ফিলোফোবিয়া পর্ব-৪১+৪২

0
531

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )

৪১.

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

নাইট শিফটের ডিউটি শেষ করে বাড়ি ফিরল শতাব্দ। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে চোখজোড়া ফুলে র*ক্তিম। মাথাটাও চিনচিনে ব্যথা করছে। চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকাল, প্রিয়’কে দেখা যাচ্ছেনা কোথাও। সেইরাতের পর আজ এক সাপ্তাহ। দুজনের মধ্যে কথাবার্তা পুরোপুরি বন্ধ। শতাব্দ বরাবরই এড়িয়ে চলছে প্রিয়’কে। প্রিয় এখনো তার জিদ এঁটে বসে। সময় গড়াচ্ছে দুজনের ভেতর দুরত্ব বাড়ছে। রাগ, ক্ষো*ভ আরো শক্ত ধারালো রূপ নিচ্ছে।
পানি নিয়ে এসেছে প্রভা। শতাব্দ পানির গ্লাস হাতে তুলে জিজ্ঞেস করল,
‘ প্রিয় বাড়িতে নেই?’
‘ সকাল সকাল বেরিয়ে আপা।’
‘ ভার্সিটিতে গেছে?’
‘ না, আজ ক্লাস নেই। সমাবেশের নিমন্ত্রণ ছিলো। অতিথি হয়ে গেছে সেখানে।’
থমকে গেল শতাব্দ। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
‘ রাজনৈতিক সমাবেশে ওর কি কাজ? কোথায় গেছে কিছু বলেছে?’
প্রভার বিহ্বল আওয়াজ,
‘ না যাওয়ার আগে শুধু বলল, ঢাকার বাহিরে একটা সমাবেশ আছে, সেখানে অতিথি হয়ে যাচ্ছে।’
প্রচন্ড রাগ হলো শতাব্দের। তড়িঘড়ি করে ফোন বের করে প্রিয়’র অফিসে ফোন করল। সেখান থেকে ঠিকানা জোগাড় করে তড়িঘড়ি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ঠিকানাটা ঊষ্ণচরের কাছাকাছি। যদি শতাব্দ ভুল না হয়, সেখানে ছবি বেগমও উপস্থিত। আগামী নির্বাচনের প্রচারণা করতে গিয়েছে। প্রিয় নিশ্চয়ই জানে সব। তাই হয়তো ইচ্ছে করে সেই সমাবেশের অতিথি হয়ে গেছে।
গাড়ি চালাচ্ছে আর বারবার প্রিয়’র নাম্বারে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করছে শতাব্দ। ঢুকছে না। বন্ধ বলছে। রাগে ক্ষো*ভে আছ*ড়ে ফেলল ফোন।

সামনে হাজারো মানুষের সমাগম। স্টেজে নেতা-নেতৃবৃন্দ। এসব রাজনৈতিক সমাবেশে আগে কোনদিন আসেনি প্রিয়।প্রত্যাশা ব্যান্ড বেশ পরিচীত হওয়ার সুবাদে প্রত্যাশা ম্যাডামের সাথে রাজনীতি খাতের অনেকেই পরিচীত আছে। উনাকে রিকোয়েস্ট করে এখানকার সমাবেশে অতিথি হয়ে এসেছে প্রিয়। অনেক সাংবাদিক আছে এখানে। তার দেওয়া চাঞ্চল্য ভার্তা সারা দেশে আগুনের গতিতে ছড়াবে। তার কার্জসাধনের জন্য এটাই সঠিক স্থান।
প্রিয়’কে এখানে দেখে ছবি বেগমের চোখমুখের রঙ পাল্টে গেছে। মুখ জুড়ে ভয় আ*তংক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আসার পরপরই লোকজন সব ঠিক করে রেখেছে। ঊনিশ থেকে বিশ হলেই, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে হা*মলা করবে প্রিয়’র উপর। এখানেই সরাসরি খু*ন করবে। এতো লোকের ভিড়ে কাজ করতে সহজ হবে। যা অনেক বছর আগে শতাব্দের জন্য পারেনি। আজ করবে। মিটিয়ে ফেলবে এই জঞ্জাল ঝামেলাকে!

