#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_২৫
#নিশাত_জাহান_নিশি
“তারছেঁড়া মেয়ে কোথাকার!”
রগচটা ভাব নিয়ে রূপল মুহূর্তেই বাইকটি ছেড়ে দিলো। অমনি নীহারিকা হাপিত্যেশ করে পেছন থেকে রূপলকে ডাকল! অস্থির গলায় বলল,
“আরে আরে থামুন। আমাকে তো নিয়ে যান।”
ঝট করে বাইকটা থামিয়ে দিলো রূপল। নীহারিকা স্বস্তি পেল! আশ্বস্ত হয়ে রূপলের দিকে তাকালো। অমনি রূপল পিছু ফিরে আক্রোশভরা দৃষ্টিতে মৃদু হেসে ওঠা নীহারিকার দিকে তাকালো। কঠিন স্বরে বলল,
“উঁহু। আপনাকে আর প্রশ্রয় দেওয়া যাবেনা। বলা যায়না এত ইয়াং, স্মার্ট, হ্যান্ডসাম বেয়াই আপনার কখন চান্স নিতে লেগে পড়েন! তাই আগে থেকেই সর্তক হয়ে গেলাম!”
বলেই রূপল ব্যগ্র হাসল! মোটামুটি ভাবসাব নিয়ে পুনরায় বাইকটা স্টার্ট করে দিলো। নীহারিকা তাজ্জব দৃষ্টিতে রূপলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। কোমরে হাত গুজে সে হেনস্তা গলায় বলল,
“এই লোক আমার ডায়লগ আমার সাথেই প্রয়োগ করল? লিফট দিবে বলেও চলে গেল? ধ্যাত্তেরি ভাল্লাগেনা। বার বার এই লোকের সামনে আমাকে নত হতে হয়। ইনসাল্টেড হতে হয়!”
রাগে গাঁ রি রি করছে নীহারিকার। মনে মনে রূপলকে অকৃতজ্ঞ এবং স্বার্থপর লোক বলে বকাও দিচ্ছে! মিনিট কয়েক বাদে একটি রিকশা খুঁজে পেতেই নীহারিকা রিকশাটিতে ওঠে গেল। তবে সে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা না হয়ে তার কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। অনেকদিন কলেজে যাওয়া হয়না তার। কিছুদিন পর ইনকোর্স এক্সাম শুরু হয়ে যাবে। এটেন্ডেন্সের উপর মার্কস দেওয়া হবে। তাই এখন আর হেলাফেলা করা যাবেনা। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে নীহারিকা তার মায়ের নাম্বারে কল করল। বাড়িতে খবরটা জানিয়ে দেওয়া উচিৎ। প্রথম কল বেজে উঠতেই নীহারিকার মা মারজিনা বেগম কলটি তুললেন। ঐপাশ থেকে মারজিনা বেগম হ্যালো বলতেই নীহারিকা বলল,
“আম্মু আমি ভাবিদের বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছি। এখন কলেজে যাচ্ছি।”
মারজিনা বেগম জিজ্ঞাসু গলায় বললেন,
“তোর ভাবি কই?”
“ভাবি আজ আসবেনা মা।”
“আসবেনা মানে? নিহাল তো বলল আজ তোরা একসাথে আসবি।”
“আমিই ভাইয়াকে বলেছিলাম আমরা একসাথে আসব। কিন্তু এখন ভাবি বলছে আজ আসবেনা ভাবি। আমিও তেমন ফোর্স করিনি। দেখলাম ভাবির মন খারাপ! মিস্টার রাতুলের বিষয়টা নিয়ে বাড়ির সবার-ই মন খারাপ। তাই আমিও আর জোর করিনি! থাক, কয়েকদিন থেকে মনটা ফ্রেশ করে আসুক। আর তুমিও ভাবিকে কিছু বলতে যেয়ো না আবার। মন ভালো হলে ভাবি নিজেই আমাদের বাড়িতে চলে আসবে।”
রুক্ষ গলায় মারজিনা বেগম বললেন,
“বেড়াক সমস্যা নেই। কিন্তু একটা বার তো ফোন করে আমাদের খবর নিবে! পরের মেয়ে বলে কী কোনো দায়-দায়িত্ব নেই?”
মারজিনা বেগমের কথায় যুক্তি আছে জেনেও নীহারিকা তার মাকে প্রশ্রয় দিলোনা! বরং তার মাকে শাসিয়ে বিরক্তিকর গলায় বলল,
“মা হইছে তো! কেন বিষয়টাকে নিয়ে এত বাড়াচ্ছ? এটা যার যার ইচ্ছা, রুচি, মর্জির উপর ডিপেন্ড করে। সবার মনমানসিকতা কী আর তোমার মনমতোন হবে? বাদ দাও এসব। কারো উপর প্রয়োজনের তুলনায় বেশী এক্সপেকটেশন রাখবে না! তাহলেই ভালো থাকতে পারবে। আচ্ছা আমি এখন রাখছি। কলেজে যাচ্ছি।”
মেয়ের কথায় চুপ হয়ে গেলেন মারজিনা বেগম! তবুও তিনি ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,
“কখন আসবি?”
“আসতে আসতে দুপুর হবে।”
“কী রান্না করব আজ?”
“যা ইচ্ছা।”
“আমি আরও ভেবেছিলাম আজ চিংড়ি মাছের মালাইকারি রান্না করব! এই ডিশটা তোর ভাবির খুব পছন্দ। যেহেতু মেয়েটা কাজ আসবেই না তাহলে মাছটা ফ্রিজে তুলে রেখে দিই। কী বলিস?”
“হুম। রেখে দাও। ভাবি এলে রান্না করো।”
“আচ্ছা রাখি। কলেজে যা। সাবধানে যাস মা।”
“ঠিক আছে মা। রাখছি।”
”এই দাড়া দাড়া৷ কল কাটিস না। খাতা, কলম ছাড়া তুই ক্লাস করবি কীভাবে?”
“আরে মা চিল! আমার তো জাস্ট এটেন্ডেন্সেরই দরকার! খাতা-কলম, ব্যাগপত্র দিয়ে কী হবে?তাছাড়া কলেজে এসব টিচাররা চেক করেনা! প্রেজেন্ট থাকলেই এনাফ!”
