ফিরে আসা ২ পর্ব-৩৫+৩৬

0
402

#ফিরে_আসা২
৩৫+৩৬ (ক)
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

লিফটের সঙ্গে হেলান দিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে অরা। লিফটে এই মুহূর্তে সে ছাড়া আর কেউ নেই। শুধু লিফট কেন, গোটা অফিসেই সে ছাড়া খুব কম মানুষ রয়েছে। রাত এগরোটার কাছাকছি বাজছে। খুব প্রয়োজন না হলে এত রাত পর্যন্ত কেউ অফিসে থাকে না। অরাকে আজ অফিসে খুব একটা প্রয়োজন ছিল, তার প্রয়োজন ছিল অফিসের। যতক্ষণ কাজে ডুবে থাকে, ততক্ষণই মনের শান্তিটা বজায় থাকে। বাড়ি ফিরে গেলে তো আবারও সেই একই বিষণ্ণতা।

অরা ভেবেছিল আরশাদকে নিয়ে আর মাথা ঘামাবে না। যতটা সম্ভব অবহেলা করবে তাকে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, আরশাদকে অবহেলা করতে পারছে না সে। দিনশেষে ঘুরে ফিরে মনটা সেই আরশাদের কাছেই ফিরে যায়। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে ওই ঘরের বদ্ধ দরজাটা ফাঁক করে দেখতে ইচ্ছা করে ঘুমন্ত আরশাদকে। আরশাদ বাড়িতে না থাকলে তার শার্ট জড়িয়ে গায়ের গন্ধ নিতে ইচ্ছা করে। এত বেহায়া কেন অরা? আত্মসম্মান থাকলে তার তো কোনোদিন আরশাদের মুখোমুখী হতেও ইচ্ছা হবার কথা নয় তার।

লিফটের দরজা খুলে গেল। নিচতলায় রিসিপশনে কয়েকজন এখনো কাজ করছে। অরাকে দেখেই তারা উঠে দাঁড়ালো বিদায় জানাবে বলে। অরা ইশারায় তাদের বসতে বলে মূল দরজার দিকে এগিয়ে গেল। মাত্রাতিরিক্ত বিষণ্ণ লাগছে আজ। আজকের দিনটা তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। শুধু আজকের দিনটাই কেন, জীবনের একটা দিনও এমন হতাশায় ঘেরা হওয়ার কথা ছিল না।

গাড়িতে উঠে বসলো অরা। সামনের সিটে ড্রাইভার আর তার বডিগার্ড। জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো অরা। যদিও সেই দৃষ্টি শূন্যতায় ভরা। তাকিয়ে সে রয়েছে ঠিকই, তবে যেন কিছুই দেখছে না। একবার ইচ্ছা হয় সকল নীরবতার অবসান ঘটিয়ে আরশাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে, “কেন সন্দেহ করলে আমাকে?” আবার পরমুহুর্তেই মনে হয়, এর থেকে অযৌক্তিক প্রশ্ন আর হতে পারে না।

বিয়ের প্রায় আড়াই বছর হয়ে গেলেও, আরশাদকে অরা চেনে সাত বছরের বেশি সময় ধরে। সুপারস্টার আরশাদ হক নয়, ব্যক্তি আরশাদ হককে তার থেকে ভালো করে খুব কম মানুষই চেনে। যতদূর ছেলেটাকে সে চিনেছে, তা থেকে অরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারে তার সঙ্গে অকারণে অমন খারাপ ব্যবহার করার মতো মানুষ আরশাদ নয়। তবে তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের কোনো কারণও তো থাকার কথা নয়।

চোখদুটো বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরা। সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। আরশাদকে নিয়ে চিন্তা করলেই তার ভেতরটা কেমন আর্দ্র হয়ে ওঠে। হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।

গাড়িটা বাড়ির সামনে এসে থামলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। গাড়ি থেকে নেমে ছোট ছোট পা ফেলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল অরা। লকের পাসওয়ার্ড চেপে ভেতরে প্রবেশ করতেই কয়েক মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়ালো।

পুরো বাড়ির সবগুলো বাতি নেভানো। বসার ঘরটা মুড়ে দেওয়া হয়েছে সোনালী রঙের লাইট বল দিয়ে। অগণিত গাঢ় নীল বেলুন দিয়ে সাজানোর চারপাশটা। বসার ঘরের ডান দিকে বিশাল এক সাদা রঙের হৃদয়। তার সামনে উঁচু গোলাকার টেবিলে প্রকান্ড এক কেক। ডানা মেলা পরির আকৃতির এক। মেয়েটা হাস্যোজ্বল ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। এই কেকের পাশে আরও ছোট বড় অনেকগুলো কেক। অরার বুঝতে বাকি নেই এসব কার কান্ড, আর কেনই বা করা হয়েছে এ কান্ড।

অরার এই মুহূর্তে ইচ্ছা করছে ছুটে ঘরের গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকতে। এসব আয়োজন তার জন্যে করা হলেও আয়োজনের অংশ হওয়ার ইচ্ছা তার বিন্দুমাত্র নেই। অভিমানে একাকার তার অন্তরাত্মা।

আচমকা অনুভূত হলো, পেছন থেকে কেউ একজন জড়িয়ে ধরেছে অরাকে। সেই কেউ একজন হওয়ার সাধ্য পৃথিবীতে আরশাদ ছাড়া আর কার আছে? চোখমুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে রইলো অরা। তার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। এতগুলো দিন পর আরশাদের স্পর্শ পেয়ে তার মনটা ছটফট করছে।

