#ফেরারী বসন্ত
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী
ফোনটা রেখে হাসনা ভাবে, এই রাশেদ ওর প্রেমে পাগল হয়ে ওকে বিয়ে করেছিলো। তখন ওর বয়স বিশ বছর। কচি লাউয়ের ডগার মতো বেড়ে উঠা শরীর। তাও হাসনা তারে বেঁধে রাখতে পারে নাই। আসলে অনেক ফুলের মধু খাওয়া যার অভ্যাস হয়ে যায় তার কি আর বাঁধা ফুলের মধুতে পোষায়? পোষায় না। তখন বাইরের বুনো ফুলের মধু খাওয়ার জন্য ছুক ছুক করে। আজও সেদিনের স্মৃতিগুলো মনের আঙ্গিনায় ঘোরাফেরা করে, রাশেদ ছিলো মেম্বারের ছেলে আজমলের ঘণিষ্ট বন্ধু। রাশেদের সাথে হাসনার প্রথম দেখা হয় গ্রামের বৈশাখী মেলায়। সেদিন প্রথম শাড়ি পরে সালমার সাথে মেলায় গিয়েছিলো। সালমা ওর ছোটোবেলার সই। বৈশাখের রোদজ্বলা দুপুরে লাল শাড়ি পরে মেলায় গিয়েছিলো। সেদিন হাসনার রুপের ছটা পুরো অবয়বে ছড়িয়ে পড়েছিলো। এমনিতেই হাসনা দেখতে চোখে পড়ার মতো মেয়ে। টিকালো নাক,ভাসা ভাসা বড় পাপড়ি ছাওয়া চোখ, কমলার কোয়ার মতো ঠোঁট আর উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রং তারউপর পিঠ ছাপানো চুল সাথে পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির একহারা গড়ন। সেদিনের সেই মেলাতেই রাশেদের পোড়া চোখের নজর পড়লো হাসনার উপর। রাশেদের চেহারা ছবিও খারাপ ছিলো না। সেদিন হাসনার যে ওকে ভালো লাগেনি তা নয়। তারপর আর কি? সাতদিনের মাথায় সকাল বিকাল দুবেলা ধর্ণা দিয়ে রাশেদ হাসনাকে বউ করে ঘরে তুলে।
তবে ওর বাবা রায়হান মাস্টার রাজী ছিলেন না। মাস্টার রায়হান মিয়া মানুষ চিনতে ভুল করেননি। মেম্বার যেদিন প্রস্তাব নিয়ে হাসনার বাপের কাছে আসলো,হাসনার বাপ সাথে সাথে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলো। কারণ হিসাবে বলেছিলেন,মেয়েকে তিনি আরো লেখাপড়া করাবেন। এতে অবশ্য হাসনার মা আসমা বেগম বলেছিলেন,
—জলে বাস করে আপনি কুমিরের সাথে লড়াই করে টিকতে পারবেন? ঘরে বয়ে মেম্বার সাহেব প্রস্তাব নিয়ে এলেন আর আপনি মুখের উপর না করে কাজটা ভালো করেন নাই।
—-ভালো মন্দ বুঝি না,তবে মেম্বার মানুষটা তো ভালো না। গরীব মানুষের মেহনত, তাদের হকের চাল গম সব চুরি করে মেম্বার তার পাহাড় সমান সম্পদ বানিয়েছে। আর সেই অবৈধ টাকা ছেলেও দুই হাতে উড়ায়। কারণ তার থেকে তার ছেলে আর এক কাঠি সেয়ানা। বাপের অবৈধ ইনকাম আছে দেখে নিজে কোনো রোজগার করে না। বরং নেশা করে খারাপ জায়গায় আসা যাওয়া করে বাপের অসৎ টাকার সদ্বব্যবহার করে। তারই বন্ধু ঐ ছেলে সে আর কতো ভালো হবে।
অমত থাকা সত্বেও মেম্বারের চাপে পড়ে রায়হান মিয়াকে এই বিয়েতে রাজী হতে হয়। কেননা একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে মেম্বারের সাথে দেখা হয়। সেদিন মেম্বার বলেছিলো,
—-রায়হান মাস্টার প্রস্তাবটা আর একবার ভাইবা দেইখো। ধরো মেয়েকে যদি তুলে নিয়ে যায় তারপর যদি বিয়ে না করে তখন তুমি কি করবা। এখনকার যুগের পোলাপাইনের হাল হকিকত বুঝা মুশকিল। তাছাড়া ঐ ছেলে যে তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে এ তোমার সাত পুরুষের ভাগ্য। ছেলের বাজারে দুটো আড়তের দোকান আছে। বাড়ি পাকা দালান,পুকুর আছে, নানা ফলফলাদির গাছ আছে। জমি জিরোত আছে। সারাবছর ওদের ধান কেনা লাগে না। পাশাপাশি তোমার ঐ ভিটে বাড়ীখান ছাড়া আরতো কিছু নাই। এখন তুমি সিদ্ধান্ত নাও কি করবা?
