#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — ছত্রিশ
কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!
মা যেমনই হোক, সন্তানের কাছে সবসময়ই ওই মানুষটা ভরসার ও সম্মানের হয়। পৃথিবীর অন্য সবার সাথে মায়ের সম্পর্ক ও রূপ খারাপ হলেও, সন্তানের কাছে তার সম্পর্ক সবসময়ই সুন্দর ও সেরা হয়। পৃথিবীতে ওই একটা নারীর ভালোবাসাই নিঃশ্বার্থ হয়। অন্য সব ব্যক্তি কিংবা সম্পর্কের ভালোবাসা এতটা গভীর হয় না, যতটা গভীর হয় মা ও সন্তানের মধ্যকার ভালোবাসা। ওই ভালোবাসা সবসময়ই, সব ভালোবাসার ঊর্ধ্বে থাকে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেই ভালোবাসা, দায়িত্ব-কর্তব্য ও সন্তানের প্রতি মায়ের সবটুকু আচরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলে। শায়লা সুলতানা বর্তমান ও অতীতের সমস্ত কাণ্ডকারখানায় আজ অসুস্থ মাহদিয়ার দুর্বল ও ভীতিগ্রস্ত মনে একটা কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, তার প্রতি মায়ের যে ভালোবাসা ছিল, সব কি মিথ্যে? অভিনয়? সবটাই কি লোকদেখানো? যদি মেয়েকে তিনি ভালোবেসে থাকেন, তবে মেয়ের সুখে পবিত্র সম্পর্কটাকে কেন গ্রহণ করতে পারেননি? কেন এতগুলো দিন সন্তানকে বৈধ সম্পর্কের বন্ধন, ভালোবাসা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখলেন? শুধু এই ক’টা প্রশ্নের সঠিক উত্তর চায় তার মন। এতে হয়তো মনের ভেতর যে অবিশ্বাসের দেয়াল গড়ে উঠেছে, তা ভেঙে ফেলা সহজ হবে। জেনে-বুঝে কে চায় মায়ের মমতাকে দূরে সরিয়ে, চিরকাল তার প্রতি ঘৃণা জমিয়ে বাঁচতে? মায়ের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা যে সন্তানের মনে গভীর শ্রদ্ধাভরে লুকিয়ে আছে, সে কোনোদিন চাইবে না, মা তার ঘৃণার পাত্রী হয়ে থাকুক। এই কারণেই শায়লা সুলতানার ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্টস্বরে মাহদিয়া জানতে চাইল,
-‘তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো, তাই না মা?’
মায়েরা সন্তানদের কত ভালোবাসে, তার প্রমাণ দিতে হয়? যন্ত্র দিয়ে মেপে দেখাতে হয়? মাহদিয়ার মুখ থেকে এমন বাক্য শোনে খুব বেশি চমকালেন না শায়লা সুলতানা। শুধু ম্লানমুখে বললেন,
-‘সন্দেহ হচ্ছে তোর?’
-‘হওয়া স্বাভাবিক মা। তুমি যা করেছ তাতে যে কারও মনে সন্দেহ জাগবে! সৎ মায়েরা এতটা নিকৃষ্ট হয় কি-না আমার জানা নেই, যতটা তুমি নিজের মেয়ের বেলায় হলে।’
-‘আমি যা করেছি তোর ভালোর জন্য করেছি।’
শায়লা সুলতানার এই স্পষ্টবাক্য শোনে মাহদিয়া যারপরনাই অবাক হলো। মলিনস্বরে বলল,
-‘তার মানে তুমি এসব ইচ্ছে করেই করেছ?’
-‘হ্যাঁ করেছি। কী আছে ওই শাদাবের? ব্যাংক-ব্যালেন্স কত আছে? জমিজমা আছে? পারবে সারাজীবন তোর দায়িত্ব নিতে? এতদিন ধরে ও যা ইনকাম করছে নিজের মা ও ভাইয়ের জন্য। তোর জন্য কী করেছে? কত টাকা জমিয়েছে? এসব কিছু জিজ্ঞেস করেছিস? তোর নামে কোনো বাড়ি কিনেছে? ব্যাংকে টাকা রেখেছে? কিছুই করেনি। ওর কাছে থাকলে তুই কী পাবি? দিনরাত খোঁটা শুনবি? গালি শুনবি? তোর মা ভালো না, খারাপ। তোর বাবা তাদের দানের টাকায় এতদূর এগিয়েছে। এসব শোনে সুখে থাকবি ওখানে?’
