ফিলোফোবিয়া পর্ব-১২+১৩

0
552

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির )

১২.

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

জুবাইদা পেটের অসুখ বাঁধিয়ে স্কুলে আসেনি আজ। গতকাল বোম্বাই মরিচ দিয়ে গুনে গুনে তিন প্লেট ফুসকা খেয়েছে। অনেক বারণ করেছে প্রিয়। শুনেনি সে। রাত থে্কে প্রচন্ড পেটে ব্যথায় ভুগছে। যা গিলছে সবই উবলে ফেলছে। ডাক্টার দেখিয়ে এখন বেডরেস্টে আছে।
স্কুল শেষে একা বাড়ি ফিরছিল প্রিয়। পথে চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে গাড়ি থামানো দেখল। চেয়ারম্যানের অফিসের শাটার খোলা ভর দুপুরে। শতাব্দ কি এসেছে তবে? চোখজোড়া নেচে উঠল খুশিতে। রিকশা অফিসের কাছাকাছি আসতেই মাথা বের করে উঁকি দিলো প্রিয়। শতাব্দের আবছা ঝলক দেখে। লাফিয়ে উঠল। বিরবির করে বলল, ‘ইয়েস! ইয়েস! সে এসেছে। আমার কথা রেখেছে।’
বাড়ির সামনে রিকশা থামলো। তড়িঘড়ি করে নামতে যেয়েও নামলো না প্রিয়। চুল ঠিক করে, কাপড় গুছিয়ে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে আস্তেধীরে নামলো। ভাড়া মিটাতে গিয়ে আড়চোখে তাকালো। ততক্ষণে অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছে শতাব্দ। তার সাথে চোখাচোখি হতেই লজ্জায় মাথা ঝুঁকিয়ে নিলো। ভাড়া মিটিয়ে তড়িঘড়ি পায়ে গেটের ভিতরে চলে গেল প্রিয়। ঘরে এসে কোনরকম ব্যাগ ফেলে। স্কুল ইউনিফর্ম নিয়েই টানটান শুয়ে পড়ল । ঠোঁটে হাসি, চোখে লজ্জা ভীষণ। বুক কাঁপছে ধুকপুক। বারবার ভাসছে শতাব্দের মুখ। মানুষটাকে কতদিন পর দেখলো! পুরো ষোলো দিন পর এসেছে সে। এই ক’দিন না দেখে কত অভিযোগ পুষেছে। কত অভিমান জমিয়েছে। আজ তার এক চাহনিতেই সব অভিযোগ, অভিমান নিমিষেই শেষ! তাকে দেখার তৃষ্ণা খাইখাই পু*ড়িয়েছে এতোদিন। কিন্তু আজ! আজ যখন সামনে এসেছে। চোখ তুলে তাকাতে পারছেনা লজ্জায়। গতরাতে তো ফোনে বেশ গলা উঁচিয়ে ‘আসতে’ বলল। এখন যখন এসেছে অনুভূতিতে মিয়িয়ে যাচ্ছে সে।
কি করে সামনে দাঁড়াবে। উপহার দিবে তাকে!
উফ! এমন অসহ্য অদ্ভুত অনুভূতি কেন? প্রেম কি এমন অদ্ভুদ-ই হয়! ভেবেই লজ্জায় মুখ লুকালো বালিশে।

শতাব্দের উপহারের কথা মনে পড়তেই। বিছানা ছেড়ে উঠল। ব্যাগ থেকে ঘড়ির বাক্সটা বের করল। আজ সকালে তাড়াতাড়ি স্কুলের জন্য বেরিয়েছিল। ক্লাস শুরু হওয়ার দুঘন্টা আগে। তানহাকে নিয়ে হাইওয়ের কাছাকাছি নতুন মার্কেটটায় গিয়েছিল। তেমন জমজমাট হয়ে উঠেনি এখনো। কিছু দোকান খুলেছে মাত্র। তানহা থেকে শুনেছিল মার্কেটের দোতলায় কয়েকটা ঘড়ির দোকান হয়েছে। বেশ ভালো। কয়েকটা দোকান ঘুরে একটা ঘড়ি পছন্দ হলো। গত ঈদের সালামি ছিল কিছু আর সামান্য টাকা যোগ করে ঘড়িটা নিলো। যদিও দর কষাকষি তেমন পারেনা প্রিয় । তবুও খানিকক্ষণ দামাদামি করে সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে কিনেছে। বেশ সুন্দর রেপিং পেপারে মুড়িয়ে প্যাকেজিং করে এনেছে। মনে মনে সুক্ষ্ম ভয় জ জমলো। সবসময় শতাব্দের হাতে নামীদামী ব্রেন্ডেড ঘড়ি দেখেছে। তার এই সামান্য উপহার পছন্দ করবে কি শতাব্দ? আচ্ছা,উপহার দেওয়ার সময় কোন শুভেচ্ছা বাক্য বলবে কি? না থাক। প্রয়োজন নেই। দেখা যাবে বলতে গিয়ে ভয়ে পাকিয়ে ফেলবে সব। তার চেয়ে বরং চিরকুট লিখবে। চট করে উঠে। রঙ্গিন কাগজ কলম নিয়ে বসলো প্রিয়। গোটা গোটা অক্ষরে লিখল,