কলটা কেটে নীহারিকা লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল! পিয়াসাকে নিয়ে সে চিন্তিত। মেয়েটা তাদের সাথে ঠিকঠাকভাবে মানিয়ে চলতে পারবে কী-না তা নিয়ে সে বড়োই দ্বিধাগ্রস্ত। এভাবে বেশিদিন চলতে থাকলে তো সংসারে অশান্তি বাড়তেই থাকবে। কতদিন আর সে তার মাকে বুঝিয়ে রাখবে? যা বুঝা যাচ্ছে, পিয়াসাকে বেশী একটা প্রশ্রয় দেওয়া যাবেনা! তার ছেলেমানুষীও মেনে নেওয়া যাবেনা।
কলেজের কাছাকাছি যেতেই নীহারিকা তার বেস্টফ্রেন্ড তুলিকে কল করল। দু-একজন সাঙ্গ পাঙ্গ ছাড়া কলেজে ক্লাস করাটা যেন পানসে লাগে। এত স্টুডেন্টের মাঝে ক্লাসে থেকেও নিজেকে একা মনে হয়! তুলি আগে থেকেই ক্লাসে বসে আছে! এই কয়েকদিনে তুলি আর না হয় একশ কল করেছে নীহারিকাকে। অসুস্থতা এবং সবদিকের ভেজালে ফোন বেশী একটা হাতে নেওয়া হয়নি নীহারিকার। তাই তুলির সাথেও যোগাযোগ করা হয়নি। এই নিয়ে তুলি নীহারিকার উপর বেশ রেগে থাকলেও নীহারিকা ঠিকই তার বান্ধবীকে মানিয়ে নিলো।
শাফকাতকে কলেজের কোথাও দেখা গেলনা আজ! অথচ এই শাফকাত কলেজে আছে ভেবে নীহারিকা খুব ভয়ে ভয়ে চলাফেরা করছিল! উপর থেকে নীহারিকা যতই শাফকাতকে ভয় না পাওয়ার ভান করুক না কেন ভেতরে ভেতরে সে শাফকাতকে ঠিকই প্রচুর ভয় পায়! কারণ, ছেলেদের মন। কখন কী থেকে কী করে বসে বলা যায়না। তাই এক্ষেত্রে মেয়েদেরকে যতটা সম্ভব সতর্ক থাকা উচিৎ।
ক্লাস শেষ হতে হতে দুপুর হলো। তুলি এবং নীহারিকা বেশ ফুরফুরা মেজাজ নিয়ে কলেজ থেকে বের হয়ে এলো। আলাপচারিতা শেষে তুলি তার নিজের বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেল। আর নীহারিকাও তার বাড়ির দিকে। রিকশায় কিছুদূর যাওয়ার পর নীহারিকার আকস্মিক দৃষ্টি পরল একটি আবাসিক হোটেলের দিকে। নীহারিকার বয়ফ্রেন্ডকে কেড়ে নেওয়া তারই এক সময়ের বেস্ট ফ্রেন্ড দিশা একটি অচেনা ছেলের হাত ধরে হোটেলটির ভেতরে ঢুকে গেছে! পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও নীহারিকা তার দূরদৃষ্টিতে যতটুকু দেখেছে ততটুকুতে খুব সম্ভবত ভুল কিছু দেখেছে বলে মনে হলোনা!
শীঘ্রই নীহারিকা রিকশা থেকে নেমে পড়ল। রিকশাটিকে দাড় করিয়ে সে রাস্তা পাড় হয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে হোটেলটির ভেতরে ঢুকে গেল! মুখে ওড়না প্যাঁচিয়ে সে হোটেলটির কাউন্টারে যেতেই দেখতে পেল সত্যিই দিশা ছেলেটির সাথে দাড়িয়ে রুম বুক করছে! দিশার চরিত্র আগে থেকেই খারাপ ছিল! দিশার চলাচলও নীহারিকার পছন্দ ছিলনা৷ সন্দেহ হত তাকে। তবে বেস্টফ্রেন্ড ছিল বিধায় তার উপর কখনও আঙুল তোলা হয়নি। কিন্তু এখন যেহেতু সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেছে সেহেতু এত ভালোমানুষী দেখানোর কোনো প্রয়োজনই পরেনা!
মেয়েটি যে দিশা তা পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পর নীহারিকা আড়ালে লুকিয়ে গেল। রুমের চাবি নিয়ে দিশা এবং ছেলেটি হাসতে হাসতে দু-তলায় তাদের বুক করা রুমের উদ্দেশ্যে ওঠে গেল। যে করেই হোক দিশার মুখোশ আজ খুলতে হবে। তাকে হাতেনাতে ধরতে হবে। এতদিনের জমিয়ে রাখা হিসেব মিটাতে হবে! সুযোগ পেলে নীহারিকা কাউকে এমনি এমনি ছেড়ে দেয়না! তার স্বভাব ছাড় দেওয়া কিন্তু ছেড়ে দেওয়া না।
হোটেলে অবস্থান করেই নীহারিকা তার নতুন নাম্বার থেকে সানিকে কল করল! মুখে ওড়না চেপে ধরে সে নিজের গলার স্বর পাল্টানোর চেষ্টা করল! তার গলার স্বর যেন সানি কোনোভাবে ধরতে না পারে সেই জন্যে। ঐপাশ থেকে সানি কলটি তুলল৷ অমনি নীহারিকা ক্ষীণ গলায় বলল,
“আপনি সানি বলছেন না?”
ঐপাশ থেকে সানি স্বাভাবিক গলায় বলল,
“হ্যা বলছি। বাট হু আর ইউ?”
“আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী! দিশা আপনার গার্লফ্রেন্ড হয় তাইতো?”
নির্বোধ গলায় সানি বলল,
“হ্যা। কেন?”
“তাকে দেখলাম একটি ছেলের সাথে আবাসিক হোটেলে ঢুকতে! যদি আমার কথা বিশ্বাস না হয় আমি ঠিকানাটা আপনাকে দিচ্ছি। আপনি নিজের চোখে এসে দেখে যান।”
বিপরীতে সানিকে কিছু বলার সুযোগ দিলোনা নীহারিকা! ঠিকানাটি বলেই সে ফট করে কলটি কেটে দিলো! দ্রুত পায়ে হেঁটে সে হোটেল থেকে বের হতেই চমকে গেল! বুকে হাত গুজে রূপল বদরাগী ভাব নিয়ে নীহারিকার দিকে তাকিয়ে আছে! অপ্রত্যাশিতভাবে রূপলকে দেখে নীহারিকা অস্বস্তিতে পরে গেল। শুকনো ঢোঁক গিলে সে রূপলের দিকে এগিয়ে এলো। কম্পিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“আআআপনি এএখানে কী করছেন?”
বুকের পাঁজর থেকে হাতদুটো ছাড়িয়ে রূপল বিক্ষুব্ধ গলায় চ্যাচিয়ে বলল,
“আগে বলুন আপনি এখানে কী করছেন? কার সাথে এসেছেন এখানে?”
রূপলের চিৎকারের আওয়াজে নীহারিকার কান দুটো ঝালাফালা হয়ে গেল! চোখ জোড়া খিঁচে ধরে সে কান দুটো চেপে ধরল। বিব্রতকর গলায় বলল,
“আরে আস্তে! এত চ্যাচাচ্ছেন কেন? আমি কানে কালা না-কী? যে আস্তে বললে শুনতে পাব না?”
পূর্বের মতই জেদ বজায় রেখেই রূপল কর্কশ গলায় নীহারিকাকে বলল,
“আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে না? ঠাটিয়ে দুটো চ/ড় মারত! আমিতো আপনার সাথে জাস্ট চ্যাচিয়ে কথা বলছি।”
অবুঝ ভাব নিলো নীহারিকা। নির্বোধ গলায় শুধালো,
“আজব! করলামটা কী আমি?”
“এই আবাসিক হোটেলে আপনি কী করছিলেন হুম? আপনি জানেন না? এসব আবাসিক হোটেলে ছেলেমেয়েরা এমনি এমনি আসেনা?”
“আরেহ্, আপনি বুঝছেন না ব্যাপারটা। আমি এখানে এসেছিলাম অন্য কারণে। কিন্তু আপনি জেনেশুনে এসব জায়গায় আসলেন কেন? তাহলে কী আমিও ধরে নিব আপনিও….”
“হেই শাট আপ! সামনের গ্যাস পাম্প থেকে বাইকের তেল পুরাতে এসেছিলাম এখানে। হঠাৎ চোখ পরল আপনার দিকে। তাই আপনাকে হাতেনাতে ধরতে এখানে আসা!”
“কিন্তু আপনি আমাকে হাতেনাতে ধরতে এসে তো, আপনি নিজেই ধরা খেয়ে গেলেন!”
