#ফিরে_আসা
৫৬
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
ঘুম ভেঙে যাওয়া সত্ত্বেও চোখদুটো বুজে রইল অরা। আজকের সকালটা অন্যরকম। আর দশটা সকালের মতো নয়। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুম ভাঙলো বলে সকালটাকে অন্যরকম লাগছে? না-কি ভিন্ন কোনো কারণ আছে? ধীর গতিতে চোখদুটো মেলে তাকালো অরা। আরশাদের গায়ের ওপর হাত-পা তুলে দিয়ে তার বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে সে। আরশাদের পরনে একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট ছাড়া আর কিছুই নেই। উদাম বুকে আগলে রেখেছে অরাকে। তড়িৎ গতিতে আবারও চোখদুটো বুজে ফেলল অরা। লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে সে। কাল রাতে যা ঘটে গেল, তারপরে সে কী করে নিজের মুখটা দেখাবে আরশাদকে? রাতে যতটা লজ্জা লাগছিল, আজ সকালে তার থেকে কয়েক হাজারগুণ বেশি লজ্জা লাগছে।
অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে চোখদুটো আবারও মেলে তাকালো অরা। আরশাদের ঘুমন্ত মুখটা তাকে চুম্বকের মতো টানছে। ইশ! এমন একটা ভাব যেন নিষ্পাপ বাচ্চা, জগতের কিছুই বোঝে না। অথচ এই মানুষটাই কিনা গত রাতে অমন কান্ড বাঁধালো। আরশাদের চোখের সামনে কতগুলো চুল এসে পড়েছে। অরা সাবধানে চুলগুলো সরিয়ে দিলো।
সে যে এতটা ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিল, নিজেই কোনোদিন বুঝতে পারেনি। চিরকাল মনে হয়েছে নিয়তি তার সঙ্গে ঠাট্টা করে আসছে। নিয়তির জোরে নিজের মাকে হারালো। সৎ মায়ের সংসারে নির্মমভাবে অত্যাচারিত হলো। একটা সময়ে নিজেদের ছোট্ট ওই টিনের বাড়িটা পৃথিবীর সবথেকে ভয়ানক স্থানে পরিণত হলো। যেখান থেকে বাধ্য হয়ে পালিয়ে আসতে হলো তাকে। এতসবের পর স্বাভাবিক একটা জীবনের আসাই অরা ছেড়ে দিয়েছিল। অথচ সেই জীবনে কিনা এতটা সুখ, এতটা আনন্দ পাচ্ছে সে। সবই এই মানুষটার জন্যে।
আরশাদকেও তো এ জীবনে কম কষ্ট সহ্য করতে হয়নি। কৈশোরে মায়ের প্রতি বাবার বিশ্বাসঘাতকতা তাকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। বেড়ে উঠতে উঠতে সে যখন নিজের ক্ষতবিক্ষত হৃদয়টাকে নিজেই সারিয়ে নিলো, তখন আরেক দফা তাকে ভেঙে গুড়িয়ে দেয় নওশীন। আরশাদ এরপর থেকে এক অনুভূতিহীন জীবে পরিণত হয়। যার কিছুতেই কিছু আসে যায় না। যে কাউকে পরোয়া করে না।
অথচ সেই মানুষটাই কিনা সব কষ্ট ভুলে নতুন করে হাসতে শিখছে, নতুন করে বাঁচতে শিখছে। একটু একটু করে আবারও পরিণত হচ্ছে সেই পুরোনো আরশাদে। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী দুরন্ত আরশাদ। আরশাদের চুলে হাত বুলিয়ে অরা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে।
অরার স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেল তার। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে অরা নিষ্পলক তাকিয়ে আছে তার দিকে। যদিও আরশাদের ঘুম ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নেয় অরা। তবে ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে।
আরশাদ দুষ্টুমিমাখা গলায় বলল, “কী অরা? আমাকে আজ বেশি হট লাগছে না-কি? এমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছ কেন?”