শায়লা সুলতানার এসব অযৌক্তিক ভাবনা ও সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যতের চিন্তা দেখে ভয়ানকভাবে অবাক হলো মাহদিয়া। কীসের খোঁটা, কী নিয়ে খোঁটা, এসব দিক পরিষ্কার করতে বলল,
-‘খোঁটা হতে যাবে কেন? ওসব তো সত্যিই, তাই না? যা সত্যি, তা তো সবসময়ই সত্যি। সত্যি কোনোদিন মিথ্যে হয় না। এতদিন ধরে, ওই মানুষগুলো সম্পর্কে এই ধারণা হয়েছে তোমার? কখনও, কোনোদিন, আন্টি তোমাকে এসব নিয়ে খোঁটা দিয়েছেন? কখনও বলেছেন, এসব হয়েছে তাদের দেয়া দান-খয়রাতের টাকায়? বলেননি তো। তবে তুমি কেন এসব মিছে ভয়কে মনে জায়গা দিচ্ছ?’
শায়লা সুলতানা চুপ হয়ে গেলেন। কোনোদিন সায়রা করীম এসব বলেননি। উলটে বলতেন, মানুষ মানুষের জন্য। তিনি নিজেই ভয় থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখেছিলেন। ভেবেছিলেন, শাদাব তার একমাত্র মেয়েকে কেড়ে নিবে। এ-ও ভেবেছেন, যদি ওই বিপদের সময়ে সায়রা করীম তার কাছে সাহায্য-সহযোগিতা চান, টাকা-পয়সা চান, তবে যে তাঁকে সাহায্য করা বাধ্যতামূলক হয়ে যেত। এত কষ্ট করে বিলেত গিয়ে, সেটেল্ড হয়ে, দু’হাত ভরা টাকা ইনকাম করে কাউকে ফ্রিতে বিলিয়ে দিবেন, এতটাও উদার মন-মানসিকতা মানুষ তিনি হতে পারেননি। এখনও হোননি। নিজের স্বার্থ ভাবতে, সবকিছুই তিনি করতে পারেন। প্রয়োজনে সম্পর্ক গড়তে পারেন, আবার ভাঙতেও পারেন। কোনো ফকির-মিসকিন ও অন্যের দয়াদাক্ষিণ্য নিয়ে বাঁচা ছেলের হাতে কোনোদিন মেয়েকে তুলে দেয়ার কথা ভাবতেও পারেন না তিনি। তখন তো বিয়ে দিয়েছিলেন, বিরাট সম্পত্তি দেখে। এখন দিয়ে কী হবে? কী দেখেই-বা দিবেন? কিছুই তো নেই। যার কিছু নেই, তার হাতে কেন নিজের মেয়েকে তুলে দিবেন তিনি? দুনিয়া কি এত সস্তা? ফকিরকে যেচেপড়ে কোটিপতি বানাবেন? রাস্তায় বসেছিল ওরা, এটাই তো তার কাছে অত্যাধিক আনন্দের বিষয় ছিল! সেই আনন্দকে মাটি করে মেয়েকে কী করে শাদাবের ঠিকানা দিতেন তিনি? কীভাবে বলতেন, যোগাযোগ হয়েছিল? জীবনে বড়ো হতে লেগে উদার হয়ে নয়, মানুষকে ঠকিয়েই বড়ো হতে হয়! এই ভাবনাটাই শায়লা সুলতানাকে এতদূর অবধি এগোতে সাহায্য করেছে।
মাকে চুপ থাকতে দেখে মাহদিয়া বলল,