উপস্থাপক প্রিয়’র প্রশংসা করল। মাইকে ডেকে, রাজনীতি নিয়ে বলতে বলল। আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল প্রিয়। ছোট ছোট পা ফেলে মাইকের সামনে দাঁড়াল সে। বড়সড় পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সে। হাতপা প্রচন্ড রকম কাঁপছে। আজ তার জীবনের অপ্রিয় কালো অতীতকে সবার সামনে আনবে। হয়তো আজকের পর সব পাল্টে যাবে। সব সম্পর্ক এলোমেলো হয়ে যাবে। সোসাল মিডিয়ায় ঝড় উঠবে। নানারকম প্রশ্ন, বাজে পরিস্থীতির মুখোমুখি হতে হবে। তার ক্যারিয়ার অস্তিত্ব সব বিলীনের পথে নামবে। হয়তো শতাব্দ চিরকালের জন্য মুখ ফিরিয়ে নিবে। তবুও সে এটা করবে। অনেক বছর আগে যেভাবে তাকে আর তার জন্মদাত্রীকে সারা গ্রামের সামনে চরিত্রহীনা প্রমাণ করে, তাদের মানসম্মান সব ধুলোয় মিশিয়েছে। জীবনের জঘন্য পরিস্থীতির দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়েছে। আজ তার শোধ নিবে। হাজার হাজার মানুষের সামনে তাদের ঠুনকো মান সম্মান সব টেনে খুলবে। তাদের সব অ*ন্যায় অহং*কার মাটিতে মিলিয়ে দিবে।
চোখ বুজে ছোট শ্বাস ফেলল প্রিয়। সূর্যের তীর্যক রশ্মি তার চোখেমুখে পড়ছে। মাথা উঁচু করে সামনের দিক তাকালো। প্রথমে সেখানে উপস্থিত সকল নেতা নেতৃবৃন্দদের প্রসংশা করল। তারপর বর্তমান যুবসমাজে রাজনীতির প্রভাব তুলে ধরল। কায়দা করে বলল,
‘ আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন এখানে উপস্থিত আপনাদের প্রিয় ছবি বেগমের সাথে আমার পারিবারিক সংযোগ আছে। তিনি আমার স্বামীর ফুপু। আমার ফুপু শাশুড়ী!’
সামনের থেকে উচ্ছাসীত উচ্চস্বর ভেসে এলো। সাংবাদিকগণ ক্যামেরা হাতে স্টেজের দিক ধরে। লাইভ ব্রডকাস্ট চলছে। চিন্তিত মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখা টানল ছবি বেগম।
খানিক চুপ থেকে ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসি টেনে প্রিয় আবারো বলল,
‘ সেই সাথে আমাদের আরো একটা সম্পর্ক আছে। তিনি আমার স্টেপ মাদার। আমি শোয়েব হক ও তার প্রথম স্ত্রী আয়শা বেগমের মেয়ে। যদিও আমাদের পারিবারিক দ্বন্দ্ব চলছে, তাতে কি! আমি চাই উনি যেন আগামী নির্বাচনে জয় হয়। উনার প্রতি আমার শুভকামনা থাকবে।’
চাপা গুঞ্জন হতে শুরু করল। স্টেজে অন্যান্য নেতাকর্মীরা ছবি বেগমকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করছে। সাংবাদিকদের ভেতর চাঞ্চল্য ছড়িয়ে। একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ছে। কোন উত্তর দিলো না প্রিয়। নিজের আসনে ছবি বেগমের পাশে যেয়ে বসলো। তার দিক ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ বিষে বিষ কা*টে। আমার সবচেয়ে অপ্রিয় জ*ঘন্য অতীত আপনাদের কাল হয়ে দাঁড়াবে। আমি আগুন ধরিয়ে দিয়েছি, বাতাস দেওয়ার কাজ সাংবাদিকরা করবে। আর বাদবাকি কাজ পাবলিক আর পুলিশ দেখবে। আমি কথার খেলাফ করিনা। বলেছিলাম জ্বা*লিয়ে দিবো। আপনাদের সব অ*হংকার, দম্ভ মাটিতে মিলিয়ে দিবো! সবে শুরু আরো অনেক কিছু বাকি আছে এখনো!’
