#ফিরে_আসা
৫২
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
একটার পর একটা অভিযোগ এসেই যাচ্ছে নওশীনের বিরুদ্ধে। আরশাদের করা অপহরণের মামলার ভিত্তিতে তার নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়। তবে গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তার বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা করে। তল্লাশির সময় তার বাড়ি থেকে পাওয়া যায় কয়েক গ্রাম মাদকদ্রব্য। পরিমাণ অল্প হলেও মাদক মামলা কঠিন জিনিস। এতসবের পর আচমকা কোথা থেকে যেন উদয় হয়েছে কবির। আজ সকালে সে নওশীনের নামে আরেকটি মামলা করে। গর্ভপাতের মামলা। বাংলাদেশে গর্ভপাত আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
এতসব অপরাধের ভীড়ে সাধারণ জনগণ বড় করে দেখছে ওই একটা অপরাধকে। সুপারস্টার আরশাদকে চিট করার অপরাধ। ইন্টারনেটে ভেসে বেড়াচ্ছে নওশীন এবং কবিরের ওই ঘনিষ্ট ছবিগুলো। লোকে দেখছে আর ছি ছি করছে। ইন্টারনেট আজ উত্তপ্ত এই একটি খবরেই।
ঠিক বেলা বারোটায় কোর্টে তোলা হবে নওশীনকে। পুলিশ সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করবে। ওদিকে নওশীনের আইনজীবীও জামিনের আবেদন করবে। তবে সমস্যা হচ্ছে আইনজীবীর গাড়ি কোর্টের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। উৎসুক জনতা তাকে কিছুই কোর্টে যেতে দেবে না। রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়ছে সকলে। এমন একটা ভাব যেন নওশীনের পক্ষে দাঁড়ানোতে এই আইনজীবীকেও তারা গিলে খাবে। পুলিশ ব্যস্ত ভঙ্গিতে এই ভিড় সরাতে ব্যস্ত।
কোর্টের সামনে হাজারো মানুষের ভিড়। কেউ এসেছে একা, আবার কেউ দল বেঁধে। একে তো সেলিব্রিটিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তার ওপরে আবার এই কেসের সঙ্গে জড়িত আরশাদ হক। মানুষের আগ্রহের যেন কোনো কমতি নেই। টিভি-চ্যানেলগুলো এখানকার অবস্থা সরাসরি সম্প্রচার করছে। কয়েকজন তরুণী মেয়ে দলবেঁধে এসেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা আরশাদের বিরাট ভক্ত। নওশীনের প্রতি ক্ষোভ ঝাড়তেই তাদের এখানে আসা।
একটা মেয়ে তেজী ভঙ্গিতে ক্যামেরার সামনে বলল, “এইরকম নির্লজ্জ, চরিত্রহীন মহিলাকে আর এক সেকেন্ডও দেশে রাখা উচিত না। ওকে এক্ষুনি দেশ থেকে বের করে দেওয়া উচিত।”
তরুণীর তেজে ঘাবড়ে গিয়ে সাংবাদিক বলল, “নওশীন হকের প্রতি আপনার এত রাগ কেন?”
মেয়েটি আবারও তেজে আগুনের ন্যায় জ্বলে উঠে বলল, “কারণ এই বেয়াদব মহিলা আরশাদের ওপর চিট করছে। অন্য একজনের বাচ্চাকে আরশাদের বলে চালায় দেওয়ার চেষ্টা করছে। ডিভোর্স তো তোর কারণেই হইছে। তাহলে এখন যখন আরশাদ নতুন করে সংসার শুরু করছে তখন তোর এত জ্বলে কেন? আরশাদের বউকে কিডন্যাপ করে ভাবছিল আবারও আরশাদ ওকে ঘরে তুলবে। কক্ষনো না!”
পেছন থেকে আরেকটা মেয়ে একই ভঙ্গিতে বলল, “এই মহিলাকে মেন্টাল অ্যাসাইলামে পাঠানো উচিত!”
বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এমন অনেকের ইন্টারভিউ নিচ্ছে। অথচ একটা মানুষও পাওয়া গেল না যে কিনা নওশীনের পক্ষে। অবশ্য নিজের পক্ষে কাউকে পাওয়ার মতো কাজ সে করেনি। প্রতিটা মানুষ আজ ঘৃণা ছড়াচ্ছে তার প্রতি। নিজের দোষেই এমন পরিণতির শিকার সে।
হঠাৎ সব ক্যামেরাগুলো ঘুরে গেল কোর্টের মূল দরজার দিকে। গাঢ় নীল রঙের পুলিশ ভ্যান এসে থেমেছে। হাতে হ্যান্ডকাফ পড়া নওশীনকে বের করে আনা হচ্ছে। তাকে দেখে জনতার রাগ যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। একদল পুলিশ সামনের ভিড় সরাতে ব্যস্ত। পুলিশ জায়গা ফাঁকা করে দিচ্ছে আর কয়েকজন মহিলা পুলিশ তাকে কোর্টের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা প্লাস্টিকের স্যান্ডেল উড়ে এসে নওশীনের গায়ে লাগলো। হকচকিয়ে চোখ তুলে তাকালো সে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পরপর আরও কয়েকটা স্যান্ডেল তার গায়ে লাগলো। পুলিশ দ্রুত গতিতে কোর্টের দিকে আগাচ্ছে। নওশীন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে চারদিকে জমে থাকা জনগণের ভিড়ে। এই সবগুলো মানুষ তাকে এতটা ঘৃণা করে?
পুরো দৃশ্যটা টিভিতে লাইভে দেখলো অরা। ঘুম ভাঙতেই সে আঁতকে ওঠে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে মনে হচ্ছিল, এখনো সে বন্দী হয়ে আছে সাবেরের কাছে। যখন উপলব্ধি হলো সে আর বন্দী নেই, নিরাপদে আছে নিজের বাড়িতে – তখনই ভয়টা কেটে গেল। তবে তার তৃষ্ণার্ত চোখদুটো ব্যস্ত খুঁজতে লাগলো আরশাদকে। তাকে আশেপাশে কোথাও খুঁজে না পেয়ে নিচে নেমে আসে অরা।
বসার ঘরের টিভিতে কে যেন আগে থেকেই নিউজ ছেড়ে রেখেছিল। টিভির দিকে চোখ পড়তেই স্তম্ভের ন্যায় দাঁড়িয়ে যায় অরা। নওশীনকে লক্ষ্য করে ক্ষিপ্ত জনগণ স্যান্ডেল ছুঁড়ে মারছে, এই দৃশ্য দেখে তার বুকটা হুহু করে কেঁপে উঠলো। যদিও অরার মনে তার জন্যে ঘৃণা জমা উচিত। এই নওশীনের কারণেই তার জীবনের সবথেকে বাজে দুটো দিন এসেছিল। ওই দুটো দিনে বারবার সে মুক্তির জন্যে আকুতি করছে। বারবার তার মনে সংশয় জাগছিল, আর কোনোদিন আরশাদের কাছে ফিরে আসতে পারবে কিনা। সবটাই নওশীনের কারণে।
সাবেরের কাছে বন্দী থাকা অবস্থায় অরা যখন জানতে পেরেছিল, এসবের পেছনে নওশীন রয়েছে তখনও ঘৃণায় তার মনটা বিষিয়ে উঠেছিল। তবে আজ এই দৃশ্যটা দেখে তার মনে মায়া জাগলো। আহারে! কী অনিন্দ্য সুন্দর চেহারা মানুষটার, কী মিষ্টি ব্যবহার! কেন যে তাকেই এমন নোংরা মনের অধিকারী হতে হলো।
হঠাৎ অরা অনুভব করলো কেউ একজন পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। সেই কেউ একজনটা যে আরশাদ তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। মৃদু কেঁপে উঠলো অরা। আরশাদের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর স্পর্শে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলে সে।
বহুকষ্টে নিজেকে সামলে অরা মলিন কণ্ঠে বলল, “এসবের কী দরকার ছিল?”
