#ফুলপিসি
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১০
নিভারানী দুপুরের জন্য রান্না করছে। পৃথিলা শাশুড়ীমায়ের হাতে হাতে কাজ করে দিল। হাতের কাজ শেষ করে, স্নান করার জন্য ঘরে চলে যেতেই শিখা চোখ, মুখ কুঁচকে বলল,
-‘ছেলেকে বিয়ে দিয়েও যদি এই বয়সে তোর রান্না করে খেতে হয়। তাহলে ছেলেকে ঘটা করে বিয়ে দিয়ে তোর কী লাভটা হলো দিদি?
-‘আহা শিখা। ওহ ছোট মানুষ। এতগুলো মানুষের রান্না করতে পারবে না কী? আস্তে আস্তে শিখে নিবেক্ষণ। তাছাড়া আমি কী আগে রান্না করে খাইনি?
-‘এত ভাল মানুষ হওয়া ভাল না দিদি। এখনো সময় আছে। ঋষির বউয়ের রাশটা শক্ত হাতে টেনে ধর। ভাল কথা। শুনলাম, ঋষির পিসেমশাই রিটায়ার্ড হয়েছে। বেশ মোটা অংকের টাকা পেয়েছে। ওনারা তো নিঃসন্তান। টাকা গুলো কী ঋষিকেই দেবে? না অনিলদার ভাতিজা-ভাতিজি পাবে?
-‘আজব তো। ওনাদের টাকা ওনারা এরে ওরে দিয়ে দিলে। ওনারা চলবে কীভাবে?
শিখা ভেংচি কেটে বলল,
-‘বারো মাসের আটমাসই তো এখানে পরে থাকে।
-‘শিখা চুপ কর। ফুলি শুনলে মন খারাপ করবে। তার বাবার বাড়িতে সে থাকে। তার ভাইয়ের কামাই সে খায়। তোর আমার কী সমস্যা?
-‘তুই সারাজীবন বোকাই রয়ে গেলি রে দিদি। এত মহৎ সেজেই তো জীবনে কিছুই জমাতে পারলি না। ছেলেটাকেও তো একটা চাকরি জুটিয়ে দিতে পারলি না।
নিভারানীর খুব মন খারাপ হলো। ঋষির জন্য প্রায়ই খোঁচা মারা কথা শুনতে হয়। ছেলেটা কেন যে চাকরি-বাকরি করতে চায় না কে জানে! সারাদিন ঘরে শুয়ে, বসে ফোন আর কম্পিউটার টিপে। আর বলে, ফ্রিল্যান্সিং করি মা। ঘরে বসে আবার টাকা কামানো যায় না কী? সত্যি মিথ্যা ভগবানই জানে। অবশ্য ঋষি আরও বছর পাঁচেক আগে থেকেই নিজের জন্য কোন হাত খরচা নেয় না। উল্টো মা, বাবা, পিসিকে প্রায়ই এটা-সেটা কিনে দেয়। নিভারানীর ধারণা ফুলিই ঋষিকে বেশ মোটা অংকের টাকা প্রতিমাসে হাত খরচ বাবদ দেয়।
অনিলবাবু, ফুলির মাথায় আধা হাত ঘোমটা দেখে চমকে উঠল। বলল,
-‘এটা কে?
-‘আমি..আমি.. তোমার বউ।
অনিলবাবু চমকে উঠল। বলল,
-‘ঘরের ভেতর এভাবে মাথায় ঘোমটা দিয়ে রেখেছো কেন? দেখি মুখ দেখি?
-‘এক সপ্তাহ পর।
-‘বুড়ো বয়সে আবার কী ঢঙ শুরু করলা ফুলি?
-‘বিয়ের পর পর না তুমি আর তোমার মা আফসোস করতা। নতুন বউ। অথচ আমি মাথায় ঘোমটা দেই না। আমার লজ্জা কম। আরও কত কী? তোমাদের মা-ছেলের লজ্জা ঘুচতে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন থেকে নতুন বউয়ের মতো মাথায় সব সময় ঘোমটা দিয়ে থাকব।
-‘আশ্চর্য আমি আবার কবে আফসোস করলাম?
-‘ওই একই হলি। একজন আফসোস করাও যা। গুষ্টি শুদ্ধ আফসোস করাও তা।
অনিলবাবু, ফুলপিসির কাপড়ের কোণা টেনে ধরে বলল,
-‘তোমার হাবভাব তো আমার ভাল ঠেকছে না। দেখি কী অঘটন ঘটায়ছো?
-‘অনিলবাবু ছাড়ো.. ছাড়ো? ইশ রে.. আমার যে কী লজ্জা লাগতেছে।
-‘ঘটনা কী? বিয়ের পরেও তো আমাকে দেখে এত লজ্জা পাইতা না।
-‘এখন পাইতাছি। তোমার কোন সমস্যা?