সমাবেশে হৈচৈ শুরু হয়েছে। ছবি বেগমের বিপরীত দলের লোকজন এমনি এক সুযোগের তালা*শ করছিল। জনসাধারণের মাঝে হৈচৈ শুরু করে। দুইদলের লোকজনের হা*তাহাতি শুরু হয়। চারিদিকে বিশৃ*ঙ্খল পরিবেশ। ছবি বেগম ক্রো*ধে টগবগ করছে। সবার আড়লে যেয়ে, ছেলেকে ফোন করে লোকজন জোগাড় করে রাখতে বললেন। ইশারা করতেই যেন, প্রিয় উপর হা*মলা পড়ে। এখানে ভিড়ের মাঝে খু*ন করে। পুলিশ এসে পরিস্থীতি সামলানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। স্টেজ থেকে নামিয়ে গাড়ি অবধি তুলে দিচ্ছে অতিথিদের। প্রিয় নামার সময়, ছবি বেগম লিমনকে ইশারা করল। সাথে সাথে কয়েকজন লম্বা বলিষ্ঠ লোক এসে হা*মলে পড়ল। হাতে মোটা লা*ঠি, ধা*রালো অস্র। পুলিশের লা*ঠি চার্জ ডিঙিয়ে প্রিয় অবধি এলো। টেনে হিঁ*চড়ে প্রিয়’কে ভিড়ে ভেতর নিয়ে গেল। একজোট হয়ে গোল করে প্রিয়’কে ঘিরে নিলো। যেন পালানোর সুযোগ না পায় কোন। সামনের মানুষটা যে লিমন। মুখ ডেকে রাখলেও বুঝতে বাকি রইল না প্রিয়’র। লা*ঠি ঘোরাত ঘোরাতে এদিকে আসছে। ভয়ে বিহ্বল প্রিয়। শরীর কাঁপছে থরথর। এমন কিছু হতে পারে, বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলনা তার। মাটিতে পড়ে আছে সে, গা ধুলাবালিতে মেখে। লিমন ক্রো*ধানিত্ব কন্ঠে গর্জিয়ে বলল,
‘ খা*** বাচ্চা। কলিজা কত বড়। আমার মায়ের সাথে ঝামেলা! পাব্লিকের সামনে গলাবাজি করা! আমার বাপের অবৈধ সন্তান। কি চাই? টাকা পয়সা, সম্পত্তি’র ভাগ চাই! এর জন্য এত নাটক। কথায় আছে, পিপীলিকার পাখা গজায় ম*রিবার তরে। আজ এখানেই তোর ম*রণ হইবো। কেউ বাঁচাতে পারবেনা। শতাব্দও আজ নাই!’
চোখের ভয় মিলিয়ে দিয়ে, ঠোঁট মেলে হিং*স্র হাসলো প্রিয়। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
‘ ওই কা*পুরুষের এক পয়সাও আমার চাইনা। টাকার না ,ন্যায়ের ভুখা! আমি থাকি আর না থাকি, তোদের পতনের বেশি দেরি নেই!’
ক্*ষেপে উঠল লিমন। এগিয়ে আসছে তার দিক। চোখ বুজে নিলো। শক্ত হাতে মাটি আঁকড়ে মনে মনে আওড়াল,
‘ সমাপ্তি যদি এখানেই হয় আমার আফসোস নাই। তবে আরেকটু সময় চাই। এই নৃ*শংস অত্যা*চারীদের পতনের সাক্ষী হতে চাই!’
লা*ঠি উঁচিয়ে লিমন মাথায় যেই আঘা*ত করবে অমনি কেউ ভিড় ঠেলে এসে প্রিয়’কে ঝাপটে ধরল। লা*ঠির আঘা*ত তার পিঠে পড়ল। তখনো চোখ বুজে প্রিয়। নাকে তীব্র ঘ্রাণ বাঁধলো। এই ঘ্রাণের সাথে নিবিড় ভাবে পরিচীত প্রিয়। অনুভূতি বলছে, শতাব্দ এসে, ঝাপটে ধরেছে। পিটপিট চোখ খুলল। দৃষ্টি উঁচিয়ে সামনে চাইল। সামনের মানুষটার ক্লান্ত, ভীতিকর মুখখানায় রাগের তীব্র আভাস। তার চিন্তিত হাত প্রিয়’র গাল ছুঁয়ে দিলো। ঘাবড়ানো, ভীত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ তুমি ঠিক আছো?’
উত্তরে প্রিয় প্রশান্ত হাসলো। ছলছল চোখজোড়া থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। ফিসফিস করে ঠোঁট নাড়াল,
‘শতাব্দ! ‘
কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে চোখমুখ পাল্টে গেল। শতাব্দের কপালের রগ ভুলে উঠল। চোয়াল শক্ত। ধপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। ক্ষি*প্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে লিমনের পেটে লা*থি মেরে নিচে ফেলল। আশেপাশের বলিষ্ঠ লোকগুলো ভয়ে চেপে গেল। সবাই বেশ ভালো করে চিনে শতাব্দকে। যদিও ইমান্দিপুরে্র চেয়ারম্যান শাহরিয়ার সাহেব, শতাব্দের কথাতেই গ্রামের সকলে উঠেবসে। তার রাজত্ব চলে। শতাব্দের বিরুদ্ধে গেলে হিতের বিপরীত হবে। ঠাই হবেনা কোথাও। ভয়ে যে যার যার মত ছুটতে লাগল। লিমন উঠে প্রতিবাদে প্রহার করতে চাইলে। শতাব্দ তাকে মাটিতে ফেলে এলোপাতাড়ি মা*রতে লাগলো। লিমনের নাক ফে*টে গলগল র*ক্ত ঝরছে। ঠোঁট মুখ থে*বড়ে গেছে। তবুও থামছে না শতাব্দ। ইট তুলে লিমনের মাথায় আঘা*ত করতে চাইল। অমনি পুলিশ এসে ছাড়ালো। শতাব্দ’কে টেনে ধরে দূরে সরালো। শতাব্দ রাগে গরগর করছে তখনো। শরীরের শার্টে র*ক্ত লেগে।

