#ফিরে_আসা২
৬৭+৬৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
বাড়ি থেকে হসপিটালের পথটুকুতেই কাহিল হয়ে পড়লো অরা। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা সহ্য করলো পুরোটা সময়। ক্রমেই ব্যাথার তীব্রতা বেড়েই চলেছে। গাড়ি হসপিটালের গ্যারেজে এসে থামতেই হইচই পড়ে গেল চারিদিকে। আরশাদ হকের স্ত্রী লেবার পেইন নিয়ে এসেছে বলে কথা। আগে থেকেই হুইল চেয়ার প্রস্তুত ছিল। গাড়ি থেকে নামতেই অরাকে বসানো হলো সেখানে। হুইল চেয়ার ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব কাউকে না দিয়ে আরশাদ নিজেই ঠেলে নিয়ে গেল লিফটের কাছে।
সাত তলায় হসপিটালের ভিআইপি এরিয়া। সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার নেই এখানে। এখানেই অরাকে আনা হলো প্রাথমিক এক্সামিনেশনের জন্যে। বাইরে বসে চিন্তায়-চিন্তায় অতিষ্ট হয়ে উঠছে আরশাদ। একেকটা মুহূর্ত হয়ে উঠছে একেক বছরের সমান। মেয়েটা মারাত্মক কষ্টে আছে। কখন হবে এই কষ্টের অবসান?
আশফিয়া আর সেলিনা হক এই হসপিটালেই এসেছিলেন। খবর পেয়ে অ্যাপয়েনমেন্ট ফেলে রেখে ছুটে এলেন সাত তলায়। ঝড়-তুফান এতক্ষণ এখানেই ছিল। আরশাদ এসেছে খবর পেয়ে উৎসুক সাংবাদিকরা ভীড় করেছে হসপিটালের বাইরে। সাধারণ রোগীদের অসুবিধা হচ্ছে তাদের কারণে। ঝড়-তুফান তাই গেছে তাদের সামলাতে।
ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে কপালে ঠেকিয়ে রেখেছে আরশাদ। দুশ্চিন্তায় পা দুটো থরথর করে কাঁপছে। গলা শুকিয়ে আসছে। হঠাৎ কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন ডক্টর নাসরিন। তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালো আরশাদ। আশফিয়া এবং সেলিনা হকও উঠে দাঁড়ালেন।
ডক্টর নাসরিন এগিয়ে এসে চিন্তিত গলায় বললেন, “ডাইলেশন এখনো শুরু হয়নি। আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের কিছুই করার নেই।”
শীতল স্রোত বয়ে গেল আরশাদের গা বেয়ে। যে ভয়টা সে পাচ্ছিল সেটাই সত্যি হলো। একজন নারীর সারভিক্স ১০ সেন্টিমিটার প্রসারিত না হলে তার পক্ষে সন্তান প্রসব করা সম্ভব হয় না। লেবার শুরু হওয়ার আগেই কোনো কোনো সময় এই প্রসারণ শুরু হয়ে যাবে। কোনো কোনো সময় আবার লেবার শুরু হওয়ার অনেক পরেও প্রসারণ শুরু হয় না। অরার ভাগ্যটাই কেন এমন হলো? বসে বসে ওই ভয়ানক ব্যাথা সহ্য করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার?
আরশাদ চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কম্পিত কণ্ঠে বলল, “কতটা সময় লাগতে পারে?”
“ডক্টর হিসেবে আমার মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া উচিত নয় মিস্টার হক। সত্যিটা হলো, নতুন মায়েদের ক্ষেত্রে পুরোপুরি ডাইলেশন হতে আঠারো থেকে চব্বিশ ঘন্টা সময় লাগাটা স্বাভাবিক। হ্যাঁ তবে এর কম-বেশিও হতে পারে।”
আবারও চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরা। একটা মানুষ আঠারো থেকে চব্বিশ ঘন্টা ওই অমানবিক ব্যাথা সহ্য করবে? আর সেটাই না-কি স্বাভাবিক?
আরশাদ ক্ষীণ গলায় বলল, “আমি যেতে পারি ওর কাছে?”
“জি অবশ্যই! ডেলিভারির আগ পর্যন্ত উনার কাছে থাকতে হবে আপনাকে। একটা মেয়ের জন্য এই সময়টা অনেক কঠিন। আপনি পাশে থাকলে আপু সাহস পাবে।”
ডক্টর নাসরিন চলে যেতেই আশফিয়া ভাইয়ের কাঁধে ভরসার হাত রেখে বলল, “টেনশন করিস না। অরার কাছে যা, ওর এখন তোকে দরকার।”
আরশাদ হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলল, “তুমি কথাকে আর্ট ক্লাস থেকে পিক করে, মাকে আর ওকে বাসায় রেখে এসো।”
সেলিনা বেগম বাঁধ সেধে বলল, “না, না! আমি থাকবো।”
আরশাদ শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “থেকে কী করবে মা? শুনলে তো ডক্টর কী বলল। ডেলিভারির আগেই আবার আপা গিয়ে তোমাদের নিয়ে আসবে। বেশিক্ষণ হসপিটালে থাকলে শরীর খারাপ করবে।”
এই কঠিন পরিস্থিতি যেন নতুন করে আরশাদকে দায়িত্ব নিতে শেখাচ্ছে। চারপাশের সবার কথা ভাবতে শেখাচ্ছে। সেলিনা হক ছেলের কথামতো বেরিয়ে পড়লেন আশফিয়ার সঙ্গে।
লম্বা শ্বাস নিয়ে কেবিনের দরজা খুলল আরশাদ। আবছা আলোয় ছেয়ে আছে পুরো কেবিন। অরাকে এক পলক দেখতেই শিউরে উঠলো আরশাদ। নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে মেয়েটা। তার বুকের সঙ্গে একগাদা তার আটকে হয়েছে। হাতে সেলাইয়ের ক্যানোল। পেটের সঙ্গে একটা বেল্ট দিয়ে তার জাতীয়ও কী যেন আটকে রাখা। অরার চোখমুখ রক্তশূন্য হয়ে উঠেছে। ঠোঁট ফেটে চৌচির হয়ে আছে। চোখদুটো বুজে মলিনভাবে পড়ে আছে সে।
বেডের পাশে স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে অরার ব্লাড প্রেসার, হার্ট বিট। আরেকটা স্ক্রিনে ভেসে উঠছে বাবুর হার্টবিট। আরশাদ একটু একটু করে এগিয়ে গেল তার দিকে। অরার কাছে ঝুঁকে তার কপালে যত্নের চুমু খেলো আরশাদ।
সঙ্গে সঙ্গে অরা চোখ মেলে তাকিয়ে দুর্বল গলায় বলল, “আরশাদ! এসেছো তুমি?”
আরশাদ অরার কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম স্বরে বলল, “ভয় করছিল একা একা?”
অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “হুঁ।”
আরশাদ আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আমি চলে এসেছি না? আর কোনো ভয় নেই।”
অরা লম্বা শ্বাস নিতে নিতে বলল, “আমার হাতটা ধরো প্লিজ।”
এক মুহূর্তের জন্যে আরশাদের মনে পড়ে গেল রাঙামাটিতে সেই যাদুকরী সন্ধ্যার কথা। যে সন্ধ্যায় সাদা শাড়ি পড়ে অরা এসেছিল তার সামনে। যে সন্ধ্যায় ওই কটেজের সামনের দিকটা মোমের আলোয় রাঙিয়ে আরশাদ তার মনের কথাটা জানিয়েছিল অরাকে। সেদিন অরার কাছ থেকেই কিছুই চায়নি আরশাদ। চেয়েছিল যেন অরা তার হাতটা শুধু ধরুক।
ঠিক এভাবেই বলেছিল, “আমার হাতটা ধরো প্লিজ।”
আরশাদ শক্ত করে অরার একটা হাত ধরলো। তার এই সামান্য স্পর্শেই অরার ভয় একটু একটু করে কাটতে শুরু করেছে। যন্ত্রণাটা আছে ঠিকই, তবে আর গায়ে লাগছে না আগের মতো।
একটু পর পর ব্যাথা উঠছে অরার। পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে। শক্ত হয়ে আসছে পেট। প্রত্যেকবার নিজেকে সামলে নিচ্ছে অরা। নীরবে ব্যাথা সহ্য করে যাচ্ছে বারবার।
অরা বাচ্চাদের মতো বলে উঠলো, “আর কোথাও যেও না।”
আরশাদ তাকে দৃঢ়কণ্ঠে আশ্বাস দিয়ে বলল, “কোত্থাও যাবো না অরা। আমি তোমার কাছেই থাকবো।”
বেডের পাশে থাকা চেয়ারে বসে আরশাদ অরার কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আরেকটা হাতে শক্ত করে ধরে আছে তার হাত। সহ্য হচ্ছে না মেয়েটার যন্ত্রণা। আর মাত্র কয়েক ঘন্টার পরই সকল যন্ত্রণার অবসান। এই ভেবে নিজেকে স্বান্তনা দিচ্ছে সে।
অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “কথা? কথাকে আর্ট ক্লাস থেকে এনেছো?”
ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটে। এই মেয়েটা যত দেখে ততই মুগ্ধ হয়ে যায় সে। এত কঠিন পরিস্থিতিতেও কথার কথা মনে রাখতে ভুল করলো না সে।
আরশাদ শান্ত গলায় বলল, “হ্যাঁ বাবা! আপা কথাকে আর মাকে বাসায় দিয়ে আসতে গেছে।”
অরা হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলল, “বাবু কি আজ আসবে না?”
ডক্টর নাসরিন পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছে তাকে। অরার কাছেও তাই অজানা নেই, দীর্ঘ সময় এই ব্যাথা সহ্য করতে চলেছে সে।
আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝতে পারছি না অরা। ডক্টর তো বলল তোমার ডাইলেশন শুরুই হয়নি এখনো। দুই ঘন্টা পর আবারও চেকআপ করতে আসবে। দেখি তখন কী বলে।”
আরশাদের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই আবারও তীব্র ব্যাথা উঠলো অরার। এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে অস্ফুটস্বরে আওয়াজ করলো অরা, “উফ!”
আরশাদ দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে বলল, “কী হলো অরা? ব্যাথা করছে অনেক?”
অরা লম্বা শ্বাস নিতে নিতে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “অসম্ভব! তুমি যদি এখন আমার শরীরে একশটা সুই ফুটিয়ে দাও, তাও আমি ব্যাথা পাবো না।”
“তুমি অনেক স্ট্রং অরা। আমার জীবনে দেখা সবথেকে স্ট্রং মানুষটা তুমি।”
আর কিছু কিছু মানুষের মতো মেয়েদের কোনো ক্ষমতাই নেই। তারা পৃথিবীতে আসেই শুধু বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্যে। সেই ‘শুধু বাচ্চা জন্ম দেওয়া’ যে কতটা দুঃসাধ্য কাজ, যদি তারা জানতো! ভুলেই আর নারীর শক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলতো না।
নার্স একটু পর পর এসে চেক করে যাচ্ছে অরার ব্লাড প্রেসার, হার্ট বিট, বাবুর হার্ট বিট। ডক্টর নাসরিন নিজেও এলেন দুবার। সবশেষে দুই ঘণ্টা পর ডক্টর নাসরিনসহ আরও দুজন ডক্টর এলেন। সেই সঙ্গে বেশ কয়েকজন নার্স। অরাকে পরীক্ষা করা হবে। তাই আরশাদকে বাইরে যেতে হলো।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বেরিয়ে এসে ডক্টর নাসরিন হাসি হাসি মুখে বললেন, “এক সেন্টিমিটার ডাইলেশন হয়েছে!”
আরশাদ ভেবে পাচ্ছে না এই তথ্যে তার খুশি হওয়া উচিত না-কি হতাশ। একটা মানুষ এতক্ষণ ধরে কষ্ট সহ্য করার পর মাত্র ১ সেন্টিমিটার প্রসারণ? তাও ভালো প্রসারণ শুরু হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ২৪ ঘন্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও শুরু হয় না ডাইলেশন।
আবারও অরার কাছে এসে বসলো আরশাদ। সেই একইভাবে, তার হাত ধরে রেখেছে। ব্যাথায় রীতিমত অবশ হয়ে উঠেছে অরার সমস্ত শরীর। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে প্রচন্ড। শ্বাস-প্রশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। ভাগ্যিস সাথে করে চুইং গাম নিয়ে এসেছিল আরশাদ। চুইং গামের কারণে শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্টটা একটু হলেও সামলে নেওয়া যাচ্ছে।
অরা জড়ানো গলায় ডাকলো, “আরশাদ?”
আরশাদ আদুরে গলায় বলল, “হুঁ?”
অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আমার চুলের মুঠি টেনে ধরতে পারবে?”
আরশাদ হতভম্ব হয়ে বলল, “কী?”
অরা ছেলেমানুষী ভঙ্গিতে বলল, “দাও না!”
আরশাদ অরার কথা মতো আলতোভাবে টেনে ধরলো তার চুলের মুঠি।
অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “এভাবে না তো!”
“তাহলে?”
“জোরে টেনে ধরো!”
আরশাদ চিন্তিত স্বরে বলল, “তুমি ব্যাথা পাবে তো অরা।”
অরা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “সেটাই তো চাই। ব্যাথা দাও আমাকে।”
আরশাদ সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিলো, “আমি তোমাকে ব্যাথা দিতে পারবো না।”
“প্লিজ আরশাদ! তুমি আমাকে কমফোর্ট দিতে চাও না?”
“চাই তো!”
অরা অসহায় গলায় বলল, “কমফোর্ট দিতে হলে ব্যাথা দিতে হবে। আমি এই ব্যাথা আর সহ্য করতে পারছি না। অন্য কোথাও ব্যাথা দাও।”
এই ব্যাথা থেকে মুক্তির জন্যে আর কতটা অপেক্ষা করতে হবে মেয়েটাকে? আরশাদ অনিচ্ছা সত্ত্বেও সজোরে টেনে ধরলো অরার চুলের মুঠি। অরাকে কখনো শারিরীক আঘাত করেনি সে। কাজটা করার সময় তার কষ্টও হলো প্রচুর। তবে আঘাত পেলেই যদি অরার ভালো লাগে, তবে কী আর করা?
অরা চোখদুটো বুজে রেখে বলল, “এবার ভালো লাগছে!”
৮ ঘন্টা কেটে গেল। প্রসারণের মাত্রা হতাশাজনক। মাত্র ৩ সেন্টিমিটার প্রসারণ হয়েছে এতক্ষণে। আর এদিকে অরার ব্যাথা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে কাটালেও আর সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে।
অরা আর্তনাদ করে বলল, “আরশাদ আমি আর পারছি না!”
ধ্বক করে কেঁপে উঠলো আরশাদের বুকটা। মেয়েটা এতক্ষণ নীরবে যন্ত্রণা সহ্য করেছে। আর সহ্য করতে না পেরে বলে উঠলো কথাটা।
না জানি কতটা তীব্র হয়েছে তার ব্যাথা।
আরশাদ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “দাঁড়াও আমি ডক্টরকে ডাকছি!”
অরা আরশাদের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলল, “না! তুমি যেও না!
আরশাদ কোমল স্বরে বলল, “এরকম করে না অরা। তুমি লক্ষ্মী মেয়ে না? ডক্টর না এলে…”
কথাটা শেষ করতে পারলো না আরশাদ। ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে চিৎকার করলো অরা। আরশাদ আর এক মুহুর্তও দেরি না করে অরার হাতটা ছাড়িয়ে ডাকলো ডক্টর নাসরিনকে।
অরাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। দুশ্চিন্তায় দিশেহারা হয়ে কেবিনের সামনে পায়চারি করছে আরশাদ। কেবিনের ভেতর থেকে একটু পর পর ভেসে আসছে অরার আর্তনাদ এবং চিৎকার। তার একেকটা চিৎকার যেন তীক্ষ্ণ শূলের মতো এসে বিঁধছে আরশাদের বুকে।
বেশ অনেকটা সময় পর বেরিয়ে এসে ডক্টর নাসরিন উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, “ডাইলেশনের এখনো অনেক বাকি। এদিকে ব্যাথাটাও বেড়ে যাচ্ছে। আমরা আপুকে এপিডিউরাল দিতে চাচ্ছি।”
এপিডিউরাল সমন্ধে এর আগেও ডক্টর নাসরিন জানিয়েছিলেন আরশাদ আর অরাকে। অ্যানালজেসিক ও অ্যানাস্থেটিক দু’য়ের মিশ্রণে তৈরি হয় এপিডিউরাল। এটি ব্যাথার অনুভূতি মস্তিষ্কে যেতে বাধা দেয়। খুব প্রয়োজন না হলে এর ব্যবহার করতে চাননি ডক্টর নাসরিন। কারণ এপিডিউরালের কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও রয়েছে।
আরশাদ চিন্তিত গলায় বলল, “অরার কোনো সমস্যা হবে না তো?”
