#বড় গল্প
#ফেরারী বসন্ত
পর্ব-সতেরো
মাহবুবা বিথী
সায়মা রেগে গিয়ে ফিরোজকে বলে,
—-তোমার আহ্লাদ পেয়ে ওর আজ এই দশা। লজ্জা শরমের বালাই নেই। এতোদিন শুনেছি ছেলেরা জোর করে মেয়েদের বিয়ে করে। এখন শুনলাম মেয়ে জোর করে ছেলেকে বিয়ে করেছে। সেই রত্নটি আবার আমার মেয়ে। ভাবতেই অবাক লাগছে এরকম নির্লজ্জ্ব একটা মেয়েকে আমি পেটে ধরেছিলাম।
সিতারা ফোঁস করে বলে,
—-কেন তোমার বড় মেয়ে তো প্রেম করে বিয়ে করেছে। তার বেলা তোমার নির্লজ্জ্ব মনে হয়নি? আমার বেলায় তোমার যত সমস্যা।
—আমার বড় মেয়ে জোর করে অন্তত কোনো ছেলেকে বিয়ে করেনি। আমাদের দুপক্ষের অভিভাবক মিলে বিয়ের আয়োজন করেছে।
একথা শুনে হাসেম বলে,
—-খালামনি, ও আমাকে জোর করে বিয়ে করেনি। আমি স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে ওকে বিয়ে করেছি।
—-এই বলদ তোকে এখানে কথা কে বলতে বলেছে?
সিতারার কথা শুনে ফিরোজ বলে,
—সিতারা, এ তোমার কেমন মুখের ভাষা? হাসব্যান্ডকে বলদ বলাটা ভালো দেখায় না।
হাসেম আবারও ফিরোজের দিকে তাকিয়ে বলে,
—খালু,আমি কিছু মনে করিনি।
হাসেম একটু লাজুক টাইপের মানুষ। সিতারার মুখে নিজের বলদ বিশেষণ শুনে কুঁকড়ে যেতে লাগলো। ছেলেটার আরো একটা গুন আছে। প্রচন্ড বিনয়। সে কারণে ফিরোজ একটু বিরক্তিসূচক ভাব এনে বললো,
—তুমি মনে না করলেও আমার গায়ে লাগে। তোমার খালা যদি আমাকে বলদ বলতো তাহলে কেমন লাগতো?
সিতারা সাথে সাথে ফোড়ন কেটে বলে,
—তুমি তো বলদ না যে আম্মু তোমাকে বলদ বলবে। আমি যাকে বলদ বলেছি সে আসলেই একটা বলদা।
এবার হাসেমের মনে মনে সিতারার উপর রাগ হলো। নিজের স্বামীকে বার বার বলদ বলছে। অথচ বলদের স্ত্রী লিঙ্গ গাই সেটা কি ও জানে না? সেই সুত্রে ওকে তো গাই গরু বলা যায়। এমন সময় সায়মা বলে,
—গাই গরুর স্বামী তো বলদ হওয়ারই কথা, তাই না?