আরশাদের বুঝতে মোটেও অসুবিধা হলো না অরা কোন দিকে ইঙ্গিত করছে। তাদের সামনে টিভিতেই নওশীনের কেসটা লাইভ সম্প্রচার করা হচ্ছে। একজন সাংবাদিক মাইক হাতে ক্যামেরার সামনে পরিস্থিতির সর্বশেষ বর্ণনা করছে।
আরশাদ স্বাভাবিক গলায় বলল, “এই কথা তুমি বলছো? আমি তো ভেবেছিলাম, তুমি চাও ওর একটা শাস্তি হোক।”
“চাই। তাই বলে এত বড় শাস্তি?”
“যত বড় অপরাধ, তত বড় শাস্তি তো পেতেই হবে অরা।”
“পুরনো কথাগুলোও ফাঁস করে দিয়েছেন?”
আরশাদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আজ আমার অনেক হালকা লাগছে অরা। ওই কথাগুলো এতদিন নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছি, আর মানুষের কটাক্ষের শিকার হয়েছি। আর কত? আমি জানতাম এই দিনটা আসবে। প্রকৃত সত্যিটা সবাই জানবে।”
হঠাৎ অরা কী যেন মনে করে বলল, “কথা?”
আরশাদ তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “ওপরে ঘুমাচ্ছে।”
আরশাদ অরাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে কপালে হাত দিয়ে বলল, “জ্বরটা এখনো কমেনি তো! চলো, ব্রেকফাস্ট করবে। একটু পর ডক্টর তোমার চেকআপ করতে আসবে।”
ব্রেকফাস্ট করতে যাওয়ার আগে অরা ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে গেল কথার ঘরের দিকে। আরশাদও তার পিছু নিল। ব্যাঙ্কেটের নিচে লুকিয়ে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা। কাল মাঝরাতে আরশাদ তাকে তুলে দেওয়ার পর আর ঘুমায়নি। ঘুমিয়েছে সকালে। অরা বিছানায় কথার পাশে বসলো। আরশাদ বসলো আরেক পাশে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে অরা হাত বুলিয়ে দিচ্ছে কথার মাথায়। খারাপ পরিস্থিতির আঁচ এই মেয়েটার ওপরে পড়তে দেওয়া যাবে না। কিছুতেই কথার শৈশবটাকে ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না। অরা নিজে সুন্দর একটা শৈশব পায়নি। তাই সে জানে এই সময়টা কত মূল্যবান।
অরা নিচু স্বরে বলল, “উনাকে ওর সামনে অ্যারেস্ট করা হয়নি তো?”
আরশাদ শান্ত গলায় বলল, “না অরা। আমি জেনেবুঝে আমার মেয়েটাকে ট্রমাটাইজড করবো?”
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অরা বলল, “একটা রিকুয়েস্ট করবো?”
“করো।”
“কথাকে কোনোদিনও জানতে দেবেন না ওর মায়ের জীবনের বাজে অধ্যায়গুলো।”
আরশাদ ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “তুমি না বললেও দিতাম না। বাচ্চাদের একমাত্র ভরসার আশ্রয় তাদের বাবা এবং মা। তারা যখন জানতে পারে সেই দুজনের একজন ভালো মানুষ নয়, তখন তাদের পৃথিবীটাই এলোমেলো হয়ে যায়। যেমন আমি! খুব কম বয়সে আমি জানতে পেরেছিলাম, আমার বাবা একজন খারাপ মানুষ।”
আরশাদ নিজের হাতে নাস্তা খাইয়ে দিলো অরাকে। ডক্টর ইশতিয়াক সাড়ে বারোটার দিকে এলেন চেকআপ করতে। অরা এখন মোটামুটি সুস্থ। তবে প্রচুর রেস্ট নিতে হবে। গত দুদিনে নেহায়েত কম ধকল যায়নি তার ওপর দিয়ে। সেই সঙ্গে লিখে দিয়ে গেলেন একগাদা ওষুধ। একেকটা ওষুধ মাসখানেক খেতে হবে। কয়েকটা ওষুধ তো ছয় মাস পর্যন্ত খাওয়ার নির্দেশ দিয়ে গেছেন তিনি। ওষুধ খাওয়ার প্রতি অরার যতটা অনীহা, ঠিক ততটাই কড়াকড়ি আরশাদের। ওষুধ খাওয়ার পুরো সময়টায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখেছে, যেন একটাও বাদ না যায়।
দিনের বাকিটা সময় আরশাদ অরার পাশেই কাটালো। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে তার জীবনে। ভেতরে ভেতরে মেয়েটা নিশ্চয়ই অনেক ঘাবড়ে গেছে। পাশে থেকে আরশাদ তাকে আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করছে, এখন আর তার কোনো ভয় নেই। অরার আরশাদের আশেপাশে বিচিত্র এক নিরাপদ অনুভূতি অনুভূত হচ্ছে। আরশাদের কর্মকান্ডে ক্রমেই অবাক হয়ে যাচ্ছে না। ইন্ডাস্ট্রির সবথেকে ব্যস্ত তারকা, যায় স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার সময় পর্যন্ত নেই সে কিনা সব শিডিউল ক্যানসেল করে তার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে। এটাও বিশ্বাসযোগ্য?
সন্ধ্যার দিকে সীমা এলো অরাকে দেখতে। প্রিয় বান্ধবীকে এতদিন পর দেখে অরার মনটা আরও ভালো হয়ে গেল। এদের দুজনকে একা ছেড়ে দিয়ে আরশাদ চলে গেল বসার ঘরে। নতুন ম্যানেজার অয়নকে ডেকে পাঠিয়েছে। এই ছেলেটার কাজ যথেষ্ট গোছানো হলেও সে অরার মতো এক্সপার্ট না। কী আর করা?
শোবার ঘরের সোফায় পা তুলে বসে আছে সীমা। তার পাশেই অরা।
সীমা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “আজ সকালে কোর্টের সামনে গিয়েছিলাম বুঝলি।”
অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “কেন?”
