#ফিরে_আসা
৫৭+৫৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
সারা দুনিয়ার চোখে সুপারস্টার আরশাদ হক। তাকে এক পলক নিজ চোখে দেখার জন্যে মানুষ চিরকাল অপেক্ষা করে থাকে। অথচ সেই আরশাদ নিজ বাড়িতে এক ফোঁটাও পাত্তা পাচ্ছে না। এখানে তো আর সে কোনো সুপারস্টার নয়, বাড়ির বড় ছেলে। তার কাজকর্মের সকল ভার এসে পড়েছে তার ওপরে।
এই মুহূর্তে বাঁশের একটা মইয়ের ওপরে দাঁড়িয়ে সে। এ বাড়িতে নির্দিষ্ট কোনো স্টোর রুম নেই। জিনিসপত্র স্টোর করে রাখার জন্যে প্রতিটা ঘরের সিলিংয়ে ছোট ছোট ঘর আছে। কার মাথা থেকে যে এমন উদ্ভট বুদ্ধি এসেছে কে জানে? যে এই উদ্ভট স্টোর রুম বানিয়েছে তার ওপর তো রাগ লাগছেই, তার থেকেও বেশি রাগ লাগছে মায়ের ওপর। আরশাদের মা না জানি কী মনে করে রাজ্যের সব হাঁড়ি-পাতিল জমিয়ে রেখেছেন এখানে।
হাঁড়ি নামিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব এসে পড়েছে বেচারা আরশাদের ওপর। তার শরীরটা মইয়ের ওপরে আর মাথা স্টোর রুমে ভেতরে। একে তো অন্ধকার, তার ওপরে আবার চারিদিকে মাকড়সার জাল। বিরক্তিতে গা জ্বলে যাচ্ছে আরশাদের।
মইটা নিচ থেকে ধরে রেখেছে আরশাদের ছোট মামার সবথেকে ছোট ছেলে আকাশ। তাকে মই ধরে রাখতে বলা হয়েছে যাতে আরশাদ ব্যালেন্স হারিয়ে না পড়ে যায়। কিন্তু সে নিজেই মইটাকে এমনভাবে কাঁপাচ্ছে, আরশাদের মনে হচ্ছে সে এক্ষুনি পড়ে যাবে।
আরশাদ ধমকের সুরে বলল, “এই ছাগল! ঠিক করে ধর!”
আকাশ আহত গলায় বলল, “ঠিক করেই তো ধরেছি ভাইয়া।”
আরও একবার স্টোর রুমে বিরক্ত ভঙ্গিতে চোখ বোলালো আরশাদ। এরপর অসহায় গলায় উচ্চস্বরে বলল, “মা! পাচ্ছি না তো।”
সেলিনা হক নিচ থেকে অবাক গলায় বলল, “না পাবার কী আছে? সবথেকে বড় হাঁড়িটা তো সমানেই রেখেছি।”
আসফিয়া পাশের ঘরে যাচ্ছিল। মা-ছেলের কথোপকথন কানে আসায় থেমে দাঁড়িয়ে ফুর্তির স্বরে বলল, “সামনে রাখলে কী আর পেছনে রাখলেই কী? ওর চোখে কিছুতেই পড়বে না। তোমার ছেলে তো মা গুড ফর নাথিং।”
রাগে-বিরক্তিতে দাঁতে দাঁত চেপে রইলো আরশাদ। মহারাগী আরশাদ হককে এমন কথা বলার সাহস এই পৃথিবীতে কারও নেই। তবে এ বাড়িতে বাইরের পৃথিবীর কোনো নিয়ম চলে না। নিজের ওপরেই রাগটা সবথেকে বেশি হচ্ছে আরশাদের। কেন যে বিয়ে করতে এসেছিল এখানে?
