমি ক্যারিয়ারে উপরে উঠতে চাও। তাই না?”

“তুমি কি আমাকে হেল্পটা করবে?”

কবির নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “আমার বাচ্চা নষ্ট করে আবার আমারই হেল্প পাবার আশা কী করে করো তুমি?”

“আমি তোমাকে এর আগেও বলেছি, বাচ্চাটা আমি নষ্ট করিনি। আমার মিসক্যারেজ হয়েছিল।”

“তোমার একটা কথাও আমি বিশ্বাস করি না, নওশীন হক। সারাজীবন তুমি কেবল নিজের স্বার্থের কথা ভেবে গেছ। অন্য কাউকে খুঁজে নাও যে তোমাকে হেল্প করতে পারবে। যদিও
আরশাদকে তুমি এ জীবনে ফিরে পাবে না।”

(চলবে)

#ফিরে_আসা
২২
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

আজকের দিনটা ভয়ানক বিশেষ। আজ সারা দেশব্যাপী মুক্তি পেয়েছে আরশাদের সিনেমা ‘শেষ বিকেল’। আমাদের দেশে সাধারণত দুই ঈদকে কেন্দ্র করে মুক্তি পায় যতশত সিনেমা। তবে আরশাদের ক্ষেত্রে ভিন্ন কথা। তার সিনেমা কোনো উপলক্ষে মুক্তি পায় না। আরশাদ হকের সিনেমা মুক্তি পাওয়াটাই তো তার ভক্তদের জন্যে একটা উপলক্ষ।

সিনেমা মুক্তির দিন সাধারণত সিনেমা সংলিষ্ট সকলের মন উৎফুল্লে পরিপূর্ণ থাকে। আর যদি সেই সিনেমায় থাকে আরশাদ তাহলে সবথেকে প্রচ্ছন্ন হাসিটা প্রযোজকই হাসে। সিনেমা সবে আজ মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু আগামী চার দিনের সব টিকিট বুকড। পঞ্চম দিনের টিকিটও প্রায় শেষের পর্যায়ে। একেই বলে আরশাদ হকের ভক্তদের উন্মাদনা।

দিনটা নিতান্তই আনন্দের। তবে আনন্দের লেশমাত্র নেই অরার মাঝে। কপাল খারাপ হলে যা হয়! সময়টা তার পার হচ্ছে দুশ্চিন্তার মাঝে। দুশ্চিন্তাটা অবশ্যই আরশাদকে ঘিরে।
সাড়ে সাতটা বাজতে আর মাত্র দশ মিনিট বাকি। সাড়ে সাতটায় শুরু হতে যাচ্ছে সিনেমার প্রিমিয়ার শো। প্রিমিয়ার শো নামি-দামী বহু তারকাকেই নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সকলেই অধীর আগ্রহে দেখতে এসেছে আরশাদের নতুন সিনেমা।

প্রিমিয়ার শো আয়োজন করা হয়েছে ঢাকার একটি মাল্টিপ্লেক্সে। এই উপলক্ষে শোয়ের পুরোটা সময়ে মাল্টিপ্লেক্সে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ করা হয়েছে। আরশাদ আসবে উপলক্ষে কর্তৃপক্ষ এখানকার নিরাপত্তা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ যার জন্যে এত আয়োজন, এত উদ্দীপনা – সেই আরশাদেরই কোনো দেখা নেই।

সীমা ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, “এই অরা? আরশাদ এখনো আসছে না কেন?”

অরা কয়েক মুহূর্ত বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সীমার দিকে। একে তো আরশাদের নিত্য-নতুন পাগলামি, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই মেয়ের পাগলামি। সীমা একপ্রকার জোরাজুরি করে আজ প্রিমিয়ার শোতে এসেছে অরার সঙ্গে। আরশাদকে সামনাসামনি দেখার শখ না-কি আজ পূরণ করেই ছাড়বে। সীমার আসা নিয়ে অরার তেমন কোনো ভয় নেই। ডিরেক্টর আগেই বলে দিয়েছেন, আরশাদের টিম থেকে যে কয়জন খুশি যে কয়জন আসতে পারে।