সীমা এমনভাবে অরার দিকে তাকালো যেন তার মতো বোকা মেয়ে এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই।
“কেন আবার? মজা দেখতে! উফ! কী যে মজা হয়েছে অরা! মানুষ ঝাঁকে ঝাঁকে ওই শাকচুন্নির গায়ে স্যান্ডেল ছুঁড়ে মেরেছে।”
অরা গম্ভীর গলায় বলল, “একটা মানুষের গায়ে স্যান্ডেল ছুঁড়ে মারা হচ্ছে, এটা তোর কাছে মজার ঘটনা?”
সীমা রাগী কণ্ঠে বলল, “ভালোমানুষী করবি না তো! খবরদার ভালোমানুষী করবি না। যে মহিলার কারণে তোকে কিডন্যাপ হতে হলো, তার প্রতি এত দরদ কীসের রে?”
“একটা মানুষ হিসেবে আরেকটা মানুষের প্রতি দরদ থাকবে না?”
সীমা হুমকির ভঙ্গিতে বলল, “না থাকবে না! আর একবার ভালোমানুষী করলে থাপ্পড় দিয়ে তোর গাল ফাটিয়ে ফেলবো।”
অরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলো।
সীমা আবারও দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলতে লাগলো, “তারপর শোন না কী হলো! একদল ঠিক করলো ওই মহিলার পুতুল বানিয়ে আগুনে পোড়াবে। কিন্তু কোর্টের সামনে বাঁশ পায় কই? শেষমেশ গাছের ডাল দিয়ে অখাদ্য দেখতে একটা পুতুল বানালো। তার কম্পিউটারের দোকান থেকে ওর একটা ছবি প্রিন্ট করিয়ে আনলো। মাথার জায়গায় ছবিটা বসানো হলো। এই পুতুল পোড়ানোটা তো টিভিতেও দেখানো হয়েছে। তুই দেখিসনি?”
অরা ক্লান্ত স্বরে বলল, “না। টিভি খুললেই এই এক টপিক। বিরক্ত লাগে।”
কিছুটা সময় চুপ করে থেকে সীমা নরম স্বরে বলল, “তোর খুব কষ্ট হয়েছিল না? তোকে সারাদিন বেঁধে রেখেছিল তোকে?”
অরা কাতর স্বরে বলল, “সীমা, এসব নিয়ে আর কথা না বলি প্লিজ?”
সীমা প্রচ্ছন্ন একটা হাসি হেসে বলল, “আচ্ছা।”
সীমা চুপ করে আছে। একটা কথা অরাকে জানাবে বলে সেই কবে থেকে তার মনটা ছটফট করছে। আজ যখন অবশেষে সেই সুযোগ পেয়েছে তখন কথাটা শুরু কী করে করবে বুঝতে পারছে না।
এক পর্যায়ে ভাবনা-চিন্তায় বিসর্জন দিয়ে সীমা বলল, “শোন না! তোকে একটা কথা বলা হয়নি।”
“কী কথা?”
“আমি না…”
কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল সীমা।
অরা বলল, “তুই কী?”
সীমা ইতস্তত করে বলল, “আমি না ওই সিঙ্গাপুরীকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি।”
অরা চমকে উঠলো। তার ঠোঁটে চওড়া একটা হাসি ফুটে উঠলো। হাসিতে ঝলমল করছে সে।
অরা ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে বলল, “মানে? তুই সত্যি বিয়ে করবি?”
সীমা লজ্জিত ভঙ্গিতে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।
অরা কৌতূহলী গলায় বলল, “কখন হলো এসব?”
“বেশিদিন আগে না। তুই আর ভাইয়া কয়েকদিন আগে বেড়াতে গেলি না? তখন।”
অরা মেকি অভিমান নিয়ে বলল, “এত বড় ঘটনা ঘটে গেল, আর আমি কিছুই জানলাম না?”
“আরে বাবা আমি তো সেদিনই ফোন করো বলতাম, তুই ছিলি নেটওয়ার্কের বাইরে। বলবো কী করে?”
“আচ্ছা বাদ দে! শুরু থেকে বল, কীভাবে কী হলো?”
“ওই সিঙ্গাপুরী…”
অরা বাঁধা দিয়ে বলল, “কথাটা সিঙ্গাপুরিয়ান হবে সীমা!”
সীমা জোর গলায় বলল, “আমি সিঙ্গাপুরীই ডাকবো!”
“কেন বেচারার নাম নেই?”
সীমা হালকা লজ্জা পেয়ে বলল, “এনায়েত! তবে আমি বাবা সিঙ্গাপুরীই ডাকছি। গত সপ্তাহে বাড়িতে যাই। ওই ছেলেও না-কি তখন ওখানে। মা বলল যা গিয়ে দেখা করে আয়। আমি প্রথমে না না করলেও পরে মায়ের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে দেখা করতে যাই। ছেলেটার ছবি দেখেছিলাম আগে। দেখতে ভালো হলেও আমার কেন জানি মনে হয়েছিল চেহারায় একটা বেয়াদব বেয়াদব ভাব। তার ওপরে আবার বিদেশফেরত ছেলে। নির্ঘাত ভাব বেশি হবে। ওমা! দেখা করতে গিয়ে দেখি ছেলে অসম্ভব বিনয়ী। আর সামনা-সামনি দেখতে ছবির থেকেও বেশি হ্যান্ডসাম।”
অরা মজার ছলে বলল, “ছেলের বর্ণনা দিতে গিয়েই এত লজ্জা পাচ্ছিস? বিয়ের পর না জানি কী হয়!”
“আরে ধুর! শোন তো! কথা বলতে গিয়ে দেখলাম ওর আর আমার মধ্যে অনেককিছু কমন আছে। এই যেমন আমার সমুদ্র ভালো লাগে, ওরও তাই। আমি হরর সিনেমা দেখতে গেলে হাসতেই থাকি, ও না তাই করে। ওই এক দেখায় এমন কতগুলো মিল যে খুঁজে বের করেছি তুই গুণে শেষ করতে পারবি না। বাড়ি ফেরার পর মা রিপোর্ট জানতে চাইলো। আমি চুপ করে রইলাম। রাতে খেয়েদেয়ে যখন ঘুমাতে যাবো তখন শুনি মাকে ওই ছেলের মা ফোন করেছে। ওই ছেলে না-কি বাসায় গিয়ে বলেছে বিয়ে করলে আমাকেই করবে। আর কাউকে নয়।”
অরা মুগ্ধ গলায় বলল, “ভাবা যায়? যে ছেলেকে বিয়ে করবি না বলে চার বছর ফ্যামিলির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখলি না, সেই ছেলেই কিনা এমন কথা বলছে।”
“আসলেই আশ্চর্যের ব্যাপার!”
অরা আনন্দে ঝলমল করে বলল, “আমি খুব খুশি হয়েছি সীমা। দেখবি! তোর সিঙ্গাপুরী তোকে অনেক ভালো রাখবে।”
সীমা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “আগামী মাসে ওরা চৌদ্দ গুষ্টি নিয়ে অফিসিয়ালি আমাকে দেখতে আসবে। সেদিনই পানচিনি হবে। তুই যাবি তো?”