আরশাদের বিয়ের প্রস্তুতি চলছে দুমাস ধরে। একমাস আগে আসফিয়া দেশে ফেরে। তারপর থেকে মূলত আসল প্রস্তুতি শুরু হয়। তাদের কাজিনদের বিশাল একটা দল আছে। দীর্ঘদিন কারও সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই। আরশাদের নির্দেশনায় সকলকে এক করে আসফিয়া।
আরশাদের সিলেটের বাড়িতে আজ উৎসবমুখরতা বিরাজ করছে। কাল আরশাদ-অরার গায়ে হলুদ। কাজিন দলের মেয়েরা বাড়ির উঠানে লাউডস্পিকারে গান বাজিয়ে নাচ প্রাকটিস করছে। নাচে কাল ছেলেদের হারিয়ে দিতে হবে তো। যদিও ছেলেদের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে তারা এমনিতেই হেরে যাবে। কেউই প্রাকটিস করার সুযোগ পাচ্ছে না। সবাই ব্যস্ত কোনো না কোনো কাজে। কেউ ঘর সাজাচ্ছে, কেউ বাজারের ব্যাগ নিয়ে ছুটে বাজারে যাচ্ছে, আবার কেউ আকাশের মতো মই ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
আরশাদের খালা এবং দুই মামীর দখলে রান্নাঘরটা। মামারা ব্যস্ত ডেকোরেটরের লোকদের সামলাতে। পুরো বাড়িটা আজ মরিচবাতিতে মুড়ে দেওয়া হবে। আরশাদের খালু এবং বড় চাচা তার তদারকি করছে।
পরিবারটার সঙ্গে একেবারে মিশে গেছে সীমা। তার একমাত্র বান্ধবীর বিয়ে আর সে থাকবে না, তা তো হয় না। সীমা এ বাড়িতে পা রাখতেই সকলের প্রিয় হয়ে গেছে। সেলিনা হক তো তার সঙ্গে পরিচয়ের এক ঘন্টার মাথায় তুইয়ে নেমে এসেছেন। তাকে কেউ বাইরের মেয়ে মনে করছে না। একেবারে ঘরের মেয়ের মতো তাকে কাজের মাঝে ব্যস্ত রাখছে।
মূল বাড়ির পেছনে বাংলাঘর। সেটা মেয়েদের জন্যে বরাদ্দ। পুরুষমানুষের প্রবেশ সেখানে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। পুরুষমানুষ বলতে আরশাদ। অরাকে বাংলাঘরে রাখা হয়েছে। বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। আরশাদের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, গায়ে হলুদের আগে সে কিছুতেই অরার সঙ্গে দেখা করতে করতে পারবে না। কাউকে না জানিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ে সেরে ফেলার এটাই শাস্তি।
একে তো একের পর এক কাজ। তার ওপরে দুদিন ধরে প্রিয়তমা বউয়ের মুখটা না দেখা। যে আরশাদ অরাকে ছাড়া এক সেকেন্ডও থাকতে পারে না। দুদিন পেরিয়ে যাওয়ার পর ভেতরে ভেতরে সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। আবারও মনে হলো, কেন যে বিয়ে করতে এসেছিল এখানে?
সীমা বাংলাঘরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “ভারী অদ্ভুত তো তোর শ্বশুরবাড়ি!”
অরা বসে বসে নিজের জামাগুলো ভাঁজ করছিল। সীমার এমন কথার তার দিকে তাকিয়ে ঝলমলে গলায় বলল, “কেন?”
সীমা এসে অরার পাশে বসতে বসতে বলল, “আরশাদ ভাইয়াকে দিয়ে রান্নার হাঁড়ি নামাচ্ছে। বেচারা বিয়ে করতে এসেছে, অথচ তাকে দিয়ে একটার পর একটা কাজ করিয়েই যাচ্ছে।”
অরা খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, “আমার না খুব আনন্দ হচ্ছে জানিস। একটা পরিবার কী, কখনো তো বুঝিনি। এবার বুঝছি।”
সীমা অরার কাঁধে হাত রেখে বলল, “অনেক সুন্দর তোর পরিবারটা। সবাই তোকে খুব ভালোবাসে।”
অরা হাসিমুখে বলল, “Touchwood.”
দুই বান্ধবীর কথোপকথনের মাঝে পাশের ঘর থেকে ছুটে এলো কথা। তার ঠোঁটে লেগে আছে পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর হাসি। আর পরনে টকটকে লাল একটা ফ্রক।
কথা অরার কাছে এসে উৎফুল্ল গলায় বলল, “অরা? কেমন লাগছে আমাকে?”
অরা মুগ্ধ গলায় বলল, “ওমা! খুব সুন্দর লাগছে। কে দিয়েছে এই ফ্রকটা?”
“ফুপি।”
“ফুপিকে থ্যাংকস বলেছিস?”
কথা মাথায় হাত দিয়ে বলল, “না তো! একদম ভুলে গেছি। দাড়াও এক্ষুনি বলে আসছি।”
কথা ছুটতে যাবে তার ঠিক আগেই অরা তাকে বাঁধা দিয়ে বলল, “কথা দাঁড়া! এদিকে আয়।”
কথা বাধ্য মেয়ের মতো তার কাছে ফিরে এলো। অরা তাকে পেছন ফিরিয়ে দাঁড় করিয়ে যত্ন নিয়ে ফ্রকের পেছনের ফিতাটা বেঁধে দিলো। অরা হাসিমুখে অরার গালে চুমু খেয়ে আবারও ছুটে গেল।
সীমা অভিভূত গলায় বলল, “তোদের বন্ডিংটা
সুন্দর কেন বল তো?”
