#বড় গল্প
#ফেরারী বসন্ত
পর্ব-তেরো
মাহবুবা বিথী
হাসেম সিতারাকে নিয়ে ভীষণ বিপদে পড়ে। এখন এই মেয়েকে সে রাখবে কোথায়? আর হোটেলে রাখতেও ভয় হয়। যে আগুনে রুপ সিতারার কিভাবে সামলে রাখবে? তারউপর মাঝে মাঝে এসব হোটেলগুলোতে পুলিশের রেইড হয়। হাসেম মনে মনে সিতারার উপর ভীষণ বিরক্ত হয়। এভাবে ওকে বিপদে ফেলার মানেটা কি? সিতারা জানে হাসেম খুব গোবেচারা টাইপের ছেলে। সে কারণে ও আর রিস্ক নিতে চায় না। যা সিদ্ধান্ত নেবার ওকেই নিতে হবে। এই জন্যই এভাবে ওকে না জানিয়ে চলে এসেছে। তা,না হলে এই ছেলে দেখা যাবে নিজের ভালোবাসার মানুষের বিয়ে হয়ে যাবে তাও মুখ দিয়ে কোনো শব্দ করবে না। তা,ছাড়া উনি তো আবার ভালো রাঁধতে জানেন। দেখা যাবে প্রেমিকার বিয়ের রান্নার দায়িত্ব উনি নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে মাহাত্ব্য দেখাবেন। ওদিকে ওর দশা হবে বেহাল। ওর পক্ষে সম্ভব নয় হাসেম ছাড়া অন্য কাউকে নিজের জীবন সঙ্গিনী হিসাবে গ্রহন করা। হাসেমকে চুপচাপ দেখে সিতারা বলে,
—-হাসেম ভাই,আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
হাসেম সিতারার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে,
—কি সিদ্ধান্ত?
—-আজ আমাদের দুজনের বিয়ে হবে।
সিতারার কথা শুনে হাসেম ভীষণ চমকে উঠে। হয়তো মাথায় বাজ পড়লেও এতো চমকাতো না। সিতারা হাসেমের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
—আপনি শুধু দুজন স্বাক্ষী যোগাড় করবেন।
হাসেম এবার প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বলে,
—এখানে স্বাক্ষী পাবো কোথায়? তাছাড়া আমার পক্ষে তোমাকে এভাবে বিয়ে করা সম্ভব নয়। খালা খালুর মনে আমি কষ্ট দিতে পারবো না। উনারা আমার বাবা মায়ের সমতুল্য।
—-বাবা মা তো নন। তাছাড়া এই বিষয়টা আপনি আমার উপর ছেড়ে দেন।
—ছেড়ে দেওয়া বললে তো ছেড়ে দেওয়া যায় না। তোমার দায়িত্ব নেওয়ার মতো যোগ্যতা আমার এখনও হয়নি।
—আমি আপনাকে বিয়ে করতে বলেছি। দায়িত্ব নিতে বলিনি। আলহামদুলিল্লাহ,আমার দায়িত্ব আমি নিজেই বহন করতে পারবো।
এদিকে হাসেমকে একটা সুন্দরী মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখে গেটের দারোয়ান জহির আড়চোখে ওদের দেখছিলো। রাতের আলো আঁধারীতে সিতারার চোখে ধরা পড়ে। সেদিকে তাকিয়ে সিতারা হাসেমকে বলে,
–ঠিক আছে,আপনাকে স্বাক্ষী যোগাড় করতে হবে না। আমিই যোগাড় করে নিচ্ছি।
একথা বলে সিতারা গেটের দিকে হাঁটতে থাকে। দূর থেকে জহিরকে ডাকতে থাকে। এবার হাসেম ভয় পেয়ে যায়। জহির জানতে পারলে মুহুর্তে পুরো হলে এই খবর ছড়িয়ে পড়বে। শেষে হল প্রভোস্টের কানে গেলে কি বিপত্তি ঘটবে কে জানে? হাসেম দৌড়ে এসে সিতারাকে বলে,
—ঠিক আছে,স্বাক্ষী আমি যোগাড় করবো। কিন্তু মনে রেখো বিয়ে কোনো ছেলে খেলা নয়। এভাবে বিয়ে না করে বরং তোমাকে আমি কামালকাছনায় পৌঁছে দিয়ে আসি। তারপর দুই পরিবারকে ম্যানেজ করে আমরা বিয়েটা পরেও করতে পারবো।
