#ফিরে_আসা
৫০
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
প্রচন্ড বেগে আরও একটা ঘুষি এসে পড়লো সাবেরের মুখের ওপরে। অনবরত আঘাতে তার মুখের নকশাই পাল্টে দিয়েছে আরশাদ। গাল-ঠোঁট ফেটে অনর্গল রক্ত পড়ছে। সাবের মুক্তির জন্যে আর্তনাদ করছে। তবুও আরশাদের মনে সামান্যতম দয়া হচ্ছে না। একের পর এক ঘুষি বসিয়েই যাচ্ছে সাবেরের মুখে।
ক্রোধে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে আরশাদ বলল, “এই জানোয়ার! তুই জানিস কোথায় হাত দিয়েছিস? কী ভেবেছিলি? আমি বেঁচে থাকতে আমার বউকে নিয়ে পালিয়ে যাবি?”
আবারও সজোরে কতগুলো ঘুষি এসে পড়লো সাবেরের মুখে। সাবের অসহায় ভঙ্গিতে কাতরাতে কাতরাতে বলল, “আমার কোনো দোষ নেই স্যার। বিশ্বাস করুন! ওই নওশীন আমাকে দিয়ে জোর করে অরাকে কিডন্যাপ করিয়েছে।”
নওশীনের নামটা শুনে বিন্দুমাত্র অবাক হলো না আরশাদ। এই জঙ্গলে পরিচিত কাঠের বাড়ির কথা মনে পড়তেই সে তৎক্ষণাৎ বুঝতে পেরেছিল এসবের পেছনে রয়েছে নওশীন।
আরশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “কেউ একজন জোর করলো আর তুই নাচতে নাচতে কিডন্যাপ করতে চলে এলি? পাঁচ বছরের বাচ্চা তুই?”
আরশাদ আবারও তাকে আঘাত করতে যাবে তখনই ওসি হানিফ বাঁধা দিয়ে বলল, “আরশাদ ভাই! এবার ওকে ছেড়ে দিলে হয় না?”
পায়ে গুলি লাগার পর পুলিশ তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আরশাদ তার আগেই ভেতরে জমে থাকা সকল রাগের প্রকাশস্বরূপ ঘুষির বর্ষণ শুরু করে দেয় সাবেরের মুখে। আরশাদের রাগ দেখে পুলিশ বাঁধা দেওয়ার সাহসও পাচ্ছিল না।
হাসু মিয়া এবং মাঝি নদীতে ঝাঁপ দিলেও বেশিদূর যেতে পারেনি। পুলিশ সাঁতরে মাঝ নদী থেকেই ধরে আনে তাদের। হাসু মিয়াও পুলিশকে জানিয়েছে এক ব্যাগ টাকা দিয়ে নওশীনই আজ সকালে তাকে এখানে পাঠিয়েছে।
আরশাদ সাবেরকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “আপনাকে একটা রিকুয়েস্ট করবো ওসি সাহেব?”
“জি অবশ্যই।”
“সাবের যে ধরা পড়েছে এই খবরটা মিডিয়ায় জানাবেন না। মূল হোতা সতর্ক হয়ে যাবে।”
ওসি সাহেব আশ্বাস দিয়ে বললেন, “এটা আপনি না বললেও আমরা জানতাম না। সমস্যা করেছে সাংবাদিকগুলো! এমন সিরিয়াস অভিযানে আমরা কখনো সাংবাদিকদের আশেপাশে অ্যালাউ করি না। তবে এই কেসটা আলাদা কারণ এই কেসের সঙ্গে আপনি জড়িত। আপনি আমাদের সঙ্গে এই অভিযানে না এলে সাংবাদিকদের এত ভীড় জমতো না। সাবেরও তড়িঘড়ি করে রওনা দেওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়তো না।”
আরশাদ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “আর আমি না এলে এই জায়গাটা খুঁজে পেতেন কী করে?”
ওসি সাহেব চুপ করে রইলেন। আসলেই তো! এই জায়গাটা শেষমেশ আরশাদই খুঁজে বের করেছে। পুলিশ অরাকে খুঁজতে এত দূর অব্দি আসতো না। প্রথম বাড়িটার পাঁচ কিলোমিটার রেডিয়াসের ভেতরেই অভিযান চালাতো। আর রেডিয়াসে এই জায়গা আসে না। আরশাদ তাদের সঙ্গে না এলে তো অরাকে খুঁজে পাওয়াই সম্ভব হতো না। সাবেরও অরাকে নিয়ে পালিয়ে যেত বহুদূর।
আরশাদ আবারও বলল, “যাইহোক, সাংবাদিকরা এখনো এদিকটায় পৌঁছাতে পারেনি। আপনারা প্লিজ দ্রুত একে নিয়ে কোথায় যাবেন যান।”
ওসি সাহেব রহস্যময় কন্ঠে বললেন, “জি। দ্বিতীয় অভিযানে কি আপনি আমাদের সঙ্গে যাবেন?”
