ফিরে আসা ২ পর্ব-৪৮+৪৯+৫০+৫১

0
436

#ফিরে_আসা২
৪৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

নারায়ণগঞ্জে আরশাদের শুটিং শুরু হওয়ার পর কেটে গেছে আরও এক মাস। এই এক মাস ধরে টানা চলছে শুটিং। পুরোটাই অবশ্য নারায়ণগঞ্জে না। সেখানে পাঁচদিন শুটিং শেষে ইউনিট চলে যায় কক্সবাজারে। এক সপ্তাহের মতো শুটিং হয় সেখানে। গল্পে সুজানার মামা কক্সবাজারের এক হোটেলে ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করে। আরশাদ নারায়ণগঞ্জে সুজানার পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে তার সম্পর্কে বেশ খানিক তথ্য জোগাড় করে। সুজানার বাবার সঙ্গে তার মামার সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। মায়ের সঙ্গেও সম্পত্তির ভাগ নিয়ে রেষারেষি লেগেই থাকতো। শুরু থেকেই এই লোকটাকে সন্দেহজনক বলে মনে করতে থাকে আরশাদ।

সে তার রোগী অর্থাৎ সুজানাকে নিয়ে হঠাৎ একদিন হাজির হয় কক্সবাজারে। মামাকে দেখেই সুজানার মনে পড়ে যায়, এই লোকই তার বাবা-মায়ের খু/নি। তার চোখের সামনেই মামা প্রাণ কেড়ে নেয় তার বাবা-মায়ের। খু/ন করার পর মামা সুজানার মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি গলায় বলেন, “তোমার বাবা-মাকে কিন্তু আমি মারিনি। তুমি মেরেছ, ঠিক আছে?”

পুলিশ এই খু/নের দায়ে গ্রেফতার করে এলাকার এক সন্ত্রাসীকে। তাকে আসামী করেই মামলাটা সাজানো হয়। সুজানা ছোটবেলা থেকেই মানসিকভাবে স্বাভাবিক নয়। নিজ চোখে যেহেতু বাবা-মাকে খু/ন হতে দেখেছে, তাই তার মনের অবস্থা আরও বিগড়ে যায়। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা তাকে পাঠিয়ে দেয় বিদেশে চিকিৎসার জন্যে। সুজানা ভালোও হয়ে গিয়েছিল। নয় থেকে উনিশ বছর বয়স পর্যন্ত স্বাভাবিক ছিল তার জীবনযাপন।

হঠাৎ সব বদলে যায়, তাদের পাশের বাড়ির এক লোকের খু/নের পর থেকে। সেই লোকটাকেও একইভাবে খুন করা হয়। অনবরত শরীরে ছু/রি চালিয়ে। তার
মৃ/তদেহটা সুজানার মনে আলোড়ন তোলে। তার মস্তিষ্কে ফিরে আসে ফেলে আসা দিনের স্মৃতি। তবে সেই স্মৃতির বেশির ভাগই ঝাপসা। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে বাবা-মায়ের র/ক্তাক্ত মৃ/তদেহ। যেহেতু সুজানার মামা বলেছিল সে নিজেই খু/নি, এটাই তার মাথায় রয়ে গেছে। সুজানা বড় হয়ে দাবি করতে থাকে, খু/নি সে।

আরশাদের তদন্তে বেরিয়ে আসে আসল খুনি। উপযুক্ত প্রমাণ আরশাদের জোগাড় করতে পেরেছে। একে তো সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ তার ওপরে সুজানার মামী নিজে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন, তার স্বামী হ/ত্যাকান্ডের দিন বাড়িতে ছিল না। বাড়ি ফেরে অনেক রাত করে। তাছাড়া সবথেকে বড় প্রমাণ সুজানা।

আজ এয়ারপোর্টে সিনেমার শেষের দিকের একটা দৃশ্যের শুটিং হচ্ছে। এখানে শুটিংয়ের জন্যে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়। সকলকে যদিও দেওয়া হয় না। সুপারস্টার আরশাদ হক অবশ্য ‘সকল’ এর কাতারে পড়েও না। উৎসুক জনতার ভীড় আরশাদকে এক নজর দেখার জন্যে। আরশাদ এক মুহূর্তও অপচয় করতে চাইছে না। একটা মাত্র দৃশ্যের শুটিং এখানে। যত দ্রুত সম্ভব শুটিং শেষ করে বেরিয়ে যেতে চাইছে। আরশাদ এখানে শুটিং করছে জেনে যাদের এয়ারপোর্টে কোনো কাজ নেই, তারাও ছুটে এসে ভীড় করছে।

গল্প অনুযায়ী আরশাদ পিএইচডি করতে অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছে। যদিও সেখানে থেকে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা তার নেই। দেশের মানুষের সেবা করাই তার মূল লক্ষ্য। সুজানা এসেছে তাক বিদায় দিতে। তার জীবনের সবথেকে বড় রহস্যের সমাধান আরশাদ করে দিয়েছে। খানিকটা কৃতজ্ঞতার বশে আর বাকিটা ভালোলাগার।

যাওয়ার আগে চমৎকার সুন্দর একটি কথোপকথন হবে তাদের মাঝে। সেই কথোপকথনের শেষের দিকে আরশাদ বলবে, “এখান থেকে সোজা আমার চেম্বারে যাবে। আমার বুকশেলফে একটা কালো ডায়রী আছে। খুঁজে পেতে একটু অসুবিধা হবে, কিন্তু খুঁজে ঠিকই পাবে। ডায়েরীর একদম শেষের পাতায় তোমার জন্যে কিছু অপেক্ষা করছে।”

আরশাদের প্লেন দেশ ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত সুজানা এয়ারপোর্টেই বসে থাকে। এরপর সোজা চলে যায় তার চেম্বারে। কাঙ্ক্ষিত ডায়রীটা খুঁজে চলে যায় একদম শেষের পাতায়। গোটা গোটা মুক্তার মতো অক্ষরে যা লেখা, তা পড়ে সুজানার পুরো পৃথিবীটাই উল্টে যায়।

তার বাবা-মায়ের খুন মামা করেনি। সুজানা বাবা ছিলেন হাই স্কুলের একজন শিক্ষক। তখন তার স্কুলের দশম শ্রেণীর নির্বাচনী পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষার খাতা দেখতে গিয়ে তিনি টের পেলেন প্রত্যেকটা ছেলে ৯৮-৯৯ পেয়েছে। কেউ কেউ তো একেবারে ১০০। উচ্চতর গণিত এমন একটা বিষয়, যেখানে ভালো করত পারলে পুরো নম্বরই পাওয়া যায়। তাই বলে সকলেই ভালো করেছে এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এমনকি সারাবছর ফেল করা ছেলেটাও পেল ৯৮!

তিনি অন্যান্য শিক্ষকদের কাছে খোঁজ নিয়ে দেখলেন, প্রতিটা বিষয়েই একই অবস্থা। স্কুলের প্রত্যেকটা ছেলে রাতারাতি বিদ্যাসাগর হয়ে যেতে পারে না। এর একটাই অর্থ, প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। স্কুলের প্রশ্নগুলো সব অফিস রুমেই থাকে। অফিস রুমে দায়িত্বরত কর্মকর্তা কখনোই এ কাজ করবে না। তার মানে কেউ না কেউ প্রশ্ন চুরি করছে।

চোর ধরার উপায় বের করলেন সুজানার বাবা। তিনি ঘোষণা করলেন, উচ্চতর গণিতে আরও একটা বাড়তি পরীক্ষা নেওয়া হবে। দুটো পরীক্ষার নম্বর গড় করে রিপোর্ট কার্ডে লেখা হবে। ছেলেরা এই সিদ্ধান্তে প্রচন্ড বিরক্ত হলেও কিছুই করার নেই।

পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করে অফিস রুমে রেখে বাড়ি চলে যান সুজানার বাবা। ফিরে আসেন রাত দশটার দিকে। স্কুলের করিডোরে লুকিয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ পর সেখানে আগমন ঘটে তার চেনা এক ছাত্রের, শিহাব। অফিস রুমের তলার চাবির ডুপ্লিকেট সে আগেই বানিয়ে রেখেছিল। সেটা দিয়ে তালা খুলে অফিস রুম থেকে প্রশ্ন নিয়ে বেরিয়ে আসবে, এমন সময়েই তাকে ধরে ফেললেন সুজানার বাবা।

পরদিন স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয় শিহাবকে, সঙ্গে ঘোর অপমান তো রয়েছেই। গ্রামের সবার সামনে তাকে কান ধরে উঠবস করতে হয়, জুতার মালা পড়ে গ্রামজুড়ে ঘুরে বেড়াতে হয়। নীরবে সব অপমান সহ্য করে নিয়েছিল শিহাব। সেই সঙ্গে মনে মনে গড়ছিল প্রতিশোধের নীল নকশা।

কয়েক মাস পরে সুজানাদের বাড়িতে এক বৃষ্টিভেজা রাতে আগমন ঘটে শিহাবের। হাতে ধারালো দুটো ছু/রি। সুজানা বাবাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নির্মমভাবে হ/ত্যা করে তাকে। সুজানার মাকে মারার কোনো ইচ্ছা তার ছিল না। কিন্তু উপায় নেই, ভদ্রমহিলা তার কৃতকর্মের একমাত্র স্বাক্ষী। সুজানাকে সে ছেড়ে দেয়। একে তো বাচ্চা একটা মেয়ে, তার ওপরে বাবা-মাকে নিজ চোখে খু/ন হতে দেখে নির্ঘাত মাথার সবগুলো তার বিগড়ে গেছে। শিহাব তাই তাকে মিষ্টি গলায় বলে, “তোমার বাবা-মাকে কিন্তু আমি মারিনি। তুমি মেরেছ, ঠিক আছে?”

শিহাব ঘটনার পরপরই গ্রাম থেকে পালিয়ে যায়নি। এতে সন্দেহের সবগুলো তীর তার ওপরেই এসে পড়তো। পুলিশ তাকে প্রাথমিক কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল ঠিকই। তবে তাদের মনে হয়নি ষোলো বছর বয়সী রোগা-পাতলা একটা ছেলে খুন করতে পারে। তাছাড়া সেই সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে আগে থেকেই অনেক অভিযোগ ছিল। আসামী হিসেবে তাই তাকেই গ্রেফতার করা হয়।

সেই শিহাব আর কেউ নয়। সুজানার ডক্টর, আরশাদ। গ্রাম থেকে চলে গিয়ে আসলেই সে ভালো ছাত্র হয়ে ওঠে। মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে সাইক্রিয়াটিস্ট হয়ে ওঠে। নাম-পরিচয় বদলে নতুন নামে জীবনযাপন করতে থাকে। প্রথম জীবনে করা ওই অপরাধ তার মস্তিষ্ক থেকে একেবারেই উড়ে যায়।

তবে সুজানাকে নিজের রোগী হিসেবে পেয়েই সবটা পাল্টে গেল। তার ভয় ছিল, সুজানার হুট করে একদিন সবটা মনে পড়ে যাবে। সকলকে জানিয়ে দেবে তার আসল সত্যিটা। তাই আরশাদ তাকে জোড়ালো নে/শাদ্রব্য দিয়ে সর্বক্ষণই একটা ঘোরের মধ্যে রাখতো। শুরু করে তার ওপরে ব্রেইনওয়াশ। ডক্টর হিসেবে আরশাদ যা বলে, সুজানা তাই বিশ্বাস করতে থাকে। সেই সুজানার মাথায় ঢুকিয়েছিল, তার মামা খু/নি। নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে গিয়ে আরশাদ জানতে পারে সুজানার মায়ের সঙ্গে মামার সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ ছিল। এই সূত্র ধরেই মিথ্যা খুনের গল্প সাজায় সে। সুজানার মামী তার মামার কাছ থেকে মুক্তি পেতে চাইছিল, মুক্তির ব্যবস্থা করতেই তাকে মিথ্যা স্টেটমেন্ট দেওয়ায় আরশাদ।

প্রকৃত সত্যিটা ডায়রীর শেষ পাতায় লেখা। সিনেমার শেষ দৃশ্যে সুজানা ডায়রীটা হাতে নিয়ে থ হয়ে বসে আছে। তার কিছুই করার নেই। আরশাদ নিজের সব দোষ স্বীকার করেছে ঠিকই, তবে তাকে ধরার কোনো উপায় নেই। সে পাড়ি জমিয়েছে পৃথিবীর আরেক দিগন্তে।

এয়ারপোর্টের দৃশ্যের শুটিংয়ের প্রস্তুতি চলছে। আরশাদ ওয়েটিং এরিয়ায় বসে মনোযোগভরা
দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে স্ক্রিপ্টের দিকে। এই দৃশ্যে তার আঠারোটা সংলাপ। যদিও তার সংলাপ মুখস্ত করার কিছু নেই। একবার দৃশ্যের ওপর চোখ বোলালেই সবগুলো সংলাপ মনে থাকবে তার।

ওদিকে উৎসুক জনতার ভিড় সামলাতে ব্যস্ত পুলিশ সদস্যরা। স্টিলের ব্যারিকেট দিয়ে তাদের পথ আটকে দেওয়া হয়েছে। তবে অতি উচ্ছ্বসিত কেউ কেউ ব্যারিকেট টপকে এ পাড়ে আসতে চাইছে।

শুটিংয়ের একজন অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টরকে একটু পর পর ভীড়কে উদ্দেশ্য করে বলছে, “আরশাদ স্যার শুটিং শেষ করে আপনাদের সবার সাথে দেখা করবে। প্লিজ এদিকে কেউ আসার চেষ্টা করবেন না।” কে শোনা কার কথা? আরশাদের পাগল ভক্তকুলের একমাত্র লক্ষ্য এদিকে আসা। ।

সুজানা এতক্ষণ দেখছিল ভক্তদের পাগলামি। এখন তার অভিনয়ে তেমন একটা সমস্যা হচ্ছে না। সংলাপ মনে রাখতেও কষ্ট হয় না।
সুজানা ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে গেল ওয়েটিং এরিয়ায়।

আরশাদের পাশের সিটে বসতে বসতে বলল, “অনেক ভালোবাসে আপনাকে আপনার ফ্যানরা।”

আরশাদ স্ক্রিপ্টের দিকে তাকিয়ে রেখেই সূক্ষ্ম হাসি হেসে বলল, “তা তো বাসেই।”

সুজানা হাসিমুখে বলল, “আমিও কিন্তু আপনার অনেক বড় ফ্যান।”

কথাটা কি সুজানা ফ্লার্ট করে বলল? সেও আরশাদের ফ্যান মানে কী? সেও আরশাদকে ভালোবাসে? অতটা মাথা ঘামলো না আরশাদ।

বিস্ময় নিয়ে বলল, “জানতাম না তো।”

সুজানা দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “না জানার কী হলো? এ দেশে এমন কোনো মেয়ে পাওয়া যাবে যে আপনার জন্যে পাগল নয়?”

শুরু হলো শুটিং, এয়ারপোর্টের এই দৃশ্যে আরশাদের অভাবনীয় অভিনয় দেখে মুগ্ধ হলো সকলে।

ইদানিং শরীরটা ভালো যাচ্ছে না অরার। অসুস্থ শরীর সামাল দেওয়া এমনিতেই কষ্টসাধ্য কাজ। মন শান্ত থাকলে সেই কাজ অনেকাংশেই সহজ হয়ে ওঠে। তবে মনই যদি অশান্ত থাকে? অরার মনটা আজকাল বড্ড অশান্ত, অস্থির, অন্ধকারাচ্ছন্ন। মনের মাঝে এমন ঘোলাটে এক অনুভূতি। নিজেকে নিজেই বুঝতে পারছে না অরা।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কয়েকটা অনলাইন নিউজ পোর্টালে লেখালিখি হচ্ছে একটা বিষয় নিয়ে। যে বিষয় ক্রমেই প্রকম্পিত করে তুলছে অরার হৃদয়টাকে। সেসব অনলাইন পোর্টালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে আরশাদ আর তার নতুন সহঅভিনেত্রী সুজানার প্রেমের গুঞ্জন! এই গুঞ্জন শব্দটার ভিত্তি কী? কোথা থেকে আসে গুঞ্জন? কে এদের সৃষ্টি করে?