“খুব স্পেশাল তো। তাই সুন্দর।”
সীমা কৌতূহলী গলায় বলল, “সবাই ঠিক আছে। কিন্তু একটা ব্যাপার। কথা তোকে নাম ধরে ডাকে কেন?”
অরা স্বাভাবিক গলায় বলল, “তাছাড়া কী ডাকবে?”
“মা জাতীয় কিছু!”
“আমাকে মা ডাকবে কেন? ওর মা তো আছেই।”
সীমা অবাক গলায় বলল, “তুই কী চাস না কথা তোকে মা ডাকুক?”
অরা সহজ ভঙ্গিতে বলল, “আমার চাওয়া না চাওয়াতে কী আসে যায়? কথার মা আছে, আর এটাই সত্যি। তাকে তো আর সারাজীবন জেলে বন্দী করে রাখা হবে না। কোনো না কোনোদিন বেরিয়ে আসবে। আরশাদও বা কতদিন মেয়েকে মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে রাখবে?”
সীমা ভ্রু কুঁচকে বলল, “ওই বদ মহিলা মাদক মামলায় আটকে গেছে। ড্রাগ মাফিয়াদের সঙ্গে পুলিশ ওর লিংক পেয়েছে। খুব সহজে ছেড়ে দেবে ভেবেছিস? তার ওপরে কিডন্যাপিংয়ের মামলাটা তো আছেই। নওশীনের বের হতে হতে আর না হলেও পাঁচ-ছয় বছর। ততদিনে কত বড় হয়ে যাবে কথা। মায়ের কথা কী আর মনে থাকবে? মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে ওকে বড় করে তুলবি।”
অরা প্রচ্ছন্ন এক হাসি হেসে বলল, “সন্তান কখনো মাকে ভুলে যায় না সীমা। মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে ওকে বড় করে তুলবো ঠিকই। কিন্তু ওর মায়ের জায়গাটা নিতে পারবো না কখনো। আমি না হয় কথার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়েই থাকলাম।”
সীমা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝি না বাবা তোকে!
“বুঝতে হবেও না।”
সীমা কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনি সেলিনা হকের ডাক কানে ভেসে এলো, “সীমা! এদিকে আয় না মা।”
সীমা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “যাই। তোর শাশুড়ির ডাক পড়েছে।”
বাংলাঘরে আপাতত কেউ নেই, অরা একা। চাতক পাখির মতো ঠিক এই সুযোগটারই অপেক্ষায় ছিল আরশাদ। গত দুদিনে এক মুহূর্তের জন্যে অরাকে একা ছাড়েনি কেউ। তাই এই সুযোগটাও পায়নি আরশাদ। বাড়ির সকলে নিজেদের কাজে ব্যস্ত। সকল ব্যস্ত চোখগুলো ফাঁকি দিয়ে বাংলাঘরের দিকে এগিয়ে আরশাদ।
দুই ঘন্টা ধরে প্রাকটিস করে করে ক্লান্ত দিশা। নাচের দলের লিডে কাল সেই থাকবে। দিশা আরশাদের একমাত্র খালার একমাত্র মেয়ে। ঢাকা মেডিকেলে দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছে। যদিও তার ভাবেসাবে কেউই বুঝতে পারে না, ভবিষ্যতে এই মেয়ে মানুষের রোগ নিরাময় করবে।
দিশা হাপাতে হাপাতে উঠান থেকে নেমে বাকিদের উদ্দেশ্যে বলল, “আমি আর পারবো না, ভাবির কাছে গেলাম। তোরা প্রাকটিস কর।”
আরশাদকে বাংলাঘরের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে ঝড়ের গতিতে ছুটে এলো দিশা।
আঁতকে উঠে বলল, “ভাইয়া! ভাইয়া! কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
ধরা পড়ায় মনে মনে আরশাদ ঘাবড়ে গেলেও তার চেহারায় তা ফুটে উঠলো না। দেশের সবথেকে নিখুঁত অভিনেতা বলে কথা!
আরশাদ উল্টো দিশাকে ধমক দিয়ে বলল, “আমার বাড়িতে আমি যা খুশি তাই করবো। তোকে জবাবদিহি করতে হবে কেন?”
“যা খুশি তাই করো না, কে মানা করেছে? তাই বলে ওই ঘরে যাবে কেন?”
আরশাদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোর ব্রেন ডেভলপমেন্ট হয়নি ঠিক মতো? ওই ঘরে যাওয়াটাও যা খুশি তাই করার মধ্যে পড়ে।”
দিশা অপমানটা চুপচাপ সহ্য করে বলল, “ব্রেন ডেভলপমেন্ট হয়েছে তো! সেজন্যেই আমার পরিষ্কার মনে আছে, তোমাকে ওই ঘরের আশেপাশে যেতে মানা করেছিলাম।”
আরশাদ জেদী গলায় বলল, “গেলে কী করবে।”
দিশা মুখ টিপে হেসে বলল, “গেলে সবাইকে বলে দিবো বউয়ের জন্য তুমি কতটা পাগল।”
আরশাদ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো দিশার দিকে। কাজিনরা সব তার এক দৃষ্টিকে জমের মতো ভয় পায়। তবে আজ কোনো এক বিচিত্র কারণে দিশা ভয় পাচ্ছে না। বরং তার প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে।
আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “রিকোকে চিনিস?”
দিশা কিছুটা সময় ভেবে বলল, “চিনি তো! ওই বাজে দেখতে লোকটা। সিনেমায় মাস্তান হয়।”
“ওর সঙ্গে খুব ভালো পরিচয় আছে আমার। এক্ষনি খালাকে গিয়ে বলছি ওর কাছে তোকে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব পাঠাতে।”
রাগে গজগজ করতে করতে মূল বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল আরশাদ। দিশা এবার প্রাণ খুলে হেসে প্রবেশ করলো বাংলাঘরে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বই পড়ছে অরা। সারা বাড়িজুড়ে সকলের এত ব্যস্ততা, অথচ তার করার মতো কিছুই নেই। এই ঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছে তাকে।
দিশা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “খুব বোর হচ্ছো, তাই না ভাবি?”
দিশার মুখে ভাবি ডাকটা শুনে অরার মাঝে একরাশ ভালো লাগা ছড়িয়ে গেল। আরশাদের অন্যান্য কাজিনরাও ইতোমধ্যে এই ডাক রপ্ত করে ফেলেছে।
অরা বইটা নামিয়ে রেখে বলল, “তা একটু হচ্ছি। তোমরা নিজেরা আনন্দ করছো, আর আমাকে এক ঘরে বন্দি করে রেখেছ।”
দিশা কিছুটা একটা বলতে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময়ে ঘরে আগমন ঘটলো আসফিয়ার।
দিশা আসফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখো না আপা, ভাবি বোর হচ্ছে। এক কাজ করি, ভাইয়াকে ঘরে বন্দি করে রাখি ততক্ষণে ভাবি বাড়িটা ঘুরে বেড়াক!”
আসফিয়া বিছানায় বসতে বসতে বলল, “তোরা পারিসও বাবা! কী দরকার ছেলেমেয়ে দুটোকে আলাদা করে রাখার? এমন তো না ওদের প্রথম বিয়ে হচ্ছে। এর আগে একে অপরের মুখ দেখেনি।”
দিশা দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “এজন্যেই তো দরকার আছে আপা। আরশাদ ভাইয়া আমাদের কাউকে না জানিয়ে কীভাবে বিয়ে করে ফেলল। এবার বুঝুক মজা! বেচারা আরশাদ ভাইয়া তো বউয়ের বিরহে একেবারে পাগল হয়ে যাচ্ছে। কাল দিনটা আসার আগেই দেবদাস-টেবদাস না হয়ে যায়।”
অরা চমকে উঠে বলল, “মানে?”
দিশা হাস্যোজ্জ্বল গলায় বলল, “এ ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছিল ভাইয়া। ভাগ্যিস আমি ধরে ফেলেছিলাম।”
দিশা আর আসফিয়া একসঙ্গে হেসে ফেলল। এদিকে লজ্জায় অরার মাথা কটা যাচ্ছে। এই নির্লজ্জ-অসভ্য ছেলেটাকে নিয়ে আর পারা যায় না! বিয়ের প্রায় আট মাস পেরিয়ে গেল, অথচ ভাবটা এমন যেন নতুন করে তার কলেজ লাইফের প্রেমিকাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে।
অরাকে লজ্জা পেতে দেখে আসফিয়া পরিস্থিতি সহজ করার উদ্দেশ্যে বলল, “ভাবি বোর হচ্ছে আর তুই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিস? বেচারিকে একটু সময় দিলেও তো পারিস।”
দিশা আত্মপক্ষ সমর্থনের উদ্দেশ্যে বলল, “আমি তো মাত্র প্রাকটিস থেকে এলাম।”
“বুঝেছি। ওই আলমারি থেকে অ্যালবামটা বের করে দে। অরাকে আমাদের পরিবারের ছবি দেখাই।”