দ্বিতীয় অভিযানটি কীসের সেটা আর বুঝিয়ে বলতে হলো না আরশাদকে।
আরশাদ দৃঢ় গলায় বলল, “অবশ্যই।”
আরশাদের গাড়ির ব্যাকসিটে গা এলিয়ে দিয়েছে অরা। তার গায়ের ওপরে নিজের জ্যাকেটটা জড়িয়ে দিয়েছে আরশাদ। সাবেরের টানাটানির কারণে তার জামার পেছনের অংশের অনেকখানি ছিঁড়ে গেছে। মোটা জ্যাকেট গায়ে থাকা সত্বেও শীতে থরথর করে কাঁপছে অরা। এমনিতেই বৃষ্টির পানি তার সহ্য হয় না। তার ওপরে আজ এতটা দীর্ঘ সময়ে বৃষ্টির মাঝে থাকতে হয়েছে।
বুকের মাঝে হৃদয়টা অনবরত লাফিয়েই যাচ্ছে। গত এক ঘন্টায় পর পর কতগুলো ঘটনা ঘটে গেল। সাবের তাকে টেনেহিঁচড়ে নৌকায় এনে ফেলল। অরার বারবার মনে হচ্ছিল এই বুঝি সে চিরতরে হারিয়ে যেতে যাচ্ছে। হাজার চিন্তায় মাঝে ঠিক করে ফেলল এই জীবনটা সে আর রাখবে না। যন্ত্রণাময় এই জীবনে বহুবার নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভেবেছে সে। তবে প্রতিবারই তা ভাবনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। আজকের মতো দৃঢ়সংকল্পভাবে উদ্যোগ নেয়নি সে কোনোদিন।
নৌকার পাটাতনে দাঁড়িয়ে যখন সে প্রায় ঝাঁপ দিয়েই ফেলছিল, তখন বারবার শুধু মনে ভেসে উঠছিল আরশাদের নামটা। মানুষটাকে তো আর বলা হলো না, ভালোবাসি। সে কি অরার দেওয়া জার অফ সিক্রেটস খুলে দেখেছিল? না দেখারই তো কথা। ওই মুহূর্তে কেবল মনে হচ্ছিল, সারাজীবন সাবেরের বন্দী হয়ে কাটানোর থেকে নদী ঝাঁপ দিয়ে মরে যাওয়া ভালো।
এতসব ঘটনার ভীড়ে শেষমেশ আগমন হলো আরশাদের। একদম সঠিক সময় বিপদের মুখ থেকে বাঁচিয়ে নিলো তার ভালোবাসার মানুষটা তাকে। পর পর ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলো যেন অরার মস্তিষ্কে বারবার বেজেই চলেছে। ক্লান্তিতে তার শরীর ভেঙে আসছে। গত আটচল্লিশ ঘন্টার প্রায় পুরোটা সময়ই তাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল চেয়ারের সঙ্গে। হাত-পা যেন তাই অবশ হয়ে আসছে।
ওসি সাহেবের সঙ্গে কথাবার্তা সেরে আরশাদ উঠে বসলো গাড়ির ব্যাকসিটে। অরার দিকে চোখ পড়তেই তার বুকটা ধ্বক করে কেঁপে উঠলো। সর্বক্ষণ যে মেয়েটা প্রাণবন্ত হয়ে থাকে, আজ সে কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। চুলগুলো অগোছালো হয়ে ছড়িয়ে আছে, চোখের কাজল অশ্রুর সঙ্গে মিশে যাওয়ায় গালে কালো দাগ বসে গেছে, নৌকায় পড়ে যাওয়ার কারণে কপাল কেটে রক্ত জমাট বেঁধেছে। বেচারি এতটাই ক্লান্ত যে নিঃশ্বাস নেওয়াটাও যেন তার কাছে বিরাট কষ্টকর কোনো কাজ বলে মনে হচ্ছে।
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না আরশাদ। এক নিমিষে অরাকে টেনে বুকে আগলে ধরলো। অরাও বিড়ালছানার মতো গুটিশুটি মেরে পড়ে রইলো আরশাদের বুকে। অরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আরশাদ চোখদুটো বুজে রইলো। এই মেয়েটার সঙ্গে থাকতে থাকতে, সিক্রেট সিক্রেট খেলতে খেলতে হঠাৎ একদিন আরশাদ উপলব্ধি করে মনের অজান্তেই ভালোবাসে ফেলেছে তাকে। তাকে ক্ষণিকের জন্যে হারিয়ে আরশাদ উপলব্ধি করতে পারছে সেই ভালোবাসার প্রখরতা কতটা বেশি। অরার এই ফিরে আসা আরশাদকে শেখালো, এই মেয়েটার উপস্থিতি ছাড়া তার চাকচিক্যময় জীবন কতটা অনর্থক।
আরশাদ অরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “তুমি ঠিক আছো অরা?”
অরা তার বুকের মাঝে গুটিশুটি মেরে থেকেই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।
অনর্থক একটা প্রশ্নের অনর্থক জবাব। আরশাদ জানে, অরা মোটেও ঠিক নেই। শারীরিক-মানসিক দুভাবেই প্রচন্ড এলোমেলো হয়ে আছে সে। তবুও প্রশ্নটা কেন করলো নিজেও জানে না। আরশাদ যাতে বেশি দুশ্চিন্তা না করে, তাই অরাও হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।
আরশাদ কোমল স্বরে বলল, “তাকাও আমার দিকে!”
অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে আরশাদের বুক থেকে মাথা তুলে তাকালো তার দিকে।
আরশাদ অরার গালে হাত রেখে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “তোমার সাথে কী করেছে ও? টর্চার করেছে?”
