ফিলোফোবিয়া পর্ব-৫০ এবং শেষ পর্ব

0
786

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )

৫০ ( প্রথম অংশ)

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

হতভম্ব, ভীতু, বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়। বাহিরে ঘন বর্ষণ। বৃষ্টির ঝুপঝাপ আওয়াজ। অন্ধকার অনুজ্জ্বল ঘর। মোমবাতির আলোতে নিভুনিভু আলো জ্বলছে।
শতাব্দ বরাবরের মতই গম্ভীর। অস্বাভাবিক শান্ত। নিগূঢ় রাগান্বিত চেয়ে। মনে মনে ঠিক এ ভয়টাই পাচ্ছিলো। শতাব্দের মুখোমুখি হলে নিজেকে কি করে সামলাবে। তার ভয়ঙ্কর ক্রো*ধের তোপ থেকে নিজেকে বাঁচানো কি আদৌ সম্ভব! ঢোক গিলল প্রিয়। হাতপা কাঁপছে অনবরত। ভয়ে পেছন দিক যেতে লাগলো। শতাব্দ আগাচ্ছে। প্রিয় পিছাচ্ছে। একটা সময় বিছানার সাথে লেগে ধপ করে পড়ে গেল। শতাব্দ থামল। তড়িঘড়ি করে প্রিয় শোয়া থেকে উঠে বসলো। ভীতু স্বরে আওড়াল,
‘ আ..আমার কথাটা শু…
প্রিয়’কে কথা শেষ করতে না দিয়ে, ধুপধাপ পায়ে এগিয়ে এলো শতাব্দ। প্রিয়’র কোলে মাথা রেখে। পেটে মুখ গুজে, সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। হতভম্ব প্রিয়। ভেবেছিল দুইচারটা থা*প্পড় পড়বে গালে। অথচ এতো স্বাভাবিক আচরণ! শতাব্দের এই স্বাভাবিক আচরণ-ই প্রিয়’র ভয় বাড়াচ্ছে। খানিক সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করল প্রিয়। আমতা আমতা করে প্রশ্ন করল,
‘ কেন এসেছেন?’
শতাব্দের রাগ চাপা অকপটে আওয়াজ,
‘ ঘুমাতে!’
‘ ঢাকা থেকে মধুপুর ঘুমাতে এসেছেন? ঠিকানা কোথায় পেলেন? মা দিয়েছে?’
চোখ বুজে আছে শতাব্দ। নিস্তেজ কন্ঠের গভীর আওয়াজে বলল,
‘ অনেক কাল ঘুম হয়না, মাথায় হাত বুলিয়ে দেও। একটু ঘুমাব!’
শতাব্দের অস্বাভাবিকরকম স্বাভাবিক আচরণে থমকে গেল প্রিয়। জলে ছলছল করছে চোখ। প্রিয় জানে কোন কিছু ঠিক নেই, সবকিছু এলোমেলো। জোর খাটিয়ে শতাব্দ স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করছে। যা প্রিয়’কে নিজের কাছে নিজেকে আরো বেশি ছোট করছে, অ*পরাধী, লাগছে। অধৈর্য হলো সে। খানিক চেঁচিয়ে বলল,
‘ কেন জোর করে এমন স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করছেন। আমি জানি, আমি অপ*রাধী। বকবেন? মা*রবেন? রাগ ঝাড়বেন? যা ইচ্ছা করে, চলে যান।’
চোখ বুজেই কপালে আঙুল চালিয়ে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে শতাব্দ। অনবরত বলে যাচ্ছে প্রিয়,
‘ চিঠিতে সবকিছু ক্লিয়ার করে দিয়েছি। আমাকে আমার মত একা থাকতে দিন। এখান থেকে চলে যান প্লিজ।’
অনেকক্ষণ যাবত রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টাটা নিয়ন্ত্রণহীন হলো এবার। শতাব্দের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গল। ক্রোধান্বিত রক্তিম চোখ জোড়া খুলে, তড়াক করে উঠে বসলো। ধাক্*কা দিয়ে প্রিয়’কে বিছানায় ফে*লে। উপরে চড়ে বসল, তার দিক ঝুঁকে তাকালো। ঘর কাঁপানো রাগী আওয়াজচিৎকার করে বলল,
‘ কি চাও তুমি? অশান্তি! শান্তভাবে ডিল করাটা পছন্দ হচ্ছেনা? রেগে দুচারটা থা*প্পড় লাগাই, সেটা ভালো লাগবে?’
বিস্ময়ে থমকে গেল প্রিয়। নিমিষ চেয়ে রইল।
আচমকা রাগে প্রিয়’র গাল চেপে ধরলো শতাব্দ। প্রিয়’র পা জোড়া নিজের পায়ের বেড়া জালে আটকে ধরলো। ঠোঁট জোড়া ঠোঁটের ভাজে নিয়ে নিলো। শক্ত করে কয়েকটা কামড় বসালো। ছাড়া পাবার জন্য হাতপা ছোড়াছুড়ি করছে প্রিয়। ছাড়ল না শতাব্দ। ওষ্ঠজোড়া আরো আড়ষ্টভাবে জড়িয়ে ধরল। গভীর করে চুমু দিতে লাগল। আস্তে আস্তে গলায় এসে ঠেকল। শক্ত করে কয়েকটা কামড় বসালো। প্রিয় ব্যথাতুর আওয়াজ করল। শুনলো না শতাব্দ। ক্রোধে যেন উন্মদ প্রায়। শতাব্দের পাগলামোতে স্থীর থমকে গেল প্রিয়। শক্ত পাথর বনে ফ্যালফ্যাল চেয়ে রইল। কি থেকে কি হচ্ছে এসব। কারো রাগ প্রকাশের মাধ্যম এমন অমানবিক ভয়ঙ্করও হয়!
অনেকটা সময় পর থামল শতাব্দ। ঝুঁকে এলো, দাঁতে দাঁত চেপে কিটকিটে আওয়াজে বলল,
‘ আমাকে হু*মকি দেওয়া? আমাকে? কাছে এলে অনর্থ ঘটাবে! এতবড় কলিজা? এইযে চুমু খেলাম। কামড়ে দিলাম। এখন কি করবে শুনি। অনর্থ ঘটাবে! এতই সহজ? চিঠিতে কি জানো লিখেছিলে, অন্যকারো সাথে যেন সংসার সাজাই। অন্যকারো সাথে সংসার সাজালে তাকে রোজ এভাবে আদর করবো, ভালোবাসবো সইতে পারবে তো? আবার নিশ্বাস থেমে যাবেনা তো তোমার!……
প্রিয় চুপ। ফ্যাচফ্যাচ নাক টানছে।শতাব্দ আবার কাছে এলো। গাল চেপে ধরল। বলল,
‘ শুনো মেয়ে আমি গল্প উপন্যাসের নায়কদের মত সাধু নই, যে দূরে সরে যাবো, অন্যকারো সাথে মানিয়ে নিবো। আমার তোমাকেই চাই! না পেলে সব জ্বা*লিয়ে দিবো।’
প্রিয়’র নিভে থাকা আঁখিপল্লব থেকে টপটপ জল গড়িয়ে পড়ছে। ঘরে ফোঁসফোঁস ফোঁপানোর আওয়াজ ভাসছে। শতাব্দ থামল। চোখ বুজে। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। শান্ত আকুল কন্ঠে বলল,
‘বছরের পর বছর কাটবে, পাঁচ বছর, দশবছর আজীবন। তবুও তোমার শূন্যতা কেউ পূর্ন করতে পারবেনা প্রিয়। এই অনুভূতিতে কোন পরিবর্তন হবে না। আমি তোমাকে ভালোবেসেছি, ভালোবাসি আর সারাজীবন ভালোবেসে যাবো।’
কান্না চেপে রাখতে পারল না প্রিয়। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। উপর থেকে সরে গেল শতাব্দ। পাশে শুয়ে বুকের গভীরে জড়িয়ে নিলো প্রিয়’কে। চুলে হাত ডুবিয়ে দিলো। বলল,
‘আমার ভালোবাসা কি এতটাই দুর্বল প্রিয়? যে এইটুকু ঠুনকো কারণে আমি ঠকে যাবো। কোন বাচ্চাকাচ্চা চাইনা, শুধু আমার প্রিয় হলেই যথেষ্ট!’
থমকে রইল প্রিয়। বুক থেকে মাথা তুলে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো। তাহলে তার অসুস্থতার কথা জানে শতাব্দ?
অশ্রুভেজা দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। নিমিষ স্বরে বলল,
‘ এখন হয়তো বাচ্চা চাইনা আপনার। পাঁচবছর, দশবছর পর একটা সময় আসবে যখন আপনার বাবা না হওয়ার আফসোস হবে। তখন আপনার সেই আফসোস আমি কি করে সহ্য করবো?’
‘তোমাকে ভালোবাসি। আমার ভালোবাসার বদলে তোমাকে সন্তান জন্ম দেওয়ার মেশিন হতে হবেনা প্রিয়। ট্রাস্ট মি সন্তান নিয়ে বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। না কখনো হবে। তুমি আমার কাছে থাকবে, এটাই আমার জন্য যথেষ্ট।’
মন সায় দিচ্ছে প্রিয়’র। অধৈর্য্যে হয়ে বলল,
‘ আপনি আমার উপর দয়া করছেন। আপনার দয়া তলে আজীবনের জন্য দেবে যাবো!’
প্রিয়’র দুগালে হাত রেখে উঁচিয়ে ধরল শতাব্দ। দৃষ্টি ঝুকিয়ে রেখেছে প্রিয়। চোখে চোখ মেলানোর চেষ্টা করল শতাব্দ। উৎকণ্ঠা, অধৈর্য হয়ে বলল,
‘ এই প্রিয় একবার আমার দিকে তাকাও, শুধু একবার ভালোবাসি বলো! কথা দিচ্ছি বউ না, চিরকাল রানির আসনে রাখবো।’
দুই লাইনের এই কথা গুলো প্রিয়’র নাছোড়বান্দা জেদ ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে যথেষ্ট ছিল। নিজেকে আর আটকে রাখতে পারল না প্রিয়। শতাব্দের বুকে ঝাপিয়ে পড়ল। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল, হাউমাউ কান্নায় ভেঙ্গে চিৎকার করে বলল,
‘ ভালোবাসি। সেই প্রথম থেকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসি।’
শতাব্দ তার প্রাণপ্রিয়কে জড়িয়ে ধরল। চোখবুঁজে তৃপ্তির হাসি হাসল। অবশেষে তার এতবছরে অক্লান্ত সাধনা পূর্নতা পেল। তার প্রাণপ্রিয় পুরোপুরি তার হলো। এখন না আছে বিচ্ছেদ, না আছে কোন দূরত্ব। মনের আকাশের সবটা জুড়ে তার ভালোবাসা আর প্রাণপ্রিয়।
প্রিয়’র ঠোঁট জোড়া, ঠোঁটের ভাজে নিয়ে নিলো। বাঁধা দিলো না প্রিয়। না সংকোচ করল। আজ দুজন উন্মাদ প্রেমিক প্রেমিকা যেন স্বর্গ পেল। বাঁধাহীন, ভীতিহীন,সংকোচহীন পবিত্র প্রেম। মিলনের গভীর সাগরে তলিয়ে গেল। নিকষ কালো রাত। বাহিরে ঝড়বৃষ্টি। ভেতরে প্রেমময় বর্ষণ।