“এই আপনি কী আমার সাথে ইয়ার্কি করছেন? আমি এখানে এসেছি আপনাকে ধরতে, নিজে ধরা খেতে না।”
“সবসময় ইয়ার্কি করতে আমার ভালো লাগেনা বুঝলেন? লজিক্যালি বিষয়টা একবার ভাবুন তো৷ এইযে আমরা দুজন এখন একই সাথে এই আবাসিক হোটেলের নিচে দাড়িয়ে আছি বাই অ্যানি চান্স আমাদের পরিচিত কেউ যদি আমাদের দুজনকে একসাথে এখানে দেখে ফেলে? তাহলে বিষয়টা কী দাড়াবে?”
নীহারিকার যুক্তিবাদী কথায় কাশি ওঠে গেল রূপলের! গলা খাঁকিয়ে সে বলল,
“চলে আসুন এখান থেকে! আপনার মত বিচ্ছু মেয়ে আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি।”
নাক ঘঁষল নীহারিকা। বেশ ভাবসাব নিয়ে বলল,
“বিচ্ছু না। কথাটা জ্ঞানী হবে!”
“হোয়াটএভার। আমি এক্ষুণি জিজুর কাছে ফোন করছি! বাড়িঘর রেখে যে আপনি এসব জায়গায় ঘুরাঘুরি করেন সব বলছি। অন্যায় তো করবে করবে আবার নিজেকে জ্ঞানী বলেও দাবি করবে। ডিজগাস্টিং।”
ফোন হাতে নিতেই রূপলকে বাঁধা দিলো নীহারিকা! নাক ফুলিয়ে কর্কশ গলায় বলল,
“এই? সবসময় নাকের ডগায় এত রাগ নিয়ে ঘুরেন কেন? রাগী ভীমরুল একটা!”
তিরিক্ষিপূর্ণ মেজাজে রূপল যেইনা নীহারিকাকে কিছু বলতে যাবে অমনি নীহারিকা ঝট করে রূপলের হাত ধরে রূপলকে নিয়ে পিছনে ঘুরে গেল! অস্থিরতা নিয়ে সে বিড়বিড় করে রূপলকে বলল,
“একটু চুপ থাকুন প্লিজ। জাস্ট ফর টু মিনিটস। এরপর আপনি যা ইচ্ছা তা করুন। আমি কোনো অভিযোগ করবনা।”
#চলবে…?
#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_২৬
#নিশাত_জাহান_নিশি
“একটু চুপ থাকুন প্লিজ। জাস্ট ফর টু মিনিটস। এরপর আপনি যা ইচ্ছা তা করুন। আমি কোনো অভিযোগ করবনা।”
নীহারিকার হাত থেকে ঝট করে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো রূপল। নীহারিকার কথা সে মানতে নারাজ! হেয়ালী তার মোটেও পছন্দ নয়। সেই কখন থেকেই নীহারিকা তাকে এই ওই বলে বুঝিয়ে রেখেছে। তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছেনা এই ধোঁয়াশার মধ্যে থাকা। তাই বিরক্ত হয়ে সে তিরিক্ষি পূর্ণ মেজাজে নীহারিকাকে শাসিয়ে বলল,
“এসব কী লাগিয়ে রেখেছেন আপনি? আসার পর থেকেই ভনিতা করে চলছেন। একচুয়েলি কী করতে চাইছেন আপনি? একটু ক্লিয়ারলি বলবেন?”
রূপলের রাগের ধার ধারল না নীহারিকা! এই মুহূর্তে রূপল এবং তার অপ্রয়োজনীয় রাগকে নিয়ে ভাববার সময় নেই তার। প্রশ্নে জর্জরিত রূপলকে উপেক্ষা করে সে আঁড়চোখে পিছনে তাকালো। বাইক থেকে তাড়াহুড়ো করে নামল সানি! অস্থির, নাজেহাল, দিশেহারা সে। কতটা চিন্তিত হলে সে খবরটা পাওয়া মাত্রই দশ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে? চোখেমুখে উদগ্রীবতার ছড়াছড়ি। তা দেখে ব্যগ্র হাসল নীহারিকা। পৈশাচিক আনন্দ খুঁজে পেল সে!
ঠিকানা অনুযায়ী সঠিক জায়গায় পৌঁছাতেই সানি তিনতলা বিশিষ্ট আবাসিক হোটেলটির দিকে তাকালো। এদিক ওদিক তাকানোর সময় নেই কার। পাগলা ঘোড়ার মত সে ছুটে চলল হোটেলটির ভেতরে! নীহারিকা এবং রূপলকে পাশ কাটিয়ে সে হোটেলের ভেতর প্রবেশ করতেই নীহারিকা স্বস্তির শ্বাস ফেলল। স্বাভাবিক হয়ে রূপলের দিকে তাকালো। মাথা থেকে ঘোমটটি সরিয়ে সে হাত দুটো ঝেড়ে বলল,
“তো এবার বলুন? কী যেন বলছিলেন?”
তেতে উঠল রূপল। অধৈর্য্য হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আপনার মধ্যে কী চলছে কাইন্ডলি একটু বলবেন? সেই কখন থেকে কথায় কথায় আমাকে আটকে রেখেছেন। বোকা বানাচ্ছেন আমাকে? হেনস্তা করছেন?”
“আর পাঁচটা মিনিট অপেক্ষা করুন প্লিজ। এরপর দেখবেন আসল খেলা।”
পূর্ণ মেজাজ নিয়ে রূপল বলল,
“আমারই ভুল হয়েছিল আপনার মত একটা অদ্ভুত মেয়ের পেছনে দৌড়ে আসা! তাকে ধরতে আসা। এসব না করে আমার ফার্স্টেই জিজুকে কল করে খবরটা জানিয়ে দেওয়া উচিৎ ছিল। জিজু এসেই আপনাকে একটা উচিৎ শিক্ষা দিত! বাসায় গেলাম আমি। যার পরিবারের লোককে সে এসে সামলাবে।”
বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে রূপল পিছু ঘুরতেই নীহারিকা বাঁধ সাধল। ব্যাকুল স্বরে বলল,
“একটা মিনিট দাড়ান প্লিজ। আপনি জানতে চাননা আমি এখানে কী করছি? কিছু না জেনে শুনে ভাইয়াকে কিছু বললেই তো হয়ে গেলনা! তাছাড়া বাড়িতে কী কাজ আপনার?”
থামল রূপল। রাগ ভুলে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল সে। খানিক ভরাট গলায় বলল,
“সবিতা তার বাড়িতে সুহাসিনীর জন্য ছোটো খাটো একটা মিলাদের আয়োজন করছে! ওখানে আমার এটেন্ড থাকতে হবে।”
অবিলম্বেই রূপলের মুখোমুখি এসে দাড়ালো নীহারিকা। রূপলের দু’চোখে তার অধীর দৃষ্টি জোড়া স্থাপন করে বলল,
“আপনার চোখে জল কেন?”
ইতোমধ্যেই বেঁধে গেল মহা তুলকালাম! হোটেল রুম থেকে সানি টেনে হিঁছড়ে ছেলেটিকে বের করে আনল! শুধু তাই নয় ছেলেটির পেছনে পেছনে দিশাও বের হয়ে এলো! হোটেলের ম্যানেজার হতে মালিকরাও হোটেল থেকে বের হয়ে বাইরে চলে এলো। সানির তার বাবার ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে হোটেলের প্রত্যেকটা কর্মচারীকে নাস্তানাবুদ করে রাখল। এই সুযোগে নীহারিকা রূপলকে নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে অনেকখানি দূরে সরে এলো! আড়ালে দাড়িয়ে সে লুকিয়ে লুকিয়ে দিশা, সানি এবং ছেলেটির কার্যকলাপ দেখছে! কোনো কথাবার্তা ছাড়াই সানি ঠাস ঠাস করে চড় মেরে বসছে ছেলেটিকে! সাথে মাথা নুইয়ে কাঁদতে থাকা দিশারও চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছে। এই দৃশ্য দেখে নীহারিকার চোখ জুড়িয়ে এলো। পৈশাচিক হেসে সে আনন্দে হাবুডুবু খেলেও রূপলের মধ্যে মানবতা বোধ জেগে উঠল! ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য সে পা বাড়ালো। উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
“আরে ছেলেটাকে এভাবে মারধর করছে কেন? কী হচ্ছে ওখানে?”
