#ফিরে_আসা২
৭৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
খোলা জানালাটা দিয়ে শীতল বাতাস বয়ে আসছে। পর্দার পুরু স্তর ভেদ করে সেই হাওয়া এসে লাগলো অরার গায়ে। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো আরশাদের শক্ত বাহুডোরে। পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমের জগতে ডুবে আছে আরশাদ। একরাশ লজ্জারা চারিদিক থেকে এসে ঘিরে ধরলো তাকে। ছেলেটা এমন সব কান্ড করে! লজ্জা না পেয়ে আর উপায় কী? লজ্জার সঙ্গে অবশ্য খানিকটা ভালোলাগায় কাজ করছে। কতগুলো দিন পর সে আরশাদের এতটা কাছাকাছি!
অরার নড়াচড়ায় আরশাদের ঘুমটাও ভেঙে গেল। আধবোজা চোখে আরশাদ গাঢ় একটা চুমু খেল অরার ঘাড়ে। তার অকস্মাৎ এমন কান্ডে বিদ্যুতের গতিতে কেঁপে উঠলো অরা।
আরশাদ তার কানের সাথে ঠোঁট মিশিয়ে ফিসফিস করে বলল, “Good Morning.”
নিজের অজান্তেই প্রচ্ছন্ন একটা হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁটে। রোজ সকালে আরশাদের গুড মর্নিংগুলো যেন তার আবশ্যিক পাওনা। সে এই পাওনা না মেটানো পর্যন্ত দিনটাই শুরু হয় না অরার।
অরা অস্পষ্ট স্বরে বলল, “Good Morning.”
আরশাদ তাকে আরেকটু নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল, “ঘুম ভালো হয়েছে?”
উত্তর দিলো না অরা। লজ্জায় চোখদুটো বুজে রইলো। এতগুলো দিন হয়ে গেল আরশাদের অসভ্য আদরে জর্জরিত সে। তবুও কেন লজ্জারা পিছু ছাড়ে না তার?
আরশাদ তার মোহনীয় কণ্ঠে বলল, “Thank you.”
অরা কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে বলল, “কেন?”
আরশাদ দুষ্টু হাসি হেসে বলল, “এত সুন্দর একটা রাত উপহার দেওয়ার জন্য।”
এক লাফে অরার হৃদস্পন্দন বেড়ে আকাশচুম্বী হয়ে উঠলো। লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার মতো অবস্থা!
অরা ব্যস্ত ভঙ্গিতে আরশাদের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল, “ছাড়ো, আমি উঠবো।”
তবে আরশাদ তো তাকে এত সহজে ছাড়বে!
বউকে আরও খানিকটা লজ্জায় ডুবিয়ে তার লজ্জারাঙ্গা রক্তিম মুখটা দেখে তবেই তার শান্তি।
আরশাদ তাকে আটকে দিয়ে বলল, “উহুঁ! আরেকটু থাকো।”
নিজ দায়িত্বে অরাকে নিজের দিকে ফেরালো আরশাদ। তার চোখের দিকে তাকাতে পারছে অরা। বুজে রেখেছে লজ্জায়। এলোমেলো কতগুলো চুল এসে পড়েছে অরার মুখের ওপরে। আরশাদ তার দৃঢ় হাতের স্পর্শে সরিয়ে দিলো সেই চুলগুলোকে। এতটুকুতেই কেঁপে উঠলো অরা। আরশাদ তার বুজে রাখা চোখদুটোতে তার ঠোঁটের সম্মোহনী স্পর্শ দিতেই আরেকদফা কেঁপে উঠলো অরা।
আরশাদ দুষ্টুমির ছলে বলল, “কেন তোমার ভালো লাগেনি?”
অরা চোখদুটো বুজে রেখেই বলল, “কী?”
“কালকের রাতটা!”
অরা লজ্জায় আরশাদের বুকে মুখ লুকিয়ে অসহায় কণ্ঠে বলল, “উফ! এসব কী কথা আরশাদ?”
আবারও অরাকে আঁকড়ে ধরলো আরশাদ।মেয়েটাকে বুকে ধরলেই যেন তার সমস্ত শূণ্যতাগুলো পূর্ণতা পায়। মনের মাঝে জমতে থাকা সকল ক্লান্তিরা ছুটে পালিয়ে যায়। অরার মাতাল হয়ে শুনছে আরশাদের শান্ত হৃদয়টার ধুকপুক। প্রত্যেকটা স্পন্দনে যেন তারই নাম লেখা। ছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে তাকেই ডাকছে আরশাদের হৃদয়টা।
কিছুটা সময় পর অরা হঠাৎ বলে উঠলো, “দেখো তো, এখানে জ্বলছে কেন জানি!”
অরা তার ঘাড়ের নিচের দিকে হাত দিয়ে দেখলো। আরশাদ কয়েক মুহূর্ত ভালো করে খেয়াল করে বাঁকা হাসি হেসে বলল, “কেউ একজন কামড় দিয়েছে।”
অরা আঁতকে উঠে বলল, “সর্বনাশ! দাগ বসে গেছে না?”
আরশাদ গর্বিত সুরে বলল, “হুঁ।”
অরা ঠোঁট উল্টে বলল, “আরশাদ! এখন আমি এটা নিয়ে মানুষের সামনে যাবো কীভাবে? সব সময় এমন করো তুমি!”
আরশাদ জোর গলায় বলল, “করবোই তো! প্রত্যেকবার আদর করার সময় একটা না একটা চিহ্ন রেখে যাবো।”
মুগ্ধ দৃষ্টিতেই নিজের দেওয়া ভালোবাসার চিহ্নের দিকে তাকিয়ে আছে আরশাদকে। অরার ফর্সা ঘাড়ে লালাভ দাগটা রক্তজবার মতো ফুটে উঠছে। এদিকে অরা গোমড়া মুখে তাকিয়ে আছে আরশাদের দিকে।
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুমিও একজন কম না-কি? যেভাবে আপনার পিঠ জ্বলছে, না জানি কতগুলো খামচি দিয়েছো। নিজের চোখেই দেখো।”
অরা তড়িৎ গতিতে বলল, “না থাক।”
আরশাদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, “থাক মানে? দেখতেই হবে!”
আরশাদ উঠে বসতেই তার উন্মুক্ত পিঠ চোখে পড়লো অরার। চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইচ্ছা হলো, এই পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোনো গ্রহে চলে যেতে। তার নখের আঁচড়ে ভরে আছে সারা পিঠ। যদিও অরার নখগুলোর আকৃতি প্রকান্ড নয়। গতকালই সদ্য নখ কাটার কারণে ধারালো হয়ে ছিল নখগুলো শেষ প্রান্ত। আর সেই ধার তার সবটুকু প্রভাব গিয়ে ফেলেছে আরশাদের পিঠের ওপরে।
অরা গোসল সেরেই চলে গেল কল্পর কাছে। সেলিনা বিছানায় তার পাশেই খবরের কাগজ মেলে বসে আছেন। অরা ঘরে প্রবেশ করতেই খবরের কাগজ নামিয়ে রেখে মিষ্টি হাসি নিক্ষেপ করলেন তার দিকে। কল্পর ঘুম ভাঙ্গেনি এখনো। ডান দিকে কাত হয়ে ঘুমে ডুবে আছে সে।
অরার ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে তার গালে চুমু খেয়ে বলল, “আপনাকে খুব জ্বালিয়েছে না মা?”
সেলিনা হক হাসিমুখে বললেন, “একদমই না। শান্ত বাচ্চার মতো ঘুমিয়ে ছিল কল্প। রাতে একবার জেগে উঠেছিল, মুখের কাছে ফিডার ধরতেই আবারও ঘুমিয়ে পড়লো।”
অরা অবাক গলায় বলল, “কী সাংঘাতিক! আমাদের কাছে তো ঘুমাতেই চায় না।”
সেলিনা হক আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন, “দাদির ঘরটাই ওর পছন্দ হয়েছে। আমি ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমার কাছেই থাকুক রাতে।”
চুপ করে রইলো কয়েক মুহূর্তের জন্যে অরা। ঢাকায় সেলিনা হকের মন টেকে না। যান্ত্রিক এ শহরে এলেই তার মনটা সিলেটের জন্যে ছটফট করে। সেখানকার হাওয়ায় অন্যরকম একটা প্রশান্তি খেলে বেড়ায়। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে একদমই কষ্ট হয় না তার। বিষয়টা খুব ভালো করেই জানে অরা। তবুও তার খুব ইচ্ছা, সেলিনা হক যেন এখানেই থেকে যান। তাদের মাথার ওপরের ছাদ হয়ে থাকেন সর্বক্ষণ।
অরা শুকনো গলায় বলল, “ফিরে কি যেতেই হবে মা? থেকে যান না আমাদের সাথে।”
আশফিয়া ঘরের বাইরেই একজন স্টাফকে কথার ঘর পরিষ্কার করার নির্দেশনা দিচ্ছিলো। অরার কথাটা কানে আসতেই সে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে করতে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “সেটাই তো আমি বলি! আমরা দুজন এখানে, সিলেটে কী আছে যে তুমি ওখানে পড়ে থাকবে?”