এরপর রায়হান মাস্টার অনিচ্ছা সত্বেও রাশেদের সাথে হাসনাকে বিয়ে দিতে বাধ্য হন। উনি অবশ্য একটু ভয়ও পেয়েছিলেন। হাসনা কত শত স্বপ্ন দুচোখে ধারণ করে রাশেদের ঘরে এসেছিলো। বিয়ের পর ছ’মাস সময় ভালো কেটেছে। রাশেদ অবশ্য বাচ্চা আরো পরে নিতে চেয়েছিলো। এ কারণে আরশি পেটে আসার পর রাশেদ অ্যাবরশন করাতে চেয়েছিলো। হাসনা রাজী হয়নি। ওর কথা হচ্ছে যে এসে গিয়েছে তার দুনিয়াতে আসার পথ রুদ্ধ করার কোনো অধিকার ওর কিংবা রাশেদের নেই। রাশেদ মুখে কিছু না বললেও আচরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলো ওর কথা না শুনার ফল কতটা কঠিন হতে পারে। এরপর থেকে রাশেদ বদলে যেতে থাকে। হাসনার শরীরে পানি আসে পেটটাও দিনে দিনে স্ফীত হতে থাকে। রাশেদও আস্তে আস্তে দূরে সরতে থাকে। হাসনার তখন খুব অবাক লাগতো। ওর গর্ভের বাচ্চাটা তো রাশেদের। কোথায় ওর খুশী হওয়ার কথা। জগতের কতো নিঃসন্তান দম্পতি একটা সন্তানের জন্য আল্লাহপাকের কাছে অঝোরে কাঁদতে থাকে। আর এরা না চাইতেই পেয়ে গিয়েছে।
আজ হাসনার মনে হয় রাশেদকে ওর বাবা ঠিক চিনেছিলো। হাসনাও দিনে দিনে মানুষ চিনে তার অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করেছে। হাসনার আটাশ বছরের জীবনে মানুষের আঘাতে বুকের ভিতর দ্রোহের আগ্নেয়গিরি তৈরী হয়েছে। যা থেকে প্রতিনিয়ত বেদনার লাভা উদগীরণ হয়। জীবনের চাইতে প্রেম বড় নয়। হাসনার কাছে প্রেম হচ্ছে ঘাসের ডগার উপরে এক ফোটা শিশির বিন্দু। রোদ উঠার সাথে সাথে যা হওয়ায় মিলিয়ে যায়। তখন শুধু পড়ে থাকে আগুন ভরা আকাশ। সেই আগুনের দহনে সারাজীবন দগ্ধ হতে হয়। আগুনে পুড়ে যেমন সোনা খাঁটি হয় তেমনি জীবনের দহনে পুড়ে মানুষও খাঁটি হতে থাকে। হাসনাও আজ একজন খাঁটি মানুষ। সে শিখেছে কি করে শক্ত মাটির উপর দাঁড়াতে হয়। আর অন্তরের কঠিন বাস্তবতার আলোকে চারপাশের মানুষগুলো ভালোভাবে চিনে নিজের পথকে সুদৃঢ় করার চেষ্টা করে। এরমাঝে একদিন জামশেদ এসেছিলো। হাসনার কাছে টাকা চুরির জন্য মাফ চেয়েছিলো। হাসনার এখন তাতে কিছু যায় না। ও বাড়ির সাথে ওর সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছে। রাশেদের আড়ত জামশেদ দেখাশোনা করে। কারণ রাশেদ এখন ভীষণ নেশাগ্রস্ত থাকে।
মানুষ নিজের অহঙ্কার বলে চারপাশের মানুষকে প্রতিনিয়ত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে থাকে। তারপর কখন যে নিজের মিথ্যা অহঙ্কারের পাঁকের মধ্যে আটকে পড়ে সে জানে না। কিন্তু যখন বুঝতে পারে তখন আর সময় থাকে না। রাশেদের ক্ষেত্রে এমনটাই হয়েছে। নাহ্ ও আর বিষাক্ত অতীতকে সামনে আনতে চায় না।
সামনের শুক্রবার হাসনার খালাতো বোনের বিয়ে। ওদের বাড়ি রংপুর শহরের প্রানকেন্দ্র কামালকাছনায়। ওরা বেশ বড়লোক। হাসনাদের বিপদে আপদে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে এই খালা পাশে এসে দাঁড়ায়। খালু ঠিকাদারী করে। বর্তমান রাজনীতির সাথে জড়িত আছে বলে ঠিকাদারী ব্যবসাটাও ফুলে ফেঁপে উঠেছে। কামালকাছনায় বেশ অনেকটা জায়গাজুড়ে দোতলা বাড়ী। হাসনার দুটো মামা। ওরা বগুড়া শহরে থাকে। ওরাও হয়তো আসবে। একজন ওকালতি করে। আর একজন পুলিশের এসআই। ওদেরও বেশ আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে। একমাত্র হাসনার বাবার আর্থিক সচ্ছলতা কম। সে কারণে আত্মীয়স্বজন এড়িয়ে চলে। হাসনার বাবা ওর দাদা দাদীর পালক পুত্র ছিলো। উনাদের দীর্ঘ দশবছর সম্তান হয়নি দেখে হাসনার বাবাকে এতিমখানা থেকে নিয়ে আসে। তখন রায়হান মিয়া দুমাসের বাচ্চা। তবে রায়হান মিয়ার যখন চার বছর হয় তখন হাসনার দাদী গর্ভবতী হন। সেই থেকে রায়হান মিয়ার আদর কমতে থাকে। বিএপাশ করিয়েছে তবে কোনো সম্পদ দেয়নি। রায়হান মিয়াও চায়নি। নিজের যা আছে তাই নিয়ে সন্তষ্ট থাকার চেষ্টা করে।
