#ফিরে_আসা২
৭০
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
ডেলিভারির তিন দিন পরও হসপিটাল থেকে রিলিজ দেওয়া হলো না অরাকে। কারণ, তার জ্বর। হুট করে সেদিন বিকেল বেলা আত্মীয়-স্বজনেরা চলে যাওয়ার পর আরশাদ খেয়াল করলো অরার গায়ে মৃদু তাপ। সেই তাপ ক্রমেই বেড়ে গেল রাতের মধ্যে। শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এলো তার। থার্মোমিটারের স্কেলে ১০৪° ফারেনহাইট। এমনিতেই ডেলিভারির পর বেচারির মাঝে ক্লান্তির শেষ নেই। তার ওপরে আবার এই জ্বর তার ক্লান্তিঘেরা শরীরকে আরও ক্লান্ত করে দিলো।
এদিকে আরশাদ রেগেমেগে একাকার অবস্থা করলো। এতগুলো মানুষ কল্পকে দেখতে এসেছে, কেউ না কেউ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল ভাইরাস। সেটাই সংক্রমিত হয়েছে অরার মাঝে। কী দরকার ছিল আপার, এতগুলো মানুষকে খবর দিয়ে ডেকে আনার?
কল্পর জন্যে আলাদা একটা কেবিন নেওয়া হলো। এটা হসপিটালের সাধারণ অংশ নয়, তাই অযথা একটা কেবিন নিয়ে রাখলে অন্যান্য রোগীদের অসুবিধা হবে না। ভিআইপি এরিয়ার বেশিরভাগ কেবিন ফাঁকাই পড়ে থাকে। কল্পর সার্বক্ষণিক দেখাশোনায় আছেন সেলিনা হক। তাকে সাহায্য করছে আরেকজন নার্স। ওদিকে আশফিয়া কথাকে নিয়ে বাড়ি-হসপিতাল দৌড়ে বেড়াচ্ছে। অরা দুর্বল হয়ে পড়ায় ডক্টর কল্পকে মিল্ক পাউডার খাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। বুকের দুধের পাশাপশি অল্প মাত্রায় এই দুধ খেলে ক্ষতি নেই।
রাতে ঘুমের মাঝেই হঠাৎ হঠাৎ জেগে ওঠে কল্প। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। খিদে নেই, অন্য কোনো সমস্যাও নেই। তবু যে কেন কাঁদে, সেলিনা হক বুঝতেই পারে না। কিন্তু বাবার কোলে উঠতেই কল্প শান্ত। আরশাদ তাকে কোলে করে হেঁটে বেড়ায় নিঃশব্দে ঘেরা করিডোরে। বাবার কোলে উঠে কল্প কখন যে ঘুমে তলিয়ে যায়!
আরশাদ দিনরাত এক করে অরার পাশে রয়েছে। দিনের বেশির ভাগ সময়েই মেয়েটার চেতনা থাকে না। আধ ঘুম আধ জাগরণের মাঝে ডুবে থেকে হঠাৎ হঠাৎ ভয়ার্ত গলায় বলে ওঠে, “আরশাদ? আছো তুমি?”
আরশাদ তার হাতটা ধরে ভরসার গলায় বলল, “এই তো আমি অরা! তোমার পাশেই আছি।”
জ্বর পুরোপুরি সারতে সময় লাগলো চার দিন। এই সাত দিনে একবারের জন্যেও বাড়িতে যায়নি আরশাদ। এক মুহূর্তের জন্যেও বিশ্রাম নেয়নি। কাজের কথা তো মাথাতেও আনেনি। দেশের সবথেকে বড় সুপারস্টার চাকচিক্যময় জীবনের ব্যস্ততা ভুলে পড়ে আছে হসপিটালে, তার ভালোবাসার মানুষটার পাশে।
আজ অরাকে রিলিজ দেওয়া হবে। বাড়ি থেকে দুজন স্টাফ এসে সব গোছগাছ করছে। কল্প প্রথমবারের মতো নিজের বাড়িতে যাচ্ছে বলে, সেলিনা হক আগেভাগেই চলে গেছেন তাকে বরণ করবেন বলে।
আজ সকালে উঠেই গোসল করেছে অরা। একা একা তা সম্ভব নয় বলে লজ্জার মাথা খেয়ে চেয়েছে আরশাদের সাহায্য। আরশাদও নিজের অসভ্য সত্ত্বাকে দমিয়ে সাহায্য করেছে তাকে। সাদা ঢিলেঢালা সালোয়ার কামিজ অরার পরনে। ভেজা চুলগুলোতে বড্ড স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। কল্প মায়ের কোলে বসে চোখ বড় বড় করে দেখছে তাকে।
অরা আদুরে গলায় বলল, “আমি কে বল তো বাবা? আমি হলাম মা!”
কথাটা বলার সময়ে গা বেয়ে বিচিত্র এক হাওয়া বয়ে গেল। মা হওয়ার এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার নয়। যখন দুচোখ ভরে সে দেখে কল্পকে, কল্প যখন হঠাৎ হঠাৎ চোখ বড় করে তাকায়, তার একটা আঙুল আঁকড়ে ধরে থাকে – অরার কী যে ভালো লাগে! এই ভালো লাগা একজন মা ছাড়া হয়তো কেউই এতটা প্রগাঢ়ভাবে অনুভব করতে পারবে না। প্রকৃতি কাউকেই সেই সাধ্য দেয় না।
অরা হাসিমুখে চুমু খেলো ছেলের কপালে। দূর থেকে দৃশ্যটা ক্যামেরাবন্দি করে রাখলো আরশাদ। তার ছবি তোলার শখ বহুদিনের। এই ক্যামেরা দিয়েই কতশত ছবি যে তুলেছে, তার কোনো হিসাব নেই। তবে এর থেকে অনিন্দ্য সুন্দর ছবি সে কখনো তোলেনি।
আরশাদ ক্যামেরাটা রেখে এগিয়ে এলো অরার বেডের দিকে। তার দিকে চোখ পড়তেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরা। এভাবে তাকিয়ে থাকতে লজ্জা লাগছে খুব, তবুও তাকিয়ে রইলো। সাদা শার্টে আরশাদকে দেখলেই কেমন দিশেহারা লাগে অরার।
কল্প চোখ বড় করে দেখছে তার বাবার। অরা তার দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, “কল্প দেখ, তোর বাবাকে আজ কত হ্যান্ডসাম লাগছে!”
আরশাদ বাঁকা হাসি হেসে কল্পর দিকে তাকিয়েই বলল, “কল্প দেখ, তোর মা আমার সাথে ফ্লার্ট করছে।”
লজ্জা পেয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো অরা। মায়ের হাসি দেখে কল্পর বিস্ময় আরও অনেকখানি বেড়ে গেল।
অরা কোনমতে হাসি থামিয়ে বলল, “আমরা কখন যাবো?”
“এই তো, ওদের গোছগাছ হলেই বের হবো।”
হসপিটালের মূল দরজা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করছে সাংবাদিকরা। প্রত্যেকের হাতেই ক্যামেরা। সেই ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠছে একটু পর পর। এতদিন তাও কোনমতে আটকে রাখা গেছিল তাদের। তবে আজ কোনো এক সাংবাদিক হসপিটালের ভেতর থেকে খবর নিয়ে এসেছে, অরাকে আজই রিলিজ করা হচ্ছে। তার মানে আরশাদ এই দরজা দিয়েই বের হবে। তাকে একটিবারের জন্যে ক্যামেরাবন্দি করার আকাঙ্ক্ষায় ছুটে এসেছে উৎসুক সাংবাদিকেরা।
অরাকে নিয়ে হসপিটালের মূল দরজা দিয়ে বের হচ্ছে আরশাদ। অরার কোলে কল্প আর তাদের পেছনে আশফিয়া। সাংবাদিকদের এই আকস্মাৎ ভীড় দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেল অরা। আরশাদ নির্বিকার রইলো। নির্বিকার ভঙ্গিতেই কল্পকে অরার কোল থেকে নিয়ে নিলো। আরশাদের ঘরের ছোট্ট এই নতুন সদস্যকে দেখে সাংবাদিকদেরা উৎসাহে উপচে পড়লো। “আরশাদ ভাই! আরশাদ ভাই!” বলে চেঁচিয়ে উঠলো তারা। তাদের পাত্তা না দিয়ে অরা গাড়ির ভেতরে উঠে বসতেই, কল্পকে তার কোলে দিয়ে নিজে বসে পড়লো তাদের পাশে।
আরশাদের জায়গায় অন্য কোনো সেলিব্রিটি হলে এতক্ষণে সাংবাদিক দেখলে গলে পড়তো। তাদের ক্যামেরার জন্য পোজ দিতো, তাদের কাছে গিয়ে হালকা আলাপও করতো। সেসবের কিছুই করলো না আরশাদ। কারণ সে খুব ভালো করেই জানে সাংবাদিকদের এই ভক্তির পুরোটাই ভন্ডামি। আরশাদের জন্যে এখানে আসেনি তারা। এসেছে তার সাফল্যের জন্যে। তার সাফল্যকে পুঁজি করে ব্যবসা করার জন্যে। আরশাদ হক তার নবসন্তানকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসছে। এই ছবিটা দিয়ে নিউজ করলেই তো তাদের চ্যানেলের টিআরপি এক লাফে বেড়ে যাবে।
কেউ যদি আরশাদের ক্যারিয়ারকে ধ্বংস করার নোংরা ষড়যন্ত্রে নামে, তবে এরাই সবার আগে চলে যাবে তার বিপক্ষে। সংবাদিক জাত, আজীবন এড়িয়ে গেছে আরশাদ। তার কাজ করে যাওয়ার একমাত্র অনুপ্রেরণা তার ভক্তরা। তাদের জন্যেই কাজ করে যাবে আজীবন।
গাড়ি বাড়ির সামনে এসে থামলো। সাংবাদিকের দল বাড়ি পর্যন্ত আসতে শুরু করলেও অনেকটা দূরেই তাদের আটকে দিয়েছে ঝড়-তুফান। অরা কল্পকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, “এই দেখ কল্প, এটা তোর বাড়ি!”