-‘জীবনে সুখী হওয়ার জন্য টাকাই কি সব, মা? কোটি কোটি টাকা দিয়ে কী করব, যদি সম্পর্কে ভালোবাসা ও বিশ্বাস না থাকে? এইযে, তুমি আমাকে এতকিছু দিয়েছ। যখন যা চেয়েছি, পেয়েছি। এসব কি টাকার বাহাদুরি দ্যাখাতে দিয়েছ, না-কি নিজের মায়া-মমতা থেকে? যদিও আমার প্রতি তোমার সব ভালোবাসাকে আজ তুচ্ছ অভিনয় মনে হচ্ছে।’
-‘এখন তো এসবই বলবি। ওরাই তোর আপন, আমি কেউ না।’
-‘ওরা সবসময়ই আপন ছিল মা। আমার প্রতি, ওদের সবার আত্মিক টান ও ভালোবাসা ছিল। দূরত্বও সেই টানের কাছে হার মেনে নিয়েছে। অথচ তুমি-ই বুঝলে না। জেনে-বুঝে আমাকে ওদের থেকে দূরে রাখলে। তা-ও একদিন, দুইদিন না, পনেরোটা বছর। ভুল আমারই জানো, আমি কোনোদিন তোমার ফোন ঘাটাঘাটি করিনি। নিজে থেকে কোনোদিন দেশে যোগাযোগ করিনি। তোমাকে বিশ্বাস করেছি। তোমার কথাকে ভরসা করেছি। ভেবেছি, দেশ থেকে সায়রা আন্টি অথবা শাদাবের ফোন আসলে তুমি একবার অন্তত আমাকে ডাকবে। অথচ তুমি তা কোরোনি। দিনের পর দিন আমার মনে ওদের প্রতি ভুল ধারণা জাগিয়ে দিয়েছ। ভাগ্যিস, ছোটো মামা আমাকে সব সত্যি বলেছিলেন, নয়তো আমি ওই দুটো মানুষকে ভুল বুঝেই জীবন কাটিয়ে দিতাম।’
-‘বেশ করেছি। যাদের আমি ইচ্ছাকৃতভাবে রাস্তায় নামিয়েছি, তাদের ঘরে আবার তোকে পাঠাব এটা তুই ভাবিস কী করে?’
-‘তিনটে মানুষের সাথে অন্যায় করেও, এত বড়ো গলায় কথা বলছ কী করে? লজ্জা হয় না তোমার? ছিঃ। যে মানুষগুলোর কারণে জীবনে সুখ খুঁজে পেলে সেই মানুষগুলোকেই রাস্তায় নামি দিলে! আবার বলছ, বেশ করেছ! কেউ উপকার করলে, তার দাম এইভাবে দিতে হয়? তোমার বিবেক বলতে কিচ্ছু নেই মা। তুমি লোভে অন্ধ হয়ে গিয়েছ। কঠিন শা স্তি পাওয়া উচিত তোমার। কঠিন শা স্তি।’
এ পর্যায়ে শায়লা সুলতানা ঘাবড়ালেন। মেয়ে কী শা স্তি দিবে সেটা ভেবেই শরীর বেয়ে ঘাম ছুটতে শুরু করল। কিছু বলার আগেই মাহদিয়া বলল,
-‘কী করবে, ওই তিনটে মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়ে, সব ঘটনা স্বেচ্ছায় পুলিশকে বলে অ্যাটেম টু মা র্ডা রের মা ম লায় জে লে যাবে, না-কি চিরদিনের জন্য দেশ ছাড়বে?’
তিনি এবারও চুপ রইলেন। মরে গেলেও সায়রা করীমের পায়ের কাছে তিনি কোনোদিনও মাথা নত করবেন না। প্রয়োজনে দেশ ছাড়বেন তবুও অন্যায় স্বীকার করবেন না। মনে মনে ফন্দী আঁটলেন তিনি। মাহদিয়াকে বোকা বানিয়ে দেশ ছেড়ে পালাবেন। সঙ্গে মেয়েকেও টেনে নিতে পারলে, সব প্ল্যান সাকসেসফুল। তাই তিনি কিছুটা কান্নামাখা স্বরে বললেন,
-‘তুই মায়ের সাথে এসব করতে পারবি?’