অরা না-সূচক মাথা নাড়লো। কথা বলার মতো শক্তি তার শরীরে অবশিষ্ট নেই। তবুও বহুকষ্টে বিড়বিড় করে বলল, “নওশীন…”
অরা আর কিছু বলার আগেই আরশাদ বলল, “আমি সব জানি অরা। তোমাকে ওসব নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হবে না।”
আরশাদ আচমকা তার ঠোঁটের স্পর্শ দিলো অরার কপালে। অরা আহ্লাদে মোমবাতির মতো গলে গিয়ে আবারও মাথা রাখলো তার বুকে। আশ্চর্য ব্যাপার! বিয়ের পর আরশাদের এতটা কাছে সে আসেনি। তার এতটা গভীর স্পর্শ সে পায়নি। অরার তো লজ্জায় নুয়ে পড়ার কথা। লজ্জায় থেকেও বেশি তার সমস্ত শরীরে বিচিত্র এক প্রশান্তি খেলে যাচ্ছে।
ঢাকায় ফিরে অরাকে নিয়ে বাড়িতে গেল না আরশাদ। সোজা চলে এল হসপিটালে। সাংবাদিকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এতটা পথ আসা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। সাংবাদিকদের কোনমতে জানতে দেওয়া যাবে না অরাকে খুঁজে পাওয়া গেছে। তারা এই খবরটা জানা মানেই হলো নওশীনের সতর্ক হয়ে যাওয়া। ডক্টর ইশতিয়াক অত্যন্ত গোপনীয়তার মাঝে হাসপাতালে অরার চিকিৎসা করছেন। এখান থেকে খবরটা ফাঁস হবার কোনো উপায় নেই।
অরার হাতে-পায়ে বেশ অনেকগুলো চোট লেগেছে। দীর্ঘ সময় হাতে-পায়ে নাইলনের দড়ির শক্ত বাঁধন থাকায় স্থায়ী দাগ বসে গেছে। ক্ষতচিহ্নগুলোতে ড্রেসিং করে দেওয়া হলো। একে তো মুখের ওপরে স্কচটেপ, তার ওপরে জানালা-বিহীন ঘরে দীর্ঘ সময় বন্দি থাকার কারণে তার শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তাই ডক্টর কয়েক ঘন্টার জন্যে তাকে অক্সিজেন মাস্ক দিয়েছে। গত দুদিন পানি ছাড়া কিছুই পড়েনি তার পেটে। অস্বাভাবিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে অরা। এজন্যে তাকে সেলাইন দেওয়া হয়েছে।
সমস্যা এখানেই শেষ হয়ে গেলে ভালো হতো। তবে বাড়তি সমস্যা হিসেবে যোগ দিয়েছে অরার জ্বর। অনেকটা সময় বৃষ্টির মাঝে থাকার কারণে তার এসেছে আকাশ-পাতাল জ্বর। কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আরশাদ ঠিক আছে ঠিক তার পাশেই। শক্ত করে ধরে রেখেছে অরার হাত। যেন হাতের বাঁধন একটু আলগা হলেই মেয়েটা দূরে কোথাও হারিয়ে যাবে।
অরার ঘুম ভাঙলো রাত দশটার দিকে। শ্বাস-প্রশ্বাসে আর কোনো অসুবিধা হচ্ছে না বলে ডাক্তার সাহেব অক্সিজেন মাস্ক খুলে নিলেন। অরার শরীরে জ্বর এখনো আছে। সেই সঙ্গে ভর করছে একরাশ ক্লান্তিবোধ।
ডক্টর ইশতিয়াক আরশাদের উদ্দেশ্যে বললেন, “সেলাইন শেষ হলেই উনাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন। তবে আমি সাজেস্ট করবো আজকের রাতটা এখানেই থেকে যেতে। আমরা তাহলে ভালোভাবে অবজার্ভ করতে পারবো।”
আরশাদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই অরা ক্লান্ত স্বরে বলল, “আমি বাসায় যাবো।”
অরার বাড়ি ফিরে যাওয়ার তাড়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সেই কবে থেকে বাড়ির বাইরে মেয়েটা!
আরশাদ বলল, “বাড়িতেই নিয়ে যাই। আপনি কাইন্ডলি কাল সকালে একবার ওর চেকআপ করে আসবেন?”
“Sure.”
বাড়ি ফিরে অরাকে নিজের ঘরে এনে বিছানায় শুইয়ে দিলো আরশাদ। অরা নিশ্চয়ই এ অবস্থায় পাশের ঘরে থাকতে পারে না। তাছাড়া মেয়েটাকে এক মুহূর্তও চোখের আড়াল করতে চাইছে না আরশাদ। অরা চোখের আড়ালে গিয়েই তো অস্থির করে দিয়েছিল আরশাদের সমস্ত চেতনাকে। আর অস্থিরতা সহ্য হবে না তার।
ঘুমের ওষুধের প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। বিছানায় মাথা রাখতেই অরা ঘুমের ঘোরে ডুবে গেল। এখনো ঘুমিয়ে পড়েনি তবে যেকোনো সময় ঘুমিয়ে পড়বে। অরাকে রেখে আরশাদ ফ্রেশ হতে চলে গেল। এতক্ষণ সেই বৃষ্টিতে ভেজা জামাকাপড় তার গায়ে জড়ানো। ফ্রেশ হতে গিয়ে আরশাদের খেয়াল করলো তার হাতের ক্ষতটা। কাল অমন সজোরে হাতটা দেয়ালে আঘাত করার কারণে এই ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। পানির সংস্পর্শে হাতটা তাই জ্বালাপোড়া করছে। অরাকে যতক্ষণ পাওয়া যাচ্ছিল না ততক্ষণ এতসব ব্যথা-ট্যথা অনুভূত হয়নি। মাথায় কেবল একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল। অরার চিন্তা।
ফ্রেশ হয়ে ঘরে এসে আরশাদ দেখলো অরা গুটিশুটি মেরে বিছানায় শুয়ে আছে। তার গলা পর্যন্ত ব্ল্যাঙ্কেট টানা। আরশাদ নিঃশব্দে গিয়ে শুয়ে পড়লো তার পাশে। সুইচবোর্ডে হাত বাড়িয়ে ঘরের সব বাতিগুলো নিভিয়ে দিলো। হঠাৎ কেন জানি তার মনে হলো অরা জেগে আছে, ঘুমিয়ে পড়েনি।
আরশাদ ক্ষীণ স্বরে ডাকলো, “অরা?”
অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “হুঁ?”
আরশাদ কোমল স্বরে বলল, “আমার কাছে এসো!”
অরা বিনা বাক্য ব্যয়ে নিঃসংকোচে আরশাদের কাছে গেল। তার বুকে মাথা রেখে আবারও শুয়ে পড়লো। আরশাদ অরার হাতটা টেনে এনে তার গায়ের ওপরে রাখলো। নিজেও শক্ত করে আকড়ে ধরলো অরাকে। ক্রমেই যেন আরশাদের এই স্পর্শের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে অরা। দীর্ঘ ক্লান্তির পর দিনশেষে বাড়ি ফিরে এনে মনে যেমন বিচিত্র এক প্রশান্তি বোধ হয়, ঠিক তেমনই এক অনুভূতি বয়ে যাচ্ছে সমস্ত শরীর জুড়ে।
আরশাদ অরার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলল, “I’m sorry Aura. আমার কারণেই তোমাকে এতটা কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। আমার আগেই উচিত ছিল তোমার সিকিউরিটি বাড়িয়ে দেওয়া।”
অরা থেমে থেমে বলল, “আপনি কেন সরি বলছেন? I’m sorry.”
