#বড় গল্প
#ফেরারী বসন্ত
পর্ব-উনিশ
মাহবুবা বিথী
হাসেম সিতারাকে ছেড়ে দিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। সিতারা ওর হাত থেকে ছাড়া পেয়ে দূরে সরে গিয়ে খিলখিল করে হাসতে থাকে। রাতে যেন সিতারার হাসির ঝঙ্কার চর্তুদিকে প্রতিধ্বনিত হয়। সিতারা একটু দূরে একটা বটগাছের গুড়ির উপর বসে পড়ে। হাসেম দৌড়ে এসে বলে,
—,এখানে বসো না, তোমার শাড়িতে দাগ লেগে যাবে।
—-,লাগুক,এই দাগটাই আমার বাসর রাতের স্মৃতি হয়ে থাকবে। এসো,আমার পাশে বসো। কিছুক্ষণ গল্প করি।
হাসেম সিতারার পাশে বসে বলে,
—রাত তো ফুরিয়ে এলো ঘরে যাবে না?
—-কেন,তোমার কি ভয় লাগছে?
হাসেম সিতারার দিকে তাকিয়ে বলে,
—পুরুষ মানুষের আবার রাতের ভয় থাকে? যেখানে রাত সেখানেই কাত।
সিতারা হাসেমের কথা শুনে বলে,
—-তোমার আবার “রাইতের নেশা” নেইতো?
—-এটা আবার কেমন প্রশ্ন?
সিতারা হেসে বলে,
—আমাদের ঢাকা ভার্সিটিতে ছাত্রদের হলে অনেক ছেলের রাতের নেশা থাকে। সে কারনেই বললাম। থাক ওসব কথা। জানো,একবার মনে হলো নাহ্ তোমার সাথে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব না। এতো ভীরু আর কাপুরুষকে আর যাই হোক পুরুষ মানুষ মনে হয় না। কিন্তু তুমি যেদিন নিজ থেকে বাবা মাকে বললে,”আমাকে তুমি বিয়ে করেছো, তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম তোমার সাথেই আমৃত্যু থাকবো। মনটা যেন বলে উঠলো,”এই মানুষটাই তোকে সারাজীবন আগলে রাখবে।”আসলে তুমি আমার দোষটা স্বাচ্ছন্দে নিজের কাঁধে তুলে নিলে। এই ব্যাপারটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।
—কিন্তু সত্যিটা তো তুমি বলে দিলে,
—-কেন দিলাম জানো, আমার বাবা মা জানেন,তাদের ছোটো মেয়েকে জোর করে যে পুরুষ বিয়ে করবে তার এখনও জন্ম হয়নি। তারা ঠিকই বুঝবে কাজটা আমি করেছি। সে কারনে সত্যিটা সেদিন বাবা মাকে বলে দিয়েছি।
সিতারার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে হাসেম বলে,
—আমিও যে তোমাকে অনেক ভালোবাসি এটা কি তুমি বিশ্বাস করো?
সিতারা ছোটো করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
—এখনো বুঝতে পারছি না।
—এখনো বুঝতে পারছো না এর মানে কি?
—তোমার সাথে কি আমার ভালোবাসাবাসি এ অবদি হয়েছে?
—-তাহলে আমাকে বিয়ে করলে কেন?
—-আমি তোমাকে ভালোবাসি বলে,
—-জীবন কোনো ছেলেখেলার জায়গা নয় সিতারা?
—আমি ছেলেখেলা করছি এটা তোমায় কে বললো?