-‘যে অন্যায় তুমি করেছ, এত সহজে তোমার সব অন্যায় ক্ষমা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না। কঠিন শা স্তি হওয়া উচিত তোমার।’
-‘তুই আমার সাথে রুড বিহেভ করছিস, এটাই তো কঠিন শা স্তি হয়ে যাচ্ছে।’
স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
-‘কী গো, তুমি কিছু বলছ না কেন? মেয়ে আমাকে এত কথা শোনাচ্ছে, আর তুমি চুপ করে আছো! কিছু বলবে না?’
মেয়ের মন-মানসিকতা দেখে আনন্দে বুক ভরে উঠল আজাদ সাহেবের। তিনি তার এরূপ সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছেন। এজন্যই মা-মেয়ের কথার মাঝখানে কিছু বলেননি এতক্ষণ। এখন স্ত্রীর মুখ থেকে আহ্লাদী কথা শোনে তাচ্ছিল্যভরা স্বরে বললেন,
-‘আমি কী বলব? আমার কোনো সিদ্ধান্তের দাম আছে? কী করিনি তোমার জন্য আমি? দু’হাত ভরা সুখ এনে দিয়েছি। তা-ও তুমি সুখী নও। উলটে মেয়ের সংসার ভেঙে দেয়ার খেলায় মেতে উঠেছ। ভাবতেও খারাপ লাগছে, এতদিন তোমার মতো একটা গিরগিটিকে নিয়ে ঘর-সংসার করেছি। মানুষ চিনতে পারিনি। আফসোস হচ্ছে আজ, ঘোর আফসোস!’
মাহদিয়া থমথমে গলায় বলল,
-‘পুলিশ তোমাকে কোনো শা স্তি দিবে না। তোমাকে শা স্তি দিব আমি। দূরত্ব বোঝো? সন্তান দূরে থাকার কষ্ট বোঝো? গর্ভের সন্তান হারানোর যন্ত্রণা বোঝো? আজ থেকে এটাই হবে তোমার শা স্তি। যাও। এক্ষুণি এখান থেকে, এই দেশ ছেড়ে চলে যাও তুমি। আর কোনোদিন আমার সামনে আসবে না। কোনোদিন আমাকে মেয়ে বলে দাবী করবে না। তোমার জন্য একটা হাসিখুশি পরিবার নষ্ট হয়ে গেছে। তোমার জন্য দুটো সন্তান বাবা হারিয়েছে। তোমার জন্য এক নারী তার দীর্ঘ বছরের বিশ্বাস, ভালোবাসা হারিয়েছে। তোমার শা স্তিও ঠিক একইরকম হবে।’
শায়লা সুলতানা নড়লেন না। দাঁড়িয়েই রইলেন। আজাদ সাহেব বললেন,
-‘কী হলো দাঁড়িয়ে আছো কেন? নেক্সট ফ্লাইট কখন খোঁজ নাওনি? যাও। ফ্লাইট ধরো। এখানে বসে বসে মশা মারতে হবে না তোমার।’
-‘দিয়াকে না নিয়ে কোত্থাও যাব না আমি।’
আজাদ সাহেব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন। মাহদিয়াকে ছেড়ে, উরাধুরা কয়েকটা চড়-থাপ্পড় মারলেন নিজের স্ত্রীকে। শায়লা সুলতানা তা-ও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এত অন্যায় করেও একটা মানুষের এরূপ আচরণ দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন আজাদ সাহেব। টানতে টানতে কেবিন থেকে বের করলেন। শায়লা সুলতানা চিৎকার-চেঁচামেচি করে বললেন,
-‘ছাড়ো আমাকে। আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে দাও। ও’কে না নিয়ে আমি কোথাও যাব না।’
-‘তুমি যাবে তোমার ঘাড়ও যাবে। আজকের মধ্যে যদি ফ্লাইট না ধরো, তোমাকে আমি জে লে না দিয়ে নিজের হাতে খু ন করব। বাঁচতে চাও তো, মেয়ের সুখী জীবনে বাঁধা না হয়ে চিরদিনের জন্য দূরে চলে যাও। যদি কোনোদিন বিবেক তোমাকে ভাবীজানের পায়ের কাছে নিয়ে ফেলে, সেদিন এসো। নয়তো বাংলাদেশের নামও তুমি আর মুখে নিবে না।’
শায়লা সুলতানা কেবিন ছেড়ে বাইরে যেতে নারাজ। দেয়ালে হাত চেপে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইছেন। আজাদ সাহেবও দমে গেলেন না। শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে টেনেটুনে তাকে কেবিনের বাইরে নিয়ে এলেন। চড়-থাপ্পড় তো থামছেই না। একাধারে মারছেন। শাদাব এই দৃশ্য দেখে বোকা বনে গেল। বাঁধা দিয়ে বলল,
-‘আংকেল, কী করছেন?’