ভোরের আলো ফুটেছে। জানালার পর্দা না থাকায় তীর্যক আলো এসে চোখে লাগছে। কপাল কুঁচকে নিলো শতাব্দ। উপুড় হয়ে শুয়ে একহাতে ঘুমন্ত প্রিয়’কে জড়িয়ে ধরে। ঘাড়ের পেছনে মুখ ডোবালো। ঘাড়ের কাছে ঘনঘন তপ্ত শ্বাস পড়তে নড়েচড়ে উঠল প্রিয়। পিটপিট দৃষ্টিতে মেলে তাকাল। ঘুমন্ত শতাব্দ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। শরীরে নড়বার জোর নেই। খানিক চেষ্টা করে থেমে গেল প্রিয়। ঘাড় ফিরিয়ে শতাব্দের দিক তাকালো। ঘুমে তলিয়ে থাকা নিস্পাপ শিশু যেন। তাকে সারারাত জাগিয়ে এখন কুম্ভকর্ণের মত ঘুমানো হচ্ছে? চুলের আগা টেনে শতাব্দের চোখেমুখে ফেলল। সুড়সুড়িতে কেঁপে উঠল শতাব্দ। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,
‘ কি হয়েছে প্রিয়?’
দুষ্টু হাসলো প্রিয়। বলল,
‘ ছাড়ুন উঠবো।’
চোখে বুজেই শতাব্দ গম্ভীর হয়ে বলল,
‘ কেন? আবার পালানোর ফন্দি আঁটছ?’
ঠোঁট মেলে হাসলো প্রিয়। বলল,
‘ উহু, এইযে বাঁধা পড়লাম, এই বাঁধা ছেড়ে কোনদিন যাবোনা আর।কথা দিলাম!’
উত্তরে কিছু বলল না শতাব্দ। প্রিয়কে বুকে জড়িয়ে, হাতের বাঁধন আরো শক্ত করল। শতাব্দের উন্মুক্ত বুকে ধাক্কা দিলো প্রিয়। কন্ঠে আহ্লাদ জুড়ে বলল,
‘ অনেক বেলা হয়েছে উঠব। নাস্তা রেডি করব।’
‘ তুমি হলেই চলবে, নাস্তায় আর কিছু বানানোর দরকার নাই।’
লজ্জায় নুয়ে গেল প্রিয়। শতাব্দের বুকে আঘা*ত করে বলল,
‘ ঠোঁট কা*টা, বেশরম লোক। ছাড়ুন। উঠবো!’
‘ ছাড়তেই হবে? না ছাড়লে হচ্ছেনা?’
মাথা ঝাকালো প্রিয়। শতাব্দ হাত উঁচাতেই, বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল প্রিয়। গায়ে শতাব্দের শার্ট জড়ানো। প্রতিদিনকার অভ্যাসের মত ফোন হাতে নিলো। অমনি আয়শার নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এলো,

