ফেরারি প্রেম পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
323

#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_২৮
#নিশাত_জাহান_নিশি

গু’ন্ডা গুলো ছুটে এসে নীহারিকাকে ধরার পূর্বেই রূপল উপস্থিত হয়ে গেল! রূপলকে দেখামাত্রই ছেলেগুলো লেজ গুটিয়ে পালালো! রূপলের সাথে মা’রা’মারি করার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে তাদের! তাই খাল থেকে কুমির আনার মত পাপ কাজ করতে চাইলনা তারা।

মাথার কাঁটা অংশে হাত রেখে ফারহান হতভম্ব হয়ে একই জায়গায় বসে রইল। তার সাথের দলবল পালিয়ে যাওয়ার পর তার শক্তি অনেকাংশেই কমে এলো! তবুও যেন হিম্মত হারালো না সে! বুকে সাহস রেখে একরোখা ভাব নিয়ে একই জায়গায় শক্ত হয়ে বসে রইল। রূপলের দিকে হিংস্র দৃষ্টি তার। চাহনিতেই লুকিয়ে আছে রূপলের শেষদিন! সুযোগ পেলে যেন এখনই সে রূপলকে আস্ত চিবিয়ে খাবে! ফারহানের এই আক্রমনাত্নক প্রতিক্রিয়া দেখে রূপল ধীর গতিতে হেঁটে এলো ফারহানের দিকে। গাঁ ছাড়া ভাব তার। যেন কোনো দিকেই কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার! সামনের মানুষটিকে গোনবারও সময় নেই। নিতান্ত প্রয়োজনের খাতিরেই সামনের মানুষটির মুখোমুখি হতে হলো তার।

ফারহানের সোজাসুজি টি-টেবিলের উপর ধপ করে চড়ে বসল রূপল। পাখার বাতাসেও তার শরীর থেকে গরম ভাপ উঠছিল। তাই সে অস্থির ভাব নিয়ে শার্টের কলারটা দুই দিকে ছড়িয়ে দিলো। সেই সুযোগে ফারহান ধপ করে রূপলের শার্টের কলার চেপে ধরল! চোঁয়াল উঁচিয়ে বলল,

“এই কে তুই? আমার সাথে দাদাগিরি করতে এসেছিস? চিনিস আমি কে?”

গাঁয়ে হাত উঠার পরেও ভাবশূণ্য রূপল! তার শার্টের কলার থেকে চোখ উঠিয়ে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফারহানের দিকে দৃষ্টিপাত করল। চাহনিই যেন বলে দিচ্ছে ফারহানের অধ্যায় আজ এখানেই শেষ! টনক নড়ল এতক্ষণে ফারহানের! রূপলের তেজস্ক্রিয় মুখের পানে তাকিয়ে সে বাধ্য হলো শুকনো ঢোঁক গিলতে। পটাপট রূপলের শার্টের কলারটা ছেড়ে দিলো সে। আপাতত তার মধ্যে ভীতসন্ত্রস্তা কাজ করলেও সে গলা উঁচিয়ে বলল,

“কী ভেবেছিস আমি তোকে ভয় পাই?”

“না। আমার ঘাড়কে ভয় পাস!”

বলেই রূপল শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ফারহানের গালে জোরে এক চড় বসিয়ে দিলো! সঙ্গে সঙ্গেই ফারহানের কানে বিকট এক শব্দ হলো। মনে হলো কানের পর্দা তার ফাটল বলে! পুরো দুনিয়া তার ফট করে ঘুরে এলো। এই দৃশ্য দেখে মারজিনা বেগম মরিয়া হয়ে উঠলেন। চিন্তিত হয়ে তিনি রূপলকে পেছন থেকে ডাকলেন। করুন সুরে বলল,

“বাবা ছেড়ে দাওনা। আমার বাড়িতে আমি কোনো দাঙাদাঙি হোক চাইনা। তাছাড়া তুমিই বা এই সময়ে এখানে এলে কী করে? তুমিতো বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গিয়েছিলে তাইনা?”

অমনি পাশ থেকে গালে হাত দিয়ে গম্ভীর ভাব নিয়ে দাড়িয়ে থাকা নীহারিকা তার মায়ের মুখের কথা টেনে নিলো। প্রত্যত্তুরে বলল,

“আমিই উনাকে আসতে বলেছি!”

নীহারিকার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চাপলেন মারজিনা বেগম! ছোটো আওয়াজে তিনি নীহারিকাকে শাসিয়ে বলল,

“খুব সাহস বেড়েছে তোর তাইনা? ছেলেটাকেও এই ঝামেলার মধ্যে টেনে আনলি? দাড়া ঝামেলাটা মিটুক তোর সাহস আমি বের করছি।”

ইতোমধ্যেই ফট করে রূপল ফারহানের শার্টের কলার চেপে ফারহানকে নিয়ে বাড়ির ড্রইংরুম থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালো। বিক্ষুব্ধ হয়ে সে ঝাঁজালো গলায় মারজিনা বেগমকে বলল,

“আমাকে থামতে বলবেন না আন্টি। তার এত বড়ো সাহস কী করে হয়? বাড়ি বয়ে এসে হুমকি দেওয়ার? তাও আবার সাথে করে গুন্ডা পান্ডা নিয়ে। এখন যদি নীহারিকা বুদ্ধি করে আমাকে খবরটা না জানাত তাহলে আপনাদের সাথে কী কী ঘটতে পারত আপনাদের কোনো ধারণা আছে?”

বিপরীতে কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিলোনা রূপল। একগুঁয়ে ভাব নিয়ে সে আ’হ’ত ফারহানকে টানতে টানতে বাড়ির গেইটের বাহিরে নিয়ে এলো! বাড়ির ভেতর থেকে দঁড়ি এনে বাড়ির গেইটের বাইরে থাকা বড়ো খাম্বাটির সাথে বেঁধে দিলো! মুহূর্তেই ঘটনাস্থলে এলাকা শুদ্ধ লোক জড় হয়ে গেল। সবার মধ্যে কৌতূহল, উদ্দীপনা এবং আতঙ্ক কাজ করতে লাগল। রূপলের এই ভয়ানক রূপের সাথে এলাকাবাসী সবাই পরিচিত। আর কোনো কারণ ছাড়া যে রূপল কাউকে এভাবে ধরে বেঁধে পিটায়না তাও তাদের জানা!

