#বড় গল্প
#ফেরারী বসন্ত
পর্ব-আট
মাহবুবা বিথী
বাসর রাতে বউয়ের সাথে প্রেমালাপ বাদ দিয়ে আগের ঘরের বাচ্চার জন্য ডায়াপার ধরিয়ে দিয়ে বরবাবু গায়েব হয়ে যান আজকাল এরকম ঘটনাও ঘটে থাকে। এসব ভেবে হাসনা মনে মনে অবাক হয়। বিয়েটা এতো তাড়াতাড়ি হয়ে গেল যে হাসনা নিজের মতামত থেকে শুরু করে কোনোকিছুই জানাতে পারেনি। এছাড়া ওর মতামতের গুরুত্ব কে দিবে? তাছাড়া রাজের সাথে দুএকবার ওর দেখা হয়েছে। এতে ওর মনে হয়েছে মানুষটা বেশ রসকষহীন। এরকম একটা মানুষের সাথে ওকে সারাজীবন কাটাতে হবে ভাবতেই বুকের ভিতরটা চিন চিন ব্যথা করে উঠে। মনে মনে ভাবে, ওর জীবনটা কেন অন্য সবার মতো স্বাভাবিক নয়। আর বিয়ে না করেও উপায় ছিলো না।
হাসেম পড়ালেখা শেষ করে চাকরি পাওয়ার সাথে সাথে বিয়ে করবে। তখন আবার থাকা নিয়ে সমস্যা হবে। ওদের দুটো বেডরুম একটা ড্রইংরুম। সেখানে একটা খাট রাখা আছে। হাসেম আপাতত সেই খাটে ঘুমায়। ক্যাটারিং এর কাজটা হাসনা করে কিন্তু সবসময় এই বিজনেসটা ভালো যায় না। কোনো মাসে প্রচুর ইনকাম হয় আবার কোনো মাসে হয় না। মফস্বল শহরে অফিস আছেই বা কয়টা। তার উপর সবাই খাবার অর্ডার দেয় না। যারা পরিবার নিয়ে থাকে তাদের খাবারের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। ওদিকে আরশি বড় হচ্ছে। মেয়ে নিয়ে ওর বাবার কোনো হেলদোল নেই। হাসনা মনে মনে ভাবে,রাজকে ও আরশির কথা জানাবে। নিজের মেয়েকে যেহেতু এতো ভালোবাসে সে কারণে আরশির দুঃখ টা রাজ বুঝবে। সারা রাত রাজ এঘরে আসেনি। একসময় হাসনা দরজা ভেজিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে। কেন যেন দুচোখে ঘুম আসতে চাইছে না। হয়তো জায়গা চেইঞ্জ হওয়াতে চোখে ঘুম আসছে না। এদিকে মাঝরাতে সায়েরার শরীর কেঁপে জ্বর আসে। হাসনার আর ঘুম হয় না। রাত জেগে জলপট্টি দিতে থাকে। হাসনার কেন যেন মনে হয় রাজ নিজের ইচ্ছাতে ওকে বিয়ে করেনি। মায়ের চাপে পড়ে ওকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে। আবার ও অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠে। এদিকে মেয়েটার তীব্র জ্বর। হাসনার খুব চিন্তা হয়। যদি মেয়েটার ভালো মন্দ কিছু হয়ে যায় রাজ তো ওকে ছেড়ে দিবে না। ভোরের দিকে সায়েরার জ্বর ছেড়ে যায়। এদিকে বউ হওয়ার চাপ তার সাথে রাত জেগে রুগীর সেবা করে ক্লান্তিতে হাসনার চোখ বুজে আসে। এদিকে সারারাত মেয়ের কোনো সাড়া না পেয়ে খুব ভোরে রাজ হাসনার রুমের দরজায় এসে নক করে। কিন্তু হাসনার কোনো সাড়া না পেয়ে দরজা ভেদ করে রুমে প্রবেশ করে। টেবিলে প্লাস্টিকের বোলে পানি তার মধ্যে তোয়ালে ভেজানো দেখে অবাক হয়। এছাড়া একটা অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে রাজের চোখে পানি এসে যায়। সায়েরা হাসনার গলা জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। ওর মনে হয় রাজ যতই সায়েরাকে ভালোবাসুক সেটা সবসময় বাবার ভালোবাসাই হবে। মায়ের ভালোবাসা একমাত্র নারীরাই দিতে পারে। এটা নারীর স্বকীয়তা। আর হাসনার নিস্পাপ মুখশ্রী দেখতে রাজের অনেক ভালো লাগে। মেয়েটাকে বিয়ের আসরে সেভাবে ও দেখেনি। দেখবে কিভাবে? আট বছরের প্রেম যখন বিয়ের একবছরেই ফিকে হয়ে যায় তখন একটা অজানা অচেনা মেয়ে কিভাবে ওর এতোটা আপন হবে। পানির বোলটা সরাতেই শব্দ হয়। হাসনার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম ভাঙ্গতেই রাজকে দেখে চমকে উঠে। প্রথমে ঘুমের ঘোর থাকায় রাজকে চিনতে পারে না। রাজ মনে হয় হাসনার অবস্থা বুঝতে পেরেছে। সে কারণে বলে,
–দরজা নক করেছিলাম,কিন্তু তোমাদের কারো সাড়া না পেয়ে টেনশন হচ্ছিলো। সে কারণে রুমে আসলাম।
হাসনা ওড়নাটা শরীরে ভালো করে পেঁচিয়ে বিছানা থেকে নেমে যায়। নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে নিয়ে বলে,
—সায়েরার হঠাৎ মাঝরাতে জ্বর এসেছিলো।
কথাটা শোনা মাত্রই বিছানায় বসে রাজ সায়েরার কপালে ব্যতিব্যস্ত হয়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
—আমাকে ডাকোনি কেন? যদি আমার মেয়েটার কিছু হয়ে যেতো?