আমার প্রিয় মা,

বরাবরই আমার চিঠি লিখতে পছন্দ। আশি দশকের মানুষ কিনা! তোকে চিঠি দেওয়ার সৌভাগ্য হলোনা। তাই আধুনিক যুগের পন্থাই অবলম্বন করলাম।
আমার কাছে তুই কোনদিন অপছন্দের, লজ্জার ছিলিনা প্রিয়।এই পৃথিবীতে তুই আমার শ্রেষ্ঠ পাওয়া। জানি তোর উপর অনেক অন্যা*য় করেছি। মায়ের মত আগলে রাখতে পারিনি। কিন্তু সদা তোর ভালো চেয়েছি। তুই আমার দুর্বলতা নয়। একমাত্র শক্তি, প্রাণভোমরা প্রিয়। আর আমি জানি আমার প্রাণভোমরা কেবল শতাব্দের কাছেই সুরক্ষিত। এই সমাজ আমার আপনজনের কাছে আমি মৃ*ত। তাই নতুন করে জীবিত হতে চাইনা আর। এই দেশ, সমাজের মানুষের উপর আমি বিরক্ত। এই সমাজের বি*ষাক্ত নিশ্বাসে ক্ষণে ক্ষণে ম*রতে চাইনা আবার। আমি চলে যাচ্ছি। এই দেশ, এই বিষাক্ত সমাজ ছেড়ে, অনেক দূর। একা মানে একাকীত্ব নয়। কখনো কখনো স্বাধীনতাও হয়। চিরকাল ধুকেধুকে ম*রলাম। প্রাণ খুলে বাঁচতে চাই এবার। জীবনের রঙগুলোকে উপভোগ করতে চাই। দেশবিদেশ ঘুরতে চাই। কোথায় যাচ্ছি জানাতে চাইছিনা। তবে হ্যাঁ, আমি চিরকাল তোর পাশে ছায়া হয়ে রবো। যখনি আমার প্রয়োজন পড়বে চলে আসবো। আমি জানি আমার মেয়ে বাঘিনী। সবরকম পরিস্থীতিতে নিজেকে সামলাতে প্রস্তুত। পরিশেষে একটা কথাই বলবো, তোকে ভীষণরকম ভালোবাসে শতাব্দ। ওর মত আর কেউ হয়না প্রিয়। তাকে বলিও আমি চললাম, কফির বিলটা তুলে রাখলাম। পরেরবার দেখা হলে সুদেআসলে নিয়ে নিবো। সবশেষে নিজের খেয়াল রেখো। আমার মেয়ে, আমার প্রিয়।

ইতি
তোর মা

প্রিয়’র চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি। অস্পষ্ট আওয়াজে ‘মা’ শব্দটা বেরিয়ে এলো। আজ কোন আফসোস নেই । না আছে কোন অভিযোগ। মায়ের ভালো থাকাটাই জরুরী একান্ত।

চায়ের কাপ নিয়ে শতাব্দের পাশে বসলো প্রিয়। সূরের সোনালী রোদ এসে চোখে মুখে পড়ছে তার। ঠোঁটে ভুবন ভুলানো হাসি তার। সামনে বসে থাকা অপ্সরীর দিক মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল শতাব্দ।স্মিত হেসে প্রিয়’র এলোমেলো অবাধ্য চুল গুছিয়ে দিলো। প্রিয় হাত উঁচিয়ে হাতের পিঠে চুমু এঁকে বলল,
‘ এবার চলো।’
‘ কোথায়?’
প্রিয়’র বিহ্বল আওয়াজ। শতাব্দ মৃদু হাসলো। গালে হাত ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
‘ আমাদের বাড়ি। তোমার ফেলে আসা সংসার অপেক্ষা করছে তোমার।’

চলবে…..
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )

৫০ (শেষাংশ )

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

গতরাতের ঝড়ের পর এক নতুন সোনালী দিনের আগমন। গত সন্ধ্যায় ছবি বেগম ও তার ছেলেমেয়েকে গুলশানের নিজ ফ্ল্যাট থেকে পুলিশ আটক করেছে। বর্তমানে খবরটা, হেডলাইন হয়ে নিউজ চ্যানেল গুলোতে ঘুরাঘুরি করছে। তাদের জন্য কিঞ্চিত আফসোস নেই কারো। চেয়ারম্যান শাহরিয়ার সাহেবও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এমন কলঙ্কিনী বোন, ভাগিনা ভাগ্নী থাকার চেয়ে, না থাকাই ভালো। অ*পরাধীরা যেন তাদের প্রাপ্য শাস্তি পায়, তা নিশ্চিত করেছে শতাব্দ।
শাদের উৎফুল্ল মন। অবশেষে তার আর তুরফার মধ্যেকার সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর হবে আজ। সকাল সকাল ক্যাম্পাসে এসেছে। তুরফার জন্য সার্প্রাইজের আয়োজন করছে। ঘটা করে প্রপোজ করবে বলে। তুরফার মনের কথা মুখে স্বীকার করিয়েই ছাড়বে। ক্যাম্পাসের পশ্চিম দিকের লেক পাড়ে সুন্দর করে সাজিয়েছে। সাদা কাপড় আর লাল গোলাপের ছাদ ছাড়া ঘরের মত বানিয়েছে। দমকা হাওয়ায় সাদা পর্দা গুলো এলোমেলো উড়ছে।
তুরফাকে আনতে তার বান্ধবী তিশাকে বাড়ি পাঠিয়েছে। ক্যাম্পাস থেকে তুরফার বাড়ি খুব একটা দূর নয়। বিশ মিনিটের পথ। ঘন্টা দুই কা*টলো। অধীর আগ্রহে তাদের আসার অপেক্ষা করছে শাদ। একটা সময় বিরক্ত হয়ে ফোন করবে বলে মোবাইল বের করতেই, দূরে তিশাকে আসতে দেখল। সাথে তুরফা নেই। তিশা একা আসছে কেন?
চোখ মুছতে মুছতে তিশা সামনে এসে দাঁড়াল। শাদ কপাল কুঁচকে নিলো। বিহ্বল সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘ কাঁদছ কেন? তুরফা কই!’
তিশা চুপ। চোখ মুছতে মুছতে কাঁধে ঝুলানো ব্যাগটা থেকে একটা চিঠির খাম বের করল। শাদের হাতে ধরিয়ে বলল,
‘ সরি। জানি মানতে কষ্ট হবে। বি স্ট্রং। ‘
বলেই বড়বড় পা ফেলে তিশা চলে গেল। শাদ বিস্মিত হতভম্ব। কাঁপাকাঁপি হাতে খাম খুলে চিঠি বের করল। পড়তে শুরু করল।