“এটা আবার জিজ্ঞেস করার কী আছে রে? অবশ্যই যাবো।”
অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “সীমা শোন, তোকেও একটা কথা বলা হয়নি।”
“কী?”
“আমরা যখন বেড়াতে গেলাম না? তখন উনি বলে দিয়েছে, এক বছর পর কোনো ডিভোর্স-টিভোর্স হবে না।”
সীমা হাস্যোজ্বল গলায় বলল, “আমি জানতাম! তুই কিডন্যাপ হবার পর ভাইয়ার চোখে তোর জন্য অনেক ভালোবাসা দেখেছি। আর এখন তোর চোখে দেখছি।”
তাদের কথার মাঝে ঘরে হঠাৎ আগমন ঘটলো কথার। মেয়েটা ছুটছে ছুটছে এসে বসলো অরার পাশে। তার হাতে একটা পুতুল।
কথা পুতুলটা অরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “অরা দেখো! আমি বার্বির চুল বাঁধার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই পারছি না।”
অরা হাসিমুখে বলল, “আচ্ছা দাও, আমি বেঁধে দিচ্ছি।”
“আমার মতো করে বাঁধবে কিন্তু!”
সীমা মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগলো দুজনের খুনশুটি। কথা খুব সহজেই আপন করে নিয়েছে অরাকে। ছোট ছোট কাজেও তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে।
সীমা হঠাৎ অন্যমনস্ক গলায় বলল, “তোর ওপর অনেক বড় একটা দায়িত্ব এসে পড়লো। ঠিকমতো খেয়াল রাখতে পারবি তো কথার?”
অরা দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “অবশ্যই পারবো। তুই তো জানিসই আমি কথাকে কতটা ভালোবাসি।”
কথা উৎফুল্ল গলায় বলে উঠলো, “আমিও তোমাকে ভালোবাসি অরা।”
“লবণের মতো?”
“হ্যাঁ! লবণের মতো।”
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় কাল রাতের লজ্জায় পড়লো অরা। কীভাবে কাল রাতে আরশাদের বুকে ঢলে পড়েছিল! ভাবতেই লজ্জায় রক্তিম হয়ে যাচ্ছে তার গালদুটো। আজও দুজনে পাশাপশি শুয়েছে, মাঝে মাত্র কয়েক সেন্টিমিটারের দূরত্ব। তবে আরশাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই এই সামান্য দূরত্বটাও ঘুচিয়ে দেবে সে। হঠাৎ আরশাদ অরার হাতের ওপরে নিজের হাত রাখলো। এমন আকস্মিক স্পর্শে কেঁপে উঠলো অরা।
আরশাদ অরার চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে ডাকলো, “অরা?”
অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “হুঁ?”
“এই বিয়েটা নিয়ে তুমি খুশি তো?”
অরা চমকে উঠে বলল, “হঠাৎ এমন প্রশ্ন?”
“হঠাৎ না। বিকেল থেকেই প্রশ্নটা মাথায় ঘুরছে। কেমন হুট করে হয়ে গেল আমাদের বিয়েটা। আমরা কেউই তো প্রিপেয়ারেড ছিলাম না বিয়েটার জন্য। যদিও আমি একটু একটু করে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখন তো তোমাকে ছাড়া আমার জীবনটা কল্পনাও করতে পারি না। কিন্তু তুমি?”
“আমি কী?”
আরশাদ চোখেমুখে একরাশ জিজ্ঞাসা নিয়ে বলল, “তুমি কি পেরেছো নিজেকে মানিয়ে নিতে?”
“আপনার কী মনে হয়?”
“সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”
অরা হাসিমুখে বলল, “তাহলে একটা সিক্রেট শুনুন। আমি নিজেকে আপনার সাথে আপনারও আগে মানিয়ে নিয়েছি।”
আরশাদ বাঁকা হাসি হেসে বলল, “এই কথাটাও তোমার জার অফ সিক্রেটসে লিখে রাখতে!”
অরা আঁতকে উঠে বলল, “আপনি খুলেছেন?”
আরশাদ স্বাভাবিক গলায় বলল, “হুঁ! না খুলে আর উপায় কী? তুমিই তো বলেছিলে, তোমার কাছ থেকে সিক্রেট শুনতে ইচ্ছা হলেই যেন ওটা খুলে দেখি।”
লজ্জায় মাটির নিচে লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে অরার। ইশ! কেন যে মনের কথাটা অমন নিঃসংকোচে লিখতে রাখতে গেল?
প্রায় অনেকটা সময় আরশাদ চুপ করে থেকে বলল, “অরা?”
“হুঁ?”
আরশাদ ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল, “I love you too.”
(চলবে)
#ফিরে_আসা
৫৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
কাকডাকা ভোরে ঘুম ভেঙে গেল আরশাদের। আশ্চর্যের ব্যাপার! শুটিং না থাকলে তো কখনো এত সকালে তার ঘুম ভাঙে না। কত বছর পর যে আজ এলার্মের শব্দ না শুনে ঘুম থেকে উঠছে সে নিজেও জানে না। হঠাৎ তার চোখদুটো গিয়ে পড়লো অরার ওপর। গুটিশুটি মেরে তার বুকে মুখ গুঁজে আছে মেয়েটা। শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ঘুমের ঘোরে কখন যে আরশাদের গায়ের ওপর একটা পা তুলে দিয়েছে কে জানে!
অরার চুলগুলো এলোমেলোভাবে মুখের ওপরে পড়ে আছে। আরশাদ আলতো স্পর্শে চুলগুলো সরিয়ে দিলো। এবার পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তার মুখটা। অরাকে দেখেই মনের অজান্তে একটা হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটে। বিচিত্র এক স্নিগ্ধতায় ভরা এই মুখটা। যতবারই সে দেখে, ততবারই যেন হারিয়ে যায় কোথাও।
অরার আরেকটু কাছে এলো আরশাদ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তাকে। এই সুযোগ তো অরা জেগে থাকলে পাওয়া যায় না। যদিও জাগ্রত অবস্থায় তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে কোনো বাঁধা নেই, অরা তো তার স্ত্রী। তবে মেয়েটা শুধু শুধু লজ্জা পাবে ভেবে এমন ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে না আরশাদ।
ঘুমের ঘোরে অরার ঢিলেঢালা জামাটা কিছুটা সরে গেছে। চোখের সামনে উন্মুক্ত হলো মেয়েটার কাঁধ। খুব অদ্ভুতভাবে তার কাঁধের ওপরে কুচকুচে কালো দুটো তিল। একটার থেকে আরেকটার দূরত্ব মাত্র কয়েক সেন্টিমিটারের। তিলদুটো ঠিক পাশাপাশি নয়, কোণাকুণিভাবে অবস্থান করছে। আরশাদের ঘোরলাগা চোখদুটো আটকে গেল তাদের দিকে। মানুষের কাঁধ এত সুন্দর হতে পারে? তিলদুটো যেন ক্রমেই আরশাদকে টেনে নিচ্ছে নিজের দিকে।
তার শীতল ঠোঁটদুটো স্পর্শ করলো অরার উন্মুক্ত কাঁধ। ঘুমের ঘোরে এমন আকস্মিক স্পর্শ পেয়ে রীতিমত কেঁপে উঠলো অরা। সেদিকে কোনো খেয়াল নেই আরশাদের। অনবরত সে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে অরার কাঁধে।
একটা পর্যায়ে অরার ঘুম ভেঙেছে বুঝে সরে এলো আরশাদ। অরার ঘুম এখনো পুরোপুরি ভাঙেনি। ঘুমের ঘোরে আরশাদের স্পর্শ টের পেলেও সেসব কিছুই আপাতত মনে রইল না।
অরা ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল, “কয়টা বাজে?”