হাসেম ওরদিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে ধরে বলে,
—তোমাকে আমি ঠিক বুঝতে পারি না।
—-আমি স্বচ্ছ পানির মত টলটলে,আমাকে না বুঝার কিছু নেই। চলো,এখন উঠা যাক।
সিতারা উঠে দাঁড়িয়ে পিছনদিকটা হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেললো। হাসেম সিতারার হাত ধরে বলে,
—-আর কিছুক্ষণ বসো,
—-আমার বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না। তাছাড়া চোখের পাপড়িগুলো ভারী হয়ে আসছে। মনে হয় ঘুম আসতে চলেছে।
সিতারা বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে। হাসেম ওর পিছু পিছু হাঁটতে থাকে।
সিতারা ঘরে এসে শাড়ি পাল্টে সাথে করে আনা একটা থ্রিপীচ পড়ে নেয়। এরপর ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়। কিন্তু হাসেম বাসর রাতের চিহ্ন ওর অধরে এঁকে দিতে চায়। সিতারা বাঁধা দিয়ে বলে ওর ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু হাসেম ওকে জোর করে ওর অধর জোড়া নিজের অধরে তুলে নেয়। একসময় সিতারা হাসেমকে জোর করে সরিয়ে দিয়ে বিছানায় পাশ ফিরে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ে। শরীরের প্রতিটি রক্ত বিন্দুতে শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে। কিছুটা লজ্জা এসে ওর দৃষ্টিতে ভর করে। সে কারণে হাসেমের দিকে আর ফিরে তাকায় না। এদিকে চোখের পাতাগুলো ক্রমে ভারী হয়ে আসছে। একসময় ঘুমের রাজ্যে সিতারা হারিয়ে যায়। মোবাইলের শব্দে সকালে সিতারার ঘুম ভাঙ্গে। পাশে তাকিয়ে দেখে হাসেম নেই। মুহুর্তে সিতারার রাতের কথা মনে পড়ে যায়। হাত দিয়ে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে। এখনও ঠোঁটটা ব্যথা করছে। সাথে সাথে লজ্জার আবরণে নিজেকে ঢেকে ফেলতে ইচ্ছে হয়। এদিকে ফোনটা বেজেই চলেছে। স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখে জারা ফোন দিয়েছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে জারা বলে,
—-ঘুম ভাঙ্গলো মহারানীর? কতক্ষন থেকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি ধরার নাম নেই। আমাকে বাদ দিয়ে বিয়ের পাঠ চুকিয়ে ফেললি তাই না?
—কি করবো বলো? আসলে শুভ কাজ কখনও ফেলে রাখতে হয় না। তবে তুমি দেশে আসলে ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করবো। তুমি রাগ করো না আপু,
—রাগ করেনি তবে কষ্ট লেগেছে। যাই হোক যা ঘটার তাতো ঘটে গেছে। হাসেম কোথায়? ওর সাথে একটু কথা বলতাম।
—-আমি এই মাত্র তোমার মোবাইলের শব্দে ঘুম থেকে উঠলাম। সে কারণে ও কোথায় বলতে পারছি না। মনে হয় আমার ভয়ে পালিয়েছে।
—-এ কেমন কথার ছিরি! তুই কি বাঘ না ভাল্লুক যে তোকে দেখে পালাবে।
—-আমি বাঘিনী আর ভাল্লুকের স্ত্রী লিঙ্গের নামটা তোমার জানা আছে?
—বাজে কথা রাখ।ওখানে তো এখন সকাল দশটা বাজে। তুই এখন ঘুম থেকে উঠলি? খালা খালু কি ভাববেন বলতো?
—কি আবার ভাববে? আপু,আমার ইউরিনের চাপ লেগেছে ওয়াশরুমে যাবো। ফোন রাখলাম।
সিতারা বিছানা থেকে নামতেই ফোনটা আবার বেজে উঠে। কিন্তু ইউরিনের চাপ থাকাতে ফোনটা রিসিভ না করেই ওয়াশরুমে চলে যায়। ফ্রেস হয়ে দাঁত ব্রাশ করে হাতমুখ ধুয়ে রুমে আসে। তোয়ালে তে মুখটা মুছে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলটা চিরুনি করে বের হয়ে আসে। যদিও একটু অস্বস্তি হচ্ছে। শ্বশুর বাড়িতে প্রথমদিন বউয়ের ঘুম সকাল এগোরোটায় ভাঙ্গে বিষয়টা শোভন দেখায় না। সিতারা সবই বুঝে। কিন্তু সিতারার কাছে লোকলজ্জা থেকে নিজের শরীরের গুরুত্ব অনেক বেশী। সে কারণে এসব ওর কাছে গুরুত্ব বহন করে না।
শহরের মতো পরিপাটি আধুনিক কিচেন নয় তবুও আসমা মানে ওর শাশুড়ীর রান্নাঘরটা ওর ভালো লেগেছে। দু ধরনের চুলো রয়েছে রান্নাঘরে। একটা সিলিন্ডার গ্যাস দিয়ে চলে আর একটা মাটির চুলো। আসমা বেগম লুচি ভাজছেন মাটির চুলোয়। সিতারাকে দেখে মুচকি হেসে বলে,
—-শরীর ভালো আছে?