লজ্জায় মোমবাতির ন্যায় গলে গেল অরা। এসব কী ধরনের অসভ্যতা? আর কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে অরা মুখ লুকালো আরশাদের বুকে।
আরশাদ অরার চুলে হাত বুলিয়ে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল, “গুড মর্নিং!”
অরা আরশাদের বুকে মুখটা লুকিয়ে রেখেই অস্পষ্ট গলায় বলল, “গুড মর্নিং।”
“ঘুম ভালো হয়েছে?”
এমনিতেই বেচারি লজ্জায় গ্রাস হয়ে আছে। তার ওপরে আবার এরকম একটা প্রশ্ন। দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে অরার। যত দূরে গেলে এই অসভ্যটার মুখোমুখি হতে হবে না, ঠিক ততটাই দূরে।
কোনো জবাব না পেয়ে আরশাদ হালকা গলায় বলল, “আমার ভাগ্যটা কত ভালো তাই না?”
অরা জড়ানো গলায় বলল, “কেন?”
আরশাদ অন্যরকম গলায় বলল, “এখন থেকে প্রত্যেকটা সকাল তোমার মুখ দেখে শুরু করবো। আর প্রত্যেকটা রাত তোমাকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে।”
অরা লজ্জায় অসহায় গলায় বলল, “কী শুরু করলেন আপনি?”
“শুরু তো এখনো করিনি। তুমি চাইলে করতে পারি। করবো না-কি?”
অরার ভাব দেখে মনে হলো যেন এক্ষনি কেঁদে ফেলবে। ব্যর্থ গলায় বলল, “এসব কী কথা? আমি কিন্তু আর আপনার সঙ্গে কথা বলবো না।”
আরশাদ হেসে ফেলে বলল, “আচ্ছা সরি।”
ধীরস্থির ভঙ্গিতে আরশাদ হাত বুলিয়ে দিচ্ছে অরার চুলে। তার প্রতিটা স্পর্শে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। এতটা প্রশান্তি সে এ জীবনে অনুভব করেনি।
আরশাদ হঠাৎ রহস্যময় হাসি হেসে বলল, “আমার পাঞ্জাবিতে সুন্দর লাগছে তোমাকে।”
এতক্ষণে নিজের দিকে চোখ গেল অরার। তার পরনে আরশাদের গত রাতের খয়েরী পাঞ্জাবিটা। গলা পর্যন্ত ব্যাঙ্কেট টেনে তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো সে। তার হলুদ জামদানি মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। এই পাঞ্জাবি তো সে পরেনি! তার মানে আরশাদ তাকে পরিয়ে দিয়েছে? ছি ছি! লজ্জায় মাটির ভেতরে ঢুকে লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে অরার।
আরশাদ উঠে বসতে বসতে মেকি অভিযোগের স্বরে বলল, “কী আশ্চর্য! পাঞ্জাবিটা পরিয়ে দিলাম যাতে সকালে উঠে লজ্জা না পাও। এখন দেখি আরও বেশি লজ্জা পাচ্ছো।”
অরা বেচারি এবার লজ্জার মিইয়ে যাচ্ছে। আরশাদের মনে হলো মেয়েটা একটু বেশিই লাজুক। সবসময়ে আবার না, এমন রোমান্টিক মুহূর্তে। যদিও তার এই লজ্জারাঙা মুখটা আরশাদ দারুণ উপভোগ করে।
অরাকে এবার একটু সহজ করতে আরশাদ তার কপালে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বলল, “যাও, তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি ততক্ষণ আরেকটু ঘুমাই।”
অরা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। আর মুহুর্তও দেরি না করে ছুটে গেল বাথরুমের দিকে। কাল রাত থেকে যেসব ঘটনা ঘটছে, তারপরে তো আরশাদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলাও মুশকিল হয়ে পড়বে।
নওশীনের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। আর সাবেরের চার দিনের। হাসু মিয়ার জন্যে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়নি বলে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হবে। পুলিশের ভ্যান থেকে নামিয়ে নওশীনকে কার্যালয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নারী পুলিশেরা ঘিরে রেখেছে তাকে। আজও পুলিশের কার্যালয়ের বাইরে ক্ষিপ্ত জনতার ভিড়। নওশীনের কঠোর শাস্তির জন্যে স্লোগান দিয়ে যাচ্ছে তারা। গভীর মনোযোগ দিয়ে টিভিতে নিউজটা দেখছে অরা।
আচমকা আরশাদ এসে তার হাত থেকে রিমোটটা কেড়ে নিয়ে টিভি বন্ধ করে দিলো।
অরা অবাক গলায় বলল, “আরে! আমি দেখছিলাম তো!”
আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “কেন দেখছিলে? সকাল সকাল মুখ ভার করে এসব নিউজ দেখতে হবে কেন?”
অরা নিচু গলায় বলল, “আমার খারাপ লাগে আরশাদ।”
আরশাদ শান্ত ভঙ্গিতে বসলো অরার পাশে। এই মেয়েটাকে প্রকৃতি কী দিয়েছে তৈরি করেছে কে জানে? যার কারণে তাকে এত কষ্ট পেতে হলো তার জন্যেই মায়া হচ্ছে?
আরশাদ অরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “কেন? তুমি চাও না তোমাকে ওপর হওয়া অন্যায়ের একটা জাস্টিস হোক?”
“চাই। কিন্তু জানেন, বারবার আমার চোখের সামনে ওই দিনটা ভেসে উঠেছে, যেদিন উনি প্রথম আমাদের এতিমখানায় আসেন। উনি না গেলে, আমার জীবনটা ওখানেই আটকে থাকতো। আমি আজ এখানে থাকতামও না।”
অরার চোখদুটো ছলছল করছে। যেকোনো মুহূর্তে তার দুই গাল বেয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়বে।
আরশাদ তার আগেই চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, “আমি মানছি তুমি নওশীনের ওপর কৃতজ্ঞ। তোমার এই সুন্দর জীবনটার পেছনে ওর অবদানই বেশি। কিন্তু অরা, তাই বলে তো তার সব দোষ মাফ করে দেওয়া যায় না। একটা মানুষ অপরাধ করলে তাকে শাস্তি তো পেতেই হবে। এতে আমার বা তোমার – কারোরই হাত নেই। এটাই আমাদের দেশের আইন।”
অরা ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, “আপনি কি কিছুই করতে পারবেন না?”
আরশাদ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “পারবো, কিন্তু করবো না। একবার মাফ পস্তাতে হয়েছে, বারবার মাফ করি কী করে?”
আরশাদের কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে রইলো অরা। নওশীন কতটা খারাপ মানুষ সে জানে, তবুও কৃতজ্ঞতার খাতিরে নিউজে তার ওই করুণ রূপটা দেখলে হৃদয় আর্দ্র হয়ে ওঠে।
আরশাদ অরাকে ছেড়ে ঠিক তার চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে বলল, “নওশীনকে নিয়ে এখন থেকে আমরা মাথা ঘামাবো না। ওর যা শাস্তি হবার, তাই হবে। শুধুমাত্র নিজেদেরকে নিয়ে মাথা ঘামাবো। ঠিক আছে?”
অরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।
“আর লিভিং রুমে এভাবে নিউজ দেখবে না। যখন তখন কথা উঠে পড়তে পারে।”
অরা আচমকা দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “আমার তো কথাকে ডাকতে হবে! দেখেছেন, এগারোটা বেজে গেছে অথচ এখনো আপনার মেয়ের ওঠার কোনো নামগন্ধ নেই!”
অরা তড়িৎ গতিতে ছুটে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। আরশাদ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। কী অদ্ভুতভাবে কথাকে আপন করে নিয়েছে মেয়েটা! ঠিক এই মুহূর্তে আরশাদের নিজেকে পৃথিবীর সব চাইতে সুখী মানুষ বলে মনে হচ্ছে। তার মেয়ে আর ভালোবাসার মানুষটাকে একই ছাদের নিচে রয়েছে সে। এর থেকে সুখময় আর কীই বা হতে পারে?
পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো আরশাদ। সামনে তার প্রচুর ব্যস্ততা। এ সপ্তাহে পরপর তিনটি বিজ্ঞাপনের শুটিং। সেই সঙ্গে আবার শুরু হয়ে যাবে আগের সিনেমাটার ডাবিং। ডাবিং শেষ হতে না হতেই নতুন সিনেমাটার শুটিং। দম ফেলার মতো সময় নেই আরশাদের।
তবুও হাজার ব্যস্ততার মাঝে সময় বের করতে হয়। যত্ন না পেয়ে প্রায় মরে গেছে সব সম্পর্কগুলো। নতুন করে বাঁচিয়ে তুলতে হবে তাদের। আগে বছরে দুবার পুরো পরিবারটাকে এক করতো আরশাদ। মামা-খালা তাদের সন্তানেরা। বাবার বাড়ির কেউ লজ্জায় আসতে চাইতো না অনুষ্ঠানে। তবুও আরশাদের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে তার ফুপু-চাচারা দল বেঁধে চলে আসতো।
গত চার বছরে নিজের মাঝে থেকেও হারিয়ে গিয়েছিল আরশাদ। পরিবারটাকে আর এক করবে কী করে? আরশাদ উদ্যোগ নেয়নি, তাই পরিবারের সকলে একসঙ্গে মিলে হইচইও করেনি? কিন্তু আর কতো? পুরনো আরশাদকে আবার ফিরতে আসতে হবে তো!
আরশাদ ডায়াল করলো আসফিয়ার নম্বরে। যুক্তরাষ্ট্রে এখন গভীর রাত। নির্ঘাত সে ঘুমে মগ্ন। তাই দুয়েকবার কল করার পরও অপরপ্রান্ত থেকে রিসিভ হলো না। আরশাদ হাল ছেড়ে মানুষ নয়। অনবরত ফোন করেই গেল।
একটা পর্যায়ে আসফিয়া ফোন রিসিভ করে ধমকের সুরে বলল, “এই বাঁদর! রাতবিরেতে এত বারবার ফোন করছিস কেন?”
আরশাদ মজার ছলে বলল, “রাত কোথায়? এখন তো ঝকঝকে দিন!”
আসফিয়া রাগী গলায় বলল, “তুই জানিস না অ্যামেরিকা আর বাংলাদেশের টাইম ডিফারেন্স কত? আমার গভীর ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলি। বেয়াদব কোথাকার!”
আরশাদ হাসিমুখে বলল, “হয়েছে, হয়েছে। বকবে পরে। এখন কাজের কথাটা শোনো।”
“কী কাজের কথা?”
“অ্যামেরিকায় অনেক থেকেছো। এবার দেশে ফিরে এসো।”
আসফিয়া ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “কেন? দেশে আমাকে দিয়ে আজ কী?”
আরশাদ অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বলল, “আমি বিয়ে করবো। আমার বিয়েতে তুমি থাকবে না?”
আসফিয়া আঁতকে উঠে বলল, “আবার কাকে বিয়ে করবি?”
আরশাদ সঙ্গে সঙ্গে বলল, “আরে বাবা আমার বউকেই বিয়ে করবো। নিজেরা তো যেমন তেমন করে বিয়ে করেছিলাম। এবার তুমি দেশে ফিরে সুন্দর একটা অনুষ্ঠান করে আমাদের বিয়ে দাও।”
আসফিয়া আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলল, “তুই এ কথা বলছিস?”