—আমাকে আপনার কি মনে হয়? আমি কি কচি খুকী? আর বোঝানোর সময় নেই। কাল যে ছেলে আমাকে দেখতে আসছে সে আব্বুর ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ছেলে। ছেলে মনোবসু স্কলারশিপ পেয়েছে। সাস্ট থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিযারিং এর উপর গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। সুতরাং বিয়ে করে চলে যাবে। তারপর ছ’মাস পর এসে আমাকে নিয়ে যাবে।
—-আমার মনে হয় তোমার সেখানেই বিয়ে করা উচিত।
—এটা আপনার ভাবনা,আমার নয়। আমার ভাবনা আমি ভেবে নিয়েছি। ভালোই ভালোই বিয়েতে রাজি হয়ে যান। তা,না হলে আমি অন্য কাহিনী করবো।
হাসেম কিছুতেই সিতারাকে বুঝাতে পারলো না। অবশেষে ওর প্রস্তাবে বাধ্য হয়ে রাজী হতে হলো। হাসেমও সিতারাকে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু এটাও তো সত্যি সিতারাদের সামাজিক মর্যাদা হাসেমদের থেকে বহুগুন বেশী। তাছাড়া ওদের বিপদে আপদে খালা সবসময় পাশে দাঁড়িয়েছে। সেখানে ও যদি সিতারাকে এভাবে বিয়ে করে তাহলে খালা খালু কষ্ট পাবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। আবার সিতারাকে ফিরিয়ে দিলে ও যদি কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলে তাহলে নিজেকে ও কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে না।
—কি ভাবছেন? এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে? বিয়ের শপিং করতে হবে না।
—এতো রাতে দোকান খােলা পাওয়া যাবে?
—-কাজী অফিস খোলা আছে তো? বিয়ে না করে আমি এখান থেকে যাবো না।
অগত্যা হাসেম ওর রুমমেট আরিফ আর সজলকে ডেকে আনে। তারপর কাজী অফিসে গিয়ে বিয়েটা সেরে ফেলে। সিতারা হাসেমের দুই বন্ধুর হাতে মিষ্টি খাওয়ার টাকা গুঁজে দেয়। ওরা চলে যাওয়ার পর সিতারা হাসেমকে অবাক করে দিয়ে বলে,
—আমি এখন হাসনা আপুর বাসায় যাবো। আর একটা কথা,
—-বলো,
—-বিয়ে করেছি বলে ভেবে নিয়েন না এখনি বাসরঘর করবো। যেদিন আপনি আমার প্রস্তাব নিয়ে আমার বাবা মায়ের সামনে দাঁড়াবেন একমাত্র তখনি আমি আপনার জন্য বাসর সাজিয়ে অপেক্ষা করবো।
—ঠিক আছে চলো।
হাসেম সিতারাকে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে আসে। আগমনি এসি বাসের রাত বারোটার টিকিট কেটে নেয়। দুটো টিকিট কাটতে দেখে সিতারা বলে,
—আপনার যাওয়ার দরকার ছিলো না। আমি একাই যেতে পারতাম।
—-কেন আমি সাথে গেলে সমস্যা?
—-,সমস্যা হবে কেন? এতোক্ষন তো আমাকে বিয়েই করতে চাননি। এখন আবার পাশে বসে যেতে চাচ্ছেন।
—অবশ্য আপু ভীষণ খুশী হবে। আপু কনসিভ করেছে।
—-এতো ভীষণ খুশীর খবর।
হাতে এখন আধ ঘন্টা সময় আছে। হাসেম সিতারাকে নিয়ে বাসস্টান্ডের পাশেই একটা হোটেলে পরোটা আর কলিজা ভুনা খেয়ে নেয়। পরোটা মুখে তুলে সিতারা মনে মনে হাসতে লাগলো। হাসেম ওকে ঠোঁট টিপে হাসতে দেখে জিজ্ঞাসা করে,
—-হাসছো কেন?