“আশা করি বড় ধরনের কোনো সমস্যা হবে না। তবে এটা ছাড়া এখন আর কোনো উপায় নেই।”
কেবিনের চাকাওয়ালা বেডটা ঠেলেই অরাকে নিয়ে যাওয়া হলো অ্যানেসথেসিয়া রুমে। এখানেই তাকে এপিডিউরাল দেওয়া হবে। ব্যাথায় এতটাই ডুবে ছিল অরা, যে কোনো ভয়ই কাজ করলো না তার মাঝে। অনেকটা সময় লাগলো এখানে। পুরোটা সময়ই আরশাদ কাটিয়ে দিলো দুশ্চিন্তার মাঝে।
রাত আড়াইটার দিকে অরাকে ফিরিয়ে আনা হলো তার কেবিনে। ডক্টর নাসরিন তাকে আপেলের জুস খাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। আরশাদ কেবিনে প্রবেশ করতেই দেখলো শুয়ে শুয়ে স্ট্রতে মুখ দিয়ে বাচ্চাদের মতো জুস খাচ্ছে অরা। হাজার দুশ্চিন্তার মাঝেও ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটে। অরার চোখেমুখে ক্লান্তির প্রবল ছাপ থাকলেও, দুর্বলতা আর নেই।
আরশাদ এগিয়ে যেতেই দেখলো, অরার হাতে একটা সিরিঞ্জ পুশ করে রাখা। একটু একটু করে তার শরীরে যাচ্ছে এপিডিউরাল।
আরশাদ অরার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “এখন ভালো লাগছে?”
অরা জুস খাওয়া স্থগিত রেখে বলল, “হুঁ।”
“ব্যাথা করছে না সিরিঞ্জটার জন্য?”
“না! বরং ভালো লাগছে। বললাম না, ব্যাথা পেতে এখন ভালো লাগে।”
আরশাদ অরার গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম অনেক।”
অরা দুর্বলভাবে আরশাদের হাত স্পর্শ করে বলল, “আমি ঠিক আছি এখন। কেন যে এই জিনিস আগে দিলো না?”
আগে কেন দেওয়া হলো না, সেটা কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেলো আরশাদ আর অরা। পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় থরথর করে কাঁপছে অরা। মৃদু জ্বরও আসছে শুরু করেছে। ডক্টরের টিম কঠিন পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখলো অরাকে।
ব্যাথা এখন আর আগের মতো অনুভব না হলো, পেটের সংকোচন ঠিকই টের পাচ্ছে সে। সেই সঙ্গে শরীরের মাঝে স্থায়ীভাবে লেগে আছে বিচিত্র এক ক্লান্তি।
রাতটা আধ ঘুম আধ জাগরণের মধ্যে কাটিয়ে দিলো অরা। সকালের চেকআপের পর জানা গেল ৭ সেন্টিমিটার ডাইলেট করে ফেলেছে অরা। আর মাত্র কিছুক্ষণের অপেক্ষা! উৎসাহ আর উত্তেজনায় দুজনেই উসখুশ করছে।
অরা আধশোয়া হয়ে রয়েছে বেডের ওপরে। বেডের ওপরে অংশটা আর সুবিধার জন্যে তুলে রাখা হয়েছে রিমোটের সাহায্যে। আরশাদ তার পাশেই আছে বরাবরের মতো।
আরশাদ হঠাৎ অন্যরকম গলায় বলল, “জানো অরা? স্বপ্নের মতো লাগছে সবটা।”
অরা কিছুই বলল না। আগ্রহভরা চোখে তাকালো আরশাদের দিকে। আরও কিছু শোনার অপেক্ষায়।
আরশাদ আবারও বলল, “কাল থেকে বারবার মনে পড়ছে আমাদের শুরুর দিনগুলোর কথা। যখন তুমি আমার ম্যানেজার ছিলে। কখনো কি ভাবতেও পেরেছিলাম, যে মেয়েটাকে সারাক্ষণ বকাঝকা করি, তার সঙ্গে এত সুন্দর একটা অভিজ্ঞতা পাবো।”
অরা মিষ্টি হেসে বলল, “আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না। জানো? এখনো মাঝে মাঝে সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন তোমাকে পাশে দেখি, থতমত খেয়ে যাই। ভাবতে থাকি, আমি এতক্ষণ আমার বসের পাশে ঘুমাচ্ছিলাম?”
অরার এমন কথায় হেসে ফেলল আরশাদ।
অরা আবারও হাসি হাসি গলায় বলল, “আর এখন সেই বসের বাচ্চার মা হতে যাচ্ছি!”
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “কথাটা ঠিক হলো না।”
“মানে?”
“তুমি আমার বাচ্চার মা হবে না। আমি তোমার বাচ্চার বাবা হবো।”
মুখে হাসি থাকা সত্বেও চোখে জল চলে এলো অরার। এই মানুষটার ভালোবাসা যেন কোনো শিল্পীর হাতে গড়া নিপুণ কারুকার্য। এতটা ভালোবাসায় এখনো পাগল না হয়ে কী করে টিকে আছে অরা?
অরার স্বাভাবিকতা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। আবারও ফিরে আসতে শুরু করেছে সেই তীব্র ব্যাথা। অদ্ভুত ব্যাপার! এতক্ষণ তো কোনো ব্যাথাই অনুভব করতে পারছিল না সে। ডক্টর পরীক্ষা করে দেখলেন, এপিডিউরাল কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কোনো মানে হয়? মেয়েটার শান্তি কি কোনোকালেই সহ্য হবে না প্রকৃতির?
এপিডিউরালের ডোজ বাড়িয়ে দেওয়া যায়, তবে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার ভয়ে সেটা থেকে আপাতত বিরত থাকলো ডক্টরেরা। ব্যথার তীব্রতা বেড়ে গেলে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
ব্যাথা আবারও বেড়ে যাওয়ার কারণে চোখ বুজে শুয়ে আছে অরা। এবার ব্যাথার তীব্রতা যেন একটু বেশিই। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে অরা। তরতর করে ঘামছে সে। আরশাদ পাশে বসে রুমাল দিয়ে মুছে দিচ্ছে তার ঘাম।
অরা ক্লান্ত গলায় বলল, “কতক্ষণ হলো?”
আরশাদ ঘড়ি দেখে বলল, “উনিশ ঘন্টা।”
অরা থমথমে গলায় বলল, “অথচ নাটক-সিনেমায় কী দেখায়? নায়িকার লেবার পেইন ওঠে, নায়ক তাড়াহুড়ো করে হসপিটালে নিয়ে যায়। সাথে সাথে নায়িকাকে ডেলিভারি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ডক্টর বাবুকে নিয়ে এসে বলে, কংগ্রাচুলেসনস!”
আরশাদ হেসে ফেলল অরার এই শিশুসুলভ কথায়।
অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “হাসছো? তোমার সিনেমাতেও এমন দেখানো হয়।”
আরশাদ হাসি নিয়ন্ত্রণে এনে বলল, “ওটাও তো ভুল না অরা। মানুষ কম সময়ের মধ্যেও ডেলিভারি করতে পারে।”
“বুঝলাম। আপাকে ফোন করে বলেছো মা আর কথাকে নিয়ে আসতে?”
“ওহ! ভুলেই গিয়েছিলাম।”
অরা হতাশ গলায় বলল, “কী হবে তোমার আমি না থাকলে?”
আরশাদ তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “না থাকার প্রশ্ন উঠছে কেন?”
অরা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই বলল, “না মানে, ধরো ডেলিভারির সময়ে খারাপ কিছু হলো আর আমি মরে-টরে গেলাম…”
অরাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আরশাদ প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে বলল, “তোমার হাত-পা ভেঙে গলায় ঝুলিয়ে রাখবো বেয়াদব মেয়ে!”
