ফেরারী বসন্ত পর্ব-০২

0
14

#ফেরারী বসন্ত
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী

রায়হান সাহেবের থাপ্পর খেয়ে রাশেদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। ও ভেবেছিলো গরীব স্কুল মাস্টার তার উপর প্রায় অসুস্থ থাকে তার আর জোর কোথায়? কিন্তু রাশেদ জানেনা একজন বাবার কাছে তার মেয়ে রাজকন্যা। এমনকি হতদরিদ্র পিতার কাছে তার কন্যাটি অনেক আদরের। যাইহোক থাপ্পর মারার সাথে সাথে জরিনা বেগম ছুটে এসে বলেন,
—আমারি বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমার ছেলের গায়ে হাত তোলার সাহস আপনার কোথা থেকে আসে?
হাসনার ভাই সাথে সাথে বলে,
—রাশেদ ভাই যে আমার বোনের গায়ের গায়ে হাত তুললো তার বেলায় আপনার জবান কোথায় ছিলো?
জরিনা নিজের তর্জনি তুলে হাসেমের দিকে তাকিয়ে বলে,
—তোমার আব্বা স্কুল মাস্টার হয়ে তোমাদের মানুষ করতে পারেনি। তোমরা দুই ভাইবোন আস্ত বেয়াদব। মুরুব্বিদের মুখে তর্ক করা ছাড়া আর কিছু শিখতে পারোনি। আর একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো মেয়ের শ্বশুরবাড়ি হচ্ছে এমন এক বাড়ি সেখানে যদি দরজার উপর জুতা টাঙ্গিয়ে রাখে তার নীচ দিয়ে মেয়ের বাবা আসতে বাধ্য।
হাসেম রেগে গিয়ে বলে,
—আপনি কোন যুগে বাস করেন। এখন এসব কথা বাজারে বিক্রি হয় না।
আপনারা জুতা টাঙ্গিয়ে রাখবেন আমরা সেন্ডেল আপনাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আমাদের মেয়ে নিয়ে চলে যাবো।
রায়হান মিয়া মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,
—এতো কথার দরকার নাই। তোর আর এবাড়ি থাকা লাগবে না। তুই আমার সাথে বাড়ি চল।
সাথে সাথে রাশেদ হাসনার দিকে তাকিয়ে বলে,
—আমিও আর তোর সাথে সংসার করবো না। বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে।
হাসনা আরশিকে ডাকা মাত্রই রাশেদ চিৎকার দিয়ে বলে,
—-খবরদার! আমার মেয়েকে তুই নিতে পারবি না।
হাসনা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
—মেয়েটাকে আমাকে দিয়ে দাও। তুমি তো বিয়ে করে আবার সংসার শুরু করবে মাঝখানে আমার মেয়েটাকে
তুমি আমার কাছে দিয়ে দাও। আরশির জন্য তোমার কোনো খরচ দিতে হবে না।
—খবরদার! আমার মেয়ের নাম মুখে আনবি না। আমার বাড়ি থেকে এখনি বের হয়ে যা।
হাসেম ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
—এখানে যতক্ষণ থাকবে শুধু অপমানিতই হতে হবে। চলো আপুকে নিয়ে বের হয়ে যাই।
এরপর হাসনাকে নিয়ে রায়হান মিয়া আর হাসেম ও বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। একটা অটো নিয়ে ওরা বাড়ির পথে রওয়ানা দেয়।

হাসনা মনে মনে ভাবে,বের হয়ে তো আসলো কিন্তু এরপর ওর জীবন কিভাবে চলবে? বাবা আর ক’টাকাই বা বেতন পান সেটা দিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে মাসের শেষের দিনগুলোতে ভর্তা ভাত খেয়ে দিন কাটাতে হয়। সেখানে ও গেলে ওর বাবা মায়ের খরচ বেড়ে যাবে। মেয়েটার জন্য হাসনার খুব মনটা পুড়ছে। পরে ভাবে, ভালোই হয়েছে এই অভাবের সংসারে আরশিকে আনলে বরং ওর কষ্টই হতো। কিন্তু রাশেদ বিয়ে করলে ওর মেয়েটাকে আবার কাজের মেয়ে বানিয়ে রাখবে নাতো?