গাড়িতে গুটিসুটি মে*রে বসে আছে প্রিয়। হাত পা এখনো থরথর কাঁপতে। এসি চলছে তবু্ও প্রচন্ড ঘামছে। এর আগে এমন ভয়া’*নক পরিস্থিতীর সম্মোখীন হয়নি কখনো। নিজের অতীত টেনে ওই লোকটার সন্তান বলে জনসম্মুখে পরিচয় দিয়ে গা ঘিনঘিন করছে। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে, সেই সাথে অদ্ভুত বা*জে রকম অনুভূতি আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। গলায় কান্না ধলা বেঁধে। অদ্ভুত ভাবে চোখ ভিজছে না। কাঁদছে না। বড় বড় শ্বাস টানল প্রিয়। আড়চোখে শতাব্দের দিক তাকাল। শতাব্দ প্রচন্ডরকম শান্ত, স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিক আচরণ যেন কালবোশেখী ঝড়ের পূর্বাভাস। খানিক সময় নিলো প্রিয়। খুব স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ আপনি কি করে জানেন আমি এখানে আছি। কে বলল?’
শতাব্দ উত্তর দিলো না। চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে। ধীরেধীরে কপালের রগ, চোয়াল শক্ত হচ্ছে। প্রিয় খাটো স্বরে বলল,
‘ ধন্যবাদ!’
শতাব্দ এবার ক্ষে*পে গেল। রাগ নিয়ন্ত্রণের যথাসম্ভব চেষ্টা করছিল। প্রিয়’র আচরণে দমিয়ে রাখা রাগ অগ্নিগিরি’র মত ফে*টে পড়ল। দ্রুত গতিতে গাড়ি থামালো। রাগে চেচিয়ে বলল,
‘ এত বড় একটা কান্ড ঘটিয়ে তোমার বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। আজ আমার পৌঁছাতে আরেকটু দেরি হলে কি ঘটতে পারত বুঝতে পারছ? এই পরিচয়টা সবার সামনে আনার কি দরকার ছিল। আমার এত বছরের সব চেষ্টা বিফলে গেল। এর ফল কি হবে জানো? না বুঝে না জেনে তুমি মৌচাকে ঢিল মেরেছ। এতদিন শুধু ছবি বেগম তোমার পরিচয় জানতো। এখন সারা দেশ জানবে। তোমাকে ছেড়ে দিবে ওরা? এর ফল কতটা ভয়*ঙ্কর হবে আন্দাজ করতে পারছ? এই পরিচয়ের কথা জেনেই শেষ পরিক্ষার দিন তোমার উপর ছবি বেগম হা*মলা করেছিল। যেন অতীত সেখানেই ধামাচাপা পড়ে! আর তুমি আজ সেই অতীতকেই সবার সামনে টেনে আনলে।’
প্রিয় রাগে চিৎকার করে বলল,
‘ তো ছেড়ে দিতাম ওদের। আমার সাথে যা করেছে ক্ষমা করে দিতাম! বিনা দোষে গ্রামের সবার সামনে ব্যা*শা বনেছি। আমার জন্মদাত্রী মা আত্নহ*ত্যা করেছে। যাকে মা বলে ডাকার সুযোগটা পর্যন্ত পাইনি। আমার জীবনের প্রত্যেকটা সমিকরণ উল্টেপাল্টে দেওয়া মানুষ গুলোকে ছেড়ে দিতাম? উহু, কখনো না। আমি ওদের জ্বা*লিয়ে দিবো। এতটা ভয়ঙ্কর হবো যে, মৃ*ত্যু’র জন্য ভিক্ষা চাইবে ওরা। মানসম্মান, দম্ভ, অহংকার সব মাটিতে মিলিয়ে দিবো। এতে যদি আমাকে ম*রতেও হয় ম*রবো।’
শতাব্দ নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে প্রিয়’র দিক এগিয়ে গেল। গালে শুকনো র*ক্ত মাখা হাত রেখে বোঝানোর স্বরে বলল,
‘ তুমি প্রতি*শোধ চাও তো? আমি তোমার সাহায্য করব! ওদের তোমার পায়ের কাছে এনে ফেলবো। শুধু তু্মি সেফ থাকো। আমাকে একটু বিশ্বাস করো!’
গাল থেকে হাত সরিয়ে দিলো প্রিয়। নিমিষ চেয়ে, তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
‘ বিশ্বাস! আপনাকে?’
বলে হেসে ফেলল প্রিয়। চোখজোড়া ছলছল করছে। গলা ধরে আসছে। কান্না চেপে বলল,
‘ আমি আপনাকে কি করে বিশ্বাস করবো শতাব্দ? সবচেয়ে বড় গোলকধাঁধা তো আপনি নিজেই। যার ভেতর আমি ক্ষণে ক্ষণে নিজের অস্তিত্ব হারাচ্ছি। আমি আপনাকে সাহায্য করতে বলিনি। আপনার দয়া আমার চাইনা।
আপনি সত্যিটা বলবেন না তো। আমিও আর জানতে চাইবো না। তবে শুনে রাখেন আমি আপনাকে বিশ্বাস করি না!’
শেষের তিনটা শব্দ শতাব্দ’কে ক্ষেপিয়ে দিতে যথেষ্ট। যার জন্য সব সম্পর্ক ভুলিয়ে দিয়েছে। নিজের অস্তিত্ব পছন্দ অপছন্দ সব বিলীন করেছে। সেই মানুষটা তাকে সামান্য বিশ্বাস করতে পারছে না? তেতে গেল শতাব্দ। রাগে গাড়ির স্টিয়ারিং’য়ের উপর পরপর দুইতিনবার বাড়ি মা*রল। মা*রামা*রির সময় কে*টে যাওয়া জায়গাটা থেকে, রক্ত ঝরছে টপটপ। রাগে চুল টেনে পিছনে টানল। ফোসফোস নিশ্বাস ফেলছে। রাগ দমাতে চেষ্টা করল। পারছেনা। আচমকা প্রিয়’র দিক ঝুঁকে এলো। বাহু চেপে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
‘ তোমার কথায় আমি চলবো? শুনো মেয়ে তুমি বিশ্বাস করো আর না করো। তাতে কিছু আসেযায় না আমার। তুমি মানো আর না মানো তুমি আমার কথা শুনতে বাধ্য। প্রয়োজনে যদি জোর খাটাতে হয়, বেঁধে রাখতে হয় তাই করবো। বুঝেছ?’
শতাব্দের শেষ ধমকে কেঁপে উঠল প্রিয়। চোখজোড়া অশ্রুভারাক্রান্ত। এই যেন অন্যকোন শতাব্দ! কি হিং*স্র চাহনি তার। নিশ্বাস ফেলতে পারছেনা। ঘামছে! ভয় পাচ্ছে প্রিয়। চোখজোড়া নিভুনিভু হয়ে আসছে তার।
প্রিয়’র অ্যাংজাইটির সমস্যাটা কি আবার দেখা দিলো! ঘাবড়ে গেল শতাব্দ। মাথা আউলে গেল। বারকয়েক প্রিয়’কে আলতো স্বরে ডাকল। উত্তর এলো না কোন। ধীরেধীরে ঝুঁকে পড়ছে প্রিয়। শতাব্দ আরো বেশি ঘাবড়ে গেল। আচমকা বুকে টেনে নিলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ কিছু হয়নি জান! ডিপ ব্রিথিং নেও। শান্ত হও। আমি আছি। এখানেই, তোমার কাছে!’