রূপল বেশ ভাবসাব নিয়ে ফারহানের মুখোমুখি চেয়ার পেতে বসল। পায়ের উপর পা তুলে সে হাঁপাতে থাকা ফারহানের দিকে ভ্রু দুটি উঁচিয়ে তাকালো। থুতনিতে আঙুল ঠেকিয়ে সে প্রশ্ন ছুড়ল,

“তো এবার বল? এলাকাবাসী সবার সামনে বল যে, তুই কেন কী কারণে মিস নীহারকাদের বাড়িতে এসেছিল তাকে হুমকি দিতে? সবারই তো বিষয়টা জানার অধিকার আছে তাইনা?”

রূপলের ভয়ে অনবরত কাঁপতে লাগল ফারহান। বিশেষ করে রূপলের হাতে মোটা রট দেখে! একটু নত না হলে আজ-ই হয়ত তার প্রাণটা যাবে! অন্যের এলাকায় এসে যে নিজের দাপট চলেনা তা সে বিষয়ে তার বেশ ভালোভাবেই জ্ঞান আছে। বুদ্ধি খাটিয়ে ফারহান এবার বিনয়ী ভাব নিলো। কাতর গলায় রূপলকে বলল,

“ভাই আমার ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দিন! আর কখনও কোনোদিনও আপনার এলাকায় পা রাখব না আমি।”

“ওকে। তা না হয় রাখবিনা। কিন্তু নিজের কুকীর্তি গুলো তো সবার কাছে স্বীকার কর! কী কারণে আজ তোকে এখানে বেঁধে রাখা হলো খোলসা করে সব বল?”

ফারহানের স্বীকারোক্তি ভিডিও করতে চাইছিল রূপল! ভেবেছিল এসব দুষ্কৃতকারীদের অপকর্ম গুলো নেট দুনিয়ায় ছেড়ে দিলে মানুষ অনেককিছু শিখতে পারবে, জানতে পারবে। সঙ্গে এসব নোংরা মনমানসিকতার পুরুষ মানুষদেরও চিনতে পারবে। কিন্তু তা আর হলোনা! স্বয়ং নীহারিকা এসে রূপলের হাত থেকে ফোনটি কেড়ে নিলো! রূঢ় গলায় সে রূপলকে বলল,

“ছেলেটির বাঁধনটা খুলে দিন!”

জায়গা থেকে দাড়িয়ে পড়ল রূপল! নীহারিকার দিকে সূচালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ধমকের স্বরে বলল,

“হোয়াট?”

“বাঁধনটা ছেড়ে দিতে বলছি। ছেড়ে দিন। তাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে আসুন।”

বলেই নীহারিকা মাথা নুইয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। নীহারিকার সিদ্ধান্ত বা তার কথার ভিত্তি কিছুই বুঝতে পারলনা রূপল। মেয়ে মানুষের মাথায় কখন কী চলে বুঝাই যায়না! দেরি হচ্ছিল দেখে নীহারিকা আবারও গেইটের বাহিরে উঁকি দিলো। রূপলকে তাড়া দিয়ে বলল,

“প্লিজ তাকে নিয়ে ভেতরে আসুন।”

রাগে গজগজ করে রূপল বাধ্য হলো ফারহানের বাঁধন খুলে দিতে। পুনরায় ফারহানের শার্টের কলার টানতে টানতে রূপল ফারহানকে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। বাড়ির গেটটাও ভেতর থেকে লাগিয়ে দিলো! গেটের বাইরে অবস্থানরত মানুষজন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কোনো সমস্যার সমাধান না করেই তারা অপরাধীকে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল? এ আবার কেমন সিদ্ধান্ত তাদের?

ফারহানকে নিয়ে বাড়ির ড্রইংরুমে ঢুকেই রূপল রাগী দৃষ্টিতে নীহারিকার দিকে তাকালো। বেশ চোট পাট করে নীহারিকাকে বলল,

“হোয়াটস ইউর প্রবলেম হুম? কী করতে চাইছেনটা কী আপনি?”

বিপরীতে অস্থির হয়ে নীহারিকা রূপলকে বুঝানোর স্বার্থে বলল,

“দেখুন। এলাকার অনেকেই দিশাকে চিনে। বিশেষ করে দিশার অনেক রিলেটিভ এই এলাকায় থাকে।”

“হ্যাঁ তো? তাতে আমার বা আপনার কী?”

“কারণ, আমি চাইনা আমাদের এলাকায় দিশার কোনো বদনাম হোক! সমস্যাটা দিশার সাথে আমার। সেটা আমাদের মধ্যেই রাখতে চাই।”

“এতকিছু ভাবলে তাকে পুলিশে দিলেন কেন? তখন কী লোক জানাজানি হয়নি?”

“তখন যা হয়েছে তা দুই এলাকার বাইরে হয়েছে! এলাকার ভেতরে কিছু হয়নি। তারা ব্যক্তিগতভাবে হোক বা পারিবারিকভাবে হোক বিষয়টা সামলে নিয়েছে। কিন্তু এখন বিষয়টা পাবলিসিটি হয়ে যাচ্ছে! বিশেষ করে আপনার ভিডিও করাটা। দিশার অপকর্ম নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ুক আমি চাইনা! আমাদের বাইরে অপরিচিত দু-একটা মানুষ তাকে খারাপ ভাবুক আমি চাইনা। তার থেকে যা শোধ নেওয়ার ছিল আমার নেওয়া হয়ে গেছে! আমার কাছে তার পরিবারের কাছে এমনকি সানির কাছেও সে আজীবন দোষী হয়ে থাকবে এই আমার জন্য অনেক।”

অবাক হলো রূপল। বিস্মিত গলায় বলল,

“আশ্চর্য আপনার লজিক। তাহলে ছেলেটা যে বাড়ি বয়ে এলো আপনাকে থ্রেড দিতে তার কী হবে?”

“তার শাস্তি তো সে পেয়েই গেছে! মাথা ফাটিয়ে দিয়েছি না তার? সঙ্গে আপনার শক্ত হাতের গরম গরম চড়!”