অমনি নীহারিকার বাঁধ ভাঙা হাসিতে ভাটা নামল! ঝট করে রূপলের হাতটা চেপে ধরল। চলতি পথে রূপলকে থামিয়ে দিলো। দাঁতে দাঁত চেপে মিনমিনিয়ে বলল,
“এই? কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
পিছু ফিরে রূপল চিন্তিত সুরে বলল,
“দেখছেন না ছেলেটাকে মারছে? ওখানে কী হচ্ছে আমাকে দেখতে হবে।”
“আরে রাখুন আপনার সমাজ সেবা! এত তোড়জোড় করে ঘটনা বাঁধালাম আমি আর আপনি যাচ্ছেন ঘটনার জট খুলতে?”
অবাক হলো রূপল। কপাল কুচঁকে নীহারিকার দিকে তাকালো। দৃষ্টি তার সূচালো। উদ্ভট গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“মানে? কী বলতে চাইছেন আপনি?”
“মানেটা পরে বলছি। আগে বলুন আপনার ফোনে ব্যালেন্স আছে?”
“আছে। কেন?”
“ফোনটা একটু দিন তো।”
“কেন? কী দরকার? কাকে কল করবেন?”
“এত প্রশ্ন করছেন কেন? দিন না ফোনটা। কথা বলার সময় তো সব শুনবেনই। আমি তো আর লুকিয়ে ছুপিয়ে কথা বলব না।”
বাধ্য হয়ে রূপল তার ফোনটি নীহারিকাকে দিলো। ফোনটি হাতে পেতেই নীহারিকা পুলিশ কল করল! বলল এখানে দুটি ছেলে এবং একটি মেয়ের মধ্যে তুমুল মা’রা’মা’রি হচ্ছে! কাউকেই থামানো যাচ্ছেনা। খুব শীঘ্রই যেন তারা ঘটনাস্থলে আসে! নয়ত পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে। পুলিশকে খবরটা জানিয়ে-ই নীহারিকা কলটি কেটে দিলো। রূপল উল্লুক হয়ে নীহারিকার দিকে তাকিয়ে রইল! কলটি কেটে নীহারিকা বাঁকা হেসে রূপলের দিকে তাকালো। বিষম খেয়ে রূপল নীহারিকার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“কী হলো ব্যাপারটা?”
দাঁত কপাটি বের করে নীহারিকা বলল,
“প্রতিশোধ নিলাম।”
“কীসের প্রতিশোধ?”
“ভালোবাসার বিনিময়ে ধোঁকার!”
নীহারিকার হেয়ালী কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলনা রূপল। বেকুব হয়ে কেবল উচ্ছ্বল নীহারিকার পানে তাকিয়ে রইল। বড়োজোর আধাঘণ্টার মধ্যেই ঘটনাস্থলে পুলিশ চলে এলো! কোনো পক্ষের কথা ভালোভাবে না শুনেই পুলিশ তিনজনকেই গাড়িতে উঠিয়ে নিলো! টাকার লোভ সামলাতে পারলনা তারা। তিনজনের থেকে মোটা অঙের টাকা কামাতে পারবে বলে লোভে তাদের চোখদুটো চকচক করছিল! ক্ষণিকের মধ্যেই নীহারিকা বেশ তৎপর হয়ে উঠল। দ্রুত গলায় রূপলকে বলল,
“আর বেশিক্ষণ এখানে থাকা যাবেনা। চলুন আমরা এখান থেকে পালাই।”
রূপলকে নীহারিকা বাধ্য করল ঘটনাস্থল থেকে সরে যেতে। দুজনই বাইকে ওঠে এবার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। নীহারিকার কথামত রূপলও ছুটছে! কোনোরূপ যোগ জিজ্ঞাসা ছাড়াই। বাইক দ্রুত গতিতে ছেড়ে রূপল কিছু সময় মৌন রইল। অতঃপর কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে সে এবার মুখ খুলে নীহারিকার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“এবার একটু বলবেন আপনার মাথায় চলছেটা কী? এই প্রথম আমার নিজেকে এতটা বোকা মনে হচ্ছে! কারো কথামত ছুটছি তো ছুটছি।”
নীহারিকা এবার বেশ তৎপর হয়ে উঠল। রূপলকে বৃত্তান্ত খুলে বলার জন্য প্রস্তুত হলো। খোলসা গলায় বলল,
“তাহলে গল্পটা বরং আপনাকে খুলেই বলি। শুনুন তবে।”
কয়েকদফা রুদ্ধ শ্বাস ফেলে নীহারিকা নিজেকে স্থির করল। পুরোপুরি নিজেকে ধাতস্থ করে সে গলাটা খানিক ঝাঁকিয়ে বলল,
“এক দেশে এক রাজকুমারী ছিল। রাজকুমারীটি দেখতে কালো এবং বেটে ছিল! যদিও রাজকুমারীরা মানুষের কাল্পনিক চিন্তাধারায় অতিমাত্রায় সুন্দরী এবং নিঁখুত হয়। তবে এই রাজকুমারীটি ছিল কালো এবং বেটে! শারীরিক গঠনের দিক থেকে তার অনেক খুঁত ছিল। সবাই বলত তার চেহারায় নাকী অদ্ভুত এক মায়া ছিল। কেউ একবার তার দিকে সুনজরে তাকালে তার থেকে আর চোখ ফেরাতে-ই পারবেনা! যদিও তাদের এসব বানোয়াট কথায় রাজকুমারী বিশ্বাস করত না তবে একদিন সে এই কথাগুলোই তার স্বপ্নে ভুল করে দেখা রাজকুমারের মুখে শুনে বিশ্বাস করে নিয়েছিল! সেই রাজকুমারের নিঁখুত জাল বিছানো কথার জালে ফেঁসে গিয়ে সে রাজকুমারকে তার মন দিয়ে বসেছিল। তাদের দুজনের প্রণয় হলো। বেশ চলছিল তাদের দিনকাল। তবে হুট করেই একদিন তাদের মাঝখানে চলে এলো এক সুন্দরী ডাইনি! ডাইনিটি আর কেউ নয়, ডাইনিটি ছিল রাজকুমারীর প্রাণপ্রিয় সখী! রূপের ঝলক দেখিয়ে ডাইনিটি রাজকুমারীর কাছ থেকে তার রাজকুমারকে কেড়ে নিলো! সেই সময়কার দুঃখী এবং বোকা রাজকুমারী ভেবেছিল রাজকুমারকে এত সহজে তার থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। তাকে ছাড়া রাজকুমার আর কাউকে ভালোবাসতে পারবেনা। কিন্তু যেদিন তার বিশ্বাস মিথ্যা প্রমাণিত হলো সেদিন রাজকুমারীও তার মনকে শক্ত করে নিলো! পাথরের মত শক্ত এবং লোহার মত কঠিন! রাজকুমারী অপেক্ষা করছিল কবে সে তার সাথে হওয়া বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নিবে! কবে ঐ বিশ্বাসঘাতকদের আসল মুখোশ সবার সামনে টেনে খুলবে। সেই সময় এবং সুযোগ যে এত দ্রত রাজকুমারীর হাতে ধরা দিবে কে জানত? আজ সুযোগ পেতেই রাজকুমারী বিশ্বাসঘাতকদের প্রতিশোধ নিলো! ঘাড় থেকে তাদের গলা আলাদা করতে না পারলেও গারোদের পেছনে ঠিক কয়েক ঘণ্টার জন্যে হলেও নিতে পারল!”