আরশাদকে নিয়ে উল্টো-পাল্টা নিউজ প্রায়ই করা হয়। গত মাসেও তো বিনোদন বাংলা নিউজ করলো, আরশাদ আর অরার মিথ্যা ডিভোর্সের। সুপরিচিত কোনো পত্রিকা বা টিভি
চ্যানেল উল্টো-পাল্টা নিউজ করলে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয় আরশাদ। রেগে আগুন হয়ে ওঠে সে। তবে দীর্ঘদিন ধরে সুজানার সঙ্গে তার প্রেমের নিউজ হচ্ছে, এতে তার কোনো মাথাব্যথা নেই?

এই ব্যাপারটাই অরার ভেতরকার অস্থিরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। যে আরশাদ বরাবরই মিথ্যা নিউজের বিরুদ্ধে, সে কেন এত বড় একটা নিউজে নীরব? যদিও নিউজগুলো করছে চুনোপুটি কিছু অনলাইন পোর্টাল। এদের তথ্যের কোনো নিশ্চয়তা নেই। এদের তথ্য বিশ্বাস করার আগেও শিক্ষিত-সচেতন মানুষ দুবার ভাবে।

অরা জানে এই নিউজ সত্যি হতে পারে না। আরশাদকে তো সে-ই সবথেকে ভালো করে চেনে। ঘরে বউ রেখে বাইরে একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে বেড়াবার মতো নিচু স্তরের মানুষ সে কখনোই হতে পারে না। আরশাদকে তো অরা নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করে। তবুও মনের অস্থিরতা কেন দূর হচ্ছে না?

এর কারণ নিউজের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে শুটিং সেটে তোলা আরশাদ এবং সুজানার কিছু ছবি। কোনো ছবিতে তারা নদীর পাড়ে বসে আছে, কোনোটাতে সুজানা হাসি মুখে আরশাদকে কিছু একটা বলছে। যদিও ছবি দেখেই কিছু বিচার করতে বসা উচিত নয়। শুটিং সেটে একসঙ্গে থাকলে দুটো মানুষের মধ্যে কথা তো হতেই পারে। কথা হওয়া মানেই কি প্রেম?

অরার মনে হচ্ছে তার বুকের ওপরে কেউ ভারী পাথর চেপে ধরেছে। প্রত্যেকবার শ্বাস নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছে ফুসফুসের বড় একটা অংশ ফাঁকা রয়ে যাচ্ছে। তার আরশাদ কেবল তাকেই ভালোবাসে, তার প্রতিই আরশাদের সকল আসক্তি। তবুও কেন নিজেকে বুঝ দিতে এত কষ্ট হচ্ছে অরার? তবুও কেন মিথ্যা নিউজগুলো অবিশ্বাস করতে এতটা কষ্ট হচ্ছে?

অরার মাথা ঘুরে উঠলো। বিছানা থেকে উঠে বসে দুহাতে মাথাটা চেপে ধরলো। আরশাদকে সরাসরি কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারছে না সে। আরশাদ যদি জানতে পারে অরা তাকে নিয়ে ক্ষীণ সন্দেহ পুষে রেখেছে তাহলে প্রচন্ড কষ্ট পাবে। অরা সন্দেহ আসলে করছে না। তবে নিউজগুলোকে একেবারেই অবিশ্বাস করতে পারছে না। এই দ্বিধা থেকে মুক্তির উপায় কী?

অরা অনলাইনে পড়েছে স্ত্রী গর্ভবতী হলে না-কি স্বামীদের পরনারীর প্রতি আসক্তি বাড়ে? তবে কি আরশাদও? অরা বিশ্বাস করতে চাইছে না। নিজের ওপর ঘৃণা হচ্ছে আরশাদকে নিয়ে এমন চিন্তা করার জন্যে। আবার নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছে, আরশাদকে অবিশ্বাস করার জন্যে।

ঝাঁঝালো অনুভূতিগুলো নিয়ন্ত্রণ করে অরা নেমে এল নিচে। মাহমুদ আজ এসেছে কতগুলো চেক নিয়ে। তার সঙ্গে কোনো কথোপকথনে জড়াবার ইচ্ছা অরার নেই। কোনমতে চেকগুলো সাইন করে উপরে উঠে আসাই তার লক্ষ্য।

সেই লক্ষ্য অবশ্য সফল হলো না। মাহমুদ আচমকা বিরক্ত গলায় বলে উঠলো, “দেখেছেন ম্যাম! এই নিউজ পোর্টালগুলোর খেয়েদেয়ে কোনো কাজ নেই। সারাদিন উল্টো-পাল্টা নিউজ করে জনগণকে কনফিউশনে রাখে। দেখুন কী লিখেছে!”

অরার কিছু বলবে তার আগেই মাহমুদ তার মোবাইলটা ধরিয়ে দিলো অরার হাতে। মিনিট দশেক আগে প্রকাশিত একটা নিউজ। শিরোনাম, ‘প্রেমে মজেছেন সুপারস্টার’। নিউজের সঙ্গে সংযুক্ত করা আজকের ছবি। এয়ারপোর্টের ওয়েটিং এরিয়ায় পাশাপশি বসে আছে আরশাদ আর সুজানা। সুজানার মুখে একরাশ হাসি। কয়েকদফা মোচড় দিয়ে উঠলো অরার হৃদয়। দমবন্ধ লাগছে তার।

(চলবে)

#ফিরে_আসা২
৪৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

গম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে আরশাদ। শুটিংয়ের সময়ে প্রয়োজন ছাড়া এই জিনিস তার হাতে দেখা যায় না বললেই চলে। এ দেশের বেশির ভাগ সেলিব্রিটিই অতিরিক্ত একটা ভাব নিয়ে চলতে পছন্দ করে। ভাবের অংশ হিসেবে সারাক্ষণ শুটিং সেটে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকা। এমন একটা ভাব করে যেন দুনিয়া উল্টে ফেলছে। অথচ করে কেবল ফেসবুক স্ক্রল।

কাজের সময়ে কাজটাকেই প্রাধান্য দেয় আরশাদ। মোবাইল থেকে তাই থাকে যথাসম্ভব দূরে। আজ বাধ্য হয়েই শুটিংয়ের মাঝে মোবাইল নিয়ে বসেছে। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে ওই অনলাইন পোর্টালের নিউজগুলো।তার এবং সুজানা বিভিন্ন সময়ের তোলা ছবি নিয়ে করা নিউজ। শুটিং ইউনিটে এমন কিছু লোক থাকে যারা টাকার বিনিময়ে গোপনে ছবি তুলে এসব নিউজ পোর্টালের কাছে সরবরাহ করে। এদের ধরার চেষ্টা করা নিতান্তই সময়ের অপচয় ছাড়া কিছু নয়। তবে আরশাদ অবাক হয়ে যাচ্ছে এসব নিউজের বিরুদ্ধে কেউ কোনো পদক্ষেপই নেয়নি?

আরশাদ মাঝখানে একবার শুনেছিল তাকে এবং সুজানাকে ঘিরে চটকদার শিরোনামে নিউজ করা হচ্ছে। এসব চুনোপুটি নিউজ পোর্টালদের নিয়ে চিন্তা করে সময় নষ্ট করতে চায়নি আরশাদ। সে ভেবেছিল কে ফিল্মসের পিআর টিম হয়তো ব্যাপারটা সামলে নেবে। তবে আজ হঠাৎই তার চোখে পড়লো নতুন একটা নিউজ। তার অর্থ, এসব নিউজ এখনো থামেনি!