-‘একশো একবার আমার সমস্যা। আমার বউ আমার সামনে মুখ ঢেকে রাখছে। দেখতেই তো কেমন লাগতেছে। এ্যাঁই.. তুমি ঘোমটা খুলো?
পিসেমশাই টানাটানি করে ঘোমটার কোণা মুখের উপর থেকে সরিয়ে ফেলতেই ফুলপিসি ভয়াবহ রেগে গেল। পিসেমশাইকে ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেলে দিয়ে, নিজে অনিলবাবুর উপরে চেপে বসল। বলল,
-‘ দেখবা..দেখবা..আরও দেখবা? নাও এখন মন ভরে দেখো?
অনিলবাবু ভয় পেয়ে বলল,
-‘তুমি কে?
-‘আমি কে মানে? আমি তোমার বউ।
-‘তোমার চেহারা এমন লাগছে কেন?
-‘আমাকে দেখতে বেশি সুন্দর লাগে তো। ছেলেরা দেখলেই শুধু প্রেম নিবেদন করে। এত সুন্দর চেহারা নিয়ে আমি অতিষ্ঠ। আমার চেহারা যেন অল্প একটু অসুন্দর দেখা যায়। তাই ভ্রু’রই ছুলে ফেলছি। ভাল করছি না কাজটা?
-‘এই ফুলি? সরে বসো..সরে বসো? আমার প্রেসার বেড়ে গেছে।
ফুলপিসি বিরক্ত হয়ে পিসেমশাইয়ের উপর থেকে উঠে গেল। তারপর ফ্যানের নীচে হাত-পা টান টান করে বসে, হা করে বাতাস খেতে লাগল।
পৃথিলা বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাবে। কত রিকুয়েষ্ট করল ফুলপিসিকে সাথে যেতে। কিন্তু পিসি কিছুতেই যেতে রাজি হচ্ছে না। বলল,
-‘আমার ভ্রু না গজালে আমি আর কোথাও যামু না। ডিসিশন ফাইনাল।
-‘চলো না পিসি? প্লিজ?
-‘তুই আমারে নিয়ে কী করবি?
-‘তোমাকে ছাড়া ভাল লাগে না পিসি।
-‘ঋষি রে.. তোর বউকে শিগগিরই মানসিক ডাক্তার দেখা?
ঋষি বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘আমার এত টাকা বেশি হয় নাই।
-‘বেয়াদব তাহলে বিয়ে করেছিস কেন?
ঋষি ভ্রু কুঁচকে বলল,
-‘বিয়ে কেন করেছি বিস্তারিত বলব?
পিসি ধুমধাম ঋষির পিঠে দুটো থাপ্পড় লাগিয়ে দিল। বলল,
-‘নির্লজ্জ কোথাকার।
-‘যাও এখন রেডি হও? পৃথিলা বোধহয় তোমাকে ছাড়া যাবে না।
-‘না গেল। আমি যামু না।
পৃথিলা কাজল নিয়ে এসে বলল,
-‘আসো সুন্দর করে ভ্রু এঁকে দেই? কেউ বুঝবে না।
পৃথিলা সময় নিয়ে ভ্রু আঁকতেই পিসির চেহারা পাল্টে গেল। আয়নায় নিজেকে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল ফুলপিসি। বলল,
-‘যা এবার যামু।
পৃথিলাদের বাড়িতে গিয়েই চোখ থেকে মোটা ফ্রেমের কালো চশমাটা খুলে ফেলল ফুলপিসি। তারপর দাঁত কপাটি বের করে হেসে দিয়ে পৃথিলার কাকাকে বলল,
-‘হাই..চোখ টিপাটিপি বেয়াই, কেমন আছেন?
ভদ্রলোক শুকনো ঢোক গিলল। চোখ টিপাটিপি বেয়াই বলতে কী বুঝাতে চাইল? তার বোধগম্য হলো না। ঋষি নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘একটু ভদ্রভাবে কথা বলো পিসি।
-‘তুই চুপ থাক।
পৃথিলাদের বাড়িতে মাঝবয়েসী ময়না নামের একজন মহিলা কাজ করে। ফুলপিসিকে যে ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে। ময়না সেই ঘরের ফ্লোর পরিষ্কার করছিল। ফুলপিসি স্নান সেরে ঘরে ঢুকতেই ফুলপিসির দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভুত ভুত করে চিৎকার করে উঠল ময়না। ফুলপিসি ভয়াবহ রেগে গেল। রাম ধমক দিয়ে বলল,
-‘এই মহিলা থামো? আমারে তোমার কোন দিক থেকে ভুত মনে হইতেছে?