‘ হবু ডাক্তার সাহেব,
শুভ জন্মদিন। কেমন আছেন আপনি? নিশ্চয়ই ভীষণ ভালো। বলেছিলেন প্রতি সাপ্তাহে আসবেন একবার। আজ ষোল দিন পর দেখা মিলল আপনার। বড্ড পা*ষাণ আপনি। আমার কথা কি একবার মনে পড়েনা আপনার? সারারাত উপহার নিয়ে অনেক ভেবেছি। কি দেওয়া যায় আপনায়! হ্ঠাৎ মনে হলো সময় উদাসীন মানুষটার জন্য ঘড়ি-ই বোধহয় যোগ্য। ঘড়িতে সময় দেখে যদি আমার কথা মনে পড়ে আপনার! পড়বে কি মনে?
ইতি,
আপনার প্রেম রোগে ব্যথিত প্রিয়।

জুবাইদার অসুস্থতার কথা শুনে।বিকেলে খালা চিকেন স্যুপ করে দিলো। অফওয়াইট গ্রাউন আর চুড়িদার বেশ চমৎকার তৈরি হয়ে নিলো প্রিয় । ঘর থেকে বের হবার জন্য পা বাড়িয়েও পিছিয়ে নিলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে দেখে নিলো একবার। ভীষণ সাদামাটা দেখাচ্ছে। একটু সাজবে কি? চোখে সামান্য কাজল ঘষে, ঠোঁটে গোলাপি রঙের লিপস্টিক লাগালো হালকা। ঠিকঠাক দেখাচ্ছে এইবার।
স্যুপের বাটি আর ঘড়ির প্যাকেট নিয়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল সে।
চেয়ারম্যান বাড়ি এসে। এদিক-সেদিক না দেখে সোজা জুবাইদার ঘরে গেল। বিছানায় কাঁথা মুড়িয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে সে। মাথার কাছে বসলো প্রিয়। আলতো স্বরে ডাকতেই পিটপিট চোখ মেলে তাকালো জুবাইদা। একরাতেই ভীষণ দুর্বল দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। খারাপ লাগল প্রিয়’র। বলল,
‘ এখন কেমন লাগছে ?’
‘কিছুটা ভালো। কাল তোর বারণ শুনা দরকার ছিল আমার ।’
আধোআধো চোখ মেলে জুবাইদা বিড়বিড় করে উত্তর দিলো।
‘ শুনলিনা তো। অসুখ বাঁধালি ঠিক।’
‘ ব্যাগে কি?’
প্রিয় হাতের ব্যাগটার দিক এক পলক তাকালো। বলল,
‘ খালা তোর জন্য চিকেন স্যুপ করে পাঠিয়েছে। বলল, শক্তি মিলবে এতে। আর…
‘ আর কি?’
গলা ঝেরে, মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে প্রিয় ভাঙ্গা স্বরে বলল,
‘ আর…আর তার গিফট। ভেবেছিলাম নিজ হাতে দিবো । কিন্তু..সাহস হচ্ছেনা এখন। আমি চলে যাওয়ার পর, তুই যদি…
প্রিয়’র কাঁচুমাচু মুখ দেখে। শুষ্ক ঠোঁট জোড়া মেলে হাসলো জুবাইদা। হাত গুটিয়ে বলল,
‘ আমি ওইসব পারবো না ভাই। দেখা যাবে ভাই রে*গে আমাকে মুড়িয়ে এই ব্যাগের ভিতর ভরে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে নিচে।’
ভীতু কন্ঠে বলল প্রিয়,
‘ তাহলে এটা কি সাথে করে বাসায় নিয়ে যাবো?’
‘ এতে রেগে যাবে আরো। তাছাড়া ভাই তোকে দেখা করে যেতে বলেছে। ঘরেই আছে।’
‘ আমি আসবো উনি আগে থেকে জানতো?’
‘ হ্যাঁ। স্কুল শেষে রুমা তানহা এসেছিল। তাদের মুখে শুনেছে।’
ভয়ে চোখ জোড়া ছোট হয়ে এলো প্রিয়’র। কপালে চিন্তার ভাঁজ। ভেবেছিল চুপিচুপি এসে। জুবাইদাকে দেখে তার হাতে উপহার ধরিয়ে চলে যাবে। পুরোপুরি ফেঁ*সে গেছে এখন।
ভীতু স্বরে জিজ্ঞেস করল প্রিয়,
‘ দেখা কি করতেই হবে?’
‘ আমাকে বলতে বলেছে আমি বলেছি। বাকিটা তুই আর ভাইয়া জানিস।’
অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করল। শতাব্দের সাথে দেখা করবে সে। মনে মনে ভেবে নিলো। কিন্তু কি করে সামনে দাঁড়াবে এখন?