-‘পথের কাঁটা দূর করছি। তুমি দিয়ার কাছে যাও। আমি এই অসভ্যটাকে এ্যায়ারপোর্ট ছেড়ে আসি।’
শাদাব দৌড় দিল। তার শুধু মনে হলো, কেবিনে মাহদিয়া একা। মেয়েটার মনের জোর দরকার। এই দু’জনের মাঝখানে সে কোনোভাবেই থাকবে না। যা হয় হোক, তাকে নিজের স্ত্রীর সুস্থতার কথা ভাবতে হবে।
শায়লা সুলতানা রাগে, ক্ষোভে অন্ধ হয়ে গেলেন। স্বামীকে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললেন,
-‘বলেছি না যাব না। ওটা আমার মেয়ে। মেয়েকে ছেড়ে এক’পাও নড়ব না আমি।’
কথা শেষ করে আবারও কেবিনের দিকে ছুটতে চাইলেন তিনি। আজাদ সাহেব পিছন থেকে তার জামার অংশ টেনে ধরে মাঝপথে আটকে দিয়ে বললেন,
-‘ছু রি চিনো? শুধু একবার ব্যবহার করব। একদম গলায়। তাতে আমার জে ল ফাঁ সি যা হয় হোক, তবুও তোমার মতো কালসাপকে এত সহজে ছেড়ে দেব না।’
-‘তুমি কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছ।’
-‘বাড়াবাড়ি তো তুমি করেছ। এখনও করছ। তোমাকে এতক্ষণ এখানে সহ্য করছি, এটাই তোমার ভাগ্য।’
এভাবে যে আর পারবেন না, সেটা শায়লা সুলতানা বুঝে গেলেন। কিন্তু তবুও সায়রা করীমের কাছে ক্ষমা তিনি চাইবেন না। প্রয়োজনে দেশ ছাড়বেন, তবু কারও পায়ের কাছে মাথা নোয়াবেন না। জীবনে সুখ, সম্মান এমনি এমনি আসেনি। অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে, শ্রম দিয়ে তা আনতে হয়েছে। এত সহজে সব সুখ নষ্ট করে দিবেন? মেয়ে দু’দিন পর ঠিকই মায়ের খোঁজ করবে! মায়ের চেয়ে মাসির দরদ কী আর বেশি হয়?