হৃদস্পন্দন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল অরার মুখে কথাটা শুনে। মেয়েটা জেনেবুঝে কেন আরশাদকে এমন কথা বলে কে জানে? নিজেকে মুহূর্তেই সামলে নিয়ে আরশাদ দেখলো গোমড়া মুখে চোখ বুজছে অরা। তার মন খারাপ আরও একদফা এলোমেলো করে দিয়ে গেল আরশাদের হৃদস্পন্দন।
আরশাদ তড়িৎ গতিতে এগিয়ে গিয়ে অরার গালে পরপর কতগুলো চুমু খেয়ে বলল, “সরি, সরি! কেন এমন বাজে কথা বলো অরা? কিচ্ছু হবে না তো তোমার।”
আশফিয়া, সেলিনা হক এবং কথা হসপিটালে এসে গেছে। অরার সঙ্গে তাদের দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। ওয়েটিং এরিয়ায় অপেক্ষা করছে তারা। অপেক্ষা কেবল একজনের জন্যেই।
ব্যাথায় কাহিল হয়ে বেডে পড়ে আছে অরা। চব্বিশ ঘন্টা হয়ে এসেছে প্রায় এই যন্ত্রণা একা হাতে সহ্য করছে সে। কিছুটা অধৈর্য্যও হয়ে পড়েছে ভেতরে ভেতরে। আরশাদ তার পাশে থেকে যথারীতি সাহস যোগাচ্ছে। ভাগ্যিস লেবারের এই পুরোটা সময় আরশাদ তার পাশে ছিল। না হলে একা একা কী করে এই কঠিন পথ পাড়ি দিতো মেয়েটা?
আচমকা আরশাদের চোখ পড়লো বেডের পাশে থাকা স্ক্রিনের দিকে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে হৃদস্পন্দন থেমে রইলো তার। অরার হার্টবিট আসছে ঠিকই, তবে বাবুর হার্টবিট আসছে না।
হিমবাহের মতো জমে রইলো আরশাদ। এতক্ষণ তো ঠিকই আসছিল বাবুর হার্টবিট। এখনো আসছে না কেন তাহলে? আরশাদ এখন কী করবে? দিশেহারা লাগছে কেমন। চোখের সামনে অন্ধকার দেখছে আরশাদ।
আরশাদ অরাকে কিছু না বলেই তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালো। অরা দুর্বল গলায় বলল, “কোথায় যাচ্ছো?”
আরশাদ ব্যস্ত গলায় বলল, “আসছি অরা!”
আরশাদ তড়িৎ গতিতে ডেকে আনলো ডক্টরকে। অস্থিরতাময় কয়েকটা মিনিট শেষে স্বস্তি ফিরে পেলো আরশাদ। বাবু ঠিক হার্টবিট নেওয়ার যন্ত্র কাজ করছে না বলেই হার্টবিট ভেসে উঠছিল না স্ক্রিনে। তবে স্বস্তি এক মুহুর্তও স্থায়ী হলো না। অরার ১০ সেন্টিমিটার ডাইলেশন শেষ হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে নিয়ে যাওয়া হবে ডেলিভারি রুমে।
অরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুজন নার্স তাকে ডেলিভারির পোশাক পড়িয়ে দিলো। তার এলোমেলো চুলগুলো সুন্দর করে বেণী করে দিলো। অরা বুঝতে পারছে, তাকে ডেলিভারি রুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
কিছুক্ষণ বাদে আরও কয়েকজন নার্স প্রবেশ করলো কেবিনে। তাদের সাথে আছেন ডক্টর নাসরিন।
ডক্টর নাসরিন হাসিমুখে বললেন, “আপু, আপনাকে ডেলিভারি রুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।”
তার বেড ঠেলে দরজার দিকে নিয়ে যাওয়া শুরু করতেই অরা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “মানে কী? আমি কোথাও যাবো না!”
ডক্টর নাসরিন অবাক গলায় বলল, “আপনাকে যেতে হবে তো আপু।”
অরা চিৎকার করে বলল, “না। আমি আরশাদের সাথে দেখা না করে কোথাও যাবো না।”
অগ্যতা দ্রুততার সঙ্গে ডাকা হলো আরশাদকে। আরশাদ এসেই ঘরভর্তি নার্স আর ডক্টরের সামনে জড়িয়ে ধরলো অরাকে। আরশাদের বুকে মাথা রেখে অশান্ত অরা নিমিষেই শান্ত হয়ে গেল।
আরশাদ অরার কানে ফিসফিস করে বলল, “ভয় করছে?”
যদিও প্রচন্ড ভয় করছে অরার। তবুও না-সূচক মাথা নাড়লো সে। তবে তার মনের আসল কথাটা ঠিকই বুঝে ফেলল তার ভালোবাসার মানুষটা।
আরশাদ দুই হাত অরার দুই কানের নিচে রেখে তার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “কোনো ভয় নেই অরা। আমি বাইরেই আছি।”
অরা ভীত গলায় বলল, “তুমি থাকবে তো?”
আরশাদ মোহনীয় হাসি হেসে বলল, “থাকবো তো! আর কোথায় যাবো আমি?”
অরাকে ডেলিভারি রুমে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে ভয়টা বেড়ে গেল আরশাদের। একা একা এই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি কী করে হবে মেয়েটা? যেভাবে সে ভয় পেয়ে গেছে, ডেলিভারির সময় যদি কোনো সমস্যা হয়?
না, না। এসব কী ভাবছে আরশাদ? কিচ্ছু হবে না অরার। সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে মেয়েটা ফিরে আসবে তার বুকে।
দুশ্চিন্তায় থরথর করে কাঁপছে আরশাদের হাত পা। কখনো অস্থির হয়ে পায়চারি করছে, কখনো বসে থেকে দুহাতে নিজের চুল নিজেই খামচে ধরছে।
আশফিয়া উৎফুল্ল গলায় বলল, “এই আরশাদ? ক্যামেরা কোন ব্যাগে?”
আরশাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “জানি না। খুঁজে নাও!”
আশফিয়া আরশাদের পাশে বসে কোমল স্বরে বলল, “আরশাদ? টেনশন হচ্ছে?”
আরশাদ অস্থির কণ্ঠে বলল, “আপা অরা অনেক ভয় পেয়েছে।”
আশফিয়া হাসিমুখে বলল, “ওই ঘরে আজ পর্যন্ত যতগুলো মেয়ে গেছে, সবাই ভয় পেয়েই গেছে।”
আরশাদ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “কিন্তু অরা তো সহজে ভয় পায় না আপা।”
“শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছিস। এত দুশ্চিন্তা করার কিছুই নেই।”
আরশাদ হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “আপা? তোমার মনে হয় না অরা বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্য এখনো অনেক ইয়াং।”
আশফিয়া অবাক গলায় বলল, “মানে?”
“মানে আমরা আরেকটু ওয়েট করলেই তো পারতাম।”
আশফিয়া হেসে ফেলে বলল, “এখন এসব ভাবার সময় গাধা?”
“জানি না।”
আশফিয়া উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে কথাকে ডাকলো। কথা একটু দূরেই বসে আছে তার দাদির সঙ্গে।
“এই কথা! তোর বাবা খুব ভয় পেয়ে আছে। বাবার কাছে এসে বসে থাক।”
কথা বাধ্য মেয়ের মতো আরশাদের গা ঘেঁষে বসে রইলো। কতটা সময় কেটে গেল কে জানে? ঘড়ি দেখতেই ভুলে গেছে আরশাদ। একটু একটু করে তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাসের গতিও কমে যাচ্ছে। বুকের ভেতরটায় বিচিত্রভাবে আকুলি-বিকুলি করছে। হৃদয়টা এত জোরে লাফালাফি করছে যে নিজের হৃষ্পন্দন নিজেই শুনছে পারছে আরশাদ।
বাড়ন্ত হৃদস্পন্দন, একরাশ দুশ্চিন্তা আর বুকভরা ভয় সবকিছুর একসঙ্গে অবসান ঘটলো, যখন ডেলিভারি রুমের দরজাটা খুলে গেল। এক লাফে উঠে দাঁড়ালো আরশাদ। ডক্টর নাসরিনকে দেখা যাচ্ছে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল আরশাদ অরার অবস্থা জানতে।
তবে মুহূর্তেই থমকে দাঁড়ালো, ডক্টর নাসরিনের কোলে আরও একজনকে দেখে। দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে আরশাদ ভুলেই গিয়েছিল, বিশেষ একটা মানুষের জন্যে অপেক্ষা করছে সে।
ডক্টর নাসরিন একটু একটু করে এগিয়ে আসছেন। কিন্তু আরশাদের অবাক চোখদুটো আটকে আছে তার দিকেই। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে তার রীতিমত। সাদা টাওয়ালে জড়ানো ছোট্ট একটা পদ্মফুল যেন চোখ বুজে আছে।
ডক্টর নাসরিন একদম আরশাদের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে বলল, “Congratulations, it’s a boy!”