ষোলদিন তার বিরহ যন্ত্রণায় কা*টালো। আজ যখন সে এসেছে, ডেকেছে। সাহস হচ্ছেনা সামনে দাঁড়ানোর। লজ্জা, ভয়, অনুভূতি ঝাপটে ধরেছে পা।
দরজা ভিড়ানো। ঠকঠক আওয়াজ করল। ভেতর থেকে গম্ভীর আওয়াজ ভেসে এলো,
‘ ভিতরে এসো।’

ছোট ছোট পা ফেলে ভিতরে গেল প্রিয়। সোফায় বসে বই পড়ছিল শতাব্দ। প্রিয়’কে দেখে উঠে দাঁড়ালো। গম্ভীর হয়ে কাছে এসে দরজাটা শব্দ করে বন্ধ করল। ভারী আওয়াজে কেঁপে উঠল প্রিয়। চোখমুখ খিঁচে নিলো। মুখোমুখি এসে দাঁড়াল শতাব্দ। বেশ স্বাভাবিক স্বরে বলল,
‘ ফোনে তো বেশ গলা উঁচিয়ে আসতে বললে। এখন পালাচ্ছ কেন?’
কোন উত্তর দিলো না প্রিয়। কাঁপছে থরথর। ঠাহর করল শতাব্দ। হাত টেনে সোফায় নিয়ে বসালো। গ্লাসে পানি ভরে এগিয়ে দিলো। তড়িঘড়ি করে পুরোটা পানি গিলে। ছোট ঢোক গিলল প্রিয়। খানিকক্ষণ পিনপতন নিরবতায় কাটলো। শতাব্দ চেয়ে রইল নিমিষ। ভীতু উত্তেজিত প্রিয়। হাত কচলাচ্ছে বারবার। প্রিয়’র হাত জোড়া টেনে হাতে মুঠোয় নিয়ে নিলো শতাব্দ। আদুরে স্বরে ডাকল। বলল,
‘ আমার দিকে তাকাও প্রিয়।’
প্রিয় শুনেও চোখ উঁচিয়ে তাকালো না। খানিক অপেক্ষা করল শতাব্দ। ডাকলো আবার,
‘ কিছু বলবেনা ?’
এবার একটু সময় নিয়ে মাথা তুলে তাকালো প্রিয়। ছোট ঢোক গিলে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করল। গলার স্বর স্বাভাবিক রকম করে জিজ্ঞেস করল,
‘ কেমন আছেন?’
হেসে ফেলল শতাব্দ। ঠোঁট চেপে হাসি থামানো চেষ্টা চালিয়ে । বলল,
‘ এতটা পথ জার্নি করে আসলাম। শুধু এটা শুনার জন্য?’
প্রিয় তড়িঘড়ি করে বলল,
‘ শুভ জন্মদিন।’
‘ আর?’