অরার যত ভয় সব আরশাদকে নিয়ে। এতগুলো মানুষকে খবর দেওয়া হয়ে গেছে। সবাই জানে আজকের প্রিমিয়ার শোতে আরশাদ উপস্থিত থাকবে এবং সকলের সঙ্গে পুরো সিনেমাটা দেখবে। আর সেখানে
আরশাদই যদি না আসে তবে তো কেলেঙ্কারি কান্ড ঘটে যাবে।

স্বাভাবিক সময় হলে অরা ফোন করে আরশাদকে আসার জন্যে অনুরোধ করতে পারতো। তবে এই সময়টা স্বাভাবিক নয়। আরশাদের মেজাজ আজ তুঙ্গস্পর্শী। তুঙ্গস্পর্শীর ওপরে যদি কিছু থাকে, তাহলে তার মেজাজটা আজ তাই।

সিনেমা মুক্তি পেয়ে গেছে সকালেই, কিন্তু প্রিমিয়ার শো করা হচ্ছে সন্ধ্যায়। আরশাদ ঠিক করে রেখেছিল মাঝের এই সময়টুকু সে প্রধান প্রধান কয়েকটা টিভি চ্যানেলে ইন্টারভিউ দেবে। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছিল। সর্বপ্রথম ইন্টারভিউ দিতে আরশাদ যায় চ্যানেল ১৬ তে। উপস্থাপক একেকটা প্রশ্ন করছিল আর আরশাদ একেক করে শান্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিচ্ছিল। সেই ইন্টারভিউ আবার সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে টিভির পর্দায়।

হঠাৎ উপস্থাপক এমন একটা প্রশ্ন করে বসলো যাতে আরশাদের মুখভঙ্গিতে নিমিষেই বদলে গেল। স্নিগ্ধ-শুভ্রতা উড়ে গিয়ে তার চোখেমুখে জায়গা করে নিলো একরাশ ক্রোধ।
প্রশ্নটা হলো, “আপনার জীবনে কী নতুন কেউ এসেছে?”

আরশাদ যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছেলে। ব্যক্তিগত জীবনে সে যতই রাগী হোক না কেন, সেই রাগের লেশমাত্র প্রকাশ করবে না লাইভ ইন্টারভিউতে, হাজার হাজার ভক্তদের সামনে। বহুকষ্টে, দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে কৌশলে এড়িয়ে গেছে সেই প্রশ্ন। রাগটা প্রকাশ করেছে ইন্টারভিউ শেষ হবার পর। সেই উপস্থাপক আর লাইভ শোয়ের ডিরেক্টরকে যেতে হয় স্টিমরোলারের নিষ্পেষণের মধ্য দিয়ে।

ওই ঘটনার পর আর কোথাও ইন্টারভিউ দিতে যায়নি সে। সোজা চলে গেছে বাড়িতে। এখনো বাড়ি থেকে বেরোনোর নামগন্ধ নেই। কোনো মানে হয়?

সীমা প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল, “এই অরা? আমাকে কেমন লাগছে?”

অরা সীমার গাল টিপে দিয়ে বলল, “পরির মতো লাগছে।”

সীমা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “পরিরা দেখতে কেমন হয়? সুন্দর হয়?”

অরা ফিক করে হেসে ফেলল।

সীমা ভ্রু কুঁচকে বলল, “হাসছিস কেন?”

“তোর ব্যস্ততা দেখে হাসছি। এত টেনশন করার কী আছে তাই তো বুঝলাম না।”

“আমার সারাজীবনের ক্রাশের সঙ্গে প্রথমবারের মতো দেখা করতে যাচ্ছি, টেনশন করবো না? এই অরা! ভালো করে খেয়াল করে দেখ তো, আমার মেকআপ বেশি হয়ে গেছে কিনা।”

“সীমা, তোর মেকআপ বেশি হলেও কিছু যায় আসে না কম হলেও না।”

“কেন?”