কেমন এক মিশ্র অনুভূতি অনুভূত হচ্ছে। একবার ইচ্ছা করছে বাকিটা জীবন ঠিক এভাবেই, আরশাদের স্পর্শ গায়ে মেখে কাটিয়ে দিতে। আবার পরমুহূর্তেই ইচ্ছা করছে
আরশাদের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে পালিয়ে যেতে। কিছুই করতে পারছে না অরা। তার পা দুটো বরফের ন্যায় জমে আছে।

কয়েক মুহূর্ত পর অরাকে নিজের দিকে ফেরালো আরশাদ। তার দিকে তাকাতেই ধ্বক করে উঠলো অরার বুকটা। আরশাদের চোখদুটো রক্তিম বর্ণের, চুলগুলো এলোমেলো। দেখে মনে হচ্ছে যেন কয়েক রাত ঘুম হয়নি তার ঠিকমতো। কেউ যেন তার ভেতরটাকে চুর্ণ-বিচূর্ণ করে গেছে।

অরা চোখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকালো। তার কান্না পাচ্ছে, প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। তবুও চোখের জল চেপে দৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। আরশাদকে এক মুহূর্তের জন্যে সেই চোখের জল দেখাতে চায় না অরা। কাউকে চোখের জল দেখানোর অর্থ তার কাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা। অরা নিজেকে দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করতে চায় আরশাদের কাছে।

আরশাদ অরার হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, “অরা?”

নিজের নামটা আরশাদের মুখে শুনে আরেকদফা আর্দ্র হয়ে পড়লো অরার মন। তবুও নিজেকে ধরে রাখলো অরা।

আরশাদ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই অরা ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, “যেতে দাও আমাকে।”

আরশাদ অনুরোধের ভঙ্গিতে বলল, “অরা প্লিজ আমার কথাটা একবার শোনো।”

আবারও যন্ত্রের ভঙ্গিতে একই কথা বলল অরা, “যেতে দাও আমাকে।”

আরশাদ অরার হাতদুটো আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, “অরা প্লিজ!”

এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না অরা। অভিমানের সুরে বলে উঠলো, “কেন শুনবো তোমার কথা? আমাকে কিছু বলবেই বা কেন? আমি তো ক্যারেক্টারলেস। একা একা ঢাকার বাইরে গিয়ে আমি অন্য কারো সাথে…”

অরার বলা এই কথাগুলো যেন কাঁটার মতো বিধছে আরশাদের বুকে। অথচ এই কথাগুলো সে নিজেই বলেছিল তার ভালোবাসার মানুষটাকে। অরাকে সে কতটা আঘাত দিয়েছে, তা হয়তো তার কল্পনারও বাইরে।

অরাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে বুকে টেনে নিলো আরশাদ। আরশাদের অশান্ত হৃদয়টার ধুকপুক অরার মাঝে প্রবল এক আলোড়ন সৃষ্টি করলো। এতক্ষণ বহুকষ্টে লুকিয়ে রাখা চোখের জল সকল বাঁধা অতিক্রম করে গড়িয়ে পড়লো। অরা সঙ্গে সঙ্গে চোখের জল মুছে অভিমানী ভঙ্গিতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো আরশাদের আলিঙ্গন থেকে।

আরশাদ কাতর স্বরে বলল, “আমি তোমার কাছে আর কিছু চাইবো না, প্লিজ শুধু একটু সময় দাও।”

কয়েক মুহূর্ত নির্বিকার দাঁড়িয়ে থেকে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো অরা। সে আরশাদকে সময় দিতে চায় না, ছুটে পালিয়ে যেতে চায় তার কাছ থেকে, কোনো কথা শুনতে চায় না তার। তবুও কেন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো, সে নিজেও জানে না।

অরাকে হাত ধরে বসার ঘরের সোফার কাছে নিয়ে এলো আরশাদ। এখন অরা খেয়াল করলো সোফাগুলোতেও গাঢ় নীল আর সাদা কাপড় দিয়ে সুন্দর ডেকোরেশন করা হয়েছে। অরাকে সোফার ওপরে বসিয়ে দিলো আরশাদ। নিজে মেঝেতে বসে ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা রাখলো অরার কোলে।

অরার গা থেকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ আসছে। দামি পারফিউমের গন্ধ নয়, অরার গায়ের গন্ধ। যে গন্ধে আজীবন নিজেকে জড়িয়ে রাখতেও দ্বিধা করবে না আরশাদ। চোখদুটো বন্ধ করলো আরশাদ। এই কদিন যে যন্ত্রণায় সে ভুগছে, সেটা মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই কমিয়ে দিলো অরা। আরশাদ পারবে তো তার যন্ত্রণাগুলো দূর করতে?

অরার কোলে মাথা রেখেই আহত ভঙ্গিতে আরশাদ বলল, “তুমি আমাকে ঘৃণা করো অরা?”

ধ্বক করে কেঁপে উঠলো অরার হৃদয়। এই কয়েকদিনে হাজারবার মনে হয়েছে আরশাদ তাকে ঘৃণা করে। একটাবারের জন্যেও মনে হয়নি সে ঘৃণা করে আরশাদকে। ঘৃণা করবে কী করে? প্রকৃতি তো সেই ক্ষমতাই দেয়নি তাকে।

অরার নীরবতার মাঝে আরশাদ আবারও বলে উঠলো, “বলো না! ঘৃণা করো আমাকে?”