শাদ,

জানি চিঠিটা পড়ার পর তুমি আমার উপর রাগবে, হয়তো ঘৃ*ণাও করতে শুরু করবে। তবুও আজ আমি সত্যিটা বলব। মনের মধ্যে আর কতকাল দাফন করে রাখব? আমি সত্যি ক্লান্ত। আমি জানি তুমি আমার অতীত সম্পর্কে অবগত। প্রিয় আপা বলেছে তোমায়। কিন্তু যদি বলি তুমি যা জানো, তা শুধু মাত্র অর্ধেক সত্য! সেইদিন নদীর পাড়ে লিমন আর তার বন্ধুদের প্রথম নজর আমার উপর ছিল। আমার তখন বয়সী বা কত ছিল। ওইটুকু বয়সের বাচ্চা মেয়েকে দেখে ওই জা*নোয়ার প*শুরুপি অ*মানুষ গুলোর যৌন আকাঙ্খা জেগে গিয়েছিল। ওদের মাদ*কাসক্ত দেখে আমি আর আপা যখন বাড়ি ফিরে আসছিলাম। তখন লিমন আপার থেকে আমাকে ছাড়িয়ে জঙ্গলের ভেতর ওদের আড্ডাখানায় নিয়ে যাচ্ছিল। আমি জোরাজোরি করলে আমার ফ্রকের শোল্ডার টেনে ধরে ছিড়ে ফেলতে চায়। তদ্রা আপা এসে আটকায়। মাতাল লিমনের হাতে কামড়ায়। আমাকে ছাড়াতে চেষ্টা চালায়। একা হাতে আমাকে ছাড়াতে পারলেও, ততক্ষণে লিমনের বন্ধুরা এসে ঘিরে ফেলে আপাকে। একজন মাতাল সামলানো সহজ কিন্তু চার পাঁচজন মাতালের সাথে একজন কিশোরী মেয়ের পেরে উঠা অসম্ভব। আপা আমাকে পালিয়ে যেতে বলে। আমি ঘাবড়ে যাই, দাদীকে ডাকতে পালিয়ে যাই। কিন্তু যখন মানুষজন নিয়ে ফিরে আসি ততক্ষণে সব শেষ। আপা আশেপাশে কোথাও নেই। লা*শ পাবার পর আব্বা আম্মা যখন কেস করল। ছবি বেগম হু*মকি দিলো। বলল, যদি কোনপ্রকার ঝামেলা তৈরি করে তাহলে আমাকে সমাজের সামনে ধর্*ষিতা প্রমাণ করবে। যদি তার ছেলেমেয়েদের কোনরকম ঝামেলা হয়, আমাকেও বাঁচতে দিবেনা তারা। আমার আব্বা আম্মা পিছিয়ে যায়। পুরোপুরি দমে যায়। যত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা ছড়িয়েছিল ততটাই চটজলদি ভাবে ধামাচাপা পড়ে যায়। অবশ্য তখন একবার শতাব্দ ভাই আমাদের বাড়িতে আসে, আব্বা আম্মার সাথে দেখা করে কেস রিওপেনের কথা বলে। কিন্তু আব্বা আম্মা সাহস পায়না। এটা একটা এক্*সিডেন্ট পানিতে পড়ে মা*রা গেছে বসে কাটিয়ে দেয়। শতাব্দ ভাইকে এইসব ব্যাপারে দূরে থাকতে বলে। তখন অবশ্য শতাব্দ ভাইকে আমি চিনতাম না। জানতাম না তিনিই চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলে। আব্বা আম্মার মেডিকেল স্টুডেন্ট বলেই জানতাম। এরপর অনেক বছর কাছে। আমার অপ*রাধবোধ আমাকে তিলেতিলে পো*ড়াতে থাকে। সেদিন আমাকে বাঁচাতে না এলে, আপা আজ জীবিত থাকত। আমি এগ্রে*সিভ প্রতি*শোধ পরায়ণ হয়ে পড়ি। সবসময় মাথাত ঘুরঘুর করত শা*স্তি দিতে হবে। কিন্তু আমি ছিলাম বরাবরই দুর্বল। এসব বড় ব্যাপার গুলো আমার দ্বারা কাম্য নয়। ভাগ্যের ফেরে হ্ঠাৎ একদিন তোমার সাথে দেখা হয়। প্রথম না জানলেও কিছুদিনের ভেতর তোমার পরিচয় জেনে গিয়েছিলাম। ইচ্ছে করে তোমাকে আমার দিক আকৃষ্ট কবন্ধুত্ব করে প্রেমের মায়ায় জড়াই। পরে পরিচয় জানার নাটক করে দূরত্ব বাড়াই। আমার প্রতি আকৃষ্টতা বাড়াই। আমার একমাত্র টার্গেট ছিল ওই পরিবারে জড়ানো। হোক তা যেকোনো মাধ্যম। ধারণা ছিল পুরো ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে চেয়ারম্যান পরিবারেরও হাত ছিল। কিন্তু অনেক পরে জানতে পারি আমি ভুল ছিলাম। এসব কিছুতে ছবি বেগমের একার হাত ছিল। তিনি নিজের টাকা ক্ষমতা, জোর খাটিয়ে এসব করেছিল। আর প্রিয় আপাই সবটা ক্লিয়ার করেছিল। সত্যি জেনে আমি দূরে সরে যেতে চাই। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছিল। নাটক করতে করতে কখন যে ভালোবাসায় জড়িয়ে যাই, নিজের ও অজানা ছিল। হয়তো প্রিয় আপার চোখে বেঁধেছিল, তাইতো আমাকে আর তোমাকে জুড়তে চাইছিল। কিন্তু আমি পারছিলাম না। মিথ্যা ছলচাতুরী দিয়ে শুরু করা সম্পর্কে আমি কি করে তোমাকে জড়াই। তাছাড়া ওই মানুষগুলোর প্রতি তিক্ততা আমার কোনদিন কা*টবে না। এত তিক্ততা ঘৃ*ণার মধ্যে আমাদের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠবে কি আদৌ। আমি কি পারতাম নিজের ভালোবাসা গুলোকে ধরে রাখতে? যদি অবেগের মত হাতছানি দিয়ে ভালোবাসার অনুভূতি গুলো আবার মিলিয়ে যেত! আমার ভয় হতে শুরু হয়। নিজের কালো অতীতের স্মৃতি নিয়ে নতুন করে জীবন সাজানো আমার জন্য অসম্ভব ছিল। দোটানায় পড়ে গেছিলাম। নিজের সাথে জড়িয়ে তোমার জীবনটা এলোমেলো করে চাইছিলাম না। তাই আব্বা আম্মার সিদ্ধান্তে আমি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। এখানে থেকে অতীত ভুলানো সম্ভব না। না এই অতীত নিয়ে সামনে আগাতে পারবো কোনদিন। আমার জন্য থেমে থেকো না। অতীত মুছে সামনে আগাও। আমি কোন আশা রাখছিনা, তুমিও রেখো না। সবার নিয়তি কি প্রিয় আপা শতাব্দ ভাইয়ের মত হয়। আমি চলে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি তা নাহয় অজানাই থাক।