—না,মানে অনেকে বিয়ে করে রোস্ট পোলাও খায় আর আমি খাচ্ছি পরোটা আর গরুর কলিজা ভুনা। অবশ্য মনে মনে এটাকেই রোস্ট পোলাও ভেবে খেয়ে নিচ্ছি।
—-তাহলে আর দুঃখ করে লাভ নেই।
—-দুঃখ করছি নাতো বরং একটা থ্রীল অনুভব করছি।
হাসেম মনে মনে বলে, আমাকে বিপদে ফেলে উনি থ্রীল অনুভব করছেন।
খাওয়া শেষ করে দু’জনে বাসে উঠে বসে। বাস চলতে শুরু করে। সিতারা মনে মনে ভাবে, কেন যে হাসেম ভাইকে ওর এতো ভালো লাগে ও জানে না। হয়তো এর নিদিষ্ট কোনো কারণ নেই। বরং প্রেমের ক্ষেত্রে মানুষটা প্রচন্ড ভীতু টাইপের। এক্ষেত্রে মেয়েরা একজন সাহসী পুরুষ খুব পছন্দ করে। যা হাসেম ভাইয়ের চরিত্রের মাঝে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তারপরও মানুষটাকে ওর ভীষণ ভালো লাগে। সিতারা বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। চাঁদের আলোয় আজ চারিদিক আলোকিত। আকাশ ভেঙ্গে যেন আজ জোছনা নেমেছে। পাশ ফিরে হাসেমের দিকে তাকায়। খুব ইচ্ছা করছে হাসেমের হাত ধরে জোছনা আলোকিত রাতে হেঁটে বেরাতে। কিন্তু এখন তো তা সম্ভব নয়। এসব নানা হিজিবিজি ভাবনায় একসময় সিতারার দুচোখে ঘুম নেমে আসে। বাসের ভিতর এসির অত্যাধিক ঠান্ডায় সিতারা কাঁপতে থাকে। হাসেম সুপারভাইজারকে ডেকে একটা কম্বল চেয়ে নেয়। এরপর সেটা সিতারার গায়ে ভালো করে জড়িয়ে দেয়। সিতারা ঘুম ভেঙ্গে যায়। কিন্তু হাসেমের কাছে ধরা দেয় না। চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভাণ করে সীটে হেলান দিয়ে শুয়ে থাকে। হাসেমের এই কেয়ারিংটুকু সিতারার ভীষণ ভালো লাগে। ভোরের দিকে ওরা রংপুরে পৌঁছে যায়। এরপর সোজা হাসনার বাসায় গিয়ে উঠে। সেসময় মর্নিং ওয়ার্ক করতে রাজ বাসা থেকে বের হয়ে ওদের দুজনকে একসাথে দেখে একটু অবাক হয়। সিতারা রাজের কৌতুহল বুঝতে পেরে বলে,
—বাসস্টান্ডে আমার সাথে হাসেম ভাইয়ের দেখা হয়ে গেল।
কিন্তু সিতারার কথা রাজের বিশ্বাস করতে মন চায় না। ওর অভিজ্ঞ চোখ অন্য কথা বলছে। রাজ সিতারার দিকে তাকিয়ে বলে,
—তুমি বাসায় যাও,শালা বাবু আমার সাথে কিছুক্ষন থাকুক।
সিতারা বাসায় ঢুকে ডোরবেলটা চাপ দেয়। হাসনা এসে দরজা খুলে দেয়। সিতারাকে এতো সকালে দেখে অবাক হয়ে বলে,
—তুমি এতো সকালে,
—-কেন,এতো সকালে আসলে কি সমস্যা?
—-সমস্যা হবে কেন? বরং অনেকদিন পর তোমাকে দেখে আমার বেশ ভালো লাগছে।
সিতারার ভয়েস শুনে জমিলা বেগম মানে জারার শাশুড়ী চলে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—এসেছো ভালোই হয়েছে। তা বেয়াই বেয়াইন জানে?
—-না আব্বু আম্মুকে বলা হয়নি। আসলে উনাদের জানিয়ে আসতে পারতাম কিন্তু উনারা এতো ভোরে আসতে দিতে চাইতেন না। আগে বাসায় যেতে বলতেন তারপর রেস্ট নিয়ে আসতে হতো। আসলে হাসনা আপুর সংবাদটা পেয়ে কনগ্রাচুলেট করতে চলে আসলাম।
এরমাঝে মরিয়ম বেগম এসে বলেন,
—-ভালোই হয়েছে। তুমি হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নাও। টেবিলে নাস্তা দিয়ে দিচ্ছি।
সিতারা হাসনার সাথে ওর ঘরে যায়। এরপর হাসনার হাত ধরে বলে,
—আপু আমার একটা উপকার করতে পারবে?