“হুঁ! শোনো আপা, রনি, দিশা, মেহের, আকাশ সবাইকে এক করতে হবে কিন্তু! নিজের বিয়ের আয়োজন নিজে করলে কেমন জানি হয়ে যায় না? সব আয়োজন তুমি করবে, কিন্তু পেছন থেকে আমিই ডিরেকশন দেবো।”
খুশিতে জল চলে এসেছে আসফিয়ার দুচোখে। ঘুম-টুম তার সব উবে গেল। মনে হচ্ছে যেন তার দুরন্ত ভাইটা ভিন্ন কোনো গ্রহে বেড়াতে গিয়েছিল। এতদিন পর ফিরেছে।
অসফিয়া চোখের জল মোছার কোনপ্রকার চেষ্টা না করেই বলল, “তুই কোনো চিন্তা করিস না আরশাদ। আমরা ধুমধাম করে তোর বিয়ে দেবো।”
সূর্য ডুবে যাওয়ার ঠিক পর পর, অরার কোলে গা এলিয়ে দিয়ে টিভির দেখছে কথা। তাদের পাশে বসে আছে আরশাদ। কাল থেকে আবারও শুরু হতে যাচ্ছে তার দৌড়ঝাঁপ। কে ফিল্মসের প্রথম পাঁচটা ছবির গল্প যাচাই-বাছাই চলছে। প্রাথমিক বাছাইয়ের পর স্ক্রিপ্টগুলো নিয়ে অরার সঙ্গে বসতে হবে। এরপর থেকে আর কোনো স্ক্রিপ্ট তো আর সে পছন্দ করবে না। এই দায়িত্ব সিইও মহাশয়ার। প্রথমবার তাকে শেখাতেই কাজটা এগিয়ে রেখেছে। ব্যস্ততার আগে যতটা সম্ভব এই দুজনের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে আরশাদ।
তার চোখদুটো পড়লো অরা এবং কথার দিকে। কথা হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে তাকে কার্টুনের দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছে আর অরা তার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন ভার্সিটির প্রফেসরের লেকচার শুনছে।
আরশাদ ঠাট্টার ছলে বলল, “তুমি এমনভাবে টিভির দিকে তাকিয়ে আছো যেন পৃথিবীতে এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই।”
অরা হাসিমুখে বলল, “আপনি কী বুঝবেন? স্পঞ্জববের ফর্মুলা চুরি হয়ে গেছে। কতটা কষ্টে আছে বেচারা!”
আরশাদ কিছু বলতে যাবে তার আগে কথা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তাদের দুজনের দিকে। কৌতূহলী গলায় বলল, “আচ্ছা অরা? তুমি বাবাকে আপনি ডাকো কেন?”
এইটুকু একটা মেয়ের এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল অরা। উত্তরে কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।
ওদিকে আরশাদ হাসতে হাসতে কথাকে একটা হাই ফাইভ দিয়ে বলল, “গুড কোয়েশ্চেন বাবা! আমার মাথায়ও এই প্রশ্নটা ঘুরছিল, কিন্তু জিজ্ঞেস করতে ভুলে যাচ্ছিলাম।”
কথা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “আমি কিন্তু ঠিকই মনে কর জিজ্ঞেস করেছি!”
আরশাদ বাহবা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “তুই বাবার স্মার্ট মেয়ে না, মনে তো রাখবিই!”
কথা বলল, “কই অরা! বললে না তো।”
কিছু কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে বলল, “আপনি ডাকি কারণ তোমার বাবা আমার থেকে বড়।”
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা কিন্তু একটা লেইম এক্সকিউজ বাবা। একেবারে বিশ্বাস করবি না।”
কথা কিছুটা সময় চিন্তা করে বলল, “আসলেই তো! বাবা তো আমার থেকেও বড়। আমি কি বাবাকে তুমি ডাকি?”
আরশাদ মুগ্ধ গলায় বলল, “Brillant logic! I’m so proud of you Kotha.”
অরা বুঝতে পারছে বাবা-মেয়ে মিলে তাকে জ্বালানোর মিশনে নেমেছে। এই দুজনের হাত থেকে সহজে তার নিস্তার নেই।
অরা কম্পিত স্বরে বলল, “তাহলে কী ডাকবো?”
কথা এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি ডাকবে! যেমন আমি ডাকি।”
অরা পরাজিত গলায় বলল, “আচ্ছা ডাকবো। এখন বসো।”
কথা জেদ ধরে বলল, “এখনই ডাকো!”
“এখনই ডাকতে হবে কেন? বললাম তো ডাকবো।”
আরশাদ মেয়েকে সাবধান করে দিয়ে বলল, “ওর কথায় বিশ্বাস করিস না কিন্তু। তোর সামনে বলছে ডাকবে, কিন্তু শেষমেশ আর ডাকবে না।”
কথা আঁতকে উঠে বলল, “সেটা তো হবে না! তোমাকে এখনই তুমি ডাকতে হবে।”
অরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরশাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যালো তুমি! ভালো আছেন?”