ইতি
তোমার খানিকক্ষণের প্রেয়সী

শাদ বিস্মিত, হতভম্ব। কানের কাছে ঝিরিঝিরি করছে। অসহ্য যন্ত্রণায় মাথা চেপে ধরছে। মস্তিষ্কে অনেক প্রশ্নের ছড়াছড়ি। কোথায় যাবে, কোথায় খুঁজবে তুরফাকে। ভেবে পাচ্ছেনা সে। তড়িঘড়ি করে মোবাইল বের করল। তিশার নাম্বারে ফোন করল। তিশা রিসিভ করতেই শাদ তড়িঘড়ি কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ এই চিঠি তোমার কাছে কে দিয়েছে। তুরফা? ওর ফ্লাইট কখন।’
তিশা চুপ। শাদ ধমক স্বরে বলল,
‘ এখনো কিছু বিগড়ায়নি, তাড়াতাড়ি বলো।’
অপর পাশ থেকে তিশা আমতা আমতা করে বলল,
‘ তুরফা দিয়েছে। আমি যখন ওর বাড়িতে গিয়েছিলাম, এয়ারপোর্টের জন্য বের হচ্ছিল। দুপুরে ফ্লাইট।’
ফোন কে*টে সাথে সাথে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল শাদ। এয়ারপোর্টে হাজার হাজার মানুষজন। এত মানুষের মাঝে তুরফাকে খুঁজবে কোথায়? হন্য পাগলের মত করে খুঁজতে লাগল। জোর গলায় তুরফার নাম নিয়ে ডাকতে লাগল।আশেপাশের মানুষজন চেয়ে। একজন তৃষ্ণার্ত পাগল প্রেমিক শেষ আশাটুকু আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছে। হন্য হয়ে তার প্রেয়সীকে খুঁজছে। তুরফা কোথাও নেই। গার্ড ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকতে চাইল। জোরাজোরি শুরু করল। গার্ডরা সর্বস্ব দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে। শাদ নারাজ। অনবরত পাগলের মত চিৎকার করে বলছে, ‘ আমাকে যেতে দিন। তুরফা ভেতরে আছে, ওর সাথে করাটা জরুরী খুব।’
বারবার আহাজারি করছে। গার্ডরা তাদের নিয়মের বিরুদ্ধে যেতে নারাজ।
মোহসিন সাহেব মাত্রই মেয়েকে শেষ বিদায় দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। অমনি ভিড় দেখে এগিয়ে গেলেন। চেনা পরিচীত আওয়াজ। গার্ডদের সাথে শাদের ধস্তাধস্তি দেখে থমকে গেলেন তড়িঘড়ি করে ভেতরে গিয়ে আটকালেন। শাদকে মূলত আগে থেকেই চিনে। শতাব্দের সুবাদে পরিচীত। সেই সাথে মেয়ের বন্ধু।
মোহসিন সাহেবকে দেখে শাদের দেহে যেন প্রাণ ফিরে এলো। অতি উৎসাহ, আশা আর আগ্রহ জুড়ে তড়িঘড়ি করে বলল,
‘ তুরফা! আঙ্কেল তুরফা কই?’
মোহসিন সাহেব নীরব। শাদের অধৈর্য অস্থিরতা বাড়লো। অকপটে আওয়াজে বলল,
‘ আঙ্কেল প্লিজ একবার বলুন তুরফা কই। শেষবার, একটাবার ওর সাথে আমার দেখা হওয়াটা দরকার। প্লিজ আঙ্কেল।’
শাদের অনুনয় বিনয় দেখে মোহসিন সাহেবের মন গললো। মেয়ের নিষেধ অমান্য করে বলল,
‘ অনেক দেরি হয়ে গেছে বাবা। ফ্লাইট টেকঅফ করেছে। তুরফা লন্ডনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে।’
শাদ থমকে গেল। নিমিষ চেয়ে রইল। এক মুহূর্তেই যেন তার পুরো দুনিয়া পাল্টে গেল। যার জন্য এত কিছু করল। সে এভাবে তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। শেষবারের মত কথা বলাটারও প্রয়োজন বোধ করল না। এতটা অকৃতজ্ঞ হয় কেউ কখনো। যদি এটাই তার ইচ্ছা হয়। শাদ ফিরে তাকাবে না আর কখনো। যে মানুষটা তাকে এইটুকু চায়না। সেই মানুষটা তার না হোক।

নীল গগনে। সাদা মেঘেদের ভেতর বিমান ভাসছে। জানার কাছে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে তুরফা। অশ্রুভারাক্রান্ত চোখ। ব্যথিত মন। শাদের করুন আকুতি আহাজারি ইমিগ্রেশন থেকে সে দেখেছিল। ততক্ষণে কোন পথ ছিলনা। ফিরে তাকানোর সব পথ বন্ধ করে এসেছে নিজে। কি লাভ হতাশা কষ্ট বাড়িয়ে। যদি তাকে ঘৃ*ণা করে ভালো থাকে শাদ। থাকুক না! তাতে ক্ষ*তি কোথায়। চোখ বুজে নিলো। বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘ তুমি জিতে গেছো শাদ। হয়তো ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়।’

একই ফ্লাইটের বিজনেস ক্লাসে বসে আছে আয়শা বেগম। উইন্ডো সিটে বসে বাহিরে তাকিয়ে। আকাশ থেকে সবকিছু ধুলিকণার মত দেখা যাচ্ছে। সাদা মেঘেদের ভেতর মিলিয়ে যাচ্ছে। অশ্রুভেজা চোখ দিয়ে প্রিয়’র হাস্যোজ্জ্বল ছবিটায় চোখ বুলিয়ে নিলো একবার। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেশ টেনে বলল,
‘ আমার অপূর্ণ জীবনের মত তোর জীবন না হোক। পৃথিবীর সব পূর্ণতা ভালোবাসা শুধু তোর হোক।’

একই ফ্লাইটে দুজন বিষন্নভারী মন নিয়ে বসে। একজন ভালোবাসার মানুষ ফেলে যাচ্ছে, অন্যজন নিজের একমাত্র সন্তান ছেড়ে। নিয়তির ফেরে দুজনই মাতৃভূমি ছেড়ে বহুদূরে পাড়ি জমাচ্ছে।

চার বছর পর,

সময় বহমান। পৃথিবীর সব ক্ষত নাকি ভরে উঠে সময়ের নীড়ে। কথাটা কি আদৌ পুরোপুরি সত্যি!
সময় পাল্টেছে। চার বছরে অনেক কিছু বদলেছে। ছবি বেগম ও তার ছেলে মেয়েদের মৃ*ত দন্ড না হলেও। যাবত জীবন কা*রাদণ্ড হয়েছে। টাকা, ক্ষমতা কোনকিছুর জোর বাঁচাতে পারেনি তাদেরকে। জেলের চৌদ্দশিকের ভেতর নিজেদের অ*পরাধের শাস্তি ভোগ করছে।
শোয়েব হক প্যারালাইজড। অবস্থার সুধার হয়নি বরং দিনদিন আরো খারাপ দিকে যাচ্ছে। আশেপাশে আপনজন কেউ নেই। টাকার দয়ায় নার্সদের দ্বারা ছিটাফোঁটা কোনরকম সেবাযত্নে শ্বাস চলছে। ক্ষণে ক্ষণে মৃ*ত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে।

চেয়ারম্যান বাড়িতে আমদ ফুর্তি লেগে। বাড়িতে নতুন অতিথি আসছে। প্রভা মা হচ্ছে। ডেলিভারির সময় প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। বোনের সাথে প্রিয়ও ইমান্দিপুর এসেছে। এখানে মানুষজন অনেক, সেবাযত্নের কমতি হবেনা। সারাক্ষণ সবাই চোখেচোখে রাখবে। সর্বক্ষণ প্রভার সাথে সাথে প্রিয় থাকছে। প্রয়োজন অপ্রয়োজনের দিক খেয়াল রাখছে। বাড়িতে নতুন অতিথি আসবে সেই উত্তেজনায় দিন গুনছে।