কি বলবে? খুঁজে পেল না প্রিয়। চোখ নুয়িয়ে নিলো। আড়চোখে এদিক সেদিক তাকালো। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছ বারবার। আঙ্গুল খুঁটাখুঁটি করছে ভয়ে। আচমকা কোমর চেপে কাছে টেনে আনল শতাব্দ। নিজের সাথে গভীর ভাবে মিশিয়ে নিলো। চিবুক ধরে উঁচু করল মুখ। চোখে চোখ ডুবালো। প্রিয়’র নিষ্পাপ চাহনি। মন্ত্রমুগ্ধের মত টানছে তাকে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। বুকে বড্ড অশান্তি হচ্ছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে ভীতু স্বরে বলল প্রিয়,
‘ ক..কি করছেন। চলে আসবে কেউ।’
কানে তুললো না শতাব্দ। আরো গভীর ভাবে প্রিয়’কে জড়িয়ে নিলো। কোমর ছেড়ে পিঠ ছুঁইছে হাত। চাহনিতে গভীর ঘোর। অদম্য নেশা। বলল,
‘ আমার স্পেশাল গিফট চাই প্রিয়।’
শতাব্দের নেশাতুর স্বর। গালে হাত রাখতেই আবেশে চোখ বুজে নিলো প্রিয়। ভীষণ কাছাকাছি দুজন। শতাব্দের গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণটা নাকে লাগছে প্রিয়’র। শরীর কাঁপছে থরথর। দক্ষিণের ধমকা হাওয়া এসে এলোমেলো করেছে চুল। আদুরে হাতে গুছিয়ে দিলো শতাব্দ। দুগালে হাত রেখে মুখটা উঁচু করে নিলো। আলতো করে গালে ঠোঁট ছোঁয়াতেই কেঁপে উঠল প্রিয়। সারা শরীর জুড়ে শীতল হাওয়া বইতে লাগল। শিরশির করছে হাতপা। নিশ্বাসের গতি বেড়েছে। বুকের ধুকপুকটাও কয়েক গুন বেড়ে গেছে। গলা শুকিয়ে প্রচন্ড তেষ্টা পাচ্ছে। আচ্ছা, অনুভূতিতে মরে যাবে কি আজ?
শতাব্দ চোখ গাল কপাল সারা মুখ এলোপাতাড়ি চু*মুতে ভরিয়ে দিচ্ছে। আজ নিজের মধ্যে নেই সে। কোন এক মোহে সম্মোহে জড়িয়ে পড়েছে। প্রিয়’কে এতো কাছে পেয়ে মাথা আউলে গেছে। নিজেকে ভুলে উন্মদের মত আচরণ করছে। আচমকা ঠোঁটের কাছে এসেই থেমে গেল সে। তার ভারী নিশ্বাসে থরথর কাঁপছে প্রিয়। তিরতির করছে ঠোঁট। কপালের সাথে কপাল মিলিয়ে নিলো। চোখ বুজে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল। ঘোর কাটতেই ভারী নিশ্বাস টেনে, খিচে দূরে সরিয়ে আসলো। পাশের সোফায় বসে মাথা চেপে ভারী ভারী নিশ্বাস ফেলছে শতাব্দ। ঘর জুড়ে নিশ্বাসের শোঁশোঁ আওয়াজ।