সেলিনা হক মলিন হাসি হেসে বললেন, “বাড়িটা তো আছে।”
আশফিয়া কঠিন গলায় বলল, “বাড়ি বাড়ির মতো থাকুক। তুমি কার জন্যে ওই বাড়িটা আঁকড়ে ধরে থাকবে? যে লোকটা আমাদের সবাইকে ছেড়ে গেছে তার জন্য?”
মায়ের ওপর মাঝেমাঝে বড্ড রাগ হয় আশফিয়ার। সে বেশ বুঝতে পারে, যে বাবা তাদের দুর্যোগের মাঝে ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছিলেন সেই বাবার জন্যে আজও মায়ের মনে অতি সূক্ষ্ম একটা জায়গা আছে।
সেলিনা হক অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন, “না রে মা। আমার নিজের জন্য। তোদের বাবাকে বিয়ে করে ওই সংসারে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু কয়েক বছর পরও সেটা আমার নিজের হয়ে ওঠে। ওই বাড়ির প্রত্যেকটা কোণা
আমার নিজ হাতে সাজানো। জীবনের বেশির ভাগ সময় ওখানেই কাটিয়েছি। বাড়িটার ওপর আমার অধিকারই সবথেকে বেশি। নিজের জন্যে আঁকড়ে ধরে আছি বাড়িটাকে।”
একটা ইট-পাথরের বাড়িও কী সুতীব্র মায়ায় জড়িয়ে রাখতে পারে মানুষকে? অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। মেয়েরা কেবল একটা বাড়িতে থাকেই না, বাড়িটাকে নিজের করে রাখতে জানে। এই যেমন অরা, বিয়ের আগে না জানি কত হাজারবার এসেছিল এ বাড়িতে। কখনো আরশাদের জরুরি তলবে, কখনো কাজের প্রয়োজনে। তখন এই বাড়িটা ছিল কেবলই তার বসের বাড়ি। সেই বসের বাড়িটাতেই একটু একটু করে নিজের অধিকার জমিয়েছে অরা। নিজের করে নিয়েছে এ বাড়ির প্রতিটা কোণা।
অরা অনুরোধের সুরে বলল, “তবুও মা, ওখানে একা একা কাজের লোকদের নিয়ে থাকেন আপনি। কখন কী সমস্যা হলো, আমরা তো জানতেও পারি না। তাছাড়া আমাদের মাথার ওপরেও তো সবসময় আপনাকে দরকার।”
সেলিনা হক প্রচ্ছন্ন হাসি হেসে বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে। এখন থেকে ঘন ঘন আসবো। তোমাদের জন্য না হলেও, আমার দিদিভাই আর দাদুভাইয়ের জন্যে তো আমাকে আসতেই হবে।”
কল্পকে কোলে নিয়ে ঘরে আসতেই সে জেগে গেল। চোখ খুলতেই মাকে দেখে দাঁতহীন মাড়ি বের করে হেসে উঠলো। আবার ঠিক পরমুহূর্তেই তার সতর্ক চোখদুটো ব্যস্ত হয়ে খুঁজতে লাগলো বাবাকে। আরশাদ গোসলে গেছে। না হলে এতক্ষণে কোলে নিয়ে ছেলেকে আদর করতে বিন্দুমাত্র ভুল করতো না সে।
অরা কল্পকে খাইয়ে দিচ্ছে। সামনেই টিভি চলছে। কল্পকে কোলে দোল দিতে দিতে স্ক্রিনের নিচে ভেসে ওঠা নিউজ স্ক্রলে চোখ বোলাচ্ছে অরা। হঠাৎ টিভি স্ক্রিনে ভেসে উঠলো আরশাদের একটা অ্যাড। কফির এই অ্যাডে সাদা টি শার্ট আর মেরুন রঙের শার্টে দারুণ হ্যান্ডসাম লাগে তাকে। মুহূর্তেই উজ্জ্বল এক হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁটে।
অরা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে টিভির দিকে আঙুল তাকে করে বলল, “কল্প দেখ, দেখ! তোর বাবা টিভিতে!”
মায়ের উচ্ছ্বাসের কারণ জানতে কল্পর কৌতূহলী চোখদুটোও গিয়ে পড়লো টিভির ওপরে। টিভিতে বাবাকে দেখে বিস্ময়ে চোখদুটো বড় বড় করে রইলো কল্প! কী আশ্চর্য! তার বাবা টিভির মধ্যে ঢুকে গেল কী করে?
ছেলের বিস্ময়ে মজা পেয়ে অরা হেসে উঠে বলল, “আবার দেখবি?”
অ্যাডটা শেষ হতেই অরা অন্য একটা চ্যানেলে গিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই সেখানে আবারও ভেসে উঠলো আরশাদের আরেকটা অ্যাড। এই অ্যাডটা একটা মোবাইল কোম্পানির। কল্পর বিস্ময় যেন আজ সকল সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
এতক্ষণে আরশাদ বেরিয়ে এসেছে গোসল সেরে। তার অ্যাডে কল্পকে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজের অজান্তেই বিস্তৃত হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে।
এগিয়ে গিয়ে কল্পর কপালে চুমু খেলো আরশাদ। আবারও বেড়ে গেল তার বিস্ময়। তার বাবা তো একটু আগেই টিভির মধ্যে ছিল। এখন আবার তার সামনে এলো কী করে?
অরা হাসিমাখা কন্ঠে বলল, “তোমার অনেক বড় ফ্যান হবে তোমার ছেলে।”
আরশাদ নরম স্বরে বলল, “তাই? দেখি দাও তো।”
অরা ছেলেকে তুলে দিলো তার বাবাকে। তার হেসে চুমু খেলো কল্পর কপালে। অরা অবাক হয়ে দেখছে তাদের। আরশাদ অভিনেতা হিসেবে দুর্দান্ত, স্বামী হিসেবে দুর্দান্তেরও উর্ধ্বে। আর বাবা হিসেবে সে নিজেই দুর্দান্তের সংজ্ঞা। একটা ছেলে এতটা পরম যত্নে আগলে রাখতে পারে তার সন্তানদের?
আরশাদ আদুরে গলায় বলল, “কী রে জুনিয়র? আমাকে একা ফেলে তুই দাদির কাছে চলে যেতে পারলি কাল রাতে? জানিস কতটা মিস করেছি তোকে আমি?”
অরা চোখ বড় বড় করে অবাক গলায় শুনছে আরশাদের কথা। এমন একটা ভাব যেন কাল রাতে কল্পর শূণ্যতায় দুঃখে সে ঘুমিয়েই পড়েছে। অথচ এই ছেলেটাই কিনা কল্পর শূণ্যতার বিন্দুমাত্র সুযোগ হাতছাড়া করেনি!
আরশাদ আবারও বলল, “তোর মা-টা খুব দুষ্ট জানিস? এতদিন তুই আমাকে ঘুমাতে দিসনি আর কাল রাতে তোর মা আমাকে ঘুমাতে দেয়নি।”
অরা লজ্জায় থতমত খেয়ে বলল, “আরশাদ! বাচ্চাদের সামনে অন্তত মুখে লাগাম টেনে কথা বলো!”
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমার বাবা-ছেলের কনভারসেশনে নাক গলাবে না তো অরা।”
কল্পকে কোলে নিয়ে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো আরশাদ। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। আকাশটা আজ সকাল থেকেই মেঘাচ্ছন্ন। এই সামান্য বৃষ্টিতে প্রকৃতি আজ শান্ত হবে বলে মনে হচ্ছে না। কল্প চোখ বড় বড় করে দেখছে আকাশ থেকে পৃথিবীর বুকে নেমে আসা জলধারা।
আরশাদ জানালার বাইরে তাকিয়ে থেকে বলল, “অরা?”
“হুঁ?”
“আজ আমাকে একবার অফিসে যেতেই হচ্ছে। তুমি কল্পকে নিয়ে থাকতে পারবে তো?”