পিআর টিমকে খানিক ধমকাধমকির পর সত্যিটা স্বীকার করে তারা। এসব নিউজ হলে মূলত সিনেমারই প্রচার হবে। তাই তারা বাঁধা দেয়নি। কোনো মানে হয়? সুপারস্টার আরশাদ হকের সিনেমার এমনিতেই কোনো প্রচারণার প্রয়োজন হয় না। তাও আবার এমন বাজে প্রচারণা। পিআর টিমের প্রধান খালেদকে ফোনে কয়েকদফা ধমকাধমকি সেরে আরশাদ এবার ডেকে পাঠিয়েছে অয়নকে। ম্যানেজার হিসেবে এই ব্যাপারটা সামলানো তারও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “আমার বলার জন্যে অপেক্ষা করো কেন অয়ন? একটা কাজও নিজে বুদ্ধি খাটিয়ে করা যায় না?”

অয়ন কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, “সরি স্যার।”

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমি কয়েদিকে নজর রাখবো? এই চুনোপুটি অনলাইন পোর্টালদেরকেও আমার থ্রেট দিতে হবে?”

“সরি স্যার, আমি এখনই এদের সাথে কথা বলছি।”

আরশাদ কঠিন গলায় বলল, “চোখ-কান খোলা রাখতে শেখো অয়ন! শুধু শিডিউল বানানো ম্যানেজারের কাজ না।”

এ ধরনের নিউজ যেকোনো সেলিব্রিটির ইমেজের জন্যে ক্ষতিকর। সুপারস্টার তার ইমেজ নিয়ে চিন্তিত নয়। তবুও নিজেকে নিয়ে এ ধরনের নিউজ কেউই সহ্য করবে না। বড় কোনো পত্রিকা হলে আরশাদ নিজেই সেই পত্রিকার সম্পাদককে ফোন করে, ডেকে পাঠিয়ে, থ্রেট দিয়ে হুলস্থুল কান্ড বাঁধতো। ছোট-খাটো সব অনলাইন নিউজ পোর্টাল। কে দেখে এদের নিউজ আর কে বিশ্বাস করে এদের? খুব একটা মাথা ঘামালো না আরশাদ। এদের সামলাবার দায়িত্বটা অয়নের হাতে দিয়েই সে নিশ্চিন্ত হলো।

আজ ‘দিগন্ত’র শুটিংয়ের শেষ দিন। প্রত্যেকটা সিনেমার শুটিংয়ের এই শেষ দিনটা বড় অদ্ভুতভাবে কাটে। ইউনিটের সকলের মাঝেই আনন্দ এবং মন কেমনের আলোছায়া খেলা করে বেড়ায়। আরশাদের অবশ্য কোনো কালেই মন কেমন করে না। এতদিন ধরে একটা চরিত্রে অভিনয় করে আসছে। চরিত্রের মায়ায় পড়ে যায় ঠিকই। তবে দিন দিন যত অভিজ্ঞতা বাড়ছে, সেই মায়া কাটিয়ে ওঠাও সহজ হচ্ছে। শুটিং শেষ হয়ে গেলে আজকাল বরং আনন্দই কাজ করে আরশাদের মাঝে।
শুটিং শেষে যত দ্রুত এডিটিং-ডাবিংয়ের কাজ শেষ হবে, ততটাই দ্রুত বেগে তা পৌঁছে যাবে দর্শকের কাছে।

রাত আটটা বাজছে কেবল। ইউনিট প্রস্তুতি নিচ্ছে শেষ দৃশ্যের শুটিংয়ের জন্যে। স্ক্রিপ্টের শেষ দৃশ্য নয়। শুটিংয়ের শেষ দৃশ্য। শুটিংয়ের সময়ে স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী একের পর এক দৃশ্য শুটিং করা হয় না। শুটিংয়ের সুবিধা অনুযায়ী যেকেনো সময়ে যেকোনো দৃশ্যের শুটিং করা যায়। দৃশ্যগুলো এলোমেলো ভাবে ধারণকৃত
হলেও এডিটের সময়ে তা আবারও স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী সাজিয়ে ফেলা হয়।

বনানীর এই শুটিং হাউজে গত কয়েকদিন ধরে স্ক্রিপ্টের মাঝামাঝি পর্যায়ের দৃশ্যগুলো ধারণ করা হচ্ছে। যখন সুজানার চিকিৎসা চলছে, আর আরশাদ তার কাছ থেকে নতুন নতুন তথ্য পাচ্ছে। সেরকমই একটা দৃশ্যের মধ্য দিয়ে শেষ হবে সিনেমার শুটিং।

দৃশ্যটা বারান্দায় ধারণ করা হবে। সেখানেই লাইট করা হচ্ছে। ইউনিটের একটা অংশের ব্যস্ততা বারান্দাকে ঘিরে। শুটিং হাউজের লিভিং রুমে বসে স্ক্রিপ্টে নিজের সংলাপগুলো পড়ছে আরশাদ। তার মুখোমুখি থাকা সোফায় বসে নিঃশব্দে নিজের সংলাপ পড়ছে সুজানা। এই মেয়েটার কর্মকান্ড এখন সহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। অভিনয়ের সময়ে আগের মতো অহরহ ভুল আর করছে না।

দুজনের লক্ষ্য করলো শুটিংয়ের হাউজের মূল দরজা দিয়ে প্রকান্ড আকারের এক কেক নিয়ে প্রবেশ করছে প্রোডাকশনের দুটো ছেলে। প্রত্যেকটা সিনেমার শেষ দিনে কেক কাটার রেওয়াজ প্রচলিত আছে ইন্ডাস্ট্রিতে। এবারও নিশ্চয়ই তার ব্যতিক্রম হবে না।

সুজানা হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে মলিন কণ্ঠে বলল, “কেক কেটে আনন্দ করতে হবে?”

আরশাদ স্ক্রিপ্টের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, “কেন তোমার আনন্দ হচ্ছে না।”

সুজানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “একদমই না। এতদিন শুটিং করতে করতে এই ইউনিটটা আমার পরিবারের মতো হয়ে গেছে। আজ শেষ দিনে মনে হচ্ছে নিজের পরিবার ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাচ্ছি।”

আরশাদ হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “পরিবার বলতে মনে পড়লো, তোমার বাবা কেমন আছে?”

সুজানা ফ্যাকাশে হাসি হেসে বলল, “আগের মতোই। তার তো আর ভালো হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”

আরশাদ শুকনো গলায় বলল, “যত্ন নিও তার। শুটিং তো শেষ। এখন আর নতুন কোনো সিনেমা হাতে না নিয়ে তার পাশে থেকো।”

সুজানা হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলল, “অবশ্যই।”

আবারও নীরবতা ফিরে এলো। আরশাদের মনে হলো সুজানার বাবার প্রসঙ্গ এই মুহূর্তে আনা ঠিক হয়নি। শুধু শুধু কষ্টের কথা একটা মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়া! আবার পরমুহূর্তেই মনে হলো, কষ্ট সর্বক্ষণ যার হৃদয়ে বিরাজমান তাকে আবার নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়ার কী আছে?

সুজানা হয়তো এই প্রসঙ্গে আর কথা বাড়াতে চাইছে না। কাজটা আগলে নিয়েছেই তো কষ্টগুলো ভুলে থাকার জন্যে। পরিস্থিতি আর নিজেকে স্বাভাবিক করে নেওয়ার জন্যে সুজানা হঠাৎ বলল, “শুটিংয়ের শেষ দিন বলে আপনিও অনেক খুশি তাই না ভাইয়া?”

আরশাদ বুঝতে পারলো সুজানা মনের অস্থিরতা দূর করার জন্যে ভিন্ন প্রসঙ্গে যেতে চাইছে। তাই সেও প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন করে বলল, “সেটা মনে হলো কেন?”

