ফুলপিসি পর্ব-০৮

0
65

#ফুলপিসি
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০৮

-‘পৃথিলা জানো? ঋষি না ছোটবেলায় যেদিন ভুত দেখতো। সেদিন ও সারারাত জেগে থাকতো।
পৃথিলা খুব যত্ন করে ফুলপিসির পায়ে আলতা পরিয়ে দিচ্ছিল। পিসির কথা শুনে হাত থেমে গেল। চোখ তুলে তাকাল। বলল,
-‘সত্যি?
-‘তো আমি কী মিথ্যা বলতেছি?
পেছনের চেয়ারে বসে একমনে রুটি খাচ্ছিল ঋষি। ফুলপিসি খেয়াল করেনি। পৃথিলা ঋষির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-‘ভুত কী রকম দেখতে ছিল পিসি?
পিসি বলল,
-‘ঋষির তখন পাঁচ বছর। রাতে ওর বাবা-মায়ের কাছে শুয়ে থাকতো। মধ্যেরাতে ঘুম ভেঙে দেখত, ওর বাবা-মা মানুষ থেকে ভুত হয়ে গেছে। একটা আরেকটার উপরে উঠে নাচতেছে..
কথাটা শুনে চমকে উঠল ঋষি। লজ্জায়, রাগে কাঁপতে কাঁপতে ফুল পিসির মুখে নিজের অর্ধখাওয়া রুটি গুঁজে দিল। তারপর দৌঁড়ে ঘরে চলে গেল। ইশ..কী লজ্জা..কী লজ্জা!
পৃথিলারও খুব লজ্জা লাগছে। ফুলপিসিটা কেমন যেন! মুখে কিছুই আটকায় না। ফুলপিসি মৃদু ধমকে বলল,
-‘কী রে ঝিম মেরে বসে রইলি কেন? পায়ে আলতা পরা? আর শোন, তোদের বাচ্চাকাচ্চা হলে, বাপ-মায়ের ভুত যেন না দেখে, তার আগেই বিছানা আলাদা করে দিবি।
পৃথিলা জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল। বিরবির করে বলল,
-‘আচ্ছা..আচ্ছা..আচ্ছা।

ফুলপিসি কিছুদিন ধরে ভাত খেতে পারে না। মুখে না কী রুচি নেই। সারাদিনে বেশি না, কম করে হলেও চারবার ভাত খায়। তাও তার ধারণা সে না কী খুব বেশি ভাত খেতে পারছে না। একটু দরকারে বাজারে গিয়েছিল ফুলপিসি। সবজির বাজার হয়ে আসার সময় বিচি কলা চোখে পরল। ছোটবেলায় গাছ থেকে পেরে কত খেয়েছে। এখন তো খুব একটা দেখা যায় না। খুব বেশি দাম না। লোভ সামলাতে না পেরে দুই হালি কলা কিনে নিল। একটা ছিলে খেয়ে দেখল, চিনির মতো মিষ্টি। পিসির একটা বদঅভ্যেস আছে। কলার বিচিসহ গিলে খায়। সারা রাস্তা যেতে যেতে তিনটে কলা খেয়ে ফেলল।
বাসায় গিয়েও আরও দুটো খেলো।