ফারহানও এবার নিস্তেজ ভাব নিলো। বিদীর্ণ গলায় নীহারিকার কথায় সায় জানিয়ে রূপলকে বলল,

“হ্যাঁ ভাই। আমার শাস্তি হয়ে গেছে! আর কখনও এই এলাকায় পা রাখবনা।”

ফারহানের কথায় নীহারিকা দাঁত কেলিয়ে হাসল! ইতোমধ্যেই মারজিনা বেগম ট্রে-তে করে লেবুর শরবত নিয়ে এলেন! ট্রে থেকে শরবতের গ্লাসগুলো হাতে নিয়ে নীহারিকা শুষ্ক হেসে একটি গ্লাস রূপের দিকে এবং অন্য একটি গ্লাস ফারহানের দিকে এগিয়ে দিলো। বলল,

“নিন ঠাণ্ডা হোন।”

সামনে ভেতর ঠাণ্ডা হওয়ার মত শরবত দেখে ফারহান ঝট করে রূপলের হাত থেকে তার শার্টের কলারটা ছাড়িয়ে নিলো! রূপল এবং নীহারিকাকে একদফা অবাক করে দিয়ে সে নীহারিকার হাত থেকে ছোঁ মেরে শরবতের গ্লাসটি ছিনিয়ে নিলো! গড়গড় করে সে গ্লাসভর্তি শরবত গিলে নিলো। শরবত খাওয়া শেষ হতেই ফারহান মুখ মুছে শরবতের গ্লাসটি নীহারিকার দিকে এগিয়ে দিলো। নীহারিকার দিকে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ব্যস্ত গলায় বলল,

“ওকে। তাহলে আমি আসছি! বায়।”

যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ফারহান পিছু ঘুরতেই নীহারিকা ধুম করে পেছন থেকে ফারহানের শার্টের কলার চেপে ধরল! দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“এই কোথায় যাচ্ছিস তুই? তোর ক্লাস নেওয়া তো এখনও আমার বাকী! আমাকে কালো বলা না? কটুক্তি করা আমাকে নিয়ে? দাড়া দেখাচ্ছি মজা।”

বলেই নীহারিকা তার ফোনটা তাজ্জব হয়ে দাড়িয়ে থাকা রূপলের হাতে তুলে দিলো। বিরামহীন গলায় রূপলকে বলল,

“আমি তাকে ক্যালাব। আর আপনি তার ভিডিও করবেন!”

মেজাজ বিগড়ে গেল রূপলের! এই মেয়ে কী আসলে পাগল? এতক্ষণ তো রূপল ভিডিও করছিল বলে তাকে জ্ঞানের কথা শুনাচ্ছিল! এখন দেখি সে নিজেই বলছে ভিডিও করার কথা। হতভম্ব হয়ে রূপল মাথা চাপরে বলল,

“হেই। কিন্তু কেন?”

“কারণ তাকে ক্যালানোর ভিডিটাও আমি দিশাকে সেন্ড করব! আমার পাওয়ার সম্পর্কে তার ধারণা থাকতে হবেনা? আমি যে একাই তার ভাড়া করা পাতি গুন্ডাকে ক্যালাতে পারি, তা তো তার জানতে হবে।”

রূপল আছে সেই সাহস পেয়ে নীহারিকা ভয়ে কাতর এবং দুর্বল হয়ে থাকা ফারহানকে এলোপাতাড়ি চড়, থাপ্পর, ঘুঁষি মারতে লাগল! জায়গায় দাড়িয়ে রইল ফারহান! নরম হাতের মার খেতে লাগল সে! হতবাক দৃষ্টিতে সে নীহারিকার দিকে তাকিয়ে রইল। নিশ্চল গলায় বলল,

“এটা আবার কেমন ট্রিকস বইন? শরবত খাইয়ে ঠাণ্ডা করে এখন আবার ধপাধপ ক্যালানো হচ্ছে? এসব হচ্ছেটা কী? আমাকে দেখতে কী পাগল মনে হয়?”

ফারহানের কথা শুনে ভিডিও করা অবস্থাতেই ফিক করে হেসে দিলো রূপল!

#চলবে….?

#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_২৯
#নিশাত_জাহান_নিশি

ফারহানের কথা শুনে ভিডিও করা অবস্থাতেই ফিক করে হেসে দিলো রূপল! হাসি চেপে রাখা তার মত ভাবওয়ালা পুরুষের কাছে দুঃসাধ্য হয়ে দাড়িয়েছিল! নীহারিকা পারেও বটে। পরিস্থিতি শান্ত করে আবার তা বিগড়েও দিলো? নিজের উপর করা কটুক্তির শোধও নিলো, জনসম্মুখে বান্ধবীর মানসম্মানও রক্ষা হলো, লোকজন না হাসিয়ে বরং ভদ্রভাবে বান্ধবী এবং তার প্রেমিককে উচিৎ শিক্ষাও দিলো, এমনকি ফ্রিতে সবাইকে বিনোদনের ব্যবস্থাও করে দিলো! রূপলকে হাসার একটা সুযোগও করে দিলো।

ফারহানের বর্তমান অবস্থা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে লাঞ্চিত, গঞ্চিত এবং অসহায় পুরুষের ন্যায়। তার নিষ্পাপ মুখখানির দিকে একবার তাকালো রূপল। ফারহানের জায়গায় নিজেকে প্রতিস্থাপন করল! আদো সুরে বলল,

“ছেড়ে দে মা। কেঁদে বাঁচি!”

ফারহানকে ক্যালাতে ক্যালাতে নীহারিকা প্রায় ক্লান্ত হয়ে এলো! মেয়ে মানুষের হাতে মারধর খেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে দাড়িয়ে রইল ফারহান। মুখমণ্ডল থেকে তার অঝরে ঘাম ঝরছে। চোহারাটা নেতিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে। লজ্জায় মুখ লুকাবার জায়গা খুঁজে পাচ্ছেনা! ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেতে সে ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলতে থাকা নীহারিকার দিকে অবুঝ দৃষ্টিতে তাকালো! ধরাশায়ী গলায় বলল,

“তোমার ক্যালানো শেষ হইছে বইন? যদি তুমি অনুমতি দাও তাহলে কী আমি এবার আসতে পারি?”

অমনি নীহারিকা গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ফারহানের দিকে। বেগতিক রগচটা ভাব নিয়ে সে অবিশ্বাস্যভাবে ফারহানের গলার টুটি চেপে ধরল! চোয়াল উঁচিয়ে বলল,

“আরে দাড়া দাড়া। এত তাড়াহুড়ো করছিস কেন? প্রয়োজনে আরও এক গ্লাস শরবত খাইয়ে তোকে ক্যালাব! শরবতের উপর আর কোনো ঔষধ আছে না-কী?”