কল্প অবাক চোখে দেখছে তার বাড়ি। আরশাদ, অরা আর কল্প দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই তাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নিলেন সেলিনা হক এবং কথা। বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই অরা দেখলো বসার ঘরটা বেলুন দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। আরশাদের অ্যাওয়ার্ড রাখার শেলফে বড় একটা পোস্টার টানানো। তাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা, “WELCOME HOME BABY BROTHER!”
বুঝতে বাকি রইলো না এই কাজ কথা। কথা নিজেই বসার ঘরটা সাজিয়েছে। বসার ঘরে বসেই কল্পর গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে কেক কাটলো তারা।
আরশাদ ছেলেকে কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে পুরো বাড়িটা। তাদের সঙ্গে কথাও আছে। কথা ভাইকে চিনিয়ে দিচ্ছে কোনটা কার ঘর। অরারও তাদের এই ভ্রমণের অংশ হওয়ার ইচ্ছা ছিল। তার কিছুটা ক্লান্ত লাগায় আরশাদ সোজা পাঠিয়ে দিয়েছে ঘরে।
দোতলায় তাদের আগের ঘরটাই প্রস্তুত করা হয়েছে। নিচতলার ঘরটায় অরার ঘুম আসতে অনেক সময় লাগে। তাছাড়া দীর্ঘদিন যে ঘরে থেকে সে অভ্যস্ত সে ঘরের বাইরে অন্য ঘরে থাকতে ইচ্ছাও তেমন করে না। আশফিয়া ধরে ধরে দোতলায় উঠিয়ে দিলো তাকে।
বিছানায় বসতেই গা এলিয়ে দিলো অরা। পুরো বাড়ি ঘুরে কিছুক্ষণ পরই কল্পকে কোলে নিয়ে চলে এলো।
আরশাদ কোমল গলায় কল্পকে বলল, “আর এটা হলো মা, বাবা আর কল্পর ঘর। সুন্দর না?”
কল্প কী বুঝলো কে জানে? ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো আরশাদের দিকে।
আরশাদ বিছানায় অরার কাছে এগিয়ে যেতে যেতে আবারও নিচু গলায় কল্পকে বলল, “মায়ের কাছে একটু থাক তো জুনিয়র। আমি এক্ষনি আসছি।”
আরশাদ তাকে অরার কোলে তুলে দিতে গেলেই কেঁদে উঠলো কল্প।
আরশাদ হেসে বলল, “কী হলো? যাবি না মায়ের কাছে?”
অরা বিস্মিত এবং অভিমানী গলায় বলল, “চব্বিশ ঘন্টার লেবার সহ্য করে জন্ম দিলাম আমি, আর উনি সারাদিন থাকে বাবার কোলে!”
আরশাদ সতর্ক কণ্ঠে বলল, “মা রাগ করেছে কিন্তু! যা মায়ের কাছে। বাবা এক্ষনি চলে আসবে।”
অরার কোলে উঠে কান্না আবারও বেড়ে গেল কল্পর। সেই কান্না অবশ্য অরা কয়েকবার দোল দিতেই থেমে গেল।
আরশাদ ফিরে এলো কালো রঙয়ের একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে। এসে বসলো অরার মুখোমুখি। ব্যাগ থেকে বের হলো একটা নীল রঙের বাক্স। আরশাদ বাক্সটা খুলতেই অরা দেখতে পেলো ছোট্ট একটা ঘড়ি। ঘড়িটার চেনের বডি থেকে শুরু করে গোল ডায়াল, সবই সোনার তৈরি। চেইন, আংটি এইসব তো কল্প অনেক পেয়েছে। আরশাদ তাই ছেলের জন্যে এই ইউনিক উপহার এনেছে।
অরার কোলের ওপর থেকে কল্পর ছোট্ট হাতটা নিয়ে তাকে যত্ন করে ঘড়িটা পড়িয়ে দিলো আরশাদ।
অরা মজার ছলে বলল, “শুধু কল্পই গিফট পেলো? আমার শাড়ি কোথায়?”
আরশাদ শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “সেটা পাওনা রইলো। যথাসময়ে পেয়ে যাবেন।”
অরা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “পাওনার সাথে কিন্তু সুদও দিতে হবে।”
আরশাদ সূক্ষ্ম হাসি হেসে বলল, “সেটাও পাবে।”
সুখবরটা অবশেষে ভক্তকূলকে জানিয়েই দিলো আরশাদ। ফেসবুকে তাদের চারজনের একটা ছবি পোস্ট করে লিখলো, “We have been blessed with a boy. Keep us, and Arhan Haque Kolpo in your prayers.”
হাজারো শুভেচ্ছায় ভেসে যাচ্ছে আরশাদ। ইন্ডাস্ট্রির সহকর্মীদের একের পর এক ফোন আসছে তার কাছে।
মা হওয়া যে মুখের কথা নয়, অরা সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। চোখে একটু ঘুম লেগে আসলেই কল্প কেঁদে উঠছে, তড়িঘড়ি উঠে তাকে খাইয়ে দিচ্ছে অরা। খিদে না পেলে কান্নার অন্য কারণ খুঁজে বের করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। কখনো সেই কারণ ডায়পার ভিজে যাওয়া, কখনো তা একেবারেই অজানা।
বহুদিন পর আয়েশ করে কফি খেতে বসলো, একটা চুমুক দিতেই কেঁদে উঠলো কল্প। সাধের কফি নির্দ্বিধায় ফেলে রেখে ছুটে গেল কল্পর কাছে। আগে আসল সময়গুলো বই পড়ে কাটাতো, কিংবা ফেসবুকে অযথা বিচরণ করে। আর এখন তো আসল সময় বলতেই কিছুই নেই তার জীবনে।
রাতে একটু পর পর জেগে উঠছে কল্প। অরার চোখদুটো ঘুমে লেপ্টে আছে, তবুও ঘুমাতে পারছে না সে।
আরশাদ চিন্তিত গলায় বলল, “অরা তোমার ছেলে তো রাতে ঘুমায় না!”
অরা হাই তুলতে তুলতে বলল, “তাই তো দেখছি।”
“তার মানে রাতেও কাউকে না কাউকে ওর সঙ্গে জাগতে হবে।”
“কাকে আবার? আমিই জাগবো।”
আরশাদ উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “তোমার ওপর দিয়ে তো প্রচুর ধকল গেল অরা। রাতের ঘুমটা না হলে পুরোপুরি ফিট হতে পারবে না।”
“কিন্তু কল্প?”
আরশাদ স্বাভাবিক গলায় বলল, “ডিউটি ভাগাভাগি করে নিই। দিনের বেলায় তুমি ওকে সামলাও, আর রাতে আমি। কল্প তো এমনিতেই ফিডার খেতে পারে।”
অরা হতভম্ব হয়ে বলল, “তুমি? আরশাদ তুমি কষ্ট করতে যাবে কেন?”
আরশাদ হেসে বলল, “আমার ছেলের জন্য আমি কষ্ট করবো না? সব কষ্ট তুমিই একাই করবে? এমনিতেই অনেক কষ্ট করেছো?”