নীহারিকার প্রতিটি কথা রূপল বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনল। নীহারিকা কী বুঝাতে চাইল রূপল ঠিক বুঝতে পারল। তবুও সে মৌণ রইল। নীহারিকাকে আরও কিছু বলার সুযোগ দিলো! কয়েক দফা শ্বাস ফেলে নীহারিকা পুনরায় বলল,
“সেই রাজকুমারীটি আর কেউ নয় আমি! নিজেকে আমি রাজকুমারী বললাম কারণ, আমার কাছে আমি সত্যিই রাজকুমারী! শুধু সুন্দর হলেই যে রাজকুমারী হওয়া যায় বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। আমি মনে করি রাজকুমারী হওয়ার মত সমস্ত গুন আমার মধ্যে আছে! আমি যেমন সাহসী, আত্নবিশ্বাসী, পরোপকার, দয়ালু, কঠিন মনের মানুষ এবং প্রয়োজনে সরল সেই সব গুন একজন রাজকুমারীর মধ্যে থাকে! ছোটো বেলায় দাদুর মুখে রাজকুমারীর অনেক গল্প শুনতাম। তখন মনে হত ইশ, আমিও যদি রাজকুমারী হতাম! তাই চেষ্টা করতাম রাজকুমারীর সমস্ত গুন নিজের মধ্যে আয়ত্ত করতে। আমি অতি আবেগী মানুষ নই। মাঝে মাঝে কষ্ট পেলে আমিও কাঁদি। তবে প্রয়োজনের তুলনায় বেশী নয়। যারা আমাকে কষ্ট দেয়, আমার সাথে প্রতারণা করে, বিশ্বাসঘাতকতা করে আমি তাদের ছাড় দিইনা! তাদের জন্য আমার কোনো মায়া হয়না! অল্পতেই ভেঙে পড়িনা আমি। বিশ্বাস করি, কারো জন্য জীবন থেমে থাকেনা। নতুন করে জীবনকে সাজিয়ে নিতে হয়। আমি আমার যাবতীয় না বলা দুঃখ কষ্ট আমার মায়ের কাছে শেয়ার করি। মায়ের আঁচল ধরে কাঁদি। তবে পৃথিবীকে তা বুঝতে দিইনা!”
“আপনি কী কোনোভাবে আমাকে পিঞ্চ করছেন?”
“পুরুষ মানুষদের এত দুর্বল হওয়া মানায় না মিস্টার রূপল! যে আপনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল আপনি তার জন্য এখনও কষ্ট পাচ্ছেন? তারই জন্য কাঁদছেন? ছিচকাঁদুনি মেয়েদের মত? আমাকে দেখেছেন? কীভাবে বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নিলাম? যে আমাকে ঠকালো তার জন্য আমার মোটেও কষ্ট হচ্ছেনা। বরং আনন্দ হচ্ছে। এতদিনে আমার মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। একটা মেয়ে হয়ে যদি আমি নিজেকে এভাবে সামলাতে পারি তাহলে আপনি একটা ছেলে হয়ে কেন নিজেকে সামলাতে পারছেন না? কথায় কথায় এখনও তার জন্য কাঁদেন! এসব ছেলেমানুষী বাদ দিন। নিজের মনকে শক্ত করুন। একবার শক্ত হয়ে দেখুন কেউ আপনাকে ভাঙতে পারবেনা।”
দুজনই চুপচাপ! নীহারিকার প্রতিটি কথা রূপলের কাছে শিক্ষনীয় মনে হলেও কথার পিঠে নীহারিকাকে কিছু বলার সাহস খুঁজে পেলনা সে! নিজেকে খুব ছোটো এবং বিবেকহীন মনে হলো। তার বয়সের ছোটো একটা মেয়ের থেকে তার জ্ঞান নিতে হলো? নীহারিকাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে রূপল সোজা তার বাড়ি চলে গেল। সবিতার বাড়িতে যাওয়ার মর্জি হলোনা তার! সবকিছু তিক্ত মনে হচ্ছিল তার। ভেতরে ভেতরে নিজের প্রতি নিজের ক্ষোভ জন্মাতে লাগল।
রুমে ঢুকে রূপল ভেতর থেকে তার রুমের দরজাটা লক করে দিলো। গাঁ থেকে শার্টটা টেনেটুনে খুলল। উগ্র মেজাজ নিয়ে সে ঘরের প্রতিটি আসবাবপত্র ছড়াতে ছিটাতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যেই সাজানো ঘরটিকে এলোমেলো করে দিয়ে সে বিধ্বস্ত হয়ে একটি সিগারেট ধরালো! গরম মাথা নিয়ে খাটের উপর বসল। গাঁ থেকে জবজবিয়ে ঘাম ঝরছে তার। দুর্বিষহ গরম লাগছে। গাঁ থেকে যেন আগুনের তাপ বের হচ্ছে। একের পর এক সিগারেটে টান দিচ্ছে সে। আস্ত সিগারেটটি শেষ হতেই সে সিগারেটটি মেঝেতে ছুড়ে মারল! দাঁতে দাঁত চেপে ক্ষোভ ঝেড়ে বলল,
“আমার অবস্থান এখন এতটাই খারাপ হয়ে গেল যে একটা হাঁটুর বয়সী মেয়ের থেকে আমার জ্ঞান নিতে হচ্ছে? কী হয়ে গেল আমার এসব? আমি কী সত্যিই এতটা আবেগী হয়ে গেলাম যে মেয়েদের মত হুটহাট কেঁদে ফেলি? যাকে বলে ছিচকাঁদুনি? আমার সেই রাগ-জেদগুলো কোথায় গেল? কী থেকে কী হয়ে গেলাম আমি?”
বলেই রূপল নিজের মাথার চুল নিজেই টানতে লাগল! খাট থেকে নেমে সে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ল। নিজের মধ্যে নেই সে। রাগে জেদে হাত-পা মেঝেতে আছড়াতে লাগল সে! পাশেই ডেস্কের উপর থেকে ফোনটি নিয়ে সে সজলের নাম্বারে কল করল! ঐ পাশ থেকে সজল কলটি তুলতেই রূপল চ্যাচিয়ে বলল,
“এই কোথায় তুই?”
পড়ার চাপে নাজেহাল সজল। বিছানার আনাচে কানাচে কেবল বই খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মাঝখানে শুয়ে সে কলম কামড়াচ্ছে আর সামনে একটি বই নিয়ে পড়ছে এবং অন্য একটি বই তার মাথার উপরে চেপে রেখেছে! অবস্থা তার বেহাল। এরমধ্যেই রূপলের ফোন। ধরাশায়ী হয়ে সে ব্যস্ত গলায় বলল,
“ভাই আমি তো হোস্টেলে। এক্সাম চলছে আমার।”
“ভিডিও কল দিচ্ছি। কলটা তোল।”
ফোনটি কেটেই রূপল ওয়াইফাই অন করল। সজলের হোয়াইট’স অ্যাপ নাম্বারে ভিডিও কল দিলো। তড়তড়িয়ে শোয়া থেকে ওঠে বসল সজল। গলা ঝাকিয়ে কলটি তুলল। একটি বই এখনও তার মাথার উপরে রয়ে গেছে! আকস্মিক রূপলের কল পেয়ে দিশেহারা হয়ে গেছে সে। সজলের দিকে সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকানোর সময় বা ইচ্ছা কোনটিই হলোনা রূপলের। মেঝেতে বসে থেকেই সে ঝাঁজালো গলায় সজলের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“আচ্ছা ভালো করে দেখ তো। আমার মধ্যে কী কোনোকিছুর পরিবর্তন এসেছে?”