অরা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “হ্যাঁ পারবো। কোনো সমস্যা হয়েছে আরশাদ?”
আরশাদ স্বাভাবিক গলায় বলল, “চুপিসারের রিলিজ পেছানোর চিন্তা করছি। রিলিজ ডেট তো দেড় মাস পরেই। আমি ডাবিং দিচ্ছি না বলে সব কাজ আটকে আছে। ট্রেইলারও বানাতে পারছে না, এডিটিংও শেষ করতে পারছে না।”
‘চুপিসারে’ আরশাদের মুক্তির অপেক্ষা থাকা একটি সিনেমা। ‘চুপিসারে’ এবং ‘দিগন্ত’ এই দুটো ছিল এ বছরের বহুল প্রতীক্ষিত সিনেমা। দর্শকের মাঝে এ নিয়ে আগ্রহেরও কমতি নেই। ‘দিগন্ত’ যেহেতু মুক্তি পাচ্ছে না, তাই কে ফিল্মসের সকল তোড়জোড় ‘চুপিসারে’কে ঘিরেই। ভৌতিক গল্পের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে সিনেমাটি। এ দেশে ভৌতিক গল্প নিয়ে সিনেমা হয় না বললেই চলে। কিংবা যে কয়েকটা হয়, সেগুলোও সাদা চাদর জড়ানো রঙিন মুখোশধারী ভূতে এমনভাবে সাজানো হয় যে ভয় তো লাগেই না বরং হাস্যরসের বিষয়ে পরিণত হয়।
‘চুপিসারে’ সেদিক থেকে একেবারেই ব্যতিক্রম। অভিশপ্ত একটা বাড়ি, প্রচলিত সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ এবং গা ছমছমে কিছু অনুভূতির ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়েছে গল্পটা। ইতোমধ্যে সিনেমার টিজার দর্শকমহলে ব্যাপক সাড়া ফেলছে। যেই টিজারটা দেখেছে, ভয়ে রীতিমত কেঁপে উঠেছে।
যে সিনেমা নিয়ে দর্শকের এত এত আগ্রহ-উৎকণ্ঠা, সেই সিনেমা মুক্তির বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই কেন আরশাদের?
অরা অবাক ভঙ্গিতে বলল, “রিলিজ পেছাবে কেন? তুই ডাবিং দিয়ে দাও। তাহলেই তো হয়ে যায়।”
আরশাদ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “এই মুহূর্তে কাজ করতে ইচ্ছা করছে না অরা। একেবারেই না। কল্পর কাছেই থাকতে চাই সারাক্ষণ।”
এতদিনে আরশাদের মনটাকে পড়তে শিখেছে অরা। সিনেমার প্রতি তার এই অনীহার পেছনে যে অন্য কোনো কারণ আছে, বেশ বুঝতে পারছে। অরা উঠে ছোট ছোট পা গিয়ে দাঁড়ালো আরশাদের পাশে।
শান্ত গলায় বলল, “কারণটা শুধু কল্প না, তাই না?”
আরশাদ শীতল গলায় বলল, “হুঁ। ওই ঘটনার পর, ইন্ডাস্ট্রি, ক্রিটিক্স, দর্শক সবকিছুর ওপরেই বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে।”
চুপ করে রইলো অরা। যে জানতো, এমন কিছু একটাই হবে। বাঙালির যেহেতু সবক্ষেত্রেই উপচে পড়া আবেগ, আরশাদকে তাই ওই নকল ছবিগুলো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অপদস্থ করতে দেরি হলো না তাদের। একযোগে হয়ে দেশের সবথেকে বড় সুপারস্টারের বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়ানোর খেলায় মেতে উঠলো সকলে।
আরশাদ আবারও বলল, “ব্যাপারটা এমন না যে আমি প্রচন্ড ডিস্টার্বড। শুধু সিনেমা করার কথা ভাবলেই একটা অনীহা কাজ করে। যে ইন্ডাস্ট্রির জন্য আমি এতকিছু করলাম, সামান্য কয়েকটা নকল ছবি দেখে কোনোকিছু বিচার না করে এদেশের মানুষ আমাকে বয়কটের ডাক দিয়ে দিলো। আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে ইন্ডাস্ট্রির! ফুরিয়ে যখন গেছেই তখন আর কষ্ট কাজ করে লাভ কী?”
আরশাদের কাঁধে দৃঢ় স্পর্শে একটা হাত রেখে অরা কোমল স্বরে বলল, “এসব বললে হবে আরশাদ? ওরকম মানুষ তো হাতে গোনা কয়েকজন। সফল মানুষদের সফলায় ঈর্ষান্বিত হয়ে এরা সারাজীবন তাদের শত্রু হয়েই কাটিয়ে দেয়। কিন্তু এদের সংখ্যা কখনোই বেশি হয় না। কোটি কোটি মানুষ তোমাকে সাপোর্ট করে। ওই মানুষগুলোর হিংসা কখনোই তোমার ভক্তদের ভালোবাসার থেকে তীব্র হতে পারে না।”
কিছুই বলল না আরশাদ। ভক্তদের পাগলপারা ভালোবাসাই আজ তাকে এতটা দূরে নিয়ে এসেছে। তাদের ওপরে বরাবরই কৃতজ্ঞ সে। তাছাড়া ক্যামেরাও তার একপ্রকার নেশা। নিজের গন্ডি থেকে বেরিয়ে ক্যামেরার সামনে অন্য কোনো চরিত্র হয়ে দাঁড়ানোতেই যেন লুকিয়ে আছে পৃথিবীর গভীরতম আনন্দে।
সিনেমাকে আরশাদ যতটা ভালোবাসে, তার থেকে ততটাই দূরে থাকতে চাইছে এই মুহুর্তে। বিচিত্র সিদ্ধান্তহীনতায় দিন কাটছে তার। সিদ্ধান্তহীনতায় দুলছে থাকা মনটাও স্বস্তি পাচ্ছে না।
অরা দৃঢ় গলায় বলল, “আরশাদ তাকাও আমার দিকে।”
আরশাদ তার চোখদুটোর দিকে তাকাতেই অরা একপ্রকার আদেশের সুরে বলল, “তুমি আগামীকাল থেকেই ডাবিং শুরু করবে।”
আরশাদ বিভ্রান্ত গলায় বলল, “কিন্তু…”
অরা মুগ্ধ ভঙ্গিতে বলল, “তোমাকে দেখে যে কত মানুষ ইন্সপায়ার্ড হয়, তুমি নিজেও জানো না। একদম শূন্য থেকে উঠে এসে সফল হওয়ার স্বপ্ন দেখে তারা। তুমি নিজেই যদি এভাবে ভেঙে পড়ো, তাহলে তো তাদের স্বপ্নটাও মরে যাবে।”
আরশাদ অনিশ্চিত গলায় বলল, “ভেঙে পড়ছি না। জাস্ট সময় নিচ্ছি।”
অরা জোর দিয়ে বলল, “কোনো সময় নিতে হবে না। এই ইন্ডাস্ট্রি তোমার। এখানে শুধুমাত্র তোমারই রাজত্ব। মানুষের কথায় নিজের রাজত্ব ছেড়ে দেবে কেন?”
কয়েক মুহূর্তেই জন্যে সত্যিই ভাবনায় হারিয়ে গেল আরশাদ। আসলেই তো! সফলতার আলোয় চকচক করতে থাকা তার ক্যারিয়ারটা শেষ করে দেওয়ার জন্যে নোংড়া ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে কতিপয় মানুষ। তার এভাবে সিনেমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া মানে তো তাদের সেই উদ্দেশ্যটাকেই সফল করা।
আরশাদ অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যেতেই কল্পকে নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটালো অরা। তাকে গোসল করিয়ে দিলো, সাবধানে হাতের নখগুলো কেটে দিলো। কথা স্কুল থেকে ফিরতেই দুই বিচ্ছুকে নিয়ে বাগানে বসে রইলো অরা।
কথাটা একটু একটু করে বড় হয়ে যাচ্ছে। বিপুল দায়িত্বজ্ঞান জন্মেছে তার মাঝে। ভাইকে ঘিরে তার দুশ্চিন্তা-উদ্বেগের শেষ নেই। ভাই কেঁদে উঠলেই সে ব্যস্ত হয়ে ওঠে নানা প্রচেষ্টায় তাকে শান্ত করার জন্যে।
দুপুরের শেষের দিকে হঠাৎই আরশাদের ম্যাসেজ এলো অরার ফোনে।
“এই যে ম্যাডাম!”