অরা থমথমে গলায় বলল, “ঘৃণা তো তুমি আমাকে করো।”

আরশাদ আঁতকে উঠে বলল, “না! কখনোই না। কে বলেছে তোমাকে?”

অরা ব্যথিত কণ্ঠে বলল, “কারোর বলা লাগে? তুমি আমাকে যে কথাগুলো বলেছ, ঘৃণা না করলে কাউকে ওই কথাগুলো বলা যায়?”

আরশাদ কম্পিত স্বরে বলল, “অরা আমি…”

আবারও অবাধ্য অশ্রুগুলো গড়িয়ে পড়লো অরার গাল। সেই অশ্রু মোছার কোনপ্রকার চেষ্টা না করেই সে বলল, “তুমি আমাকে সন্দেহ করেছো আরশাদ! এমন একটা কাজের জন্যে আমার দিকে আঙুল তুলেছো যা করার কথা আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারি না।”

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল আরশাদ। তবুও না বলে চুপ করে রইলো। কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। মনে মনে সাজিয়ে রাখা সমস্ত কথাগুলো এলোমেলো হয়ে গেল নিমিষেই। আবারও হাজারতম বারের মত নিজেকে প্রশ্ন করলো, এতটা কষ্ট কী করে সে দিয়ে ফেলল অরাকে?

আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “I’m a mess.”

অরা টের পাচ্ছে আরশাদের সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। বেহায়া মনটার ইচ্ছা হলো মাথায় হাত শান্ত করতে তাকে। তবুও নিজেকে ধরে রাখলো অরা। কিছুতেই নিজের দুর্বলতা সে প্রকাশ করবে না আরশাদের কাছে।

অরার কোলে মুখ ডুবিয়ে চোখদুটো বুজে আরশাদ বলল, “মানুষের জীবনে সবথেকে মুখ্য বিষয় হলো খুশি থাকা। আমার জীবনে তোমার উপস্থিতি আমাকে যতটা খুশি করেছে, ততটা খুশি আমি কোনোদিনও হতে পারিনি। নিজের হাতে, নিজের সমস্ত খুশিগুলো শেষ করে ফেললাম আমি।”

চুপ করে রইলো অরা।

আরশাদ আবারও বলল, “অরা তুমি তো চেনো আমাকে। পৃথিবীর অন্য যেকোনো মানুষের থেকে ভালো করে চেনো। তোমার তো জানার কথা, আমি এরকম না। সত্যিই মন থেকে আমি তোমাকে সন্দেহ করিনি, কখনোই করতেও চাইনি…”

আরশাদকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আরশাদ প্লিজ! তোমার এই অজুহাতগুলো এখন শুনতে ইচ্ছা করছে না। ছাড়ো আমাকে।”

অরা আহত কণ্ঠে বলল, “অজুহাত না অরা। আমি জানি না তুমি বিশ্বাস করবে কিনা, বিশ্বাস না করারই কথা। কিন্তু আমি কোনো অজুহাত দিচ্ছি না। প্রত্যেকটা কথাই সত্যি। প্লিজ একটু সময় নিয়ে আমার কথাগুলো শুনবে?”

অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল, “যা বলার তাড়াতাড়ি বলো, আমার কাজ আছে।”

অরার কোল থেকে মাথা উঠিয়ে একনজর তাকে দেখে নিলো আরশাদ। মেয়েটা ভালো নেই। তার চোখেমুখেই তা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। একটা বিষণ্ণ অতীত কীভাবে বর্তমানে দুটো মানুষের জীবনকে ছারখার করে দিতে পারে! এতটা সময় আরশাদের মনে হচ্ছিল, কোনো কিছুই আর আগের মতো হবে না। অরা কখনোই ক্ষমা করবে না তাকে। তবে এই মুহূর্তে অরার মুখটা দেখে, কোথা থেকে যেন বিচিত্র এক শক্তি পেলো আরশাদ। মনে হলো, তাকে সবকিছু ঠিক করে ফেলতেই হবে।

অরার জামার ওপর দিয়ে তার পেটে চুমু খেলো আরশাদ। তার এমন কান্ডে সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো অরার। তাতে কিছুই যায় আসে না আরশাদের। আবারও একই ভঙ্গিতে পরপর কতগুলো চুমু খেলো সে অরার পেটে। এখানেই তো একটু একটু করে বেড়ে উঠছে তাদের ভালোবাসার ফসল। তার জন্যে হলেও তো সবটা ঠিক করে ফেলতে হবে আরশাদকে।