সুজানা হাসিমুখে বলল, “যা জ্বালিয়েছি আপনাকে, খুশি তো হওয়ারই কথা।”

“জ্বালিয়েছ ঠিকই। কিন্তু আমার মনে হয় অভিনয়ের পেছনে তোমার আরও বেশি সময় দেওয়া উচিত। ভবিষ্যতে ভালো করতে পারবে তাহলে।”

“চেষ্টা করবো ভাইয়া। তবুও, আপনাকে জ্বালানোটা অনেক মিস করবো।”

শেষ হয়ে গেল আরশাদ হকের ঊনত্রিশতম সিনেমা ‘দিগন্ত’র শুটিং। বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির প্রেক্ষাপটে দশ বছরের ক্যারিয়ারে ঊনত্রিশটা সিনেমা নেহায়েত কম একটা সংখ্যা। তবে আরশাদ সংখ্যাকে কখনোই গুরত্ব দেয়নি। তার কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সিনেমার গুণগত মান। এজন্যেই তো সে আজ দেশের সবথেকে বড় সুপারস্টার।

দশটার মধ্যে শুটিং শেষ হয়ে গেলেও আরও কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হলো। কেক কাটা, ছবি তোলা। এছাড়াও কয়েকটা টিভি চ্যানেলেকে আজ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাদেরকে ইন্টারভিউ দিতে দিয়েও ঘন্টাখানেক লেগে গেল।

দিনভর শুটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও ক্লান্তি আজ গ্রাস করতে পারেনি আরশাদকে। বহুদিন পর আজ নিজেরই ড্রাইভ করতে ইচ্ছা হলো। ড্রাইভারকে জহিরকে তাই ডেকে বলল,
“জহির তোমাকে আজ ড্রাইভ করতে হবে না। আমি নিজেই ড্রাইভ করবো।”

জহির খুশিমনে বলল, “জি আচ্ছা স্যার।”

আরশাদের এক অ্যাসিস্টেন্ট আর জহির মিলে গ্রিন রুম থেকে তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো গাড়িতে তুলছে। স্ক্রিপ্ট, ডায়েরি, কস্টিউম আরও কয়েকটা জিনিস। জিনিসগুলো গাড়িতে তোলা পর্যন্ত বাইরেই অপেক্ষা করছে আরশাদ।

হঠাৎ দেখলাম সুজানা এগিয়ে আসছে। এগিয়ে এসে মিষ্টি গলায় বলল, “ভাইয়া? শেষ বারের মতো আপনাকে একটু বিরক্ত করবো?”

আরশাদ ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আবার কী?”

সুজানা হেসে ফেলে বলল, “আমার নিজের তো গাড়ি নেই, প্রতিদিন উবার নিয়ে বাসায় ফিরি। আজকে কোনো উবার পাচ্ছি না। ইউনিটের সব গাড়িগুলোও চলে গেছে। আপনার বাসার পথেই আমার বাসা পড়বে। আমাকে ড্রপ করে দেবেন প্লিজ?”

নায়িকাজাত বরাবরই গায়ে পড়া স্বভাবের। তার ওপরে এই মেয়েটাকে শুরুর দিকে সুবিধাজনক বলে মনে হয়নি আরশাদের। যদিও সুজানার অবস্থান এখন তার কাছে সহনীয় পর্যায়ের। আরশাদ খেয়াল করলো আসলেই ইউনিটের সব গাড়িগুলো চলে গেছে। শুটিং সেটের সামনেই দিনভর ছিল তারা। ইন্টারভিউ দিতে দিতে দেরি হয়ে গেছে বলে তারা চলে গেছে।

আরশাদ জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে বলল, “কোথায় তোমার বাসা?”

“সাত নম্বর রোডে।”

খানিকক্ষণ চিন্তা করে আরশাদ বলল, “আচ্ছা এসো।”

(চলবে)

#ফিরে_আসা২
৫০+৫১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

একরাশ আলসেমি নিয়ে বিছানায় পড়ে আছে অরা। রাত যে কত গভীর হলো সেদিকে তার কোনোই খেয়াল নেই। শরীরটা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। কোনো কাজ করার শক্তি পেয়ে ওঠে না অরা। এমনকি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ানোও তার পক্ষে দুঃসাধ্য কাজ। আজ সারাদিন ঘর থেকে বের হয়নি সে। স্টাফরা প্রতিবেলায় এখানেই খাবার নিয়ে এসেছে, বিকেলের দিকে কথা অনেক সময় তার সঙ্গে কাটিয়ে পড়তে চলে গেছে।

মনের অস্থিরতা কিছুতেই দূর হচ্ছে না অরার। মনের মাঝখানে একটা অস্বস্তি, একটা ভারী অনুভূতি সারাক্ষণই বিরাজমান। প্রত্যেকটা নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে সেই অনুভূতি নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছে।

সামান্য নিউজ পোর্টালের গুঞ্জনে রীতিমত গা ভাসিয়ে দিচ্ছে সে। অথচ আরশাদের পুরোটা জুড়েই যে কেবল অরা, সেটা সে খুব ভালো করেই জানে। নিজেকে প্রচন্ড অসহায় লাগছে অরার। না পারছে ওই নিউজগুলোকে এড়িয়ে যেতে, না পারছে আরশাদের সঙ্গে আলোচনা করতে। কী বলবে আরশাদকে? “তুমি কি ওই মেয়েটার সঙ্গে প্রেম করছো?” – ছি ছি! প্রশ্নটা কল্পনা করতেই গা গুলিয়ে উঠলো অরার। সে যে এ বিষয়টাকে নিয়ে চিন্তা করছে, জানলেই ভীষণ কষ্ট পাবে আরশাদ।

তবে অরা নিরুপায়। নিজেকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। আরশাদকে সন্দেহ করার জন্যে ভর্ৎসনা করছে নিজেকে বারবার। তবে কিছুতেই, কোনো উপায়েই দমিয়ে রাখতে পারছে না নিজেকে। বারবার মনে হচ্ছে, যদি এই নিউজগুলো সত্যি হয়? যদি সত্যিই তার ভালোবাসার মানুষটাকে ওই মেয়েটা দখল করতে শুরু করে? যদি সত্যিই তার প্রতি আরশাদের সকল ভালোবাসা অদৃশ্য হয়ে যায়?

বিছানায় শুয়ে আছে অরা। এক হাতে চোখের সামনে ধরে রেখেছে মোবাইলটা। স্ক্রিন জ্বলজ্বল করছে ওরকমই একটা নিউজে। শুটিং সেটে আরশাদ আর সুজানা শুটিংয়ের পর ধারণকৃত দৃশ্যটা দেখছে ক্যামেরায়। আরশাদ তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে আর সুজানা আরশাদের দিকে। ছবিটা যথেষ্ট অরার পুরো শরীর হিম করে দেওয়ার জন্যে। শুধু শরীর নয়, অরার হৃদয়টাও একটু একটু করে জমে যাচ্ছে।

হঠাৎ অরা সংবিৎ ফিরে পেলো দরজার আওয়াজে। দরজার দিকে চোখ পড়তেই লক্ষ্য করলো আরশাদকে। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলের স্ক্রিন বন্ধ করে ফেলল অরা।

এই সময়ে অরাকে জেগে থাকতে দেখে। ইদানিং অরা রাত জাগতে পারে না। দশটা নাগাদই ঘুমিয়ে পড়ে। শুটিং থেকে ফিরে গত এক মাসে তাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখেনি আরশাদ।

আরশাদ বিস্ময় এবং উদ্বেগ নিয়ে বলল, “অরা! তুমি এখনো জেগে আছো? কয়টা বাজে খেয়াল আছে?”

অরা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। এতক্ষণ তার চিন্তাভাবনায় কেবল আরশাদই ঘোরাফেরা করছিল। কয়েক মুহূর্ত ঘোরলাগা দৃষ্টিতে আরশাদের দিকে তাকিয়ে রইলো অরা। এই মানুষটাকেই সে সন্দেহ করছে?