এবার ফিরোজ বিরক্ত হয়ে বলে,
—একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তোমাদের হালকাভাবে নেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে। যেখানে দুটো জীবন জড়িয়ে আছে। সায়মা, ওদের বাসায় নিয়ে এবার আসল বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
সিতারা বেশ শান্তভাবে বলে,
—-আমি ওকে আর বিয়ে করবো না।
—ঠিক আছে। এবার বাসায় গিয়ে আমাদের ধন্য করো।
সিতারার মুখে বিয়ে করবো না শুনে হাসেম চমকে উঠে। অথচ আজ রাতে স্বপ্নে সে সিতারার সাথে বাসর করেছে। অবশ্য সিতারাকে যখনি বাহুডোরে জড়াতে যাবে অমনি সিতারার পায়ের শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে যায়৷ অবশ্য ঘুমটা খুব একটা গাঢ় ছিলো না। তবে ঘুম ভেঙ্গে যাবার পর একটা ভালো লাগা ওকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। আহা,স্বপ্নেই যদি এতো ভালো লাগা বিরাজ করে বাস্তবে তাহলে কতনা মধুর হবে সে কথা ভাবতেই রোমাঞ্চিত হলো। আর এখন বলছে ও বিয়ে করবে না। হাসেমের ভীষণ খারাপ লাগছে।
মায়ের কথা শুনে সিতারা মনে হয় একটু হোঁচট খেলো। মনে মনে ভাবলো কোথায় একটু সাধাসাধি করবে। অথচ সেটা না করে ওর কথাতেই সায় দিলো। ফিরোজের মুখটাও থমথমে হয়ে গেল। সায়মা অবশ্য মনে মনে খুশী হয়েছে। ও কিছুতেই চায় না সিতারা দেশের বাইরে চলে যাক। জারা গিয়েছে তাই বলে ওকেও যেতে হবে নাকি? দেশে থেকেও সুন্দর ক্যারিয়ার তৈরী করা যায়। তাছাড়া হাসেমের রেজাল্ট ভালো। ওকে বলবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ওর একটা সিভি জমা দিতে। বলা যায় না রিজিকে থাকলে চাকরি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এই মনোভাব প্রকাশ করা যাবে না। যতটা সম্ভব মুখে বিরক্তি ভাব সাজিয়ে রাখতে হবে। ওরা সবাই নাস্তা করে রংপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।
মীরা বসারঘরের জানালা দিয়ে দেখলো সিতারা সহ সবাই আসছে। হাসেম ভাইকে দেখে মনে হচ্ছে উনি যেন জেলখানার কয়েদি। পুরো শরীর ঘেমে ভিজে আছে। শার্টটা গায়ের সাথে চিপকে লেগে আছে। ডোরবেল বাজার আগেই মীরা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। ওরা সবাই বসার ঘরের সোফায় বসে। সায়মা মীরার দিকে তাকিয়ে বলে,
—তোমার আম্মুকে চার গ্লাস শরবত বানাতে বলো।
মীরা ভিতরে চলে যায়। হাসেমের ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। সিতারার চাচীর মুখের জবানের যে ধার ছুড়ি দিয়ে কাটলেও মানুষ এতো ব্যথা পাবে না যতটা পাবে উনার কথা দিয়ে। ফিরোজ হাসেমের দিকে তাকিয়ে বলে,
—-শরবত খেয়ে তুমি গেস্টরুমে গিয়ে কাপড়চোপড় ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হও।
এরপর সিতারার দিকে তাকিয়ে বলেন,
—তুই ও নিজের ঘরে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নে।
এমন সময় রুবা চার গ্লাস শরবত নিয়ে বসার ঘরে ঢুকলেন। হাসেমের হাতে শরবত তুলে দিয়ে বলে,
—তুমি কি আজ এখানেই থাকবে নাকি?
সিতারা ওর রুমের দিকে যাচ্ছিলো। চাচীর কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
—কেন,থাকলে আপনার কি সমস্যা?
—ওমা,আমি এখানে খারাপ কি বললাম? ওর বোনের বাসায় তো যেতে পারে? সেটা জানতে চাওয়া কি দোষের? তাছাড়া—-
—-তা ছাড়া কি? কথাটা শেষ করেন।