অরা সঙ্গে সঙ্গে লিখলো, “বলেন স্যার!”
“আজ রাতে ফ্রি আছেন?”
“হ্যাঁ। কেন?”
অরা আগ্রহ নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতেই ভেসে উঠলো আরশাদের নতুন ম্যাসেজ, “তাহলে আমি কি আজ রাতে আপনাকে ডেটে নিয়ে যেতে পারি?”
হাজারো প্রজাপতি একসঙ্গে উড়ে বেড়াচ্ছে অরার বুকের মাঝে। এমনভাবে প্রশ্নটা করছে যেন মাত্র কয়েকদিনের পরিচয় তাদের। দুয়েকবার একে অপরের সঙ্গে কথা বলে ভালো লেগেছে, কয়েকবার লোকচক্ষুর অগোচরে একে অপরের দিকে হাসি নিক্ষেপ করেছে মাত্র। তারই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নটা করা।
অরা দুষ্টুমির ছলে লিখলো, “ভেবে বলছি।”
“ভাবতে কতক্ষণ লাগবে?”
“এক মিনিট।”
পাক্কা এক মিনিট পর রিপ্লাই এলো অপর প্রান্ত থেকে, “কী ভাবলেন?”
অরা আবারও দুষ্টুমির ছলে লিখলো, “যাওয়া যায়। কিন্তু গেলে আমি কী পাবো?”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অপরপ্রান্ত থেকে আরশাদ লিখলো, “অনেক অনেক আদর।”
লজ্জায় হেসে উঠে অরা লিখলো, “অসভ্য!”
“রেডি হয়ে থাকো। নয়টার দিকে তোমাকে পিক করে নিয়ে যাবো।”
অরা চিরচেনা নিয়মে জিজ্ঞেস করলো, “কীভাবে রেডি হবো বলে দাও!”
“ক্লজেট খুলে দেখো, নিজেই উত্তর পেয়ে যাবে।”
তড়িঘড়ি করে ক্লজেটের কাছে গেল অরা। যেখানে আরশাদের শার্টগুলো থাকে, সেখানেই গিফট র্যাপে মোড়ানো একটা বাক্স। র্যাপিং পেপারের ওপরে হলুদ রঙয়ের একটা চিরকুট আটকে দেওয়া। সেই চিরকুটে আরশাদের গোটা গোটা মুক্তার মতো হাতের লেখায় লেখা, “এই সেই পাওনা শাড়ি। চিন্তা কোরো না, সুদটাও যথাসময়ে পাবে।”
চিরকুটটা সাবধানে সরিয়ে নিজের কাছে রেখে র্যাপিং পেপার টেনে খুললো। তারপর বাক্সটার উপরিভাগ খুলতেই তার চোখের সামনে ধরা দিলো টকটকে লাল রঙের এক জামদানি। আনমনেই হেসে উঠলো অরা। কতদিন শাড়ি পড়া হয় না! আরশাদের বোধ হয় তাকে শাড়িতে দেখার জন্যে তর সইছে না।
যেহেতু ডিজাইনার শাড়ি, তাই সঙ্গে ব্লাউজও আছে। ব্লাউজটা হাতে নিয়ে দেখতেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল অরা। স্লিভলেস একটা ব্লাউজ, তার ওপরে আবার পিঠখোলা। পিঠের দিকটা আবৃত রাখার কোনো ব্যবস্থাই নেই। এমন ব্লাউজ কখনোই পড়ে না অরা।
তড়িঘড়ি করে ফোনটা হাতে নিয়ে আরশাদকে ম্যাসেজ পাঠালো, “আরশাদ, এই ব্লাউজ পড়ে আমি বাইরে যেতে পারবো না।”
আরশাদ বোধ হয় কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, রিপ্লাই আসতে তাই কয়েক মিনিট সময় লাগলো।
“পড়ো না প্লিজ! যেখানে আমরা যাচ্ছি, সেখানে শুধু আমিই থাকবো।”
পরের ম্যাসেজটা সঙ্গে সঙ্গেই এলো, “এখন আবার বোলো না আমার কাছেও লজ্জা পাবে।”
সত্যি তো সেটাই। এই জিনিস পড়ে আরশাদের সামনে কী করে দাঁড়াবে সে? লজ্জায় তো মাটির নিচেই ঢুকে পড়বে রীতিমত।
অফিসের কাজ সেরে বাড়ি ফিরলো না আরশাদ। অন্য কী একটা কাজ না-কি আছে তার। সন্ধ্যাটা দুশ্চিন্তার মাঝেই কাটিয়ে দিলো অরা। নয়টার দিকে তো বাড়ির কেউই ঘুমায় না। সকলের সামনে দিয়ে কোন মুখে আরশাদের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে যাবে সে?
আরশাদ অবশ্য আগেভাগেই টের পেয়েছিল তার লজ্জাবতী বউটা এই সামান্য বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠবে। তাই আগেভাগেই আশফিয়াকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে অরাকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছে। দুটো বিচ্ছুর যেন খেয়াল রাখে সে। আশফিয়াও মনে মনে খুশি না হয়ে পারলো না। যে ঝড়টা গেছে তাদের দুজনের ওপর দিয়ে, এতটুকু একান্ত সময় তো তাদেরই প্রাপ্য।
আশফিয়া অরার ঘরে এসে উৎফুল্ল গলায় বলল, “এই অরা! আরশাদ বলল তোমরা না-কি ঘুরতে যাচ্ছো? এসো তোমাকে সাজিয়ে দিই!”
বেশি একটা সাজেনি অরা। চোখে কাজল, কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ আর বড় একটা কানের দুল। যদিও স্লিভলেস ব্লাউজটার কারণে কেমন জড়সড় লাগছে। আঁচল দিয়ে তাই অনাবৃত কাঁধটা ঢেকে দিলো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখছে অরা। আরশাদের মন মতো লাগছে তো তাকে?
(চলবে)
#ফিরে_আসা২
৭৪+৭৫ (শুধুমাত্র প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য)
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
নয়টা বাজার আগেই আরশাদের ফোন এলো। বাড়ির সামনে এসে গেছে সে। অরাকেই যেতে বলল তার কাছে। অরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখলো বাগান থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে আরশাদের গাঢ় সবুজ গাড়িটা। এগিয়ে গিয়ে অবশ্য আশেপাশে দেখলো না কাউকে।
গাড়ির ভেতরেও না।
বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে অরা যখন চারপাশে চোখ বুলিয়ে তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে খুঁজতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই কাঙ্ক্ষিত মানুষটা পেছন থেকে আচমকা জড়িয়ে ধরলো তাকে। অরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে ঘুরিয়ে গাড়ির সঙ্গে ঠেকিয়ে দাঁড় করালো। মুখ ডুবিয়ে দিলো তার গলায়।
ঘটনাটা এত তাড়াতাড়ি ঘটলো যে এক লাফে বেড়ে দাঁড়িয়েছে অরার হৃদস্পন্দন। একদিকে আরশাদের একেকটা স্পর্শে পাগল হয়ে যাচ্ছে সে, আরেকদিকে কেউ তাদের এভাবে দেখে ফেলার ভয়ে জমে আছে।
অরার দিকে এক মুহুর্ত মোহাবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে রইলো আরশাদ। টকটকে লাল শাড়িতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে। মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর সবটুকু সৌন্দর্য এসে ধরা দিয়েছে তার সামনে। অরার চোখদুটোতে ভয়ের চিহ্ন, নিঃশ্বাসের গভীরতা – সবই একটু একটু করে পাগল করে দিচ্ছে আরশাদকে।
ভয়ের মাঝেও আরশাদকে দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলো না অরা। কালো পাঞ্জাবিতে অসহনীয় সুদর্শন লাগছে তাকে। পাঞ্জাবি আরশাদ খুব একটা পড়ে না। তবে যখনই পড়ে, মুগ্ধতার সকল সীমা ছাড়িয়ে যায় অরার। এই বুঝি প্রেমে পড়ার অনুভূতি? বিয়ের আগে কখনো কারও প্রেমে পড়েনি অরা। তাই বলে কী, বিয়ের পর প্রেম হয় না? অরা তো রোজ, দিনে-রাতে হাজারবার প্রেমে পড়ছে এই ছেলেটার।
অরা সতর্ক কণ্ঠে বলল, “আরশাদ! কী হচ্ছে এসব!”
আরশাদ মৃদু ধমকের সুরে বলল, “Shut up!”