আবারও কাঁটা দিয়ে উঠলো আরশাদের সমস্ত শরীর জুড়ে। থরথর করে কাঁপছে সে। এই পদ্মফুলের মতো স্নিগ্ধ শিশুটা তার? আরশাদ বুঝে উঠতে পারছে না তার কী করা উচিত।
পেছন থেকে ভেসে এলো আশফিয়ার ধমক, “কোলে নে গাধা কোথাকার!”
আরশাদ দু হাতে কোলে নিলো তার সন্তানকে। নিজের সন্তানকে প্রথমবারের মতো দেখাই হয়তো পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর মুহূর্ত। আরশাদের চোখে জল এসে গেল। সেই জল লুকানোর কোনো প্রচেষ্টাই নেই তার মাঝে। বাবুর মুখে পরপর কতগুলো চুমু যে সে দিলো!
কথা ফুপির কোলে উঠে উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে দেখলো তার ভাইকে। ভেবেছিল ভাই হলে হয়তো একটু মন খারাপ হবে তার। কিন্তু না! আনন্দের কোনো কমতি রইলো না কথার।
আরশাদ হঠাৎ ডক্টর নাসরিনের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন এবং কম্পিত স্বরে বলল, “অরা?”
“ডেলিভারির শেষের দিকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সে। এমনিতে ঠিক আছে। একটু পরেই বেডে দিয়ে দেওয়া হবে।”
অরা ঠিক আছে শুনে আরশাদের ধড়ফড় করতে থাকা হৃদয়টা যেন স্বস্তি পেলো।
সেলিনা হক বিজ্ঞ গলায় বললেন, “আরশাদ ছেলের কানে আজান দে।”
চোখে আনন্দের অশ্রু নিয়েই বাবুর কানে আজান দিলো আরশাদ। সুন্দর এই পৃথিবীতে আলো ছড়াতে যে এসেছে, সেও যেন কান পেতে শুনলো।
অরার জ্ঞান ফিরলো ঘন্টা দুয়েক পর। একটু একটু করে চোখ মেলে তাকাতেই চোখের সামনে সবটা আবছা দেখলো সে। সে কোথায় আছে মনে করতে কয়েক মুহূর্ত লাগলো।
অরার পর্যবেক্ষণে থাকা ডক্টর তার পাশেই ছিল।
তিনি মিষ্টি হেসে বললেন, “এখন কেমন লাগছে মিসেস হক?”
অরা ভাঙা গলায় বলল, “ভালো। আমার…”
কথাটা শেষ করার আগেই থেমে গেল অরা। কথা বলতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার।
ডক্টর আবারও মিষ্টি হেসে বললেন, “আমার ফুটফুটে একটা বাবু হয়েছে।”
চমকে চোখ বড় বড় করে তাকালো অরা। যেন সে জানতোই না তার বাবু আসবে।
অরা ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, “কোথায় ও?”
“উনি তার বাবার কাছে আছেন।”
অরা অস্থির হয়ে বলল, “আমি কি দেখবো না?”
“অবশ্যই দেখবেন। আমরা বাবুকে সবার আগে মাকেই দেখাই। কিন্তু আপনি তো ডেলিভারির সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। তাই বাবুর বাবাকে দেখানো হয়েছে।”
বাবুকে আগে দেখতে না পারার কোনো আক্ষেপ নেই অরার মাঝে। বরং আরশাদ তাকে আগে দেখেছে বলে বেশি আনন্দ হচ্ছে। আরশাদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল বাবুকে দেখার পর? আচ্ছা? তার ছেলে হয়েছে না-কি মেয়ে? ডক্টর তো এটা বলল না! নিজেকে নিজেই হাজারটা প্রশ্ন করে অস্থির করে তুলছে অরা।
তার সমস্ত প্রশ্ন থমকে গেল যখন কেবিনের দরজাটা খুলে গেল। বাইরে থেকে আরেকজন খুলেছে দরজাটা। আরশাদের পক্ষে দরজা খুলে ভেতরে আসা সম্ভব নয়। কারণ তার হাতদুটো অন্য কাউকে ধরতে ব্যস্ত।
বাবুকে আরশাদের কোলে দেখে পাথরের মতো জমে রইলো অরা। কখনোই ভাবতেই পারেনি তাকে প্রথমবারের মতো বাবুকে দেখানোর মানুষটা হবে আরশাদ।
আরশাদ বাবুকে কোলে নিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে এসে বসলো অরার মুখোমুখি। অরার হতবিহ্বল চোখদুটো শুধু তার কোলের মধ্যে থাকা মানুষটাকেই দেখছে। এই ফুটফুটে মানুষটা এতটা তার পেটের মধ্যে ছিল? ভাবতেই অবাক লাগছে অরার। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে যাচ্ছে।
জল ভরে উঠেছে অরার চোখে। আরশাদের দিকে তাকাতেই অরা দেখলো, তার চোখেও খেলা করছে অশ্রুরা।
আরশাদ যাদুকরী কণ্ঠে বলল, “আমাদের ছেলে।”
অরার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে অবিরাম। দু হাতে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে সে। আনন্দের কান্না এতটা সুখময় হতে পারে? চব্বিশ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে সহ্য করা ওই যন্ত্রণাগুলো এই ভয়ঙ্কর আনন্দের কাছে ফিকে হয়ে গেল।
আরশাদ আর্দ্র গলায় বলল, “কোলে নেবে না?”
অরা মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে কাঁপা কাঁপা হাত দুটো বাড়িয়ে দিলো। আরশাদ সাবধানে বাবুকে কোলে তুলে দিলো তার মায়ের।
অরা কাঁপা কাঁপা হাতে বাবুর মুখটা ছুঁয়ে দেখছে। তার মনের মাঝে যেন শত শত প্রজাপতি ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। এই ছোট্ট দুটো চোখ, ছোট্ট নাক, ছোট্ট ঠোঁট – এই বাবুটা না-কি তার! বিশ্বাসই হচ্ছে না অরার।
অরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আরশাদ! ও সত্যিই আমাদের?”
আরশাদ এগিয়ে এসে অরার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “সত্যি!”
কতটা সময় দুজনে বাবুর দিকে তাকিয়ে রইলো কেউ জানে না। কতবার আনন্দের অশ্রু তাদের চোখ ভিজিয়ে দিয়ে গেল, তাও জানে না।
এক পর্যায়ে আরশাদ হঠাৎ কোমল কণ্ঠে বলল, “তুমি মনে মনে ছেলের নাম ঠিক করে রেখেছো না?”
বাবুর জন্মের আগ তার নাম সংক্রান্ত আলোচনা হয়নি দুজনের মাঝে। তবে দুজনের জানে তারা মনে মনে ছেলের আর মেয়ের দুটো নামই ঠিক করে রেখেছে।
অরা বলল, “তুমিও তো রেখেছো।”
আরশাদ হেসে বলল, “তোমারটা আগে শুনি!”
অরা বাড়ন্ত হৃদস্পন্দন নিয়ে বলল, “আরহান।”
প্রচ্ছন্ন হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটে। অরা তার নামের সঙ্গে মিলিয়ে বাবুর নাম রাখবে বলে ঠিক করে রেখেছিল!
“আর তোমার নাম?”