“কারণ স্যার ভালো করে মেয়েদের দিকে তাকায় না।”

সীমা মুখ খুলে আহত গলায় কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই তার চোখ পড়লো মাল্টিপ্লেক্সের বাইরে বিশাল জনস্রোতের দিকে। শত শত মানুষের ভীড়ে একজনকে কেন্দ্র করে। যাকে এক পলক দেখার জন্যে দীর্ঘকাল তপস্যা করতে পারবে তারা।

এক লাফে উঠে দাঁড়ালো সীমা। তার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে, গলা শুকিয়ে আসছে। যে মানুষটাকে এতকাল স্বপ্নে দেখে এসেছে, সে আজ তার চোখের সামনে। সীমার চোখে জল চলে এল। আজকেই এই দিনটা নিঃসন্দেহে তার জীবনের সেরা একটি দিন।

সীমা কম্পিত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে আরশাদের দিকে। অরা যাচ্ছে তার পিছন পিছন।সিকিউরিটিরা আরশাদকে ঘিরে রেখেছে। ভক্তদের প্রবল স্রোতকে তার কাছেও ঘেঁষতে দিচ্ছে না। তবুও অনেকটা যুদ্ধ করে মাল্টিপ্লেক্সের ভেতরে প্রবেশ করলো আরশাদ।

সীমা নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “আরশাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, আরশাদ! আমি আপনার অনেক বড় ফ্যান।”

আরশাদের চোখদুটো সানগ্লাসের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে। তবুও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে তার চোখেমুখে বিরক্তির শেষ নেই।

আরশাদ একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে ডাকল, “অরা!”

অরা সীমার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। আরশাদের ডাক পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে সামনে এসে বলল, “জি স্যার?”

আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “তোমাকে কতবার বলেছি এসব ফ্যান-ট্যান আমাকে বিরক্ত করতে না আসে।”

অরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “I’m sorry sir. এই সীমা তুই যা গিয়ে হলে বস।”

সীমা এক বিন্দু নড়লো না, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বেচারি নিস্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরশাদের দিকে। চোখের সামনে দিয়ে কী ঘটছে বুঝতেই যেন তার কষ্ট হচ্ছে।

আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “এরপর থেকে যেন এই ভুলটা না হয়।”

আরশাদ দৃপ্ত পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেল। সিনেমার প্রযোজক কোত্থেকে যেন ছুটে এসে হাত মেলানোর উদ্দেশ্যে হাসিমুখে তার হাতটা এগিয়ে দিল। আরশাদ তার সঙ্গে হাত না মিলিয়েই প্রবেশ করলো সিনেমা হলে। সর্বনাশ করেছে! আজ মনে হয় তার মেজাজের অবস্থা একটু বেশিই খারাপ। তবুও যে প্রিমিয়ার শোতে এসেছে, এই ঢের বেশি। সিনেমা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আরশাদকে নিয়ে চিন্তাভাবনা না করলেও চলবে। আপাতত সীমাকে সামলানোর গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে অরাকে।

অরা নিচু গলায় বলল, “বলেছিলাম, আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাবি না। আমি সময় সুযোগ বুঝে কথা বলিয়ে দেবো। কী হতো আমার কথাটা শুনলে?”

সীমা চুপ করে রইলো। অরার কথাগুলো তার কর্ণকুহরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে কিনা কে জানে? সম্ভবত তার মস্তিষ্কে এখনো আরশাদের বলা শব্দগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে।

অরা আবারও বলল, “চল হলে গিয়ে বসি, সিনেমা শুরু হয়ে যাবে তো।”

সিনেমা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, “আমি কোনো সিনেমা-টিনেমা দেখবো না। তোর বসের সিনেমা তুই দেখ! আমি গেলাম।”

সীমা দ্রুত পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল মাল্টিপ্লেক্স থেকে। অরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়ে রইল তার গমনের দিকে। অরার ভাগ্যটাই খারাপ! যেখানেই যায় সেখানেই তার সময় পার হয়ে যায় মানুষের পাগলামির সামাল দিতে দিতে।
সীমা যেমন হন্তদন্ত করে বেরিয়ে গেল, রাস্তায় নির্ঘাত একটা অঘটন ঘটাবে। বাধ্য হয়ে অরাও বেরিয়ে গেল তার পিছু পিছু। আপাতত এখানে না থাকলেও চলবে। সিনেমা চলাকালীন সময়টুকুতে আরশাদ নিশ্চয়ই তার খোঁজ করবে না।