‘ পড়াশোনা তো শেষ। সামনে কি করবি। কিছু ভেবেছিস?’
সমুদ্রের জিজ্ঞাসু আওয়াজে নড়েচড়ে উঠল শাদ। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে উত্তর দিলো,
‘ এখানে ভাবাভাবির কি আছে। রাজনীতিতে যুক্ত হবো অনেক আগেকার সিদ্ধান্ত।’
‘ আর বিয়ে?’
শাদ উত্তর দিলো না কোন। সমুদ্র উত্তরে প্রতিক্ষা করল। শাদের হেলদোল না পেয়ে। আবার বলল,
‘ তোকে নিয়ে আম্মার চিন্তার শেষ নেই। বয়স হচ্ছে।সব সময় প্রেসার হাই থাকে। তাড়াতাড়ি বিয়েশাদি করিয়ে তোর একটা গোছানো সংসার দেখতে চাইছে।’
শাদ বিরক্ত হলো। কন্ঠে রাগ চেপে বলল,
‘ তো এখন কি আমাকে বিয়ে করতে হবে? এসব বিয়েশাদিতে আমার ইন্টারেস্ট নাই। শুধু শুধু টাকা আর সময়ের বরবাদি।’
‘ বেঁচে থাকতে ভালোবাসা জীবন সঙ্গীর প্রয়োজন।’
‘ ভালোবাসা, জীবন সঙ্গী এসব কিছু বাজে কথা। বাঁচার জন্য একমাত্র ক্ষমতা আর টাকার প্রয়োজন। ভালোবাসা নামক দুনিয়াতে কি নেই। সবকিছু আবেগ আর মায়া।’
ছোট ভাইয়ের কথার ধরন দেখে সমুদ্র হতভম্ব, বিরক্ত। তার এসব কথার জন্য লোকে কানাঘুষা করে। তাকে ফিলোফোবিয়ায় আক্রান্ত পাগলও বলে। সমুদ্র জিদ চেপে বলল,
‘ তাহলে কি লোকের কথা ধরে নিবো? তুই ফিলেফোবিয়ায় আক্রান্ত!’
‘ লোকের কথায় আমার আশেযায় না। বিয়েশাদি ভালোবাসা আমার জীবনে চাইছিনা। যদি তোমরা বাধ্য করো বাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য হবো।’
‘ হুম*কি দিচ্ছিস?’
‘ না, সত্যি বলছি।’
সমুদ্র প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়াল। হন হনিয়ে চলে যেতে লাগল। শান্ত হওয়াটা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অপ*রাধ। যে যা পারে সব দায়িত্ব শান্ত মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়। মা আর প্রিয়’র জোরাজোরিতে শাদকে বিয়ের জন্য বোঝাতে এসেছিল। এখানে এসে উল্টো তার রাগ ঠেলতে হলো।
সদর দরজা থেকে প্রিয় প্রভা আড়ি পেতে ছিল। সমুদ্রকে রেগে ফিরতে দেখে কি হয়েছে বুঝতে বাকি রইল না আর। তড়িঘড়ি পায়ে প্রিয় সমুদ্রের দিক গেল। উত্তেজিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি বলল শাদ?’
সমুদ্রের রাগী আওয়াজ,
‘ আমি আর বোঝাতে পারবোনা। তোমাদের দেবরকে তোমরা বিয়ে করিয়ে আনো এবার।’
প্রভাকে রেখে প্রিয় গেল এইবার। প্রিয় কি বলবে তা যেন খুব ভালো করেই ঠাহর করতে পারল শাদ।
প্রিয় কিছু বলার আগেই রাগী তড়িঘড়ি কন্ঠে বলে উঠল শাদ,
‘ ভাবি, আপনার যদি মনে হয় কথা বলে, বিয়ে করার জন্য রাজি করিয়ে ফেলবেন। তাহলে ভুল। আপনারা জোরাজোরি করলে আমি বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হবো।’
‘ বিয়ের জন্য জোরাজোরি করতে আসিনি। একটা প্রশ্ন জানতে এসেছি। তুমি কি তুরফার ফিরে আসার অপেক্ষা করছো?’
খানিক চুপ রইল শাদ। অনেক বছর পর আবার এই নামটা শুনল। টনটন করে মস্তিষ্ক নড়ে উঠল। রাগ জেদ অভিমান কিছু একটা চেপে ধরল। অস্থির স্বরে বলল,
‘ আমি কারো অপেক্ষায় নেই ভাবি। যদি জিজ্ঞেস করেন বিয়েশাদি না করার কারণ। তাহলে বলবো, আমি কাউকে ভালোবাসতে পারবোনা। অনেস্টলি বলতে আমার ভয় হয় এখন। হাস্যকর হলেও এটাই সত্য। আমি চাইনা কেউ এসে আবার আমাকে ভাঙ্গুক। এতে যদি লোকে আমাকে ফিলোফোবিয়ায় আক্রান্ত পাগল বলে। বলুক।’
প্রিয় কিছু বলল না আর। যেন কয়েকবছর আগের নিজেকে দেখছে। সেও এমন একটা সময় পাড় করেছে। এসব যন্ত্রণা কষ্ট গুলোর সাথে বেশ ভালো করে অবগত। সময়ের হাতে ছেড়ে দিলো সব। হয়তো কোনদিন কেউ আসবে। শাদকে গুছিয়ে নিবে।

রাত প্রায় আটটা। ল্যাপটপের সামনে প্রিয় প্রভা অধীর আগ্রহে বসে। প্রিয়’র ভেতর চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। একটা হাসপাতালে ‘সারোগেট মাদারের’ জন্য এপ্লাই করেছিল। আজ রেজাল্ট আসার দিন। রাত আটটায় তারা মেইলে জবাব জানাবে। আচমকা মেইল এলো। প্রিয়’র চোখেমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তড়িঘড়ি করে মেইল খুলতেই মুখখানা চুপসে গেল। ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেল। সরি লেটার এসেছে। ধপ করে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলো প্রিয়। একটা বাচ্চার জন্য কতই না হাই হতাশ। বিধাতার কাছে আহাজারি করছে। তার দিক কি উপরওয়ালা চাইবেনা একবার। তার অপূর্ণতা কি পূর্ণতা পাবেনা কোনদিন?
প্রিয়’র অশ্রুভারাক্রান্ত চোখ দেখে প্রভা বলল,
‘ কিছু হয়নি আপা। ইনশাআল্লাহ খুব শীঘ্রই তোমার কোল ভরবে।’
বোনের সামনে কান্না চেপে মাথা ঝাকালো প্রিয়।

রাত গভীর। শতাব্দ এসেছে। প্রিয় কয়েকমাস যাবত এখানে প্রভার সাথে আছে। তাই ছুটির দিনগুলো ইমান্দিপুর কা*টায়। ঘরে ঢুকতে চারিপাশ অন্ধকারে বিলীন দেখলো। শব্দহীন ঘরটায় ফোপাঁনোর আওয়াজ পেল। প্রিয় কি কাঁদছে?
ব্যাগ ফেলে তড়িঘড়ি করে বিছানার দিক গেল। বিছানার পাশের আলো জ্বালাতেই, প্রিয়কে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখল। মুখখানা বালিশে গুজে রেখেছে। হয়তো শতাব্দের পায়ের ভাঁজ পেয়ে কান্না চেপে রাখতে চাইছে । প্রিয়’র চুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে আলতো করে ডাকল শতাব্দ। উঠলো না প্রিয়। ঘুমের ভাণ করে পড়ে রইল। কি লুকাতে চাইছে প্রিয়? নিজের কষ্ট গুলোকে। আদৌ কি শতাব্দের থেকে লুকিয়ে রাখতে পারবে। এই বৃথা চেষ্টাই বা কেন করছে?
টেনে প্রিয়কে নিজের দিক ফিরালো। পাজকোলে তুলে বারান্দার দিক পা বাড়ালো। গভীর রাতের মৃদু হিম হাওয়া বইছে। চারিদিকে শীতল আভাস। প্রিয়কে কোলে করেই চেয়ারে বসলো।বুকের গভীরে প্রিয় মুখ ডোবালো। কান্নার বেগ কমেছে এখন। এই একাকীত্বের মুহূর্তে শতাব্দের আহ্লাদটা খুব প্রয়োজন ছিল যেন।
চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে শতাব্দ। আলতো স্বরে প্রিয়কে বলল,
‘ কেউ কিছু বলেছে প্রিয়?’
প্রিয় চুপ। উত্তরের অপেক্ষায় থেকে শতাব্দ আবার বলল,
‘ কিছু বলবেনা? আচ্ছা ঠিক আছে, সকালে নাস্তার টেবিলে আমিই সবাইকে জিজ্ঞেস করবো।’
প্রিয়’র ধীর আওয়াজ,
‘ ডাক্তার আহসান খাঁন শতাব্দের বউকে কিছু বলবে। সেই সাহস আদৌ আছে কি কারো? আমার অপূর্ণতাই আমার একমাত্র বিষন্নতার কারণ।’
‘ মেইল এসেছিল?’
উত্তরে কিছু বলল না প্রিয়। শতাব্দ প্রিয়কে বুকের মাঝে আরো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। প্রিয়’র কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলল,
‘ এইটুকু কারণে এত কান্না? ঠিক হয়ে যাবে সব। হাজার বার বলেছি তোমার মলিন মুখ আমায় বড্ড পো*ড়ায়।’
‘ আফসোস হয়না আপনার?’
‘ কেন হবে আফসোস? আমার প্রিয় আমার বুকে জড়ানো এরচেয়ে শান্তি, সুখের আছে কি কিছু? কিছু চাইনা আমার, তুমি থাকলেই সন্তুষ্ট।’