কথা শোনা বা বলার মতো বিন্দুমাত্র সময় নেই আরশাদের। আবারও ডুব দিলো অরার ঘাড়ে। নিবিড়ভাবে একের পর এক স্পর্শে এলোমেলো করে দিচ্ছে তার সবটা।
অরা অসহায় কণ্ঠে বলল, “কেউ দেখে ফেলবে তো!”
আরশাদ অস্থির গলায় বলল, “দেখুক।”
অরা আঁতকে উঠে বলল, “দেখুক মানে? একেবারেই পাগল হয়ে গেলে তুমি? ছাড়ো আমাকে!”
ছাড়ার কোনো নামগন্ধ নেই আরশাদের মাঝে। অরার কোমড় জড়িয়ে ধরলো একের পর এক গাঢ় স্পর্শে ভরিয়ে দিচ্ছে তার ঘাড়। এক মুহূর্তে কতবার যে অরা কেঁপে উঠছে, সে নিজেও জানে না।
তবুও ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, “আরশাদ ছাড়ো!”
অরাকে ছেড়ে দিয়ে আরশাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “উফ! এত বিরক্ত করো কেন তুমি?”
অসম্ভব শক্তিশালী এক তরঙ্গ প্রকম্পিত করে তুলছে আরশাদের সমস্ত শরীর। এক মুহূর্তের অরার থেকে দূরে থাকা সম্ভব নয় তার পক্ষে। অরা নামক নেশায় নেশায় বুদ হয়ে আছে সে।
ব্যস্ত ভঙ্গিতে গাড়ির ব্যাকসিটের দরজা খুলে অরাকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিলো ভেতরে। নিজেও আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে ঢুকে পড়লো গাড়ির ভেতরে। অরাকে ব্যাকসিটের ওপরে শুইয়ে দিয়ে নিজে ঝুঁকে পড়লো তার ওপরে। আরশাদের এমন কান্ডে অরা রীতিমত মূর্ছা যাচ্ছে। নিঃশ্বাসের গতি এলোমেলো হয়ে এসেছে তার। চারিদিক থেকে অদৃশ্য এক ঘোরে তাকে আটকে ফেলেছে আরশাদ। যে ঘোর থেকে এ জীবনেও বের হতে চায় না সে।
গাড়ির জানালাগুলো কালো কাঁচ দিয়ে ঘেরা। ভেতরও কোনো আলো নেই। বাগান থেকে আসা ক্ষীণ আলোয় অরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে আরশাদের মুখটা। আরশাদের চোখদুটোতে নিজের জন্যে তীব্র এক তৃষ্ণা দেখতে পাচ্ছে অরা।
আরশাদ তার কানের নিচে হাত রেখে বলল, “শাড়ির সাথে সুদ চেয়েছিলে না? এই নাও তোমার সুদ।”
অরা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই সুযোগ আর পেলো কোথায়। তার আগেই তার ঠোঁটদুটো বাঁধা পড়ে গেলো আরশাদের ঠোঁটে। ঝড়ো হাওয়ার মতো দুর্বার গতিতে চুমু খাচ্ছে আরশাদ। অরা যেন আজ নিজের মধ্যে নেই। একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে আরশাদের মাঝে। এই মুহূর্তে তার উচিত আরশাদকে আটকানোর চেষ্টা করা। সেই চেষ্টার লেশমাত্র নেই তার মাঝে। সেও আরশাদের ঠোঁটে চুমু খাচ্ছে তার মতো করেই। নিজের অজান্তেই একটা হাত চলে গেল আরশাদের চুলের মাঝে।
অরা এতটুকু সাড়া, সারা শরীরে শিরহন জাগিয়ে তুলল আরশাদের। পাগল হয়ে গেল সে নিমিষেই। চুমুর গতি মুহূর্তেই বেড়ে গেল কয়েক হাজারগুণ।
কতক্ষণ এভাবে একে অপরের মাঝে ডুবে রইলো আরশাদ আর অরা, তারা নিজেরাও জানে না। কেবল জানে, এর থেকে সুখকর আর কিছুই হতে পারে না।
অরার ঠোঁটদুটো ছেড়ে তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে লম্বা শ্বাস নিচ্ছে আরশাদ।
অরা হাঁপাতে হাঁপাতে কম্পিত স্বরে বলল,
“আরশাদ, এখানে এসব আর না প্লিজ।”
আরশাদও হাঁপাতে হাঁপাতে হেসে ফেলে বলল, “তাহলে কোথায়? ডেটে গিয়ে রোমান্স করতে চাচ্ছো আমার সাথে?”
লজ্জার হাসি হেসে উঠে বসে এলোমেলো নিজেকে ঠিকঠাক করলো অরা।
আরশাদ গাড়ি থেকে বেরিয়ে ড্রাইভিং সিটের দিকে এগিয়ে যেতেই অরা শিশুসুলভ বায়না করে বলল, “আমি ড্রাইভ করি? কতদিন ড্রাইভ করি না।”
আরশাদ ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল, “কে বলল কতদিন ড্রাইভ করো না? You’re driving me crazy all the time.”
লজ্জায় দুহাতে মুখ লুকালো অরা। উফ! ছেলেটা কি এমন মজা পায় তাকে বারবার লজ্জা পেতে দেখে?
অরা নিজেই ড্রাইভ করে আরশাদকে নিয়ে এলো তাদের গন্তব্যে। যদিও জায়গাটা অরার চেনা নয়। আরশাদই পুরোটা চিনিয়ে চিনিয়ে দিচ্ছিল তাকে।
কটেজের নাম ‘কল্পনাতীত’। কটেজের বাইরে নেমপ্লেটে এমন নাম ভেবে মনে মনে বিভ্রান্ত না হয়ে পারেনি অরা। তবে ভেতরে পা রাখতেই তার সকল বিভ্রান্তি কেটে গেল। আসলেই কল্পনাতীত সুন্দর জায়গাটা।
কটেজের সামনের অংশটা জুড়ে বিশাল বাগান। মূল দরজা থেকে কটেজের দরজা পর্যন্ত সরাসরি একটা রাস্তা, তার দুধারে বাগান। বিশাল বিশাল সব আম-কাঁঠালের গাছ। কতগুলো শিউলি গাছেরও দেখা পেলো অরা। রাস্তাটা ঘেঁষে ছোট ছোট টবে সুসজ্জিত রঙিন সব ফুল। স্যান্ডেল খুলে খালি পায়ে ঘাস স্পর্শ করলো অরা।
বাগানটা এমনিতেই সুন্দর। তবে তাতে বাড়তি সৌন্দর্য যোগ করেছে সোনালী রঙয়ের আলোয় জ্বলজ্বল করতে থাকা হাজারো লাইট বল। সেই সঙ্গে অসংখ্য লাল-কালো বেলুন। লালটা অরা, আর কালোটা আরশাদ। তাদের পরনের পোশাকের সাথেই মিলিয়ে রাখা হয়েছে এই রঙয়ের বেলুন। বাগানের ঠিক মাঝামাঝি অবস্থানে গোলাকার একটা টেবিল। টেবিলের দু প্রান্তে দুটো চেয়ার।
টেবিলের ওপরটা গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সাজানো।
পুরো কটেজটা মরিচবাতিতে মুড়ে দেওয়া। গাছগুলোকেও সাজানো হয়েছে এই একই আলোয়। অরা ছুটে ছুটে দেখছে সবটা। তার পিছে শান্ত ভঙ্গিতে কেবল তাকেই দেখে যাচ্ছে আরশাদ। অরার উচ্ছ্বাস তাকে ভালোলাগার সমুদ্রে ভাসিয়ে দিচ্ছে বারবার।
অরার হাসিমুখটা এই পৃথিবীতে তার সবথেকে প্রিয় দৃশ্য। যেকোনো অসাধ্য নির্দ্বিধায় সে সাধন করে ফেলছে পারে, শুধুমাত্র তার ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তুলতে। অরা হঠাৎ উৎফুল্ল দৃষ্টিতে তাকালো আরশাদের দিকে। ধ্বক করে কেঁপে উঠলো তার বুকটা। এই তাকানোটাই আরশাদকে পাগল করে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট।
অরা হাস্যোজ্বল কণ্ঠে বলল, “এত সুন্দর একটা জায়গায় আমাকে আগে নিয়ে এলে না কেন?”
আরশাদ হাসিমুখে বলল, “তুমি যখন প্রেগন্যান্ট, তখন এই জায়গাটার খোঁজ পেয়েছি। জানতাম, এলেই এভাবে ছোটাছুটি করবে। তাই ঠিক করে রেখেছিলাম, কল্প পৃথিবীতে আসার পরই তোমাকে নিয়ে আসবো এখানে।”
অরা হঠাৎ কৃতজ্ঞ গলায় বলল, “কী দরকার ছিল এসবের?”