—-জ্বী খালা,
—– তোমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। একসাথে নাস্তা করবে। তোমার শ্বশুরও খাননি। সবজি,সুজি বানানো হয়ে গিয়েছে। শুধু লুচিটা ভাজা বাকি আছে। শুনলাম,তোমরা ভোররাত পর্যন্ত বাহিরে হাঁটাহাটি করেছো।
—-হুম,
সিতারা মনে মনে ভাবে, কোথায় লজ্জা পাওয়ার কথা আমার অথচ হাসেম মিয়া লজ্জা পেয়ে একাকার। এদিক ওদিক তাকিয়ে কোথাও হাসেমের টিকিটা দেখতে পারছে না। আসমা আবারও বললেন,
—-আর এভাবে রাত দুপুরে বাহিরে হাঁটাহাটি করো না। এতে হাওয়া বাতাস লাগতে পারে?
—-হাওয়া বাতাস লাগানোর জন্যই তো হাঁটতে বেরিয়ে ছিলাম।
—আমি ঐ হাওয়াবাতাসের কথা বলিনি। দুষ্ট জীন পরীর কথা বলেছি।
সিতারার ফোনটা আবারও বেজে উঠে। মোবাইল স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখে হাসনা ফোন দিয়েছে। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হাসনা বলে,
—-ঘুম কেমন হলো,শুনলাম তোমরা নাকি সারারাত বাহিরে হেঁটে বেরিয়েছো।
—কাল তো পূর্নিমা ছিলো, সে কারনে বাহিরে কিছুটা সময় ছিলাম।
—-দেখো আবার তোমাদের ঘাড়ে জ্বীন পরীর আছর না পড়ে?
কথাটা বলে হাসনা হাসতে থাকে। আর এদিকে সিতারার হাসেমের উপর রাগ হতে থাকে। ও আর কত জায়গায় এই খবর প্রচার করেছে কে জানে? আসুক সামনে এমন মজা দেখাবো যে বাপের জনমে নিজের ব্যক্তিগত বিষয় কারো কাছে বলবে না।
—-কি ব্যাপার চুপ হয়ে গেলে কেন?
—-তোমার কথাগুলো শুনছিলাম।
—-আপু তুমি রাজ ভাইয়াকে নিয়ে চলে আসো। খুব মজা হবে।
—মাথা খারাপ,এমনিতেই বাসা থেকে বের হতে দিতে চায় না। আর অতদূরে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। বরং তুমি আর হাসেম আমাদের এখানে বেড়াতে আসো।
মনোয়ারা বেগমের ডাকে হাসনা আর কথা চালিয়ে যেতে পারলো না। ফোন রেখে কিচেনে শাশুড়ীর কাছে চলে আসে। মনোয়ারা বেগম সিতারার দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
—কাজের সময় ফোনে কথা বলা আমার একদম পছন্দ নয়। কে ফোন দিয়েছে?
হাসনা সত্যিটা গোপন রেখে বলে,
—-সিতারা ফোন দিয়েছে।
—-মেয়ে তো হেব্বি সেয়ানা,শুনলাম হাসেমকে নাকি ও জোর করে বিয়ে করেছে? তোমার মা আর হাসেম ঐ মেয়েকে সামলে রাখতে পারবে তো?
—-আমি তো এসবের কিছুই জানি না। আপনি কার কাছে শুনেছেন?