“কেন?”
“সেদিন আপনাকে না জানিয়ে বাড়ির বাইরে যাওয়া আমার উচিত হয়নি।”
আরশাদ ক্ষীণ হাসি হেসে অরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “তোমার কোনো দোষ নেই অরা। তুমি কি সব জায়গায় যাওয়ার আগে আমাকে জানিয়ে যাও?”
অরা ক্লান্ত স্বরে বলল, “আমার খুব ভয় করছিল জানেন। বারবার মনে হচ্ছিল আর কখনো আপনাকে দেখবো না।”
“ভরসা ছিল না আমার ওপরে?”
“ছিল কিন্তু…”
অরাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আরশাদ বলল, “থাক। আর কথা বলতে হবে না। চুপ করে ঘুমাও তো তুমি।”
কেটে গেল প্রশান্তিময় নীরবতার হাওয়া। যে নীরবতার মাঝে হাজার বছর কাটিয়ে দেওয়া কষ্টকর হবে না তাদের পক্ষে।
আচমকা নীরবতা ভঙ্গ করে অরা কম্পিত স্বরে বলল, “আরশাদ?”
মনে মনে চমকে উঠলো আরশাদ। এই প্রথমবার তাকে নাম ধরে ডাকছে অরা। প্রথমবারের মতো নাম ধরে ডাকায় চমকায়নি আরশাদ। তার চমকানোর কারণ তার ডাকার ধরনটা। আর এবং শাদের মাঝে ন্যানোসেকেন্ডের বিরতি। হাজারো মানুষের মুখে মুখে আরশাদের নাম। তবে এতটা সুন্দর করে আজ পযর্ন্ত কেউ তা উচ্চারণ করেছে বলে মনে তো হয় না।
আরশাদ মুগ্ধতার হাসি হেসে বলল, “হুঁ?”
অরা উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “ওরা যদি আবার নতুন কোনো প্ল্যান করে আমাকে…”
অরার কথাটা শেষ হবার আগেই আরশাদ তার একটা আঙুল অরার ঠোঁটের ওপর রেখে বলল, “হুস! ভালো করে তাকিয়ে দেখো কার বাহুডোরে আটকা পড়ে আছ তুমি। এই পৃথিবীতে কারও সাধ্য নেই তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার।”
আরশাদের বুকে মাথা রেখেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো অরা নিজেই জানে না। আরশাদ সাবধানে অরাকে বুক থেকে নামিয়ে বালিশে শুইয়ে দিলো। হঠাৎ কী যেন মনে করে অরার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো আরশাদ। তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে মনে মনে বলল, “সরি অরা। আমাকে এখন যেতেই হবে। কিন্তু তুমি চিন্তা কোরো না। তোমার ঘুম ভাঙার আগেই আমি ফিরে আসবো তোমার কাছে।”
(চলবে)
#ফিরে_আসা
৫১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
পুলিশের একটা চালাকির কারণে নওশীনের দুশ্চিন্তা একেবারেই কমে গেল। পুলিশ সাবের এবং হাসু মিয়াকে দিয়ে জোর করে ফোন করিয়েছে নওশীনকে। তারা দুজনেই আশ্বাস দিয়ে বলেছে, “অরাকে নিয়ে বর্ডারের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। আমরা পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে।”
কথাগুলো শুনে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল নওশীন। বুকের ওপর থেকে বিশাল এক পাথর নেমে গেছে। আজ সারাটাদিন তার কেটেছে দুশ্চিন্তার মাঝে। অরাকে নিয়ে পালাচ্ছে সাবের, অথচ এদিকে দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে ব্লাড প্রেসার বেড়াচ্ছে নওশীন। অবশেষে মিলল মুক্তি। অবশেষে আপদ বিদায় নিয়েছে আরশাদের জীবন থেকে। আপাতত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও বড় একটা কাজ এখনো বাকি হয়েছে গেছে। সেটা হলো আরশাদের জীবনে নওশীনের প্রত্যাবর্তন।
যে কোনো মূল্যেই হোক, আরশাদের জীবনে তার জায়গাটা আবার ফিরে পেতেই হবে। সারাদেশ অবাক হয়ে দেখবে, নওশীন হকের রিএন্ত্রি। সেসব নিয়ে এখন মাথা না ঘামালেও চলবে। যথাসময়ে উপযুক্ত প্ল্যান প্রয়োগ করা হবে।
ঘড়িতে প্রায় রাত দুটো। আশেপাশে শুনশান নীরবতা। এই বাড়িটা জনমানব থেকে কিছুটা দূরে নির্জনতার মাঝে তৈরি করেছিল আরশাদ। সেজন্যেই নওশীনের কোনো প্রতিবেশী নেই। সে কারণেই এই গভীর রাতে লাউডস্পিকারে গান বাজাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করলো না নওশীন। যদিও পাশের ঘরে কথা ঘুমোচ্ছে। তবে তাতে কোনো অসুবিধা নেই। কথার ঘুম তার বাবার মতোই গাঢ়।
গানটা তার এবং আরশাদের প্রথম সিনেমা ‘আয়না’র। উফ! কবে যে আরশাদের সঙ্গে তার নতুন সিনেমা আসবে! আর কবে যে সেই সিনেমার গান ঠিক এভাবেই লাউডস্পিকারে শুনতে পারবে নওশীন। তার যেন আর তর সইছে না।
বসার ঘরের ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিলো নওশীন। আজ তার জীবনের অন্যতম সেরা একটা দিন। নিজেকে বিরাট বিজয়ী বলে মনে হচ্ছে। বিজয়ীর হাসি হেসে নওশীন চোখ বুজে পড়ে রইলো ইজিচেয়ারে।
আচমকা একটা শব্দে চমকে উঠলো নওশীন। শব্দটা কলিংবেলের। এ বাড়িতে সাধারণত সন্ধ্যার পর কলিংবেল বাজে না। কাজের লোক, কথার টিচার – এরা সবাই এর আগেই বিদায় নেয়। যেখানে সন্ধ্যার পরই কলিংবেল বাজে না সেখানে রাত দুটোর সময়ে কলিংবেল বাজা অসম্ভব অস্বাভাবিক ব্যাপার। এই রাতে কে এলো আবার?