অরা বারণের সুরে বলল, “আমি পারবো আরশাদ। আমার কোনো সমস্যা হবে না।”
আরশাদ সোজা-সাপটা জানিয়ে দিলো, “এত কথা শুনতে চাচ্ছি না। তুমি নিজে আগে সুস্থ হও।”
সন্তান পৃথিবীতে আসার পর ছেলেরা বউয়ের সাহায্যে কতটুকু এগিয়ে আসে অরা জানে না। তবে আরশাদের প্রত্যেকটা কার্যক্রম দারুণভাবে মুগ্ধ করছে তাকে। বারবার মনে হচ্ছে, তার জীবনটা সাধারণ মানুষের জীবন নয়। সাক্ষাত রূপকথার গল্প। যে গল্পে কেবলই সুখের ছড়াছড়ি।
আরশাদ সত্যিই কল্পর সঙ্গে রাত জাগতে শুরু করলো। অরার মাঝে হাজার অনুতাপ থাকা সত্ত্বেও বেশি রাত অব্দি জেগে কাটাতে পারে না সে। রাত দশটার দিকেই ঘুমে তলিয়ে যায়। কল্প মায়ের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেও সেই ঘুম ক্ষণিকের। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আবার জেগে যায়। আরশাদ কখনো তাকে ফিডারে করে দুধ খাওয়ায়, কান্নার শব্দে অরা জেগে উঠলে সে নিজেই খাইয়ে দেয়। কল্পর খিদে না থাকলে আরশাদ বাড়িজুরে হেঁটে বেড়ায় তাকে কোলে নিয়ে। এটা-ওটা কত কথা যে বলে ছেলের সঙ্গে। কল্প অবাক চোখে বাবার কথা শোনে। যে আরশাদ হকের কথার ভঙ্গিতে পুরো দেশ মুগ্ধ, সেই ভঙ্গিতে কল্পও নির্ঘাত মুগ্ধ না হয়ে পারে না।
হাঁটাহাঁটি করে কল্প ঘুমিয়ে পড়লে আরশাদ তাকে শুইয়ে দেয় মায়ের পাশে। নিজেও শুয়ে পড়ে। একটু চোখ লেগে আসতেই আবারও কেঁদে ওঠে কল্প। আবারও সেই আগের প্রক্রিয়া আগ্রহ নিয়ে অনুসরণ করে আরশাদ।
সারারাত জেগে থেকে ভোর সাতটার দিকে ঘুমাতে যায় আরশাদ। ততক্ষণে জেগে ওঠে অরা। শুরু হয়ে যায় তার দিনভরের ব্যস্ততা। শাশুড়ির কাছ থেকে গোসল করানোটা শিখে নিয়েছে অরা। প্রথম প্রথম অসম্ভব ভয় করলেও, এখন ভয় কেটে গেছে। গোসল করতে করতে কল্প যখন তার ভেজা হাত দিয়ে তার মুখটা ভিজিয়ে দেয়, আনমনেই হেসে ওঠে অরা।
গোসল শেষে রোজ বাগানে কল্প-কথাকে নিয়ে রোদ পোহায় অরা। এতদিনে কল্প বেশ বুঝে গেছে, কথা তার খুব আপন কেউ। কথা কাছে এলেই কেবল তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কথা কিছু বললে, আগ্রহ নিয়ে তার কথা শোনে।
আরশাদের ভোরের ঘুম ভাঙে দুপুরের দিকে। দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত সময়টুকুতেই বাবা আর মাকে একসঙ্গে পায় কল্প।
এভাবেই একটা মাস চোখের পলকেই কেটে গেল। বাচ্চারা যে কত দ্রুত বড় হয়ে যায়, কল্পকে দেখেই উপলব্ধি হলো অরার। এখন অরা আদুরে ভঙ্গিতে কিছু বললেই হেসে দাঁতহীন মাঁড়ি বের করে হেসে ওঠে। কৌতুহল নিয়ে আশেপাশের সবকিছু দেখে। কোনো খেলনা নিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হলে, সেই খেলনাটা নিজের হাতে নিতে চায়।
সবকিছুই সুন্দরভাবে কাটছে। তবে আরশাদ আর অরা যেন নিজেদের অজান্তেই বহু দূরের মানুষ হয়ে গেছে। কল্পর রাত জাগার অভ্যাসটা তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। আরশাদ সারারাত তাকে নিয়ে জেগে থাকছে, আর অরা সারাদিন। যতটা সময় নিজেদের পাশে পায়, ততক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয় কল্পকে। তাদের কথোপকথনের মুখ্য বিষয়ও এখন কল্প। “কল্পর এটা লাগবে, কল্পকে অমুক দিন চেকআপের জন্যে নিয়ে যেতে হবে, কল্প আজ এই করেছে!” এসবের বাইরে কথা বলার সুযোগ আর নেই। একান্তে সময় কাটানো যেন দুঃসাধ্য ব্যাপার।
কল্পকে পেয়ে দুজনেই এত খুশি যে, এ নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। তবুও দিনশেষে, সকলের অগোচরে একে অপরের এই শূন্যতা বুকে নিয়ে বয়ে বেড়ায় তারা।
হুট করে ঘুম ভেঙে গেলো অরার। পাশেই আবিষ্কার করলো কল্পকে। দুদিকে দুহাত ছড়িয়ে ঠোঁট উল্টে ঘুমে মগ্ন সে। এগিয়ে গিয়ে নিঃশব্দে চুমু খেলো অরা ছেলের গালে। জগতে রাত নেমে এসেছে আর কল্প ঘুমাচ্ছে, এমনটা তো সচরাচর হয় না! দেয়ালে ঝুলন্ত ডিজিটাল ক্লকের দিকে তাকিয়ে দেখলো অরা, দুইটা আঠারো।
আরশাদকে আশেপাশে কোথাও দেখতে না পেয়ে উঠে দাঁড়ালো অরা। বারান্দার দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই দেখা পেলো তার। তাদের বারান্দায় যে সুইমিং পুল আছে, তার পাশেই নতুন একটা দোলনা আনা হয়েছে কিছুদিন আগে। অরা এখানে কল্পকে কোলে নিয়ে বসে থাকে, আর কল্প অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সুইমিং পুলের জলের দিকে।
সেই দোলনার ওপরেই ক্লান্ত ভঙ্গিতে গা এলিয়ে বসে আছে আরশাদ।
“আরশাদ?”
অরার ডাকে চোখ তুলে তাকালো আরশাদ। ঘুমজড়ানো চোখদুটোতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাকে। নিজের অজান্তেই ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটে।
অরা বারান্দার ভেতরে আসতে আসতে বলল, “কল্প ঘুমিয়েছে তো।”
আরশাদ হেসে বলল, “হ্যাঁ! কতদিন পর রাতে ঘুমালো তোমার ছেলে!”
অরা দোলনায় আরশাদের পাশে বসতে বসতে বলল, “তুমিও একটু ঘুমিয়ে নাও।”
আরশাদ ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “ঘুম আসছে না।”
অরা মায়ামাখা কণ্ঠে বলল, “অনেক টায়ার্ড দেখাচ্ছে তো তোমাকে।”
“সেজন্যেই বোধ হয় ঘুম আসছে না। বেশি টায়ার্ড থাকলে আমার ঘুম উড়ে যায়।”
অরা শুকনো গলায় বলল, “অনেক কষ্ট হচ্ছে না তোমার?”
আরশাদ দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “না তো! আজ ঠিকমত ঘুম হয়নি, সেজন্যই বোধ হয় টায়ার্ড লাগছে।”
“তোমাকে কতবার বলেছি কষ্ট করে রাত জাগতে হবে না! আমি সামলে নেবো।”
আরশাদ মোহনীয় এক হাসি হেসে বলল, “তুমিও তো কষ্ট কম করছো না অরা। তাছাড়া কল্পর জন্য আমার কখনোই কষ্ট হয় না।”
মুগ্ধ দৃষ্টিতে অরা তাকিয়ে রইলো আরশাদের দিকে। সত্যিই, আরশাদ রাত জেগে কল্পকে সামলাচ্ছে বলেই তো এত দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পেরেছে সে। আরশাদও ঠিক একই ভাবে ঘোরলাগা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে অরাকে। কী দেখে মুগ্ধ হচ্ছে কে জানে?
আরশাদ হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে বলল,
“কাছে এসো। বুকে মাথা রাখো। কতদিন কাছে পাই না তোমাকে!”
আরশাদের এই এতটুকু কথা প্রবল এক শীতল হাওয়া বয়ে গেল অরার গা বেয়ে। এক মুহূর্তেও দেরি না করে মিশে গেল তার বুকের মাঝে। আরশাদও পরম মততায় আগলে ধরলো তাকে। এতদিন পর তাকে এতটা কাছে পেয়ে কেমন ছটফট করছে অরা। নিঃশ্বাস মুহূর্তেই এলোমেলো হয়ে গেল। আরশাদ তার পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছে তাকে। যদিও নিজেই ভেতর থেকে এলোমেলো হয়ে গেছে সে।
বহুকষ্টে নিজেকে শান্ত করে অরা বলল, “জীবনটা আচমকা কত সুন্দর হয়ে গেল না?”