এমনসময় সায়েরার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মাম্মি মাম্মি বলে হাসনাকে ডাকতে থাকে। হাসনা বিছানায় ওর পাশে বসে বলে,”এই তো আমি।”
রাজ ভীষণ অবাক হয়। একরাতের মধ্যেই মেয়েটা হাসনাকে এতোটা আপন করে নিলো। রাজের উত্তেজিত হয়ে কথা বলার আওয়াজে মরিয়ম বেগম ঘরে আসেন। এরপর রাজের দিকে তাকিয়ে বলেন,
—কি সমস্যা? এভাবে উত্তেজিত হয়ে কথা বলছো কেন?
—দেখোনা আম্মু রাতে সায়েরার জ্বর এসেছিলো অথচ আমাকে জানায়নি।
হাসনা ইতস্তত করে বলে,
—আসলে অত রাতে আমি বাড়ির সবার ঘুম ভাঙ্গাতে চাইনি। কেননা বিয়ে বাড়ীর চাপে এমনিতেই বাড়ীর মানুষগুলো খুব ক্লান্ত ছিলো। তাছাড়া জলপট্টি দেওয়ার সাথে সাথে জ্বরটা কমে যায়। সে কারণে ডাকিনি।
হাসনার কথা শুনে মরিয়ম বেগম রাজের দিকে তাকিয়ে বলেন,
—-ওতো ঠিক কাজই করেছে। তুমি শুধু শুধু ওর উপর রাগ করছো,
—-রাগ করছি না। তুমি তো জানো আমি সায়েরার ব্যাপারে খুব সেনসেটিভ।
একথা বলেই রাজ রুম থেকে বের হয়ে যায়। মরিয়ম বেগম হাসনার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
—রাজের কথায় কিছু মনে করো না। দীর্ঘ আট বছরের সম্পর্কে যখন বিয়ের একবছরে ভেঙ্গে যায় তখন থেকেই আমার সদালাপী হাস্যোজ্জ্বল ছেলেটা বদলে যেতে থাকে। তবে আমার বিশ্বাস তুমি যদি ওকে ভালোবাসা দাও তাহলে ও আবার পূর্বের অবস্থানে ফিরে আসবে। তুমি হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নাস্তা খেতে আসো।
মরিয়ম বেগম চলে যাবার পর হাসনা মনে মনে ভাবে,ভালোবাসা কাউকে জোর করে দেওয়া যায় না। ভালোবাসা নেওয়া জন্য মন থাকতে হয়।
নাস্তা করেই হাসনা সায়েরাকে নিয়ে রুমে চলে আসে। সায়েরার শরীরটা আবারও একটু গরম করছিলো। রাজদের ফ্যামেলি ডাক্তার এসে সায়েরাকে দেখে যায়। দুদিন সায়েরাকে নিয়ে হাসনার প্রচন্ড ব্যস্ত থাকতে হয়। সায়েরার প্রতি হাসনার যত্ন দেখে রাজের দাদী আমেনা বেগম অবাক হয়ে হাসনাকে বলে,
—নিজের সন্তান নয় তারপরও সায়েরার প্রতি তোমার ভালোবাসা দেখে অবাক হলাম।
হাসনার চোখ দুটো ভিজে উঠে। মনে মনে বলে আমি ওর মাঝে আমার আরশিকে খুঁজে চলেছি।
জারা এসে একবার হাসনার খোঁজ খবর করে যায়। বাড়ীর সবাই এসে সায়েরাকে দেখে যাওয়ার পর মরিয়ম বেগম এসে হাসনাকে বলেন,
—যদিও কথাটা তোমার ব্যক্তিগত তারপরও জিজ্ঞাসা করছি। তুমি আবার কিছু মনে করো না।
হাসনা মনে মনে অবাক হয়ে মরিয়ম বেগমকে বলে,
—আপনি নিশ্চিন্তে বলতে পারেন মা।
—রাজ কি আজকে এঘরে ঘুমায়নি?