স্পিকারের গানটা বন্ধ করলো নওশীন। ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। ডাকাত-টাকাত পড়লো না-কি? না তা তো হবার নয়। মূল দরজায় সার্বক্ষণিক দুজন সিকিউরিটি গার্ড থাকে। তাহলে কে এল এখন?
লুকিং গ্লাসে চোখ রাখতেই আরেকদফা চমকে উঠলো নওশীন। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে আরশাদ। যে আরশাদ ডিভোর্সের পর এ বাড়িতে পা পর্যন্ত রাখেনি, সেই আরশাদ কলিংবেল বাজাচ্ছে? আরেকবার লুকিং গ্লাসে চোখ রাখলো নওশীন। সে ঠিক দেখছে তো?
কলিংবেল আবারও বেজে উঠলো। নওশীন আর দেরি না করে খুলে দিলো দরজাটা। আরশাদকে দেখে অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে। কাল ফোনে যে ঝাঁঝ নিয়ে আরশাদ কথা বলল, তার লেশমাত্র ফুটে উঠছে না তার মুখভঙ্গিতে। সাদা শার্ট, পরিপাটি চুল আর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা সূক্ষ্ম হাসির রেখায় তাকে খুবই শান্ত বলে মনে হচ্ছে।
নওশীন বুঝতে চেষ্টা করছে আরশাদের এখানে আসার পেছনে উদ্দেশ্য কী? সে কি নওশীনকে হুমকি-টুমকি দিতে এসেছে? অরাকে খুঁজে পাওয়া না গেলে নওশীনের খবর করে দেবে, এরকম কিছু?
নওশীন গলার স্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল, “তুমি? এত রাতে?”
আরশাদ সোজাসাপ্টা জবাব দিয়ে বলল, “কেন আসতে পারি না?”
নওশীন জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে বলল, “অবশ্যই! এসো, ভেতরে এসো।”
আরশাদ বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে হেয়ালীর স্বরে বলল, “আমি আসায় ঘাবড়ে গেলে না-কি?”
নওশীন আসলে ঘাবড়ে গেলেও তা চেপে রেখে বলল, “ঘাবড়াবো কেন? অবাক হচ্ছি। তুমি তো কখনো আসো না এখানে।”
“এতদিন প্রয়োজন পড়েনি তাই আসিনি। আজ প্রয়োজন পড়েছে।”
“কী প্রয়োজন?”
“বলবো, বলবো। এত তাড়াহুড়োর কী আছে?”
আরশাদের এই হেয়ালি মোটেও ভালো ঠেকছে না নওশীনের কাছে। এই আকস্মিক আগমনের পেছনের উদ্দেশ্যটা কী কে জানে! অরার নিখোঁজের পর থেকে আরশাদ তো কেমন উদভ্রান্তের মতো হয়ে গিয়েছিল। নওশীন টিভিতে দেখেছে, একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে সে পুলিশ স্টেশনে ঢুকছে। কাল যখন ফোনে কথা হলো, তখনো আরশাদের কণ্ঠস্বরে মিশ্রিত ছিল হাজারো উদ্বেগ। অথচ আজ সেই উদ্বেগের ছিটেফোঁটাও প্রকাশ পাচ্ছে না। কী হচ্ছে এসব?
আরশাদ বসার ঘরের চারিদিকে চোখ বোলাতে বোলাতে বলল, “কথা ঘুমিয়ে পড়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“ভালোই হলো, নির্বিঘ্নে কথা বলতে পারবো তোমার সাথে।”
“কী কথা?”
“তুমি এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন?”
আরশাদ নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে বসার ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। আর ওদিকে চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে নওশীন। এটাও কি আরশাদের নতুন কোনো চাল? তা তো অবশ্যই। যে মানুষটা তাকে সহ্য করতে পারে, তার তো আচমকা বাড়িতে এসে এমন স্বাভাবিক আচরণ করার কথা নয়।
আরশাদ বলল, “কতদিন পর এলাম এই বাড়িতে। ডেকোরেশনটা কী পাল্টে ফেলেছো?”
“হ্যাঁ, এবছরই।”
“সব ডিজাইন নিশ্চয়ই তোমার।”
“হুঁ।”
আরশাদ মুগ্ধ গলায় বলল, “আমি তোমাকে সহ্য করতে পারি না ঠিকই, কিন্তু একটা সত্যি অস্বীকার করার উপায় নেই। তোমার মাঝে ট্যালেন্টের অভাব নেই। চমৎকার ছবি আঁকার হাত তোমার। ডিজাইনিং স্কিলও অসাধারণ। আর অভিনয়ের কথা তো বাদই দিলাম। তোমার মতো গুণী অভিনেত্রী এই দেশ খুব কম পেয়েছে।”
নওশীন চুপ করে রইলো। প্রশংসায় বিগলিত বলে তাকে মনে হচ্ছে না। তার চোখেমুখে একরাশ প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছে, আরশাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য কী?
আরশাদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আফসোস! ট্যালেন্টের সদ্ব্যবহার করতে পারলে না। কিংবা হয়তো সেই চেষ্টাই করনি কখনো। সারাজীবন ফেমের পেছনে দৌঁড়ে গেছ। এজন্যেই তো আজ এই অবস্থা।”
“এর মানে?”