মাল্টিপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে সোজা বাসায় উদ্দেশ্যে রওনা দিলো সীমা। অরাকেও বাধ্য হয়ে তার সঙ্গে ফিরে আসতে হলো। পুরোটা রাস্তা সীমা টু শব্দ পর্যন্ত করলো না। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে গেল শুধু। অরাও আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে গেল না। আরশাদকে ঘিরে মেয়েটার হাজারো অনুভূতি জড়িয়ে আছে। সেই অনুভূতিগুলো মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মাথায় ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে আরশাদ নিজেই। কান্না পাওয়াটাই তো স্বাভাবিক।

বাড়িতে ঢুকেই বসার ঘরে সোফায় গা এলিয়ে দিলো সীমা। কান্নার রেশ এখনো কাটেনি, বরং বেড়েছে। নিঃশব্দের কান্না এখন পরিণত হয়েছে সশব্দের কান্নায়। সীমা কাঁদছে আর একটু পর পর হেঁচকি তুলছে।

অরা রান্নাঘরে ঢুকে সীমাকে উদ্দেশ্য করে উঁচু গলায় বলল, “আর কত কাঁদবি? এবার তো থাম।”

সীমার থামাবার কোনো নামগন্ধ নেই। অরা ফ্রিজ থেকে কাপকেক বানানোর সরঞ্জাম বের করলো। সবকিছু হাতের কাছেই থাকে। সীমা যখন রেগে যায় বা কষ্ট পায়, তখনি তাকে এই জিনিস বানিয়ে খাওয়াতে হয়। অরা চট করে ব্যাটার তৈরি করলো, কাপকেকের মল্ডে তা ঢেলে ওভেনে ঢুকিয়ে দিলো বেক করার উদ্দেশ্যে। বেক হতে বেশি একটা সময় লাগবে না। দেখা যাক, ততক্ষণে সীমার কান্না থামানোর চেষ্টা সফল করা যায় কিনা।

অরা সীমার কাছে এসে সোফায় বসতে বসতে বলল, “তোর এত কান্নাকাটি করার কী আছে তাই তো বুঝলাম না। ঝাড়িটা তো আমি খেয়েছি, তোকে তো কিছু বলেনি।”

সীমা চোখ জল মুছতে মুছতে আক্ষেপজড়িত কণ্ঠে বলল, “আমি ফ্যান-ট্যান? ফ্যান-ট্যান?”

“আহা থাম তো!”

“কেন থামবো আমি? এত বছর ধরে ওকে সাপোর্ট করে গেলাম, একটা সিনেমারও ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো বাদ যায়নি। আর আমাকে কী বলল? ফ্যান-ট্যান? আমি না-কি তাকে বিরক্ত করতে গেছি!”

অরা শীতল গলায় বলল, “আগেই বলেছিলাম প্রেমে এত হাবুডুবু খাস না। আগ বাড়িয়ে দেখা করতে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। শুনলি আমার কথা?”

“আগে বুঝেছিলাম না-কি আরশাদ এতটা খারাপ?”

“স্যার মানুষটা কিন্তু খারাপ না। মাঝে মাঝে শুধু ভয়ঙ্করভাবে রেগে যায়।”

সীমা ক্রুদ্ধ গলায় বলল, “এত স্যার স্যার করবি না। খবরদার! আমার সামনে ওর নামও উচ্চারণ করবি না। সেলিব্রিটিরা এত খারাপ হয়? ছি! সামনাসামনি না দেখলে তো বুঝতেই পারতাম না। ক্যামেরার সামনে এমন ভাব করে রাখে যেন পৃথিবীতে তাদের মতো ভালো মানুষ আর দ্বিতীয়টা নেই। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবাই খারাপ। ওকে আজ সুপারস্টার বানিয়েছে কে? বল কে বানিয়েছে?”

“কে?”

“আমার মতো ফ্যানরা। অথচ সেই ফ্যানদের জন্যে বিন্দুমাত্র রেসপেক্ট নেই ওর।”

সীমার জন্যে এই মুহূর্তে খারাপই লাগছে। বেচারি কত আশা নিয়ে গিয়েছিল নিজের স্বপ্নের সেলিব্রিটির সঙ্গে দেখা করতে। আজ সামনাসামনি আরশাদকে দেখবে বলে গতরাতে তার চোখে এক ফোঁটাও ঘুম নেমে আসেনি। আরশাদ কি পারতো না তার সঙ্গে একটু ভালোভাবে কথা বলতে? ভালোভাবে কথা না বললেও, অমন কঠিন কঠিন কথা শোনানোর কী প্রয়োজন ছিল?