আরশাদ মোহনীয় গলায় বলল, “কল্প।”
অরা হেসে ফেলে ফিসফিস করে বলল, “আরহান হক কল্প।”
(চলবে)
#ফিরে_আসা২
৬৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
চোখভরা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে কথা। পৃথিবীর সবথেকে আশ্চর্য্যজনক জীবন্ত খেলনা তার সামনে। অরার বেডের পাশে ছোট্ট একটা ক্রিবে শুইয়ে রাখা হয়েছে তাকে। দুদিকে দু হাত ছড়িয়ে চোখ বুজে ঠোঁট ফুলিয়ে ঘুমিয়ে আছে কল্প। তাকে পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে নীল রঙের একটা জামা, হাতে হাতমোজা। একটা মানুষ এতটা সুন্দর হতে পারে? কল্পর দিক থেকে চোখ ফেরাতেই পারছে না কথা।
ক্রিবের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে কথা। তার পাশেই হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে আরশাদ। মুগ্ধ দৃষ্টিতে মেয়ের বিস্ময় দেখছে সে।
কথা হঠাৎ উঁচু স্বরে বলে উঠলো, “বাবা?”
আরশাদ তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আস্তে কথা বল বাবা। মাম্মাম ঘুমাচ্ছে না?”
কথা দৃষ্টি ফিরিয়ে বেডে ঘুমন্ত অরার দিকে একবার তাকালো। যদিও সবগুলো জনালায় পর্দায় টেনে দেওয়া হয়েছে, তবুও কোন এক পর্দার ফাঁক থেকে এক চিলতে রোদ এসে পড়েছে অরার মুখের ওপর। অসম্ভব স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। এটাই কি তাহলে মাতৃত্বের উজ্জ্বলতা?
কথা নিচু গলায় বলল, “কল্প কি সারাদিনই ঘুমাবে?”
আরশাদ হেসে বলল, “হ্যাঁ মা। ছোট বাবুরা তো দিনের বেশিরভাগ সময়ই ঘুমিয়ে কাটায়।”
কথা কৌতুহল নিয়ে বলল, “আমি যখন ওর মতো ছিলাম, আমিও সারাদিন ঘুমাতাম?”
“হ্যাঁ।”
কথা আবারও কৌতূহলী গলায় বলল, “আমিও ওর মতো এতটুকু ছিলাম?”
কথার কৌতুহল দারুণ উপভোগ করছে আরশাদ। কাল রাত থেকে কল্পকে নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। তার সকল আগ্রহ যেন এই ছোট্ট মানুষটার মাঝে এসে আটকে গেছে।
আরশাদ মেয়েকে বুকের মাঝে নিয়ে এসে বলল, “হুঁ! সারাক্ষণ আমার কোলে কোলে ঘুরতি।”
কথা জোর গলায় বলল, “এখনও তো ঘুরি!”
আরশাদ হতাশ গলায় বলল, “কই এখন ঘুরিস? এখন তো সারাদিন শুধু কার্টুন দেখিস।”
কথা আনমনেই হেসে ফেলল। মুহূর্তেই আবার হাসি লুকিয়ে বলল, “বাবা? আমি ওকে কল্পকে ধরি?”
“দাঁড়া এক সেকেন্ড!”
আরশাদ উঠে গিয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিয়ে এলো। হাত জীবাণুমুক্ত না করে নবজাতকে ধরাটা বেশ বিপজ্জনক। আরশাদ তাই কথার হাতে কয়েক ফোঁটা স্যানিটাইজার দিলো।
কথা কাঁপা কাঁপা হাতে স্পর্শ করলো কল্পর গাল। যেন মানুষের গাল নয়, তার কোনো পুতুলের গাল। এতটা তুলতুলে নরম মানুষের গাল হতে পারে। কথা ভাইয়ের সারা মুখে হাত বুলিয়েই যাচ্ছে। ঘুমের মাঝে কিঞ্চিৎ নড়ে উঠলো কল্প। তার নড়ে ওঠা দেখেও বেশ মজা পেলো কথা।
কথা শিশুসুলভ গলায় বলল, “I love you my baby brother!”
আরশাদ আদুরে এবং মুগ্ধ গলায় বলল, “বড় বোন হয়ে গেলি কথা?”
কথা আত্মতৃপ্তির ভঙ্গিতে বলল, “হুঁ! আমি এখন আর ছোট নেই!”
“কে বলেছে? কথা সবসময়ই বাবার কাছে ছোট থাকবে।”
কথা হঠাৎ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শুকনো গলায় বলল, “আচ্ছা বাবা? তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো? আমাকে না-কি কল্পকে?”
আরশাদ সঙ্গে সঙ্গে দৃঢ় গলায় বলল, “দুজনকেই!”
কথা ভ্রু কুঁচকে বলল, “কাকে বেশি?”
আরশাদ আবারও জোর গলায় বলল, “দুজনকেই সবথেকে বেশি।”
“আর আমাকে তোমরা কেউ ভালোবাসো না?” ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল অরা।
এতক্ষণে ঘুম ভাঙলো তার। কাল ডেলিভারির পর ক্লান্তি চারিদিক থেকে গ্রাস করে নিয়েছিল তাকে। কল্পকে দেখে, তাকে প্রথমবারের মতো খাইয়ে অরা তলিয়ে গেছে গভীর ঘুমে। ঘুম ভাঙতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো পৃথিবীর সবথেকে সুখময় দৃশ্য। আরশাদ আর কথা গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছে কল্পকে। আনমনেই প্রচ্ছন্ন হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে।
অরাকে জেগে উঠতে দেখে কথা “মাম্মাম!” বলে, উৎফুল্ল ভঙ্গিতে ছুটে এলো তার কাছে। আরশাদও উঠে দাঁড়িয়ে তার পিছু নিলো।
কথা অরার বেডের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “I missed you!”
অরা থেমে থেমে বলল, “I missed you too!”
“আমি তোমার কাছে যাবো।”
অরা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরশাদ শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “না বাবা। তুই ওখানে গেলে অসুবিধা হবে না মাম্মামের?”
অরা আদুরে ভঙ্গিতে বলল, “কিচ্ছু হবে না। অনেক জায়গা আছে তো। উঠিয়ে দাও।”
আরশাদ কথাকে কোলে তুলে বসিয়ে দিলো অরার পাশে। কথা তার ছোট্ট হাতে জড়িয়ে ধরলো অরাকে। মুগ্ধতার প্রবল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে আরশাদের গা বেয়ে। একটা সময়ে সে ধরেই নিয়েছিল, বাকিটা জীবন তার একা একাই কেটে যাবে। বিষণ্ণতায় ঘেরা নিঃসঙ্গতাকে আনন্দদায়ক বলেই চালিয়ে দিতে হবে আজীবন। তার মানুষগুলো তার নির্জীব জীবনটায় নতুন করে প্রাণ ফিরিয়ে এনেছে।
অরা কথার চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “ভাইকে দেখেছিস?”
কথা মুগ্ধ ভঙ্গিতে বলল, “দেখেছি তো। কল্প অনেক কিউট। I already love him!”
কথার কথায় একসঙ্গে হেসে ফেলল আরশাদ আর অরা। এমন তীব্রতর সুখ যে মানুষ সহ্য করতে পারে, কল্প না এলে বুঝতেই পারতো না তারা।
কথা হঠাৎ সতর্ক গলায় বলল, “ওরা কি তোমাকে অনেক ব্যাথা দিয়েছে মাম্মাম?”
অরা সত্যির মতো করে মিথ্যা বলল, “না তো! একটুকুও ব্যাথা দেয়নি।”
“তাহলে তুমি কাঁদছিলে কেন?”
“কখন?”
“যখন তোমাকে ওরা আরেকটা ঘরে নিয়ে গেল?”
অরাকে যখন কেবিন থেকে ডেলিভারি রুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, দূর থেকে তখন দৃশ্যটা দেখেছে কথা। এমনিতেই ডক্টর আর হসপিটালে তার চিরকালের ভয়। তার ওপর অরাকে ওভাবে দেখে সে নেহায়েত কম ভয় পায়নি।
অরা কী বলবে ভেবে না পেয়ে বলল, “আনন্দে। তোর ভাই আসছে সেই আনন্দে।”
অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “আনন্দে কেউ কাঁদতে পারে না-কি?”
অরা আশ্বাস দিয়ে বলল, “পারে তো! কেন পারবে না?”