সোফা ছেড়ে উঠল শতাব্দ। চোখেমুখে পানি ছিটা দিয়ে খানিক বাদে ফিরে এলো। প্রিয়’র দিক আড়চোখে তাকালো। সোফায় গাঁ এলিয়ে চোখ বুজে ভারী ভারী নিশ্বাস ফেলছে এখনো।
প্রিয়’র গিয়ে পাশে বসলো। বুকে জড়িয়ে। একটু সময় নিয়ে আলতো স্বরে ডাকলো। পিটপিট দৃষ্টি মেলে তাকালো প্রিয়। সরল চাহনিতে অদ্ভুত ঘোর, গভীর মোহ। বুকটা কেঁপে উঠল শতাব্দ’র। মনে মনে কয়েক হাজার বার জপলো,’ এই প্রিয় আমার। শুধুই আমার!’
এলোমেলো চুল গুলো গুছিয়ে দিতে দিতে মুখে বলল,
‘ অন্যসবার মত ভদ্র প্রেমিক হয়ে অত নিয়ম বেঁধে ভালোবাসতে পারবো না প্রিয়। অনেকবার চেষ্টা করেছি। হচ্ছেনা। পারছিনা না আমি। তুমি আশেপাশে থাকলে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাই হুটহাট।’
শতাব্দের শেষ কথা গুলোতে একরাশ ব্যকুলতা মিশানো। প্রিয় শতাব্দের দিক নিমিষ চেয়ে রইল। মনে মনে বলল,
‘ নিয়ম বেঁধে ভালোবাসতে বলিনি তো আমি। আপনার হুটহাট পাগলাটে রুপটাই যে আমার পছন্দ।’
কথা এড়াতে মুখে বলল,
‘ এ ক’দিন ব্যস্ত ছিলেন খুব?’
‘ হ্যাঁ ভীষণ। এপার্টমেন্টে শিফট হয়েছি। কেনাকাটা গোছগাছ করতে সময় লেগেছে।’
‘ এপার্টমেন্ট? আপনি তো হোস্টেলে ছিলেন।’
‘ হ্যাঁ সেখানকার কোলাহল পরিবেশ ভালো লাগেনি। তাই ধানমণ্ডি আমাদের এপার্টমেন্টে শিফট হয়েছি।’
প্রিয় ছোট ব্যাগটা নিয়ে শতাব্দের দিক এগিয়ে দিলো।বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘ এটা আপনার জন্য।’
ব্যাগ খুলে বাক্সটা বের করে। আনবক্সিং করে ঘড়িটা হাতে পড়ে নিলো শতাব্দ। দ্বিধান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করল প্রিয়,
‘ পছন্দ হয়েছে আপনার?’
‘ ভীষণ। থ্যাংকইউ।’
অমনি চিরকুটে চোখ পড়তেই ভ্রু কুঁচকে এলো শতাব্দের।হাতে নিয়ে পড়ে হেসে ফেলল। বলল,
‘ আড়ালে তো ভীষণ চঞ্চল। খুব বকবক করো। সামনে এলে পালাই পালাই করো কেন?’
লজ্জা পেল প্রিয়। মিয়িয়ে গেল একদম। প্রিয়’র হাত হাতের মুঠোয় নিয়ে আঙুল বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ চিরকুটের প্রশ্নটা তোলা থাকলো। কোন একদিন উত্তর জানাবো।’

চলবে……..

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির )

১৩.