এখন আর এসব ভেবে কি হবে? অথচ এই রাশেদ ওকে একরকম জোর করেই বিয়ে করেছিলো। বিয়ের আট বছরের মাথায় ভালোবাসা উধাও হয়ে গেল। অবশ্য আট বছর লাগেনি। আরশির জন্মের পর থেকেই রাশেদ হাসনার উপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। শরীরে পানি আসাতে সেই যে শরীরটা ফুলে উঠেছে এরপর ফোলাটা আর সেরে যায়নি। আর যাবেই বা কি করে। সংসারে সবার জন্য রুটি জুটলেও হাসনার জন্য পান্তা আর রাতের একটু তরকারী নাস্তা হিসাবে বরাদ্দ ছিলো। একবার ডাক্তারের কাছে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিলো। কারন শরীর বেশী ফুলে যাওয়াতে সংসারের কাজ হাসনা করতে পারছিলো না। সে কারণে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়েছিলো। ডাক্তার বলেছিলো দুবেলা রুটি খেতে যাতে শরীরের পানিটা শুকিয়ে আসবে। কিছুদিন খেয়েছিলো। শরীরের ফোলাটা কমে আসতে আবার সেই পান্তা বরাদ্দ হয়ে যায়।
কিছুদিন যেতে না যেতে হাসনার এই ফোলা শরীরের উপর থেকে রাশেদের আগ্রহ চলে যায়। হাসনা ভাবে স্বামী স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্কের সাথে মানসিক সম্পর্ক গড়ে না উঠলে সম্পর্ক মজবুত হয় না। সামান্যতম কারণে সেই সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়। হাসনার আজ উপলব্ধি হয় রাশেদের সাথে ওর মানসিক সম্পর্ক কখনও গড়ে উঠেনি। বাবার বাড়ির আর্থিক অসঙ্গতির কারণে হাসনা সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলো কিন্তু শেষরক্ষা আর হলো না।
বৈশাখ মাস। আকাশে সুর্যের প্রচন্ড আক্রোশ। ধীর মন্থর গতিতে অটোটা এগিয়ে চলছে। খগাখড়িবাড়ি থেকে বড়বাড়ি গ্রামে আসতে দশ থেকে পনেরো মিনিট সময় লাগে। আকাশের বুকে একটা চিল দিকচক্রবালে চক্রাকারে উড়ছে। রোদজ্বলা দুপুরে তপ্ত নির্জনতাকে ফালি ফালি করে চিলটা ডেকে উঠে। হয়তো কাছে ধারে ওর শিকার দেখতে পেয়েছে।

আসমা বেগম গোসল করে বের হয়ে উঠানে নিজের ভেজা শাড়িকাপড় মেলে দিয়ে শুকনো গামছা দিয়ে চুলগুলো মুছতে লাগলেন। হঠাৎ বাড়ির সামনে অটো থামার শব্দ হলো। মাথায় শাড়ি দিয়ে ঘোমটা টেনে আসমা বেগম বাড়ির ভিতর থেকে বের হয়ে আসেন। ভাড়া মিটিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই আসমা বেগম রায়হান মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন,
—হাসনাকে নিয়ে এলে যে?
—আজ নিয়ে না আসলে এরপর গিয়ে লাশটা নিয়ে আসতে হতো।
হাসেম ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
—আপুকে নিয়ে না আসা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখো মেরে কেমন ঠোঁটটা ফাটিয়ে দিয়েছে।
আসমা বেগম মুখে কিছু বলেন না। কিন্তু মনে মনে ভাবেন তিনটা মুখ চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে এখন আর একটা মুখ কেমন করে চালাবে।

হাসমা বাড়ি ফিরে কটা দিন বিশ্রামে থাকলো। আর মনে মনে ভাবতে লাগলো এভাবে শুয়ে বসে থাকলে জীবন চলবে না। আরশির কথা খুব মনে পড়ে। কিন্তু কিছু তো করার নেই। বাবার বাড়িতে ওর খরচটা চালাতেই ওর বাবাকে হিমসিম খেতে হচ্ছে। নাহ্ ওকে কিছু না কিছু করতে হবে। আবার ভাবে কিইবা করবে। ওর তো টাকাপয়সাও নেই যে ব্যবসা করবে। শিক্ষা তেমন নেই যে চাকরি করবে। কেবল এইচএসসি পাশ করেছে। এর মাঝে রাশেদ ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিয়েছে। তবে উকিলের মারফত একটা বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে বছরে দুবার আরশি ওর মায়ের কাছে এসে কিছুদিন থাকতে পারবে।