সেই কলা খাওয়ার পর তিনদিন ধরে পায়খানা হয় না পিসির। কত চেষ্টা করে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাথরুমে বসে থাকে। কিছুতেই কিছু হয় না। এদিকে পেটে তিনদিনের খাবার জমে পেটটা ফুটবলের মতো ফুলে ঢোল হয়ে গেছে।
ঋষি, ফুলপিসির ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। পিসির বিকট কান্নাকাটির শব্দ শুনে চমকে উঠল। বুকে থু থু দিয়ে হন্তদন্ত পায়ে পিসির ঘরে গিয়ে সারাঘর খুঁজেও পিসিকে পাওয়া গেল না। ফুলপিসি আবারও চিৎকার করে উঠল।
-‘ও মা গো..আমি মরে গেলাম গো। ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, মাগার আসল মাল-মশলা তো বের হচ্ছে না। ওরে.. বাবা। আমার কী হইলো রে..?
ঋষি ইতঃস্তত করে বাথরুমের দরজায় কড়া নাড়ল। বলল,
-‘এই পিসি কী হয়েছে তোমার?
ফুলপিসি শব্দ করে কেঁদে দিল। কী মুশকিল কাঁদলেও ব্যথা লাগে। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,
-‘ঋষি রে…আমি তো না হাগতে হাগতে মরে যাইতেছি। আমারে বাঁচা তোরা?
-‘এই তুমি বাথরুম থেকে বের হও? কী খাইছো?
-‘বিচি কলা খাইছি ঋষি। বিচি কলা। আর জীবনেও খামু না। কান ধরছি..আমার কী সর্বনাশ হইলো রে। পেটের ভেতর হাগু জমতে জমতে ফাইটা যাইতে চাইতেছে।
-‘আরও খাও? বেশি করে খাও?
-‘খামু না ঋষি। তুই আমার ভাইয়ের পোলা ভাইপো হয়ে এমন করে বলিস না বাপ। তোর কথা শুনলে আমি অর্ধেক হার্ট অ্যাটাক করি। ওরে..মা… আমার পেটের মধ্যে কেমন জানি করতেছে..! ঋষিরে আমি মইরা যাইতাছি। আমার শ্রাদ্ধটা অন্তত বড় করে করিস।
ঋষির চিন্তায় হাত-পা কাঁপছে। ভীতু কণ্ঠে বলল,
-‘পিসি দরজা খুলো?
ফুলপিসি বহুকষ্টে উঠে এসে দরজা খুলে দিল।
ঋষি আর দেরি করল না। ফুলপিসিকে নিয়ে ছুটলো ক্লিনিকের উদ্দেশ্যে। ডাক্তার পরিক্ষা – নিরীক্ষা করে অপারেশন করতে বলল। এছাড়া আর কোন উপায় নেই। খাওয়া-দাওয়া অনিয়মিতর জন্য পায়ুপথ দিয়ে নিয়মিত রক্ত যায়। তারপর আবার এতগুলো বিচি কলা খেয়েছে। পায়ুপথের মাংস পুরোপুরি ঢেকে গেছে। অপারেশন করে বাড়তি মাংসপেশি কেটে ফেলে দিতে হবে।
পঁচিশ টাকার কলা খেয়ে একলক্ষ চার হাজার টাকা চারদিনে জলের মতো চলে গেল। টাকার দুঃখে ফুলপিসি কেঁদে ভাসাল। ঋষি, ফুলপিসির পাশে বসে বলল,
-‘এখন কাঁদছো কেন? আরও চারটে বিচি কলা খাবে? এনে দেব?
ফুলপিসি শব্দ করে কেঁদে দিল। সুর করে বলল,
-‘ওরে ঋষিরে.. আমি আর জীবনেও বিচি কলা কেন! কোন কলাই খামু না৷
-‘থাক..থাক। এটা হাসপাতাল। আশেপাশে সবাই দেখছে।
-‘দেখুক। সবার জানা উচিৎ। বিচি কলা খেয়ে আমার কী সর্বনাশ হইলো।
ঋষি বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘পিসি চুপ করো তো?
-‘তুই চুপ কর বেয়াদব। তোর মাল-মশলা আটকে গেলে বুঝতি কেমন জ্বালা। ওই তোর পিসেমশাই কোথায়?
-‘ঔষধ কিনতে গেছে।
-‘বেশি বেশি ঔষধ কিনতে বল। যত বেশি ঔষধ খামু তত তাড়াতাড়ি আমি ভাল হয়ে যামু।
পাশের বেডের এক মহিলা এগিয়ে এলো। সম্ভবত পাশের বেডের রোগীর কোন আত্মীয় হবে। ঋষিকে দেখিয়ে ফুলপিসিকে জিজ্ঞেস করল,
-‘ছেলেটা আপনার কী হয় দিদি?
-‘আমার একমাত্র ছেলে।
-‘ছেলে বিয়ে দিবেন না?
ফুলপিসি বলল,
-‘দেব তো। ভাল মেয়ে খুঁজতেছি। আজকাল ভাল মেয়ের যে কী অভাব দিদি।
-‘ছেলে কী করে?
ফুলপিসি সবকয়টা দাঁত বের করে বলল,
-‘ছেলে তো বেকার।
ঋষি ফুল পিসির দিকে কটমট চোখে তাকাল। ফুলপিসি এক চোখ টিপে ভদ্রমহিলার দিকে তাকাল। ভদ্রমহিলা বলল,
-‘ছেলের বাবা কী করে?
ফুলপিসি ফিসফিস করে বলল,
-‘একটাই ছেলে আমাদের বুঝলেন দিদি। ছেলের বাবা ঢাকা আজিমপুর রোডে ভিক্ষা করে। তাতে কী আমাদের কিন্তু ঢাকা শহরে নিজস্ব ফ্ল্যাটবাসা আছে। ছেলেরেও ঘুষ দিয়ে চাকরি যোগাড় করে দিবো ভাবতেছি। যাইহোক এইকথা আবার কাউরে বইলেন না কিন্তু। বড় বিশ্বাস করে আপনারে বললাম।
-‘না..না..কাউকে বলব না। আমি এখন আসি।
ভদ্রমহিলা চলে যেতেই ফুলপিসি নিঃশব্দ হেসে দিল। রাগে, দুঃখে ঋষির চোখদুটো লাল টুকটুকে হয়ে গেল। ইচ্ছে করছে ফুলপিসিকে ফেলে চলে যেতে। অসুস্থ দেখে আবার মায়াও লাগছে। ফুলপিসি বলল,
-‘পৃথিলা ভাল মেয়ে। ও সতীনের সংসার করলে আমার মোটেও ভাল লাগবে না। তাই কৌশলে তোর বিয়েটা ভেঙে দিলাম রে ঋষি।
-‘হ্যাঁ এসব কাজে তো তুমি খুব এক্সপার্ট। শুধু আসল কাজেই লবডঙ্কা।
-‘থাক থাক আর বলতে হবে না। এরজন্যই কারো ভাল করতে নাই। হুহ..