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

নভেম্বর মাস। শীতের মৃদু আমেজ। জোরেশোরে ইমান্দিপুরে নির্বাচনের আয়োজন চলছে। আজকাল প্রায় প্রতি সাপ্তাহে গ্রামে আসে শতাব্দ। পড়াশোনার পাশাপাশি এদিকটাও দেখছে। বাপ চাচাদের সাথে নির্বাচনের কাজে হাত লাগাচ্ছে। তার সাথে প্রায়ই চোখেচোখি হয়, চুপিচুপি ফোন কথাও হয়। ‘ভালোবাসি’ প্রকাশ না করলেও। অধিকারবোধটা বরাবরই প্রখর। কিছু সম্পর্ক বোধহয় বেনামিই সুন্দর। আয়োজন করে, ভালোবাসি বলে নাম করণের প্রয়োজন পড়েনা কোন।
প্রিয়’র বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। আজকাল ব্যস্ত খুব। সারাবছর ঝিমিয়ে কাটানোর মাশুল দিচ্ছে এখন। নাকানিচুবানি খেয়ে বই নিয়ে পড়ে থাকে সারাক্ষণ। এর মাঝে বাড়িতে এলো অতিথি’র আগমনী সংবাদ। ছোট খালার বড় ছেলে ‘মজনু ভাই’ আসছে দেশে। বড় আপার সমবয়সী মজনু ভাই। ‘মজনু’ নামটা ছোট খালুর রাখা। হিস্ট্রিকাল লাভস্টোরিতে গভীর ভক্তি তার। লায়লা মজনু’র প্রেমকাহিনী থেকে অনুপ্রেরিত হয়ে বড় ছেলের নাম মজনু। আর ‘রোমিও জুলিয়েট’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ছোট ছেলের নাম ‘রোমিও’ রেখেছেন। যদিও বড় হয়ে মজনু ভাই নাম পাল্টে। মেহতাব রেখেছে। কিন্তু মজনু নামটা খাতায় কলমে ঠিকই রয়ে গেছে। নামটা শুনতে বেশ বিব্রত শোনালেও। মজনু ভাই দেখতে যথেষ্ট সুদর্শন। শুধু মাথার মধ্যেখানে একটু চুল কম। অনেক বছর দেখেনি তাকে। সেই ছোটবেলায় দেখেছিল একবার। এতবছরে কি চুল যেয়ে টাক বেরিয়েছে এসেছে তার! কি জানি।
প্রিয় ভাবনা জগতে ডুবে। সামনে বই খুলে উপরের দিক তাকিয়ে কলমের মাথা চাবাচ্ছে। দেখে ক্ষে*পে উঠল খালা। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
‘ কলম লেখা জন্য খাওয়ার জন্য না! এমন করে পড়লে পাশ করতে হবে না আর।’
ভাবনাচ্ছেদ হলো প্রিয়’র। নড়েচড়ে বসলো। কপাল কুঁচকে বলল,
‘ তুমি শুধু আমাকেই বলো। প্রভা যে দুই সাব্জেক্টে ফেল করলো কই তাকে তো ফোন কিছু বললা না! উল্টো আদর আহ্লাদ করলা’
‘ প্রভা আর তুই এক হলি প্রিয়? ও ক্লাস সিক্সে পড়ে আর তুই সামনে বছর মেট্রিক দিবি। ফেল করলে কোথাও মুখ থাকবে আমাদের?’
‘ অত চিন্তা করো না তো খালা। দেখবে কোনরকম ঠিক পাশ করে যাবো!’
খালা এবার আরো অবাক হলো। হতাশ কন্ঠে বলল,
‘ শুধু পাশ?’
‘ হ্যাঁ! মেয়েদের এত পড়ে কি হবে। সেইতো শ্বশুরবাড়িতে চুলাই ঠেলবে।’
খালা রেগে গেল। কট কট করে বলল,
‘ কাউকে সর্বস্র না ভেবে নিজেকে সম্পদ বানা প্রিয়। প্রেম ভালোবাসা বিয়ে এসব খানিকের মোহ। এসব ছাড়াও জীবনে বাঁচা যায়!’
চুপসে গেল প্রিয়। খালা বরাবরই প্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে বিরো্ধী।কিন্তু কেন? কারণটা আজো জানে না সে। ছোট থেকে খালাকে আত্মনির্ভরশীল দেখেছে। কখনো কারো কাছে হাত পাততে দেখেনি। নিজের সকল প্রয়োজন সমস্যা নিজেই মিটিয়েছে। সফল নারী বলাই যায় খালাকে।
প্রিয় বিড়বিড় করে বলল,
‘ তুমি শুধু আমাকেই বলো!’
‘ আর কাকে বলবো। তুই আপন তোকেই তো বলবো!’
‘ আমি আপন আর প্রভা পর? ওকে কেন বলোনা এসব?’
মুখ বেজার করে অভিযোগ করলো প্রিয়। খালা দেখে হেসে ফেলল।বলল,
‘ আচ্ছা, এবার দেখা হলে বলবো। ঠিক আছে?’