____________________

অপারেশন রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।ভেতরে ডেলিভারি হচ্ছে প্রভার। সমুদ্র চিন্তিত মুখে ঘুরঘুর করছে, শান্ত হয়ে বসতে পারছেনা একটুও। চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে তার। প্রিয় চুপচাপ বসে আছে। মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়ছে। বোনের চিন্তায় বিষন্ন ক্লান্ত । খানিকক্ষণ পর নার্স সাদা তোয়ালে পেঁচিয়ে দুইটা ফুটফুটে শিশুকন্যা পেঁচিয়ে আনলো। একজনকে সমুদ্রের কোলে দিলো। অন্যজনকে প্রিয় জড়িয়ে নিলো। বাচ্চাটা কোলে নিতেই প্রিয়’র অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। মাতৃত্ব যেন মন ছুয়ে দিলো। ভেতর থেকে অদ্ভুত এক টান জন্মালো। কোন এক অদ্ভুত আবেশে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল।
বাচ্চাকে কোলে নিয়ে সমুদ্র নার্সকে তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করল,
‘ প্রভা কেমন আছে, সুস্থ আছে তো?’
‘ পেশেন্ট সুস্থ। ঘুমাচ্ছে।’
স্থির নিশ্বাস ফেলল সমুদ্র।

বিকেলে জ্ঞান ফিরেছে প্রভার। কেবিন জুড়ে ভীড় করেছে সবাই। করবে নাইবা কেন। বাড়িতে প্রথম সন্তান এলো। তাও আবার জোড় কন্যা। কথায় আছে, কন্যারা ভাগ্যলক্ষ্মী হয়।
নার্স বাচ্চাটাকে কোলে দেওয়ার পর এক মুহূর্তের জন্যও নিজের থেকে আলাদা করেনি প্রিয়। কোলে নিয়ে বোনের পাশে বসে আছে এখনো।
চোখ খুলে মা বোনকে পাশে দেখে প্রভার মলিন মুখকানায় আলতো হাসি ফুটলো। প্রিয় আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘ কেমন লাগছে এখন?’
উষ্কখুষ্ক ঠোঁটে মলিন হাসল প্রভা। বলল,
‘ ভালো।’
প্রিয় বাচ্চাকে আদর করতে করতে কন্ঠে উৎসাহ জুড়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ আমাদের ছোট্ট প্রভা কত বড় হয়ে গেছে দেখেছ মা? আমাদের প্রভারও এখন দুইজন মেয়ে আছে।’
প্রভা হাসলো। বলল,
‘ উহু, আপা একজন।’
থমকে গেল ঘরের সবাই। বিহ্বল কন্ঠে প্রিয় বলল,
‘ একজন! মানে?’
প্রভা মুচকি হেসে আবার বলল,
‘ আমি যখন জানতে পারি আমার গর্ভে দুই সন্তান তখন থেকে আমি আর সমুদ্র সিদ্ধান্ত নেই আমার এক সন্তান আমার আপার।’
চমকে গেল প্রিয়। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে সমুদ্রের দিক চাইল। সমুদ্রের ঠোঁটের কোণে হাসি। প্রিয় বিস্মিত কন্ঠে বলল,
‘ এটা হয় না। অসম্ভব। একজন মায়ের কাছ থেকে আমি কি করে তার সন্তান কেড়ে নিবো। এরা তোর সন্তান। এদের উপর তোর অধিকার।’
শতাব্দ এগিয়ে এলো। বলল,
‘ প্রিয় ঠিক বলছে। এটা সম্ভব না। ওরা তোমাদের সন্তান। ‘
প্রভা অধৈর্য কন্ঠে বলল,
‘ কেন সম্ভব না শতাব্দ ভাই? অনেক বছর আগে খালা তার একমাত্র মেয়েকে আমার সন্তান হারা মায়ের আঁচলে রেখে যায়। আর আমি আমার প্রিয় আপাকে পাই। আজ অনেক বছর পর আমি খালার সেই ঋণ শোধ করতে চাই, আমার দুই সন্তানের এক সন্তান আমার আপার। ওর উপর আমার কোন দাবি নাই। এখন থেকে ওকে আপনার আর আপার সন্তান বলেই চিনবে সবাই।’
‘ লোকে কি বলবে?’
‘ লোকের কথা আপনি কবে থেকে ধরতে শুরু করলেন শতাব্দ ভাই। আমি চাই আপার কোলের সন্তান আপার কাছে থাক। ওর উপর আমার কোন দাবি, কোন অধিকার নাই। যদি কাগজ কলমে লিখে দিতে হয় তবুও আমরা রাজি।’
সবাই চুপ। প্রভা আবার বলল,
‘ আপা! ওযে তোমার মেয়ে মেনে নিতে অসুবিধা আছে তোমার?’
আবেগ, আনন্দ, অনুভূতিতে কেঁদে উঠল প্রিয়। আজ এই কান্না তার খুশির কান্না। বোনের হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বলল,
‘ আমি চিরকাল তোর কৃতজ্ঞ থাকবো বোন।’
‘ তুমি এখন মা। মেয়ের সামনেও এভাবে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদবে আপা?’
কান্নার মাঝে হেসে ফেলল প্রিয়। ঘাড় ফিরিয়ে শতাব্দের দিক চাইল। ছলছল করছে শতাব্দের চোখ। চোখেমুখে অদ্ভুত চমক। এটা কিসের চমক, বাবা হওয়ার কি?