—-আমার মীরা এখন বড় হচ্ছে। সুতরাং এই বিষয়গুলোতে আমার এখন সাবধান থাকতে হবে।
ফিরোজ কঠিনস্বরে রুবাকে বললো,
—এতো সাবধান থাকার দরকার নেই। ও বিবাহিত। তুমি কিচেনে ভালো কিছু রান্নার ব্যবস্থা করো। ও আজ এখানেই থাকবে। আর টেবিলে খাবার দিয়ে দাও।
হাসেম গেস্টরুমে চলে গেল। রুবা মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত হয়। কিন্তু কিছু করার নেই ভাসুর বলে কথা। বিয়েটা কার সাথে হয়েছে সেটা জানার কৌতুহল ছিলো। কিন্তু ওকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফিরোজ সায়মাকে নিয়ে নিজের রুমে আসলেন। তাদের গোপন কিছু আলোচনা আছে। সায়মার সাথে আলাপ করে হাসেমের মা বাবাকে ফোনে আগামীকাল বাসায় আসতে বললেন। কেন আসতে বলা হলো সেই কারণটা অবশ্য গোপন রাখলেন।
হাসনা আজ একটু ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে। দুপুরে ওর খালার বাসায় ওদের সবার দাওয়াত আছে। ওর কাছে বিষয়টা যেন কেমন লাগলো। হঠাৎ করে খালা এই দাওয়াতের ব্যবস্থা কেন করলেন বুঝতে পারছে না। কিচেনে গিয়ে শাশুড়ী মায়ের সাথে কাজে হাত লাগায়। ও পরোটা বানিয়ে দেয়। শাশুড়ী মা ভেজে নিতে লাগলেন। আজ জারার শাশুড়ী জমিলা বেগমের প্রেসারটা বাড়ার কারণে উনি শুয়ে আছেন। সবজিটা হয়ে এসেছে। পরোটাগুলো ভাজা হয়ে গেলেই টেবিলে বেড়ে দেওয়া যাবে। শাশুড়ী মনোয়ারা বেগম পরোটা ভাজতে ভাজতে হাসনাকে বলেন,
—-শোনো, রাজের কিন্তু এবার ছেলে চাই।
হাসনার হাতের বেলুনিটা থেমে গেল। ছেলে কিংবা মেয়ে সন্তান এটাতো কারো হাতের ব্যাপার নয়। আল্লাহপাকের যা ইচ্ছা উনি সেটাই দান করবেন। সেকারনে শাশুড়ী মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসনা বলে,
—-মা, আমি একটা সুস্থ সবল সন্তান চাই।
মনোয়ারা বেগমের মুখটা সাথে সাথে কালো হয়ে যায়। বিরক্ত হয়ে হাসনাকে বলেন,
—-,তোমার চাওয়াটা শুধু দেখলে হবে না। আমার ছেলের চাওয়াটা তোমার ভাবতে হবে। আর বাকি পরোটাগুলো ভেজে টেবিলে খাবার বেড়ে দাও।
একথা বলে হাসনাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের শাশুড়ীর খাবারটা নিয়ে চলে গেলেন। হাসনার খুব খারাপ লাগলো।কিন্তু কিছু করার নেই। রাজ হয়তো ওর মায়ের কাছে নিজের চাওয়ার কথা বলেছে। সে কারনে হয়তো উনি বলেছেন। ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখে খালামনি ফোন দিয়েছে। রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে সায়মা বলে,
—হাসনা তুই একটু তাড়াতাড়ি চলে আসিস। রাজ বাড়ির সবাইকে নিয়ে পরে আসলে চলবে।
হাসনা ওর খালাকে আশ্বস্ত করে বলে,
—-তুমি এতো চিন্তা করো না। আমি একটু পরেই রওয়ানা দিচ্ছি।
দ্রুত নাস্তার পর্ব শেষ করে হাসনা সায়েরা আর আরশীকে রেডী করে নিজেও একটু সাজুগুজু করে নেয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে শাড়ী পরা নিয়ে। পেটটা একটু ভারী হওয়াতে ঝুঁকে এখন শাড়ীর কুচিগুলো ঠিক করতে পারে না। তারপরও কষ্ট করে ঠিক করতে লাগলো। সামনে ঝুঁকতেই রাজ দৌড়ে এসে বলে,
—করছো কি? এভাবে ঝুকে পড়া ঠিক নয়। আমাকে বললেই তো পারো।
—আপনি শাড়ীর কুচি ঠিক করতে পারেন?
—-,কেন পারবো না? একসময় রশ্নির—
কথাটা রাজ আর শেষ করলো না। অসমাপ্ত থেকে গেল। কিছুটা নিরবতা। কুচিটা ঠিক করে রাজ হাসনাকে বলে,
—দেখো, ঠিক হয়েছে কিনা?