অবশেষে হাসেমের সাথে পরামর্শ করে ক্যাটারিং এর কাজ করার সিদ্ধান্ত নেই। হাসেম এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ওর হাতে এখন কিছু সময় আছে। সরকারী অফিসগুলোতে ঢু মেরে কিছু খাবার সাপ্লাইয়ের অর্ডার নেয়। এভাবে একজন দুজন হতে হতে হাসনার খাবারের বহু কাস্টমার যোগাড় হয়ে গেল। রান্নাটা হাসনা বরাবর ভালো করে। এভাবে বছরখানিক সময় পার হয়ে যায়। মাঝে আরশি এসে হাসনার কাছে পনেরোদিন থেকে যায়। ওর কাছে রাশেদের বিয়ের কথা হাসনা জানতে পারে। কথায় আছে যা রটে তার কিছু তো বটে। সিতারার সাথে রাশেদের বিয়ে হয়। হাসনার খুব জানতে ইচ্ছা হয় সিতারার সাথে রাশেদের ব্যবহার কেমন? পরে আবার নিজেকে সামলে নেয়। পুরোনো অতীতকে ও মনে করতে চায় না। বরং আরশি যখন আসে হাসনা নানা রকম শুকনো খাবার বানিয়ে দেয়। নারিকেলের নাড়ু,মুড়ির মোয়া,চিরার মোয়া,বুটের হালুয়া এসব খাবার বানিয়ে আরশির সাথে পাঠিয়ে দেয়। ক্যাটারিং এর কাজ করাতে হাসনার হাতে ভালোই পয়সা থাকে। আরশিকে দুটো দামী ফ্রক কিনে দিয়েছে। পনেরোদিন সময় পার হলে হাসেম আরশিকে ওর বাবার বাড়িতে দিয়ে আসে ।
এদিকে হাসনার বাবার বাড়িতে সচ্ছলতা ফিরে আসায় বাবা মা ভাই হাসেম সবাই খুব খুশী থাকে। হাসনার ক্যাটারিং সার্ভিসের আয় ওর বাবার স্কুলের বেতনের থেকে মাঝে মাঝে বেশী হয়। হাসনার মনে হয় কোথায় ও ভেবেছিলো ওর জীবন কিভাবে চলবে? অথচ আল্লাহপাকের রহমতে এখন ওর জীবন সচ্ছলতায় কাটে। এমনকি রাশেদের কাছে যেমন থাকতো তার থেকে হাসনা অনেক ভালো থাকে।
হাসেম জিপিএ ফোর পেয়ে এইচএসসি পাশ করেছে। এবার রাজশাহী ইউনিভার্সিটি নৃবিজ্ঞানে চান্স পেয়েছে।
সেদিন হাসনা দুপুরে খেয়ে বিছানায় একটু শুয়েছে। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠে। অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসে।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসে।
—-হ্যালো, আপনি কি হাসনা বলছেন?
—জ্বী,
—-আমি জোহরা বলছি।
নামটা শুনে হাসনা ক্ষণিক চুপ করে থাকে। তারপর বলে,
—কি বিষয়ে কথা বলবেন?
—-না,মানে আমি রাশেদের সাথে আট বছর কাটালেন কিভাবে? আমার পক্ষে একবছর কাটানো কঠিন হয়ে গেল। তাই বাবার বাড়িতে চলে এসেছি। ওতো ভীষণ চন্ডাল। আর ও মা হচ্ছে ডাইনি বুড়ি।
হাসনার আসলে জোহরার কথাগুলো শুনতে ভালো লাগছিলো না। হাসনার এখনও মনে হয় ওর আর রাশেদের মাঝখানে জোহরা না আসলে হয়তো ওর সংসারটা টিকে যেতো। হাসনা বলে,
–+আমি খুব ব্যস্ত আছি। ফোনটা রাখছি।
ফোনটা রেখে হাসনা মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে আর বলে,
” এক বছরেই মজা ফুরিয়ে গেল।”

চলবে