ফারহান এবার বাধ্য হলো নীহারিকার আগে হাত জোর করতে! নিজের মধ্যে রইলনা সে। অনুনয়-বিনয়, কাকুতি-মিনতি করে সে বলল,

“না মা না! আমি আর শরবত খাবনা প্লিজ! আজ থেকে শরবত আমার রুচি থেকে ওঠে গেল। সত্যিই শরবতের উপর আর কোনো ঔষধ নাই! আজীবন আমার এই উক্তিটি মনে থাকবে! শেষে কী-না একটা মেয়ের হাতে….ছিঃ ছিঃ ছিঃ।”

ফারহানের জীর্ণ শীর্ণ এবং বেদনাতুর মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া জন্ম নিলো নীহারিকার! ফারহানের শার্টের কলারটা ছেড়ে সে নিজের অশান্ত চিত্তকে শান্ত করল। বড়ো বড়ো কয়েক দফা শ্বাস ফেলে ফারহানকে বুঝানোর জন্য স্থির গলায় বলল,

“রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখলেই শুধু তাদের নিয়ে কু-মন্তব্য করতে হবে কেন? তাদের গাঁয়ের রঙ নিয়ে বিদ্রুপ করা, হাসি ঠাট্টা করা লাগবে কেন? গাঁয়ের রঙ কালো বলে কী আমরা মানুষ নই? আমাদের কী কোনো মূল্য নেই? সাদা কালোর বিবেধ তৈরী করে তোরা নিজেরাই নিজেদের পাপী সাবস্ত করছিস! স্বয়ং উপর ওয়ালার ইচ্ছেকে নিয়ে তোরা হাসি ঠাট্টা করছিস। উপর ওয়ালা ভালো বুঝেছেন বলেই তো আমাদের গাঁয়ের রঙ কালো করে আমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আমরা আল্লাহ্’র তৈরী সামান্য মানুষ হয়ে পারিনা আল্লাহ্’র খুশি, ইচ্ছে, অনিচ্ছাকে নিয়ে বিদ্রুপ করতে!”

ধীর হয়ে দাড়ালো ফারহান। নীহারিকার দিকে নিশ্চল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। পরক্ষণেই মাথাটা নুইয়ে সে নিজের অপরাধ স্বীকার করল! ক্ষীণ গলায় বলল,

“আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি বোন। সন্ধ্যা থেকে যা কিছু ঘটল এই সবকিছুর জন্য আমি সত্যিই মন থেকে অনুশোচিত! এই শিক্ষা পাওয়াটা আমার জরুরি ছিল। তোমার কথাগুলো আমি মাথায় রাখব।”

মুহূর্তেই ফারহানের মুখের কথা টেনে নিলো রূপল। ফোনের ভিডিওটা অফ করল সে। ভ্রু যুগল কুচকে তীক্ষ্ণ গলায় ফারহানকে শুধালো,

“কথাগুলো পরে যদি মনে না থাকে তো? তখন তোকে ঠিক কী শাস্তি দেওয়া উচিৎ? নিজের মুখেই বলে যা।”

“কেন ভাই? শরবতের উপর তো আর কোনো ঔষধ নাই!”

বলেই ফারহান আর এক সেকেন্ডও জায়গায় দাড়ালো না! মানে মানে করে সে ছোঁ মেরে জায়গা থেকে দৌঁড়ে পালালো! একটিবারের জন্যও আর পিছু ফিরে তাকালো না। ফারহানের যাওয়ার পথে তাকিয়ে নীহারিকা খিলখিলিয়ে হেসে দিলো! হাসতে হাসতে সে ধপ করে সোফার উপর বসে গেল। হাসি যথেষ্ট চেপে রাখল রূপল। এমন হাস্যকর পরিস্থিতির মধ্যে সে জীবনে একবারই পড়ল! তবুও নিজের ভাব বজায় রেখে রূপল অন্য দিকে তাকিয়ে নীহারিকার দিকে ফোনটি এগিয়ে দিলো। ভাবশূণ্য গলায় বলল,

“নিন আপনার ফোন।”

হাসতে হাসতে নীহারিকা রূপলের হাত থেকে ফোনটি হাত বাড়িয়ে নিলো। প্রশ্ন ছুড়ল,

“ভিডিওটা ঠিকঠাকভাবে করেছেন তো?”

“চেইক করে নিন।”

নীহারিকা ফোনে মনোসংযোগ দিতেই রূপল হনহনিয়ে জায়গা থেকে প্রস্থান নেওয়ার জন্য সদর দরজার দিকে পা বাড়ালো। অমনি নীহারিকা পেছন থেকে অধীর গলায় রূপলকে ডাকল। বসা থেকে দাড়িয়ে ওঠে বলল,

“আরে আরে কোথায় যাচ্ছেন আপনি? শরবতটা তো খেয়ে যান।”

পিছু ফিরে তাকালো রূপল। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে টি- টেবিলের উপরে রাখা শরবতের গ্লাসটির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। পরক্ষণেই আবার নীহারিকার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় শুধালো,

“আমাকে কী ফারহান ভেবেছেন? যে শরবতের লোভ দেখিয়ে আমার সাথেও যা ইচ্ছা তা করতে পারবেন? তার মত পাগল আমি?”

“আপনাকে ক্যালাতে পারলে তো হতই! সুহাসিনীর ভূত আপনার মাথা থেকে নামিয়ে দেওয়া যেত।”

মিনমিনিয়ে কথাগুলো বলেই নীহারিকা রূপলের অগোচরে রূপলকে ভেংচি কাটল! রূপল তার কথা শুনল কী-না সেদিকেও আবার নজর রাখল। তড়তড়িয়ে জায়গা থেকে ওঠে সে হেঁটে গেল রূপলের কাছে। রূপলের মুখোমুখি দাড়িয়ে কোমরে হাত গুজে ঝগড়ুটে ভাব নিলো। খরখরে গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“আমি আপনার সাথে যা ইচ্ছা তা করব মানে? আমি কী কখনও আপনার সাথে খারাপ কিছু করেছি?”

“করতে কতক্ষণ? মাথার মধ্যে তো নাটকের ভূত চেপেছে! বেয়াই-বেয়াইনের প্রেম! আমি কিন্তু কিছুতেই এসবে পাত্তা দিচ্ছিনা। মাইন্ড ইট ওকে?”

ডান হাতের মধ্যমা আঙুল দ্বারা রূপল নীহারিকার কপালের মাঝ বরাবর একটি খোঁচা মারল! নীহারিকাকে হাত দ্বারা ইশারা করে বলল,

“দূরে দূরে থাকবেন ওকে?”

