ফেরারী বসন্ত পর্ব-০১

0
10

#ফেরারী বসন্ত
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

হাসনা নাস্তা টিফিন সব রেডী করে ফেলে। কারণ সাতটা বাজে। ওদিকে আরশিকে ঘুম থেকে জাগাতে হবে। ওকে এখন না উঠালে স্কুলে নিয়ে যাওয়া মুশকিল হবে। আর রাশেদ তো বদমেজাজী মানুষ। নিজের দোষ ত্রুটি চোখে দেখে না। পান থেকে চুন খসলেই হাসনার উপর চোট পাট শুরু হয়। সাথে মাঝে মাঝে বোনাস হিসাবে চড় থাপ্পর জুটে যায়। ওকেও আটটার মধ্যে আড়তে যেতে হবে। টেবিলে নাস্তা বেড়ে দিয়ে ঘরে আসতেই রাশেদ হাসনার চুল ধরে দুগালে কষে থাপ্পর লাগিয়ে বলে আমার টাকার বান্ডিলে হাত দিয়েছিস কেন? হাড় হাভাতে ঘরের মেয়ে তুই সেটা আমি জানি তবে চুন্নী ছিলি সেটা তো জানতাম না। একথা বলে তলপেট বরাবর লাথি মারে। হাসনা দূরে সিটকে পড়ে সাথে সাথে কোঁৎ করে শব্দ হয়। হাসনা ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে বলে,
—আমি তোমার টাকার বান্ডিলে হাত দেইনি।
রাশেদ কাছে গিয়ে গালে কষে আরো দুটো থাপ্পর মেরে বলে,
—চুন্নীর আবার বড় বড় কথা। এমনিতেই চুরি করিস তার উপর শিনা চুরি। আমি টাকা গুনে রেখেছি। তার সাথে টাকার নাম্বার ও গুনে রেখেছি। তুই ছাড়া এঘরে আর তো কেউ আসে না। তাহলে আমার টাকা গেল কোথায়। তোর কোন ভাতাররে দিয়ে বাপের বাড়ি আমার কষ্টের টাকাগুলো পাঠিয়েছিস। তোর বাপ মা আর কিছু শেখায়নি। কিন্তু চুরি করতে ভালো ট্রেনিং দিয়েছে।
হাসনা রাগতস্বরে বলে,
—-তুমি যা বলার আমাকে বলো কিন্তু আমার বাবা মাকে কিছু বলবে না। ওরা তোমারটা খেতে আসে না নিতেও আসে না।
রাশেদ হাসনার কাছে ছুটে গিয়ে ওর মাথাটা মেঝের সাথে চেপে ধরে পিটের উপর কিল বসিয়ে বলে,
—এই বিশ্বাসঘাতক অকৃতজ্ঞের বাচ্চা, তোর বাপ দুচারদিন পরপর যে হাসপাতালে ভর্তি হয় তখন ডাক্তার ওষুধের খরচ কে বহন করে? এইতো গতমাসে তোর ভাইয়ের ফরমফিলাপের টাকা আমার কাছে ভিক্ষা করে গেলি। এখন সব অস্বীকার করছিস তাই না?
হাসনাও কাঁদতে কাঁদতে বলে,
—তুমি আমার কোনো হাত খরচ দাও না,সংসারে একটা কাজের লোক রাখো না,বাচ্চার জন্য টিউটর রাখো না,সংসারের সবই তো আমি করি। বাথরুম ধোয়া ঘর মোছা থেকে শুরু করে কোনো কাজই বাদ যায় না। এসব লোক দিয়ে করাতে গেলে তোমার কত টাকা খরচ হতো সে হিসেব করে দেখো।
রাশেদ ঠোঁট বরাবর জোরে থাপ্পর মেরে বলে,
—-তোর নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ,একটা ধুমসী খাসি হয়েছিস। তোর আছেটা কি? গায়ের রং ফর্সা হলে হয় না। ফিগারটারে বানিয়েছিস কি? দেখে মনে হয় পাঁচ সন্তানের মা হয়েছিস।