রূপলের প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সজল! প্রশ্নের আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলনা সে। দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করতেও ভয় করছিল তার! যদি রূপল রেগে যায় তাই। তবুও জড়তা নিয়ে সজল কাঠ কাঠ গলায় শুধালো,
“বুঝিনি ভাই আবার বলেন?”
অমনি রূপলের মেজাজ আরও চওড়া হয়ে গেল! বসা থেকে দাড়িয়ে গেল সে। তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় শুধালো,
“বাংলা বুঝিস না তুই? ভালো করে আমার দিকে তাকিয়ে দেখ আমার মধ্যে কোনো পরিবর্তন এসেছে কী-না বল?”
এমনিতেই রূপলকে ভয় পায় সজল! তার উপর একই প্রশ্ন দুইবার করার পরেও সে প্রশ্নের মানে বুঝতে পারছেনা। এই অবস্থায় সে আবারও কী করে একই প্রশ্ন তৃতীয় বার করতে পারে? মনে ভয় নিয়ে সজল ঠকঠক করে কেঁপে উঠল। বলল,
“কেমন পরিবর্তন ভাই?”
“আমার মধ্যে কী কোনো মেয়ে মেয়ে ভাব আছে?”
“আস্তাগফিরুল্লাহ্! নাউযুবিল্লাহ্! এসব আপনি কী বলেন ভাই? আমাদের বংশের মধ্যে তো কোনো ‘গে’ নাই!”
#চলবে…?
#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_২৭
#নিশাত_জাহান_নিশি
“আস্তাগফিরুল্লাহ্! নাউযুবিল্লাহ্! এসব আপনি কী বলেন ভাই? আমাদের বংশের মধ্যে তো কোনো ‘গে’ নাই!”
“এই কী বললি তুই? আমাকে ইনডিরেক্টলি গে বললি?”
রূপলের ঝাঁজালো প্রশ্ন এবং গলার স্বরে সজল তার নিজের মধ্যে ফিরে এলো! ঠেলার চোটে সে নিজের বড়ো ভাইকে ‘গে’ বলে ফেলল? সামনে থাকলে আজ নির্ঘাত তার গর্দান যেত! পরিস্থিতি কীভাবে স্বাভাবিক করবে হবে বুঝতে পারলনা সজল। এই অবস্থায় পল্টি নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও খুঁজে পেলনা সে। নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে ডর ভয় বিসর্জন দিয়ে সে হুমকি স্বরূপ গলায় ঝাড়ি মেরে বলল,
“ভাই একবার শুধু নামটা বলেন? কে আপনার মত একজন সুপুরুষ, বলবান, ইয়াং, হ্যান্ডসাম, ড্যাশিং একটা ছেলেকে মেয়েদের সাথে তুলনা করেছে? জাস্ট নামটা একবার বলুন। বাকীটা আপনার ছোটো ভাই বুঝে নিবে।”
“আগে তো আমি তোর ক্লাস নিব! এরপর সুস্থ থাকলেই না তুই অন্যের ক্লাস নিবি। পরীক্ষা শেষ করে ভালোয় ভালোয় জাস্ট বাড়ি ফিরে আয়। তোর চৌদ্দটা বাজাব আমি! খুব চালাক হয়ে গেছিস তাইনা? বড়ো ভাইকে টপকে?”
সজলকে থ্রেট দেওয়া শেষে রাগী হুংকার দিয়ে কলটি কেটে দিলো রূপল। কান থেকে ফোনটি সরিয়ে সজল ভয়ের চোটে নখ কামড়াতে লাগল। পড়ার ভূত তার মাথা থেকে নেমে গেল। সারা রুম জুড়ে কেবল পায়চারী করতে লাগল। কীভাবে রূপলকে পাম দিয়ে ঠাণ্ডা করা যায় সেই ভাবনা ভাবতে লাগল!
কলটি কেটেই রূপল আয়নার সামনে দাড়ালো। নিঁখুতভাবে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। মুখশ্রীতে ফুটে ওঠা হিংস্রতা প্রমাণ করে দিলো পূর্বের রূপল এবং এখনকার রূপলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তবে পার্থক্য ঘটেছিল তার মনে! এক ছলনাময়ীর প্রেমে পরে মন বেচারাকে সে এতটাই প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছিল যে, তার পুরুষত্ব এটিটিউড, ইগু সব বিসর্জন দিতে হয়েছিল! গত আড়াইটা বছর সুহাসিনী তাকে নাকে দাঁড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে। ভালোবাসার বিনিময়ে দিয়েছে শুধু ধোঁকা এবং ধোঁকা। তার বিশ্বাস ভেঙে তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে সুহাসিনী। তবুও তো সুহাসিনীকে ভুলা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা! প্রতিটা পদে পদে সুহাসিনীর কথা মনে পড়ে তার! কী এমন কালো জাদু করে গেল মেয়েটা তাকে?
রাগে ফোঁস ফোঁস করে রূপল তার ডেস্কের ড্রয়ারটি খুলল। ড্রয়ারটি নিয়ে সে মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ল। ড্রয়ার ভর্তি বিভিন্ন ডিজাইনের সানগ্লাস, ওয়াচ, পারফিউম, দুটো ব্র্যান্ডের শার্ট এবং দুটো পাঞ্জাবি! সুহাসিনীর দেওয়া গিফট গুলো বেশ যত্নসহকারেই সাজিয়ে রেখেছিল সে। তবে এখন তার আর এসবের প্রয়োজন নেই! সুহাসিনীর রেখে যাওয়া এই স্মৃতিগুলোই তাকে বড্ড পোড়াচ্ছে! স্মৃতিধ্বংস করতে চায় সে। তবেই হয়ত সুহাসিনীর মায়া হতে আংশিক মুক্তি পাবে সে! বেলকনিতে সমস্ত জিনিসপত্র রেখে সে আগুনে পোঁড়াতে গিয়েও থেমে গেল! লাইটার হাতে নিয়ে সে বিবেকবান গলায় বিড়বিড়য়ে বলল,
“এতগুলো ব্যবহারযোগ্য জিনিসকে এভাবে পুঁড়িয়ে দেওয়া কী ঠিক হবে? এরচেয়ে কী ভালো নয় এগুলো দান করে দেওয়া? অভাবগ্রস্ত মানুষেরা অন্তত এসব পড়ে মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করবে!”
বলেই রূপল সবগুলো জিনিসপত্র প্যাকেট করে নিলো। লম্বা এক শাওয়ার নিয়ে সে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো। অর্ধ ভেজা শরীরে সে পুনরায় আয়নার সামনে দাড়ালো। বিগত সাত মাসে এই প্রথমবার সে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে এতটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অবলোকন করছে! চুল, দাড়ি তার অসম্ভব রকম বড়ো হয়ে আছে। অন্তত শাওয়ার নেওয়ার আগে সেলুনে যাওয়া উচিৎ ছিল তার! বিষয়টা মাথা থেকেই বের হয়ে গিয়েছিল তার।
ইতোমধ্যেই সবিতার কল এলো তার নাম্বারে। ভ্রু কুঁচকে রূপল কলটি তুলল। ঐপাশ থেকে সবিতা বেশ কাতর স্বরে বলল,
“কী রূপল? তুমি আসবে না?”