—সিতারার চাচী রুবা ফোন দিয়ে জানালো। বাদ দাও ওসব কথা। এখন রান্না শুরু করো।তুমি তো জানো আম্মা আর তোমার শ্বশুরকে বেলা একটার মধ্যে দুপুরের খাবার দিতে হয়। এখানে সবজিগুলো কেটে রাখা হয়েছে। চুলায় বসিয়ে দাও। আর কাঁচা কলা কেটে হলুদ দিয়ে ভিজিয়ে রাখা আছে। রুইমাছের পিছগুলো দিয়ে ঝোল করো। আচ্ছা তোমার ক সপ্তাহ হলো?
—-আট সপ্তাহ,
—আর আট সপ্তাহ পার হলে সনোগ্রাফি করে জেনে নিও ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে।
একথা বলে মনোয়ারা বেগম কিচেন থেকে বের হয়ে যায়। হাসনা মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত হলো। আর রুবা চাচীর এনার্জি আছে বলতে হবে। ফোন দিয়ে নিজেদের ঘরের খবর বাহিরে জানাতে সময় ও পায়।
যদিও মনোয়ারা বেগম কে ও ট্রিপিক্যাল শাশুড়ীদের কাতারে ফেলতে চায় না কিন্তু উনার এই ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে এটা নিয়ে এতো কৌতুহল ওর ভালো লাগে না। হাসনা ভাবে,রাজও কি ওর মায়ের মতো। এখন পর্যন্ত ছেলে চায় কিনা মেয়ে চায় এসব নিয়ে কিছু বলেনি। কিন্তু রাজ তো এমনিতেই কম কথা বলে। সে কারণে রাজকে হাসনা ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারে না। সে কারণে হাসনা মরিয়ম বেগমের বিষয়ে কিছু বলতে পারেনি। এমনিতে মানুষটা খারাপ নয়। হাসনাকে খেতে পরতে কষ্ট দেয়নি তবে বাচ্চা হতে দেরী হওয়ায় মাঝে মাঝে কিছু মন্দ কথা হাসনাকে শুনতে হয়েছে। কনসিভ করার পর থেকে তার নাতি চাই এই বিষয়ে প্যারা দেওয়া শুরু করেছে। তবে ওর প্রতি রাজের অনেক বেশী কেয়ারিং দেখে হাসনা তার শাশুড়ীর এই আচরণকে গুরুত্ব দিতে চায় না। রাজের এই কেয়ারিং হাসনা খুব উপভোগ করে তবে মাঝে মধ্যে ভয়ও হয়। যদি রাজও ওর মায়ের মতো ছেলে চাওয়ার মানসিকতা পোষন করে কিন্তু ওর ছেলে না মেয়ে হলো তখন কি রাজ ওকে এভাবে যতনে রাখবে নাকি রাশেদের মতো আচরণ করবে? সেসব ভাবনায় মাঝে মাঝে হাসনার রাতগুলো নির্ঘুম কেটে যায়।
চলবে
#বড় গল্প
#ফেরারী বসন্ত
পর্ব-বিশ
মাহবুবা বিথী
প্রতিদিনের মতো হাসনা ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করে কিচেনে গিয়ে চুলায় চায়ের পানি চাপিয়ে দেয়। রাজ এসময় মর্নিং ওয়ার্ক করতে বাইরে বের হয়।চা বানিয়ে ফ্লাক্সে ঢেলে টেবিলে কাপ সহ রেখে দেয়। সাথে মুড়ি মাখা। ওর শ্বশুর আর চাচা শ্বশুর দুজনেই টেবিলে এসে কাপে চা ঢেলে নেয়। মুড়ি মাখা দিয়ে খেতে থাকে। এই ফাঁকে হাসনা চা আর মুড়িমাখা নিয়ে ওর দাদী শাশুড়ীর রুমে যায়। দাদী শাশুড়ী তখন নামাজ শেষ করেছেন। হাসনাকে দেখে মুচকি হেসে বলেন,
—শরীর কেমন আছে?