চেয়ারম্যান বাড়িতে ঘটা আয়োজন। ধুমধাম করে মেয়েদের নামকরনের উৎসব করা হলো। মায়েদের নামের সাথে মিলিয়ে মেয়েদের নাম রাখা হয়েছে। প্রিয়’র মেয়ের নাম ‘ প্রেয়সী’ আর প্রভার মেয়ের নাম ‘ সুপ্রভা’ রাখলো।

গভীর রাত। নিস্তেজ চারিপাশ। নিকষ কালো অম্বরে পূর্ণ চাঁদ উঠেছে। চারিদিক উজ্জ্বল আলোয় ছড়িয়ে। তীরতীর বাতাস বইছে। গায়ে ভালোবাসার মাদকতা মাখিয়ে। মেয়েকে বুকে আগলে, শতাব্দের বুকে পিঠ এলিয়ে বসে আছে প্রিয়। প্রিয়’র মাদকতা মেশানো মেঘবরণ কেশে মুখ গুজে আছে শতাব্দ। প্রিয়’র উন্মুক্ত কোমরে হাত বোলাচ্ছে।
শতাব্দের গায়ের মিষ্টি সুবাসের আবেশে ডুবে থাকা প্রিয় অস্পষ্ট গভীর কন্ঠে বলল,
‘ ধন্যবাদ শতাব্দ। আপনার ভালোবাসায় আমি আজ পরিপূর্ণ। আমার অপূর্ণ, বেরঙের জীবনটায় ভালোবাসার রঙ্গে রাঙিয়ে দেওয়া জন্য আমি আপনার চিরকৃতজ্ঞ।’
চোখ বুজে হাসল শতাব্দ। প্রিয়’র ঘাড়ে আলতো চুমু দিতে দিতে বলল,
‘ তোমার ভালোবাসা সবসময় আমাকে পূর্ন করেছে, আজ বাবা হয়ে আমি যেন পরিপূর্ণ। জীবনে আর কি চাই? আমার সব সুখ যে তোমাতেই। আমার নিশ্বাসের মত তোমাকে ভালোবাসাটাও সত্য। নিশ্বাস ছাড়া যেমন জীবনের মূল্য নেই। প্রিয়কে ছাড়া এই শতাব্দ অমূল্য।’
চোখ খুলে ঘাড় বাকিয়ে চাইল প্রিয়। ঠোঁটের কোণে ভুবন ভুলানো হাসি। চোখে অদ্ভুত মোহিত দীপ্তি। নিগূঢ় কন্ঠে বলল,
‘ ভালোবাসি শতাব্দ। চিরকাল ভালোবাসবো।’
কপালে গভীর চুমু এঁকে দিলো শতাব্দ। স্ত্রী কন্যাকে বুকে জড়িয়ে নিলো। ঘোর লাগানো, গভীর কন্ঠে বলল,
‘ ভালোবাসি আমার প্রাণপ্রিয়।’
প্রকৃতি আজভালোবাসার চাদরে মাখিয়ে। চারিপাশ প্রণয় সমুদ্রের অতলে। দূর আকাশের লাজুক চাঁদটা যেন মিটিমিটি হাসছে।

____________________

একই বাড়ির অন্যপাশে একাকীত্বের ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলছে শাদ। অনেক অভিমান অভিযোগ জড়ানো। কোন এক উড়োখবর কানে এসেছে আজ। বহুবছর পর খুব পরিচীত অজানা কেউ দেশে ফিরেছে। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে কোন অনুভূতি হচ্ছেনা। না আবেগেরা বাসা বাঁধছে। অনুভূতিহীন ঠাই শুনেছে।
লোকে বলে ফিলোফোবিক। আসলেই কি সে ফিলোফোবিয়ায় আক্রান্ত?

সমাপ্ত♥

সারসংক্ষেপ: ফিলোফোবিয়া’ একটা ফোবিয়ার নাম। গ্রীক শব্দ ‘ফিলো’ অর্থ ‘ভালোবাসা’ আর কোন কিছু নিয়ে অস্বাভাবিক ভীতিকে ‘ফোবিয়া’ বলে। ফিলো আর ফোবিয়া যুক্ত হয়ে পূর্ণ অর্থ দাঁড়ায় ‘ভালোবাসার ভয়’।
গল্পটা ফিলোফোবিক প্রিয়’র অতীত ও তার ডাক্তার পাগল প্রেমিককে ঘিরে। প্রিয় যার ছিল ভালোবাসায় প্রচন্ডরকম ভয়। দুইহাজার এগারোতে কিশোরী প্রিয় বড় আপার সু*ইসাইডে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে, ডিপ্রেশনে ডুবে থাকে। হাস্যোজ্জ্বল প্রাণবন্ত জীবন থেকে ক্রমশ দূরে সরে যায়। ব্যাপারটা বাবার চোখে পড়ে তাই, ডাক্তারের পরামর্শে স্থান পরিবর্তনের জন্য ঢাকা থেকে ইমান্দিপুর বড় খালার বাড়িতে পাঠায়। সেখানকার চেয়ারম্যানের ছেলে শতাব্দ। তেজি, গম্ভীর। কারো সামনে নত না হওয়া ছেলেটা ভালোবাসার সামনে ঝুঁকে যায়। রগচটা ছেলেটা প্রেমিকার সামনে জব্দ প্রায়। রূপবতী প্রিয়’র সৌন্দর্য, সরল স্বভাবের গভীরে তলায়। ধ্যানজ্ঞান ভুলে শুধু প্রিয়’কে চায়। বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশ, ভুল বোঝাবুঝি পাড় করে দুজনের প্রণয়ের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। হ্ঠাৎ একদিন তীক্ষ্ণ অতীত এসে হানা দেয়।ভুলবোঝাবুঝি হয় দুজনের। বিচ্ছেদ পর, কে*টে যায় অনেক বছর। শতাব্দের নজর সর্বদাই ছিল প্রিয়’তে। অনেক বছর পর মুখোমুখি হয় দুজনে। অতীতের রহস্য উদঘাটন করতে শতাব্দের সাথে বিয়ের সম্বন্ধে জড়ায়। এতবছর কষ্টে জরজড়ীত থাকা প্রিয়।নিজেকে শক্ত খোলসে ডেকে নেয়। দূরে সরিয়ে দেয় তার প্রিয়তমকে। কিন্তু শতাব্দের অদম্য প্রেম, তা মানতে নারাজ। প্রিয়কে আবার ভালোবাসতে শেখায়। তার ভালোবাসার ভীতিকে হারিয়ে পুরানো অনুভূতিতে আবার মোড়ায়। অতীতের কিছু ভয়ঙ্কর রহস্যের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। অনেক মান অভিমান, মিলন বিচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে দুজন জেদি প্রেমিক প্রেমিকার সুখময় প্রেম জীবনের আরম্ভ হয়। যা অনন্তকাল অবধি পাড়ি জমায়। ফিলোফোবিয়া’র দুই অংশ। প্রথমটা প্রেমময়, বিরহ।দ্বিতীয়টা সামান্য থ্রিল একটু সাসপেন্স মিলন- বিচ্ছেদ গড়া।

লেখিকার কথা: গল্পটা প্রিয়’র ফিলোফোবিয়া নিয়ে শুরু হয়েছে। শাদের ফিলোফোবিয়াতে শেষ হয়েছে। শাদ, তুরফা গল্পের সাইড কারেক্টার হলেও তারা যেন শতাব্দ, প্রিয়’র ছায়া ছিল। ওদের ব্যাপারটা ওপেন এন্ডিং দিয়েছি। মিল বিচ্ছেদ সবটা পাঠকদের উপর ছেড়ে দিলাম। যদি কখনো ওদের নিয়ে লেখার আগ্রহ হয়। ইনশাআল্লাহ কোন একদিন ওদের নিয়ে আবার লিখবো।

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাই সবার মতামত জানাবেন।