অরা কম্পিত স্বরে বলল, “ঘুম আসছিল না।”

আরশাদ এগিয়ে এসে বিছানায় অরার পাশে বসলো। ক্ষীণ ধমকের সুরে বলল, “ঘুম না এলে ফোন ঘাটাঘাটি করতে হয়? দাও ফোনটা আমাকে!”

আরশাদ মোবাইলের দিকে হাত বাড়াতেই আঁতকে উঠলো অরা। এমনটা কখনো হয়নি। একে অপরের মোবাইলে অবাধ বিচরণের অধিকার দুজনেরই আছে। একে অপরের কাছ থেকে লুকানোর কিছু নেই বলেই হয়তো। তবে এই প্রথম আরশাদের কাছ থেকে লুকানোর কিছু আছে অরার। এতক্ষণ আরশাদ আর সুজানাকে ঘিরে তৈরি করা ওসব নিউজগুলো দেখছিল সে। ব্যাপারটা জানতে পারলে আরশাদ না জানি কীভাবে নেবে।

অরা চট করে বলল, “আমিই রেখে দিচ্ছি!”

আরশাদকে অতিক্রম করে অরা মোবাইলটা রেখে দিলো বেডসাইড টেবিলে। এই ব্যাপারে আর মাথা ঘামালো না আরশাদ। অরার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। এই দৃষ্টি অরার অতিচেনা। ভালোবাসাময় এক দৃষ্টি। যে দৃষ্টি অরাকে বারবার জানান দেয়, তার পাশে বসে থাকা মানুষটাকে তাকে কতটা ভালোবাসে।

অরার কপালে চুমু খেয়ে আরশাদ নরম স্বরে বলল, “আজ শরীরটা বেশি খারাপ?”

অরা ক্ষীণ হেসে বলল, “বেশি খারাপ না, তবে খারাপ।”

অরা মুখে না বললেও আরশাদ জানে তার শরীরটা একদমই ভালো নেই। দিনভর স্টাফদের ফোন করে জেনেছে অরা কেমন আছে। অরা নিজে তো কিছুই বলবে না। আরশাদ যাতে দুশ্চিন্তা না করে তাই হাসিমুখে বলে, “আমি ঠিক আছি।”

আরশাদ চিন্তিত স্বরে বলল, “এসির মধ্যেও ঘামছো তো!”

শরীরজুড়ে থমথমে হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল বলেই ঘামছে অরা। কতক্ষণ যে ওসব নিউজ দেখেছে আর কতক্ষন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ডুবে ছিল, সে নিজেও জানে না।

বিছানা থেকে নেমে গেল আরশাদ। ক্লজেট থেকে নতুন একটা টাওয়াল বের করে সেটা নিয়ে আবারও ফিরে এলো অরার কাছে।

“একটু উঠে বসবে?”

আরশাদ নিজেই অরাকে ধরে ওঠালো। এতটুকু কাজেই হাঁপিয়ে উঠেছে বেচারি। একটা হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছে আরশাদের বাহু। যেন ছেড়ে দিলেই পড়ে যাবে সে। চোখদুটো বন্ধ করে নিঃশ্বাস ফেলছে অরা।

আরশাদ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, “কষ্ট হয় উঠে বসলে?”

অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “হুঁ। উঠে বসতে কষ্ট হয়, হাঁটাচলা করতেও কষ্ট হয়।”

আরশাদের চোখদুটোতে অদ্ভুত এক কষ্টের ছায়া দেখলো অরা। তাকে কষ্টে দেখে আরশাদের কষ্ট নেহায়েত কম হচ্ছে না। ইচ্ছা করছে এই মুহূর্তে যাদুর কাঠি ছড়িয়ে অরার সমস্ত কষ্টগুলো দূর করে দিতে।

টাওয়াল দিয়ে আলতোভাবে অরার মুখে, গলায়, ঘাড়ে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে দিলো আরশাদ।

অরা দুই গালে দুটো হাত রেখে ভালোবাসাময় গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো আরশাদ। অরাও ঠিক তার মতো করে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। এমনভাবে হাজার বছর কাটিয়ে দেওয়াও কঠিন কোনো কাজ হবে না তাদের পক্ষে।

আরশাদ ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “তুমি অনেক স্ট্রং অরা। কত সুন্দরভাবে এতদিন বাবুকে নিজের ভেতরে সমলাচ্ছো! আর তো মাত্র কয়েকটা দিন।”

মুগ্ধতার হাওয়া বয়ে গেল অরার গা বেয়ে। একটা মানুষ এত সুন্দর করে কাউকে সাহস যোগাতে পারে? তাও আবার এই কঠিন সময়ে? অরা কিছু একটা বলতে যাবে, তখনই টের পেলো বাবু তার ছোট্ট শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে লাথি মারছে তার পেটে।

অরা আরশাদের একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে তার পেটের ওপর রেখে বলল, “দেখো কীভাবে লাথি দিচ্ছে আমাকে!”

প্রচ্ছন্ন হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটে। অরার অসুস্থতা দুঃচিন্তায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তাকে। বাবুর উপস্থিতি একটু হলেও প্রশান্তি ছড়িয়ে দিলো তার মাঝে।

আরশাদ অরার পেটের ওপরে কান রেখে আরও ভালোভাবে অনুভব করতে চেষ্টা করলো বাবুকে। টের পেলো আবারও বাবু লাথি দিচ্ছে অরার পেটে। সেই সঙ্গে একটু পর পর নড়েচড়ে উঠেছে।

আরশাদ আদুরে গলায় বলল, “জুনিয়রটা! মাকে বিরক্ত করে না এভাবে। তুই না ঘুমালে মাও তো ঘুমাতে পারছে না। ঘুমিয়ে পড় বাবা।”

অরার চোখে এসে জমেছে একরাশ জল। যেকোনো সময়ে তা গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায়। এই মানুষটাকে সে সন্দেহ করেছে? যে মানুষটার জীবনজুড়ে কেবল অরা, তাকে? কতগুলো ভুয়া পোর্টালের ভুয়া সংবাদের কারণে নিজের ভালোবাসাকে অবিশ্বাস করলো? তার ভালোবাসা কি এতটাই ঠুনকো?
কী করে পারলো সে আরশাদের মতো একটা মানুষকে অবিশ্বাস করতে? নিজের ওপরে অসম্ভব ঘৃণা হচ্ছে অরার।

“আরশাদ?”

অরার কান্নামাখা কণ্ঠে কানে আসতেই চোখ তুলে তাকালো তার দিকে। মেয়েটার চোখদুটো ছলছল করছে। আরশাদ সোজা হয়ে বসে অরাকে টেনে নিলো বুকের মাঝে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো মেয়েটা নিঃশব্দে কাঁদছে। তার টিশার্টের একপাশ ভিজে যাচ্ছে অরার অশ্রুতে।

আরশাদ উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “কী হয়েছে অরা?”

সত্যিটা বলতে পারলো না অরা। এই সত্যি বলা কখনোই সম্ভব নয় তার পক্ষে। অসহায় কণ্ঠে বলল, “আমার খুব দমবন্ধ লাগে। একদম ভালো লাগে না।”

আরশাদ বুঝতে পারছে, অরার মুড সুইং করছে। এমনটা প্রেগন্যান্সির শুরুর দিকে খুব বেশি হতো। শেষের দিকেও আবার ফিরেছে।

আরশাদ আরেকটু শক্ত করে অরাকে আগলে ধরে বলল, “অরা! আমি চলে এসেছি না? আর কোত্থাও যাবো না তো। আজ থেকে সারাক্ষণ তোমার কাছেই থাকবো। একটুও খারাপ লাগবে না তোমার। তাকাও আমার দিকে!”

অরা আরশাদের বুক থেকে মুখ তুলে তাকালো তার চোখের দিকে। অরার চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছে তার চোখদুটো।

আরশাদ কোমলতায় ভরা কণ্ঠে বলল, “খুব মন খারাপ লাগে একা একা?”