আরশাদ অন্যরকম গলায় বলল, “খুব দরকার ছিল। এই যে তুমি বাচ্চার মা হওয়ার পরও হঠাৎ এই সুন্দর জায়গাটায় এসে আবারও বাচ্চা হয়ে গেলে। তোমাকে হাসতে দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে গেল। দরকার ছিল না?”
অরা প্রচ্ছন্ন হাসি হেসে, ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। আরশাদেও তার শক্ত দুটো হাতের বাঁধনে আবদ্ধ করে ফেলল তাকে। কাছেই প্রচন্ড শব্দে মেঘ গর্জন করে উঠলো। কেঁপে উঠে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অরা। আরশাদের বুকের মাথা রেখে মোহাবিষ্ট হয়ে শুনছে তার অশান্ত হৃদয়টার ধুকপুক। ওই হৃদয়টা আজ অরাকে দেখার পর থেকে যে প্রচন্ড গতিতে ধুকপুক শুরু করেছে, এখনো তার থামবার নাম-গন্ধ নেই।
আরশাদ তাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে রেখেই বলল, “অরা? আর কতক্ষণ নতুন বৌয়ের মতো শাড়ির জড়িয়ে রাখবে।”
অরা কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। আরশাদ নিজের এক টান দিয়ে আঁচলটা সরিয়ে ফেলল তার গায়ের ওপর থেকে। তার অকস্মাৎ এমন কান্ডে লজ্জায় থতমত খেয়ে গেল অরা।
আরশাদ ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরার উন্মুক্ত কাঁধের দিকে। তার ডান কাঁধের তিলদুটো প্রবলভাবে টানছে তাকে। নিজেকে সামলে রাখার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই আরশাদের মাঝে। ঘোরের জগতে ডুবে অরার তিলদুটো ওপর চুমু খেলো সে।
অরার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। কেঁপে উঠলো তার সর্বাঙ্গ।
আরশাদ দুষ্টুমির স্বরে বলল, “এই মেয়ে! এভাবে কেঁপে উঠবে না আমার সামনে। এমনিতেই নিজেকে সামলে রাখতে পারছি না!”
আরও একটা চমক অপেক্ষা করছিল অরার জন্যে। কটেজের পেছনে বাঁধানো পুকুর। পুকুরের পাড়েও আলোকসজ্জার ছড়াছড়ি। পুকুরে ভেসে বেড়াচ্ছে অসংখ্য পদ্মফুল। প্রত্যেকটা পদ্মফুলের ভেতরে লাইটবল থাকার কারণে সারাটা পুকুর আলোয় আলোয় ছেয়ে আছে। এখানে ঘাস নেই। পায়ের নিচে তবুও নরম কিছু একটা অনুভব করলো অরা। তাকাতেই দেখতে পেলো অসংখ্য গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।
পুকুর পাড়ে মস্ত একটা বোর্ড। তাতে বড় বড় অক্ষরে কিছু একটা লেখা। এক দেখাতেই অরা চিনে গেল আরশাদের হাতের লেখা। সে লিখেছে, “You’re special, কল্পর মা।” নিজের অজান্তেই চোখে জল চলে এলো অরার। তার জীবনটা কি আসলেই এত সুন্দর? না-কি পুরোটাই স্বপ্ন।
স্বপ্ন নয়। স্বপ্নে কারও স্পর্শ টের পাওয়া যায় না। অরা টের পাচ্ছে, আরশাদ ভালোবাসামাখা স্পর্শে তাকে নিয়ে যাচ্ছে পুকুরের কাছে। পাড়ে বসে দুজনেই পুকুরে পা ডোবালো। অরা শাড়িটা উঠিয়ে রাখলেও কিছুটা ঠিকই ভিজে গেল।
অরা মাথা রাখলো আরশাদের কাঁধে। পৃথিবীর সকল প্রশান্তি যেন এই মানুষটার মাঝে এসেই আটকে গেছে। প্রশান্তিতে ভিন্ন এক গ্রহে হারিয়ে যাচ্ছে অরা।
কাছেই কোথাও বজ্রপাত হলো। মিষ্টি শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে চারিদিকে। রাতের আকাশটা মেঘে মেঘে ছেয়ে কেমন বেগুনি বর্ণ ধারণ করেছে।
অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে আগ্রহ নিয়ে বলল, “আচ্ছা আরশাদ? এই জীবনে তোমার কতগুলো গার্লফ্রেন্ড ছিল?”
আরশাদ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “এতগুলো বছর পর তোমার মনে হলো আমাকে এই প্রশ্নটা করা দরকার?”
অরা কখনো জানতে চায়নি কতবার প্রেম নেমে এসেছিল আরশাদের জীবনে। কারণ সেই প্রেমের কোনোটাই তো আসল ছিল না। তাদের মাঝে যে প্রেমটা আছে, কেবল সেটাই আরশাদের জীবনের একমাত্র সত্যিকার প্রেম। অতীত কখনোই একটা মানুষের জীবনের মুখ্য বিষয় হতে পারে না। সেজন্যেই তো আরশাদের অতীত নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই অরার। তার বর্তমানে আষ্টেপৃষ্টে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে আজীবন।
অরা হাস্যোজ্বল কণ্ঠে বলল, “দরকার তো এখনো নেই। কৌতুহল হচ্ছে, তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
আরশাদ খানিকটা ভেবে বলল, “সত্যি বলতে আমার প্রেম-টেমের প্রতি আগ্রহ কোনো কালেই ছিল না।”
অরা অবাক গলায় বলল, “স্কুল-কলেজেও না?”
আরশাদ হেসে ফেলে বলল, “স্কুল? অরা স্কুলে কার গার্লফ্রেন্ড থাকে?”
অরা খিলখিল করে হেসে বলল, “আজকালকার যুগে প্রায় সবারই থাকে।”
আরশাদ শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “ওই যুগটা এমন ছিল না। আমি তো বয়েজ স্কুল আর বয়েজ কলেজেই ছিলাম, তাই এত ছোট বয়সে প্রেম করার সৌভাগ্য আমার হয়নি।”
আবারও খিলখিল করে হেসে উঠলো অরা। তার হাসিটা মুগ্ধ দৃষ্টিতে নিজের ভেতরে শুষে নিয়ে আরশাদ আবারও বলল, “কিন্তু ভার্সিটিতে দুয়েকজনের সাথে… ব্যাপারটাকে ঠিক প্রেম বলা যায় না। সাথে সাথে ঘুরতাম, পাশে পাশে হাঁটতাম, বাড়ি পৌঁছে দিতাম। কিন্তু এটাকে কি প্রেম বলা যায়? প্রেমের দিকে গড়ানোর আগে সেটা শেষ হয়ে যায়।”
অরা হাসি হাসি কণ্ঠে বলল, “তাদের কাউকে এত সুন্দর ডেটে নিয়ে গিয়েছিলে?”
আরশাদ অন্যরকম গলায় বলল, “এমন ডেটে তো গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে যাওয়া যায় না অরা। শুধু বউকেই নিয়ে যাওয়া যায়।”
“কেন?”
আরশাদ অরার কানের সঙ্গে ঠোঁট মিশিয়ে বলল, “আজ রাতে তোমার সাথে যা যা হতে যাচ্ছে, তা শেষে নিজেই টের পাবে।”
লজ্জারাঙা ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেল অরার গা বেয়ে। আরশাদের কাঁধে মাথা রেখে পড়ে রইলো চোখদুটো বুজে।
কিছুক্ষণ পর আরশাদ তার মোহনীয় কণ্ঠে ডাকলো, “অরা?”
অরা চোখদুটো খুলে অস্পষ্ট গলায় বলল, “হুঁ?”
আরশাদ গভীর একটা শ্বাস নিয়ে বলল, “রিলিজ পেছাচ্ছে না। আমি ডিসাইড করেছে ডাবিংটা শেষ করবো।”
অরা আরশাদের কাঁধ থেকে মাথা তুলে তার চোখের দিকে তাকালো। আনন্দে-উচ্ছ্বাসে অরার মুখটা ঝলমল করছে।
ঝলমলে কণ্ঠেই অরা বলল, “Thank you, Arshad! Thank you so much!”