—আলহামদুলিল্লাহ, দাদীমা ভালো আছি।
চায়ের কাপটা আমেনা বেগমের হাতে তুলে দিয়ে হাসনা বলে,
—দাদী আপনার চা,
আমেনা বেগম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,
—এবার একটা ছেলে হলে ভালো হয়।
সাথে সাথে হাসনার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। মনে মনে বলে সাত সকালে এই প্রসঙ্গটা সামনে আনার কি দরকার ছিলো। সাথে সাথে ওর এটাও মনে হয়, মেয়ে হলে এরা কি কেউ খুশী হবে না? অথচ একজন মায়ের কাছে ছেলে সন্তান যেমন প্রিয় তেমনি মেয়ে সন্তানও। এমন সময় জারার শাশুড়ী জমিলা বেগম রুমে আসেন। হয়তো আমেনা বেগমের কথাগুলো শুনেছেন। সেই কথার সুত্র ধরে জমিলা বেগম বলেন,
–আম্মা,আজকাল ছেলে কিংবা মেয়ের কোনো তফাৎ নেই। উভয়কে একইভাবে বড় করে তুলতে হয়।
আমেনা বেগমও বলেন,
—-তা অবশ্য ঠিকই বলেছো।
হাসনা মনে মনে বলে এটাই যদি আপনারা মানেন তাহলে এই প্রসঙ্গে কথা বলার কি দরকার ছিলো। এরমাঝে ডোরবেল বেজে উঠে। বেল বাজার ধরণ দেখে হাসনা বুঝে ফেলে রাজ এসেছে। পরপর তিনবার চাপ দেয়। হাসনা দরজা খুলে দেয়। রাজ ভিতরে এসে ডাইনিং এর চেয়ারটায় বসে পায়ের মোজাগুলো খুলে ফেলে। গায়ের টিশার্টও ঘেমে গিয়েছে। ওটাও খুলে ফেলে। মনোয়ারা বেগম ততক্ষণে টেবিলে এসে বসেন। ফ্লাক্স থেকে চা কাপে ঢেলে নিয়ে তাতে চুমুক দিয়ে বলেন,
—-,হাসনার চারমাস হয়ে গেলে আলট্রাসনো করতে হবে।
—-এই সিদ্ধাম্তটা ডাক্তার নিবে। আমরা তো ডাক্তারের অনুমতি ছাড়া ইচ্ছে করে ওর সনোগ্রাফি করাতে পারি না।
—তাহলে এবার আমাকে তোদের সাথে নিয়ে যাস। আমিই ডাক্তারকে বলবো।
—-তুমি এতো সনোগ্রাফি নিয়ে ব্যস্ত হচ্ছো কেন?
—-কারণ আছে।
এরমাঝে রাজের বাবা আরশাদ চৌধুরী বললেন,
—-তোর মা যেহেতু বলছে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে।
রাজ ওর চাচার দিকে তাকিয়ে বলে,
—-চাচা,আজ তুমি আমার আগে অফিসে গেলে ভালো হয়। আরশীর স্কুলে প্যারেন্টস মিটিং আছে। আমাকে যেতে হবে।
—-ঠিক আছে,
এর মাঝে হাসনা টেবিলে দুটো সিদ্ধ ডিম আর ব্লাক কফি দিয়ে যায়। সাথে সাথে রাজ বলে,
—-এখান থেকে একটা ডিম নিয়ে যাও। তোমাকে আবার ওষুধ খেতে হবে। ডিমটা খেয়ে ওষুধ খেয়ে নিও।
মনোয়ারা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,
—তুই তো প্রতিদিন দুটো ডিম খেয়ে নিস। আজ আবার একটা খাচ্ছিস কেন? দরকার হলে হাসনা একটা সিদ্ধ করে নিবে।
—-মা আমি ছোটা বাচ্চা নই। আমার কখন কোনটা খেতে হবে সেটা আমি খুব ভালোভাবে জানি। বরং হাসনা নিজের প্রতি বড্ড অবহেলা করে। সে কারনে ওকে খেতে বললাম।