প্রশ্নপত্র নিয়ে মুখে বাতাস করতে করতে মাঠে এলো প্রিয়। সকালে শীতশীত করলেও এখন ভাপসা গরম ছেড়েছে। বিদুৎ না থাকায় হলে গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার। পরিক্ষা শেষে দূর আমগাছ তলায় তানহা জুবাইদাকে দেখা যাচ্ছে। গলা উঁচিয়ে ডাকলো একবার। শুনেনি তারা। গল্পে মজে। পা চালিয়ে এগিয়ে গেল প্রিয়। কাছাকাছি যেতেই জুবাইদাকে বলতে শুনলো,
‘ শতাব্দ ভাই কি করে…আসলেই…
প্রিয়’র দিক চোখ পড়তেই। জুবাইদা সাথে সাথে থেমে গেল। তার দৃষ্টি অনুকরণ করে তানহা পিছন ফিরে চাইল। প্রিয়কে দেখে চমকে গেল। বিড়বিড় করে বলল,
‘ আরে প্রিয়! কখন আসলি। পরিক্ষা কেমন হলো?’
‘ কি বলছিলি তোরা? আমাকে দেখে থেমে গেলি কেন? কি করেছে উনি।’
ভনিতা বিহীন জিজ্ঞেস করল প্রিয়। জোর করে ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে কথা এড়াতে তানহা স্বভাবিক কন্ঠে বলল,
‘ তেমন কিছুনা এমনি….
চোখ পাকালো প্রিয়। শান্ত স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘ আমি সত্যিটা জানতে চেয়েছি ।’
জুবাইদা তানহা দুজন চোখাচোখি করল। একটু সময় নিয়ে। তানহা বিড়বিড় করে বলল,
‘ গতকাল সমুদ্র তোর কথা জিগ্যেস করছিল বারবার। শতাব্দ ভাইয়ের সাথে সম্পর্কে আছিস কিনা, তুই সিরিয়াস কি না। আরো অনেক কিছু। সন্দেহ হলো আমার। প্রথমে কিছু বলতে না চাইলেও। কড়াকড়ি ভাবে জিজ্ঞেস করতেই গড়গড়িয়ে বলতে লাগল। গতকাল বিকালে শতাব্দ ভাইয়ের মোবাইলে ঢাকা থেকে করিয়ে আনা নির্বাচনের পোস্টারের ছবি দেখতে ঘরে গিয়েছিল। শতাব্দ ভাই ওয়াশরুমে ছিল। আচমকা একটা আইডি থেকে ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ এলো। কৌতুহল বশত খুলে দেখে একটা মেয়ে শতাব্দ ভাইকে প্রপোজ করছে। আরো কৌতুহল নিয়ে পুরানো মেসেজ পড়ে বুঝল মেয়েটা শতাব্দ ভাইয়ের সাথে একই মেডিকেলে পড়ছে। ম্যাসেজে গুলো এডাল্ট ছিল খুব। সাথে মেয়েটার এডাল্ট ছবি..
থামিয়ে দিলো প্রিয়। বুকে মোচড়ে উঠেছে হ্ঠাৎ । খাড়া থেকে বসে পড়ল। জলে চিকচিক করছে চোখ। শরীর কাঁপছে থর থর। সামনের সব ঝাপসা দেখছে। অদ্ভুত য*ন্ত্রণায় বিষিয়ে যাচ্*ছে মন। জুবাইদা তানহা পাশে বসল। জুবাইদা বুঝানোর স্বরে বলল,
‘ শতাব্দ ভাইয়ের কোন দোষ….’
উঠে দাঁড়ালো প্রিয়। ধরে আসা কন্ঠে বলল,
‘ বাড়ি যাবো আমি।’
বলেই তড়িঘড়ি পা চালিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে গেল। রিকশা ডেকে বাড়ির দিক রওনা হলো। চোখ ভরে আসছে বারবার। প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করছে। শরীর অবশ লাগছে। কান্না পাচ্ছে খুব।
রিকশা বাড়ির কাছাকাছি আসতেই শতাব্দকে দেখল। লোকজন জমিয়ে মিটিং করছে। বুকের য*ন্ত্রণাটা যেন আরো কয়েক গুন বেড়ে গেল। চোখাচোখি হতেই মুখ ফিরিয়ে নিলো প্রিয়। ভাড়া মিটিয়ে তড়িঘড়ি করে ভেতরে চলে গেল। পেছন থেকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল শতাব্দ।
না খেয়ে, না নেয়ে ঘরে দুয়ার দিয়ে কাটালো সারাদিন। বিকালেও ছাদে উঠেনি আজ। সন্ধ্যায় খালা এসে জিজ্ঞেস করতেই হুহু করে কেঁদে উঠল প্রিয়। খালাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ আমার এখানে ভালো লাগছেনা খালা। বুকে কষ্ট হচ্ছে খুব…. বাড়ি যাবো।’
হ্ঠাৎ বুক ব্যথা করছে কেন? উল্টাপাল্টা কিছু খেয়ে পেটে গ্যাস জমলো কি মেয়েটা! আয়েশা বেগম ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লো। কয়েকবার কারণ জানতে চাইল। ডাক্টারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথাও বলল। প্রিয় সাড়াশব্দ করলো না কোন। কাঁদোকাঁদো গলায় বিড়বিড় করে বলল, ‘ ডাক্টারের কাছে না। মাকে খুব মনে পড়ছে! আমার মায়ের কাছে যাবো।’
আজ পরিক্ষা শেষ হয়েছে। তাই বারণ করলেন না তিনি। সকাল সকাল গাড়ি ভাড়া করে প্রিয়’কে ঢাকায় দিয়ে এলেন।