***
-‘ভ্রমর…।’
আধশোয়া হয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছে মাহদিয়া। কান্নায় কোনো আওয়াজ না হলেও তার ভেতরে যে ঝড় যাচ্ছে সেটা শাদাব ঠিকই বুঝতে পারল। পাশে বসে হাত ধরার পরও মেয়েটা কোনো রেসপন্স করেনি। মুখ ফিরিয়েই রেখেছে। তার এই অভিমানী রূপ দেখেই মৃদুস্বরে ‘ভ্রমর’ বলে ডাক দিল শাদাব। সঙ্গে সঙ্গে দু’চোখ বন্ধ করে নিল মাহদিয়া। ঠোঁট কামড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। অস্ফুটস্বরে বলল,
-‘মা পালটাবে না শাদাব। কখনওই না। অতিরিক্ত অহংকারের কারণে ভুলেই গিয়েছেন, আমি ওনার মেয়ে। আমার কথা তো ভাবতেই পারতেন একবার। আমার জন্য হলেও আন্টির কাছে ক্ষমা চাইতে পারতেন।’
বাবা ছাড়া সন্তানেরা যেমন অসহায়, একা, এতিম হয়ে পড়ে, মা ছাড়া একটা সন্তানের পরিস্থিতিও তেমন হয়। মাহদিয়ার পরিস্থিতি যেমনই হোক, আগামীর দিনগুলো মেয়েটার খুব কষ্টে কাটবে। যতই মাকে দূরে সরাক, যতই সম্পর্ক এড়িয়ে চলুক, মনের ভেতর মায়ের জন্য যে আত্মিক টান, সেটা কীভাবে অস্বীকার করবে? শাদাব তাকে সান্ত্বনা দিতে দু’হাতে বুকের ভেতর আগলে নিয়ে বলল,
-‘তুমি এসব নিয়ে ভেবো না। নিশ্চয়ই উনি ওনার ভুল বুঝতে পারবেন।’
-‘কোনোদিনও না। লোভে পড়ে যে মানুষ নিজের সন্তানের গায়ে হাত তুলে, সে কোনোদিন নিজের ভুল স্বীকার করবে না। আমি কখনও ভাবিনী, এমন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। মা’কে অনেক ভালোবাসি আমি।’
-‘একটু ধৈর্য্য ধরো, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
-‘কিচ্ছু ঠিক হবে না শাদাব। ঠিক হওয়ার হলে আজই হোতো। আমার এই অবস্থা দ্যাখার পর, মা হয়ে ওনার উচিত ছিল, সব লোভ-লালসাকে পিছনে ফেলে, একবার আমার জন্য ভাবা। অথচ মা সেটা করেননি উলটে…।’
-‘হুসস্, শান্ত হও। উল্টাপাল্টা চিন্তা মাথা থেকে দূর কোরো। আমি জানি, অন্য কাউকে দিয়ে মায়ের অভাব পূরণ করার ক্ষমতা আমার নেই। তবে আমার মনে যতটুকু অনুভূতি আছে, সবটা দিয়ে তোমার চোখের পানি মুছে দিতে পারব। একটু ভরসা কোরো। কখনও, কোনো পরিস্থিতিতে তোমার হাত আমি ছাড়ব না। এখন যেভাবে আছি, সারাজীবন থাকব।’
নীরবতা দিয়ে উষ্ণ আলিঙ্গনের মাধ্যমে সদ্যপ্রাপ্ত ব্যথাটুকু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করল মাহদিয়া। শাদাব বলল,
-‘প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে আপন কিছু মানুষের শূণ্যতা সবসময়ই থাকে। এই শূণ্যতা থাকে বলেই আমরা বুঝতে পারি, আমাদের জীবনে একজন আপন মানুষের প্রয়োজন ঠিক কতখানি। উনি তো তোমার মা। দূরে থাকলেও, তুমি ঠিকই মা’কে উপলব্ধি করবে। আমি তোমাকে বলব না, এই দূরত্বটাকে তুমি চিরস্থায়ী কোরো। আমি শুধু বলব, ওনি যে ভুল করেছেন, অন্যায় করেছেন, এটা ওনাকে মন থেকে উপলব্ধি করার সময়-সুযোগ দাও। দ্যাখবে, সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে।’
আসলেই সব ঠিক হবে? শায়লা সুলতানা অনুতপ্ত হবেন কোনোদিন? নিশ্চিত হতে পারল না মাহদিয়া। তবে সে বুঝতে পারল, মায়ের থেকে দূরে থাকা অসম্ভব। শত হলেও ওই নারী তার জন্মদাত্রী। খারাপ হলেও উনি মা, ভালো হলেও মা। মা’কে কি আর ভুলে থাকা সম্ভব হবে?