হাসনা বুঝে,রশ্নি ওর প্রথম প্রেম। তাকে ভুলে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরও কষ্ট হয়। তবে ভিন্ন পরিস্থিতীতে হাসনা নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে। আসলে ওযে রাজকে ভালোবেসে ফেলেছে। মাঝে মাঝে ভাবে রশ্নি কিভাবে এই মানুষটাকে, সায়েরাকে ফেলে রেখে চলে গেল? আবার এও ভাবে রশ্নি চলে না গেলে ওর তো এই জায়গায় আসা হতো না। আয়নায় হাসনা তাকিয়ে দেখে অবাক হয়। আসলেই রাজ খুব নিঁখুতভাবে কুচিগুলো ঠিক করে সেফ্টিফিন লাগিয়ে দিয়েছে। হাসনার জীবনে কখনও এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়নি। নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠা হাসনা কখনও ওর বাবাকে দেখেনি মায়ের শাড়ির কুচি ঠিক করে দিয়েছে। আর নিজের জীবনে তো ও একজন অমানুষের সংসার করেছে। যার কাছে এই সুন্দর চাওয়াগুলো পাওয়া মানে আকাশ কুসুম ভাবনা।
চলবে
#বড় গল্প
#ফেরারী বসন্ত
পর্ব-আঠারো
মাহবুবা বিথী
হাসনা রেডী হয়ে সায়েরা আর আরশীকে নিয়ে সিতারাদের বাসায় একা যেতে চাইলে রাজ বাঁধা দিয়ে বলে,
—এ অবস্থায় তোমাকে একা যেতে দিবো না। আমিও তোমার সাথে যাবো।
রাজের কথা শুনে হাসনার ভীষণ ভালো লাগে। হাসনা রাজের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। আসলে এই পৃথিবীতে সবাই চায় একটু আদর একটু ভালোবাসা। রাজ হাসনার চোখের কাছে তুড়ি বাজিয়ে বলে,
—- কি হলো,পাথরের মূর্তির মতো তাকিয়ে আছো কেন?
হাসনা ওর নির্লজ্জ্বের দৃষ্টিতে রাজকে দেখছিলো আর ভাবছিলো। ওর জীবনে দাম্পত্য সুখ খুব একটা স্থায়ী হয়নি। বাবা মায়ের অভাবের সংসারে সচ্ছলতা না থাকলেও পারিবারিক শান্তি ছিলো। তারপর ধুর্ত রাশেদের প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে ওকে বিয়ে করে ফেলে। বিয়ের কিছুদিন ভালো চললেও আরশী পেটে আসার পর রাশেদের কালকূট চেহারা আস্তে আস্তে প্রকাশ হতে থাকে। সাথে সাথে ওর মায়ের কাছেও অত্যাচারিত হতে থাকে। হাসনা যদিও জীবনের এই অবস্থাকে ওর নিয়তি বলে ধরে নিয়েছিলো বাস্তবে শেষ রক্ষা হয়নি। আটবছর পর ঐ সংসার থেকে বেরিয়ে আসে। ডিভোর্সের তকমা গায়ে লেগে যাওয়াতে শুরু হয় আর এক যন্ত্রনা। তার জীবনের সমস্ত দুঃখ কষ্ট ঘোচাতে রাজ যেন এক অচিন দেশের রাজকুমার হয়ে ওর জীবনে এসেছে। আস্তে আস্তে এই মানুষটা ওর হৃদয়ের সিংহাসন দখল করে নিচ্ছে। চোখ সরিয়ে হাসনা বলে,
—সমস্যা নেই,আমি একাই যেতে পারবো।
—তুমি জানো,আমি এক কথা বার বার বলা পছন্দ করি না।
হাসনা আর কথা বাড়ায় না। অবশেষে ওরা এগারোটার সময় সিতারাদের বাসার উদ্দেশ্য রওয়ানা দেয়। যাওয়ার সময় রাজ ওর মাকে বলে,
—হাসনার শরীরের এই অবস্থায় ওকে একা ছাড়া ঠিক হবে না। ও বাড়িতে পৌঁছে আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিবো।
ঐ সময়টাতে রাস্তা কিছুটা ফাঁকা থাকে। সে কারনে সাড়ে এগারোটার মধ্যে ওরা কামালকাছনায় পৌঁছে যায়। আসার সময় রাজ ভালো দোকান থেকে দুকেজি কালোজাম আর দুকেজি রসগোল্লা কিনে আনে। মিষ্টিগুলো বাড়ির অ্যাসিসটেন্ট সালেহার হাতে দিয়ে রাজ আর হাসনা ড্রইং রুমে বরের বেশে হাসেমকে দেখে প্রচন্ড অবাক হয়। হাসনা হাসেমের দিকে তাকিয়ে বলে,
—বরের পোশাক পড়েছিস কেন? তোর কি আজ বিয়ে?