অরার উচ্ছ্বাস প্রচ্ছন্ন হাসি ফুটিয়ে তুলল আরশাদের ঠোঁটে। আজ সকাল পর্যন্ত সিনেমা মুক্তি দেওয়া নিয়ে দোনোমনো করছিল সে। তখন অরার বলা কথাগুলোই আরশাদের বিশ্বাস আবারও ফিরিয়ে আনলো।
অরা হঠাৎ কম্পিত স্বরে বলল, “আমিও ডিসাইড করেছি।”
আরশাদ কৌতুহল নিয়ে বলল, “কী?”
অরা হাসি মুখে বলল, “মেটার্নিটি লিভ শেষ হলেই আমি অফিসে জয়েন করবো।”
আরশাদ মজার ছলে বলল, “All thanks to me!”
হাসিমুখে অরার কপালে চুমু খেলো আরশাদ।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে একটা সময়ে তাদের কাজই না-কি বাঁধা হয় দাঁড়ায়। স্বামীর কাজের ব্যস্ততা নিয়ে স্ত্রীয়ের অভিযোগের শেষ নেই। স্ত্রীয়ের কাজ নিয়েও কিছু কিছু স্বামী হীনমন্যতায় ভোগে।
আরশাদ আর অরা যেন সেক্ষেত্রে একেবারেই বিপরীত মেরুর মানুষ। একে অপরের কাজ নিয়ে তাদের গর্বের শেষ নেই। একে অপরকে কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চটা দিয়ে সাপোর্ট করার চেষ্টা করে তারা। এজন্যেই কি তাদের ভালোবাসার সৌন্দর্য এতটা উজ্জ্বল?
পুকুরের পাড় থেকে অরাকে নিয়ে কটেজের ভেতরে গেল আরশাদ। আজ অফিস থেকে সে এখানে চলে এসেছিল, অরার প্রিয় পাস্তা কার্বনারা রান্না করতে। পাস্তা বেক করে ওভেনের ভেতরেই রেখে দিয়েছিল। এখন সেটা আবারও গরম করছে।
অরা হতবিহ্বল কণ্ঠে বলল, “তুমি আস্ত একটা পাগল আরশাদ!”
আরশাদ সূক্ষ্ম হাসি বলল, “তোমার মতো একটা বউ পেলে কেউ পাগল না হয়ে কী করে পারে?”
অরা সত্যিই অবাক হয়ে যায়। সে তো নিতান্তই সাধারণ একটা মেয়ে। এই সাধারণ মেয়েটার মধ্যে কী এমন আছে যে অসাধারণ আরশাদ দিনরাত তার তাকে ঘিরে পাগলামি করছে?
পাস্তা নিয়ে দুজনে এলো বাগানের ওই গোলাকার টেবিলের কাছে। পাস্তা মুখে দিতেই মুগ্ধতার জগতে ডুবে গেল অরা। ছেলেটা শেষমেশ রান্না শিখেই গেল! দুদিন পর তো দেখা যাবে তাকেই টক্কর দিচ্ছে।
আরশাদ টেবিলের আরেকপ্রান্ত থেকে অরার হাতটা ধরে বলল, “আমাদের কিন্তু এখন থেকে নিজেদের জন্যে সময় বের করতে হবে অরা।”
অরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলল, “হুঁ। কল্প আসার পর তো দুজনেরই দায়িত্ব বেড়ে গেল না? একে অপরকে সময়েই দিতে পারছি না।”
আরশাদ সহজ গলায় বলল, “সামনে দায়িত্ব আরও বাড়বে, কাজের চাপও বাড়বে। তাই বলে ভালোবাসাকে অবহেলা করবো?”
অরা দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “কখনোই না। তুমি ঠিকই বলছো, যত কষ্টই হোক সময় বের করতে হবে।”
আরশাদ দুষ্টু ভঙ্গিতে বলল, “তুমি সময় বের করবে, আর আমি এমন হুটহাট তোমাকে নিয়ে ডেটে চলে আসবো।”
অরা ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “আর তোমার সময়ের কী হবে?”
আরশাদ মোহনীয় এক হাসি হেসে বলল, “আমার সবটুকু সময় তো শুধু তোমারই জন্য।”
“ইশ! দুদিন পর শুটিং শুরু হলে তো দেখাও পাওয়া যাবে না।”
“কেন? শুটিং থাকলে আমি তোমাকে সময় দিই না? মনে নেই? কল্প যখন তোমার পেটে ছিল, শুটিং থেকে ফিরে তিনটা পর্যন্ত জেগে তোমার সাথে সিনেমা দেখেছি। সাতটায় উঠে আবারও শুটিংয়ে গিয়েছি!”
অরা নির্দ্বিধায় বলল, “এজন্যেই তো এত ভালবাসি তোমাকে।”
আরশাদ ঠিক অরার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমিও।”
অরা হেসে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আরশাদ শোনো! তোমার সাথে একটা অ্যাগ্রিমেন্ট করতে চাচ্ছি।”
আরশাদ খানিক বিস্ময় নিয়েই বলল, “অ্যাগ্রিমেন্ট? কীসের অ্যাগ্রিমেন্ট?”
অরা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, “আমাকে স্বার্থপর ভাবো আর যাই ভাবো, এটা আমাকে করতেই হবে।”
“কী করবে বলবে তো!”
অরা লজ্জায় মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তোমাকে জড়িয়ে না ধরে ঘুমাতে পারছি না। এখন থেকে আমি মাঝখানে ঘুমাবো। তুমি আমার এক পাশে, কল্প আরেক পাশে।”
আরশাদ গালে হাত রেখে কৃত্রিম অসহায়ত্ব নিয়ে বলল, “কী সাংঘাতিক! লজ্জাবতীর লজ্জা-শরম দিন দিন উড়ে যাচ্ছে!”
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব সেরে অরাকে আবারও আরশাদ নিয়ে গেল কটেজের ভেতরে। বিশাল দুটো বেডরুম এখানে। তার একটা বাইরের মতোই উজ্জ্বল সোনালী লাইটবল দিয়ে সাজানো। ঘরের সবগুলো বাতি নিভিয়ে রাখা, তবুও সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম এই বাতিগুলোই ঘরটাকে আলোকিত করে রেখেছে।
একপাশের দেয়ালে মাথা থেকে পা পর্যন্ত বিশাল আয়না। এই আয়নার সামনেই এনে দাঁড় করালো আরশাদ অরাকে। ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে কতগুলো লাল রঙয়ের বাক্স নিয়ে এলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাক্সগুলো গয়নার।
একটা বাক্সে চকচকে একটা হীরার আংটি। আংটিটা পড়িয়ে দিলো আরশাদ অরার অনামিকায়। আংটি পড়ানোর অজুহাতে তার হাতে ঠোঁটের শীতল স্পর্শ দিতে ভুলল না। আরেকটা বাক্স খুলে বের করে আনলো চমৎকার এক জোড়া কানের দুল। এখন অরার কানে যে দুলগুলো আছে, যত্ন নিয়ে সেগুলো খুলে পড়িয়ে দিলো নতুন দুল। সঙ্গে কানের লতিতে চুমু তো রয়েছেই।
অরা অবাক হয়ে দেখছে আরশাদকে। তার চোখেমুখে উৎসাহের কোনো কমতি নেই। ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে বউকে সাজাচ্ছে নিজের মনের মতো। অনেকটা সময় জমে দাঁড়িয়ে রইলো অরা। জল চলে আসছে চোখে বারবার।
আরেকটা বাক্স খুলে চমৎকার একটা হীরার নেকলেস বের করে আনলো আরশাদ। অরার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে সেটা পড়িয়ে দিলো তার গলায়। ঘাড়ের কাছে আরশাদের পাগলপারা স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলো অরা। আরও একবার তার কেঁপে ওঠায় ঘায়েল হয়ে আরশাদ তার কোমরে জড়িয়ে ঘাড়ে গাঢ় একটা চুমু খেলো। নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ অরা সামনে থেকে শক্ত করে চেপে ধরলো আরশাদের হাত। নিজের খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো আরশাদ ঘষে দিলো অরার ঘাড়ে। শিহরণে আরেকদফা কেঁপে উঠলো অরা।
আরশাদের অবাধ্য ঠোঁটদুটো কোনো নিয়ন্ত্রণ মানতে চাইছে না আজ। অরার ঘাড় ছেড়ে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে অরার উন্মুক্ত পিঠজুড়ে। শিহরণে শিহরণে পাগল হয়ে যাচ্ছে অরা।
আরশাদ মোহগ্রস্ত হয়ে অরাকে নিজের দিকে ফেরাতেই অরা থেমে থেমে বলল, “কী দরকার ছিলো এসবের?”