চলবে……

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )

৪২.

(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

দিনের আলো নিভিয়ে চারিদিক অন্ধকারে ডাকছে। বিকালের অন্তিম প্রহর কাটিয়ে, সন্ধ্যা নামছে ভুবনে। বিছানায় অচেতন পড়ে আছে প্রভা। পাশে বসে নিগূঢ় চেয়ে আছে সমুদ্র। সবার সামনে সবকিছু স্বাভাবিক দেখালেও, ভেতর ভেতরে দুজনের মধ্যেকার দূরত্ব বিশাল। অনেকবার প্রভাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। সে শুনতে নারাজ। এরপর হাল ছেড়ে নিজের মত থাকতে শুরু করেছে সমুদ্র। প্রভার অচঁচল, অন্ধ জেদের সামনে বরাবরই দুর্বল হয়ে পড়েছে। সবটা সময়ের উপর ছেড়ে দিয়েছিল। আজ দুপুরে টিভি চ্যানেলের নিউজ দেখে আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়ে প্রভা। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে জানায়, খাওয়াদাওয়ার, অনিয়ম, মাত্রাতিরিক্ত চিন্তায় প্রেসার লো হয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। বাসায় ফিরেছে খানিক পূর্বে, ঘুমের ঔষধ দিয়েছে। ঘুমাচ্ছে।