কিচেনে এসে হাসনা ডিমটা খেয়ে নেয়। তবে ওর খুব নার্ভাস লাগে। হাসনা জানে সনোগ্রাফি করার কারণটা কি? ছেলে না মেয়ে হবে ওর শাশুড়ী জানতে চায়। কিন্তু সনোগ্রাফি করার কারণ রাজ তো ওর মাকে জিজ্ঞাসা করতে পারতো? কিন্তু ওতো কিছু জিজ্ঞাসা করলো না বরং ওর মায়ের আমাদের সাথে ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা মেনে নিলো। এদিকে সায়েরা আর আরশীর স্কুলে যাওয়ার সময় চলে আসলো। হাসনা ওদের টিফিন রেডী করে রুমে গিয়ে ওদেরকে ডেকে তুলে। সকালে ওরা নাস্তা খেতে পারে না। ওদের নাকি বমি বমি লাগে। সে কারণে হাসনা টিফিন একটু বেশী করে দেয়। মেয়ে দুটো ওর বেশ বুদ্ধিমতী। শুধু ঘুম থেকে ডেকে তুলে দিলেই হয়। বাকি কাজ যেমন দাঁত ব্রাশ করা, হাতমুখ ধোয়া, ব্যাগটা গুছিয়ে নেওয়া স্কুলের ড্রেস পড়ে রেডী হওয়া সব ওরা নিজেরাই করে নেয়। আরশী অবশ্য সায়েরাকে সাহায্য করে। এর মাঝে ওর শাশুড়ী আর চাচী শাশুড়ী মিলে নাস্তা রেডী করে ফেলে। হাসনার শরীরটা একটু অসুস্থ বোধ করাতে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়।
হাসেমকে দেখতে না পেয়ে সিতারা ওর মোবাইলে ফোন দেয়। কিন্তু মোবাইল সুইচ অফ বলছে। বেশ কয়েকবার ফোন দেয় কিন্তু প্রতিবার একই রেজাল্ট আসে। এদিকে আসমা বেগম সিতারাকে নাস্তা করার জন্য ডাকে। অগত্যা হাসেমকে ছাড়াই সিতারা, আসমা বেগম,আর ওর শ্বশুর রায়হান মাস্টার একসাথে নাস্তা করে নেয়। কিন্তু সিতারা মনে মনে হাসেমের জন্য খুব অস্থির হয়। সকাল গড়িয়ে ঘড়ির কাঁটা দুপুর দুটোয় পৌঁছায়। সিতারা বাসার সামনে একটা অটো থামার শব্দ পায়। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে হাসেম অটো থেকে নামছে। ওর প্রচন্ড অভিমান হয়। বিছানায় ঘুমের ভাণ করে শুয়ে থাকে। হাসেমকে বাসায় ঢুকতে দেখে আসমা বেগম বলেন,
—-সাত সকালে কোথায় বেরিয়েছিস? আর এখন তোর ফেরার সময় হলো। মোবাইল অফ রেখেছিস কেন? সিতারা তোকে বহুবার ফোন দিয়েছে।
–চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছে। দেখ হাসেম,বিয়ের আগে যা করেছিস এখন আর এগুলো করতে যাবি না। এভাবে হুটহাট করে বাসা থেকে বের হওয়া যাবে না। মনে রাখিস, এখন তোর ঘরে বউ আছে।
—ঠিক আছে, এখন সবাইকে বলে বের হবো।
—সিতারাকে জানালেই হবে।
হাসেম রুমে ঢুকে গলায় শব্দ করে। কিন্তু সিতারার কোনো সাড়া শব্দ নেই। একসময় সিতারার অনামিকায় হাসেম একটা আংটি পরিয়ে দেয়। সিতারা শোয়া থেকে উঠে বসে। এরপর আংটির দিকে তাকিয়ে বলে,
—-তুমি আংটি কেনার জন্য সাতসকালে বেরিয়ে ছিলে?
—-হুম,বিয়ে উপলক্ষে তোমাকে আমি কিছুইতো দেইনি।
—-আংটিটা সুন্দর হয়েছে।
—-পরে দেখো অনামিকায় ঠিকঠাক মতো লাগে কিনা?
হাসনা আঙ্গুলে পরে দেখে একদম ঠিক আছে। ও অবাক হয়ে হাসেমকে বলে,
—তুমি তো আমার আঙ্গুলের মাপ নাওনি তাহলে এতো সঠিকভাবে কি করে আনলে?