আরশাদ নিজেকে সামলে নিয়ে একবার ঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে বলল, “সাড়ে ছয়টা।”
“আপনি এত সকালে ঘুম থেকে উঠেছেন কেন?”
“ঘুম ভেঙে গেছে, কী করবো?”
অরা আদুরে গলায় বলল, “আমি আরেকটু ঘুমাই?”
অরার এমন বাচ্চাদের মতো আবেদন শুনে আরশাদ হেসে উঠলো।
ফিসফিস করে বলল, “ঘুমাও।”
অরা আবারও আগের মতো গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়লো। উঠে পড়লো আরশাদ। একবার ঘুম ভেঙে গেলে সহজে আর ঘুম আসে না তার। নিজেকে ফিট রাখার জন্যে সব তারকাই কম-বেশি জিমে যায়। আরশাদও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে অন্যান্যদের মতো সকাল সকাল জিমে যায়না সে। তার জিমের সময় সন্ধ্যায় কিংবা রাতে।
সকাল সকাল উঠে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। হঠাৎ কী যে মনে করে নিজের করা লাইব্রেরি ঘরের দিকে পা বাড়ালো সে। যদিও এই ঘরের ওপর তার থেকে এখন অরার অধিকারই বেশি। নিয়মিত বইগুলো গুছিয়ে রাখে মেয়েটা। শুধু তাই নয়, প্রত্যেকটা বইয়ের প্রথম পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে নিজের নামটা লিখে রেখেছে। নিঃশঙ্কোচে আরশাদের বইগুলো নিজের করে নিয়েছে সে। কবে যে আরশাদকেও ঠিক এভাবে নিজের করে নেবে!
প্রথম শেলফটাতে একটা বই চোখে পড়লো আরশাদের। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভয় সমগ্র’। এতদিন পর নিজের লাইব্রেরিতে পা রেখেছে আরশাদ। তবুও স্পষ্ট বলে দিতে পারে কোন বইটা সে পড়েছে আর কোনটা পড়েনি। এই বইটা সে কিনে রেখেছিল ঠিকই, কিন্তু শেষমেশ আর পড়া হয়নি। বইটা হাতে নিয়ে সোফায় বসলো আরশাদ।
দীর্ঘদিন তার মাঝে ভর করেছিল রিডিং ব্লক। ডিভোর্সের পর প্রচন্ড ট্রমাটাইজড হয়ে পড়েছিল সে। মনটাকে শান্ত রাখার জন্যে যতবারই বই পড়ার চেষ্টা করেছে, প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। মন তাকে টেনে অন্যদিকে নিয়ে গেছে। আরশাদ ভেবেছিল আজও হয়তো সে পড়তে পারবে না। তবে সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো বত্রিশ পৃষ্ঠা পড়ে ফেলেছে! তার মানে কী? রিডিং ব্লক তাহলে কেটে গেছে?
হঠাৎ পেছন থেকে দুটো নরম হাত এসে আরশাদের চোখদুটোকে বন্ধ করে দিলো। আরশাদ বেশ বুঝতে পারছে হাতদুটো কার।
অরা আরশাদের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “গুড মর্নিং!”
আরশাদ মুচকি হাসি হেসে বলল, “উঠে পড়ছো?”
অরা আরশাদের চোখের সামনে থেকে হাতদুটো সরাতে সরাতে বলল, “হুঁ।”
আরশাদ ঘাড় ঘুরিয়ে অরার দিকে তাকিয়ে বলল, “গুড মর্নিং।”
অরা মিষ্টি একটা হাসি হেসে বলল, “আপনাকে বই পড়তে দেখে ভালো লাগছে।”
“All thanks to you.”
অরা কৌতূহল নিয়ে বলল, “কেন?”
আরশাদ সোজাসাপ্টা উত্তরে বলল, “আমার অশান্ত মনটা আগে বই পড়তে পারতো না। তুমি এসেছ, তাকে শান্ত করেছ। এখন সে বই পড়তে পারে।”
একরাশ লজ্জারা এসে ঘ্রাস করলো অরাকে। প্রসঙ্গটা পাল্টানোর জন্যে সে দ্রুত বলল, “নিশ্চয়ই ব্রেকফাস্ট করেননি এখনো?”
“না।”
“চলুন, একসাথে ব্রেকফাস্ট করবো।”
কথা এখনো ঘুমাচ্ছে। বাবার কাছে আসার পর থেকে সে মুক্ত জীবনযাপন করছে। যে জীবনে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যেতে হয় না, সন্ধ্যার পর টিচারের সঙ্গে পড়তে বসতে হয় না। তবে এভাবে তো আর চলতে দেওয়া যায় না। ব্রেকফাস্ট করতে করতে তাদের মধ্যে আলোচনা হলো কথার নতুন স্কুল নিয়ে। গাজীপুরে থাকতে একটা কিন্ডারগার্টেনে নার্সারিতে পড়তো সে। এবার কেজিতে উঠবে।
অরা চাইছে কথা এমন একটা স্কুলে পড়ুক যেখানে আপাতত পড়াশোনার বেশি চাপ নেই। এই বয়সেই বাচ্চাদের কাঁধে বইয়ের বোঝা তুলে দিলে তারা জীবনটাকে উপভোগ করতে শিখবে কী করে? ওদিকে আরশাদ চায় কথার নতুন স্কুলটা যেন হোক বাংলা মিডিয়াম। আজকালকার বাবা-মায়েদের বাচ্চাকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানোর প্রতি ঝোঁক বেশি। ভাবটা এমন যেন ইংলিশ মিডিয়ামে না পড়লে তাদের সন্তানের জীবনটাই বৃথা হয়ে যাবে। অথচ তারা এটা বোঝে না জীবনে সফলতার জন্যে কোনো মিডিয়ামের প্রয়োজন নেই। যোগ্য ব্যক্তি একদিন সফলতার স্বাদ ঠিকই পাবে।
ব্রেকফাস্ট সেরে অরা গোসলে চলে গেল। আরশাদের ঘরের সঙ্গে যে বাথরুম, তাতে বিশাল এক বাথটাব। এই বাথটাবে একবার নেমে পড়লে আর উঠতে ইচ্ছা হয় না।
ওদিকে আরশাদ ঘরের সোফায় ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। অনেক ফাঁকিঝুঁকি হয়েছে। সুপারস্টারকে এবার তো কাজে ফিরতে হবে। ঝাঁক ঝাঁক ভক্তরা অপেক্ষা করে আছে তার জন্যে। কয়েকটা জরুরি ফোন সারলো আরশাদ। আজ দুপুরে তার মিটিং পরিচালক সাদাদ করিমের সঙ্গে। ছেলেটার বয়স কম কিন্তু আজকাল দুর্দান্ত সিনেমা বানাচ্ছে। তার বানানো প্রতিটা সিনেমাই বক্স অফিসে ব্যবসাসফল হচ্ছে।