আসফিয়া পুরনো দিনের ছবিগুলো অরাকে দেখাচ্ছে আর পরিবারের সকল সদস্যদের চিনিয়ে দিচ্ছে। কোনটা মামা, কোনটা মামা, কোনটা চাচা, কোনটা চাচী। এই মধুর ডাকগুলো ডাকার মতো কোনো মানুষ অরা এ জীবনে পায়নি। কোনোদিন পাবে বলে ভাবতেও পারেনি। যে নিয়তি একদিন তার থেকে সব কেড়ে নিয়েছিল, সেই নিয়তিই আজ এমন সুখময় একটা সময়ের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে।
একটা ছবি চোখে পড়তেই অরা খিলখিল করে হেসে উঠলো। কোনো এক বিয়ে বাড়ির মূল স্টেজের সোফায় পা টানটান করে শুয়ে আছে ছোট্ট আরশাদ। ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা কে জানে? বর-কনে বসার জায়গা না পেয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
আসফিয়া ঝলমলে গলায় বলল, “আমাদের ছোট মামার বিয়ের ছবি। আরশাদটা ছোটবেলা থেকেই বাঁদর প্রকৃতির। বিয়ে বাড়িতে যেতে চায়নি। তার না-কি ঘুম পাচ্ছে। মা আর আমি জোর করে নিয়ে যায়। ওমা! বিয়ে বাড়িতে গিয়ে বর-কনের আসনেই ঘুমিয়ে পড়লো।”
অরা প্রচ্ছন্ন একটা হাসি হেসে অ্যালবামের পাতা উল্টালো। হঠাৎই একটা প্রশ্ন জেগে উঠলো তার মনে। প্রশ্নটা আসফিয়া করা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না সে।
দোনোমনো করতে করতে অরা জিজ্ঞেস করলো, “আপনাকে একটা প্রশ্ন করি আপা?”
“করো না! এত ফর্মালিটির কী আছে?”
অরা কৌতূহলী হয়ে বলল, “আপনি কখনো বিয়ে করেননি কেন?”
অরা ভেবেছিল এমন একটা প্রশ্নে কিছুটা হেলো অপ্রস্তুত হয়ে যাবে আসফিয়া। অথচ তেমন কিছুই হলো না। খুবই স্বাভাবিক একটা হাসি হেসে আসফিয়া দ্রুত গতিতে অ্যালবামের পাতা উল্টাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। যেন কোনো নির্দিষ্ট একটা ছবি খুঁজছে সে।
ছবিটা খুঁজে পেয়ে আসফিয়া সেদিকে আঙুল তাক করে বলল, “এই মহাশয়ের জন্যে!”
আসফিয়ার আঙুল অনুসরণ করে অরা তাকালো সেদিকে। অনেক পুরনো একটা ছবি। শাপলা চত্বরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুই তরুণ-তরুণী। দুজনের কারও মুখেই হাসি নেই। কিঞ্চিৎ বিরক্তি হয়েছে। রোদের তীব্রতায় চোখ মেলে তাকাতে পারছে না তারা। তরুণী যে আসফিয়া এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই তরুণ কে?
আসফিয়া মলিন গলায় বলল, “সৌরভ। ইউনিভার্সিটিতে অনার্স করতে গিয়ে ওকে ক্লাসমেট হিসেবে পাই। প্রথম প্রথম আমি একেবারেই দেখতে পারতাম না ওকে। কেমন অগোছালো একটা হেসে। ডেস্ক থেকে উঠে দাঁড়াতে গেলে জিনিসপত্র সব ফেলে দেয়! অথচ কীভাবে যেন এই অগোছালো ছেলেটার প্রেমে পড়ে গেলাম। আমাদের সম্পর্কটা ছিল অনেকদিনের। সম্পর্কের থেকেও গভীর ছিল আমাদের বন্ধুত্ব। সৌরভের মতো বন্ধু আমি এ জীবনে পাইনি।”
অরা আগ্রহ নিয়ে বলল, “এখন সে কোথায়?”
আসফিয়া ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “আমাকে একা ফেলে কোথায় যেন পালিয়ে গেছে।”
অরা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল আসফিয়ার দিকে। কথাটার মানে যেন ঠিক বুঝতে পারলো। পালিয়ে যাওয়ার মানে কী? অরার চোখেমুখে হাজারো প্রশ্নেরা আনাগোনা করছে।
আসফিয়া ক্ষীণ স্বরে বলল, “ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট বলে পাশ করে বেরিয়ে আসতে না আসতেই চাকরি পেয়ে যায়। এক মাসের মতো চাকরি প্রথম স্যালারি পায়। আমাকে বলেছিল প্রথম স্যালারি দিয়ে আমার আর ওর মায়ের জন্যে হুবহ একই রকমের শাড়ি কিনবে। ওর মা যেদিন আমাদের বাড়িতে আমাকে দেখতে আসবে, সেদিন ওই শাড়িটা পরবে। এদিকে আমিও একই শাড়ি পরে সেজেগুজে থাকবো। সময়মতো যেই ট্রে হাতে তাদের সামনে যাবো, ওর মা আঁতকে উঠে বলবে, এ কী কান্ড! আমাদের শাড়ি তো একই!”
