ফেরারী বসন্ত পর্ব-০৪

0
12

#বড় গল্প
#ফেরারী বসন্ত
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী

ডিভোর্সি শব্দটা আত্মীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশী সবার কাছে শুনতে শুনতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। যতই হাসনা নিজেকে এই বলে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করুক তাই বলে কি সান্তনা পাওয়া যায়? যায় না।বুকের মাঝখানটা মোঁচড় দিয়ে উঠে । কেননা যেই মানুষটা ওকে আঘাত করলো তার জন্য তো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তাহলে ব্যথাটা লাগে কেন? ব্যথা লাগার কারণটাও হাসনার অনুসন্ধান করেছে। যারা বলে তাদের বডিল্যাঙ্গুয়েজ,এবং কথা বলার ধরণ ভিকটিমকে আহত করে। ওর খালার জায়ের মুখে ডিভোর্সী কথা শুনে মায়ার অস্বস্তি লাগছে। সে কারণে হাসনা খালাকে জিজ্ঞাসা করে,
—খালামনি, জারা কোথায়?
—-দোতলায় ওর রুমে আছে। তুই ওর রুমে চলে যা। ও হয়তো এখনও জানে না তুই আসছিস।
হাসনা মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে। সাদা মার্বেলের সিঁড়ির রেলিংটা সেগুন কাঠের উপর সুন্দর ডিজাইন করা আর সিঁড়ির লাগোয়া দেয়ালটায় কারুকাজ খঁচিত ওয়াল পেইন্টিং টাঙ্গানো রয়েছে। আসলে টাকা থাকলে মানুষ তার রুচির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই এ বাড়ির হেল্পিং হ্যান্ড একটা তেরো চৌদ্দ বছরের মেয়ের সাথে দেখা হলো। তাকে জারার রুমটা হাসনা দেখিয়ে দিতে বলতেই দখিন দিকের কর্ণারের রুমটার দিকে নিয়ে যায়। ভিতরে ঢুকতেই হাসনা দেখে জারা কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। হাসনাকে ইশারা করে সোফায় বসতে বলে। এরপর ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিকে বলে,
—আমি তোমার সাথে পরে কথা বলবো। আমার একটা আপু এসেছে।
ফোনটা রেখে জারা দৌড়ে এসে হাসনাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
—-কতোদিন পর তোমার সাথে দেখা হলো আপু। কল্পনা করতে পারো দশ বছর পর তোমার সাথে আমার দেখা হলো।
হাসনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
—বিয়ের পর আর তোর সাথে আমার দেখা হয়নি। দেখা হবেই বা কি করে?নিজের বাবার বাড়িতে সকালে আসলে বিকালে ও বাড়িতে চলে যেতে হতো। তাও সংসারটা ধরে রাখতে পারলাম না। আর ডিভোর্সের পর এই প্রথম আমি তোর বিয়েতে আসলাম। গত দুবছর আমি বাসা থেকে বের হয়নি। সবাই কেমন যেন বাঁকা দৃষ্টিতে দেখে।
হাসনার কথা শুনে জারার ভীষণ মন খারাপ হয়। সে কারণে ও হাসনাকে বলে,
—এতো মন খারাপ করো না আপু। একটা কথা মনে রেখো ভুল মানুষকে ভালোবেসে সারাজীবন জ্বলে পুড়ে মরার থেকে একলা থাকার নীতিতে অটল থাকাটা নিজের জন্য মঙ্গল। সমাজ কি বলবে সেটা নিয়ে ভাবলে নিজেকে ভালো রাখা যাবে না। আর নিজেকে ভালো রাখতে না পারলে জীবনের সবকিছুতেই ভজঘট পাকিয়ে যাবে।
হাসনা কথার প্রসঙ্গ পাল্টাতে জারাকে বলে,
—তোর বরের কথা বল। মানুষটা কেমন? কোথায় জব করে?
জারা মুচকি হেসে বলে,
—এই মুহুর্তে মানুষটা আমার জন্য খুব হেল্পফুল। তবে সারাজীবন এমন যেন থাকে সে দোয়া করো। আর বিয়ের পর আমরা দুজনে আমেরিকা মাস্টার্স করতে যাবো। তুমি তো জানো আমি ঢাকা ভার্সিটি থেকে সিএসসি তে গ্রাজুয়েশন করেছি। পাভেলও আমার সাথে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। পিএইচডির চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পেলাম না। মাস্টার্সে পেয়েছি বিশ পার্সেন্ট স্কলারশিপ। আব্বুকে বাকিটা দিতে বললাম। প্রথমে রাজী না হলেও পরে যখন পাভেল ওর পরিবার থেকে মাস্টার্সে পড়তে যাওয়ার টাকা যোগাড় করলো তখন আব্বুও অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো করে রাজী হতে হলেন।
জারার কথা শুনে হাসনা ভাবে,ওদের জীবনটা রুপ কথার মতো মনে হয়। এদের কতো টাকা আছে কে জানে? বিদেশে মাস্টার্স করতে না হলেও কোটি টাকা লাগবে। জারা ওর মোবাইল থেকে পাভেলের ছবি বের করে হাসনাকে দেখিয়ে বলে,
—এই আমার হবু বর।
হাসনা অবাক হয়ে দেখে। এরপর জারার দিকে তাকিয়ে বলে,
—আমার রাজকন্যার মতো বোনকে নিতে এক রাজপুত্র এসেছে। মাশাআল্লাহ,খুব সুন্দর। তোদের জুটিটাকে বেশ মানিয়েছে।
জারা খুশী হয়ে বলে,
—সত্যি বলছো আপু?