আবারও অরার কোলে মাথা রাখতে রাখতে আরশাদ বলল, “অরা জানো! আমার আত্মীয়-স্বজন বা পরিবারের যে কাউকে আমার ছোটবেলার কথা জিজ্ঞেস করলে, সবাই একই ধরনের গল্প বলবে। আমার দুরন্তপনা, ছটফটে স্বভাব, কোনো একটা ঝামেলা বাঁধিয়ে পালিয়ে যাওয়া – আমার পুরো ছেলেবেলা জুড়ে কেবল এগুলোই। আমার জীবনটা টিকেই ছিল অ্যাডভেঞ্চারের ওপর। আশেপাশের মানুষগুলো এসবই জানে। তবে তারা যা জানে না, তা হলো আমার ছেলেবেলায় কয়েকটা বছর কেটেছে অন্ধকারে। আমার বয়স তখন চৌদ্দ কী পনেরো। জীবনটা বেশ চলছিল জানো। স্কুলে সারাটাদিন বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করছি, বাড়ি ফিরে এসে কোনমতে ব্যাগটা রেখে আবারও তাদের সাথেই মাঠে খেলতে যাচ্ছি। আনন্দের কোনো সীমা ছিল না ওই সময়টায়। তবে আমি বুঝতে পারতাম, আমার বাড়ির পরিস্থিতি আর দশটা স্বাভাবিক বাড়ির মতো নয়। বাবা আর মায়ের মাঝে অদ্ভুত একটা অস্বাভাবিকতা। বাবা সবসময় মায়ের সাথে চড়া গলায় কথা বলে, গায়ে হাত তোলে। যদিও মা আমাদের এসব নিয়ে চিন্তা করতে বারণ করেছিল। একসাথে সংসার করতে গেলে না-কি এসব সমস্যা একটু-আধটু লেগেই থাকে। আমিও তাই খুব একটা চিন্তা করতাম না।”

অরা ধৈর্য নিয়ে শুনছে আরশাদের প্রতিটা কথা। এ কারণেই হয়তো মেয়েটার ভালোবাসায় বাঁধা পড়েছিল আরশাদ। অরা তার কথাগুলো শোনে, তাকে বুঝতে চেষ্টা করে। যা খুব কম মানুষই করে তার জন্যে।

আরশাদ আবারও বলতে লাগলো, “তবে বেশিদিন চিন্তা এড়িয়ে চলতে পারলাম না। হঠাৎ একদিন শুনলাম, আমার বাবা না-কি মায়ের টাকা নিয়ে অন্য এক মহিলার হাত ধরে বিদেশে পালিয়ে গেছে। আমাদের রীতিমত ফেলে রেখে, পথে বসিয়ে। আমাদের কিছু দিয়ে তো যায়নি বরং মাকে উল্টো ঋণগ্রস্ত করে রেখে গেল। সেটা কোনো ব্যাপার না। বাবা মানেই তো শুধু অর্থনৈতিক দায়িত্ব নেওয়া না, বাবা সন্তানের জন্যে একটা মানসিক আশ্রয়। বাবা মাকে সর্বক্ষণ অত্যাচার করলেও আমার আর আপার সামনে ছিল একদম ভালো মানুষ। সে চলে যাওয়ার পর কেবলই মনে হতে লাগল, ওই ভালো মানুষটার জীবনে তাহলে আমাদের কোনোই ভূমিকা ছিল না?”

কয়েক মুহূর্তের জন্যে থেমে দম নিলো আরশাদ। ছেলেবেলার এই অধ্যায়টা আজও যন্ত্রণা দেয় তাকে। জীবনের প্রথম কয়েকটা বছরের ছাপ আজীবন মানুষের মাঝে থেকে যায়।

আরশাদ থেমে থেমে বলল, “জীবনে সেবারই প্রথমবারের মতো বদলে গেলাম। ভেঙে পড়েছিলাম অনেকটা। মনে হতে লাগলো, হয়তো দোষটা আমারই। আমার জন্যেই বাবা আমাকে ফেলে রেখে চলে গেছে। আমিই হয়তো নিজেকে ভালো সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি। তাই আমার প্রতি বাবার কোনো টানও নেই। অদৃশ্য একটা চাদরে মুড়িয়ে ফেললাম নিজেকে। যে আমি সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকতাম, সেই আমি নিজ থেকেই চলে গেলাম আড়ালে। দুরন্ত থেকে নিস্তেজ হয়ে পড়লাম। আগের মতো সহজে মিশতে পারতাম না কারো সঙ্গে। মনে হতো আমার সামনে থাকা মানুষটাও আমার বাবার মতো করেই আমাকে অপছন্দ করবে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরশাদ। ওই সময়টায় মা আর আপা তাকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে, বাবার চলে যাওয়ায় তার তো কোনো দোষ নেই। বাবার চলে যাওয়ার পেছনে দোষ একমাত্র তার নিজের। তবে মানসিক সমস্যাগুলো বাঁধা-ধরা কোনো নিয়ম জানে না। তারা হঠাৎই আসে, আবার হঠাৎই চলে যায়। যে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি, তাকে এর গভীরতা বোঝানো কঠিন।

আরশাদ বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালো অরার দিকে। অরা কি বুঝতে পারছে তার ভেতরটা? মেয়েটা তো সবসময়ই তাকে সবথেকে ভালো বোঝে। আজও তো তার ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়।