হাসেম কিছু বলার আগেই সায়মা চলে আসে।
হাসনার দিকে তাকিয়ে বলে,
—-তোমার ভাই বিয়ে করে ফেলেছে। আজ তার রিসিপশন হবে।
—-খালামনি,বউ কোথায়?
—পাশের রুমে বসে আছে।
সায়মার এরকম ক্রিয়াহীন কথা বার্তায় হাসনা একটু অবাক হয়। রাজের দিকে তাকিয়ে সায়মা বলে,
—-রাজ, তোমার আব্বা আম্মা সহ বাড়ির সবাই রওয়ানা দিয়েছেন?
—আমরা এখানে নেমেই গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।
আরশী আর সায়েরা ততক্ষণে পাশের রুমে গিয়ে সিতারাকে বৌ বেশে বসে থাকতে দেখে হাসনার কাছে এসে আরশী বলে,
—আম্মু ওই রুমে তো সিতারা খালা বউ সেজে বসে আছে।
আরশীর কথা শুনে হাসনা সায়মার দিকে তাকায়। কিন্তু সায়মার চেহারায় কোনো উচ্ছাস দেখতে পায় না। ওর কেমন যেন অস্বস্তি হতে থাকে। সায়মা ঐ রুম থেকে চলে যায়। রাজ বুঝতে পারে ঘটনা কবে ঘটেছে। কিছুটা বয়স তো বেড়েছে। সে কারণে কিছু অভিজ্ঞতা জীবনে সঞ্চয় হয়েছে। সেদিন ভোরে একসাথে যখন ওরা দুজনে বাসায় এসেছিলো তখনি রাজের সন্দেহ হয়েছে। রাজ সেই প্রসঙ্গে না গিয়ে হাসেমকে বলে,
—গ্রাজুয়েশন তো শেষ হলো। এবার কি বিদেশে পাড়ি জমাবে নাকি দেশেই ক্যারিয়ার গড়বে?
—-এখনো কিছু ভাবিনি।
হাসনা পাশের রুমে গিয়ে দেখে সিতারা বসে আছে। ও অবাক হয়ে বলে,
—কাজটা তোরা ঠিক করিসনি? খালা খালু হয়তো মনে অনেক কষ্ট পেয়েছেন।
সিতারা শান্ত ধীর স্থিরভাবে বলে,
—-বাবা মা কষ্ট পেয়েছেন আবার একসময় ভুলেও যাবেন। কিন্তু আমি নিজের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করতে না পারলে সারাজীবন কষ্ট পেতাম। তাই নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়েছি। তাছাড়া হাসেম ভাই পাত্র হিসাবে অযোগ্য কোনদিকে?
এসময় চাচী রুবা সিতারার রুমে আসে। ওর কথাগুলো শুনতে পেয়ে বলে,
—এটা তুমি কি বললে? হাসেম কোনদিকে তোমার যোগ্য?
—সবদিক থেকেই ও আমার যোগ্য। পরিবার ভালো,ভালো ছাত্র,রেজাল্ট ভালো সে কারণে ইনশাআল্লাহ চাকরিও ভালো পাবে।
—তুমি এর থেকে আরো ভালো ছেলে বিয়ে করতে পারতে। হাসেমের একটাই ভালোদিক। তা হচ্ছে ও ছাত্র হিসাবে ভালো। আর তো কিছু চোখে পড়ে না। বাড়ি তো সেই ভেন্না পাতার ছানি। একটুখানি বৃষ্টিতে গড়িয়ে পড়ে পানি।
হাসনা রুবার কথা শুনে ওর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। কি করে পারে কারো আর্থিক বিষয় নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করতে? সিতারার রাগ চড়ে যায়। সে কারণে ও কঠিনস্বরে বলে,
—আর যাই হোক আপনার মেয়ের মতো কোনো ফেলটুর সাথে সম্পর্ক করিনি। নিজের ঘরকে সামলান।আমারটা আমি বুঝে নিবো।
এমন সময় মীরা এসে রুবাকে বলে,
—-বড়মা তোমাকে ডাকছে?