আরশাদ অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, “হুঁ। আমার জীবন এতটা সুন্দর হবে, কখনো ভাবতে পেরেছিলাম? এই বাড়িতেই কত নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে আমি। সেই প্রত্যেকটা রাতই ছিল বিভীষিকাময়। আজও নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছি। তবে সেটা আনন্দের।”
অরা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে চাপা স্বরে বলল, “কী অদ্ভুত না? তোমার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না। অথচ সেই আমিই কষ্ট দিলাম তোমাকে।”
আরশাদ অবাক হয়ে বলল, “অরা! তোমাকে বলেছি না ওই ঘটনাটা যে ঘটেছে, এটা আজীবনের জন্য ভুলে যেতে?”
অরা ব্যর্থ ভঙ্গিতে বলল, “ভুলতে চেষ্টা করি তো। লাভ হয় না কোনো। সারাজীবন অপরাধবোধে ভুগতে থাকবো ওই ঘটনার জন্য।”
“না অরা! অপরাধবোধের কোনো কারণ তো নেই। তোমার কোনোই দোষ ছিল না। পরিস্থিতি তোমাকে বাধ্য করেছিল।”
“কিন্তু…”
অরাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আরশাদ কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল, “আচ্ছা আমরা কেন ওই ঘটনা নিয়ে কথা বলছি? খবরদার আর কখনো যেন তোমার মুখে এসব কথা না শুনি। কোনো কষ্ট দাওনি তুমি আমাকে!”
অরা আরশাদের বুকের ওপর থেকে মাথা তুলে ডাকলো, “আরশাদ?”
অভিমান নিয়ে চুপ করে রইলো আরশাদ। সাড়া দিলো না তার ডাকে।
অরা হেসে বলল, “আচ্ছা সরি! শোনো না আমার কথা।”
“শুনছি।”
অরা অন্যরকম গলায় বলল, “এত ভালোবাসা কি সত্যিই আমি ডিজার্ভ করি?”
আরশাদ সোজাসাপ্টা উত্তরে বলল, “না।”
অরা কিছুটা বিস্ময় নিয়ে তাকাতেই সে আবারও বলল, “এর থেকেও অনেক বেশি ভালোবাসা তুমি ডিজার্ভ করো।”
ঘোরলাগা দৃষ্টিতে দুজনে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো একে অপরের চোখে। তবে আরশাদের অবাধ্য চোখদুটো নিমিষেই গিয়ে পড়লো অরার ঠোঁটের ওপরে। সারা শরীরে তরঙ্গের ন্যায় কী যেন খেলে গেল অরার। আরশাদকে বাঁধা দেওয়ার কোনো কারণ তার নেই। বরং সে চাইছে, আরশাদ যেন আরেকটু কাছে আসুক তার।
তার চাওয়াটাই পুরণ হচ্ছে। একটু একটু করে আরশাদ অগ্রসর হচ্ছে তার ঠোঁটদুটোর দিকে। শিহরণে চোখদুটো বুজে ফেলল অরা। তবুও টের পাচ্ছে আরশাদের কাছে আসা।
আচমকা দুজনেরই সংবিৎ ফিরলো, কল্পর কান্নার আওয়াজে। অরা চোখ মেলে তাকাতেই দুজনে এক মুহূর্তের জন্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো একে অপরের দিকে। সেই দৃষ্টিতে খানিক সতর্কতা আর খানিক নিরাশা। তবুও দুজনে দ্রুত পায়ে ছুটে গেল কল্পর কাছে। আবারও সকল ব্যস্ততা গিয়ে পড়লো তাদের ভালোবাসার চিহ্নের ওপরেই।
(চলবে)
#ফিরে_আসা২
৭১+৭২ (শুধুমাত্র প্রাপ্তমনস্কদের জন্য)
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
কল্পকে আজ ডক্টরের কাছে নিয়ে যাওয়ার দিন। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তার কোনো না কোনো টিকা বা চেকআপের জন্যে হসপিটালে ছুটতে হচ্ছে আরশাদ আর অরাকে। ভোর রাতে ঘুমিয়ে সকাল নয়টায় উঠেছে আরশাদ। যদিও কাল রাতে অরাই বেশ অনেকটা সময় জুড়ে সামলেছে কল্পকে। তবুও তার ঘুম আসেনি। কিংবা ঘুমানোর ইচ্ছা হয়নি। কল্প এদিকে কাঁদছে, আর ওদিকে সে আরাম করে ঘুমাচ্ছে! এ যেন অকল্পনীয় দৃশ্য।
একটা ছেলে বাবা হলে চোখের পলকেই বদলে যায়। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকটায় বড্ড ধৈর্যহীন ছিল আরশাদ। ঘরে বেশিক্ষণ থাকলেই কেমন ছটফট করতো মনটা। খানিক অবসর পেলেই বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে যেত। ঘরের কাজ করার তো প্রশ্নই ওঠে না! কথা আসার পর সেই আরশাদ অনেকটাই বদলে গেল। অযথা বাইরে ঘোরাঘুরি তো দূরে থাক, শুটিংয়ে থাকলেও তার মনটা বাড়িতেই পড়ে থাকে। দিনভর অপেক্ষা করে, কখন কথাকে দেখবে। তাকে কোলে নিয়ে আদর করবে।
কল্প আসার পর তো সে পরিবর্তনের মাত্রা অনেকটাই বেড়ে গেছে। অবশ্য কল্প আসার পর বললে ভুল হবে, সে আসার আগেই অরার যত্নে সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করছে সে। কল্পর সঙ্গে রাত জাগা, তার ডায়পার বদলে দেওয়া, তার জন্যে ফিডারে দুধ বানানো, কল্পকে কাঁদলে তাকে শান্ত করা – প্রত্যেকটা কাজে মন ঢেলে দিচ্ছে সে। যাকে বলে পুরোদস্তর ফ্যামিলি ম্যান।
কল্পর কাল রাতে কী হলো কে জানে! আরশাদ আর অরার হাজার চেষ্টার পরও কিছুতেই শান্ত হলো না। তাকে কোলে করে বাড়িজুড়ে হেঁটে বেড়ানোর পরও না, অরা খাইয়ে দেওয়ার পরও না, তার প্রিয় খেলনা নিয়ে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করানোর পরও না। শেষ রাতের দিকে আরশাদ টিভিতে ‘বেবি শার্ক’ গানটা ছাড়তেই শান্ত হলো সে।
তীব্র আকর্ষণ নিয়ে টিভি স্ক্রিনে দেখছে দুটি শিশুর হাত-পা দোলানো। বাচ্চাদের ওই গান কেমন লাগে কে জানে! তবে বড়দের কাছে গানটা অসহনীয়। একবার সেই সুর কানে এলেই বিরক্তিতে চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করে। আরশাদ আর অরা টানা এক ঘন্টা অসহায় ভঙ্গিতে সহ্য করলো সেই গান। বন্ধ করার চেষ্টা করলেই, চেঁচিয়ে উঠছে কল্প। সে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ার পরই শান্তি দুজনের।
কল্পর জন্যে একজন গভর্নেন্স রাখা হয়েছে।
কথার গভর্নেন্স পায়েলেরই ছোট বোন নূপুর।
যদিও একান্ত প্রয়োজন না হলে গভর্নেন্সের কাছে অরা রাখে না কল্পকে। নিজেই ছেলের কাছে থাকে পুরোটা সময়। একান্ত প্রয়োজন বলতে এই যে এখন, কল্পকে নূপুরের কাছে রেখে ব্রেকফাস্ট করতে এসেছে দুজনে।
আবার অনেক সময় দেখা যায়, অরা গোসলে গেছে ওদিকে আরশাদের জরুরি কল এসেছে অফিস থেকে। ওইটুকু সময় নূপুর কল্পকে সামলায়।
ঘুম কম হওয়ার কারণেই বোধ হয় ব্রেকফাস্টের টেবিলে রীতিমত ঝিমুচ্ছে আরশাদ। অরা ঝিমুচ্ছে না, তবে তার চোখদুটোও রক্তিম বর্ণ ধারণ করে আছে।সেলিনা হক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছেন দুজনকে।
ভাগ্যিস আশফিয়া আশেপাশে নেই। আজ কথার আর্ট স্কুলে সারাদিনব্যাপী কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। কথাকে নিয়ে সেখানে আছে সে। এখানে থাকলে খাবার টেবিলে ঝিমানোর জন্যে নির্ঘাত তার কাছে ধমক খেত হতো আরশাদকে।
সেলিনা হক হঠাৎ পরিষ্কার গলায় বললেন, “শোন আরশাদ, এবার কয়েকটা দিন আমি কল্পকে রাতের বেলা সামলাই। তুই রেস্ট নে।”
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “কেন?”