আরশাদ ভীত কণ্ঠে বলল, “তুমি বুঝতে পারছো আমি কী বলার চেষ্টা আজ করছি অরা? ওপরে ওপরে ভালো ব্যবহার করলেও ভেতর থেকে আমার বাবা আমাকে অবহেলা করেছিল। তার পালিয়ে যাওয়ার পর আমার মনে হতে লাগলো আশেপাশের সবগুলো মানুষও বোধ হয় তার মতোই। হাসি মুখের আড়ালে আমার প্রতি তীব্র ঘৃণা পুষে রাখে সকলে। এমন মনে করার কোনো কারণ নেই, তবুও সমস্যা হলো আমার মানসিক অবস্থা তখনও স্বাভাবিক ছিল না। স্বাভাবিক হতে হতে প্রায় বছর খানেক সময় লাগলো। এই একটা বছর আমি নিজেও স্বাভাবিক ছিলাম না, আশেপাশের মানুষগুলোর কাছেও নিজেকে স্বাভাবিকভাবে তুলে ধরিনি। ধীরে ধীরে নিজেই বুঝতে পারলাম, যা ঘটেছে তাতে আমার তো কোনো দোষ নেই। আমি ভালো সন্তান হতে পেরেছিলাম ঠিকই। সেই ভালো বাবা হতে পারেনি। তাই তো নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে আমাদের ফেলে রেখে পালিয়ে যেতে দ্বিধা বোধ করেনি। মাঝখান থেকে একটা বছর নষ্ট করলাম। নিজেকে নিজেই মানসিক যন্ত্রণায় অতিষ্ট করে তুললাম।”

ভেতরে ভেতরে চাপা ধরনের এক কষ্ট অনুভূত হচ্ছে অরার। যাই হয়ে যাক না কেন, সে চায় না আরশাদ কষ্ট পাক। ছোটবেলার স্মৃতি এখনো কষ্ট দিচ্ছে তাকে। অরার ইচ্ছা করছে এই মুহূর্তে আরশাদের সমস্ত কষ্টগুলো যাদুর কাঠি দিয়ে দূর করে দিতে।

অরা ধরা গলায় বলল, “এসব কথা আমাকে কেন বলছো?”

আরশাদ মিনতির স্বরে বলল, “একটু শোনো না, প্লিজ। বেশি কিছু কি চেয়ে ফেলেছি?”

আবারও মোচড় দিয়ে উঠলো অরার হৃদয়। এই নিঃসংকোচ আবেদনের কাছে কেউ হেরে না গিয়ে কী করে পারে? আরশাদ কখনোই তার কাছে কিছু চায়নি। দুষ্টুমির ছলে হাজারবার চুমু চেয়েছে। অরা লজ্জা পেয়ে সেই চাওয়া যখন পূরণ করেনি, দিনভর তখন জ্বালিয়েছে তাকে। এর থেকে বেশি কিছু আসলেই সে কখনো চায়নি। আজ চাচ্ছে। সেই চাওয়াটাও যেন কিছুই নয়।

আরশাদ আর্দ্র গলায় বলল, “তখন বয়স কম ছিল, যন্ত্রণার তীব্রতাও ছিল বেশি। ভেবেছিলাম পৃথিবীর সবথেকে ভয়ানক কষ্ট হয়তো আমার ইতিমধ্যেই পাওয়া হয়ে গেছে। তখনও কি জানতাম এই এক জীবনে এর থেকেও আরও কোটি কোটি গুণ বেশি যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে হবে।”

অরা জানে কোন যন্ত্রণার কথা বলছে আরশাদ। ওই আঘাতের ক্ষতচিহ্ন আজও বয়ে বেড়ায় ছেলেটা। যখনই ওই যন্ত্রণার কথা আরশাদের মনে পড়ে, তখনই অরার ইচ্ছা হয় তাকে দুহাতে জড়িয়ে সমস্ত কষ্টগুলো দূর করে দিতে। আজ যেমন করছে। নিজেকে আর দৃঢ়ভাবে ধরে রাখতে পারছে না অরা। একটু একটু করে গলে পড়ছে তার শক্ত হৃদয়।

আরশাদ অন্যরকম গলায় বলল, “ক্যামেরার সামনে কত সহজেই ভালোবাসি বলে ফেলা যায়। তবে আসলে যে ভালোবাসা কতটা জটিল, নিজে ভালোবাসার পরই টের পেলাম। আশেপাশে কত মানুষকে দেখি, টাইম পাসের জন্যে প্রেম করে, বলার জন্যে ভালোবাসি বলে। আমার ভালোবাসা আবার এতটা ঠুনকো ছিল না। জোরালো এক ভালোবাসা ছিল আমার। নিজেকেও মনে হয় এতটা ভালোবাসিনি, যতটা ভালো নওশীনকে বেসেছিলাম।”

(চলবে)

#ফিরে_আসা২
৩৫+৩৬ (খ)
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

নিজের ভালোবাসার মানুষের মুখে অন্য কাউকে ভালোবাসার কথা খুব কম মেয়েই সহ্য করতে পারে। হোক না সেটা অতীতের ভালোবাসার কথা। সেই কমের তালিকায় রয়েছে অরার নামও। সত্যটাকে বদলে দেওয়া যায় না। অরা বদলাতেও চায় না। সে তো কেবল চায় আরশাদের বর্তমান আর ভবিষ্যতের সঙ্গে জুড়ে থেকে নতুন সত্যি সৃষ্টি করতে।

আরশাদ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “যে ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে বাকিটা জীবন বাঁচবো বলে ভেবেছিলাম, সেই ভালোবাসাই আমার আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। আবারও ফিরে এলো ওই মানসিক যন্ত্রণাগুলো। ভালোবাসা শব্দটার ওপর থেকে রীতিমত বিশ্বাস উঠে গেল। মনে হতে লাগলো ভালোবাসলেই তো বিশ্বাসঘাতকতার স্বাদ নিতে হয়। জীবনের সবথেকে খারাপ সময় ছিল ডিভোর্সের পরের ওই কয়েকটা বছর। প্রত্যেকটা দিন যেন ছিল একেকটা বছরের সমান। একেকটা দিন পাড় করাই হয়ে ওঠে সবথেকে কষ্টকর। খ্যাতির অভাব আমার কোনোকালেই ছিল না। এত খ্যাতি, ভক্তদের এত এত ভালোবাসা তবুও জীবনটা উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়ে। মনে হয় যেন, কোনো কারণ ছাড়াই বেঁচে আছি।”