অরা দৃঢ়ভাবে বলল, “অনেক।”

আরশাদ তাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, “আমি চলে এসেছি তো! এখন থেকে সারাক্ষণ তোমার মনটা ভালো থাকবে।”

আবারও আরশাদের বুকে মুখ লুকিয়ে রাখলো অরা। আসলেই এখন থেকে তার মনটা অনেক বেশি ভালো থাকবে। এই মানুষটা যতক্ষণ আশেপাশে থাকে, ততক্ষণই ভালো থাকে অরা।

প্রায় অনেকক্ষণ পর অরাকে ছেড়ে দিয়ে আরশাদ বলল, “দাঁড়াও, আমি ফ্রেশ হয়ে এসে তোমাদের রিলাক্সেশনের ব্যবস্থা করছি। দেখবো ম্যাজিকের মতো ঘুম এসে গেছে।”

অরা অবাক গলায় বলল, “কী করবে?”

আরশাদ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “Wait and see!”

ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে আরশাদ ঘরের বাইরে চলে গেল। ফিরে এলো নারকেল তেলভর্তি একটা কাঁচের জার নিয়ে। বাজারের ক্যামিকালযুক্ত নারকেল তেল নয়। স্টাফদের তৈরি খাঁটি নারকেলের খাঁটি তেল। আরশাদ ইন্টারেন্টে দেখেছে, গর্ভাবস্থায় এই তেল নিয়ে
পেটে ম্যাসাজ করা হলে বাবু আর মা দুজনেই আরাম পাবে।

অরা বিছানাতেই শুয়ে ছিল। আরশাদ এসে তার পেটের ওপর থেকে জামাটা সরিয়ে ফেলল। কতগুলো চুমু খেলো উন্মুক্ত পেটের ওপরে। এরপর হাতের তালুতে তেল নিয়ে শুরু করলো ম্যাসাজ।

অরা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, “আরে এসব কোনো দরজার আছে? টায়ার্ড হয়ে এসে শুধু শুধু কষ্ট করছো।”

আরশাদ শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “একদম চুপ করে শুয়ে থাকো। আমি কোনো কিছুই শুধু শুধু করি না।”

আলতোভাবে ম্যাসাজ করে দিচ্ছে আরশাদ। এই ছেলেটার প্রত্যেকটা স্পর্শই অরার কাছে সম্মোহনী। তার ওপরে আবার এমন প্রশান্তিদায়ক স্পর্শ! বিচিত্র আরাম ঘিরে ধরলো অরাকে। কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়লো, নিজেও জানে না।

সকালে অরার ঘুম ভাঙলো আরশাদের ডাকে। প্রশান্তিময় লম্বা একটা ঘুম দিয়েছে অরা। রাতে একবারও ঘুম ভেঙে যায়নি না।

আরশাদ তার গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, “ওঠো অরা! কয়টা বাজে খেয়াল আছে?”

অরা ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল, “আমি উঠবো না।”

অরার শিশুসুলভ এই আচরণে হাসি থামাতে পারলো না আরশাদ। মেয়েটা বিশ্বাসই করতে চায় না, দিন দিন সে নিজেই একটা বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে।

অরার চুলে হাত বুলিয়ে আরশাদ বলল, “না উঠলে কীভাবে হবে অরা? এগারোটা বাজে। কতক্ষণ না খেয়ে আছো তুমি! ওষুধগুলো খেতে হবে না?”

অরা এক লাফে উঠে বসে বলল, “এগারোটা বাজে?”

“জি ম্যাডাম।”

“আমি এতক্ষণ ঘুমালাম?”

“হ্যাঁ।”

অরা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, “তুমি আমাকে ডাকবে না?”

আরশাদ হেসে অরার গালদুটো টিপে বলল, “সকাল সকাল উঠে কী করবে? ঘুমালে বরং শরীরটা ভালো লাগবে। তাই ডাকিনি।”

অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে আঁতকে উঠে বলল, “কথার স্কুল?”

আরশাদ হেসে ফেলে বলল, “আমি দিয়ে এসেছি।”

“ওর তো আজ একটা অ্যাসাইন্মেন্ট জমা দেওয়ার কথা। অ্যাসাইন্মেন্টটা ওর টেবিলের ওপরে…”

“আমি ব্যাগে দিয়ে দিয়েছি।”

অরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আরশাদের দিকে। তার দায়িত্বগুলো কী সুন্দর করে নিজের করে নিলো আরশাদ। কিছু বলে দেওয়ারও প্রয়োজন হলো না। ছেলেটা আসলে কী দিয়ে তৈরি?

অরাকে ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিলো আরশাদ। ওপরের তলার ঘরে থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হয় অরাকে। তাই বাবু আসার আগ পর্যন্ত তারা নিচতলার সবথেকে সুন্দর ঘরটায় থাকবে বলে ঠিক করলো। গোছগাছ সব স্টাফরাই করলো। অরার প্রয়োজনীয় জিনিস, ওষুধপত্র সব সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। অরাকে কিছুই করতে হলো না। আরশাদের কোলে চরে নিচতলায় নেমে এলো কেবল।

কিছুক্ষণ আরশাদের হাত ধরে বাগানে হাঁটাহাঁটি করলো অরা। কাল সারাটাদিন ঘরের মধ্যে অবরুদ্ধ থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে সে।
আজ অনেক ভালো লাগছে। ভালো লাগার আসল কারণ অবশ্য আরশাদ। সে পাশে আছে বলেই আজ আর অস্থির লাগছে না।

বাগান থেকে ঘরে ফিরে অরা গোসলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

আরশাদ দুষ্টুমির ছলে বলল, “গোসলে আমার হেল্প লাগলে বলতে পারো।”

অরা লজ্জায় লাল হয়ে বলল, “শখ কত!”

আরশাদ বাঁকা হাসি হেসে বলল, “বউকে গোসল করিয়ে দেওয়ার শখ সব পুরুষেরই থাকে, বুঝেছো।”

লজ্জায় এলোমেলো হয়ে অরা হেসে বলল, “সরো তো, অসভ্য!”

আরশাদের শখ অপূর্ণ রেখে অরা নিজেই গোসল করে বেরিয়ে এলো। ঠিকমত চুল মোছেনি বলে পিছের কাছে জামাটা একেবারে ভিজে গেছে। অগ্যতা আরশাদ তাকে বাধ্য করলো এটা খুলে আরেকটা জামা পড়তে। যদিও এটাকে আরশাদের অসভ্যতার অংশ বলে মনে করলো অরা।

কথা স্কুল থেকে ফিরে এলে তিনজন একসাথে গল্প করলো। কথা তার স্কুলের বন্ধুদের কাছে না-কি একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে তার অনাগত ভাই বা বোনের গল্প করেছে। গল্প পর্ব শেষে তারা লাঞ্চও করলো একসঙ্গে।

তিনটার দিকে কথার আর্ট ক্লাস রয়েছে। কয়েকদিন হলো নতুন আর্ট ক্লাসে ভর্তি হয়েছে সে। যদিও কথা যথেষ্ট ভালো আঁকে। আঁকার চর্চাটা নিয়মিত রাখার জন্যেই আরশাদ আর অরার এখানে ভর্তি করিয়েছে তাকে। একই সময়ে ডক্টরের সঙ্গে অরার অ্যাপয়েনমেন্ট রয়েছে।

কথা আর পায়েলকে আর্ট ক্লাসে নামিয়ে দিয়ে আরশাদ অরাকে নিয়ে গেল হসপিটালে। ডক্টর বাবুর চেকআপ করে জানালেন, বাবু একদম সুস্থ আছে। অরার অসুস্থতাগুলোও প্রেগন্যান্সির এই সময়ের প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিক। তবে বরাবরের মতোই অরাকে চাপমুক্ত থাকার পরামর্শ দিলেন ডক্টর নাসরিন।

ফেরার পথে হঠাৎ আরশাদের ফোনটা বেজে উঠলো। অরা দেখলো স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে কে ফিল্মসের ফাইন্যান্স টিমের হেড রিয়াজের নাম।

বিরক্ত ভঙ্গিতে কল রিসিভ করলো আরশাদ। ওপাশের কথা শোনা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর বিরক্ত স্বরে আরশাদ বলল, “মানে?”