সিনেমা হিট করানোর জন্যে হিট ডিরেক্টরের প্রয়োজন তার হয়। সিনেমা হিট করার জন্যে আরশাদ হক নামটাই যথেষ্ট। তবুও সাদাদের সঙ্গে আরশাদের কাজ করার আগ্রহ, কারণ ছেলেটা আসলেই গুণী। তার বানানো কয়েকটা সিনেমা আরশাদ দেখেছে। প্রত্যেকটা সিনেমাতেই সুন্দর একটা গল্প থাকে। আর থাকে সেই গল্পের গোছানো পরিবেশন।
মিটিং শুরু হবে তিনটার দিকে। পরিচালক তাকে গল্পটা শোনাবে। সঙ্গে প্রযোজকও থাকবে। গল্প পছন্দ হলে আজই হবে সিনেমার সাইনিং। এটাই হবে আপাতত অন্যের প্রযোজনায় আরশাদের অভিনীত শেষ সিনেমা। এরপর থেকে তার অভিনয় করা প্রতিটি সিনেমাই তৈরি হবে ‘কে ফিল্মস’- এর ব্যানারে।
কাজের মধ্যে ডুবে থাকা আরশাদের চোখদুটো এক মুহূর্তের জন্যে পড়েছিল ড্রেসিং টেবিলের দিকে। চোখদুটো সরিয়ে নিয়েছিল ঠিকই কিন্তু চমকে উঠে আবারও সেদিকে তাকালো। সদ্য গোসল করে বেরিয়েছে অরা। পরনে তার হালকা গোলাপী রঙয়ের একটা শাড়ি। শাড়িতে কোনো প্রিন্ট নেই, পাড় নেই। কেবল এক রঙের শাড়িটা। শাড়ির সঙ্গে মিল রেখে ব্লাউজেও কোনো ডিজাইন নেই। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন সদ্য ফুটে ওঠা পদ্মফুল।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে তার লম্বা চুলগুলো মুছতে ব্যস্ত অরা। ওদিকে দুটো চোখ যে তার দিকে আবদ্ধ হয়ে আছে, তার কোনো হুস রইলো না। আরশাদ সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো। একটু একটু করে এগিয়ে গেল অরার দিকে। এই মেয়েটা নির্ঘাত জাদু করেছে তার ওপরে। আরশাদ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছে আয়নায় ভেসে ওঠা অরার প্রতিচ্ছবির দিকে।
হুট করে আরশাদ এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো অরাকে। চোখদুটো বুজে মুখ ডুবিয়ে দিলো অরার চুলে। আরশাদের এমন কান্ডে রীতিমত হকচকিয়ে গেল। আয়নার দুজনকে এভাবে দেখে লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে অরা। আরশাদ যেন একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে তার মাঝে। অরাও ঠিক তাই।
আরশাদ আচমকা হ্যাঁচকা টান দিয়ে অরাকে নিজের দিকে ঘোরালো। টাল সামলাতে না পেরে অরা আছড়ে পড়লো আরশাদের বুকে। অরা সরে যেতে চাইলেও সেই সুযোগ তাকে দিচ্ছে না আরশাদ। একবার তার চোখের দিকে তাকিয়ে চোখদুটো সরিয়ে নিলো অরা। ওই চোখদুটো একরাশ দুষ্টুমি খেলা করে বেড়াচ্ছে।
আরশাদ তার ডান হাতটা রাখলো অরার উন্মুক্ত কোমরে। তড়িৎ গতিতে অচেনা এক শিহরণ খেলে গেল অরার সমস্ত জুড়ে। প্রচন্ড গতিতে কেঁপে উঠলো অরা। আরশাদ এমনিতেও অরার এই রূপ দেখে পাগল হয়ে ছিল। এখন আবার এমন কেঁপে ওঠা দেখে নিজেকে সামলাতে পারলো না। তার বাম হাতটা এবার রাখলো অরার গালের ওপরে। লজ্জায় চোখদুটো বুজে আছে মেয়েটা। ইশ! লজ্জা পেলে যেন তার সৌন্দর্য বহুগুণ বেড়ে যায়।
আরশাদের চোখদুটো এবার স্থির হয়ে আছে অরার ঠোটদুটোর দিকে। একটু একটু করে সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। সেদিনও তো এই একই কাজ করতে যাচ্ছিল আরশাদ। মাঝখান থেকে ফোনটা বেজে উঠে বাঁধ সাধলো। তবে আজ তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর কোনো বাঁধাই আর মানবে না সে।
আরশাদের ঠোঁট স্পর্শ করলো অরার ঠোঁটকে। উত্তেজনায় অরা নিজেকে সামলাতে না পেরে জড়িয়ে ধরলো আরশাদকে। দুজনে ঠিক এভাবেই কতক্ষণ রইলো তার হিসাব নেই কারো কাছেই। দুজনেরই হয়তো কেবল মনে হচ্ছে ঠিক এভাবে, একে অপরের স্পর্শের মাঝে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারলে মন্দ হয়না।
অনেকটা সময় পর অরার ঠোঁটদুটো ছেড়ে তার কপালে কপাল ঠেকলো আরশাদ। তার উত্তপ্ত একেকটা নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে অরার মুখের ওপরে। আর এলোমেলো করে দিচ্ছে মেয়েটার সমস্ত চেতনাকে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো অরা। আরশাদের নেশাভরা চোখদুটো এখনো তার দিকে স্থির হয়ে আছে। লজ্জায় অরা আবারও চোখ বুজে ফেলল।
আরশাদ মুচকি হাসি হেসে অরার কানের কাছে ঠোঁটদুটো নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এই লজ্জাবতী! অনেক লজ্জা পেয়েছো, এবার তাকাও আমার দিকে।”
অরা লজ্জারাঙা চোখদুটো মেলে তাকালো আরশাদের দিকে। আরশাদ তার নেশালো কণ্ঠে বলল, “আজ রাতে আপনাকে আবারও আমার জন্যে সাজতে হবে।”
অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “তার মানে আজও জন্যে কোনো সারপ্রাইজ আছে।”
আরশাদ দুষ্টুমিমাখা কণ্ঠে বলল, “কেন? সারপ্রাইজের লোভ না দেখালে সাজবে না?”
অরা বিব্রত গলায় বলল, “আমি কী সে কথা বলেছি?”
আরশাদ অরার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “চিন্তা কোরো না। তুমি কষ্ট করে সাজবে আর আমি তোমাকে কোনো সারপ্রাইজ দেবো না, তা তো হতে পারে না।”
অরা হাসিমুখে বলল, “তাহলে কীভাবে সাজবো বলে দিন! নিশ্চয়ই শাড়ি পড়তে বলবেন। কী রঙয়ের শাড়ি পড়বো?”