অরার কোল থেকে মুখ তুলে আবারও তার দিকে তাকালো আরশাদ। তার চোখদুটোতে জল টলমল করছে, যেকোনো মুহূর্তেই গড়িয়ে পড়বে। তড়িৎ গতিতে চোখ ফিরিয়ে নিলো অরা। কারণ তার চোখেও জল চলে আসছে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজের চোখের জল আরশাদের কাছ থেকে গোপন করার।

আরশাদ অস্পষ্ট স্বরে বলল, “তুমি তো নিজেই আমাকে দেখেছিলে ওই সময়টায়। ডিপ্রেশড হয়ে পড়ে ছিলাম আমি। অনবরত ড্রিংক করতাম, প্রয়োজনের বাইরে কারও সঙ্গে কোনো কথা বলতাম না। নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছিলাম আমি।”

কয়েক মুহূর্তের জন্যে সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল অরার। তখনকার আরশাদ, আর আজকের আরশাদের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। তখনকার আরশাদ ছিল প্রাণহীন, যান্ত্রিক।

“প্রাণ ফিরে পেলাম শুধু তোমার কারণে। তুমি না থাকলে আমার কী হতো অরা? আমি তো মরেই যেতাম।”

অরা সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠে বলল, “চুপ করো তো।”

আরশাদ শান্ত স্বরেই বলল, “না সত্যিই! ওই যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকাটা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা হতো মাঝেমধ্যে। তুমি ঠিক সময়ে এসে আমার যন্ত্রণাগুলো কমিয়ে দিয়েছিলে বলেই তো বেঁচে আছি।”

আর ধরে রাখতে পারলো না অরা নিজেকে। তার চোখদুটো বেয়ে গড়িয়ে পড়লো জল। সেই জল মোছার কোনপ্রকার উদ্যোগ না নিয়েই অরা অভিমানী কণ্ঠে বলল, “সেজন্যেই সন্দেহ করলে আমাকে?”

চোখদুটো বুজে ফেলল আরশাদ। তার ওই দুই চোখে যে অবিরাম যন্ত্রণা। তার চোখ বেয়েও গড়িয়ে পড়লো অবাধ্য অশ্রু।

অরা একরাশ অভিমান নিয়ে বলল, “তোমার বলার প্রতিটা কথা আমি মেনে নিতাম, যদি জীবনে কোনদিনও আমার মনে কোনো খারাপ চিন্তা আসতো। আমাকে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই, সেটা তুমিও জানো আরশাদ। তবুও সন্দেহ করলে। বাজে কথাগুলো বলতেও পিছপা হলে না।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো আরশাদ। তার ভয় হচ্ছে, সেদিন তার মনে কাজ করতে থাকা ওই নেতিবাচক অনুভূতিগুলোর গভীরতা অরা বুঝতে পারবে কিনা। লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করলো আরশাদ। তাকে বোঝাতেই হবে সেদিনকার মনের অবস্থাটা।

আরশাদ থেমে থেমে বলল, “অরা তুমি কাকে বিয়ে করেছো জানো? তুমি কোনো সুপারস্টারকে বিয়ে করোনি। তুমি যাকে বিয়ে করেছো যে একটা প্রবলিমেটিক মানুষ, মানসিক যন্ত্রণায় ভোগা একজন মানুষ। ভেতর থেকে আমি একেবারেই পারফেক্ট নই, তবুও তো ভালোবেসেছো আমাকে।”

অরা চুপ করে রইলো। আসলেই তো। সেই যান্ত্রিকতায় ডুবে থাকা আরশাদকেই তো ভালোবেসেছে সে।

আরশাদ ক্ষীণ স্বরে বলল, “অরা আমি ট্রমাটাইজ হয়ে পড়েছিলাম। এমনকি এখনো ট্রমাটাইজ। তুমি যখন ঢাকার বাইরে চলে গেলে, আমার তখন মনে হচ্ছিল অতীতের সময়টা আবারও ফিরে এসেছে। আমি জানি না কতটুকু বিশ্বাস করবে আমার কথাগুলো, কিন্তু এটাই সত্যি অরা। আমি যখন দেশের বাইরে শুটিংয়ে গিয়েছিলাম, তখনই নওশীন তার মামাতো ভাইয়ের সাথে অ্যাফেয়ারে জড়িয়ে যায়। আমার থেকে দূরে থেকে আমার বিশ্বাসের সুযোগ নেয় সে। আমার ভেবেছিলাম তুমিও তাই করবে।”

অরা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “এমনটা ভাবলে কী করে তুমি? আমি কেন এমন করবো? এতদিনে এই চিনলে আমাকে?”