অরা উঠে গেল। কাপকেক এতক্ষণে হয়ে গেছে। ওভেন থেকে সেগুলো বের করে সুন্দর করে ক্রিম দিয়ে সাজিয়ে নিলো। এরপর সীমার সামনে নিয়ে এসে বলল, “হয়েছে, আর কাঁদতে হবে না। নে কাপকেক খা।”

কাপকেকের নাম শুনেই উঠে বসলো সীমা। দুহাত দিয়ে চোখের জল মুছে কাপকেকে কামড় দিয়ে বলল, “আমি তোকে বলে দিলাম অরা, আজকের পর থেকে আরশাদকে সব জায়গা থেকে আনফলো করে দেবো। এমনকি নিজের জীবন থেকেও আনফলো করবো।”

অরা মজার ছলে বলল, “আর তোর ক্রাশের কী হলো?”

সীমা তেজী কণ্ঠে বলল, “বললাম না, জীবন থেকেও অনফলো করে দেবো! আমার কোনো ক্রাশ নেই। আজকে থেকে ওর একটা সিনেমাও দেখবো না আমি।”

“তোর জীবনের প্রথম হার্টব্রেক তাহলে স্যারই করলো, তাই না?”

“আবারও স্যার স্যার করছিস? যা তো আমার চোখের সামনে থেকে।”

স্বাভাবিক হতে আরও ঘন্টাখানেক সময় লাগলো সীমার। মেকআপ-টেকআপ তুলে নিজের ফোনটা নিয়ে দৃঢ় ভঙ্গিতে বসলো আরশাদকে ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রাম থেকে আনফলো করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু শেষমেশ আনফলো করতেই গিয়েও করলো না। খানিকটা দার্শনিকের মতো করে বলল, “থাক আনফলো করবো না! আরশাদ তার ফ্যানদের ভালোবাসে না। কিন্তু সুপারস্টার হিসেবে আমি তো একটা সময়ে তাকে ভালোবেসেছি।”

আচমকা অরার ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে তার স্যারের নাম। ঠিক যেমনটা ধারণা করেছিল অরা। অরা জানতো সিনেমা শেষ হলেই তার ডাক পড়বে। তাই তো বাইরের পোশাক না ছেড়ে বসে আছে এখনো।

অরা ফোন রিসিভ করতেই আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “এখনই আমার বাসায় চলে আসো অরা। আর সাথে করে তোমার ল্যাপটপটাও আনবে।”

আরশাদের মতো ঘরকুনো নায়ক এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। আজ নতুন সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে এতবড় হিটে পরিণত হয়েছে, দর্শক তার অভিনয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কোথায় প্রিমিয়ার শোয়ের শেষে আজকের দিনটা উদযাপন করবে, তা না। বাড়িতে গিয়ে বসে আছে। অবশ্য আরশাদের দোষ দিয়েও লাভ নেই। সোশ্যাল অ্যাংজাইটিতে জর্জরিত মানুষেরা নিজেকে সর্বক্ষণ সবার থেকে আড়াল করে রাখতে চায়।

আরশাদ গম্ভীর ভঙ্গিমায় বসে আছে বসার ঘরের সোফায়। তার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনোদিনও ওই চোখ কোনো অনুভূতির স্বাদ পায়নি। তার বিপরীতে থাকা সোফায় বসে আছে অরা। ভেতরে ভেতরে অরার গা বেয়ে বয়ে যাচ্ছে প্রবল কালবৈশাখীর ঝড়।

আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “তুমি কি ইন্টারভিউয়ের আগে ওদেরকে বলেছিলে কোনো পার্সোনাল কোয়েশ্চেন না করতে।”

অরা শুকনো ঢোক গিলে বলল, “বলেছিলাম স্যার। কিন্তু ওরা শোনেনি।”

কয়েক মুহূর্ত কী যেন চিন্তা করে আরশাদ শুকনো গলায় বলল, “একটা কমপ্লেইন্ট লেটার লেখো। ওই উপস্থাপক আর শোয়ের ডিরেক্টরের অ্যাগ্যাইস্টে। পরিষ্কার লিখবে আমার টিম বারণ করা সত্ত্বেও তারা ইচ্ছা করে লাইভ প্রোগ্রামে আমাকে পার্সোনাল প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছে।”