ঢাকায় এসেও ভালো লাগছেনা প্রিয়’র। বাবা মা প্রভা কারো সাথে সময় কাটাতে ইচ্ছে করছে না। শান্তি পাচ্ছেনা কোথাও। তানহার কথা গুলো কানে বাজছে সারাক্ষণ। রাতে মায়ের ফোনে সিম ঢুকালো। অন করতেই, সাথে সাথে ম্যাসেজের টুংটাং আওয়াজে কেঁপে উঠল ফোন। শতাব্দের ম্যাসেজ সব। মিনিট পাঁচেক গড়াতেই শতাব্দের নাম্বার থেকে ফোন এলো। ঝাপসা চোখে ফোনে স্কিনে তাকিয়ে থাকলো প্রিয়। ধরলো না। খানিক বেজে একাই থেমে গেল। শতাব্দের ফোন থেকে ম্যাসেজ এলো,
‘ ইগনোর করছো! কি হয়েছে? সমস্যা কোন? এখানে আসো সামনা সামনি বসি। সবটা শুনে, সমাধান করি। এভাবে পালিয়ে বেড়ালে লাভ হবে না কোন। তোমার ঢাকার বাড়ির ঠিকানা আমার জানা। যদি সেখানে বড়সড় কোন ঝা*মেলা না চাও। ভালোয় ভালোয় কালকের ভেতর ফিরে আসবে ইমান্দিপুরে।’
দ্রুত মোবাইল বন্ধ করে সিম খুলে নিলো প্রিয়। হা পা কাঁপছে তার। ম্যাসেজের কথা গুলো স্বাভাবিক দেখালেও। এর ফল কতটা অস্বাভাবিক হতে পারে আন্দাজ করতে পারছে প্রিয়।

পরের দিন সকালে বাবার জোরাজোরিতে। বাবার সাথে মজনু ভাইকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে গেল। প্রিয়’র ধারণা ঠিক। এই কয় বছরে চুল গিয়ে টাক বেরিয়ে এসেছে মজনু ভাইয়ের।উঁচা লম্বা বলিষ্ট শরীর, সুন্দর চেহারা সবই ঠিক ছিল। শুধু মাথার টাকটার জন্য সুদর্শন হতে হতে পিছিয়ে গেল বেচারা।
গাড়িতে বসে দেশে আসার কারণ জানালো মজনু ভাই । ছোট থেকে ইউরোপে বড় হয়েছে। দেশের রীতিনীতির থেকে দীর্ঘকাল বিচ্ছিন্ন। এখানকার কালচার সম্পর্কে সম্পূর্ণ অ*গ্যত। তাই এবার লম্বা সময় হাতে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ ঘুরে দেখবে। সেই সাথে আরেকটা কারণও আছে। মজনু ভাইয়ের চাচা সোহরাব আলি ইমান্দিপুরের পাশের গ্রামের চেয়ারম্যানি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে এইবার। সেই নির্বাচন দেখতে আরো তড়িঘড়ি করে ছুটে এসেছে। প্রিয়’র হাসি পেল। মজনু ভাইকে প্রচণ্ড বুদ্ধিহীন বোকা লোক মনে হলো। নয়তো নির্বাচন দেখার জন্য কেউ এভাবে ছুটে আসবে কেন?

মজনু ভাই সবার জন্য বেশ উপহার এনেছে। সারাদিন ভরপুর খাওয়া দাওয়া ব্যস্ততার সাথে কাটলো প্রিয়’র। রাতে সিম খুলতেই শতাব্দের ম্যাসেজ। পাঁচ মিনিট আগে পাঠিয়েছে।,

‘ তোমাদের বাড়ির সামনে আছি। তুমি আসবে? নাকি আমি উপরে আসবো!’

আঁতকে উঠল প্রিয়। তড়িঘড়ি করে জানালার পর্দা সরিয়ে বাহিরে তাকালো। রাস্তার অপর পাশে গাড়ি থেমে। ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোতে শতাব্দের মুখ ভেসে। ড্রাইভিং সিটে বসে এদিকটাই চেয়ে। ভীষণ এলোমেলো ক্ষে*পে আছে সে। ঘড়ির দিক তাকালো প্রিয়। এগারোটা আটচল্লিশ। ভ*য়ে ঢো্ক গিলল। এতো রাতে কেন এসেছে সে?

চলবে…..