এমন সময় কে যেন দরজায় নক করলো। জারা দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করে,
—কিছু বলবি?
—খালাম্মা ঐ আপুমনিকে খেতে ডাকছেন?
হাসনা কিছু বলার আগেই জারা বলে,
—তুই যা,আমি আপুকে নিয়ে আসছি।
হাসনা এক ফাঁকে উঁকি দিয়ে মেয়েটাকে দেখে। বেশ মায়াকাড়া চেহারা। মেয়েটার গায়ে যে জামাটা সেটাও হাসনার জামার থেকে দামী। বড়লোকের বাড়িতে কাজ করে তাই কাপড় ও পড়ে সে রকম। এই মেয়েটাই ওকে জারার রুমে পৌঁছে দিয়েছিলো। হাসনা জারার দিকে তাকিয়ে বলে,
—-মেয়েটার নাম কি?
—সালেহা,
—-চেহারাটা বেশ মিষ্টি। দেখে মনে হয়ে বেশ সচ্ছল ঘরের মেয়ে।
—হুম,আসলে আমার ফুটফরমাশগুলো ঐ করে দেয়। এই কারণে আমার জামা একটু পুরোনো হলে ওকে দিয়ে দেই। ও কেটে ছেঁটে নিজের মাপমতো করে নিয়ে পড়ে।
হাসনার অস্বস্তি হচ্ছে। কেউ চায়না নিজের দৈন্যতা অন্যের কাছে প্রকাশ করতে। হাসনা বার বার নিজের জামার দিকে তাকিয়ে দেখছে আর কুন্ঠা বোধ করছে। এমন সময় জারা এক অদ্ভুত কাজ করে বসে। হাসনার দিকে তাকিয়ে বলে,
—আম্মুর কাছে শুনেছিলাম তুমি আসবে। তোমাকে দেখার জন্য আমার চোখ দুটো অস্থির হয়ে উঠেছে। সেই ছোটোবেলায় যখন নানা নানী বেঁচে ছিলেন বছরে আমাদের একবার দেখা হতো। তখন মামাদের বিয়ে হয়নি। আমরা কতো আনন্দ করতাম। বেশীরভাগ সময়ে শীতকালে যেতাম। নানী কত ধরণের পিঠা বানাতো। জানো আপু আমি সেসব দিনগুলোকে খুব মিস করি।
এরপর জারা নিজের ক্লসেট থেকে দুই সেটা পাকিস্থানী লনের থ্রীপিচ বের করে হাসনার হাতে দিয়ে বলে,
—-ফ্রী সাইজ বানানো হয়েছে। মনে হয় তোমার হয়ে যাবে। তবে তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে।
হাসনা অবাক হয়ে বলে,
—কি,
—-আমি যে তোমাকে এই থ্রীপিচ দুটো দিয়েছি কাউকে বলবে না।
হাসনার চোখের পাতা ভিজে উঠলো। মাথা নাড়িয়ে বলে,
—ঠিক আছে কাউকে বলবো না।
—আপু,আম্মু তো খেতে ডাকছে। তুমি ওয়াশরুমে গিয়ে ড্রেস চেইঞ্জ করে এখান থেকে একটা থ্রীপিচ পড়ে নাও। লাঞ্চের সময় পার হয়ে যাচ্ছে।
হাসনা ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে ড্রেস চেইঞ্জ করে বের হয়ে এসে জারাকে বলে,
—সিতারাকে দেখছি না,ও কোথায়?
—-ঢাকা থেকে এয়ারে করে রওয়ানা দিয়েছে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে।
এরপর হাসনাকে নিয়ে জারা খাবার টেবিলে এসে বসে। জারার মা হাসনার গায়ে নতুন চকচকে থ্রীপিচ দেখে একটু অবাক হয়। বেশী অবাক হয় জারার চাচী রুবিনা বেগম। নিজের কৌতুহল দমন করতে না পেরে হাসনাকে বলে,
—এই জামাটা কি জারা তোমাকে গিফট করলো?