রুবা তেতে উঠে বলে,
—-গিয়ে বল,আমি কিছুই করতে পারবো না।
একথা বলে রুবা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এরমাঝে আসমা মানে হাসেমের মা বাবা চলে আসে। যদিও ফিরোজ হাসেমের বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছে,
—ছেলেমেয়েরা ভুল একটা করেছে। এখন আমরা বিষয়টা মিটিয়ে ফেলি।
কিন্তু হাসেমের বাবা সহজ হতে পারছেন না। এসময় রাজ এসে ফিরোজকে বলে,
—বিয়ে করাতো ভুল নয় আঙ্কেল,
—বিয়ে করাটা ভুল নয় কিন্তু নিজেরা এভাবে বিয়ে না করে আমাদের জানাতে পারতো। কারণ বিয়েতে ছেলে এবং মেয়ের ক্ষেত্রে দুজন করে ওলী থাকতে হয়। সেটা হতে হয় বাবা,চাচা,মামা খালা থেকে,তা না হলে বিয়েটা শুদ্ধ হয় না।
—তা অবশ্য ঠিক বলেছেন।
এদিকে আসমা সায়মার সাথে সহজ হতে পারছে না। এই বোনটা সবসময় পাশে থেকে সাহায্য করে গিয়েছে। অথচ হাসেম কিভাবে পারলো সিতারাকে এভাবে বিয়ে করতে? জুবায়ের আর সাবেরও বউ বাচ্চা নিয়ে চলে এসেছে। সিতারার ছোটো মামা জুবায়ের একফাঁকে আসমাকে বলে,
—হাসেম কি করে পারলো সায়মা আপুর বুকে ছুঁড়ি মারতে? সায়মা আপু সবসময় তোমার পাশে থেকেছে। কত ভালো ঘর দেখে হাসনার বিয়ে দিয়েছে।
সিতারার বড় মামী লিলি জুবায়েরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে টিপ্পনী কেটে বলে,
—আপার ছেলে মেয়ে দুটো ভীষণ করিৎকর্মা। সায়মা আপুর ঘাড়ে বসে কি করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিলো।
এমনসময় সিতারা আসমার সাথে দেখা করতে ঐ রুমে আসছিলো। মামীর কথা শুনে রুমে এসে বলে,
—মামী, আপনি কথাটা ভুল বললেন,বরং আমি হাসেম ভাইকে বিয়ে করে আমার আখের গুছিয়ে নিয়েছি। ভবিষ্যতে সেটা বুঝতে পারবেন।
এরপর আসমার দিকে তাকিয়ে সিতারা বলে,
—-আপনার ছেলেকে এভাবে বিয়ে করলাম বলে আমার উপর রাগ করেছেন?
আসমা বিছানা থেকে নেমে সিতারাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
—তোর মতো মেয়েকে বউ হিসাবে পেয়ে মনে মনে আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া আদায় করেছি। রাগ করবো কেন?