সন্ধ্যার পর ঘুম ভাঙ্গল প্রভার। দুর্বল চোখের পিটপিট চাহনি। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই সমুদ্রকে দেখল। দুহাতে বিছানায় ভর ঠেকিয়ে উঠতে চাইল। আটকালো সমুদ্র। বলল,
‘ অসুস্থ শরীর নিয়ে উঠছ কেন! কিছু লাগবে? আমি দিচ্ছি।’
কোন উত্তর দিলো না প্রভা। নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো, একপ্রকার জোর খাটিয়ে বিছানা থেকে নামতে চাইল। তেতে উঠল সমুদ্র। প্রভার হাত চেপে ধরল। ক্রো*ধান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ সমস্যা কি তোমার! কথা বলছি কানে যাচ্ছে না?’
এবারো উত্তর দিলো না প্রভা। ছলছল চোখ নিয়ে হাত ছাড়ানোর জোরালো চেষ্টা চালাল। অকপটে ক্ষেপে আছে সমুদ্র। ছাড়বে না সে। একটা সময় প্রভা ক্লান্ত হয়ে কেঁদে ফেলল। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল। সমুদ্র হতভম্ব, বিমূঢ়! বিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে।
প্রভা পা ভাঁজ করে বসে, হাউমাউ করে কাঁদছে। সাথে সাথে মুখোমুখি বসে পড়ল সমুদ্র। প্রভার দুগালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হয়েছে তোমার। এভাবে কাঁদছ কেন?’
সমুদ্রের জিজ্ঞাসায় কান্নার বেগ আরো বাড়ল। কোথাও চাপা পড়ে থাকা অভিমানটা ফুপিয়ে উঠল। সমুদ্রের বুকে মাথা ঠেকাল। টিশার্টে খামচে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। বিহ্বল সমুদ্র যন্ত্রের মত হাত তুলে, প্রভার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত করতে চাইল। প্রভা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে তখনো। সমুদ্র আবারো জিজ্ঞেস করল,
‘ আমি কি এখন তোমার এতই অপছন্দ! যে আমার স্পর্শে য*ন্ত্রণা বেড়ে যায় আরো।’
সমুদ্রের বাঁকা কথায় প্রভার কান্না বেড়ে গেল। সে কি করে বুঝাবে কতটা ভালোবাসে সমুদ্রকে। এই কয়েকদিন সমুদ্রের এড়িয়ে চলা তাকে কতটা যন্ত্র*ণা দিয়েছে। কতটা পু*ড়িয়েছে। হুট করে তানহার কথা জেনে প্রচন্ড আঘা*ত পেয়েছিল প্রভা। মেনে নিতে পারেনি নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার প্রথম প্রেমকে। অভিমান, ইগোর তলে দেবে গিয়েছিল সে। উপচে উঠতে পারছিলনা নিজের জেলেসি, অভিমান থেকে। সমুদ্রকে দেখা মাত্রই পুরানো ঘা’য়ে লবণের ছিঁটা পড়ত।তাই বারবারই এড়িয়ে চলত। কিন্তু যেই সমুদ্র মুখ ফিরিয়ে নিলো। এড়িয়ে চলতে শুরু করল! অমনি নিজেকে নিঃস্ব মনে হলো। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। ক্ষণে ক্ষণে তপ্ত আগুনে পু*ড়ছিল। রাতের ঘুম, খাওয়া দাওয়া সব উঁড়ে গেল। দিনের পর দিন নির্ঘুম রাত কাটাতে লাগল। অনেকবার নিজের থেকে এগিয়ে সবকিছু মিটমাট করে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু ওইযে ইগো! দেয়াল হয়ে দাঁড়াল। কোনভাবেই মুখোমুখি দাঁড় হতে পারছিলনা সমুদ্রের। শক্ত অভিমান চেপে এড়িয়ে চলছিল। আজ পারছেনা আর। অভিমানের পাথর ঠেলে, ভালোবাসা সুপ্ত চারাগাছের মত মাথা উঁচিয়ে দাড়িয়েছে। মনের গহিনে হাজারো কন্ঠে স্লোগান তুলছে, আজ নয়তো, কোনদিন নয়! হয়তো হারিয়ে ফেলবে তার ভালোবাসা সমুদ্রকে।
কান্নাভেজা আধোআধো কন্ঠে ফিসফিস করে বলল প্রভা,
‘ ভালোবাসি সমুদ্র! অনেক বেশি ভালোবাসি।’
হতভম্ব সমুদ্র পাথর হয়ে বসে রইল। তার কানে আওয়াজ এলোও মস্তিষ্কে বসতে সময় লাগছে। যা শুনেছে সত্যি তো!
আচমকা হেসে ফেলল। ঠোঁটের কোণে হাসির বিশাল রেখা ফুটে উঠল শক্ত করে বউকে বুকে জড়িয়ে নিলো। জোরালো অকপটে আওয়াজে বলল,
‘ আমিও প্রচন্ড ভালোবাসি বউ। তুমি আমার জীবনের আঁধার রাতের উজ্জ্বল আলো! তোমাতে তুমি শ্রেষ্ঠ। না, তোমার মত কেউ ছিল। না থাকবে কখনো। তুমি আমার একমাত্র’
ছলছল চোখ নিয়ে হেসে ফেলল প্রভা। সমুদ্র কানের কাছে মুখ নিয়ে আবারও ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ অতীতের সব স্মৃতি পু*ড়িয়ে দিয়েছি। ছুড়ে ফেলে দিয়েছি আমাদের দূরত্বের সব কারণ। হাজার তানহা আসলেও, আমার প্রভার সামনে ফিকে পড়বে সব!’
সমুদ্রকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, বুকে মাথা রাখল প্রভা। অনেক দিন পর আজ শান্তি মিলল। এরচেয়ে মধুর অনুভূতি কি আছে কোথাও!