শো শো বেগে রূপল নীহারিকার সামনে থেকে প্রস্থান নিলো। নীহারিকা হতভম্ব হয়ে রূপলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। নাক ফুলিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে বলল,

“তোর কাছে যেতে আমার বয়ে গেছে। একটু সুদর্শণ হয়েছে বলে আমার মাথা কিনে নিয়েছে! ভাগ্য ভালো হলে তোর থেকে সুদর্শণ পুরুষ-ও আমার বর হতে পারে! তখন তুই এই হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরবি! বদরাগী ভীমরুল কোথাকার।”

ইতোমধ্যেই বাড়ির সদর দরজা খোলা পেয়ে দুজন অপরিচিত মহিলা নীহারিকাদের বাড়িতে ড্রইংরুমে ঢুকে গেল! দুজনই অপরিচিত বিষয়টা এমন নয়। দুজনের মধ্যে একজনকে নীহারিকা অল্প সল্প চিনে। সামনের গলিতেই তাদের বাসা। তাই আসা যাওয়ার রাস্তায় একটু আধটু দেখা হয় মহিলাটির সাথে। তবে কখনও তেমন কথা হয়নি। হঠাৎ তাদেরকে দেখে নীহারিকা খানিক অপ্রস্তুত হয়ে গেল! দুজন মহিলা-ই নীহারিকার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। বিনিময়ে নীহারিকাও জোরপূর্বক হাসল। ভদ্রতার খাতিরে নীহারিকা দুজনকেই ভেতরে এসে বসতে বলল। পরিচিত মহিলাটিকে সে নম্র সুরে বলল,

“ভালো আছেন আন্টি?”

মহিলাটিও বেশ বিনয়ের সুরে নীহারিকাকে বলল,

“ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছ?”

“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। নিশ্চয়ই আপনারা আমার আম্মুর কাছে এসেছেন? আচ্ছা আপনারা একটু বসুন। আমি আম্মুকে ডেকে দিচ্ছি।”

বিরামহীনভাবে কথাগুলো বলেই নীহারিকা তাড়াহুড়ো করে এই অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে বিদায় নিলো। তার মাকে ডেকে পাঠালো মহিলা দুটির কাছে। তার রুমে প্রবেশ করেই সে খাটের উপর বেশ আরাম করে বসল। আনন্দে তার গলা থেকে গান বের হয়ে আসছিল! টুক করে নীহারিকা দিশার হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিওটি সেন্ড করে দিলো! দিশা এই মুহূর্তে অনলাইনে নেই। অনলাইন হলেই ভিডিওটি সে দেখতে পাবে। ফোনটা পাশে রেখেই নীহারিকা মনের সুখে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। পায়ের উপর পা তুলে খুশিতে গলা ছেড়ে গান গাইতে লাগল! গানের কোনো আগামাথা নেই তার। নিজের মতো করে ভুলভাল লিরিক্সে গান গাইতেই লাগল।

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে সে মিনিট পনেরোর মধ্যে বের হয়ে এলো। অমনি তার ফোনে একটি আননোন নাম্বার থেকে কল এলো। কলটি পেয়ে কপাল কুঁচকালো নীহারিকা। কলটি তুলবে না-কী তুলবে না সেই দু’মনায় ভুগতে ভুগতে প্রথম কলটি প্রায় কেটেই গেল। দ্বিতীয় কলটি বেজে উঠতেই নীহারিকা টুক করে কলটি তুলে ফেলল! কর্কশ গলায় বলল,

“হ্যালো কে?”

অমনি কোনো পুরুষ মানুষের আত্নচিৎকারের আওয়াজ নীহারিকার কানে ভেসে এলো! বিভৎস সেই আওয়াজ! গাঁয়ের লোম কাটা দিয়ে উঠলো নীহারিকার। সঙ্গে সঙ্গেই তার হাত থেকে ফোনটি বিছানার উপর পড়ে গেল! শুকনো ঢোঁক গিলে নীহারিকা বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলতে লাগল। এদিক ওদিক অস্থির দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছিল না তার। তবুও সে যথাসাধ্য চেষ্টা করল তার মাকে ডাকার! তবে কিছুতেই যেন কিছু হলোনা। কোনো আওয়াজই তার গলা থেকে বের হলোনা।

ইতোমধ্যেই আবার অন্য একটি আননোন নাম্বার থেকে তার নাম্বারে কল এলো! বাজতে থাকা কলটির দিকে নীহারিকা আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সাহসে কুলালো না কলটি তোলার। প্রায় অনেক বার কলটি বেজে যাওয়ার পর নীহারিকা কাঁপা কাঁপা হাতে কলটি তুলল। ফোনটি কানে তুলে সে ভয়ে চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নিতেই ফোনের ঐ প্রান্ত থেকে রূপলের গলার স্বর ভেসে এলো! বিরক্তিকর গলায় রূপল বলল,

“আচ্ছা। আমি মেবি ভুল করে আপনাদের বাসায় আমার ঘড়িটা ফেলে এসেছি। কাইন্ডলি ঘড়িটা একটু খুঁজে দেখবেন তো।”

নিশ্চুপ হয়ে রইল নীহারিকা। রূপলের গলার আওয়াজ শুনেও ঘোর যেন কাটলনা তার। মনের ভয়টা এখনও দূর হলোনা তার। এভাবে নিস্তব্ধতায় কয়েক সেকেণ্ড কেটে যেতেই তিক্ত হয়ে রূপল গলা ঝাকালো। বলল,

“নীহারিকা। আর ইউ হেয়ার?”

অমনি নীহারিকা বড়ো একটি রুদ্ধশ্বাস ফেলল! গলা ঝাঁকিয়ে ভয়ার্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“নাম্বারটা কার?”

“কেন? আমার।”

“এই নাম্বারটা সেভ করা ছিলনা।”

“হ্যা। এটা আমার নতুন সিম। আজই নিয়েছি। তাই সেভ করা ছিলনা।”

পরমুহূর্তেই রূপল পুনরায় কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

“কেন? আপনি ভয় পেয়েছেন?”

“উঁহু! আমি ভয় পাইনা! আচ্ছা আমি ঘড়িটা খুঁজে দেখছি।”

“এক সেকেণ্ড, এক সেকেণ্ড। কলটা কাটবেন না। আপনার ভয়েস শুনে মনে হচ্ছে আপনি স্বাভাবিক নন। কিছু হয়েছে কী?”

ব্যাপারটা পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল নীহারিকা! গাঁ ছাড়া ভাব নিলো সে। ভনিতা করে বলল,

“না তো! কী হবে?”

শ্লেষাত্মক গলায় রূপল বলল,

“না মানে। আন্টি মারধর করল না-কী?”

“আশ্চর্য! আম্মু আমাকে মারতে যাবে কেন?”

“ঐযে শরবত খাইয়ে গুন্ডাটাকে ক্যালালেন!”

নীহারিকা হঠাৎ প্রসঙ্গ প্রশ্ন নিলো। গভীর চিন্তিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“আচ্ছা? আপনি ভয়েস পাল্টাতে পারেন?”

নীহারিকার এই অদ্ভুত প্রশ্নের মানে বুঝতে পারল না রূপল! বিস্মিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“মানে?”