আরশাদ অরাকে ছেড়ে বলল, “দাঁড়াও!”
আরশাদ এগিয়ে গেল তার সাদা আলমারিটার দিকে। আলমারির দরজাগুলো খুলতেই চোখে পড়লো পুরোটা আরশাদের জামা-কাপড়ে ভরে আছে।
আরশাদ বিরক্ত গলায় বলল, “তোমার জিনিসপত্র এখানে এনে রাখনি কেন?”
অরা থমথমে গলায় বলল, “কেউ জায়গা করে দিলে রাখতে পারতাম।”
আরশাদের মনে হলো, আসলেই তো! সে জায়গা না করে দিলে অরা কী করে নিজের জামা-কাপড় রাখবে?
আরশাদ বলল, “আচ্ছা, আজ স্টাফদের বলবো জায়গা খালি করে রাখতে। এখন চলো গিয়ে তোমার শাড়ি পছন্দ করি।”
অরা আগে যে ঘরটায় থাকতো সে ঘরের আলমারিতে তার সব জামা-কাপড় গুছিয়ে রাখা আছে। স্যুট, শার্ট, জিন্স, সালোয়ার কামিজ, শাড়ি – সবকিছু আলাদা আলাদা করে সাজিয়ে রাখা। আরশাদ এমনভাবে তার শাড়িগুলোকে পর্যবেক্ষণ করছে যেন এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ পৃথিবীতে আর একটাও নেই। অরা বিছানায় পা তুলে বসে তার কান্ড দেখছে আর মিটিমিটি।
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “তোমার কাছে আর শাড়ি নেই?”
অরা হাসিমুখে বলল, “না। আমি তো শাড়ি খুব একটা পরি না। মাঝেমধ্যে পরি। স্যুট আর শার্টের বিশাল কালেকশন। আপনার ম্যানেজার যখন ছিলাম তখন তো ওগুলোই পরতে হতো। আজ পরবো না-কি স্যুট এর শার্ট?”
আরশাদ কৃত্রিম রাগ নিয়ে বলল, “তোমাকে তুলে আছাড় মারবো।”
অরা খিলখিল করে হেসে উঠলো। আছাড় খাওয়ার কথা শুনে কেউ এভাবে হাসতে পারে? আরশাদ যেন বুকে ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেল।
মুহূর্তেই অবশ্য নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “এভাবে হাসবে না তো অরা।”
অরা হাসিটা ধরে রেখেই বলল, “কেন? হাসলে সমস্যা কী?”
আরশাদ ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল, “আমি পাগল যাই।”
নিমিষেই অরার ঠোঁট থেকে হাসি উড়ে গিয়ে জায়গা করে নিলো একরাশ লজ্জা।
আরশাদ অরাকে সহজ করতে বলল, “তোমার শাড়ির কালেকশন আরও বাড়াতে হবে অরা। আমার বউয়ের এত কম শাড়ি, এটা মেনে নেওয়া যায় না।”
অরার হৃদস্পন্দন এক লাফে বহুগুণ বেড়ে গেল। আরশাদ তাকে নিজের বউ বলে সম্বোধন করলো? এত সুন্দর করে সে কি এর আগেও তাকে বউ ডেকেছে? কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল অরা।
আরশাদ এসে বসলো তার পাশে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কন্ট্যাক্ট লিস্টে কার যেন নম্বর খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
অরা জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে বলল, “কাকে ফোন করছেন?”
“রাশনাকে।”
রাশনা জনপ্রিয় একজন ডিজাইনার। ঢাকায় তার বিলাসবহুল একটা স্টোর আছে। তার মূলত সেলিব্রিটিরাই তার স্টোর থেকে কেনাকাটা করে।
রাশনা ফোন রিসিভ করতেই আরশাদ নির্দেশের ভঙ্গিমায় বলল, “রাশনা, আধ ঘন্টার মধ্যে তোমার স্টোরের বেস্ট শাড়িগুলো নিয়ে আমার বাসায় চলে এসো।”
অরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আরশাদের দিকে। কবে শেষ হবে এই মানুষটার পাগলামি? অরার খুব একটা শাড়ি নেই, তাই বলে এক্ষুনি ডিজাইনারকে ডেকে আনতে হবে?
আরশাদের পাগলামিতে অরা আরও একবার বিস্মিত হলো রাশনা বাড়িতে আসার পর। সে এক এক করে নিজের ডিজাইন করা শাড়িগুলো প্যাকেট থেকে বের করে সোফার ওপরে রাখলো। কমপক্ষে ত্রিশটা শাড়ি সে এনেছে সঙ্গে করে।
আরশাদ শাড়িগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ ঠিক আছে, সবগুলোই আমরা নিচ্ছি।”
অরা আঁতকে উঠে আরশাদের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “এতগুলো শাড়ি দিয়ে আমি কী করবো?”
আরশাদ কিছু বলল না। কেবল তার বিখ্যাত অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো অরার দিকে। ওই দৃষ্টিই তাকে চুপ করিয়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট। অরার নতুন শাড়িগুলোর মধ্যে থেকে আরশাদ হলুদ রঙয়ের একটা জামদানি পছন্দ করলো।
শাড়িটা অরার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এটাই পরবে আজ। আর সাজগোজ নিজের পছন্দমতো কোরো।”
শাড়ি বাছাবাছি পর্ব শেষে আরশাদ ডেকে তুলল কথাকে। মেয়েটাকে কেউ না ডাকলে তার ঘুম ভাঙেই না। আরশাদ কয়েকবার ডাকতেই কথা তার কোলে উঠে বসলো। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটা এখনো ঘুমে আচ্ছন্ন। আরশাদ এরপর যত্ন নিয়ে কথাকে ব্রাশ করিয়ে দিলো। এলোমেলো চুলগুলো আঁচড়ে আবার নতুন করে বেঁধে দিলো। নিজ হাতে ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিলো। যদিও কথাকে ব্রেকফাস্ট খাওয়াতে তার সঙ্গে কিছুটা যুদ্ধ করতে হলো। রোজ রোজ সকাল বেলা কথার ডিম খেতে ভালো লাগে না। আরশাদ নানা ছুতোয় তাকে ডিম খাওয়ানোর চেষ্টা করছে।
অরা প্রাণভরে দেখছে বাবা-মায়ের খুনশুটিময় সকালটা। কথাকে নিজের কাছে আনার পর থেকে আরশাদের যেন তার প্রতি যত্ন একটু বেশিই বেড়ে গেছে। সে কোনোভাবেই চায় না কথা মায়ের অভাবটা টের পাক।
দুপুরে লাঞ্চের ঠিক পরপর আরশাদ বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে কথাকে আদুরে গলায় বলে গেল, “বাবা! লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকবি কিন্তু!”
কথা ভ্রু কুঁচকে বলল, “কিন্তু আমি তো লক্ষ্মী মেয়েই।”
আরশাদ হাসিমুখে বলল, “সেটা তো আমি জানি সোনা। আর শোন! অরাকে ডিস্ট্রার্ব করবি না কিন্তু!”