কথা চিন্তিত গলায় বলল, “আচ্ছা মাম্মাম? আমরা কি সত্যিই কল্পকে বাসায় নিয়ে যেতে পারবো?”
অরা অবাক গলায় বলল, “বাসায় না নিয়ে গেলে কোথায় রাখবো?”
আরশাদ হেসে ফেলে বলল, “তুই কি ভেবেছিস হসপিটালেই রেখে যাবো?”
আরশাদের এই প্রশ্নে হেসে ফেলল অরা এবং কথাও। হাসতে হাসতে কথা মাথা রাখলো অরার কাঁধে।
আরশাদ অরার কাছে গিয়ে নরম স্বরে বলল, “এখন কেমন লাগছে?”
অরা প্রচ্ছন্ন হাসি হেসে বলল, “ভালো।”
“একটু ভালো না অনেক ভালো?”
“অনেক ভালো।”
আরশাদ উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে বলল, “আর কষ্ট হচ্ছে না তো?”
অরা আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “উঁহু!”
ঘোরলাগা দৃষ্টিতে আরশাদ তাকিয়ে রইলো অরার দিকে। মেয়েটার সাহস আর শক্তি, সত্যিই মুগ্ধ করেছে আরশাদকে। দিনভর অমন তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করার পরও সাহস হারায়নি অরা। ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করে গেছে তার সন্তানের জন্য।
অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আমরা কি আজ বাসায় যেতে পারবো?”
আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “বাসায় যাবে মানে? সুস্থ হয়েছো তুমি? সাহস কত!”
অরা দুর্বলভাবে জোর দিয়ে বলল, “হয়েছি তো সুস্থ!”
আরশাদ গলায় একটা কঠোর ভাব নিয়ে বলল, “না অরা। আরও দুই দিন অবজারভেশনে থাকবে হবে তোমাদের দুজনকে।”
অসম্ভব সুন্দর সময় কাটালো তিনজন। তবে তাদের কথাবার্তায় কেন্দ্রে আছে নতুন ওই চতুর্থজনটি।
আশফিয়ার আগমন ঘটলো ঘরে। এতক্ষণ আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে ফোনালাপে ব্যস্ত সময় পাড় করেছে সে। সুখবরটা জানাতে হবে তো সকলকে। আরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে তার ভক্তকূল বা মিডিয়ায় খবরটা জানায়নি এখনো। এমনিতেই হসপিটালের সামনে সাংবাদিকদের ভীড় লেগেই আছে। সে খবরটা জানালে তাদের উপচে পড়া উৎসাহে অতিষ্ট হতে হবে। তার ওপরে আবার তাকে ‘অভিনন্দন’ জানাতে ইন্ডাস্ট্রির সহশিল্পী আর পরিচালকদের ফোনের বন্যা বয়ে যাবে। এত মানুষের এত ‘অভিনন্দন’, শোনার সময় এটা না। হসপিটালে অবস্থানকালে সকলপ্রকার ঝামেলা এড়াতে চাইছে আরশাদ। আপাতত অরার সুস্থ হয়ে ওঠার দিকেই তার সমস্ত মনোযোগ আবদ্ধ।
আশফিয়া বেডের সামনে এসে দাঁড়িয়ে অরাকে উদ্দেশ্য করে মিষ্টি গলায় বলল, “এখন কেমন আছো অরা?”
অরা স্নিগ্ধ গলায় বলল, “ভালো আছি আপা।”
আশফিয়া গল্পের ছলে বলল, “তোমাকে কাল যখন ডেলিভারি রুমে নিয়ে যাওয়া হলো, আমার বোকা ভাইটা এত ভয় পেয়েছিল!”
অরা এক মুহূর্তের জন্যে তাকালো আরশাদের দিকে। ভয়ে বিব্রত হওয়ার কোনো লক্ষণ তার মাঝে নেই।
আশফিয়া সরে গিয়ে দাঁড়ালো কল্পর ক্রিবের দিকে। একরাশ আগ্রহ আর মুগ্ধতা দেখছে তাদের পরিবারের সবথেকে ছোট্ট সদস্যটিকে।
অরা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কার মতো দেখতে হয়েছে আপা?”
আশফিয়া মুগ্ধ গলায় বলল, “হুবহু আরশাদের ছোটবেলার মতো। চোখদুটো তো অবিকল আরশাদের মতো!”
কল্প আরশাদের মতো দেখতে হয়েছে জেনে অরার সকল আনন্দ যেন সীমা ছাড়িয়ে গেল।
জুনিয়র আরশাদকে তো সে আরশাদের মতো করেই গড়ে তুলতে চায়।
আশফিয়া এবার আরশাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আরশাদ শোন! মামা-মামীরা আর খালা-খালু আজ বিকেলে কল্পকে দেখতে আসবে। চাচা-চাচীরাও আসবে সন্ধ্যার দিকে। তোমার বিচ্ছু বান্ধবীকেও বলেছি অরা। ফুপুরা ঢাকায় নেই দেখে আসতে পারছে না। ওরা কাল আসবে।”
বিরক্তির হাওয়া বয়ে গেল আরশাদের গা বেয়ে। এতগুলো মানুষ হসপিটালে হাজির হবে? শুধু মামা-মামী, চাচা-চাচীটাইপ মানুষেরা এলে একটা কথা ছিল। কিন্তু তারা আসবে তাদের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে। একেকজনের দুইয়ের নিচে বাচ্চা নেই। কারও কারও ছেলে-মেয়েদের আবার বিয়েও হয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে আবার আসবে ছেলের বউ বা মেয়ের জামাই! এত এত মানুষ একত্রিত হওয়া মানে হইচইয়ের চূড়ান্ত।
হইচই এড়াতেই যেখানে আরশাদ এত বড় খুশির খবর পৃথিবীর থেকে আড়াল করে রাখলো, সেখানে আশফিয়া হইচইয়ের মেলা বসিয়ে দিলো হসপিটালে? কোনো মানে হয়?
আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “মানে কী? এতগুলো মানুষ হসপিটালে আসবে কেন?”
আশফিয়ার অরার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, “দেখেছো কত বড় বেয়াদব!”
“বেয়াদবি না আপা। প্র্যাক্টিকাল হও। অরা তো এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। এতগুলো মানুষ একসাথে এলে ও রেস্ট নেবে কীভাবে?”
আশফিয়া অবাক গলায় বলল, “তাই বলে ওরা বাবুকে দেখবে না?”
আরশাদ বিরক্ত গলায় বলল, “আমরা বাসায় ফিরলে বাবুকে দেখা যেত না?”
আশফিয়া সোজা-সাপ্টা জানিয়ে দিলো, “আমি এতকিছু না জানি না। আত্মীয়-স্বজনরা আসতে চাইলে আমি না করি কী করে?”
আরশাদ ক্রুদ্ধ গলায় বলল, “বাঙালি কোনো ম্যানার্স জানে না!”
অরা তাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলল, “থাক না আরশাদ।”
আশফিয়া হুমকির সুরে বলল, “ওদের সামনে কিন্তু খবরদার কোনো বেয়াদবি করবি না।”
আরশাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “বুঝেছি বুঝেছি!”
আশফিয়া এবার কথার দিকে তাকিয়ে বলল, “আর এই যে আপনি!”
কথা ধরা পড়া অপরাধীর ন্যায় অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
“কাল থেকে হসপিটালে পড়ে আছিস! বাসায় যাবি না?”
কথা জেদ ধরে বলল, “না। আমি থাকবো মাম্মামের কাছে।”
আশফিয়া শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “থাকবি তো। এখন বাসায় গিয়ে গোসল করে, খেয়ে-দেয়ে, একটু ঘুমিয়ে আবারও চলে আসবি মাম্মামের কাছে।”
“তুমি নিয়ে আসবে তো আমাকে?”
“অবশ্যই নিয়ে আসবো। এখন চল।”
আরশাদ, অরা আর ছোট্ট ভাইটার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আশফিয়ার হাত ধরে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো কথা। এতক্ষণ তীর্থের কাকের মতো যে সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছিল আরশাদ, অবশেষে সেই সুযোগটা পেয়েই গেল।
অরার কাছে গিয়ে তার মুখের ওপর ঝুঁকে সবার আগে গাঢ় একটা চুমু খেলো তার কপালে। তারপর একেক করে অনবরত কত-শত ভালোবাসার স্পর্শে যে ভরিয়ে দিলো তার মুখ, তার কোনো হিসাব নেই। আরশাদের এমন আকস্মাৎ আদরে অজানা এক সুখের রাজ্যে ভেসে গেল অরা।
অস্পষ্ট গলায় বলল, “সারাদিন মাথায় শুধু দুষ্টুমি ঘোরে না?”