“একবার বলা কথা আমার বারবার এক্সপ্লেইন করতে ভালো লাগে না। বুঝে নাও।”
হুট করে আরশাদের চোখ পড়লো বসার ঘরের সেন্টার টেবিলের ওপরে। সোনালী রংয়ের একটা আস্ট্রেতে সিগারেটের ছাই জমা পড়ে আছে। পাশেই সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার।
আরশাদ ভ্রু ওপরে তুলে বলল, “এখনো স্মোক করো?”
নওশীন লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, “সবসময় না, মাঝে মাঝে। তুমি তো জানো শাদ, নার্ভ ঠিক রাখার জন্যে আমার এই জিনিসের প্রয়োজন পড়ে।”
“সেটা জানি। সিগারেট খাওয়া দোষের কিছু না। আমিও তো অনবরত সিগারেট খাই। তাই বলে বাসায় সিগারেট খাবে? মেয়েটা কী শিখবে তোমার কাছ থেকে?”
নওশীন সত্যের মতো করে মিথ্যা বলল, “আমি কথার সামনে স্মোক করি না তো! ও স্কুলে গেলে করি।”
আরশাদ মৃদু মাথা নেড়ে সোফায় বসতে। তার বসার ভঙ্গিতে কোনো তারাহুরো নেই। শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে যাচ্ছে নওশীনও তার দেখাদেখি আরশাদের মুখোমুখি থাকা সোফাটায় বসলো। আচ্ছা? এমন কি হতে পারে, অরা কিডন্যাপ হয়েছে, তাকে কোনোক্রমেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেজন্যে আরশাদ এখানে এসেছে নওশীনকে তার জীবনে ফিরিয়ে নিতে? নিজের ওপর নিজেই বিরক্ত হয়ে উঠলো নওশীন। এসব বোকামি চিন্তাভাবনা কী করে আসছে তার মাথায়?
আরশাদ হালকা গলায় বলল, “তারপর? তোমার প্রেম কেমন চলছে?”
নওশীন হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “প্রেম? কীসের প্রেম? এসব তুমি কী বলছো শাদ?”
“কেন? তোমার খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে! উফ! এই লোকটার নামই আমি বারবার ভুলে যাই। কী যেন নাম?”
নওশীন ক্ষীণ গলায় বলল, “কবির।”
“রাইট! কবির।”
নওশীন আহত গলায় বলল,“তোমার মনে হয় এখনো আমি ওর সঙ্গে প্রেম করে বেড়াচ্ছি?”
আরশাদ অবাক হবার ভান করে বলল, “বেড়াচ্ছো না?”
“না শাদ। ওসব তো সেই কবেই শেষ। মানুষ জীবনে বারবার ভুল করে না। একবারই করে।”
আরশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “ভুল?”
নওশীন আর্দ্র গলায় বলল, “হ্যাঁ, ভুল। আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল। তখন আমি কন্টিনিউয়াসলি ড্রাগস নিতাম শাদ। আমার মাথা কাজ করতো না। ঝোঁকের মাথায়, তোমার ওপরে রাগ করে…”
নওশীনকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আরশাদ ক্লান্ত গলায় বলল, “থাক, থাক! এত আগের কথা টেনে এনে আর ইমোশনাল হতে হবে না।”
“ভুল তো মানুষই করে। আবার মানুষই ক্ষমা করে। তুমি কি পারতে না আমাকে ক্ষমা করে দিতে?”
আরশাদ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “মানুষ একবার ভুল করলে তাকে না হয় ক্ষমা করা যায়। কিন্তু তাই বলে বারবার?”
“মানে?”
“বললাম না এত এক্সপ্লেইন করতে ভালো লাগে না!”
মানেটা ঠিক বুঝতে পারলো না নওশীন। প্রসঙ্গটা তাই পাল্টে দিয়ে বলল, “তুমি কেমন আছো? কেমন চলছে তোমার জীবন?”
আরশাদ ফুর্তির ভঙ্গিতে বলল, “একদম ফার্স্ট ক্লাস! কপাল করে একটা বউ পেয়েছি জানো। আমাকে এত ভালোবাসে!”
নওশীন আচমকা আঁতকে উঠে বলল, “ওই মেয়েটা…”
নিমিষেই নিজেকে সামলে নিলো নওশীন। আরশাদের সামনে এমন আঁতকে ওঠা যাবে না। শান্ত রাখবে হবে নিজেকে।
নওশীন গলায় স্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, “তোমার বউকে না কিডন্যাপ করা হয়েছিল? পেয়েছো কোনো খোঁজ?”
আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,“পেয়েছি তো। শুধু খোঁজ না। আস্ত বউটাকেই খুঁজে পেয়েছি?”
এবার আর নিজের ভেতরকার অনুভূতি গোপন করার চেষ্টা করলো না নওশীন। দ্বিতীয়দফা আঁতকে উঠে বলল, “মানে? কখন? কোথায়? কীভাবে?”
আরশাদ রহস্যের হাসি হেসে বলল, “ওরে বাবা! তোমার দেখি বিরাট কিউরিসিটি।”
নওশীনের মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন চোর চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে নওশীন বলল, “জ্বলজ্যান্ত একটা মেয়েকে কিডন্যাপ করা হলো, কিউরিসিটি তো থাকবেই।”
আরশাদ বাঁকা হাসি হেসে বলল, “কখন এবং কীভাবের উত্তর না জানলেও কোথায়ের উত্তর নিশ্চয়ই তুমি জানো!”
নওশীন কম্পিত স্বরে বলল, “এসব কী বলছো তুমি শাদ? আমি কী করে জানবো?”
“প্রায় চার বছর আগে, বর্ষাকালে, ওখানেই তো নিয়ে গিয়েছিলে আমাকে। মনে নেই?”