আরশাদ অভিযোগ করার ভঙ্গিতে বলল, “দেখ কথা! কী চিটারের পাল্লায় পড়েছি! বলে কিনা ভালো আছেন!”
অরা ফিসফিস করে আরশাদের কানে বলল, “কী শুরু করলেন আপনি?”
আরশাদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই কথা ধমকের সুরে বলল, “অরা! সুন্দর করে তুমি ডাকো।”
অরা ব্যর্থ গলায় বলল, “আচ্ছা। কী বলবো তুমি বলে দাও!”
কথা কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে ভেবে বলল, “বলো, তুমি অনেক ভালো।”
অরা আরশাদের দিকে তাকিয়ে লজ্জাসরমের মাথা খেয়ে বলল, “তুমি অনেক ভালো।”
আরশাদ অরার গাল টিপে দিয়ে বলল, “তুমিও সবথেকে ভালো।”
কথা এতে কী মজা পেল কে জানে? আনন্দে আত্নহারা হয়ে কতগুলো লাফ দিয়ে হাততালি দিতে লাগলো। বাচ্চা এই মেয়েটার সঙ্গে থাকলে সময়টা কী করে যে কেটে যায় খেয়ালই থাকে না আরশাদ-অরার। কথার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা আর টিভি দেখতে দেখতেই রাত নেমে এলো।
তিনজনে একসঙ্গে ডিনারের টেবিলে বসলো। অরা কথাকে খাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, তবে মেয়েটা অনর্গল কথার মেলা আর বিচ্ছুপনার কারণে তা কিছুটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অরা আজ সারাদিন কথাকে অনেকটা সময় দিয়েছে। তার ওপরে আবার ডিনারের সময় কথার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে বেচারি ক্লান্ত। আরশাদ তাই অরাকে রেস্ট নিতে পাঠিয়ে দিয়ে কথাকে নিয়ে গেল ঘুম পাড়াতে। কথার বহু বদভ্যাসের একটা হলো রাতে ব্রাশ করার প্রতি অনীহা। আরশাদ ব্রাশ করতে জোরাজুরি সে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “সকালে একবার ব্রাশ করেছি।” এমন পরিস্থিতিতে কোনো উপায়ন্তর খুঁজে না পেয়ে বিছানায় টুথব্রাশ এনে তাকে ব্রাশ করাতে হয়। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। আরশাদ মেয়েকে যত্ন নিয়ে ব্রাশ করিয়ে দিলো।
কথাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে আরশাদের নিজেরই ঘুম পেয়ে গেল। তবুও মেয়ের চোখে একফোঁটা ঘুম নেই। অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেই বাবার সঙ্গে। শুধু শুধু তার নাম কথা রাখেনি আরশাদ! কথার এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো কথা। আরশাদ মেয়ের গলা পর্যন্ত ব্ল্যাঙ্কেট টেনে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে অরা। আরশাদ ঘরে এসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আয়নার ফুটে ওঠা তার প্রতিচ্ছবি দেখে। কেমন জড়সড় হয়ে গেল অরা। আরশাদের এই চাহনি খুব ভালো করে চেনা তার। তাকে মাতাল করে দেওয়া চাহনি।
আরশাদ ধীর পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো অরার পেছনে। অরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তড়িৎ গতিতে তার ব্লাইজের পেছনের ফিতার বাঁধনটা খুলে দিলো সে। বিদ্যুতের ন্যায় কেঁপে উঠলো অরা। আরশাদ এসব কী করছে তার সঙ্গে? যতবারই অরা নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করে ততবারই আরশাদ এসে এলোমেলো করে দেয় তাকে। অথচ অরার মনে হয়, সে ঠিক এভাবেই এলোমেলো হয়ে থাকতে চায় আজীবন।
অরা আরশাদের দিকে ঘুরে কম্পিত স্বরে বলল, “ঘুমাবেন না?”