-‘আপনের চেহারা এমন ক্যান?
-‘কেমন?
ময়না মুখ ফস্কে বলে ফেলল,
-‘ডাইনী রিনা খানের মতো।
পিসি এক চিৎকার দিয়ে পৃথিলাকে ডাকল। পৃথিলা হন্তদন্ত পায়ে ছুটে এলো। পৃথিলার পিছুপিছু বাড়ির সবাই এসে, ফুলপিসির এক ভ্রু ছোলা দেখে তব্দা খেয়ে গেল। পৃথিলার কর্তামা গালে হাত রেখে বলল,
-‘মাগো…এ আমি কী দেখলুম?
পৃথিলা বলল,
-‘কী হয়েছে পিসি?
ফুলপিসি কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,
-‘দ্যাখ না পৃথিলা? ময়না না ফণা.. ও আমাকে ডাইনী বলেছে। অথচ আমাকে তোর পিসেমশাই সবসময় বলতো, আমাকে না কী নায়িকা শাবনূরের মতো সুন্দর দেখা যায়।
এই ফণা আমার এত বছরের বিশ্বাস ভেঙে দিল, কেন..কেন…কেন?
পৃথিলা, ময়নাকে মৃদু ধমকে বলল,
-‘আহ্..ময়নাদি তুমি পিসিকে ডাইনী বলেছো কেন?
-‘আমার কী দোষ? ওনিই তো বলল, ওনাকে কেমন লাগতেছে বলতে। যা সত্যি আমি তাই তো বলছি।
ঋষি ময়নার ব্যবহারে প্রচুর বিরক্তবোধ করল। তার পিসিকে হোক রসিকতার ছলে, তবুও কেউ এত বাজে ভাবে অপমান করলে ঋষির একটুও ভাল লাগে না। আবার নতুন শ্বশুরবাড়ি দেখে কিছু বলতেও পারছে না। পৃথিলার মা ময়নাকে ধমক দিল। বলল,
-‘এত বয়স হয়েছে অথচ কোথায় কী বলতে হয় এখনো শিখলি না ময়না? মাফ চা ওনার কাছে।
ময়না গিন্নীমাকে দেখে যা একটু ভয় পায়। ভয়ে ভয়ে পিসির কাছে ক্ষমা চেয়ে চলে গেল। সবাই যার যার ঘরে চলে যেতেই ঋষি বলল,
-‘পৃথিলা কিছুদিন থাকুক। তুমি চলো পিসি। আমরা বাড়ি যাব।
পৃথিলার মন খারাপ হয়ে গেল। বলল,
-‘ঋষি?
-‘প্লিজ পৃথিলা। সামান্য কাজের লোক হয়ে আমার পিসিকে অপমান করবে। এটা তো আমি কিছুতেই মেনে নেব না।
ফুলপিসি মিনমিন করে বলল,
-‘কিন্তু ফণা তো মাফ চাইছে।
-‘চুপপ..আর একটা কথা বলবানা তুমি। আমার মাথা গরম না করে রেডি হও। পৃথিলা কিছুদিন থাকুক। ওর বেড়ানো হয়ে গেলে আমি এসে নিয়ে যাব।
-‘ঋষি আমিও যাব। তোমাদের সাথে?
-‘না পৃথিলা। খারাপ দেখা যায়।
-‘তাহলে তোমরাও থাকো না প্লিজ?
ঋষি সেকথার উত্তর না দিয়ে পিসিকে তাড়া দিল। কত বলে কয়েও কেউ ঋষিকে আটকে রাখতে পারল না। ঠিকই পিসিকে নিয়ে চলে গেল। ফুলপিসি মজার মানুষ। রসিক মানুষ ঠিক আছে। তাই বলে, যে সে পিসিকে অপমান করবে এটা তো ঋষি কিছুতেই মেনে নেবে না। মরে গেলেও না।
পিসি বাড়িতে এসে ঋষির মলিণ মুখের দিকে তাকিয়ে পৃথিলাকে ফোন দিল। ঋষির কণ্ঠ নকল করে বলল,
-‘পৃথু বেবি তোমাকে ছাড়া আমার ভাল লাগছে না। আমার বুকের ভেতর মনে হয় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছি। তুমি কবে আসবা বেবি? তোমাকে জড়িয়ে ধরে না ঘুমালে আমার তো রাতে ঘুমই হয় না।
হাতে কুশন ছিল। পিসির দিকে ছুঁড়ে মারল ঋষি। তারপর দুজনেই শব্দ করে হেসে দিল। এই মানুষটার আশেপাশে থাকে বেশিক্ষণ মন খারাপ করেও থাকা যায় না। কী আশ্চর্য?
(চলবে)