—-কি বল?
—আমি গতকাল বাসা থেকে পালিয়েছি।
—-কেন?
—আমাকে না জানিয়ে পাত্র ঠিক করেছে।
—-তাতে কি হয়েছে? তাই বলে বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি।
—ঠিক বেঠিক পরে ভাবা যাবে। এখন আমার উপকারটুকু করো।
—-কি করতে হবে?
—আব্বু আম্মুকে বলবো আমি খালার বাসায় ছিলাম। তুমি খালা খালুকে ফোন দিয়ে বলো আব্বু আম্মু জানতে চাইলে উনারা যেন তাই বলে।
—কিন্তু আম্মা রাজী হলেও আব্বা রাজী হবেন কিনা বলতে পারছি না। আব্বা তো কখনও মিথ্যা বলেন না।
চলবে
#বড় গল্প
#ফেরারী বসন্ত
পর্ব-চৌদ্দ
মাহবুবা বিথী
হাসনা একরাশ অস্বস্তি নিয়ে ওর মায়ের বাসায় ফোন দেয়। কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতেই ওর মায়ের কাছে জানতে পারে ওর বাবা ট্রেনিং এ ঢাকায় গিয়েছে। ও হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তবে মাকে সিতারার কথা বলতেই ওর মা রেগে গিয়ে বলে,
—সোমত্ত মেয়ে,কাল সারা রাত ও কোথায় ছিলো? জিজ্ঞাসা করেছিস?
এমন সময় ডোরবেলটা বেজে উঠে। ফোনে মাকে হাসনা বলে,
—দাঁড়াও,দেখি কে এলো আবার?
হাসনা দরজা খুলে দেখে হাসেম দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে হাসনা অবাক হয়ে বলে,
—তুই এসময় কোত্থেকে?
—কোথা থেকে আবার? ভার্সিটি থেকে এসেছি।
হাসনার ফোনে তখন আসমা বেগম হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছেন। হাসেম শুনতে পেয়ে বলে,
—তোমার ফোনে কে?
—-আম্মা,
—কথা শেষ করো?
হাসনা ফোনটা কানে তুলে বলে,
—-আম্মা তোমাকে যে কাজটা করতে বললাম সেটা দয়া করে করো। কোনো প্রশ্ন করো না। বুঝতে পারছো তো কেন বলছি?
—আমি বলদ না,ঠিকই বুঝতে পারছি। সায়মা তোর বিয়ের ব্যবস্থা করেছে। ওর মেয়ে বলে কথা। সবই বুঝি। কিন্তু যদি কোনো অঘটন ঘটে তখন এর দায়ভারও আমাকে নিতে হবে। তোর বাপকে তো ভালো করেই চিনিস। উনি কখনও কোনো ঝামেলায় জড়াতে চান না। আর হাসেম কেন এতো সকালে তোর বাসায় এসেছে? কাল তো ফোনে আমাকে বললো,ওর নাকি নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় নাই। দুদিনের মধ্যে থিসিস পেপার জমা দিতে হবে। আবার সিতারাও এসেছে। এদের মাঝে আবার কোনো যোগসুত্র নাই তো?
—আমি কিছু বুঝতে পারছি না। এখন রাখি। একটু পর রাজ আসবে। ওকে নাস্তা দিতে হবে।
ফোনটা রেখে আসমা বেগম মনে মনে হিসেব মেলাতে লাগলেন। যদিও প্রবল অনিচ্ছা সত্বেও হাসনার কথায় রাজী হতে হলো কিন্তু মনের ভিতর অশান্তি শুরু হলো। আবার কোনো ঝামেলায় পড়তে হয় কে জানে?
হাসনা ফোন রাখতেই সায়মা মানে সিতারার মা ফোন দেয়। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সায়মা বলে,
—তোর খালুর বুকে ব্যথা উঠেছে। মেডিকেলে যাচ্ছি। রাজকে নিয়ে একটু আসতে পারবি?