যাক আবারো কাজী ডেকে ওদের দুজনের নতুন করে বিয়ে পড়ানো হলো। ভালোই ভালোই বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো। কিন্তু সমস্যা হলো সিতারাকে নিয়ে। সবাই চাইছিলো সিতারা আর হাসেমের বাসর কামাল কাছনাতে মানে ওর বাবার বাড়িতে হোক। কিন্তু হাসেম রাজী থাকলেও সিতারা রাজী নয়। সবাই জানি সিতারা এক কথার জেদী মেয়ে। অবশেষে ওর কথাই থাকলো। একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে হাসেম নিজের বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়। রংপুর শহর থেকে জলঢাকা যেতে ঘন্টা দুয়েক সময় লাগে। বাড়ি পৌঁছাতে বেশ রাত হয়। আসমা বেগম গাড়ি থেকে আগে নেমে তালা খুলে বাড়িতে ঢুকে যান। ছেলে আর বৌমার জন্য গাছের পাতি লেবু দিয়ে দুগ্লাস শরবত রেডী করেন। রায়হান মাস্টার ছেলে আর বউকে নিয়ে ঘরে তুলে। হাসেম সিতারাকে নিয়ে ড্রইংরুমের সোফায় বসে। সিতারা ঘরের চতুর্দিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। টিনের চালের একতলা বাড়ি। কিন্তু বেশ পরিপাটি করে গুছানো। জানালায় সাদা রঙের পর্দা ঝুলছে। সোফার কুশনগুলো বেশ সুন্দর। মনে হলো খালা নিজের হাতে সুই সুতা দিয়ে কাজ করেছে। সোফার সামনে টেবিলেও একই ফুলের ডিজাইন করা হয়েছে। বুকসেলফের বইগুলো পরিপাটি করে গোছানো। কোথাও এতোটুকু ধুলো জমে নেই। আসমা ওদের দুজনকে শরবত খাইয়ে বরণ করে। আসমা সিতারাকে নিয়ে হাসেমের ঘরে খাটে নিয়ে বসিয়ে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে চলে যায়। একটুপর হাসেম রুমে আসে। সিতারার দিকে তাকিয়ে বলে,
—বাসর খাট তো সাজানো হলো না,
সিতারা শীতল স্বরে বলে,
—বাসর তো এখানে হবে না?
হাসেম অবাক হয়ে বলে,
—তাহলে কোথায় হবে?
সিতারা হাসেমের দিকে তাকিয়ে বলে,
—আজ আমরা দুজনে ঘরের বাইরে হাঁটবো। যতটুকু জানি আজ পূর্ণিমা। পূর্ণিমারাতে আমার বাইরে হাঁটতে খুব ভালো লাগে।
সিতারার কথা শুনে হাসেম মনে মনে খুব বিরক্ত হয়। কিন্তু সে জানে সিতারা মুখ দিয়ে যা বলে তা সে করবেই। সেকারণে সিতারাকে হাসেম বলে,
—-আব্বা আম্মা ঘুমিয়ে পড়ুক তারপর তোমাকে নিয়ে বাইরে যাবো।
সিতারারা সবাই দ্রুত রাতের খাবার খেয়ে নেয়। বিশেষ করে আসমা ভাবছে,আজ যেহেতু ওদের দুজনের বাসর হবে তাই যত দ্রুত ওদেরকে ফ্রী করে দেওয়া যায়। হাসেম একসময় বাবা মায়ের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে, উনারা গভীর ঘুমে অচেতন। হাসেম আর দেরী করে না। সিতারাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। চারিদিকে রুপালী আলোর বন্যা বইছে। আজকের এই আলো হাসেমের কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে। হাসেম আর সিতারা মেঠোপথ ধরে হাঁটছে। কিছুদূর হেঁটে সিতারা ওর জুতো জোড়া খুলে হাসেমের হাতে দিয়ে খালি পায়ে শিশির ভেজানো পথে হাঁটতে থাকে। সিতারা নিচু হয়ে ঘাসের ডগার শিশিরগুলো দেখতে থাকে। চাঁদের আলো পরে সেগুলো হীরার মতো চকচক করছে। হাসেম অবাক হয়ে সিতারার ছেলেমানুষিগুলো দেখে মজা পায়। একসময় সিতারার মাথায় হালকা চাটি মেরে বলে,
—তোমার মাঝে এখনও বড্ড ছেলেমানুষি লুকিয়ে আছে।
সিতারা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
—-সবার মাঝেই কিছুনা কিছু ছেলেমানুষি থাকে।
হাসেমের মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি খেলে যায়। সে জুতোজোড়া মাটিতে রেখে সিতারাকে জড়িয়ে ধরে। সিতারা হাসেমকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু পেরে উঠে না। তখন হাসেমকে চমকে দিয়ে বলে,
—ঐ দেখো বাবা মনে হয় আমাদের ডাকতে চলে এসেছেন।
চলবে