“না। কিছুনা! আচ্ছা রাখছি। মেবি কোনো নাম্বার থেকে আমার নাম্বারে কল আসছে।”

“আচ্ছা। আমি কলটা কাটছি।”

রূপল ঐ পাশ থেকে কলটি কাটতেই নীহারিকার নাম্বারে আরও একটি নতুন নাম্বার থেকে কল এলো! মনে এবার জোর রাখল নীহারিকা! নিজেকে যতটা সম্ভব স্থির করল। নিজের মনোবলকে কিছুতেই ভেঙে পড়তে দিলোনা। বুকের ছাতি টান টান করে সে কলটি কানে তুলল! ঝাঁজালো গলায় বলল,

“হ্যালো কে?”

“সানি বলছিলাম! তোমার বেলকনিতে একটু আসতে পারবে? আমি তোমার বাড়ির নিচে দাড়িয়ে।”

#চলবে…?

#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৩০
#নিশাত_জাহান_নিশি

“সানি বলছিলাম! তোমার বেলকনিতে একটু আসতে পারবে? আমি তোমার বাড়ির নিচে দাড়িয়ে।”

প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত অবাক হলো নীহারিকা! বিপরীতে সানিকে কোনো প্রত্যত্তুর না করেই সে ছুটে গেল বেলকনিতে। বেলকনির এক পাশের পর্দা সরিয়ে বাড়ির নিচের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই দেখল সানি ফোন হাতে নিয়ে দাড়িয়ে। দূরদৃষ্টি তার নীহারিকার বেলকনিতে! দেখতে হতাশ এবং অপেক্ষায়মান সানিকে এক নজর দেখামাত্রই নীহারিকা হুড়োহুড়ি করে বেলকনির পর্দাটা টেনে দিলো! কিছুতেই সানির সাথে মুখোমুখি হতে চায়না সে। দ্রুত পায়ে হেঁটে সে রুমের ভেতর ঢুকে গেল। নীহারিকার মৌনতা উপলব্ধি করা মাত্রই সানি গলা ঝাকালো। পুনরায় কুর্ণিশ গলায় বলল,

“কী হলো নীহারিকা? কিছু বলছ না যে? আসবে না তুমি?”

সানির নত হয়ে যাওয়াটাও যেন নীহারিকার কাছে নাটক মনে হলো! মেজাজ তুঙে ওঠে গেল তার সানির এসব নাটুকে কথাবার্তা শুনে। বিছানার উপর ধপ করে বসল সে। সোজাসাপটা গলায় বলল,

“না আসব না! তোমার সাথে তো আমার সব সম্পর্ক চুকেই গেছে। সেই জায়গায় তুমি কীভাবে আশা করো আমি তোমার কথা শুনে তোমার সাথে আবারও দেখা করতে যাব?”

“সত্যিই কী আমাদের মধ্যে সব সম্পর্ক চুকে গেছে নীহারিকা?”

“তা আবার বলতে বাকী কী? ভাঙা জিনিস জোড়া লাগাতে আমি পছন্দ করিনা। জিনিসটা যতই দামী হোক না কেন তা আমি জোড়া লাগাতে নয় বরং আরও ভেঙেচুরে ছুড়ে ফেলে দিতে পছন্দ করি! অতীত ভুলে যাইনি আমি। আমার চেয়ে বেটার কাউকে পেয়ে আমাকে ছেড়ে যাওয়া, কাঁচের টুকরোর মত আমার মনটাকে ভেঙে দেওয়া, আমার বিশ্বাসের সুযোগ নেওয়া, তোমার প্রতিটা অসহিষ্ণু আচরণ, কারণে অকারণে আমাকে এড়িয়ে চলা, তোমার প্রতিটা কাজ আমার এখনও অক্ষরে অক্ষরে মনে আছে সানি! হোপ সো ভবিষ্যতেও মনে থাকবে। জীবন থেকে পাওয়া শিক্ষা কী কখনও ভুলা যায়? আজকের পর থেকে তুমি আমাকে কোনো রকমভাবে ডিস্টার্ব করবেনা সানি। এরপর থেকে তোমার মুখটাও আমি দেখতে চাইনা। আর এটাই আমার শেষ কথা। বায়।”

তেজ দেখিয়ে নীহারিকা কলটি কেটে দিলো! রাগে ফোঁস ফোঁস করে সে একই জায়গায় প্রায় দুই থেকে তিন মিনিট বসে রইল। সানি চলে গেল কী-না তা শিওর হওয়ার জন্য সে পা টিপে টিপে হেঁটে বেলকনিতে গেল। বেলকনির পর্দা সরিয়ে নিচে তাকাতেই দেখল সানি হতাশ হয়ে তার বাড়ির সামনে থেকে হেঁটে চলে যাচ্ছে! তা দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল নীহারিকা। চোখ বুজে বুকে হাত রেখে বলল,

“থ্যাংকস গড। আপদ বিদেয় হলো।”

শান্ত মেজাজ নিয়ে নীহারিকা রুমে ঢুকল। ফোনটা বিছানার উপর রেখে চলে গেল সোজা রান্নাঘরে। গিয়ে দেখল চায়ের পাতিলে এক কাপ পরিমাণ চা রয়ে গেছে। বুঝতে বেশী বেগ পেতে হলোনা তার মা চা টা তার জন্য রেখে গেছে। হয়ত তাদের প্রতিবেশীদের জন্য চা টা বানিয়েছিলেন তিনি। সেই চা থেকেই তার জন্য চা টা রয়ে গেল। চা টা হালকা গরম করে নীহারিকা চা খেতে খেতে বাড়ির ড্রয়িং রুমে গেল। তার মা ছাড়া ড্রয়িং রুমে আর কেউ নেই। ব্যাপারটায় বেশ অবাক হলো নীহারিকা। সোফায় তার মায়ের পাশে বসে সে চিন্তিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“কী হলো মা? তুমি একা যে? আন্টিরা কী চলে গেছেন?”

অমনি গাঁ ঝারা দিয়ে জায়গা থেকে ওঠে গেলেন মারজিনা বেগম! চোখেমুখে রাগী ভাব তার। তেঁতে ওঠে তিনি জায়গা থেকে প্রস্থান নিতে নিতে বললেন,

“হ্যা চলে গেছে। নেক্সট টাইম এই মহিলাদের আর আমাদের বাড়িতে জায়গা দিবি না!’

বেকুব হয়ে নীহারিকা তার মায়ের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। তার মায়ের এহেন উদ্ভট আচরণে সে চা খেতেও ভুলে গেল! ঠোঁট উল্টে নির্বোধ গলায় বলল,

“ব্যাপারটা কী হলো? মা হঠাৎ এতটা রিয়েক্ট করল কেন? তাদের এই বাড়িতে জায়গা দিতেও বা না করল কেন? হলোটা কী তাদের মধ্যে?”