ঠোঁটটা কেটে গলগল করে রক্ত পড়তে থাকে। হাসনা মারের ব্যথা সহ্য করতে না পেরে জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। এমন সময় আরশি ঘুম থেকে উঠে যায়। মাকে ওভাবে মেঝেতে পড়ে কাঁদতে দেখে ও কাঁদতে থাকে। রাশেদ মেয়ের কাছে এসে বলে,
—কাঁদিস না। তোর মা টাকা চুরি করেছে বলে আমি রেগে গিয়ে দুচারটে থাপ্পর মেরেছি। কিন্তু এমনভাবে কাঁদছে দেখে মনে হচ্ছে আমি কিনা কি করে ফেলেছি।
আরশি চিৎকার দিয়ে বলে,
—তুমি আমাকে ধরবে না। যে হাত দিয়ে আমার মাকে মেরেছো সেই হাত দিয়ে আমাকে ধরবে না। টাকা গতকাল রাতে তোমরা যখন খেতে বসেছিলে তখন জামশেদ চাচা ওয়ারড্রোব খুলে টাকা নিয়ে যায়। চাচা ভেবেছিলো আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। কিন্তু আমি তখন জেগেছিলাম।
এতোক্ষণ রাশেদের মায়ের এঘরে আসার তাগিদ ছিলো না। যেই আরশি তার ছোটো ছেলের চুরির কথা সামনে আনলো অমনি জরিনা বেগম তড়িঘড়ি করে ছেলের রুমে এসে বলেন,
—অন্ধকারে আরশি কি দেখতে কি দেখেছে তুই ওর কথা বিশ্বাস করিস না বাপ। টাকা কে সাফাই করেছে তা তুইও জানিস আমিও জানি।
আরশি চেঁচিয়ে উঠে বলে,
—-টাকা আমার মা চুরি করে নাই। তোমরা মিথ্যা বলছো। রাশেদ আর একমুহুর্ত ঘরে দাঁড়ালো না। বাসা থেকে বের হয়ে গেল। ওর মা তখন হাসনার কাছে এসে বলে,
–যেমন মা তার তেমন মেয়ে। মেয়ের মুখ টিপলে এখন দুধের গন্ধ বের হয় সেই মেয়ে বাবার মুখে তর্ক করে। কেবলতো আট বছর বয়স তাতেই এই অবস্থা। তাছাড়া স্বামীরা ওরকম এক আধটু কিল ঘুষি চড় থাপ্পর মারে। তাই বলে তোমার মতো কেউ কাহিনী করে না।
যদিও এতোদিন হাসনা সহ্য করেছে। কিন্তু আজ ওর সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েছে। তাই শাশুড়ীর দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলে,
—আজ আপনার স্বামী বেঁচে থাকলে তাকে বলতাম আমার শরীরে আপনার ছেলে যে পরিমান আঘাত করেছে সেই সম পরিমান আঘাত আপনাকে করতে তাহলে বুঝতেন মারগুলো এক আধটু ছিলো কিনা?
এবার তেড়ে এসে জরিনা বেগম হাসনার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
—-আমি তোর মতো হাড়হাভাতে ঘরের মেয়ে ছিলাম না। আমার দাদা জমিদার ছিলেন। আমার বাপের বাড়ির জিনিস খেয়ে আমার শ্বশুরবাড়ির মানুষ কুলাতে পারতো না। আমের সময় আম, পিঠার দিনে পিঠা পায়েশ এমনকি কোরবানি ঈদে আস্ত ছাগল পাঠিয়ে দিতো। তোর মতো আমি ফকিন্নির ঘরে জন্ম নেই নাই।
হা এখন তুমি থেকে তুই চলে আসছে। এরপর হাসনা কিছু বললে জরিনাও দুই একটা চড় থাপ্পর দিতে পিছপা হয় না। জরিনা নিজের ঘরে গিয়ে হাসনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,
—-এতো মার খায় তারপরও চোপাগিরী ছাড়ে না। রাশেদ ঠিক কাজ করে। তোর এইভাবেই মাইর খাওয়া উচিত।