রাত করে বাড়ি ফিরল প্রিয় শতাব্দ। পথেই প্রভার অসুস্থতার কথা শুনেছিল। জ্যামে আটকে ফিরতে দেরি হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে তড়িঘড়ি করে বোনের ঘরে গেল প্রিয়। দরজা ভিড়ানো একপ্রকার হুড়মুড়িয়ে ডুকে গেল। ভিতরে ডুকে বেক্কল বনে গেল। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে প্রভা। পাশে বসে মুখে ফল তুলে দিচ্ছে সমুদ্র। প্রিয়কে দেখে খানিক দূরে সরে বসলো। লজ্জায় পড়ে গেল প্রিয়। আমতা আমতা করে বলল,
‘ সরি, আসলে দরজা খোলা ছিল। তাই…’
বিব্রত পরিস্থীতি এড়াতে সমুদ্র স্বাভাবিক হয়ে বলল,
‘ সমস্যা নাই। ভিতরে আসো।’
জড়সড় ছোটছোট পা ফেলে প্রিয় ভেতরে গেল। প্রভাকে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হয়েছিল? হ্ঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লি কি করে? বেবি ঠিক আছে তো!’
‘ বেবি’র’ কথা জিজ্ঞেস করতেই প্রভা ঘাবড়ে গেল। সমুদ্র চুপচাপ। বিয়ের আগে প্রভা বলেছিল, সে প্রেগন্যান্ট তাই প্রিয় বিয়ের জন্য রাজি হয়েছিল। বিছানা ছেড়ে উঠল সমুদ্র, কায়দা করে বলল,
‘ তোমরা কথা বলো, আমি আসছি।’
বাহানা দেখিয়ে বেরিয়ে গেল। সমুদ্রের যাওয়ার দিক প্রভা অসহায় চেয়ে রইল। সে জানে তার আপাকে। এই মিথ্যা কথার জন্য নিশ্চয়ই রাগে ঘাড় ভাঙবে তার। প্রিয় অস্থির কন্ঠে তাড়া দিয়ে বলল,
‘ কি হলো, বেবি ঠিক আছে তো?’
ছোট ঢোক গিলল প্রভা। আমতা আমতা আওয়াজে বলল,
‘ আমি প্রেগন্যান্ট না আপা। তোকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য মিথ্যা বলেছিলাম।’
চোখমুখ খিঁচে নিলো প্রভা। বোনের ধমক, রাগ ঠেলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো। প্রিয় চুপ, শান্ত। হতভম্ব চেয়ে আছে। চেহারায় খানিক বিষাদের আভাস। বোনের আওয়াজ না পেয়ে চোখ খুলে তাকালো প্রভা। ধপ করে হাত জড়িয়ে ধরলো। আকুতি স্বরে বলল,
‘ আপা রাগ করো না প্লিজ! তখন কোন উপায় মাথায় আসছিল না। যা মনে হয়েছে হুট করে বলে দিয়েছি।’
প্রিয়’র শান্ত আওয়াজ,
‘ আমি ভাবছিলাম, বাড়ির সবাইকে ভয় করে প্রেগ্ন্যাসির কথা লোকাচ্ছিস।তোদের দুজনের ঝামেলা চলছে, মিটে গেলে জানাবি সবাইকে।’
প্রভার অনুতপ্ত নিস্তেজ স্বর,
‘ সরি আপা, ভুল হয়ে গেছে। রাগ করিও না। আমি তোমাকে মিথ্যা বলতে চাইনি! ঠকাতে চাইনি।’
‘ অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ঠকে গেলাম।’
প্রভা বোনের হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আকুতি জুড়ে বলল,
‘ সরি। প্লিজ রাগ করো না।’
‘ উহু, রাগ করিনি। এমনিতেও আমি তোর কথাতে বিয়ের জন্য রাজি হইনি। আমার উদ্দেশ্য অন্য। হ্যাঁ, সামান্য আপস্যাড হয়েছি। বাড়িতে বাচ্চা আসবে শুনে খুশি হয়ে ছিলাম। কোলে নিবো, আদর করব, সন্তানের মত….’
এতটুকু বলে চুপ হয়ে যায় প্রিয়। খানিক শান্ত থেকে উদাসীন কন্ঠে বলল,
‘ ব্যাপার না। আজ না হয় কাল, বাড়িতে বাচ্চা আসবে। মা হবি তুই। কারো কারো হয়তো মাতৃত্বসুখ অনুভব করার সেই সুযোগটাও নেই।’
বোনের গম্ভীর ছলছল চোখজোড়ায় তাকিয়ে আছে প্রভা। হ্ঠাৎ কি হলো তার। রেগে যাওয়ার বদলে এতটা আবেগী হচ্ছে কেন আপা!

সমাবেশে ঝামেলার ব্যাপারটা নিয়ে টিভি চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ চলছে। ইতোমধ্যে মোটামুটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপারটা ছড়িয়ে গেছে। জল এতটা ঘোলা হতোনা যদি না প্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার না হতো। তার আইডি পেজে নানারকম ম্যাসেজ আসছে। সাংবাদিকরা শোয়েব হকের অতীত বর্তমানের পুরো হিস্ট্রি নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। সবার একটাই প্রশ্ন, ‘আসলেই কি শোয়েব হকের প্রথম স্ত্রীর মেয়ে অশীতা জাফর প্রিয়!’
বাড়ি ফিরে শতাব্দের মুখোমুখি হয়নি প্রিয়। আসার পর একের পর এক ফোনে ব্যস্ত। প্রিয়কে সুরক্ষা করতে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করে যাচ্ছে।
আজকের ব্যাপারটা নিয়েও কেউ কোন কথা বলছেনা। না প্রিয়’কে কিছু জিজ্ঞেস করছে বাড়ির কেউ। অভিলাষা বেগম অনেক আগেই এমন কিছু হবে বলে ধারণা করেছিল। ভাইয়ের দিক আঙুল তুলছে, বা*জে মন্তব্য উঠছে তা নিয়ে কোন আফসোস নেই। বরং তার ভাষ্যমতে এমনটা আরো আগে হওয়া উচিত ছিল। তারা আরো ভ*য়ানক কিছুর কাম্য!