“চিনেছি তো অরা। নিজের থেকেও ভালো করে চিনেছি। আমি জানি তুমি কখনোই এমনটা করবে না। এসব চিন্তায় কোনোদিন তোমার মস্তিকে আসে না। কিন্তু ওই যে বললাম, সমস্যাটা আমারই। ভেতরে ভেতরে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। কোনটা অতীত আর কোনটা বর্তমান আলাদা করতে পারছিলাম না।”

আরশাদের চোখেমুখে প্রগাঢ় অপরাধবোধ দেখতে পাচ্ছে অরা। নিজেদের মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক করাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। সত্যিই সে অনুতপ্ত। সত্যিই তার ইচ্ছা করছে নিজের করা কাজের জন্যে নিজেকে ভয়ানক শাস্তি দিতে।

আরশাদ দুহাতে চোখের জল মুছলো। তবুও লাভ হলো না কোনো। টপটপ করে আবারও বেয়ে পড়লো অশ্রুগুলো।

আরশাদ অনুতপ্ত স্বরে বলল, “একজনকে ভালোবেসে তার কাছ থেকে আঘাত পেয়ে দীর্ঘদিন ভুগেছি। বারবার মনে হচ্ছিল আরও একটা আঘাত আমি সহ্য করতে পারবো না। নিজেকে যন্ত্রণা থেকে বাঁচাতে গিয়েই ওই পাগলামিটা করে ফেলি। ঝোঁকের মাথায় তোমার ঘরে স্পাই ক্যামেরা লুকিয়ে রাখতেও দ্বিধা বোধ করি না।”

“আর সেদিন আমাকে বলা ওই কথাগুলো?”

আরশাদ আরও কয়েকগুণ অনুতাপ নিয়ে বলল, “অরা বিশ্বাস করো, আমি একটা কথাও মন থেকে বলিনি। সেদিনও আমি ট্রমাটাইজ ছিলাম। তোমাকে তো বলে ছিলাম, ধরা পড়ে যাওয়ার পরও নওশীন বারবার নিজেকে জাস্টিফাই করছিল। তোমার প্রতিবাদের কারণটা যৌক্তিক ছিল। কারো ঘরে স্পাই ক্যামেরা লুকিয়ে রাখাটা অন্যায়। কিন্তু আমার বারবার মনে হচ্ছিল তুমি প্রতিবাদ করছো, কারণ তুমি গিল্টি। ঠিক যেমনটা নওশীন করেছিল।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরশাদ। তার মনের মধ্যে কালবৈশাখীর ঝড় বেয়ে যাচ্ছে। অনেক সাহস সঞ্চয় করে আজ অরাকে মনের কথাগুলো বলছে সে।

“নওশীনের সাথে ওই ঘটনার আজ কতগুলো বছর হয়ে গেছে। তবুও সেটা নিয়ে আমি ডিস্টার্বড। ওই ঘটনা ভেবে ভেবে আমি ট্রমাটাইজ হয়ে পড়ছি। পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি। আমার অতীত আজও আমাকে স্বস্তি দেয় না অরা। একটা আঘাত দীর্ঘদিন যন্ত্রণা দিয়েছে আমাকে, জানি না আরও কত যন্ত্রণা পেতে হবে এই একটা আঘাতের জন্যে। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি অরা। তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি ভালো নেই। তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছি।”

আবারও কেঁদে ফেলল আরশাদ। এবার চোখের জলের ধারা খরস্রোতা নদীকেও হার মানাবে। নিঃশব্দে সে মুখ লুকালো অরার কোলে।

আরশাদের এই কান্না আর সহ্য করতে পারছে না অরা। নিজের কাঁপা কাঁপা হাতটা রাখলো তার মাথার ওপরে।

আরশাদ অরার কোলে মুখটা লুকিয়ে রেখেই কান্নাজড়িত ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, “আমাকে মাফ করে দাও অরা। যত খুশি তত শাস্তি দাও, যতটা কষ্ট আমি তোমাকে দিয়েছি তার থেকেও হাজারগুণ বেশি কষ্ট দাও। তবুও মাফ করে দাও।”

অনেকটা সময় এভাবেই কেটে গেল। আর কোনো কথা বলল না আরশাদ। অরার কোলে মুখ লুকিয়ে অশ্রু ঝড়িয়ে গেল নিঃশব্দে। পুরোটা সময়জুড়ে তার মাথায় হাত রেখে তার কথাগুলো বুঝতে চেষ্টা করলো অরা।

ট্রমা কী সে জানে। সেই ছোটবেলায় নতুন মায়ের অত্যাচারের শিকার হয়েছিল সে। আজ পর্যন্ত সেই ট্রমা তাকে জ্বালায়। আজও সে নতুন মাকে দুঃস্বপ্নে দেখে। ট্রমা বলতে কিছু আসলেই আছে, এটা মানুষের তৈরি নয়। অরা নিজে যেহেতু এই পরিস্থিতির শিকার, তাই আরশাদের মনের অবস্থাটা বুঝতেও তার অসুবিধা হলো না। প্রতিবারের মতোই সবার থেকে ভালো করে আরশাদকে বুঝলো অরা।

অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে চোখের জলগুলো মুছে ভেতরকার আর্দ্রতা দূর করার চেষ্টা করলো।

খানিকটা আদেশের সুরে আরশাদকে বলল,
“উঠে বসো।”

আরশাদ সঙ্গে সঙ্গে বাধ্য ছেলের মতো উঠে অরার পাশে সোফায় বসলো। অরার দিকে তাকাতে পারছে না সে। তার দৃষ্টি মেঝের দিকে আবদ্ধ।

অরা তার কোমল স্পর্শে মুছে দিলো আরশাদের চোখের জল। আরশাদ চোখদুটো বুজে সেই স্পর্শে মাখছে নিজেকে। চোখের জল মুছে হাত দিয়েই অরা ঠিক করে দিলো তার এলোমেলো চুলগুলো।

“আমার কেক কোথায়?”