হাসনা লজ্জায় সংকুচিত হয়ে বলে,
—মা,এসব বিষয় নিয়ে আপনি ভাববেন না। বউ যখন হয়েছি তখন আর আমাকে কতদিন দূরে ঠেলে রাখবে?
মরিয়ম বেগম চিন্তিত হয়ে বলেন,
—স্বামীর রাশ টেনে রাখতে হয়। কখনও এই বিষয়টাকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। কথাটা সারাজীবন মনে রাখবে।
হাসনা মাথা নাড়িয়ে বলে,
—আপনার এইকথাগুলো আমার সবসময় মনে থাকবে।
হাসনা মনে মনে ভাবে,এখনি সুযোগ আরশির কথাটা মরিয়মবেগমকে জানিয়ে দিতে হবে। হাসনা যখনি কথার বলার জন্য প্রস্তুত হয় তখন কে যেন দরজা নক করে? মরিয়ম বেগম সাথে সাথে বলে,
—কে?
–আম্মু আমি,
রাজের গলার সাউন্ড পেয়ে মরিয়মবেগম রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় রাজকে বলেন,
—সায়রাকে নিয়ে এতো ভেবো না। হাসনা খুব যত্নশীল একজন মানুষ।
মায়ের কথা শুনে রাজ একটু লজ্জিত হয়। আসলে সকালে হাসনার সাথে ওরকম ব্যবহারটা করা ঠিক হয়নি। মরিয়ম বেগম ঐ স্থান ত্যাগ করার সাথে সাথে রাজ রুমের ভিতরে আসে। ওকে দেখে হাসনার খুব বলে বিরক্ত লাগে। কারণ আরশির কথাটা বলার সুযোগটা হারিয়ে গেল। কিন্তু রাজকে কিছু বুঝতে দিলো না। রাজ হাসনার দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে,
—,এটা তোমার।
হাসনা অবাক হয়ে বলে,
—এতে কি আছে?
—তোমার কাবিনের টাকাগুলো সব এতে রাখা আছে।
হাসনা বেশ অবাক হয়। যতটুকু জানে পাঁচলাখ টাকায় ওর কাবিন হয়েছে। জীবনে যেখানে একলক্ষ টাকা ও কখনও দেখেনি সেখানে একসাথে পাঁচলক্ষ টাকা হাতে পেয়ে হতবিহ্বল হয়ে গেল। রাজ বুঝতে পেরে বলে,
—-এটা আমাদের পরিবারের নিয়ম। বাসর রাতেই স্ত্রীর হাতে তার কাবিনের টাকা বুঝিয়ে দিতে হয়। আমিই বরং একদিন দেরী করে ফেললাম।
হাসনা ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
—টাকাগুলো আমি রাখবো কোথায়? এর থেকে বরং আপনার কাছেই থাকুক। আমার প্রয়োজনের সময় চেয়ে নিবো।
—তোমাকে আমার ক্লসেটের চাবিটা দিয়ে দিচ্ছি। তুমি বরং ওখানে রেখে দাও। পরে তোমার একাউন্টে জমা দিয়ে দিও।
একথা বলে রাজ চাবিটা টেবিলের উপর রেখে দেয়। এরপর হাসনার দিকে তাকিয়ে বলে,
—সকালের ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত।
হাসনা বিনয় নিয়ে বলে,
—আমি আপনার অবস্থা বুঝতে পেরেছি। কিছু মনে করেনি। সন্তানের কিছু হলে বাবা মায়ের কত কষ্ট হতে পারে এই উপলব্দি বোধ আমার আছে।
হাসনার কথা শুনে রাজ কিছুটা অবাক হয়। কেন যেন মনে হয় হাসনার ও সন্তান আছে। তা,না হলে এতো সুন্দর করে সায়েরার যত্ন করতে পারতো না। একবার ওর মনে হলো হাসনাকে জিজ্ঞাসা করা উচিত। পরমুহুর্তে ভাবে সন্তান থাকলে তো আম্মু ওকে বলতো। তা,ছাড়া ওতো আম্মুকে বলেছিলো,ডিভোর্সি হতে হবে তবে সন্তান থাকা যাবে না। এতে ওর সায়েরার অযত্ন হবে।
চলবে