কথা কিছু বলতে যাব তার আগেই অরা বাঁধ সেধে বলল, “কী যে বলেন আপনি! কথা আবার কখনো আমাকে ডিস্ট্রার্ব করতে পারে?”
আরশাদ অরার গালে হাত রেখে বলল, “কথার খেয়াল রেখো। আর প্লিজ, বাইরে যেতে হলে আমাকে জানিয়ে যেও।”
অরা আশ্বাস দিয়ে বলল, “আপনি চিন্তা করবেন না। আমি বাড়িতেই থাকবো।”
ওই ঘটনার পর থেকে অরার সিকিউরিটি নিয়ে বাড়তি সতর্ক হয়ে গেছে আরশাদ। নওশীন ছাড়াও এই পৃথিবীতে আরও অনেক মানুষ থাকতে পারে যারা আরশাদের ক্ষতি করতে চায়। আর আরশাদের ক্ষতি করার অন্যতম একটা উপায় হলো তার স্ত্রীকে কষ্ট দেওয়া। আরশাদ তাই এ বাড়ির সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা গার্ডের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে অরার জন্যে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে একজন বলশালী বডিগার্ড। অরা যখন বাইরে যাবে, তখন তার কাজ হবে ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করা।
আরশাদ চলে যাওয়ার পর অরার বাকি দিনটা কাটলো কথাকে নিয়ে। পুরোটা বিকেল জুড়ে অরা কথাকে বই পড়ে শোনালো। কথা ঠিক আরশাদের বই পড়ার শখটা পেয়েছে। ডিজনির রূপকথার গল্পের তার নিজস্ব ছোটখাটো একটা কালেকশন আছে। কথার বইগুলো নিয়ে অরা আরশাদের লাইব্রেরিতে রাখলো। তার বেশিরভাগ বইগুলোই পাতলা পাতলা। তাই বেশি জায়গা নেয় না।
বই পড়া শেষে অরাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো কথার একগাদা পুতুলের সবগুলোর চুল বেঁধে দেওয়া। অরাও আগ্রহ নিয়ে চুল বাঁধছে। চুল বাঁধা শেষে কথা পুতুলদের জামা বদলে দিচ্ছে।
আজকালকার বাচ্চারা পুতুল নিয়ে বেশিক্ষণ খেলতে পারে না। একটা নির্দিষ্ট সময়ে তাদের মোবাইল ফোন অথবা টিভি চাই। কথাও ব্যস্ত হয়ে গেল মোবাইলে গেম খেলতে। অরা কী করবে ভেবে না পেয়ে নিজেও মোবাইলটা নিয়ে বসলো। ফেসবুক ঢুকতেই সবার আগে চোখে পড়লো আরশাদের নতুন পোস্ট। সাদাদ করিমের গল্প তার পছন্দ হয়েছে। সিনেমাটার সঙ্গে সে চুক্তিবদ্ধ হয়ে গেছে। নতুন সিনেমার নাম ‘বরষা’। আরশাদ কন্ট্যাক্ট পেপারে সই করছে এমন একটা ছবি সে পোস্ট করেছে।
অরা তার পোস্টটা শেয়ার দিয়ে ক্যাপশনে লিখলো, “Congratulations Superstar.”
সাইনিং পর্ব শেষেও আরও কিছু আনুষ্ঠানিকতা থাকে। দীর্ঘদিন আরশাদের ম্যানেজার থাকার সুবাদে এটা অরার অজানা নয়। কিছুটা সময় নিয়ে সাজতে বসে গেল। কথাকে অবশ্য চোখের আড়াল করেনি। কথা তাদের ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছে।
ডিজাইনারদের শাড়ির এই এক সুবিধা। শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজও থাকে। সাইজটা নিজে থেকেই কম বেশি করা যায়। ব্লাউজ বানাতে আলাদা করে ঝামেলা করতে হয় না।
শাড়ি পরা শেষে অরা কথাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আমাকে কেমন লাগছে কথা?”
কথা মুগ্ধ গলায় বলল, “তোমাকে একদম বেলার মতো লাগছে!”
“বেলা কে?”
কথা অবাক গলায় বলল, “তুমি বেলাকে চেনো না? বিউটি এন্ড দ্য বিস্টের প্রিন্সেস। এরকম হলুদ ড্রেস পরে সবসময়।”
“ও আচ্ছা, এবার চিনেছি।”
অরা ড্রেসিং টেবিলের সামনে সাজতে বসে গেল। খুব বেশি একটা সাজলো না অবশ্য। চোখে কাজল, কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ। ঠোঁটে লিপস্টিক দিতে গিয়েও দিলো না অরা। তার ঠোঁটের রঙ এমনিতেই গোলাপী। সেজন্যে খুব একটা কৃত্রিম রং ব্যবহার করে না। কানে বড় একটা রূপার দুল পড়লো অরা। গলায়ও সুন্দর থেকে একটা রূপার হার পরলো।
আচমকা আরশাদের ফোন এলো। অরা ফোন রিসিভ করে কিছু বলতে যাবে আর আগেই আরশাদ হড়বড় করে বলল, “শোনো অরা। তুমি কথাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও। নিজে খাবে না কিন্তু! আর কথাকে ঘুম পাড়িয়ে ওর ঘরেই বসে থাকবে। বাইরে বের হবে না।”
অরা সন্দেহজড়িত কণ্ঠে বলল, “আপনি কী করতে যাচ্ছেন বলুন তো?”
“সেটা না হয় নিজেই দেখলে!”
কথাকে ঘুম পাড়িয়ে আধশোয়া হয়ে রইলো অরা। এ কোন যন্ত্রণায় পড়া গেল? একই ঘরে বসে থাকতে হবে, বাইরে যাওয়া যাবে না! আরশাদের পাগলামির সত্যিই কোনো অন্ত নেই। তবে তার এই ছোট ছোট পাগলামিই মুগ্ধতা ছড়ায় অরার মাঝে।
অপেক্ষা করতে করতে অরার চোখদুটো কখন যে লেগে এসেছে সে নিজেও জানে না। ঘুম ভাঙলো রিংটোনের আওয়াজে। মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে কাঙ্ক্ষিত মানুষটারই নাম।
অরা ফোন রিসিভ করে আরশাদকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, “কোথায় আপনি? আপনার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে আমি তো ঘুমিয়েই পড়েছিলাম।”
আরশাদ অপরপ্রান্ত থেকে হালকা গলায় বলল, “কথা ঘুমিয়েছে?”
“হুঁ।”
“তাহলে সোজা ছাদে চলে এসো। অন্য কোনো রুমে যাবে না কিন্তু। বিশেষ করে আমাদের রুমে।”
“আসছি।”
কথার ঘর থেকে বের হওয়ার আগে অরা বাথরুমের আয়নায় একবার গিয়ে নিজেকে দেখে এলো। আজ তাকে কেমন লাগছে? আরশাদ তাকে এই রূপে পছন্দ করবে তো?
(চলবে)