অরা নিঃশব্দে শুনছে তার কথাগুলো।
আসফিয়া হতাশ গলায় বলল, “শাড়ি আর কিনতে পারলো কই? ওই রাতে দুজন ছিনতাইকারী ওর রিকশা আটকায়। টাকা ছিনিয়ে নিতে চায় কিন্তু সৌরভ বারবার বাঁধা দিচ্ছিল। তার ওর পেটে ছুরি বসিয়ে দিয়ে টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়।”
অরা হতভম্ব হয়ে গেল। এমনটা সে মোটেও আশা করেনি। সে ভেবেছিল, পালিয়ে যাওয়ার মানে হয়তো প্রেমে বিচ্ছেদ। বিচ্ছেদ তো বটেই! তাই বলে এতটা করুণ বিচ্ছেদ? আসফিয়ার মতো প্রাণবন্ত একটা মানুষ ভেতরে ভেতরে এতটা কষ্ট নিয়ে বসবাস করছে?
অরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “I’m so sorry!”
আসফিয়া স্বাভাবিক গলায় বলল, “আরে ধুর! সরি বলার কী আছে? আমাকে কেউ সৌরভের কথা মনে করিয়ে দিলে আমি কষ্ট পাই না, বরং খুশি হই।”
অরা শুকনো গলায় বলল, “এতটা কষ্ট কীভাবে সহ্য করছেন আপা?”
“সহ্য করতে পারতাম না তো। ও পালিয়ে যাওয়ার পর কেমন পাগলের মতো হয়ে গেছিলাম। ঠিক মতো খেতে পারতাম না, ঘুমাতে পারতাম না। দিনরাত চিৎকার করে কাঁদতাম। পরে একটা সময় নিজেই রিয়ালাইজ করলাম, সৌরভ কি কোনোদিন আমাকে এভাবে দেখতে চেয়েছিল? ও সবসময় বলতো জানো, তোকে কাঁদলে ভূতের মতো লাগে। কখনো কাঁদবি না। ওর কথা মনে করে আবারও নিজের মধ্যে ফিরলাম। সৌরভ খুব বিয়ে পাগল ছিল বুঝলে। কথায় কথায় বলতো, আমাদের বিয়ের দিন এটা করবো ওটা করবো। সে মানুষটা এত আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও বিয়ে করতে পারলো না, তাকে রেখে অন্য কাউকে আমি বিয়ে করি কী করে?”
নিজের অজান্তেই অরার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।
আসফিয়া অরার চোখে জল মুছে দিয়ে বলল, “এই বোকা মেয়ে! কাঁদছো কেন? আমাকে দেখো, আমি কাঁদছি?”
অরা আর্দ্র গলায় বলল, “আপনি অনেক স্ট্রং আপা। প্রিয়জনকে হারিয়ে কেউ কী করে বাঁচতে পারে?”
আসফিয়া অরাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “স্ট্রং আমাকে সৌরভই বানিয়েছে। আমি তো ওকে হারাইনি অরা। পালিয়ে গিয়ে ঠিক আমার হৃদয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে। এখন সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করে। তুমি কেঁদো না তো অরা। আরশাদ যদি জানতে পারে তার বউকে আমি কাঁদিয়েছি, তাহলে আমার খবর করে ফেলবে।”
দুজনের কথোপকথনের মাঝে ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো দিশা।
বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল, “কী নিয়ে কথা হচ্ছে?”
আসফিয়া বলল, “তেমন কিছু না। তোর ভাবিকে ছবি দেখাচ্ছিলাম।”
দিশা কোলের ওপর একটা বালিশ রেখে একরাশ কৌতূহল নিয়ে বলল, “ভাবি? আরশাদ ভাইয়া হাসবেন্ড হিসেবে কেমন?”
অরা খানিকক্ষণ ভেবে বলল, “আমি তো জীবনে কখনো আদর্শ হাসবেন্ডের উদাহরণ দেখিনি। আমার বাবাকে দেখেছি কেবল। সে হাসবেন্ড হিসেবে ছিল জঘন্য।”
“কেন?”
“তার অবহেলার কারণেই আমার মা মারা যায়। পরবর্তীতে সৎ মাকে ঘরে আনলেও তাকেও অবহেলা করতো। আমি ভাবতাম হাসবেন্ডরা বুঝি এমনই হয়।”
দিশা উৎফুল্ল হয়ে বলল, “কিন্তু আরশাদ ভাইয়াকে বিয়ে করে তোমার সেই ধারণা পালট গেছে। তাই না?”