আরশাদ দুষ্টুমিমাখা কণ্ঠে বলল, “সারাদিন মাথায় দুষ্টুমি ঘোরে বলেই তো আজকে বাবুর মা হতে পারলে।”
লজ্জা পেয়ে অরা দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টাবার উদ্দেশ্যে বলল, “সেলাইন কি সারাদিনই দিয়ে রাখবে?”
“ডক্টর তো বলল, তুমি খেতে পারলে আজকেই খুলে নেবে। খেতে পারবে?”
“পারবো বোধ হয়।”
“কী খেতে ইচ্ছা করছে?”
অরা কিছুক্ষণ ভেবে হাসিমুখে বলল, “কফি!”
আরশাদ হেসে ফেলে বলল, “আমি জানতাম এটাই বলবে।”
অরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে বলল, “বলবো না কেন? পাক্কা নয় মাস কফি থেকে বঞ্চিত করেছো আমাকে।”
আরশাদ আবারও সেই দুষ্টু গলায় বলল, “শুধু কফি? আরও কতকিছু থেকে বঞ্চিত করলাম। সেসব নিয়ে তো অভিযোগ করলে না?”
চমকে উঠে আরশাদের দিকে তাকালো অরা। তার গালদুটো নিমিষেই রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। লজ্জারাঙা অরাকে সবথেকে সুন্দর লাগে। আরশাদ যতবারই তাকে লজ্জা পেতে দেখে, বিচিত্র এক ঘোরে হারিয়ে যায়। তার ঘোরলাগা এই দৃষ্টি যেন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে অরা লজ্জা।
আচমকা দুজনেই সংবিৎ ফিরে পেলো কল্পর কান্নার শব্দে। জেগে উঠেছে কল্প। তার কান্নার সুরটাও এত অদ্ভুত সুন্দর! মাত্র কয়েক ঘন্টা হয়েছে এই মানুষটা পৃথিবীতে এসেছে, ইতোমধ্যেই মুগ্ধতায় ডুবিয়ে ফেলেছে তার বাবা আর মাকে।
অরা সতর্ক গলায় বলল, “খাওয়ার সময় হয়ে গেছে না?”
আরশাদ ক্রিবের দিকে পা বাড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ। দাঁড়াও এনে দিচ্ছি।”
এতক্ষণ আধশোয়া হয়ে ছিল অরা। কল্পকে খাওয়ানোর জন্য তাকে পুরোপুরি উঠে বসতে হবে। উঠে বসতে গিয়ে কোমরের নিচের অংশটা ব্যাথায় কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। বসতেও ভীষন কষ্ট হচ্ছে তার। যে ১০ সেন্টিমিটার ডাইলেশনের জন্যে চব্বিশ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছে তাকে, ডেলিভারির সময় সেটাও যথেষ্ট হলো না। বাবুর কাঁধ বের করে আনার সুবিধার্থে সারভিক্স এরিয়া আরেকটু প্রশস্ত করতে ছোট করে কেটে দেওয়া হয় সেখানে। ডেলিভারির পর আবার সেলাই দেওয়া হয়েছে। সেলাইয়ের কারণেই বসতে অসুবিধা হচ্ছে তার।
আরশাদ উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “উঠে বসতে কষ্ট হচ্ছে অরা?”
অরা ব্যাথাতুর কণ্ঠে বলল, “হুঁ।”
আরশাদ ব্যস্ত পায়ে তার গুছিয়ে রাখা ব্যাগের কাছে গিয়ে নরম পিলোটা বের করে আনলো।
যত্ন নিয়ে অরাকে সাহায্য করলো সেটার ওপরে বসতে।
অরা অবাক গলায় বলল, “এজন্যেই পিলোটা নিয়ে এসেছিলে?”
অরা নিজেই তার ব্যাগ গোছাতে চেয়েছিল। ভাগ্যিস আরশাদ বাঁধা দেয় তাকে। তার বুদ্ধি করে আনা প্রতিটা জিনিস কাজে লেগেছে অরার। লেবারের সময় শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার জন্যে চুইং গাম অনেক উপকারে এসেছে। আরশাদ যে বুকের দিকে চেইনওয়ালা জমা এনেছে অরার জন্যে, সেটাও এখন কল্পকে খাওয়ানোর সময় কাজে লাগছে। এখন কাজে লাগলো পিলোটাও। মানুষটা অরার ছোট ছোট সকল প্রয়োজনের এতটা নিখুঁত যত্ন নেয় কী করে?
দুপুরের দিকে চলে এলেন সেলিনা হক। সকাল থেকেই খেতে পারছে। তার জন্যে তাই নিজের হাতে রান্না করে নিয়ে এলেন। যত্ন নিয়ে নিজ হাতে খাইয়েও দিলেন।
অরার যত্ন নেওয়া শেষে নাতিকে কোলে নিয়ে বসলেন। হ্যান্ডব্যাগ থেকে লাল রঙয়ের একটা বক্স বের করলেন। বক্সে একটা সোনার চেইন। চেইনটা পড়িয়ে দিলেন নাতির গলায়।
অরা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, “এসবের কী দরকার ছিল মা? ওকে কি আর সবসময় এটা পড়ানো হবে?”
সেলিনা হক বিজ্ঞ গলায় বললেন, “তাও। সোনার কিছু একটা দিয়ে বাচ্চার মুখ দেখতে হয়। আরশাদ শোন! তুইও ছেলের জন্য সোনার কিছু একটা নিয়ে আসবি। আর বৌমার জন্য একটা শাড়ি।”
আরশাদ বিস্মিত ভঙ্গিতে বলল, “শাড়ি?”
“হ্যাঁ, এটাই নিয়ম। মায়েরা কষ্ট করে সন্তানকে পৃথিবীতে নিয়ে আসে না? এজন্যে তাদের শাড়ি দিতে হয়।”
বিকেলের দিকে এক এক করে আসতে শুরু করলো আত্মীয়-স্বজনেরা। আরশাদের ধারণা সঠিক হলো না। অরার অসুবিধা তো হলেও না, বরং কল্পকে দেখে সকলের আনন্দিত মুখটা তার ভালোলাগা আরও বাড়িয়ে দিলো। বয়োজ্যেষ্ঠরা কোলে তুলে কল্পকে আশীর্বাদ করলো, আর ছোটরা তার গাল টিপে দিয়ে আদর করলো। ক্ষনিকের জন্যে ঘুম ভেঙে চোখ বড় করে নতুন মুখগুলোকে দেখলো কল্প।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই এলো সীমা এবং এনায়েত। সীমা যখন কেবিনে প্রবেশ করছিল, তখন আরশাদ ফিসফিস করে কী যেন বলছিল অরার কানে। দৃশ্যটা দেখেই চোখে জল এসে গেল তার। আরশাদ আর অরা খুশি, মানে যেন পুরো দুনিয়াটাই খুশি।
আরেকদফা চোখে জল এলো কল্পকে কোলে নিয়ে। তার শান্ত-শিষ্ট কাজপাগল বান্ধবীটা আজ মা হয়ে গেল। সীমা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে আরশাদের ফুপুদের কাছে গিয়ে বলছে, “জানেন? আমি খালা হয়েছি!”
আরশাদ সেই এআই রহস্যের উদঘাটনের জন্যে সীমাকে ধন্যবাদ জানতেই সীমা জোর গলায় বলল, “ধন্যবাদ দিলে তো হবে না ভাইয়া! আমাকে সুপারফ্যান অ্যাওয়ার্ড দিতে হবে। যে অ্যাওয়ার্ড দেখে আপনার অন্য ফ্যানরা হিংসায় জ্বলে উঠবে।”
আরশাদও হেসে এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল সীমার শর্তে। প্রত্যেকটা সেলিব্রিটিরই কম-বেশি ভক্ত রয়েছে। তবে এমন পাগল ভক্ত কজনের আছে?
(চলবে)