— চোখের আন্দাজে কিনেছি। আমার প্রিয়তমার আঙ্গুলের মাপ যদি নাই জানলাম তাহলে আমি কেমন প্রেমিক?
এরপর হাসেম শার্টের পকেটে থেকে আর একটা লাল রঙের ছোটো বাক্স বের করে। সিতারা অবাক হয়ে বলে,
—আংটি দুটো এনেছো কেন?
—-আগে দেখোই না এতে কি আছে?
হাসেম একটা সাত পাথরের সোনার নাকফুল বের করে সিতারার হাতে দিয়ে বলে,
—-আজ এটা পরো। ইনশাআল্লাহ,একদিন আমার অনেক টাকা হবে সেদিন তোমাকে ডায়মন্ডের নাকফুল আর আংটি কিনে দিবো।
আনন্দের আতিশয্যে সিতারার মুখটা জ্বল জ্বল করছে। হাসেম সিতারার দিকে তাকিয়ে ভাবে,
“এই মেয়েটা খুব অল্পতেই খুশী হয়ে যায়।”
হাসেম অপলক দৃষ্টিতে সিতারার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হাসলে মেয়েটাকে ভীষণরকম সুন্দর লাগে। সিতারা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাকফুলটা পরার চেষ্টা করে কিন্তু পেরে উঠে না। এমনসময় হাসেম এগিয়ে এসে বলে,
—কাছে এসো,আমি তোমাকে পরিয়ে দিচ্ছি।
সিতারা হাসেমের একদম নিকটে চলে আসে। হাসেম সিতারাকে নাকফুল পরাতে গেলে ও জোরে হাঁচি দেয়। এতে নাকফুলটা ছিটকে পড়ে। হাসেমের মুখের উপর হাঁচি দেওয়াতে ও বিরক্ত হয়ে বলে,
—-তুমি এটা কি করলে?
—-কি করলাম?
—-এভাবে কেউ মুখের উপর হাঁচি দেয়?
—-বাইরের মানুষ তো দেয়নি। তোমার বউ দিয়েছে। তাতে সমস্যা কি?
—তোমার সব জীবানু আমার মাঝে ছড়িয়ে পড়লো।
—কত কিছু এখন ছড়িয়ে পড়বে। নাকফুলটা খুঁজে বের করে আমাকে আবার পরিয়ে দাও।
হাসেম রেগে গিয়ে বলে,
—-তুমি খুঁজে আন।
—- জ্বী না,তোমাকেই খুঁজতে হবে।
হাসেম জানে,ও যখন খুঁজবেনা বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুতরাং ওকে খুঁজতে হবে। অগত্যা হাসেম নাকফুল খুঁজতে শুরু করে। তাছাড়া আংটি আর নাকফুলটা কিনতে ওর পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ওর তিনমাসের টিউশনির টাকা। বেশিদূরে পড়েনি। খাটের পায়ার কাছে পড়ে ছিলো। নাকফুলটা তুলে সিতারার হাতে দিয়ে বলে,
—তোমার জিনিস তুমি পরে নাও।
—জ্বী না তুমি বলেছো পরিয়ে দিবে সুতরাং তোমাকেই পরিয়ে দিতে হবে।
অগত্যা হাসেম নাকফুল পরাতে শুরু করে। ওর ঘনশ্বাস সিতারার উপর পড়তে থাকে। সিতারার দেহ মন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে। নাকফুল পরাতে গিয়ে হাসেম সিতারার মুখটা খুব কাছ থেকে দেখতে পায়। কত নিশ্পাপ মুখশ্রী। অথচ কি ত্যাড়া টাইপের মেয়েরে বাবা!এমন সময় আসমা বেগম ওদের দুজনকে দুপুরের খাবার খেতে ডাকলেন। নাকফুল পরানো হলে হাসেম সিতারাকে বলে,
—এতো কষ্ট করে নাকফুল পরিয়ে দিলাম আমাকে গিফট দিবে না?
—-কিসের গিফট? মা খেতে ডাকছে, আমি গেলাম।
একথা বলেই সিতারা দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। হাসেম ওকে দৌড়ে যেতে দেখে মনে মনে বলে,
“পাগলি একটা।”
চলবে