—-হঠাৎ খালুর বুকে ব্যথা হলো কেন? হার্টের সমস্যা ছিলো?
—আমি কিছুই জানি না। ডাক্তার দেখে বলতে পারবে। তুই বরং রাজকে নিয়ে এখুনি চলে আয়।
ফোন রেখে দিতেই আমেরিকা থেকে জারার ফোন এলো। হাসনা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে জারা বলে,
—আপু আব্বুর খবর পেয়েছো?
—-হুম,এই মাত্র খালামনির সাথে কথা হলো।
—সব হয়েছে সিতারার জন্য।
সিতারা পাশেই দাঁড়ানো ছিলো। ফোন লাউডস্পিকারে থাকার কারণে ও জারার সব কথা শুনতে পায়। হাসনার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে জারাকে বলে,
—তুমি তো নিজের পছন্দে বিয়ে করেছো। তারপর বরের হাত ধরে বিদেশে নিজের আখের গুছাতে গিয়েছো। তখন বাবা মায়ের কথা মনে হয়নি? আর আমার বেলায় তোমরা কেউ একবার জানতে চাইলে না আমার পছন্দ আছে কিনা?
—এখানে আলাদা করে জানার কি আছে?তুই বললেই হতো।
—আব্বু আম্মু আমাকে সেই সুযোগ দিয়েছে?
এরপর ফোনের লাইন কেটে দিয়ে সিতারা হাসেমের দিকে তাকিয়ে বলে,
—তুমি কি আমার সাথে হাসপাতালে যাবে নাকি আমি একাই যাবো?
হাসেম কিছু বলার আগে হাসনা বলে,
—অবশ্যই যাবে, তোরা নাস্তা করে যা।
—না আপু, আমার কিছুই ভালো লাগছে না।
ওরা দুজন না খেয়েই হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দিলো। বিষয়টা মরিয়ম আর জমিলার কাছে কেমন যেন লাগলো। যাক এরা এযুগের ছেলেমেয়ে। তাই নিজ থেকে কিছু বললো না। এর মাঝে রাজও মর্নিং ওয়ার্ক সেরে বাসায় চলে এসেছে। আরশাদ আর রিশাদ চৌধুরী ফজরের নামাজ পড়ে একটু ঘুমিয়ে নেন। রাজের দাদী আমেনা বেগমও তাই করেন। সে কারণে আজ সকালে এই কাহিনী ওদের সবার কাছে অজানা রয়ে যায়। তবে খাবার টেবিলে মরিয়ম বেগম হাসনাকে বলে,
—ওরা কি দুজন দুজনকে পছন্দ করে?
হাসনা কিছু বলার আগে রাজ বলে,
—সেরকম কিছু থাকলে তুমি এমনিতেই ক’দিনপর জানতে পারবে। আর হাসনা তো এখানে থাকে। ওর পক্ষে তো ওদের দুজনের মনের খবর জানা সম্ভব নয়।
মরিয়ম আর কথা বাড়ালেন না। কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে কৌতুহল থাকা রাজ পছন্দ করে না। দেখা যাবে এখানে এমন একটা কথা বলে ফেলবে যে নিজের মান সম্মান রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে।
হাসপাতালে পৌঁছে সিতারা ইমার্জেন্সিতে চলে যায়। ওখানে ওর বাবার পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। সিতারাকে দেখে ওর মা রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাবে অমনি পিছনে হাসেমকে দেখে নিজেকে সামলে নেয়। এরপর সিতারার দিকে তাকিয়ে গলা ভার করে বলে,
—-কাল রাতে কোথায় ছিলি?