মনে মনে আকাশ থেকে পড়লো নওশীন। তার বুঝতে বাকি রইল না ওই জায়গাটা খোদ আরশাদই খুঁজে বের করেছে। রাগে-ক্ষোভে নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে। ওই জায়গাটা যে আরশাদ খুঁজে বের করতে পারে, এই চিন্তা একবারও আসেনি তার মাথায়। তার মানে কী? সাবেরও ধরা পড়ে গেছে? তাহলে একটু আগে যে তাকে ফোন করে বলল, বর্ডারের কাছে পৌঁছে গেছে।
নওশীনের পৃথিবীটা প্রচন্ড এক ঘূর্ণির ন্যায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এসব কী হচ্ছে তার সঙ্গে। মনে মনে ব্যস্ত হয়ে উঠলো মোবাইলের কাছে যাওয়ার জন্যে। সাবেরকে কল করার জন্যে। কিন্তু আরশাদ সামনে থাকার কারণে তা আর সম্ভব হলো না। পাথরের মতো জমে রইলো নওশীন।
এক পর্যায়ে মনে হলো হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। যেকোনো পর্যায়ে হোক, তাকে শেষ পর্যন্ত অভিনয় করে যেতে হবে।
নওশীন চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না…”
আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “থাক নওশীন! এত কষ্ট করে আর অভিনয় করতে হবে না। নার্ভাস থাকলে তুমি এমনিতেই ভালো অভিনয় করতে পারো না।”
“তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে শাদ। আমি কেন এই কিডন্যাপিংয়ের সাথে জড়িত থাকতে যাবো?”
আরশাদ বাঁকা হাসি হেসে বলল, “আমি কি একবারও বলছি তুমি জড়িত?”
আরেকদফা ঘাবড়ে গেল নওশীন। ঝোঁকের মাথায় বারবার ভুল করছে সে।
আরশাদ পকেট থেকে নিজের মোবাইলটা বের করলো। খানিকক্ষণ ঘাটাঘাটি করে একটা অডিও প্লে করে দিয়ে বলল, “দেখো তো! কথাগুলো চেনা চেনা লাগছে কিনা?”
আরশাদের ফোনে বেজে উঠলো একটা কল রেকর্ড। নওশীনের কণ্ঠে শোনা গেল, “পুলিশ তোমাদের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। একবার ধরা পড়ে গেলে কী হবে বুঝতে পারছো? শাদ ওই মেয়েটাকে তো পেয়েই যাবে, সাথে সাথে তোমাকেও জেলে যেতে হবে!”
সাবের ভয়ার্ত গলায় বলল, “আমাকে জেলে যেতে হবে কেন? এসব প্ল্যান তো আপনার।”
“পুলিশ তোমার কথা বিশ্বাস করবে কেন?”
নওশীন বিস্ময়ের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে গেল। এই কল রেকর্ড কী করে পৌঁছালো আরশাদের হাতে? সে তো ভিন্ন একটা সিম থেকে কথা বলেছিল সাবেরের সঙ্গে!
ধরা পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও আত্মরক্ষার চেষ্টায় কোনো কমতি রইল না নওশীনের। তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো, “এটা আমার ভয়েস না শাদ। কেউ আমার ভয়েস নকল করে…”
আরশাদ ঘৃণাভরা চোখে বলল, “আর কত মিথ্যা বলবে নওশীন? মিথ্যা বলতে বলতে তো বিষিয়ে ফেলেছো নিজেকে।”
নওশীন চুপ করে রইলো। এসব কী হয়ে গেল? তার চোখের সামনে তার সাজানো পারফেক্ট প্ল্যান তছনছ করে ভেঙে পড়ছে?
আরশাদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তুমি যে নিকৃষ্ট আমি জানতাম। তবে এতটা নিকৃষ্ট এটা আমার জানা ছিল না। টাকা খাইয়ে আমারই বউকে অন্য একটা ছেলের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলে তুমি? কোন সাহসে? তোমার ধারণা আমি তোমাকে ক্ষমা করিনি? ক্ষমা করেছি বলেই তো এতদিন সম্মান নিয়ে সমাজে বেঁচে ছিলে। আমি তো চাইলেই পারতাম তোমার সব কুকীর্তি মিডিয়ার ফাঁস করে দিতে। তোমার আসল মুখোশটা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। আমার সন্তানের মা হিসেবে সম্মান করেছিলাম। তাই এখনো সেসব কথা কেউ জানে না।”
নওশীন নিশ্চুপ হয়ে শুনে গেল আরশাদের কথা। তার কাছে আর বলার মতো কোনো কথাই বাকি নেই।
আরশাদ আবারও বলল, “কিন্তু আর কতদিন? আফটার অল, আমার সন্তানের মা হলেও তুমি একজন নোংরা মনের মানুষ।”
আচমকা উঠে দাঁড়ালো আরশাদ। পা বাড়ালো ভেতরের ঘরের দিকে।
নওশীন আঁতকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
“শাদ? কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
আরশাদ হাঁটতে হাঁটতে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “কথার কাছে।”
নওশীন এবার বুঝতে পারছে আরশাদের এখানে আগমনের পেছনে উদ্দেশ্য কী! কথাকে তার কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া। তবে তা কী করে হতে পারে? মেয়েকে ছাড়া কী করে থাকবে সে?
“না শাদ! তুমি আমার কাছ থেকে আমার মেয়েকে আলাদা করতে পারো না।”
আরশাদ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “তোমার কি ধারণা? সবকিছু জেনে বুঝে আমি আমার মেয়েকে তোমার মতো জঘন্য একটা মানুষের কাছে থাকতে দিবো? এক সেকেন্ডের জন্যেও না?”
নওশীন মিনতির স্বরে বলল, “শাদ প্লিজ! আমি যেমনই হই না কেন, কথাকে আমি নিজে থেকেও বেশি ভালোবাসি।”
কথার ঘরে ঢুকে পড়লো আরশাদ। নওশীন দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। আতঙ্কে তার হাত-পা কাঁপছে রীতিমত। কথা গুটিশুটি মেরে বিছানায় ঘুমোচ্ছে। অন্ধকার ভয় পায় বলে রাতে সবসময় তার ঘরে ডিম লাইটের আলো জ্বলে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
আরশাদ মেয়ের গায়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল, “মা? মা ওঠ!”