হাসনা অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালো। আলমারীর উপর থেকে ভাঙ্গাচোরা সুটকেসটা নামিয়ে মেঝেতে রাখতে গিয়ে ককিঁয়ে উঠে। পুরো শরীরটাকে রাশেদ চোরের মতো পিটিয়েছে। আরশি কাছে এসে ওর মায়ের শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
—চলো মা,আমরা নানুবাড়ি চলে যাই। এখানে থাকলে আব্বা তোমাকে মারতে মারতে মেরেই ফেলবে।
হাসনা মেয়ের কথা শুনে মনে মনে বলে,”মারে আবার বাবার যে সেই সামর্থ নাই। আমাকে আর তোকে পালবে। তবে আজকে হাসনা ওর বাবার বাড়িতে চলে যাবে। এভাবে প্রায় প্রতিদিন ছুঁতো ধরে রাশেদের আঘাতগুলো ও আর নিতে পারছে না। বাবার কাছে অনুরোধ করে বলবে, আব্বা আমারে শুধু একটু থাকতে দেন। মানুষের বাসায় কাজ করে হলেও আমি আমার পেট আর মেয়ের পেট চালানোর ব্যবস্থা করবো। সুটকেস কাপড় গুছিয়ে যখনি বের হতে যাবে অমনি জরিনা বেগম সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর হাসনার হাত থেকে সুটকেস কেড়ে নিয়ে বলে,
—আমার ছেলের ঘর থেকে কি চুরি করে সুটকেসে ভরে বাপের বাড়ি যাচ্ছিস? আমি তোরে যেতে দিবো না। আমার ছেলে আসুক তারপর তোর যেখানে যেতে ইচ্ছে হয় যাবি।
এরপর জরিনা বেগম রাশেদকে ফোন দেয়। আড়ত বাসা থেকে বেশী দূরে নয়। রিকশা করে আসলে দশ মিনিট লাগবে। রাশেদও বাসায় চলে আসে। এরপর হাসনাকে বলে,
—তোর বাপরে আসতে বলছি। স্বামীর মুখে মুখে কথা বলছ এর বিচার না করে আমি তোরে যাইতে দিবো না। আর এটাও কান খুলে শুনে রাখ এবার বাপের বাড়ি গেলে আমি তোর সাথে আর সংসার করুম না। কথাটা যেন মনে থাকে।
হাসনা জানে এরকম কিছু ঘটবে। কারণ খবর তো চাপা থাকে না। যে রাশেদ ওর রান্নার পাগল ছিলো আজকাল ওর রান্না করা খাবার দিয়ে দুপুরের খাবার মাঝে মাঝে খায় না। পাশে শহিদুলের আড়ত। ওর বাসা থেকে খাবার আসে। ওর একটা ডিভোর্সি বোন আছে। শহিদুল এখন বিয়েশাদি করে নাই। ওর বোন নিজে আড়তে খাবার নিয়ে আসে। তখন শহিদুল রাশেদকে ডেকে ওর সাথে খেতে বসায়। হাসনার কানে খবর আসে শহিদুলের বোন জোহরার সাথে রাশেদের ইটিস পিটিস চলে। যখন থেকে শহিদুলের বোনের সাথে তার উঠাবসা তখন থেকেই হাসনার উপর রাশেদের মারের মাত্রাটা বেড়ে গিয়েছে। রাশেদের পাশের গ্রামেই হাসনাদের বাড়ি। ঘন্টা খানিকের মধ্যে হাসনার ভাই হাসেম আর ওর বাবা রায়হান মিয়া চলে আসেন। এরপর রাশেদ তাদেরকে বসিয়ে হাসনার নামে নানা কথা বানিয়ে বলে। সবচেয়ে বেশী বলে হাসনা নাকি প্রায় টাকা চুরি করে। এটা শুনে হাসনা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
—বাবা ও মিথ্যা কথা বলছে। টাকা কে চুরি করে আপনার নাতনিরে জিজ্ঞাসা করেন। সেই আপনারে বলবে।
এরপর হাসনা নিজের ঠোঁটটা দেখিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে
—দেখেন বিনা দোষে আমারে মেরে ঠোঁটটা ফাটিয়ে ফেলছে।
সাথে সাথে রাশেদ বলে,
—-আপনার মেয়ের মতো মিথ্যা কথা বলার জুরি মেলা ভার। ঘরের মধ্যে হোঁচট খেয়ে পড়ে ঠোঁটটা ফাটিয়ে ফেলছে। এখন আমার দোষ দিচ্ছে।
সাথে সাথে আরশি বলে,
— তুমি মেরে আম্মুর ঠোঁট ফাটিয়েছো। আর টাকা জামশেদ চাচা চুরি করছে।
তখন রাশেদ রেগে গিয়ে হাসনার গালে কষে থাপ্পর লাগায়। সাথে সাথে হাসনার বাবা রেগে গিয়ে রাশেদের গালে থাপ্পর লাগায়। হাসনার ভাইও তেড়ে আসে। হাসনার বাবা থাপ্পর মেরে বলে,
—-আমার সামনে তুমি আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলেছো তাহলে আমার অবর্তমানে কি করো তা আমার জানা আছে।

চলবে