সেলিনা হক কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই অরা আঁতকে উঠে বলল, “না, না মা! কোনো দরকার নেই। আপনি কেন কষ্ট করতে যাবেন? আমিই সামলে নেবো। আপনার ছেলেকে তো আমি প্রতিদিন বলি রাতে আমি কল্পকে সামলাতে পারবো। ওকে জেগে থাকতে হবে না। তাও কোনো কথা শোনে না আমার।”
অরা হয়তো ভেবেছে ছেলের কষ্ট করে রাত জাগা নিয়ে চিন্তিত বলে সেলিনা হক কল্পকে নিজের কাছে রাখতে চাইছেন। তবে তিনি দুজনের কথাই ভাবছেন।
তাই তো হেসে বললেন, “আহা বৌমা! তোমাকে খোঁচা দেওয়ার জন্য বলিনি তো কথাটা। তুমি কি কম কষ্ট করছো? চোখের সামনেই তো দেখতে পাচ্ছি সবটা। তোমাদের দুজনেরই রেস্ট দরকার।”
অরা অনাবশ্যক জোর দিয়ে বলল, “আমার রেস্ট দরকার নেই মা। কল্পকে সামলাতে আমার ভালোই লাগে।”
“ভালো লাগা মন্দ লাগার প্রশ্ন উঠছে কেন?তুমি সারাটাদিন কল্পর পেছনে কাটিয়ে দিচ্ছো, আরশাদও রাত জেগে জেগে ওর দেখাশোনা করে যাচ্ছে। একনাগাড়ে কষ্ট করে গেলে মাঝে মাঝে বিশ্রামের প্রয়োজন হয়।”
অরা হাসি হাসি মুখ করে বলল, “সত্যিই কোনো প্রয়োজন নেই মা। রাতে ঘন্টায় ঘন্টায় আমার ঘুম ভেঙে যায়। কল্পকে আমিই দেখে রাখতে পারবো।”
“ঘন্টায় ঘন্টায় ঘুম ভেঙে গেলে আমার ঘরে এসে দেখে যাবে ছেলেকে।”
“কিন্তু মা…”
সেলিনা হক তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, “এ বিষয়ে আর কোনো কথা শুনতে চাচ্ছি না।”
রাতের কথা ভেবে এখনই ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিতে ভুগতে শুরু করলো অরা। কী দরকার শাশুড়ী মাকে এতটা কষ্ট দেওয়ার? ছেলে তার আস্ত একটা বিচ্ছু। নিজে তো রাতে ঘুমাতে চায়ই না, আশেপাশের মানুষকেও ঘুমাতে দেয় না।
আরশাদ আর সে নিঃশব্দে এই যন্ত্রণা সহ্য করে আসছে। করবে না-ই বা কেন? বাবা-মায়েরা অলিখিতভাবেই সন্তানদেরই দেওয়া যন্ত্রণা হাসিমুখে সহ্য করতে বাধ্য। কিন্তু সেলিনা হক তো বাধ্য নন। তিনি কেন সহ্য করবেন? এমনভাবে চেপে ধরেছেন, অরা নাও করতে পারছে না।
হসপিটাল থেকে ফিরেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো আরশাদ। বেচারা বোধ হয় প্রচন্ড ক্লান্ত। বালিশের মাথা রাখার এক মিনিটের মাথায় ঘুমে তলিয়ে গেছে সে। তাকে ঘুমানোর সুযোগ করে দিয়ে কল্পকে কথার ঘরের বাথরুমে গোসল করালো অরা।
কল্পকে নিয়ে বাগানে খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতেই সেও ঘুমিয়ে পড়লো। তাকে বাবার পাশে শুইয়ে দিলো অরা। কল্পর সঙ্গে কাটানো প্রত্যেকটা মুহুর্ত স্বর্গীয় আনন্দের। সে পৃথিবীতে আসার পর তো অরার ব্যস্ততার শেষ নেই। তবুও এই ব্যস্ততায় ঘেরা মুহূর্তগুলো তার কাছে সবথেকে আনন্দের।
মাঝেমাঝে ক্লান্ত লাগে ঠিকই, তবে কল্পর হাসিমাখা মুখটা চোখে পড়তেই সব ক্লান্তি যেন মাটিতে মিলিয়ে যায়। কিছুই আর ভালো লাগে না আগের মতো। একাকী কোনো একটা বই নিয়ে বসে থাকতে ভালো লাগে না, বাগানের সুইমিং পুলে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে ভালো লাগে না। এই যে কল্প ঘুমিয়ে পড়েছে, এতেও ভালো লাগছে না।
অরা যেখানেই যায়, সেখানেই শুধু কল্পর চিন্তা। গোসল করে চুল আঁচড়ানোর সময়, কল্প কীভাবে তার চুল টেনে ধরে ভেবেই আনমনে হেসে উঠলো অরা। আরশাদের ধারণাই শতভাগ সঠিক। বংশ পরম্পরায় সেই বিখ্যাত রাগ কল্প পেয়েছে। অরা তার চাহিদা বুঝতে না পারলে চেঁচিয়ে উঠে ছোট্ট হাতের মুঠোয় তার চুল টেনে ধরে।
হালকা কিছু খেয়ে অরাও ঘুমিয়ে পড়লো তাদের পাশে। অদ্ভুত ব্যাপার! আগে দুপুরে ঘুম দেওয়ার কথা অরা কল্পনাও করতে পারতো না। আর এখন, যখন সুযোগ পাচ্ছে তখনই ঘুমিয়ে নিচ্ছে।
বিকেলের দিকে ঘুম ভাঙলো তিনজনেরই। অফিস থেকে প্রোডাকশন টিম আর ফাইন্যান্স টিমের কয়েকজন এসেছে আরশাদের সঙ্গে জরুরি কথা বলছে। আরশাদ বসার ঘরে তাদের সঙ্গে কথা বলছে। তবে ঠিক কথা বলছে না ধমকাচ্ছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অন্য সময় হলে, অফিসের কী এমন প্রয়োজন হলো যে আরশাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে
– জানতে আগ্রহের কমতি থাকতো না অরার। তবে আজ তার কোনো আগ্রহ নেই। সব আগ্রহ কল্পতেই আটকে আছে।
আচ্ছা এমনটা কি সব মেয়েরই ক্ষেত্রেই হয়? সন্তানের মায়ায় পড়ে তারা কি সত্যিই কাজ ভুলে যায়? না-কি এটা ক্ষণিকের আবেগ? এজন্যেই কি তাহলে কর্মচারী হিসেবে নারীদের প্রতি তেমন একটা আস্থা রাখা হয় না?
ঘরে বসে কল্পকে খাওয়াচ্ছে অরা। কল্পর ছোট্ট হাতদুটো অরার মুখের ওপর বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। অরা হাসি মুখে তাকে এটা-ওটা বলছে। কল্প আগ্রহ ভরা চোখে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। ভাবতেই অবাক লাগে, এই ছোট্ট পদ্মফুলটার মা না-কি সে। ‘মা’ এই ভারী শব্দটার ভার অরা বইতে পারবে তো?
মিনিট দশেক পর ঘরে এলো আরশাদ। অরা আড়চোখে একবার তাকে দেখে চোখ নামিয়ে ফেলল। কলো টিশার্ট আর কালো ট্রাউজারে কেমন ঘোরলাগানো হ্যান্ডসাম লাগছে তাকে।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আরশাদ কতক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দুজনের দিকে। এরপর এগিয়ে এসে বসলো অরার মুখোমুখি। অরার কোলে থাকা কল্পর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো আলগোছে।
অরা মুগ্ধ ভঙ্গিতে বলল, “চুলগুলো একদম তোমার মতো ঘন।”
আরশাদ হেসে বলল, “তাই?”
অরা উজ্জ্বল গলায় বলল, “হুঁ। আর চোখদুটোও। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে যেন তোমাকে খুঁজে পাই।”
আরশাদ রহস্যের ভঙ্গিতে বলল, “আর কী কী মিল আছে আমাদের?”
অরা লজ্জামাখা গলায় বলল, “তোমাকে যখন জড়িয়ে ধরি, তোমার গা থেকে অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ পাই। কল্পর গায়ের গন্ধটাও ঠিক তেমন।”
অরা হঠাৎ লক্ষ্য করলো কল্প চোখ বড় বড় করে তার কথা শুনছে। আদুরে গলায় তাই ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তাই না আমার বাবাটা?”