অপরপ্রান্ত থেকে আবারও কী যেন বলছে রিয়াজ। আরশাদ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “ম্যামের তো ফোন ধরার কথাও না। লিভে থাকা একটা মানুষকে বারবার বিরক্ত করো কেন তোমরা?”

আবারও কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। অরা বুঝতে পারছে, কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। সেই সমস্যা সমাধানের জন্যে রিয়াজ অরাকে ফোন করেছিল। অরার ফোনটা হ্যান্ডব্যাগের ভেতরে থাকায় সে শুনতে পায়নি। তাকে না পেয়েই হয়তো কল করেছে আরশাদকে।

আরশাদ ধমকের সুরে বলল, “না আমি পারবো না। নিজেরা ঝামেলা করেছো, এখন নিজেরাই এর সমাধান করো।”

ফোন রেখে ড্রাইভিংয়ে মনযোগ দিলো আরশাদ। অরা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “কী হয়েছে?”

“আবারও বাজেট নিয়ে সমস্যা। দেড় কোটির জায়গায় তিন কোটির বাজেট করে বসে আছে। ডিরেক্টর এই বাজেট দেখে বিগড়ে গেছে। এখন বলছে তিনের নিচে তার সিনেমা বানানোই যাবে না।”

“কোন ডিরেক্টর?”

“ফয়সাল।”

অরা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “আরশাদ, আমার মনে হয় তোমার যাওয়া উচিত। ফয়সাল সাহেবের সিনেমায় দেড় কোটি দিতেও আমি রাজি হইনি। এক কোটি ত্রিশের বাজেট করতে বলেছিলাম। উনি অনেক রিয়েকুয়েস্ট করে বিশ লাখ বাড়িয়েছে। কিন্তু এর বেশি যাওয়া তো সম্ভব না। তিন কোটির তো প্রশ্নই ওঠে না!”

আরশাদ কী যেন চিন্তা করে বলল, “কিন্তু তোমাকে একা রেখে তো যেতে ইচ্ছা করছে না।”

অরা হেসে বলল, “কিছুক্ষণেরই তো ব্যাপার। ঘন্টাখানেক পরেই তো চলে আসবে।”

আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “মাঝেমাঝে ইচ্ছা করে কী জানো?”

“কী?”

আরশাদ মজার ছলে বলল, “মাঝরাতে চুপি চুপি অ্যাটম বোম দিয়ে কে ফিল্মসকে উড়িয়ে ফেলতে। এই বদটাই আমার বউকে আমার কাছ দূরে রাখে।”

অরা খিলখিল করে বলল, “চেষ্টা করে দেখো না! হাতও দিতে দেবো না তোমাকে!”

দুজনের এই মিষ্টি খুনসুটির মাঝেই গাড়ি এসে থামলো বাড়ির সামনে। আরশাদ নেমে গিয়ে, হাত ধরে নামালো অরাকে।

বাড়ি পর্যন্ত রেখে আসতে চাইলে অরা বলল, “আমি একটু বাগানে বসবো। তারপর ঘরে যাবো।”

আরশাদ অরার দুটো হাত ধরে মোহনীয় কণ্ঠে বলল, “আচ্ছা। সাবধানে থেকো, এক্ষনি চলে আসবো আমি।”

এক মুহূর্তের জন্যে ভালোবাসাময় দৃষ্টি আদান-প্রদান করলো আরশাদ আর অরা। অথচ তারা কেউই জানতো না, মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে এলোমেলো হয়ে যাবে সবটা।

গাড়িতে উঠে আরশাদ রওনা দিলো কে ফিল্মসের অফিসের উদ্দেশ্যে। অরা ছোট ছোট পা ফেলে বাগানজুড়ে হাঁটছে। শরীরটা আজ বেশ ফুরফুরে লাগছে। হাঁটাচলা করতেও খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না। কিছুক্ষণ সুইমিং পুলের পাশে বসে রইলো। ক্লান্ত হয়ে যখন ঘরে ফিরে যাবে তখন অরা হঠাৎ লক্ষ্য করলো বাগানের এক কোণে দুজন স্টাফ আরশাদের কালো পাজেরো গাড়িটা ধুতে ব্যস্ত।

এই গাড়িটাই সচরাচর শুটিংয়ে নিয়ে যায় আরশাদ। তার চারটা গাড়ির মধ্যে সবথেকে বেশি ব্যবহৃত হয় এই কালো পাজেরো। কাল এটাই শুটিংয়ে নিয়ে গিয়েছিল আরশাদ। উৎসাহ নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল অরা। কাছে যেতেই দেখলো আরেকজন স্টাফ গাড়ির ভেতর থেকে আরশাদের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বের করতে ব্যস্ত।

জিনিসগুলো একে একে বের করে সে একটা টেবিলের ওপরে রাখছে। হঠাৎ তার হাতে এলো একটা কালো লেদার জ্যাকেট। কাল রাতে আরশাদ গাড়িতেই জ্যাকেটটা ফেলে গিয়েছিল।

অরা এগিয়ে গিয়ে বলল, “আমাকে দাও, আমি নিয়ে যাচ্ছি।”

স্টাফ বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল, “সমস্যা নেই ম্যাম। আমিই রেখে যাবো।”

“আহা আমি তো ভেতরেই যাচ্ছি, দাও আমাকে।”

অরার আরশাদের জ্যাকেটটা নিয়ে ঘরের ভেতরে এসে পড়লো। ওই ছেলেটার কাছ থেকে জ্যাকেটটা এভাবে কেড়ে নেওয়ার কারণ একটাই – আরশাদের গায়ের গন্ধ নেওয়া। কী অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে রেখেছে আরশাদ অরাকে! যখন চোখের সামনে থাকে, তখন কেবল তাকেই দেখতে ইচ্ছা হয়। সামনে না থাকলেও কোনো না কোনো অজুহাতে তাকে স্পর্শ করতে ইচ্ছে হয়।

চোখ বন্ধ করে জ্যাকেটের গন্ধ নিতেই বরফের ন্যায় জমে গেল অরা। আরশাদের গায়ের গন্ধ পাচ্ছে ঠিকই। যে গন্ধ তার অস্তিত্বে মিশে আছে। তবে তার সঙ্গে ভেসে আসছে আরও একটা গন্ধ, পারফিউমের গন্ধ। না, আরশাদের পারফিউম নয়। মেয়েদের পারফিউম। কোন মেয়ের পারফিউম তাও অরা জানে।

“বাহ্! তোমার পারফিউমটা তো দারুণ। বিদেশী?”

“না, না! খাঁটি বাংলাদেশী!”

মনে পড়ে গেল সেদিনের কথোপকথন। সুজানা এই পারফিউমটাই ব্যবহার করে। আর এখন আরশাদের জ্যাকেটে তারই সুঘ্রাণ। অরা হন্তদন্ত হয়ে জ্যাকেটের ভেতরটা দেখলো। রূপালী রঙয়ের কেমন জরির মতো পদার্থ ছড়িয়ে আছে ভেতরের দিকটায়।

অরার কী যেন হলো। পাগলের মতো ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলো। ফেসবুকে ঢুকে খুঁজে বেড়ালো গতকালের ছবি। শুটিং সেটের পর কেক কাটা পর্বের ছবি।

ওই তো দেখা যাচ্ছে আরশাদকে। তার পরনে সাদা টি শার্ট আর এই জ্যাকেট। আর সুজানার পরনের রূপালী রঙয়ের একটা টপস। যার পুরোটাই জরিওয়ালা পদার্থে ঘেরা। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাচ্ছে অরা। সবটাই তার কাছে জলের মতো পরিষ্কার।

রাগে, অবিশ্বাসে তার চোখ ছলছল করছে। পৃথিবীটা ঘুরপাক খাচ্ছে চোখে সামনে। চুনোপুটি নিউজ পোর্টালদের নিউজ মিথ্যা নয় তাহলে?

(চলবে)