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “আবার আপনি? আমি কিন্তু গিয়ে কথার কাছে নালিশ করবো!”
অরা হতবাক গলায় বলল, “এখন সত্যি সত্যিই তুমি ডাকতে হবে? তখন তো কথার ছেলেমানুষীর সঙ্গে পেরে আমি…”
“এসব কোনো কথা চলতে না মিসেস হক। একবার যখন তুমি ডেকে ফেলেছো, তখন তো আর আপনিতে ফিরতে দেওয়া যাবে না।”
আরশাদের মুখে মিসেস হক ডাকটা শুনে অরার কী যে ভালো লাগলো! একটু একটু করে নিজের অধিকারটা তাহলে সে প্রতিষ্ঠা করেই ফেলল আরশাদ হকের জীবনে।
অরা আরশাদকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ লুকিয়ে বলল, “আপনি জানেন না আমার কত লজ্জা করে।”
আরশাদ অরার চুলে হাত ডুবিয়ে বলল, “আহারে আমার লজ্জাবতী বউটা! এসব লজ্জা-টজ্জা এবার ঝেড়ে ফেলো তো অরা। আমার কাছে লজ্জা কীসের?”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অরা বলল, “একটা কথা বলি?”
“কথা বলার আগে পারমিশন নেওয়ার অভ্যাসটা তোমার আর গেল না। কী করি তোমাকে নিয়ে!”
হাসিমুখে চুপ করে রইলো অরা। যখন সে ম্যানেজার ছিল আরশাদের তখন মনে হতো হুট করে বসকে কোনো একটা কথা বলা বেয়াদবির লক্ষণ। তাই কিছু বলার আগে অনুমতি নেওয়ার অভ্যাস তার বহুদিনের।
আরশাদ বলল, “বলো।”
“আমার না শাড়ি পরে ঘুমাতে খুব অসুবিধা হয়।”
আরশাদ অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “ঠিক আছে। আজকেও ঘুমানোর আগে তোমাকে আমার টিশার্টটা পরিয়ে দিবো।”
অরা চমকে উঠে তাকালো আরশাদের দিকে।সেই গম্ভীর ছেলেটা কিনা ভেতরে ভেতরে এত অসভ্য ছিল! কী সাংঘাতিক ব্যাপার! অরার লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে হেসে ফেলল আরশাদ। মেয়েটাকে কথায় কথায় লজ্জা পাইয়ে দিয়ে তার দারুণ লাগে।
আরশাদ ঠোঁটের হাসিটা বজায় রেখে বলল,
“যাও, চেঞ্জ করে এসো।”
চেঞ্জ করে সাদা একটা সালোয়ার কামিজ পরে এলো অরা। সাদা রঙের নিজস্ব একটা ভাষা আছে। এই রঙ মানুষের স্নিগ্ধতা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। অরাকে এরূপে দেখে নতুন করে মুগ্ধ হলো আরশাদ।
অরা বিছানার ওপর বসতে বসতে বলল,
“কাল কখন উঠবেন আপনি?”
আরশাদ বিরক্ত গলায় বলল, “আবারও আপনি-আজ্ঞে শুরু করলে?”
অরা অসহায় গলায় বলল, “কাল থেকে তুমি ডাকবো, প্রমিজ!”
“কেন? আজকে কি সমস্যা?”
“এভাবে হুট করে কাউকে তুমি ডাকা যায় না-কি?”
আরশাদ হুমকির স্বরে বলল, “ঠিক আছে। কালকে থেকে, মনে থাকে যেন।”
“কখন উঠবেন বললেন না তো।”
“সাতটায়।”
“এত সকালে?”
“হুঁ। নয়টা থেকে মিটিং স্টার্ট। একসঙ্গে কতগুলো স্ক্রিপ্ট যে শুনতে হবে কালকে! মানুষের কাছে আগে শুনতাম প্রোডিউসারের অনেক যন্ত্রণা। এখন প্রোডিউসার হওয়ার আগেই তা হারে হারে টের পাচ্ছি।”
অরা আগ্রহ নিয়ে বলল, “আচ্ছা? কাল যে স্ক্রিপ্টগুলো পছন্দ করবেন, সেগুলোই কী সিনেমা বানানোর জন্যে ফাইনাল?”