আরশাদ কৃত্রিম অসহায়ত্বের সুরে বলল, “নাহ্! তুই তো দেখছি আমাকে বিপদে ফেলে দিলি জুনিয়র। মা এখন আমার থেকে বেশি তোকে ভালোবাসে।”
অরা হাসিমুখে কিন্তু জোর গলায় বলল, “ভালোবাসার কোনো বেশি-কম হয় না আরশাদ। মানুষ যাদের ভালোবাসে, সবার ক্ষেত্রেই ভালোবাসার মাত্রা একই থাকে।”
আরশাদ আচমকা অরার খুব কাছাকাছি চলে এলো। তার কানের সঙ্গে মিশিয়ে দিলো ঠোঁট। নিমিষেই কেঁপে উঠলো অরা।
আরশাদ ফিসফিস করে বলল, “That’s why I love you!”
দৃশ্যটা বোধ হয় পছন্দ হলো না কল্পর। চেঁচিয়ে উঠে মুঠো করে টেনে ধরলো মায়ের চুল।
আরশাদ হেসে বলল, “কী রে? আমার বউয়ের কাছে আমি এসেছি। তোর পারমিশন নিয়ে আসতে হবে?”
অরাও হেসে ফেলল আরশাদের কথায়। কল্প এতদিনে একটা ব্যাপার বেশ ভালো করেই আয়ত্ত্ব করতে পেরেছে। বাবা তার, মা তার। কিন্তু এটা এখনো বুঝে সারতে পারেনি যে বাবা আর মা একে অপরেরও।
ছেলেকে নিজের কোলে নিলো আরশাদ। সঙ্গে সঙ্গে তার একটা আঙ্গুল নিজের মুঠোর আয়ত্তে নিয়ে এলো কল্প।
“অরা?”
“হুঁ?”
আরশাদ বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে বলল, “একটা ব্যাপার ঠিক বুঝলাম না।”
অরা কিঞ্চিৎ চিন্তার সুরে বলল, “কোন ব্যাপার?”
আরশাদ গলার যথাসম্ভব গম্ভীর করে রাখার চেষ্টা করে বলল, “মা কি এত তাড়াতাড়ি আরেকটা কল্প চাচ্ছে?”
অরা বুকে ছোটখাটো ধাক্কার মতো খেয়ে বলল, “মানে?”
আরশাদের পক্ষে আর গম্ভীর থাকা সম্ভব হলো না। অরার ভয়ার্ত মুখটা দেখে তার ঠোঁটে হাসি লুকোচুরি খেলে বেড়াচ্ছে।
আরশাদ বহুকষ্টে গলায় স্বর স্বাভাবিক রেখে বলল, “না মানে, দেখলে না? কীভাবে আজ রাতে কল্পকে নিজের কাছে রাখতে চাইলো।”
অরা সোজাসাপ্টা উত্তরে বলল, “হ্যাঁ, যাতে আমরা রেস্ট নিতে পারি।”
আরশাদ এবার হেসে ফেলেই বলল, “অরা, তুমি বড্ড সহজ-সরল!”
অরা অসহায় ভঙ্গিতে বলল, “কেন?”
আরশাদ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “মা আজ রাতে কল্পকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছে আমাদের স্পেস দেওয়ার জন্য।”
অরা ভড়কে গিয়ে বলল, “হ্যাঁ?”
রীতিমত ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল অরা। কী সর্বনাশ! এমন চিন্তা তো তার মাথাতেই আসেনি। লজ্জায় লাল হয়ে গেল তার গালদুটো।
আরশাদ সহজ গলায় বলল, “হ্যাঁ! যাতে আমরা একে অপরের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পাই।”
অরা মাথায় হাত রেখে কম্পিত গলায় বলল, “ওহ! এটা তো আমার মাথাতেই আসেনি!”
লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছা করছে অরার। এজন্যেই আরশাদ ব্রেকফাস্টের টেবিলে চুপ করে ছিল? আর অরা কিনা নির্লজ্জের মতো বিষয়টা নিয়ে তর্ক করেই যাচ্ছিল শাশুড়ির সঙ্গে! এত বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে, এই সামান্য বিষয়টা ধরতে পারলো না?
অরার লজ্জাটা বরাবরের মতোই দারুণ উপভোগ করছে আরশাদ।
হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠেই সে বলল, “হয়েছে, হয়েছে এত লজ্জা পেতে হবে না। সুযোগটা কাজে লাগানোর চেষ্টা কোরো, তাহলেই হবে।”
চোখ বড় বড় আরশাদের দিকে তাকালো অরা। গালদুটো বোধ হয় আরেক দফা রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। আরশাদ ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরার দিকে। লজ্জা পেলে একটা মানুষকে এতটা সুন্দর লাগতে পারে?
অরাকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে দরজার টোকা পড়লো।
আরশাদ কল্পকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে
দাঁড়াতে বলল, “চল তো দেখি, কে এসেছে!”
দরজা খুলতেই অপরপ্রান্তে আরশাদ দেখলো কথাকে। গোলাপি রঙের ফ্রকে তাকে আজ সত্যিকারের প্রিন্সেসের মতো লাগছে। তার কাঁধে ঝুলন্ত বেগুনি রঙের ব্যাকপ্যাক থেকে উঁকি দিচ্ছে রোল করে রাখা বড় একটা কাগজ।
কথা দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কথা বলল, “বাবা!”
অরা কোমল স্বরে বলল, “মা! কেমন হলো তোর ওয়ার্কশপ?”
কথা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “অনেক সুন্দর! আজকে আমি অনেক বড় একটা ছবি এঁকেছি!”
আরশাদ আগ্রহ নিয়ে বলল, “কই দেখি, কী এঁকেছিস?”
কথা জেদ ধরে বলল, “দেখাবো তো! আগে কল্পকে দেখবো।”
“বাইরে থেকে এসেছিস না মা। আগে হাত ধুয়ে আয়।”
অরা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “চল আমি হেল্প করে দিচ্ছি।”
কথা অরার সঙ্গে ফ্রেশ হয়ে এসেই কল্পকে কোলে নিয়ে বিছানায় বসলো। যদিও অরা কল্পর মাথার দিকটা ধরে রেখেছে। কথার ছোট্ট কোলে উঠে দারুণ মজা পাচ্ছে সে। একটু পর পর হেসে উঠছে। কথাও একটু পর পর হয় তার গাল টিপে দিচ্ছে না হয় গালে চুমু খাচ্ছে। আরশাদ আর অরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে তাদের দুই বিচ্ছুর কর্মকান্ড।
অরা আদুরে গলায় বলল, “কল্প! বল তো আমি কে?”
কল্প কী যেন মনে করে ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো।
কথা সঙ্গে সঙ্গে ধমকের সুরে বলল, “ওদিকে তাকাচ্ছিস কেন? আমার দিকে তাকা!”
আরশাদ বিস্মিত গলায় বলল, “মা? ভাইকে কেউ এভাবে ধমক দেয়?”
কথা জোর গলায় বলল, “দেয় তো। তুমি ফুপির ভাই না? ফুপি তো সারাক্ষণ তোমাকে ধমক দেয়।”
কথার এই কথায় আরশাদ আর অরা দুজনেই হেসে ফেলল। আসলেই তো, আশফিয়া বলতে গেলে সর্বক্ষণই ধমকের ওপরে রাখে আরশাদকে। এটাই বড় বোনদের জন্মগত অধিকার। তারা ভালোবাসে এক আকাশ সমান, শাসনও করে ঠিক ততটাই।
অরা হঠাৎ নরম সুরে বলল, “কথা? ভাই হয়েছে বলে কি তুই মন খারাপ করেছিস?”
কথা ভ্রু কুঁচকে বলল, “মন খারাপ করবো কেন মাম্মাম?”
“ও পৃথিবীতে আসার আগে তো বোন চেয়েছিলি তুই।”
কথা হেসে ফেলে বলল, “ধুর! তুমিই তো বলেছিলি, ভাই-বোন যেই আসুক সে ছোট্ট কথা হবে। মন খারাপ করবো কেন?”
অরা কথার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “সেজন্যেই তো কথা আমার লক্ষ্মী বাচ্চা!”
বেশিক্ষণ ভাইকে কোলে রাখতে পারলো না কথা। রাখবে কী করে? নিজেরই তো এখনও কোলে থাকার বয়স পাড় হয়নি! কল্প আবারও ফিরে গেল বাবার কোলে। আর কথা এসে বসলো মাম্মামের কোলে।
কল্পকে ঘিরে কথার কৌতূহলের শেষ নেই। কৌতূহলী ভঙ্গিতে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে সে।
“আচ্ছা বাবা? কল্প কি বড় হলে আমার সাথে স্কুলে যাবে?”
“হ্যাঁ, যাবে তো।”
“আর্ট ক্লাসেও যাবে?”
“ওর ছবি আঁকতে ভালো লাগলে যাবে।”
“আর ভালো না লাগলে?”
আরশাদ খানিকটা চিন্তা করে বলল, “ওর যা ভালো লাগবে, সেটার ক্লাস করবে।”
কথা দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “আর্ট ভালো লাগতেই হবে। আমার ভাই হয়ে ছবি আঁকবে না, তা হয় না-কি?”