হাসনা কিছু বলার আগেই জারা বলে,
—তোমার একথা কেন মনে হলো চাচী? আপু নিজেও তো কিনে আনতে পারে। এভাবে বলা ঠিক না।
রুবা সাথে সাথে বলে,
—জিজ্ঞাসা করা কি অপরাধ? ঠিক আছে হাসনাকে কিছু বলতে হবে না।
হাসনার মা ইতি উতি করে বলে,
—-এখানে আসার আগে হাসনা অনলাইন থেকে অনেক কেনা কাটা করেছে।
রুবার উপর সায়মার ভীষণ রাগ হচ্ছে। বিয়ে বাড়ী বলে কথা। সে কারনে রুবাকে কিছু বলতে পারছে না।
খাওয়া শেষ করে সায়মা ওর বোনকে ডেকে নিয়ে নিজের রুমে আসে। দরজাটা লক করে আলমারী খুলে সায়মার কিছু পুরোনো শাড়ি বের করে দিয়ে বলে,
—আপা,তুমি এখান থেকে কিছু শাড়ি বেছে নিতে পারো, দেখো না রুবাটা কেমন করে তোমাদের দিকে লক্ষ্য রাখছে।
আসমা একটু কষ্ট পায়। মনে মনে বলে, ওর বোনের তো টাকার অভাব নেই। মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে একটা নতুন শাড়ি কিনে দিতে পারতো। যদিও সায়মার শাড়িগুলো খুব বেশী পুরোনো নয়। অন্য সময় হলে আসমা নিতে অস্বীকৃতি জানাতো না। কিন্তু নিজের মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে পুরোনো শাড়িগুলো না সাধলেই ভালো হতো। সে কারণে সায়মাকে বলে,
— এখানে আসার উপলক্ষ্যে হাসনা আমাকে কিছু শাড়ি কিনে দিয়েছে। তোকে আর আমার শাড়ি নিয়ে ভাবতে হবে না।
মনে মনে আসমা বেগম কষ্ট পান। কিন্তু প্রকাশ করেন না। সায়মার অবশ্য সেদিকে হেলদোল নেই। সায়মা একটু মন খারাপ করে। তারপরও বোনকে বলে,
—তোমার জন্য নাইবা নিলে কিন্তু হাসনার জন্য ক’টা বেছে নিতে পারতে। মেয়েটার পুরো জীবন পড়ে আছে। ওকে আবার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তখন এই শাড়িগুলো ওর কাজে লাগবে।
—সেটা পরে ভাবা যাবে।
দরজা নক করার শব্দে সায়মা দ্রুত শাড়ি কাপড়গুলো ভাঁজ করে ক্লসেটে তুলে রাখে। এরপর দরজা খুলতেই সিতারা বলে,
—দরজা লক করে কি করছো?
—তেমন কিছু না,তোর বড় খালার সাথে কথা বলছিলাম।
সিতারা আসমার দিকে তাকিয়ে সালাম দিয়ে বলে,
—-খালামনি কেমন আছো?
—-আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। সবাই তোরা বড় হয়ে গেলি। তুই কিসে পড়ছিস?
—-ঢাকা ভার্সিটিতে ল’তে পড়ছি। তুমিও তো আমাদের বাসায় আসো না। শেষ কবে দেখা হয়েছে মনেও পড়ছে না।
—-তোরাও গরীব খালামনির বাসায় যেতে পারিস,
—-আসলে লেখাপড়া নিয়ে এতোদিন ব্যস্ত ছিলাম। নানী মারা যাবার পর ওদিকটায় আর যাওয়া হয়নি। হাসনা আপু কোথায়?
—-জারার সাথে গল্প করছে।
সিতারা হাসনার সাথে দেখা করতে জারার রুমে গেল। হাসনাকে দেখেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলে,
—দশ বছর পর তোমার সাথে দেখা হলো।
—-হুম,তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস। সুন্দরী হয়েছিস।
—-তুমিও তো এখনও বেশ সুন্দরী।
জারা সিতারার দিকে তাকিয়ে বলে,
—গল্প পরে করিস। এখন ফ্রেস হয়ে ভাত খেয়ে নে।
—-ওকে,বুঝতে পারছি আমি থাকলে তোমাদের দুজনের গল্পে ব্যাঘাত ঘটবে। ঠিক আছে আমি ফ্রেস হয়ে আসছি। সে পর্যন্ত হাসনা আপু তোমার জিম্মায় থাকুক।
সিতারা চলে যাবার পর জারা বলে,
—আপু আজকাল এতো ডিভোর্স হয় সেকারণে বিয়ে করতে ভয় হয়। কিন্তু আব্বু একা একা দেশের বাইরে যেতে দিবে না। অগত্যা পাভেলকে বিয়ে করতে হলো।
হাসনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
—সবার ভাগ্য তো এক হয় না। তাছাড়া তোর মুখে শুনলাম,পাভেল তোকে চোখে হারায়, তাছাড়া তোদের পাঁচ বছরের জানাশোনা আছে। আল্লাহর রহমতে সব ভালোই হবে।
হাসনার মনে পড়ে রাশেদ বিয়ের পর ওকে বলেছিলো,
“তুমি সারাজীবন আমার পাশে থেকো। তুমি পাশে না থাকলে আমার বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।” মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে হাসনা বলে, “আমাকে ছাড়া রাশেদ দিব্যি বেঁচে আছে। যতটুকু আরশির কাছে শুনেছি ওর লাইফ সাপোর্টের দরকার পড়েনি।”

চলবে