দু’জনের কথা বলার মাঝখানেই লোকাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসে উপস্থিত হোন হসপিটালে। তিনি এসে যখন দেখলেন, শায়লা সুলতানাকে ধরেবেঁধে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, অবাক হলেন। কন্সটেবল দু’জনের মাধ্যমে ওনাদের হসপিটালের বাইরেই অপেক্ষা করিয়ে রাখলেন। এরপরই আসলেন, মাহদিয়ার সাথে কথা বলতে। দরজায় নক দিয়ে অনুমতি চাইলেন। শাদাব নিজেই তাঁকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিল। একটা চেয়ার এগিয়ে দিল। তিনি গম্ভীর মেজাজে চেয়ারে বসে মাহদিয়ার শারিরীক সুস্থতা-অসুস্থতার খোঁজ জানতে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-‘আপনি কি আগের চেয়ে একটু সুস্থবোধ করছেন? যদি দুটো মিনিট সময় দিতেন আমাকে।’
মাহদিয়াকে স্বাভাবিকভাবে বসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করে দিল শাদাব। ভর দেয়ার জন্য পিছনে নরম বালিশ রাখল। হাতের নিচেও একটা বালিশ রেখে নিজে একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। মাহদিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শাদাবের দিকে তাকাল। হুট করে কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না সে। তাই সাহস সঞ্চয় করার জন্যই নীরবে দৃষ্টি বিনিময়। শাদাবও তাকে নির্ভয়ে সবটা শেয়ার করতে বলল। ওখানে কী ঘটেছে, তার প্রত্যক্ষদর্শী যেহেতু সে, তা-ই তাকেই সবটা স্পষ্ট করে বলতে হবে। মনের ভেতর সাহস সঞ্চয় করে বলল,
-‘আপনার যা জিজ্ঞেস করার আছে, করতে পারেন!’
-‘ওয়েল, ওখানে ঠিক কী কী ঘটেছে একটু পরিষ্কার করে বলবেন? আপনার গায়ে আঘাতটা কী করে লাগল? ওখানে কি আর কেউ ছিল না? ঝামেলাটা ঠিক কী নিয়ে?’
শুরু থেকে সব ঘটনা একটা একটা করে বলে গেল মাহদিয়া। কিচ্ছু বাকি রাখল না। সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা, তাকে ভুল বুঝিয়ে আটকে রাখা, সম্পর্কটাকে জোরপূর্বক ভাঙতে চাওয়া, সায়রা করীম ও শাদাবকে বাড়ি থেকে বিদায় করে দেয়া, একেবারে যাবতীয় ঘটনার সবটাই স্পষ্টবাক্যে প্রকাশ করল। এরপর বলল,
-‘উনি আমার মা। আমি জানি মা ভুল করেছেন। এরজন্য আমি বা আমরা কেউ-ই ওনাকে ক্ষমা করতে পারব না। কিন্তু একটা কথা সত্য যে, আইন ওনাকে ঠিক করতে পারবে না। এজন্যই আমি চাইছি, কেইসটা তুলে নিতে। ওনার যা শা স্তি, সেটা আমি ওনাকে দিয়েছি। উনি অনুতপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সবার কাছে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত, ওনার সাথে কোনোপ্রকার যোগাযোগ আমরা কেউ-ই রাখব না।’
-‘আইনের ওপর আপনার বিশ্বাস নেই?’