গভীর রাত। শতাব্দের ঘরে আলো জ্বলছে। ভিতর থেকে হু*মকি ধ*মকির আওয়াজ। দরজার কাছে কান পাতল প্রিয়। ভেতর থেকে শতাব্দের ক্রো*ধান্বিত আওয়াজ ভেসে আসছে। কাউকে রাগী স্বরে বলছে,
‘ এতকিছু বুঝিনা আমি! কে মামা, কে ফুপু ! তাতে আমার কি! আমার ওয়াইফকে নিয়ে যেন কোন বা*জে নিউজ না ছাপে। বাকিরা সবাই গোল্লায় যাক। আমার তাতে আসেযায় না কিছু।’
অপর পাশ থেকে কিছু বলল। শুনে শতাব্দ ক্ষে*পে গেল। রাগে দেয়ালে বাড়ি দিলো। সাথে সাথে হাতের কা*টা জায়গা থেকে ফি*নকি দিয়ে র*ক্ত ঝরতে শুরু করল। সেই দিকে খেয়াল নেই শতাব্দের। ফোনে চেঁচিয়ে বলল,
‘ ছবি বেগম যত টাকা দিয়েছে আমি তার ডাবল দিবো। যদি আমার ওয়াইফকে নিয়ে কোন বা*জে নিউজ ছাপে, আমি তোদের অফিসে আ*গুন ধরিয়ে দিবো। মাইন্ড ইট!’
ফোন কে*টে বিছানায় ছু*ড়ে ফেলল। অকথ্য ভাষায় সাংবাদিককে গালি দিতে দিতে সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় গেল। মাথা বিগড়ে আছে প্রচন্ড। অমনি ঘর থেকে খটখট আওয়াজ ভেসে এলো। ঘাড় ফিরিয়ে একবার চাইল। প্রিয় এসেছে। অস্থির হয়ে, কিছু খুঁজছে। ভীষণ শান্ত দৃষ্টিতে চোখ ফিরিয়ে নিলো, সামনে তাকালো। মিনিট দুএকের ব্যবধানে প্রিয় ফাস্ট এইড বক্স হাতে বারান্দায় এলো। অকপটে চাহনি, অস্থির আওয়াজ,
‘ বসুন, ওষুধ লাগিয়ে দেই হাতে।’
শতাব্দ যেন শুনেও, শুনলো না। নীরবে সিগারেট ফুঁকছে। প্রিয় আবার বলল,
‘ কতটুকু কে*টেছে! র*ক্ত ঝরছে।’
এবারো শতাব্দ চুপ। প্রিয় উত্তরের অপেক্ষায় রইল। কোন জবাব না পেয়ে। জোর করে হাত টেনে ঘরে আনলো। বিছানায় বসিয়ে, মুখোমুখি বসলো। স্যাভলন দিয়ে কাটা জায়গা পরিষ্কার করে দিচ্ছে। প্রিয়’র চিন্তিত মুখখানায় নিগূঢ়, নিমিষ চেয়ে আছে শতাব্দ। কন্ঠে অভিযোগ এঁটে প্রিয় বলল,
‘ কতখানি লেগেছে! কা*টা জায়গাটা খোলা রেখেছেন কেন? ইনফেকশন হবে, ব্যথা বাড়বে।’
‘ কিছু হবেনা, হাত ছাড়ো।’
শতাব্দ হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইল। আটকালো প্রিয়। হাতটা আরো শক্ত করে কোলে উঠিয়ে নিলো। কা*টা জায়গাটা পরিষ্কার করতে মন দিয়ে বলল,
‘ হবে। ইনফেকশন হবে।’
‘ ডাক্তার আমি না তুমি!’
বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নিলো প্রিয়। বলল,
‘ আপনি! তো? তাই বলে কি ডাক্তারদের ওষুধদের প্রয়োজন হয়না?’
শতাব্দ উত্তর দিলো না কোন। প্রিয় জোর খাটিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। শতাব্দ এক দৃষ্টিতে তখনো চেয়ে। বাতাসে প্রিয়’র অবাধ্য চুল উড়ছে। শতাব্দ হাত বাড়িয়ে গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ আজকাল তোমাকে বড্ড অচেনা লাগে প্রিয়। কখনো মনে হয় তুমি শুধু আমার। কখনো আবার ভিন্ন কেউ। এই রহস্যময়ীর এতো রূপ কেন?’
চোখ উচিয়ে তাকালো প্রিয়। শতাব্দের গভীর চাহনি। ব্যথাতুর আ*হত। কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেল প্রিয়। হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই, টেনে বসিয়ে দিলো শতাব্দ। কাছে এনে বুকে মিশিয়ে নিলো। রাগী, গম্ভীর মুখ। চোয়াল শক্ত। অকপট কন্ঠে বলল,
‘ সব ইচ্ছা তোমার! যখন ইচ্ছা অধিকার খাটাবা, যখন ইচ্ছা ছেড়ে যাবা। আর আমার? আমার কোন ইচ্ছা, অধিকার নাই।’
প্রিয়’র ভীতু, ভড়কানো মুখ। হাত ছাড়াতে, ছটফট করছে প্রচন্ড। শতাব্দ দমলো না। বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কপালে কপাল ঠেকিয়ে নিলো। চোখ বুজে, নাকের সাথে নাক ঘোষতে ঘোষতে নিগূঢ় কন্ঠে বলল,
‘ আমারও তোমার উপর অধিকার খাটাতে ইচ্ছে করে প্রিয়। জোর করে কোলে বসিয়ে চুমু খেতে ইচ্ছে করে। বুকে জড়িয়ে গভীর রাতে তোমার এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। আমাকে কেন বাঁধা দেও?’
চোখ বুজেই ভীতু ঢোক গিলল প্রিয়। খাল কে*টে কুমির আনাটা কি খুব দরকার ছিল!

চলবে……