এসব বিয়ে বাড়ীর হাঙ্গামায় হাসনার যেতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু খালা বার বার ফোন করে যেতে বলেছে। ওদিকে হাসেমও যেতে চাচ্ছে। ভাবছে জুয়াইরিয়াকে কি উপহার দেওয়া যায়। ও মনে মনে ঠিক করলো অনলাইন থেকে একটা জামদানী শাড়ি কিনে ফেলবে। তবে রায়হান মিয়া যেতে চাইছিলো না। কিন্তু হাসনা অনেক অনুরোধ করাতে রাজী হয়। তবে যেদিন বিয়ে হবে সেদিন রায়হান মিয়া যাবেন। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে সবাই ঐ দিনই ফিরে আসবে।
হাসনা ওর মায়ের জন্য অনলাইন থেকে একটা মিরপুরের কাতান শাড়ি অর্ডার করে। বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবী আর নিজের হাতে বানানো হ্যান্ড পেইন্ট করা সুতি শাড়ি সিলেক্ট করে। কারণ টাকার সংকট। এই কারণে নিজের জন্য কিছু কিনলো না। হাসেমের জন্য চার হাজার টাকা রেখে দিয়েছে। হাতে জমানো যা টাকা ছিলো সবই প্রায় এখন শেষের পথে। যাই হোক ওর মায়েরও অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় না। হাসনাও যেতে চায় না। সবাই ওর ডিভোর্সের প্রসঙ্গ তুলে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে। অন্য মানুষের জীবন নিয়ে কেন এতো কৌতুহল হাসনা বুঝে পায়না। অথচ হাসনার কারো জীবন নিয়ে কোনো কৌতুহল নেই। এই যে জুয়াইরিয়ার হাসবেন্ড কি করে একবারও খালার কাছে জানতে চায়নি।
নিদিষ্ট দিনে হাসনারা রংপুর শহরের কামাল কাছনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। বাস থেকে নেমে একটা অটো নিয়ে কামাল কাছনার দিকে যেতে থাকে। কামাল কাছনায় ফিরোজ ঠিকাদারের বাসা সবাই চিনে। যে অটোতে এসেছে সেই অটোওয়ালা ওদের নিয়ে ফিরোজ ঠিকাদারের বাসায় যায়। ভাড়া মিটিয়ে কলিং বেল টিপতেই দারোওয়ান দরজা খুলে দেয়। জানতে চায়
—-আপনারা কোথা থেকে আসছেন।
হাসনা বলে,
—-আমি এ বাড়ীর মালিকের বোনের মেয়ে।
কিন্তু ঐ লোক হাসনার আপাদমস্তকের দিকে তাকিয়ে বলে,
—-কোন বোন?স্যারের তো একটাই বোন। ঢাকায় থাকে।
হাসনা সাথে সাথে বলে
—ফিরোজ সাহেবের স্ত্রী আমার খালা হোন।
এতো জেরার মুখে দাঁড়িয়ে হাসনার বিরক্ত লাগছিলো। এমন সময় ওর খালা সায়মা বের হয়ে এসে বলে,
—-আরবআলী তুমি কার সাথে কথা বলছো?
—আপনার বোনের মেয়ে বলছে,
সায়মা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আসমা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলে,
—যাক, অবশেষে তোর আসা হলো।
এরপর হাসনার দিকে তাকিয়ে বলেন,
—,কেমন আছিস হাসনা?
—-আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি খালামনি।
—-,তুই তো বেশ সুন্দর হয়ে গেছিস। একদম আগের মতো।
বলে ওকেও জড়িয়ে ধরেন। সায়মা বেগমের পিছু পিছু আর মহিলা আসেন। উনি সায়মার ছোটো জা। উনি চট করে সায়মাকে বলেন,
—ভাবী এই মেয়েটা তোমার বোনের ডিভোর্সি মেয়েটা না?
সায়মা উনার দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড বিরক্ত বোধ করে বলেন,
—তুমি এখানে এসেছো কেন? ছাদে হলুদের ডেকোরেশন হচ্ছে। সেদিকটা তোমাকে দেখতে বললাম না?
একথা বলে হাসনার হাত ধরে টেনে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলেন। হাসনা অবশ্য এখন এসবে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। প্রায় দুবছর ধরে এই কথা শুনতে শুনতে নিজেকে এসবের সাথে মানিয়ে নিয়েছে।
চলবে