অরা লজ্জামাখা গলায় বলল, “হুঁ। হাসবেন্ড যে এতটা কেয়ারিং হতে পারে, এটা ওকে দেখেই শিখেছি। আমার ছোট থেকে বড় সব প্রয়োজনের খেয়াল রাখে। সামান্য একটু মাথা ব্যাথা হলেও ডক্টরকে ডেকে এনে হুলস্থুল কান্ড করে। যতক্ষণ তার আশেপাশে থাকি, ততক্ষণ মনে হয় কোনো রূপকথার জগতে আছি।”
দিশা অরার দিকে ঝুঁকে এসে বলল, “আচ্ছা ভাবি? আরশাদ ভাইয়া সিনেমার পর্দায় যেমন রোমান্স করে, বাস্তবেও কী ততটা রোমান্টিক?”
দিশার এমন প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে গেল অরা। লজ্জায় তার গালদুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। সিনেমার পর্দায় আরশাদের রোমান্টিক অবতার সকলের পছন্দের। অথচ সেই রোমান্স তার বাস্তব জীবনের রোমান্সের কাছে কিছুই নয়। এসব কথা সকলকে বলে বেড়ানো যায় না-কি? অরা কী বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইলো।
আসফিয়া পরিস্থিতি সামাল দিতে ধমকের সুরে দিশাকে বলল, “এসব কী দিশা? ভাবিকে কেউ এমন প্রশ্ন করে?”
দিশা হতবাক হয়ে বলল, “ভাবিকেই তো এসব প্রশ্ন করে। ননদ-ভাবির সম্পর্কটা হলো বন্ধুদের মতো। ভাবি! বলো না!”
অরা অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বসে রইলো। এসব কথা সে মরে গেলেও কাউকে বলতে পারবে না। ভাগ্যিস এই মুহূর্তে ঘরে আগমন ঘটেছিল অরার শাশুড়ি মায়ের। তিনি না এলে তো এই মেয়ে অরাকে মুখ খুলতে বাধ্য করে ছাড়তো।
সেলিনা হক দিশাকে উদ্দেশ্য করে বিরক্ত গলায় বলল, “এই দিশা! মেয়েগুলো আর কতক্ষণ প্রাকটিস করবে? তিন ঘণ্টা ধরে লাউডস্পিকারে গান বাজছে। বাড়ির সবার মাথা ধরে গেছে তো!”
দিশা আদুরে গলায় বলল, “একটু সহ্য করে নাও না খালা। আজই তো শেষ দিন। কাল ছেলেদের হারিয়ে দিতে হবে না?”
“তোরা এমনিতেও জিতবি। ছেলেরা নাচ পারে না-কি? এবার তো মেয়েগুলোকে ক্ষান্ত দিতে বল। আমাদের কারো কথা ওরা শুনছে না।”
কাল গায়ে হলুদের পর্ব শেষে আরশাদের সকল কাজিনদের মাঝে নাচের প্রতিযোগিতা হবে। মেয়েরা এক দলে এবং ছেলেরা এক দলে। প্রতিযোগিতা উপলক্ষে বিচারকের প্যানেলও গঠন করা হয়েছে। সেলিনা হক, আরশাদের দুই মামী, খালা, এবং দুই চাচা। যদিও এঁদের মধ্যে কেউই নাচ বোঝেন না, তবুও বয়োজেষ্ঠোদের প্রতি সম্মান রেখে তাদের এই প্যানেলে রাখা হয়েছে।
প্রত্যেক দল নাচের জন্যে সাত মিনিট সময় পাবে। এই সাত মিনিটে তাদের সেরাটা দিয়ে পারফর্ম করতে হবে। বিজয়ী দল পাবে এক লাখ তেষট্টি হাজার টাকার একটা চেক। এমন উদ্ভট এমাউন্ট নির্ধারণকারী আর কেউ নয়, আরশাদ। যেহুতু চেকটা দিচ্ছে সে, তাই এমাউন্টও সেই ঠিক করেছে। প্রথম দিকে যদিও সকলে বলেছিল, হয় এক লাখ ষাট, না হয় পঁয়ষট্টি রাখতে। তেষট্টি আবার এমন হিসাব? আরশাদের একটাই কথা তার কাছ থেকে চেক নিতে হলে এই এমাউন্টের চেকই নিতে হবে। এর থেকে বেশি নয়, কমও নয়।
প্রাকটিস শেষে তাদের আড্ডায় যোগ দিলো মেহের। মেহের আরশাদের চাচাতো বোন। দিশা এবং মেহের সমবয়সী। দুজনে এক ইউনিভার্সিটিতেই পড়ে। তার দুজনের মধ্যে ভাবটা একটু বেশি। পুরোটা বিয়ে বাড়িতে দিশা যেখানে, মেহের সেখানে।
চারজন মিলে লুডো ফেলতে বসলো। ইদানিং এই খেলার অভ্যাস হয়েছে অরার। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সে, আরশাদ এবং কথা মোবাইলে একসঙ্গে লুডো খেলে। প্রতিবারই সে হেরে যায় আরশাদের কাছে। অরা ভেবেছিল আজও হয়তো হেরে যাবে। তবে ঘটলো ঠিক বিপরীত চিত্র। লাল রঙ নিয়ে সে একের পর এক সকলের গুটি খেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
আচমকা বেজে উঠলো অরার ফোনের রিংটোন। ফোনটা উল্টো করে রাখা ছিল। অরা তার ফোন হাতে নিতে যাবে তার আগেই মেহের চট করে ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো।
মেহের ভ্রু উপরে তুলে বলল, “কে ফোন করেছে বল তো দিশা?”