মারিজনা বেগমকে এখনই কোনো প্রশ্ন করতে চাইল না নীহারিকা। কিছুক্ষণ তার মাকে একা থাকতে দিলো। এতে রাগটা নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে হলো তার। গরম গরম কোনো কিছুই ভালো নয়। সবকিছুতেই একটুখানি সময় দিতে হয়। সেই ফাঁকে চা টা খেতে খেতে নীহারিকা রূপলের ঘড়িটি খুঁজতে লাগল। অমনি তার সূক্ষ্ণ দৃষ্টি গেল টি টেবিলের নিচে। দেখল ঘড়িটি ওখানেই পড়ে আছে। হাত বাড়িয়ে নীহারিকা ঘড়িটি তুলল। হাতের মুঠোয় ঘড়িটি নিয়ে সে সোজা তার রুমে চলে গেল।

বিছানার উপর থেকে ফোনটি হাতে তুলতেই সে কিছুক্ষণের আগের আসা প্রথম রং নাম্বারটি থেকে আবারও অনেকগুলো কল পেল! কপাল কুঁচকে নীহারিকা নাম্বারটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। নাম্বারটি কার হতে পারে? কে তাকে এভাবে কল করে জ্বালাচ্ছে? তাছাড়া ঐ সময়ের পুরুষালি চিৎকারটিই বা কার ছিল? কে তাকে নিয়ে মজা করছে? সেই বিধ্বংসী চিৎকারের আওয়াজটি এখনও তার কানে বাজছে! মনোযোগ দিয়ে সেই আওয়াজটি অনুভব করতে গেলে তার প্রাণবায়ু বের হয়ে আসার মত অনুভূতি হচ্ছে!

হাতে থাকা চা টা শেষ করে নীহারিকা নিজেকে স্থির করল। কপাল থেকে গড়িয়ে পরা ঘামগুলো মুছে তার মস্তিষ্ককে অন্যদিকে ঘুরানোর চেষ্টা করল। এই একই জিনিস নিয়ে ভাবতে গেলে তার নিজেরই ক্ষতি হচ্ছে। তাই এই মুহূর্তে নিজেকে ঠিক রাখার জন্য তার অন্য চিন্তাভাবনা ঘুরানোর পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।

ঘড়িটি হাতে রেখে রূপলের নাম্বারে কল করল নীহারিকা। প্রথম কলটি বেজে যাওয়ার পর দ্বিতীয় কলটি তুলল রূপল। টাওয়াল দিয়ে ভেজা চুল মুছতে মুছতে রূপল প্রশ্ন ছুড়ল,

“কে কল করেছিল?”

“সানি।”

“আপনার এক্স?”

“হুম।”

“কী বলল?”

“ফিরে আসতে চাইল।”

“আপনি কী বললেন?”

“বললাম ভাঙা জিনিস ফেলা দেওয়াই ভালো।”

“গুড!”

“জানি। এখন বলুন আমাকে কত টাকা দিবেন?”

অবাক হলো রূপল। চুল থেকে টাওয়াল সরিয়ে কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“মানে? কীসের টাকা?”

“বা রে। হারিয়ে যাওয়া জিনিসটা খুঁজে দিলাম যে তার কমিশন চাইব না?”

“ঘড়িটা খুঁজে পেয়েছেন?”

“হুম। এখন টাকা দিলেই তবে ঘড়িটা হাতে পাবেন! এর আগে নয়।”

ব্যগ্র হেসে রূপল বলল,

“ওকে! আপনি বরং ঘড়িটা আপনার কাছেই রেখে দিন! কারণ, ওই ঘড়িটা আমি এমনিতেও ফেলে দিতাম।”

হতাশ হলো নীহারিকা। বিস্মিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“এহ্! মানে কী? তাহলে বললেন যে ঘড়িটা খুঁজে রাখতে?”

“ভেবেছিলাম ঘড়িটা পেলে নিজের হাতে আমি ভেঙে গুড়িয়ে দিব! কিন্তু এখন যেহেতু ঘড়িটা টেক্স ছাড়া পাচ্ছিনা সো আমার কোনো প্রয়োজন নেই টাকা ওয়েস্ট করে ঘড়িটা নেওয়ার!”

“আরে আরে আরে। এসবের মানে কী। এমন জানলে তো আমি এত খাটাখাটুনি করে ঘড়িটা খুঁজতাম না।”

“ইট’স ইউর প্রবলেম! নট মাই প্রবলেম।”

রূপলের অগোচরে মনে মনে অভিসন্ধি কষিয়ে নীহারিকা বলল,

“আচ্ছা লোকটা আবার টাকা দেওয়ার ভয়ে ঘড়িটাকে নিতে অস্বীকার করছেনা তো? ভাবতে পারে ঘড়িটা নিতে অস্বীকার করলে হয়ত আমি তাকে ঘড়িটা এমনি এমনি দিয়ে দিব? এটাও তো একটা ট্রিক হতে পারে তাইনা? আমি কী একবার তাকে বাজিয়ে দেখব?”

যে ভাবা সেই কাজ। গলাটা খাকিয়ে নীহারিকা মিচকে হেসে বলল,

“তাহলে এক কাজ করি। ঘড়িটা আমি বেচে দিয়ে টাকা উসুল করে ফেলি!”

“এজ ইউর উইশ। ঐ ঘড়ির প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই! একটু আগে বললেন না? ভাঙা জিনিস ফেলা দেওয়াই ভালো? এই ঘড়ির অবস্থাটাও ঠিক তাই!”

বলেই রূপল কলটি কেটে দিলো। নীহারিকা এতক্ষণে বুঝতে পারল ঘড়িটি নিতে রূপল কেন অস্বীকার করল। রূপলের এই পরিবর্তন দেখে নীহারিকা খুশি হলো! ঘড়িটি সে সযত্নে তার ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিলো। এসব ছেড়ে নীহারিকা পড়তে বসে গেল। টানা দু/এক ঘণ্টা পড়াশোনার পর সে পড়ার টেবিল থেকে উঠল। রাতের খাবারের জন্য তার মা তাকে ডাকল। ততক্ষণে নিহালও অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এলো।

খাবার টেবিলে খাবার খেতে বসেও নিহাল মুখটাকে গম্ভীর করে রাখল। খাবার না খেয়ে বরং খাবারটাকে নাড়াচাড়া করতে ব্যস্ত সে। নিহালের এহেন খামখেয়ালি ভাব দেখে মারজিনা বেগম মুখে খাবার রেখে নিহালের দিকে প্রশ্ন ছুড়লেন,

“কী রে কী হয়েছে? খাবার না খেয়ে শুধু নাড়ছিস কেন?”