সিতারা বেশ মুড নিয়ে বলে,
—বড় খালামনির বাসায়।
সায়মা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কাল সিতারার বন্ধু বান্ধবদের কাছে খোঁজ নেওয়া হয়েছিলো। তবে কেউ হারিয়ে গেলে তাকে খুঁজলে তবুও পাওয়া যায় কিন্তু কেউ নীচ থেকে লুকিয়ে থাকলে সে ধরা না দিলে তাকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সে কারণে ফিরোজ আর সায়মা আত্মীয়স্বজন কাউকে খুব একটা জানায়নি। তবে ফিরোজকে বুকে ব্যথা হওয়ার অভিনয়টুকু করতে হয়েছে। যাইহোক জারা যখন বাপের অসুস্থতা নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিবে তখন সিতারা আর লুকিয়ে থাকতে পারবে না। কারণ সিতারা উনার উপর দুর্বল সেটা উনি জানেন। ডাক্তার বললো গ্যাসের সমস্যা হয়েছে। তবে সিতারা ভেবেছিলো ওর অন্তর্ধানে বাবা হয়তো ছেলে পক্ষকে নিষেধ করে দিবে কিন্তু বাস্তবতা হলো ভিন্ন।
সায়মা মনে মনে আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া আদায় করলো। ফিরোজ বাসায় যেমন ব্যথায় কাঁতরাচ্ছিলো সায়মা ধরেই নিয়েছে, মনে হয় হার্টে সমস্যা হয়েছে। তবে হাসেমকে দেখে মনে মনে সায়মা বেশ খুশী হলো। কারণ আজকে মেহমানদের রান্নাগুলো হাসেমকে দিয়ে করিয়ে নিতে পারবেন।
সবাই মিলে বাসায় চলে আসার পর সিতারা মনে মনে ভাবলো বিপদ কেটে গিয়েছে। তাছাড়া কাল সারা রাত তেমন একটা ঘুম হয়নি। খুব ক্লান্ত লাগছে। ও নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে। সায়মা হাসেমকে ডেকে বলে,
—তুই এসেছিস ভালোই হয়েছে। আজ আবার পাত্রপক্ষ সিতারাকে দেখতে আসবে। আমাকে একটু রান্নার কাজে সাহায্য করবি।
হাসেম চমকে উঠে বলে,
—ক্যান্সেল হয়নি?
—ক্যান্সেল কেন হবে? এরকম সোনায় সোহাগা ছেলে কি সহজে পাওয়া যায়? যদি সব কিছু ঠিক থাকে তাহলে কাবিন করিয়ে রাখবো। পরে ছেলে ছ,মাস পর এসে বিয়ে করে সিতারাকে নিয়ে যাবে।
হাসেম মনে মনে বলে,এও কপালে লিখা ছিলো। নাহ্ এখানে থেকে নিজের বৌয়ের বিয়ে দেখা ওর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। সে কারণে চলে যাওয়াই ভালো। সায়মা হাসেমের নিরবতা দেখে বললো,
—কি ভাবছিস? আমাকে একটু সাহায্য কর।
আসলে খালামনি থাকতে পারলে আমার ভালোই লাগতো। কিন্তু আমার থিসিস পেপার জমা দিতে হবে। খালুর অসুস্থতার কথা শুনে দেখতে এসেছিলাম।
—-তাহলে আর কি? আমাকে একাই ম্যানেজ করতে হবে।
হাসেম আর বেশীক্ষণ এখানে থাকতে চাইলো না। যদিও সায়মা কিছু খেয়ে যেতে বলেছিলো। কিন্তু হাসেমের পক্ষে এখানে একফোঁটা পানি খাওয়াও সম্ভব নয়। বাসা থেকে বের হয়ে বাসে করে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। ওর খুব খারাপ লাগছে। সিতারার প্রস্তাবে রাজী হয়ে এভাবে ওকে বিয়ে করাটা একদম ঠিক হয়নি। সিতারার বিয়ের কথা শুনে হাসেমের মনে হলো কে যেন ওর হৃদয়টা একটা ধাঁরালো তলোয়ার দিকে কেটে রক্তাক্ত করে দিলো। আকাশে প্রচন্ড মেঘ জমেছে। বাসে উঠার সাথে সাথে আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামতে শুরু করলো। মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছে। হঠাৎ মনে হলো ওকি কাপুরুষ? নিজের বৌয়ের বিয়ের কথা শুনে এভাবে চলে আসা ঠিক হলো কিনা বুঝতে পারছে না। আসলে হাসেমের মাথা ঠিক মতো কাজ করছে না। শুধু বুকের ভিতরটা ফাঁকা লাগছে। হাসেমের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। কে বলে পুরুষ মানুষ কাঁদে না। হয়তো মেয়েদের মতো হাহুতাশ করে কাঁদে না তবে নিরবে হৃদয়ের অন্তপুরে বেদনার অশ্রু ঝরতে থাকে। তার কিয়দংশ কিছুটা হয়তো চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে।
চলবে