নিজের পছন্দকে ছোটজনের ওপরে চাপিয়ে দেওয়াও বড় বোনদের আরেকটি জন্মগত অধিকার। কথা সেই অধিকার থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবে কেন?
অরা হঠাৎ চমকে উঠে বলল, “এই কথা! আজকের ছবিটা তো দেখালি না।”
কথা এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ভুলেই গিয়েছিলাম। দাঁড়াও দেখাচ্ছি।”
কথা উঠে গিয়ে তার ব্যাগ থেকে রোল করে রাখা কাজগটা বের করে আনলো। বিছানার ওপরে সেটা মেলে ধরতেই মুগ্ধতার হওয়া বয়ে গেল আরশাদ আর অরার গা বেয়ে। সুবিশাল সমুদ্র, বড় বড় নীলাভ ঢেউ এগিয়ে আসছে। আর সমুদ্রের তীরে বসে আছে আরশাদ, অরা, কথা আর কল্প। চারজনের মুখেই প্রচ্ছন্ন হাসি। সূর্যের আলো এসে পড়ছে তাদের মুখের। ছবিটার উপরিভাগে বড় বড় ইংরেজি অক্ষরে লেখা ‘MY HAPPY FAMILY’।
এক ঘন্টার ব্যবধানে ছবিটা দোকানে পাঠিয়ে ফ্রেমে বাঁধাই করিয়ে আনলো অরা। বসার ঘরে আরশাদের অ্যাওয়ার্ড রাখার বিশাল শেলফের একটু পাশেই ঝুলিয়ে দিলো ছবিটা। এ বাড়িতে যেই আসবে, আরশাদের শত শত প্রাপ্তির পাশাপাশি চোখে পড়বে সবথেকে বড় প্রাপ্তিটা।
রাতে সেলিনা হক নিজ দায়িত্বে নিয়ে গেলেন কল্পকে। অরার তো লজ্জায় রীতিমত মাথা কাটা যাচ্ছে। উনার ঘরে গিয়ে বিস্ময়ে খাবি না খেয়ে পারলো না অরা। রাতে যে কল্পের চোখে ঘুম নেমে আসার প্রশ্নই ওঠে না, দাদির ঘরে গিয়ে দুদিকে দুহাত ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে সে। একফোঁটাও জ্বালাচ্ছে না সেলিনা হককে। তাহলে কি তার সমস্ত জ্বালানো কেবল বাবা-মায়ের জন্যেই প্রযোজ্য?
বারান্দার সুইমিংটা কাঁচ দিয়ে ঘেরা। সেই কাঁচের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝের ওপর বসে আছে অরা। আরশাদটা তাকে বসিয়ে রেখে কোথায় গেল কে জানে? চোখদুটো বুজে স্মৃতিচারণ করছে অরা। তাদের হঠাৎ বিয়ের মাত্র কয়েক মাস আগে, তীব্র মাইগ্রেন নিয়ে নিজেকে ঘরে বন্দি করে রেখেছে আরশাদ। ওষুধ খাচ্ছে না, ডক্টরকে দেখা দিচ্ছে। নিজেকে ইচ্ছা করে কষ্ট দেওয়াটাই যেন তার নেশায় পরিণত হয়ে উঠেছিল।
অরাই তো ছুটে এসে জেদ ভাঙতে। দরজা খুলিয়ে চিকিৎসা নিতে বাধ্য করে। সেদিন এই বারান্দায় বসেই কফি খেতে খেতে আরশাদ বলেছিল, “তোমাকে মাঝেমধ্যে বকাঝকা করি। কারণ বকা খাওয়ার মতো কাজ তুমি করো। তারপরও কাজের প্রতি তোমার সিরিয়াসনেস দেখে আমি খুশি।”
ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভেবে আনমনেই হেসে উঠলো অরা। সেদিন তারা কী ভেবেছিল, এই বারান্দাটা একদিন তাদের দুজনের হবে?
বারান্দায় পা রাখলো আরশাদ। তার দু হাতে দুটো মগ। অরাকে একনজর খেলেই তার সারা শরীরে তরঙ্গের ন্যায় কী যেন খেলে গেল। গাঢ় ল্যাভেন্ডার রঙয়ের একটা জামা তার গায়ে, আর গাঢ় খয়েরী স্কার্ট। চুলগুলো খোঁপা করে বেঁধে রেখেছে। হঠাৎ হঠাৎ অরাকে এভাবে দেখলে যেন মনে হয় যেন এই তাকে প্রথম দেখা। যদিও অরাকে প্রথম দেখে তার প্রেমে পড়েনি আরশাদ। তবুও কেন মনে হয় এমনটা?
নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে গেল আরশাদ। তাকে দেখে প্রচ্ছন্ন একটা হাসি নিক্ষেপ করলো অরা। হাসিটা যেন আরেকদফা এলোমেলো করে দিলো তাকে।
আরশাদ কম্পিত স্বরে বলল, “মাটিতে বসে আছো কেন অরা?”
অরা অপরাধী ধরা পড়ার মতো ভঙ্গিতে হেসে বলল, “এখানেই ভালো লাগছে। তুমিও বসো না!”
আরশাদ বসতে বসতে একটা মগ অরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “তোমার প্রিয় কফি!”
অরা অবাক গলায় বলল, “তুমি বানিয়েছো?”
“হুঁ।”
অরা আগ্রহ নিয়ে এক চুমুক দিলো কফি মগে। চোখদুটো বুজে আবেশে হারিয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। যেন এর থেকে সুস্বাদু কিছু সে এ জীবনে খায়নি, ভবিষ্যতে খাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
অরা প্রশংসার ভঙ্গিতে বলল, “কত দিন পর তোমার হাতের কফি খাচ্ছি!”
আরশাদ মুগ্ধ দৃষ্টি দেখছে অরার কফি খাওয়া।
অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে আরশাদের দিকে তাকিয়ে সতর্ক কণ্ঠে বলল, “কিন্তু আরশাদ? এত রাতে কফি খেলে ঘুম আসবে না তো।”
আরশাদ অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ তো? তুমি কি আজ রাতে ঘুমানোর প্ল্যান করে বসে আছো?”
বরফের মতো জমে আরশাদের দিকে তাকিয়ে রইলো অরা। প্রাণপণ চেষ্টা করছে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে, তবে পারছে না। মোহনীয় কোনো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে তার গা বেয়ে।
আরশাদ নিজের মগে চুমুক দিয়ে দুষ্টুমিমাখা কণ্ঠে বলল, “খাও অরা। রাত জাগতে হবে তো!”
অরা দুর্বলভাবে চুমুক দিয়ে বলল, “একটা মানুষ এত অসভ্য হতে পারে কী করে?”
আরশাদ জোর গলায় বলল, “সমস্যা কোথায়? বিয়ে করা বউয়ের কাছে অসভ্য হচ্ছি। অন্য কারো কাছে তো আর না।”
কফি শেষ করে আরশাদের বুকের মাঝে গা এলিয়ে দিয়ে বসে রইলো অরা। আরশাদ কোমল স্পর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছে তার পিঠজুড়ে। তার একেকটা স্পর্শ একটু একটু করে আলোড়ন বাড়িয়ে তুলছে অরার মনে। তবুও ঠিক আগের মতোই পড়ে রইলো সে।
আরশাদ হঠাৎ নরম স্বরে বলল, “তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে না?”
অরা হেসে বলল, “কই? না তো!”
“আমার কাছে মিথ্যা বোলো না অরা। নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছি তোমার কষ্টটা। সেই প্রেগন্যান্সির শুরু থেকে কষ্ট করে আসছো। এই ছোট্ট পেটের ভেতরে একটু একটু করে বড় করে তুলেছো আমাদের বাবুকে। ডেলিভারির সময়ও কত কষ্ট করলে।”
অরা স্নিগ্ধ গলায় বলল, “শুধু কষ্টের কথা ভাবলেই হবে। কষ্টের ফলটা কত সুন্দর, সেটা ভাবছো না? তুমিও তো কল্পর জন্যেই কষ্ট করছো। পুরো দেশ তোমার নতুন সিনেমার অপেক্ষা করছে, আর তুমি শুটিং বাদ দিয়ে কল্পর কাছে আছো।”
আরশাদ হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলল, “নতুন প্যারেন্টসদেরকে কাজ একটু-আধটু স্যাক্রিফাইজ করতেই হয়। তুমি করছো না?”
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো অরা। কয়েকদিন ধরেই একটা ব্যাপার ঘুরপাক খাচ্ছে তার মনের মাঝে। কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতেও ভুগছে অরা। ব্যাপারটা আরশাদকে বলা না পর্যন্ত অস্বস্তি কাটবেও না।
অরা ক্ষীণ গলায় বলল, “আরশাদ? তোমার একটা পরামর্শ দরকার আমার?”