খানিকক্ষণ ডাকাডাকির পর অবশেষে ঘুম ভাঙলো কথার। চোখদুটো কচলে আরশাদের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত স্বরে বলল, “বাবা তুমি?”
আরশাদ প্রচ্ছন্ন হাসি হেসে বলল, “হ্যাঁ! তোকে নিতে এসেছি। কতদিন বাবার কাছে যাস না!”
“তুমি ভুলে গেছ? আমার এক্সাম চলছিল তো!”
“তাই তো! এখন এক্সাম শেষ?”
কথা বাবার কোলে উঠে বসে বলল, “হ্যাঁ। কালকেই শেষ হয়েছে।”
“তাহলে এখনই আমরা যাবো, ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে।”
“তুই প্যাকিং শুরু করে দে, আমি এক্ষুনি এসে হেল্প করছি। আর শোন! তুই সবসময় বলিস না, এবার বাবার কাছেই থেকে যাবি। আর এখানে ফিরে আসবি না।”
“বলি তো!”
“এবার কিন্তু সত্যি সত্যিই বাবার কাছে থেকে যেতে হবে।”
অরা কৌতূহলী গলায় বলল, “কেন বাবা? মা কোথায় যাবে?”
আরশাদ মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বলল, “মা বেড়াতে যাবে। লম্বা একটা ভ্যাকেশন।”
কথা মনের আনন্দে উৎফুল্ল ভঙ্গিতে নিজের প্রিয় খেলনা গুলো প্যাক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আরশাদ বেরিয়ে এল কথার ঘর থেকে। একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে বসার ঘরের দিকে। তার পিছু পিছু নওশীন ঝড়ের গতিতে হাঁটতে হাঁটতে বলছে, “এসবের মানে কী শাদ? তুমি কী বললে কথাকে? আমি বেড়াতে যাবো মানে?”
প্রশ্নটার জবাব আরশাদ দিলো না। বাড়ির মূল দরজাটা খুলে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে নওশীন দেখতে পেল পুলিশ ফোর্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাথরের ন্যায় জমে গেল নওশীন। বারবার কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে, তবে পারছে না।
পুলিশ অফিসার গম্ভীর স্বরে বললেন, “নওশীন হক! You are under arrest.”
নওশীন অবাক চোখে একবার দেখছে আরশাদকে আরেকবার অফিসারকে।
পুলিশ অফিসার আবারও বললেন, “আফরোজা অরার অপহরণের মূল পরিকল্পনা করার অভিযোগে আপনাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।”
নওশীন চমকে উঠে বলল, “শাদ! তুমি আমার সাথে এমনটা করতে পারো না।”
“কেন পারি না?”
নওশীন চোখের জল ফেলে বলল, “কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি!”
আরশাদ সঙ্গে সঙ্গে বলল, “আর আমি তোমাকে ঘৃণা করি। এই পৃথিবীর সবথেকে জোরালো অনুভূতি ভালোবাসা নয়, ঘৃণা।”
ধপ করে সোফার ওপরে বসে পড়লো নওশীন। তার চোখ বেয়ে অনবরত জল পড়ছে। এটা কী করলো সে? নওশীন ভেবেছিল সে যত বড় অপরাধই করুক না কেন, সন্তানের মা হবার সুবাদে আরশাদ ঠিকই বাঁচিয়ে নেবে তাকে। সেই আরশাদই শেষমেশ তাকে ধরিয়ে দিচ্ছে?
আরশাদ ক্রুব্ধ স্বরে বলল, “আমার থেকে ভালো করে তোমাকে কেউ চেনে না নওশীন। ভালোবাসা-টালোবাসা কিছু না। আমার কাঁধের ওপর ভর করে নিজের ক্যারিয়ার বাঁচাবে বলেই এত বড় প্ল্যান করলে, তাই না?”
নওশীন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আরশাদের বলা প্রতিটি শব্দ সত্যি। তবুও তা স্বীকার করে নিতে অসস্তি হচ্ছে তার।
আরশাদ আবারও বলল, “আমার ওপর নির্ভর না করে যদি আজ নিজের ট্যালেন্টের ওপর নির্ভর করতে তাহলে সত্যিই তোমার ক্যারিয়ার ঘুরে দাঁড়াতো। কিন্তু তোমার মাথায় তো আর প্যাঁচ ছাড়া কিছুই কাজ করে না। নিজের খারাপ রূপটা সামনে এনেছো। এবার আমার খারাপ রূপ দেখবে। যতক্ষণে পুলিশের ভ্যান তোমাকে থানায় নিয়ে যাবে ততক্ষণে পুরো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে যাবে তোমার আর ওই কবিরের ইন্টিমেট ছবি। সবাই দেখবে, আর তোমার ওপরে ঘৃণার বর্ষণ করবে।”
নওশীন অবিশ্বাসের চোখে আরশাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “এতকিছু, শুধুমাত্র ওই একটা মেয়ের জন্যে?”
আরশাদ সূক্ষ্ম হাসি হেসে বলল, “না। আমার নিজের জন্যে। তোমাকে সম্মানের সঙ্গে বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে নিজে বারবার অপমানের শিকার হয়েছি। মানুষ তোমার বদলে আমাকে চরিত্রহীন ডেকেছি। মুখ বুজে সহ্য করেছি। বারবার ডিপ্রেশনে পড়েছি। আর কত? তুমি সীমা লঙ্ঘন করেছো না? এবার তো আমাকেও সীমা লঙ্ঘন করতে হবে।”
পুলিশ এগিয়ে এসেছে নওশীনের হাতে হ্যান্ডকাফ পড়াতে। নওশীন উঠে দাঁড়ালো মনের অনিচ্ছায়।
আরশাদ হালকা গলায় বলল, “যাই! কথার অনেক প্যাকিং বাকি। Have a safe journey.”
(চলবে)