চুল থেকে গড়িয়ে পড়া পানিগুলো ঝেরে রূপল ধীর গলায় বলল,
“আসছি।”
“আর কখন আসবে বলো? দুপুর একটা তো বেজে গেল।”
“এইতো রওনা হচ্ছি।”
“একটু তাড়াতাড়ি এসো প্লিজ। বাড়িতে একজন পুরুষ মানুষ না থাকলে হয়? যোহরের নামাজ পড়েই হুজুররা চলে আসবেন।”
“রান্নাবান্না সব কমপ্লিট?”
“হ্যাঁ। মাত্র কমপ্লিট হলো।”
“ওকে আমি আসছি।”
কলটি কেটে রূপল তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে গেল। হুট না বলে কয়ে সবিতাকে নিরাশ করা ঠিক হবেনা বলে তার মনে হলো! অফ হোয়াইট রঙের একটি শার্ট এবং তার সাথে একটি কালো জিন্স পড়ে হাতে সুহাসিনীর সেই গিফটসের প্যাকেট গুলো নিয়ে রূপল বের হয়ে গেল। যাওয়ার পথে নাজনীন বেগম হঠাৎ তার সামনে পরলেন। রূপলকে দেখে তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। পেরেশানি গলায় বললেন,
“তোর বোনকে নিয়ে আর পারা যাচ্ছেনা!”
অবাক হলো রূপল। ভ্রুদ্বয় কুঁচকালো। প্রশ্নবিদ্ধ গলায় বলল,
“কেন? কী হয়েছে?”
রূপলের বেশভূষা দেখে নাজনীন বেগম থমকালেন। ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন,
“কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
“সবিতাদের বাড়িতে। তোমরা তো যাবেনা বললে!”
নাক সিটকে নাজনীন বেগম বললেন,
“না! এই দাওয়াত আমি রাখিনি!”
প্রসঙ্গ পাল্টে রূপল বলল,
“পিয়াসাকে নিয়ে যেন কী বলছিলে?”
“ওখান থেকে আগে ফিরে আয়। এরপর বলছি।”
রূপলের সামনে থেকে সরে দাড়ালেন নাজনীন বেগম। রূপলও বিষয়টাকে নিয়ে আর তেমন জল ঘোলা করলোনা। সবিতার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রূপল সবিতাদের বাড়িতে এসে পৌঁছে গেল। বাইকটা বাড়ির এক পাশে পার্ক করে সে সবিতাদের অর্ধভেজা সদর দরজা পেরিয়ে ড্রইং রুমে প্রবেশ করল। অমনি কারো মাথার সাথে তার মাথার সংঘর্ষ ঘটল! চমকে ওঠে রূপল কপাল ঘঁষে অগ্রে দৃষ্টি ফেলতেই দেখল নীহারিকা তার সামনে দাড়িয়ে! কপাল ঘঁষতে ঘঁষতে নীহারিকা ব্যথায় নাকমুখ কুঁচকে বলল,
“এই আপনি কী দেখেশুনে চলতে পারেন না? হুটহাট কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেন?”
মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল রূপলের! কোথায় সে নীহারিকাকে ঝাড়ি মারবে উল্টো নীহারিকা এসে তাকে ঝাড়ি মারল? রগচটা হয়ে রূপল বলল,
“ও হ্যালো। আমি হুটহাট এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসিনি। বরং আপনিই এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন! আপনার এখানে কী হ্যাঁ?”
ব্যথা ভুলে গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে নীহারিকা বলল,
“আমার এখানে কী মানে? আমি এখানকার গেস্ট! ইনভাইট করে আনা হয়েছে আমাকে। বিশ্বাস না হলে সবিতা আপুকে জিজ্ঞেস করুন।”
চুল উড়িয়ে বেশ ভাবসাব নিয়ে নীহারিকা রূপলের সামনে থেকে প্রস্থান নিলো! সেই উড়ন্ত চুল এসে রূপলের নাকেমুখে লাগল। অমনি রূপলের মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেল! দাঁতে দাঁত চেপে রূপল পেছন থেকে নীহারিকাকে ডেকে বলল,
“এই খবরদার। পরের বার থেকে আপনার চুল যেন আমার মুখে এসে না পরে! এসব আমার পছন্দ নয়৷ চুল ঠিক কেটে রেখে দিব!”
পিছু ফিরে তাকালো নীহারিকা৷ অট্ট হাসল সে। আদেখ্যাতা মেশানো স্বরে বলল,
“আহারে সোনা গো আমার! শখ দেখছি কম না আপনার। আমার চুল আমি যখন ইচ্ছা তখন উড়াব! কার চোখেমুখে গিয়ে আমার চুল পরল এসব আমার দেখার বিষয় নয়। প্রয়োজনে আপনি সর্তক থাকবেন, কোনো মেয়ের চুল যেন আপনার চোখেমুখে না পরে। আমি কেন সর্তক হব? আইছে আমার সাথে মেজাজ দেখাতে!”
রূপলকে রাগিয়ে দিয়ে নীহারিকা রান্নাঘরে ঢুকে গেল। খিলখিলিয়ে হেসে উঠল সে। রূপলকে অহেতুক রাগাতে ইদানিং তার ভালোই লাগছে! পুরুষ মানুষ রাগলে তাদের রাগাতে আরও ভালো লাগে। আসার পর থেকেই নীহারিকা নানানভাবে সবিতাকে সাহায্য করছে। সালাদ কাটা থেকে শুরু করে খাবার সাজানো সব নীহারিকা একাই সামলাচ্ছে। একা হাতে সব রান্নাবান্না করে সবিতা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাই এখন সে রুমে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। খেয়েদেয়ে হৃদি ঘুমুচ্ছে। খাওয়ার পরই হৃদিকে ঘুমাতে হয়। তখন অটোমেটিকলি তার ঘুম চলে আসে।
রাগে ফুলে ফেঁপে ওঠে রূপল ডাইনিং টেবিলে চেয়ার টেনে বসতেই হুজুরদের আগমন ঘটল। হুজুরদের গলার শব্দ পেয়ে সবিতা শোয়া থেকে ওঠে এলো। সোজা রান্নাঘরে চলে গেল। নীহারিকা এবং সবিতা মাথায় বড়ো এক ঘোমটা টানল। খাবারগুলো এখনও ডাইনিং টেবিলে সাজানো হয়নি। তবে বড়ো বড়ো বোলে, পেয়ালায় সাজানো হয়ে গেছে। হুজুরদের সামনে তো তারা এখন যেতে পারবেনা। তাই নীহারিকা এক প্রকার ছুটে এসে রপলকে বলল,
“এখানে বসে কী করছেন হ্যাঁ? আমাদের হেল্প করুন। খাবারগুলো এখনও ডাইনিং টেবিলে সাজানো হয়নি। হুজুরদের সামনে তো আমরা আসতে পারবনা। খাবারগুলো আপনি সাজিয়ে দিন। আসুন।”
ফটাফট রূপল বসা থেকে ওঠে দাড়ালো। ধমকের স্বরে নীহারিকাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমাকে রাগিয়ে দিয়ে এখন খুব কাজ দেখানো হচ্ছে না?”