আরশাদ কৌতুহল নিয়ে বলল, “কী পরামর্শ?”
অরা শুকনো গলায় বলল, “তোমার কি মনে হয়, আমার সিইওর পোস্ট থেকে রিজাইন করা উচিত?”
আরশাদ হতবিহ্বল কণ্ঠে বলল, “মানে? রিজাইন করবে কেন?”
অরার এই চিন্তার পেছনে নিজ স্বার্থের চিন্তা নেই। নিজে তো সে অফিসে ফিরতেই চায়। এমন নয় যে, অফিসের প্রতি তার সকল আগ্রহ হারিয়ে গেছে। অফিসটা তার দ্বিতীয় সংসারের মতো। সেজন্যেই অফিসের স্বার্থে ভাবছে অরা। তার শূণ্যতার প্রভাব কি অফিসে পড়ছে না? নিশ্চয়ই পড়ছে। এই শূণ্যতায় কতদিন আর ভোগাবে অফিসকে?
অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “দেখো, প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল আমি অফিসের বাইরে। আরও পাঁচ মাস পর আমার লিভ শেষ হবে। তাও কল্পকে সামলে অফিসকে কতটুকু সময় আমি দিতে পারবো, জানি না। কে ফিল্মস এখন সাফল্যের চূড়ায়। এই সময়ে এমন একজন সিইওর দরকার, যে পুরোটা সময় অফিসকে দিতে পারবে।”
আরশাদ একহাতে শক্ত করে অরাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “অরা, এই চিন্তা ভুলেও কোরো না। ক্যারিয়ার ক্যারিয়ারের জায়গায়, আর পার্সোনাল লাইফ পার্সোনাল লাইফের জায়গায়। আমাদের জীবনে কল্প এসেছে বলে কাজ কী থেমে থাকবে?”
চিন্তায় পড়ে গেল অরা। যুক্তি তো আছে আরশাদের কথায়।
আরশাদ তার মোহনীয় কণ্ঠে বলল, “আমি সবসময় চাই তুমি ক্যারিয়ারে ফোকাস করো। আমার বউ, কল্পর মা এই পরিচয়গুলো বাইরে আলাদা একটা পরিচয় আছে তোমার। অনেক পরিশ্রম করে নিজেই ওই পরিচয়টা তৈরি করেছো তুমি। আমি চাই মানুষ সেই পরিচয়েই চিনুক তোমাকে।”
মুগ্ধতায় হাওয়ায় গা ভাসালো অরা। ছেলেরা না-কি বউয়ের কাজ করা নিয়ে ইন্সিকিউরিটিতে ভোগে? কোথায়? এই ছেলে তো সমাজের এই ভ্রান্ত ধারণাগুলো এক এক করে ভুল প্রমাণিত করছে।
আরশাদ আবারও বলল, “এখন অফিসে সময় দিতে পারছো না, আমি ম্যানেজ করে নিচ্ছি তো। দরকার হলে আরও সময় নাও। অফিসে আবারও জয়েন করার পর আমাকে পাশেই পাবে অরা। তবুও ক্যারিয়ার ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবো না।”
অনেকটা সময় চুপ করে রইলো অরা। অবশেষে আরশাদের বুকের মাঝে হারিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল, “তুমি কি আসল?”
আরশাদ হেসে ফেলে বলল, “মানে?”
অরা থেমে থেমে বলল, “মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি শুধুই আমার কল্পনা।”
আরশাদ গাঢ় স্পর্শে বুকের ওপর থেকে অরার মুখটা তুলে ঠিক তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কল্পনা হই আর বাস্তব, আমি যে তোমার এতে কোনো সন্দেহ নেই।”
একে অপরের চোখের মাঝে ডুব দিয়ে কতটা সময় তারা রইলো তার কোনো হিসাব নেই। ওই দুটো চোখের মাঝে হাজারো অনুভূতির আনাগোনা দেখতে পাচ্ছে অরা। তার জন্যে আরশাদের ভালোবাসা, আকাঙ্ক্ষা, তৃষ্ণা সব এক হয়ে ধরা দিচ্ছে। তার চোখে আরশাদ কী দেখতে পাচ্ছে কে জানে!
আরশাদ ফিসফিস করে বলল, “কিন্তু তোমার মনে যখন এতই সন্দেহ, তখন চলো দেখিয়েই দিই আমি আসল না নকল।”
আরশাদের হঠাৎ কী যে হলো! বিদ্যুতের গতিতে অরার উঠিয়ে বসলো তার কোলে। অকস্মাৎ এমন কান্ডে রীতিমত হকচকিয়ে গেল অরা। বেচারি দম নিয়ে নিজেকে সামলাবে, সেই সময়টুকুও পেলো না। তার কানের নিচে হাত রেখে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে আরশাদ। শীতল প্রশান্তিময়, ধীরস্থির কোনো চুমু এটা নয়। উষ্ণ তৃষ্ণার্ত, বজ্রালো বর্ষণের মতো চুমু খাচ্ছে আরশাদ। উত্তেজনায় নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ অরা খামচে ধরেছে তার টিশার্ট।
নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই আজ আরশাদের। নিজেও জানে না কতটা প্রগাঢ়ভাবে এলোমেলো করে দিচ্ছে সে অরাকে। ঠোঁটে ঠোঁট রেখেই আরশাদ অরার খোঁপায় বাঁধা চুলগুলোকে বাঁধনমুক্ত করে দিলো। চুলের মাঝে হাত ডুবিয়ে নিবিড়ভাবে চুমু খেয়েই যাচ্ছে।
অরার সারা শরীরে কাটা দিয়ে উঠছে। নিজেকে আজ একেবারেই পোষ মানিয়ে রাখতে পারছে না নিজের কাছে। সবটুকু সমর্পণ করতে চাইছে আরশাদের কাছে। প্রবল এক ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে আছে সে। যে ঘোরের জগতে কেবলই তার আর আরশাদের বিচরণ। অরার দিশেহারা হাতদুটো কখন যে আরশাদের টিশার্ট খুলতে চলে গেল, সে নিজেও জানে না।
আরশাদ হঠাৎ তার ঠোঁটদুটো ছেড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “এই মেয়ে! এখন কোথায় তোমার লজ্জা?”
লজ্জা পেয়ে তড়িৎ গতিতে হাতদুটো সরিয়ে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চাইলো অরা। আরশাদ মাঝপথেই আটকে দিলো তার দৃঢ় হাত দিয়ে।
কানের কাছে ঠোঁট এমে ফিসফিস করে বলল, “খবরদার! যেটা শুরু করেছো, শেষ করো।”
লজ্জার মাথা খেয়ে অরা নিজেই টেনে খুললো আরশাদের টিশার্ট। আরশাদের উন্মুক্ত পুরুষালি শরীর যেন শিহরণের বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে অরাকে। কাঁপা কাঁপা একটা হাত রাখলো তার উন্মুক্ত বুকের ওপর। অরার এই এতটুকু স্পর্শই যথেষ্ট আরশাদকে পাগল করে দেওয়ার জন্যে।
অরার চুলের মাঝে হাত রেখে আরশাদ মুখ ডুবিয়ে দিলো তার ঘাড়ে। একের পর এক অনবরত ঠোঁটে স্পর্শে শিহরিত করে তুলছে সে অরাকে। কম্পিত নিঃশ্বাসে নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে অরা।
হঠাৎ আরশাদের হাতটা চলে গেল অরার জামার চেইনে। তার কানের নিচে ঠোঁট মিশিয়ে রেখে এক নিমিষে টেনে খুলে ফেলল চেইনটা।
আরশাদ উন্মুক্ত পিঠে হাত ডুবিয়ে দিতেই কেঁপে উঠলো অরা।
অরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আরশাদ?”
আরশাদ অরার মাঝে ডুবে থেকেই বলল, “অরা?”
অরা অস্থির কণ্ঠে বলল, “ঘরে চলো।”
অরার এইটুকু কথা বিদ্যুতের মতো খেলে গেল আরশাদের সারা শরীরে।
তবুও নিজেকে সামলে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “বাব্বাহ! লজ্জাবতীর এত তাড়া?”
লজ্জায় লাল হয়ে আরশাদের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলল অরা। আরশাদ তাকে কোলে নিয়েই উঠে দাঁড়ালো। আবারও তার ঠোঁটদুটো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পা বাড়ালো ঘরের দিকে। আবারও তাদের জীবনে নেমে এলো ভালোবাসাময় উজ্জ্বল এক রাত। যে রাতে যেন অন্ধকারে চিহ্ন নেই। চারিদিকে কেবলই আলোর বিচ্ছুরণ।
(চলবে)