দিশা আগ্রহভরা গলায় বলল, “আরশাদ ভাইয়া?”
মেহের ফিক করে হেসে বলল, “উহুঁ! আরশাদ হার্ট!”
মোবাইলের স্ক্রিনটা মেহের ঘোরালো দিশার দিকে। অরার ফোনে তার নামটার পাশে একটা কালো হৃদয়ের একটা হার্ট দিয়ে সেভ করা। অরার বুঝতে বাকি রইলো না সেদিকেই ইঙ্গিত করছে মেহের। ইচ্ছা করছে এই মুহুর্তে ফোনটা তাদের হাত কেড়ে নিতে। কিন্তু লজ্জায় জমে রইলো অরা।
আসফিয়া মেহেরের হাত থেকে অরার ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল, “এত বড় হয়ে গেলি, তবুও ছিটেফোঁটা ম্যানারস শিখলি না। জানিস না, পারমিশন ছাড়া কারোর ফোন ধরতে হয় না?”
দিশা আপার ধমকে কর্ণপাত না করে চোখ চকচক করে বলল, “আরশাদ ভাইয়া কী লেভেলের বউপাগল দেখেছিস? দেখা করতে দিচ্ছি না বলে ফোন দিয়েছে!”
মেহের কিছু একটা চিন্তা করে বলল, “ভাবি, কালকের আগে এই ফোন তুমি পাচ্ছো না। এটা এখন আমাদের দখলে।”
অরার বুকটা ধ্বক করে কেঁপে উঠলো। এরা ফোন নিয়ে গেলে তো সর্বনাশ! এমনিতেই দুদিন ধরে অরার ধারের কাছেও ঘেঁষতে দিচ্ছে না তারা আরশাদকে। ফোনটা ছিল বলে রক্ষা। সকলের চোখের আড়ালে দুজনে ফোনে কথা বলতে পেরেছে। ফোন নিয়ে গেলে তো সেটাও বন্ধ। যদিও একটা রাতেই ব্যাপার। তবুও, এই একটা রাত আরশাদের পাগলামি বাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট। আরশাদ যেমন মানুষ, অরাকে ফোনে না পেয়ে শেষমেশ বিরক্ত হয়ে বলবে, “আর বিয়েই করবো না।”
এবং শুধুমাত্র বলা পর্যন্তই ক্ষান্ত থাকবে না সে। সত্যি সত্যি অরা আর কথাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে।
অরা অসহায় গলায় বলল, “মেহের প্লিজ, ফোনটা নিও না। একটু পরে আমার জরুরি একটা ফোন আসবে।”
মেহের সন্দেহজড়িত গলায় বলল, “কীসের জরুরি ফোন?”
অরা তৎক্ষণাৎ বলল, “অফিস থেকে!”
কে ফিল্মসের অফিসের কাজ মোটামুটি শেষ। আরশাদ যেভাবে চেয়েছিল, ঠিক সেভাবেই ভেতরের ঘরগুলো তৈরি করা হয়েছে। এখন শুধু ডেকরেশনের কাজ চলছে। ওদিকে এই প্রোডাকশন হাউজ লাইসেন্সও পেয়ে গেছে। আগামী মাসে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করবে। অরা এই দুই মাসে অনেক কাজ শিখে গেছে। এখনও শিখছে।
অরার এই অজুহাতটা বিশ্বাসযোগ্য হলেও সংশয় গেল না মেহেরের। যে বলল, “ভাইয়ার সাথে কথা বলবে না তো?”
“একেবারেই না।”
“ঠিক আছে। তোমাকে বিশ্বাস করে ফোনটা রাখলাম কিন্তু!”
অরা কখনো কারও বিশ্বাস ভাঙতে চায় না। তবে এবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও এ কাজ তাকে করতে হবে। এক পাগলের পাগলামির হাত থেকে বাঁচার জন্যে।
(চলবে)