দাঁতে দাঁত চেপে এক লোকমা খাবার মুখে নিলো। খাবারের দিকে তাকিয়েই তার মায়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“পিয়াসা তোমাকে কল করেছিল মা?”

“না তো। কেন? কল দেওয়ার কথা ছিল না-কী?”

“কাল থেকে এই অবধি তোমার কোনো খোঁজ খবর নেয়নি?’

মুখটা কালো করে মারজিনা বেগম বললেন,

“না নেয়নি। হয়ত আমাকে এখনও তোর বউ আপন ভাবতে পারেনি।”

অমনি নিহাল খাওয়া থামিয়ে খাবারের প্লেটটা তার সামনে থেকে সরিয়ে দিলো! চোয়াল উঁচিয়ে রগচটা ভাব নিয়ে বলল,

“আমার মনে হয়না এই সম্পর্কটা আর বেশিদিন টিকবে মা! যত দ্রুত সম্ভব সম্পর্কটাকে ভেঙে দেওয়াই ভালো!”

বলেই নিহাল খাবার টেবিল ছেড়ে ওঠে গেল! মারজিনা বেগম পেছন থেকে নিহালকে অনেক ডাকলেও সে কোনো সাড়া দিলোনা। ছেলের মন খারাপ দেখে নিহালের বাবাও খাবার সম্পূর্ণ না খেয়ে খাবার টেবিল থেকে ওঠে গেলেন। সব দেখে এবং শুনেও নীহারিকা চুপ করে রইল! মারজিনা বেগমও খাবারের প্লেটটা দূরে সরিয়ে হায় হুতাশ করে বললেন,

“আমিই আমার ছেলের জীবনটাকে নষ্ট করলাম! একটা ফা’ল’তু, অহংকারী মেয়ের সাথে ছেলেটার বিয়ে দিলাম। ছেলের জীবনটা তো শেষ করলামই। এখন আমার মেয়েটার ভাগ্যে কী আছে আল্লাহ্’ই ভালো জানেন৷”

পাশ থেকে নীহারিকা শান্ত গলায় তার মাকে বলল,

“আমার জন্য চিন্তা করতে হবেনা মা। তুমি বরং এখন ভাইয়াকে নিয়েই চিন্তা করো।”

“শুধু কী এক দিকেই চিন্তা করলে হবে? সবদিকেই তো চিন্তা করতে হয় আমার। সম্বন্ধ আসে কই তোর জন্য? আজ যা ও একটা এলো তাও আবার গাঁয়ের রঙের দোহাই দিয়ে চলে গেল! ফা’লতু লোক কোথাকার! গাঁয়ে রঙ দেখে আমার মেয়েকে জাজ করতে আসে। এজন্যই আচ্ছেমত ধূয়ে দিয়েছি। লজ্জা থাকলে আমার বাড়ির ত্রি-সীমানা দিয়ে আর আসবেনা!”

নীহারিকা এতক্ষণে বুঝতে পারল তার মা কেন ঐ সময় এত রাগ দেখাচ্ছিল! তার মানে ভদ্র মহিলা দুজন তার বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিল? তবে যেই আসুক না কেন সে জানে কেউ তাকে প্রথম দেখায় পছন্দ করবেনা! এভাবেই একের একের এক সবার কাছে সে রিজেক্টেড হতে থাকবে। যদিও এই নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই নীহারিকার! কারণ, সে মেয়েটাই ভাগ্যে বিশ্বাসী। ভাগ্য যদি ভালো থাকে তার, তাহলেই নিশ্চয়ই একদিন না একদিন কেউ তার জন্য আসবে। যা সে আশা করছেনা হয়ত তার চেয়েও ভালো কেউ আসবে!

সেই শান্তনা মনে মনে রেখেই নীহারিকা খাবার টেবিল ছেড়ে ওঠে গেল। হাতটা ভালো করে ধূঁয়ে সে নিহালের ঘরে গেল। গিয়ে দেখল নিহাল মাথার উপর হাত রেখে লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। দেখতে বড্ড চিন্তাগ্রস্ত এবং বিষন্ন দেখাচ্ছে তাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীহারিকা নিহালের পাশে এসে বসল। ধীর গলায় নিহালের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“ভাবির জন্য বেশী মন খারাপ লাগছে ভাইয়া?’

কপাল থেকে হাতটা সরালো নিহাল। শোয়া থেকে ওঠে বসল। নীহারিকার দিকে ক্লান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ব্যথীত গলায় বলল,

“সকাল থেকে তোর ভাবি আমার কলটা তুলছে না। হাজারটা কল দেওয়া হয়ে গেছে এই অবধি! আমিও তো মানুষ বল? আমারও খারাপ লাগে।”

“আমি বরং কাল গিয়ে ভাবিকে ঐ বাড়ি থেকে নিয়ে এসো। তুমি গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“কিছু ঠিক হবেনা! আমার মনে হচ্ছে পিয়াসা আমার সাথে থাকতে চাইছেনা।”

“তুমি একটু বেশীই ভেবে ফেলছ ভাইয়া। সারাদিন অফিসে কাজে কাজে ব্যস্ত ছিলা। তুমি বরং এখন একটু রেস্ট নাও। নিজেকে একটু সময় দাও। দেখবে, সব ঠিক হয়ে গেছে।”

প্রত্যত্তুরে নিহালকে কিছু বলার সুযোগ দিলোনা নীহারিকা। নিহালের রুমের লাইট অফ করে সে দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে নিজের রুমে চলে এলো। পিয়াসা এবার সত্যিই বাড়াবাড়ি করছে! বাড়ির সবার সামনে ব্যাপারটাকে নীহারিকা তুচ্ছ মনে করলেও ভেতরে ভেতরে সে ব্যাপারটাকে বড়ো করে দেখছে! মানিয়ে চলতে না পারলে তো সত্যিই সংসারটা টিকবে না। রাগে রি রি করে নীহারিকা রুমে ঢুকেই রূপলের নাম্বারে কল করল! ঐ পাশ থেকে রূপল কলটি তুলতেই নীহারিকা কর্কশ গলায় বলল,

“কী ব্যাপার হুম? বোনের দিকে কী কোনো নজরই নেই আপনার?’

সবেমাত্র সিগারেটটা ধরাচ্ছিল রূপল। এরমধ্যেই নীহারিকার উস্কানিমূলক কথা। হঠাৎ রেগে গেল রূপল! সিগারেটটা হাতে তুলে নিয়ে প্রত্যত্তুরে ঝাঁজালো গলায় বলল,

“মানে? কী বলতে চাইছেন আপনি?”

#চলবে…?