আরশাদ ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল, “কী দরকার ছিলো মানে? আমার বউকে আমি যা খুশি তাই দেবো, তাতে তোমার কী?”
“আমি কি খুব একটা গয়না পড়ি?”
“তোমাকে গয়নাতে দেখতে আমার ভালো লাগে।”
অরা অবাক গলায় বলল, “তাই? কখনো বলোনি তো।”
“বললে যে আমার ভালো লাগার জন্য বেশি বেশি গয়না পড়তে। বছরে যে দুয়েকবার তুমি গয়না পড়ো, ওটাই আমাকে পাগল দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।”
একে অপরের চোখে ডুবে রইলো দুজনে কয়েক মুহূর্ত। অরার চোখদুটোতে আজ অন্যরকম কিছু একটা দেখতে পাচ্ছে আরশাদ। তার কাছ থেকে অনেক অনেক ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, অথবা তাকে নিজ থেকে ভালোবাসার তীব্র ব্যাকুলতা। এই চোখদুটোতে যতবারই আরশাদ তাকায়, ততবারই কষ্ট হয় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে। তার আজীবনের আসক্তির উৎস ওই চোখদুটো।
অরাকে আরেকটু কাছাকাছি টেনে নিলো আরশাদ। লজ্জায় তার অবস্থা জড়সড়। লজ্জা পেলেও প্রতিটা মুহূর্ত তো অরা ব্যাপক উপভোগ করছে, আরশাদ ঠিকই বুঝতে পারে। কানের নিচ থেকে চুলের মাঝে হাত ডুবিয়ে মুহূর্তেই তার ঠোঁট ঠোঁট মিশিয়ে দিলো আরশাদ। তার চুমু খাওয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন হাজার বছরের তৃষ্ণার্ত সে। এই তৃষ্ণা মিটবে কেবল অরার ঠোঁটদুটোর মাঝেই।
আরশাদের ঠোঁটের মাঝে হারিয়েই দিশেহারা হয়ে পড়েছে অরা। দুহাতে শক্ত করে খামচে ধরেছে তার পাঞ্জাবিটা। অরার হঠাৎ কী যে হলো! আরশাদের ঠোঁটদুটো ছেড়ে ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দিলো তার ঘাড়। অরার এমন কান্ডে। মনে মনে ব্যাপক হকচকিয়ে গেলেও তা প্রকাশ করলো না আরশাদ। চোখদুটো বুজে ভিন্ন এক জগতে হারিয়ে উপভোগ করতে লাগলো তার লজ্জাবতীর আদর।
নিজেকে একেবারেই নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখতে পারছে না অরা। আরশাদ যেন তাকে শক্তিশালী কোনো নেশাদ্রব্যের মতো নিজের দিকে টানছে। অরাও নেশাগ্রস্তের মতো দিকেই পা বাড়াচ্ছে। লজ্জার মাথা খেয়ে অরা একটা একটা করে খুলছে আরশাদের পাঞ্জাবির বোতাম। আরশাদের সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে অনবরত।
ঘোরগ্রস্ত হয়েই অরা টেনে খুলে ফেলল আরশাদের পাঞ্জাবিটা। আরশাদও সাহায্য করলো তাকে। কম্পিত দৃষ্টিতে অরা তাকালো আরশাদের পুরুষালি উন্মুক্ত বুকের দিকে। বুকটা যেন একটু একটু করে তাকেই ডাকছে। পাগলের মতো একের পর এক চুমু খেতে শুরু করলো অরা আরশাদের বুকে।
পাগলামির কমতি আরশাদের মাঝেও নেই। তার অবাধ্য হাতটা ক্রমশই বিচরণ করে যাচ্ছে অরা সারা শরীরে। অরার এই রুপটার দেখা সচরাচর পাওয়া যায় না। তবে যখনই পাওয়া যায়, রাতের ঘুম উড়ে যায় আরশাদের।
অরার ছোট ছোট চুমুগুলো কামড়ে পরিণত হচ্ছে। একদমই ব্যথা লাগছে না আরশাদের। ভালোলাগার ঝড়ো হাওয়া ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।
আরশাদ ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল, “অরা! মেরে ফেলতে চাও না-কি আজ রাতে আমাকে?”
নিমিষেই সংবিৎ ফিরে পেলো অরা। পাথরের ন্যায় জমে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। কী করছিল এটা সে এতক্ষণ! উফ! সব দোষ আরশাদের! প্রত্যেকবার এভাবে পাগল করে দেয় সে তাকে। পাগলামির বশে সবটুকু নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সে। লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে যে। কী করে এই মুখটা দেখাবে আরশাদকে?
আরশাদ অরার কোমড় জড়িয়ে দুষ্টু গলায় বলল, “এখন লজ্জা পেলে চলবে না ম্যাডাম। আমার আরও আদর চাই।”
আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হলো না অরার পক্ষে। নিজেকে কোনমতে আরশাদের হাতের বাঁধন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে লজ্জায় ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আরশাদও তড়িৎ গতিতে তার পিছু নেই। যেভাবে তাকে এলোমেলো করে দিয়েছে অরা, আজ তার হাত থেকে রেহাই নেই মেয়েটার।
ছুটতে ছুটতে কটেজের সামনের সিঁড়িগুলো বেয়ে নামতে গিয়েই অঘটন বাঁধলো অরা। পা পিছলে পড়ে গেল বাগানের ঘাসের ওপরে। ব্যাথা পেয়ে হাঁটু চেপে ধরেছে অরা। ধ্বক করে কেঁপে উঠলো আরশাদের বুকটা।
আরশাদ ছুটে গিয়ে অরার কাছে বসে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, “দৌড় দিতে গেলে কেন অরা? ব্যাথা পেয়েছো না?”
কিছুক্ষণ আগের ঘটনায় এখনো লজ্জায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে অরা। গলা থেকে তার কথাই বের হচ্ছে না।
তবুও বহুকষ্টে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “না।”
আরশাদ ব্যস্ত গলায় বলল, “কই দেখি!”
অরা আঁতকে উঠে বলল, “দেখতে হবে না। সত্যি ব্যাথা পাইনি।”
“একদম চুপ!”
অরাকে বাঁধা দেওয়ার কোনপ্রকার সুযোগ না দিয়ে আরশাদ হাঁটু পর্যন্ত টেনে তুলল তার শাড়ি। ভাগ্যিস ছিলে যায়নি, ভেতরটাই ব্যাথায় টনটন করছে কেবল। অরা তেমন একটা ব্যাথা না পাওয়ায় আরশাদ স্বস্তি পেলেও, মুহূর্তেই সেই স্বস্তি পরিণত হলো তীব্র এক শিহরণে।
চোখের সামনে অরার উন্মুক্ত পা দুটো। পাগলের মতো অরার পা জুড়ে চুমু খাচ্ছে আরশাদ। লজ্জায়-শিহরণে কুকড়ে অরার অবস্থা দিশেহারা।
আরশাদের অবাধ্য আদরের মাঝে হারিয়ে অরা টেরই পেলো না কখন তুমুল বর্ষণ নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে। বৃষ্টির ফোঁটা ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তাদের দুজনকে।
আচমকা অরাকে কোলে তুলে নিলো আরশাদ। আবারও ঠোঁটদুটো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে চলে গেল তাদের ঘরে। অরাকে বিছানায় নামিয়ে রাখতে গিয়ে তার বুকের ওপরে থেকে ভেজা আঁচলটা সরে গেল। আরেকদফা পাগলামির হাওয়ায় মিশে গেল আরশাদ। আঁচলটা পুরোপুরি সরিয়ে দিয়ে কতশত চুমুতে ভাসিয়ে দিচ্ছে তাকে, তার কোনো হিসাব নেই।
অরা কাঁপা কাঁপা গলায় এলোমেলো নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, “আরশাদ প্লিজ!”
আরশাদ অস্থির কণ্ঠে বলল, “প্লিজ কী? আরও বেশি আদর লাগবে?”
অরা লজ্জায় অসহায় হয়ে বলল, “এরকম কোরো না।”
কথাটা অরা কেন বললে সে নিজেও জানে না। এই ভালোবাসার সাগরে ডুবে নিজেকে ভুলতে বসেছে সে।
আরশাদ দৃঢ়ভাবে বলল, “অসম্ভব! আমার মাথাটা যেভাবে বিগড়ে দিয়েছো তুমি, আজ কোনো রেহাই নেই তোমার।”
(চলবে)