স্বাভাবিক কথা বলছে, তবুও যেন অরার কণ্ঠে একটা রাগী রাগী ভাব। রাগ তার মাঝে বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। তবুও যেন রাগের ভাবটা ধরে রাখতে ইচ্ছা করছে।

আরশাদ উঠে গিয়ে পরির আকৃতির ওই কেকটা নিয়ে এলো। কেকের ওপরে আগে থেকে মোমবাতি সাজানো ছিল। আরশাদ পকেট থেকে লাইটার বের করে এক এক করে সবগুলো মোমে আগুন জ্বালানো।

অরা রীতিমত ধমক দিয়ে বলল, “এই তোমার কাছে লাইটার কী করছে? আবারও স্মোকিং শুরু করেছো?”

আরশাদ চুপ করে রইলো। অরাকে সে কথা দিয়েছিল সিগারেট খাওয়া মাত্রা কমিয়ে আনবে। যদিও এই কয়েকদিনে সেই প্রতিশ্রুতি ভেঙে গেছে। গত দুদিনে আরশাদ যে কতগুলো সিগারেট খেয়েছে, সেই হিসাব তার নিজের কাছেও নেই।

আরশাদ শুকনো গলায় বলল, “সরি।”

অরা ক্রুদ্ধ গলায় বলল, “আমার খেয়েদেয়ে আর কোনো কাজ নেই তাই না। সারাদিন শুধু তোমার সরিই শুনতে থাকবো?”

আরশাদ চুপ করে তাকিয়ে রইলো মেঝের দিকে। সে যা করেছে তারপর অরার রেগে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। বরং এই পর্যন্ত সে কমই রেগেছে।

আচমকা আরশাদকে অবাক করে দিয়ে অরা জড়িয়ে ধরলো তাকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে আশ্বাস দিচ্ছে, “আমি আছি তো!”
আরশাদও আর এক মুহুর্ত অপচয় না করে অরাকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রাখলো।

অরা তার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কোমল স্বরে বলল, “ভেতরে ভেতরে যে এত কষ্ট পাচ্ছো, আগে বলোনি কেন আমাকে?”

আরশাদ ইতস্তত করে বলল, “সাহস করে উঠতে পারিনি।”

অরা জোর দিয়ে বলল, “সাহস করতে না পারার কী হলো? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক? বউ আমি তোমার। ভেবেছো কী, শুধু ভালো সময়েই পাশে থাকবো, খারাপ সময়টায় থাকবো না?”

আরশাদ অনুতপ্ত স্বরে বলল, “কিন্তু আমি তো তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি অরা।”

“তা দিয়েছো। কিন্তু দিয়ে তো কোনো মজা পাওনি, উল্টো নিজেই কষ্ট পেয়েছো।”

আরশাদ ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “ভুল তো করেছি। তোমার যা ইচ্ছা, তাই শাস্তি দাও আমাকে।”

অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমি কি আদালত খুলে বসেছি যে শাস্তি দিবো? শাস্তি যা পাওয়ার তুমি পেয়ে গেছো।”

আরশাদ অবাক চোখে তাকালো অরার দিকে। এই মেয়েটা এত ভালো কেন? আরশাদ যা করেছে, অন্য কেউ হলে তো তাকে বুঝতেই চাইতো না। অরা তাকে বুঝেছে, নির্দ্বিধায় ক্ষমাও করে দিয়েছে। আসলেই কি সে এত ভালো একটা মেয়ের ভালোবাসার যোগ্য?

নিঃশব্দে দুজনে কেকটা কাটলো। নীরবতার একটা ভাষা আছে। এই মুহূর্তে নীরবতা উচ্ছ্বাসে উড়ে বেড়াচ্ছে দুজনের আশেপাশে। অরাকে কেক খাইয়ে দিলো আরশাদ, অরাও তাকে খাইয়ে দিলো। এই দুজনকে এই মুহূর্তে দেখলে কে বলবে তাদের মাঝে গত কয়েকদিন ভয়ানক ঝড় বয়ে গেছে।

আরশাদ আবারও অরাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “Happy Birthday lifeline!”

অরা কিঞ্চিৎ লজ্জা পেয়ে বলল, “হয়েছে, ছাড়ো। ঢংয়ের নামে ডাকতে হবে না।”

অরা নিজেকে আরশাদের আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করলো।

আরশাদ আরও শক্ত করে তাকে জাপটে ধরে বলল, “একশবার ডাকবো, কী করবে তুমি?”

অরার হঠাৎ কী যেন হলো। বিচিত্র এক সাহস এসে ভর করলো তার ওপরে।

অন্যরকম গলায় বলল, “দেখবে কী করবো?”

আরশাদকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তার ঠোঁটে নিজের ঠোঁটের স্পর্শ দিলো অরা। দুজনে কতটা সময় এভাবে ছিল কেউ জানে না। জানাটা মুখ্যও নয়। দুজনে এতটুকু জানে, ভালোবাসার শক্তির কাছে পৃথিবীর সব শক্তি হেরে যায়।

(চলবে)