অরা অবাক গলায় বলল, “কিন্তু স্যার, এতে তো ওদের চাকরি চলে যেতে পারে।”

আরশাদ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো অরার দিকে। তার এই একটা দৃষ্টিই যেন যথেষ্ট একটা মানুষের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্যে।

আরশাদ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “ওদের চাকরি নিয়ে তোমার এত চিন্তা কীসের? নিজের চাকরি বাঁচাতে চাইলে চুপচাপ লেটারটা লেখো।”

আর কোনো কথা বলার সাহস অবশিষ্ট রইল না অরার মাঝে। বিনা বাক্য ব্যয়ে নিজের ল্যাপটপটা বের করে টাইপ করতে শুরু করলো কমপ্লেইন্ট লেটার। সীমা আরশাদের ওই একটা ধমক খেয়েই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ভাগ্যিস অরার মনটা অত নরম নয়। না হলে তো সেই কবেই আরশাদের এসব ধমকাধমকি সহ্য করতে না পেরে চাকরি ছেড়ে দিতো।

ওই বেচারাদের জন্যে খারাপই লাগছে অরার। আরশাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সাংবাদিকদের এত আগ্রহ কীসের কে জানে? বারবার বারণ করে দেওয়া সত্ত্বেও লাইভ ইন্টারভিউতে ওই প্রশ্নটা না করলে ওদের এই দিন দেখতে হতো না।

লেটার টাইপ করে অরা তার ল্যাপটপ নিয়ে রাখলো আরশাদের সামনে। আরশাদ মনোযোগ দিয়ে পড়লো প্রত্যেকটি অক্ষর। এখন তার মুখভঙ্গি স্বাভাবিক পর্যায়ে এসেছে। চোখমুখ থেকে সেই কাঠিন্য ক্রমেই দূর হতে শুরু করেছে। তাকে দেখে আর অনুভূতিশূন্য মানুষ বলে মনে হচ্ছে না।

আরশাদ বলল, “চ্যানেল সিক্সটিনে মেইল করে পাঠিয়ে দাও।”

আরশাদের নির্দেশ অনুযায়ী অরা মেইল করে পাঠিয়ে দিলো সেই লেটার।

কাজ শেষে অরা আরশাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে যাবে তখনই আরশাদ বলল,
“অরা?”

“জি স্যার।”

“ওই মেয়েটা কে ছিল?”

“আমার ফ্রেন্ড স্যার। আপনার অনেক বড় ফ্যান।”

“ওকে আমার তরফ থেকে সরি বলে দিও প্লিজ।”

মনে মনে বিস্ময়ের সীমা রইল না অরার। সুপারস্টার আরশাদ হক, যে কাউকে ভয় পায় না সে কিনা সরি বলছে একটা সাধারণ মেয়েকে?

আরশাদ আবারও শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “এই ঝামেলার কারণে আমার মাথা এমনিতেও কাজ করছিল না। তুমি জানো আমি ফ্যানদের সাথে কখনো বাজে বিহেভ করি না। I’m so sorry.”

অরা ব্যস্ত গলায় বলল, “আপনাকে সরি বলতে হবে না স্যার। It’s completely fine.”

“But I’m genuinely sorry. তুমি এক কাজ করো, তোমার ফ্রেন্ডকে আগামীকাল আমার সাথে দেখা করতে নিয়ে এসো।”

অরা অবাক গলায় বলল, “আগামীকাল?”

“হ্যাঁ। কেন? কোনো সমস্যা আছে?”

“জি না স্যার।”

আরশাদ মানুষটা এমনই। নিজের ভয়ঙ্কর রাগে চারিদিকের সবকিছু ধ্বংস করে দেওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে, আবার নিজের কোমল হৃদয়টা দিয়ে আশেপাশের মানুষের মনে গভীর ছাপ রাখার ক্ষমতাও রাখে। চার বছর ধরে নিয়মিত তার আশেপাশে থাকার সুযোগ পাচ্ছে অরা। তবুও এই মানুষটা প্রতিনিয়ত বিস্মিত করে তোলে তাকে।

(চলবে)