“না। প্রাথমিকভাবে সিলেক্ট করবো। তারপর সেই স্ক্রিপ্টগুলো আমি আর তুমি একসঙ্গে পড়ে ফাইনালাইজ করবো।”
অরা হতবিহ্বল কণ্ঠে বলল, “আমি?”
“হ্যাঁ। সিইও হয়েছো, আর এই কাজটা করবে না। এরপর থেকে তো সবগুলো স্ক্রিপ্ট বাছাই তোমাকেই করতে হবে। আমাদের প্রোডাকশন হাউজে প্রচুর স্ক্রিপ্ট জমা পড়বে। আর তুমি তো আমার টেস্ট খুব ভালো করেই জানো। যে গল্পগুলো আমার টেস্টের সঙ্গে যাবে সেগুলোই সিলেক্ট করবে।”
“আর কী কী করতে হবে আমাকে?”
আরশাদ সুন্দর করে গুছিয়ে বলল, “স্ক্রিপ্ট পছন্দ করার পর থেকে সিনেমা রিলিজ পর্যন্ত প্রসেসটা অনেক লম্বা। তোমাকে প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে তদারকি করতে হবে। সিনেমার কাস্টিং, লোকেশন, প্রোডাকশন ম্যানেজমেন্ট। এরপর শুটিং শুরু হওয়ার পর শুটিং ঠিক মতো চলছে কিনা, সেটে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা। তুমি তো জানোই একটা সেটে হাজারটা ঝামেলা লেগেই থাকে। শুটিংয়ের পর এডিটিং, ডাবিং এসব ঠিকমত হচ্ছে কিনা। তারপর রয়েছে প্রমোশনের দায়িত্ব। আর সবথেকে বড় কথা, বাজেটটা সামলানো। খুবই তীক্ষ্ণভাবে তোমাকে বাজেট করতে হবে। আর আমি জানি আমার টাকাগুলো তুমি পানিতে ফেলতে দিবে না।”
“আপনার ম্যানেজার হওয়ার আগে আমি তো কিছুই পারতাম না। ট্রেনিং পেয়ে পেয়ে শিখেছি। এবার আমাকে কে শেখাবে?”
“এবারও ট্রেনিং পাবে। আর ভেবো না এই সব কাজগুলো তোমাকে একা করতে হবে। তোমাকে হেল্প করার জন্যে আমাদের বিশাল টিম রয়েছে। তাছাড়া আমি তো আছিই সবসময়।”
অরা আগ্রহে উজ্জ্বল হয়ে বলল, “জানেন, আগে না এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার খুব ভয় লাগলো। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ততই আমার এক্সাইটমেন্ট বেড়ে যাচ্ছে।”
আরশাদ অন্যরকম গলায় বলল, “আর আমার এক্সাইটমেন্টের কী হবে?”
অরা চুপ করে রইলো। তার চোখদুটো আটকে আছে আরশাদের চোখের দিকে। চোখে চোখে যেন মনের মাঝে জমে থাকা অজস্র ভালোবাসার আদান-প্রদান করছে তারা। অরা তার দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। ওই চোখদুটোর দিকে তাকালো যে কারোরই নেশা হয়ে যাওয়ার কথা।
আরশাদ আচমকা হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজের বুকে এনে ফেলল অরাকে। আবারও হারিয়ে যেতে শুরু করেছে অরা। একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে আরশাদের মাঝে। সত্যিকারের পৃথিবীর সঙ্গে যেন তার কোনো যোগাযোগ নেই।
আরশাদ আর এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে ঠোঁটের স্পর্শ দিলো অরার ঠোঁটে। অরা শক্ত করে খামচে ধরলো আরশাদের টিশার্ট। আরশাদের ভালোবাসাময় জগতের দুয়ার আবারও খুলে গেছে তার জন্যে। যে জগৎ না করার কোনো উপায় তার নেই।
(চলবে)