বাড়িতে যেতেই ঋষির মা ফুলপিসিকে দেখে এগিয়ে এলো। বলল,
-‘এখন কী অবস্থা তোমার?
ফুলপিসি হতাশ হয়ে বলল,
-‘আমার আর অবস্থা বৌদি। মন্দের ভাল এখন আমি হাগতে পারি। কোন অসুবিধা হয় না।
ঋষির মা মুখটিপে হেসে দিল। পিসি দেখে ফেলে বলল,
-‘তুমিও মজা নিচ্ছো বৌদি? তোমরা সব কয়টা স্বার্থপর।
-‘আহা..ফুলি রাগ করছো কেন?
ঋষি, পৃথিলাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
-‘ফুলপিসি আজ হাসপাতালে আমার জন্য ঘটকালি করেছে মা।
ফুলপিসির চোখদুটো ছানাবড়া হয়ে গেল। পৃথিলার মুখটা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেল। ফুলপিসি ক্ষেপে গেল। চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘গাধার বাচ্চা। মিথ্যা কথা বলোস কেন? নিজেই তো অল্প বয়সী মেয়েকে দেখে ফোন নাম্বার আদান-প্রদান করছিলি। আমি দেখিনি ভেবেছিস?
ঋষি রেগে গেল। বলল,
-‘আজব! তুমি মিথ্যা কথা বলতেছো কেন?
-‘কোনটা মিথ্যা কথা? তুই মেয়েটাকে বলোস নাই? সেই মেয়েটার জন্যই না কী হাসপাতালে পরে ছিলি। একটু দেখার লোভে।
-‘পিসির বাচ্চা…
ফুলপিসি একচোখ টিপে নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘এখন দ্যাখ কেমন লাগে রে ঋষি। আমার বিরুদ্ধে পৃথিলার কানে বিষ ঢালা। পৃথিলার যে জেদ। ও যে তোকে কী করবো রে ঋষি..আমি শুধু তাই ভাবতেছি। কাটা লাগা…আহ্ হা..
ফুলপিসি পৈশাচিক হাসি দিয়ে পৃথিলাকে বগলদাবা করে ঘরে চলে গেল। ঋষি বোকার মতো ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। ঘোর কাটতেই দৌঁড়ে গেল। বলল,
-‘এই পৃথিলা আমার কথাটা শোন প্লিজ লক্ষ্মীটি? ওই কুটনি মহিলা তোমাকে মিথ্যে কথা বলেছে।

(চলবে)