এই মুহূর্তে হুজুররাও ড্রইংরুমে চলে এলেন। তাই নীহারিকা আর কথা বাড়াল না। একছুটে সে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। চারজন হুজুরদের মধ্যে হঠাৎ একজন হুজুর শান্ত গলায় রূপলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“আহ্ বাবা। বউয়ের সাথে এভাবে খারাপ ব্যবহার করতে নেই! তাদের সাথে ঠাণ্ডা মাথায় নম্রভাবে ব্যবহার করতে হয়। জানো না তুমি?”
হতবাক হয়ে রূপল হুজুরের দিকে তাকালো! মাথায় বাজ পড়ার মত অনুভূতি হলো তার। কীসব উদ্ভব কথা বলছে হুজুর! জোরপূর্বক হেসে সে নমনীয় গলায় হুজুরকে বলল,
“না মানে হুজুর। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমরা স্বামী-স্ত্রী নই!”
রূপলের কথাকে আমলে নিলেন না হুজুর। তিনি বরং উল্টো রূপলের কাঁধে হাত রেখে রূপলকে বুঝিয়ে বললেন,
“বুঝলে তো বাবা। এখনকার যুগের ছেলেমেয়েদের দেখি পান থেকে চুন খসলেই একে অপরকে অস্বীকার করে বসে! এসব আবার কেমন কথা বলো বাবা? আচ্ছা, আমরা আগে মিলাদটা পড়ে নিই। এরপর এই বিষয়ে কথা বলছি। অনেক ফতুয়া আছে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নিয়ে। সব তোমাকে বুঝিয়ে বলব!”
রূপলকে হতভম্ব বানিয়ে হুজুর মিলাদ পড়ানো শুরু করলেন। এইদিকে একদম-ই মন নেই রূপলের। তার মাথায় শুধু ঘুরছে হুজুরের বলা ঐসব মনগড়া কথা। রাগে গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে তার! ঐ ঝগড়ুটে মেয়েটা নাকী হবে তার বউ? ইম্পসিবল! এসব আস্তাগফিরুল্লাহ্ চিন্তাভাবনা যেন তার দুঃস্বপ্নেও না আসে!
মোনাজাতে সুহাসিনী এবং সাফোয়ানের রুহের মাগফেরাত চেয়ে মিলাদ শেষ করলেন হুজুর। তাদের জন্য দোয়া চেয়ে অঝরে কেঁদে ভাসালো সবিতা! রূপল মন থেকে সুহাসিনীর জন্য দোয়া করলেও তার জন্য কষ্ট বা কান্না কোনোটাই পেলনা তার! শুধু মোনাজাতে চাইল আল্লাহ্ যেন তাকে অতীত থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে! সুহাসিনীর মায়া কাটিয়ে খুব দ্রুত যেন সে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে।
____________________________________
হাতে মোটা রট নিয়ে চেয়ারের পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে রূপল! গোটা শরীর তার রাগে রি রি করছে। তার সামনেই বড়ো খাম্বার সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে ফারহানকে! এই সেই ফারহান আজ সকালেই যে ফারহানকে নীহারিকা বুদ্ধি খাটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিল! দিশার সাথে রুম ডেট করতে যাওয়া ছেলেটিই ফারহান। দিশা এবং সানি ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল আজ সকালে হওয়া সব ষড়যন্ত্রের পেছনে পরোক্ষভাবে নীহারিকাই জড়িত ছিল! নীহারিকার কাজে সানি বেশ খুশি হলেও দিশা রাগে টগবগ করছিল। পুলিশের কাছ থেকে মোটা অঙের টাকা জরিমানা দিয়ে ছাড়া পাওয়ার পর দিশার মাথা নষ্ট হয়েছিল। কীভাবে সে নীহারিকার থেকে শোধ নিবে তার জন্য হাসফাস করছিল। কোনো প্রকার উপায় বুদ্ধি না পেয়ে ফারহানকে উস্কালো সে নীহারিকার বিরুদ্ধে! তাই এই ভর সন্ধ্যায় পুলিশ হাজত থেকে ছাড়া পেয়েই ফারহান তার দলবল নিয়ে ছুটে এসেছিল নীহারিকার বাড়িতে নীহারিকাকে হুমকি দিতে! তার ক্ষতি করতে। কিন্তু তা আর সম্ভব হলোনা। নীহারিকার ক্ষতি করতে এসে ফারহান নিজেই তার পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলল!
ফারহান তার দলবল নিয়ে যখন নীহারিকাদের বাড়িতে এলো তখনই রূপল নীহারিকাকে তার বাড়িতে ড্রপ করার জন্য এসেছিল! প্রথমে রূপল বাড়ির ভেতরকার ব্যাপার স্যাপার কিছুই বুঝতে পারলনা। নীহারিকাকে বাড়ির গেইটের সামনে ড্রপ করে সে সোজা চলে গিয়েছিল। বাড়ির ভেতরে নীহারিকা ঢুকেই দেখতে পেল তার বাড়ির ড্রইংরুমে ফারহানসহ তিনটি ছেলে সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে! তার মা মারজিনা বেগম তাদের সামনেই দাড়িয়ে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে! তারা নানাভাবে হুমকি দিচ্ছিল মারজিনা বেগমকে। এই দৃশ্য দেখেই ফট করে নীহারিকার মাথা গরম হয়ে গেল। তবে এর আগে সে ছোট্টো একটি কাজ করল। রূপলের নাম্বারে ছোটো করে একটি মেসেজ দিয়ে সে ছুটে এসে সে তার মায়ের পাশে দাড়ালো! ফারহান এবং তার দলের ছেলেফেলেদের উদ্দেশ্য করে সে চ্যাচিয়ে বলল,
“কী হচ্ছেটা কী এখানে? আপনারা আমার বাড়িতে কী করছেন?”
অমনি ফারহান নীহারিকার দিকে তাকিয়ে অট্ট হাসল! নীহারিকার দিকে সে কিছুক্ষণ বিশ্রী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। আচমকা নীহারিকাকে সে কটাক্ষ করে বলল,
“কালো মেয়ের তেজ দেখো! রূপ দেখে নয় বরং তেজ দেখেই ছেলেরা তোকে ছেঁকে দেখবে!”
“কু’ত্তা’র বাচ্চা! এত বড়ো সাহস তোর? কী বললি তুই?”
বলেই নীহারিকা টি-টেবিলের উপর রাখা ফুলদানিটি হাতে নিলো! সেকেণ্ডের মধ্যেই সে মেজাজ হারিয়ে ফুলদানিটি ফারহানকে কপালে নিক্ষেপ করল! অমনি ফারহানের কপাল কেটে গড়গড়িয়ে র’ক্ত ঝরতে লাগল। নীহারিকার দুঃসাহস দেখে মারজিনা বেগম হতভম্ব হয়ে গেলেন। নীহারিকার গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলেন তিনি! তটস্থ গলায় বললেন,
“এটা তুই কী করলি?”
গালে হাত দিয়ে নীহারিকা আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে তাকালো। বিশ্বাসই হলোনা তার মা তার গালে চ’ড় মারল! ঐদিকে ব্যথায় কুকিয়ে ওঠে ফারহান তার ছেলেফেলেদের বলল,
“মেয়েটাকে ধর।”
গুণ্ডা গুলো ছুটে এসে নীহারিকাকে ধরার আগেই রূপল উপস্থিত হয়ে গেল! রূপলকে দেখামাত্রই সাথের ছেলেরা লেজ গুটিয়ে পালালো! রূপলের সাথে মা’রা’মারি করার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে তাদের। তাই খাল থেকে কুমির আনার মত পাপ কাজ করতে চাইলনা তারা।
#চলবে…?