-‘অবশ্যই আছে। কিন্তু কিছু বিচার আইনকে দিয়ে করাতে হয় না। বিচার করতে হয়, তাঁর তৈরী ফাঁদে তাঁকে ফেলে দিয়ে। আমি মনে করি, আমার ও বাবার থেকে সবসময়ের জন্য যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখা, এটাই মায়ের সর্বোচ্চ শা স্তি। এই শা স্তি না দিলে, ওনার বিবেকের দরজা কোনোদিন খুলবে না। আপনার আইন তাকে কতদিন শা স্তি দিবে? একমাস? দু’মাস? এক বছর? এরপর? এরপর তো তিনি আরও বেশি বর্বর হয়ে উঠবেন। তখন কী করবেন? উনি পূণরায় কারও না কারও ক্ষতি করতে মাঠে নামবেন। জেল-জরিমানা সবার বিবেককে জাগাতে জানে না অফিসার। ওটা শুধু পারে, আরও হিংস্র করে তুলতে। হিংসাত্মক মনোভাবাপন্ন মানুষ জেলে থাকলে দিনদিন শুধু হিংস্র হয়, মানুষ হয় না।’
মাহদিয়ার কথা শোনে শাদাব ও পুলিশ অফিসার দু’জনেই চমকালেন। আদতে, এটা শায়লা সুলতানার সঠিক শা স্তি হবে তো? পুলিশে দিয়েও লাভ হতো না বোধহয়। ক’দিন পর তিনি ঠিকই ছুটে এসে আগের রূপ ধারণ করতেন। কেইসটা তো সাধারণ। এত বেশি কঠিন ও জটিল নয়! তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য অফিসার আবারও জানতে চাইলেন,
-‘আপনি শিওর, কেইসটা তুলে দেব? পরবর্তীতে যদি এরকম ঝামেলা হয়, আমাদেরকে তখন পাশে পাবেন না।’
-‘হবে না ইন-শা-আল্লাহ্! সেরকম কোনো সুযোগ আসতে দেব না। আপনি মা’কে এ্যায়ারপোর্ট অবধি যেতে দিন। প্রয়োজনে সিকিউরিটি রাখুন। আজ যদি উনি দেশ ছাড়েন, আগামী তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ফিরতে পারবেন না। তিন বছর সন্তানের থেকে দূরে থাকলে, ওই মা অনুতপ্ত হতে বাধ্য।’
-‘ওকে। আপনি যা ভালো বুঝেন। আমরা কেইসটা উইথড্র করছি।’
পুলিশ অফিসার চলে যাওয়ার পর, নিজেকে হালকা করতে বেশ খানিকক্ষণ সময় নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল মাহদিয়া। শাদাব একটা প্লেটে সামান্য খাবার নিল। চব্বিশ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে মেয়েটা অভুক্ত। শরীর ও মনকে সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত খাবার জরুরী। খাবারের প্লেটটা একপাশে রেখে গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ বের করে গ্লাসে পানি ঢেলে মাহদিয়ার মুখের ধরে রেখে বলল,
-‘হা কোরো।’
আচমকা এই শব্দে ভরকে গেল মাহদিয়া। সামান্য কেঁপে উঠল। সামনে তাকিয়ে ঔষধ দেখে বিনাবাক্যে সেটা মুখে তুলে পানির সাহায্যে গিলে ফেলল। বলল,
-‘অসুস্থতা আমার পিছু ছাড়ছে না। তুমি বোধহয় আমার জন্য একটুও প্রার্থনা কোরো না। স্ত্রীর জন্য একটু প্রার্থনা তো করতেই পারো। স্বামীর দোয়াটোয়া না থাকলে সুস্থ হব কী করে?’
-‘না তো। আমি কেন প্রার্থনা করব? আমি তো শুধু ফ্রিতে ট্রিটমেন্ট-ই করতে পারি। ওসব দোয়াটোয়া আমার আসে না।’
মাহদিয়া মুখ বাঁকিয়ে বলল,
-‘ফ্রিতে ট্রিটমেন্ট করছ ভালো কথা। তাই বলে একটু দোয়া করতে পারবে না? কেউ অসুস্থ হলে তারজন্য দোয়া করতে হয় এসবও জানো না? দুচ্ছাই, এমন মানুষ…।’
আর কিছু বলার সুযোগ দিল না শাদাব। ঝটপট মুখের ভেতর খাবার ঢুকিয়ে দিল। হুটহাট এহেন কাণ্ডে মাহদিয়া বোকা বনে গেল। খাবার চিবোতে চিবোতে একগাদা বকা দিল। হাসিমুখে সব বকা হজম করল শাদাব। ধীরেসুস্থে পুরো খাবারটা শেষ করে, ঔষধ খাইয়ে দিল। বিশ্রাম নেয়ার কথা বলে পূণরায় শুইয়ে রেখে, কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল,
-‘আমি যাকে চাই, তাকে প্রতি মোনাজাতে চাই। তার সুস্থতা চাই। তার দীর্ঘায়ু জীবন চাই। চাই সে সারাজীবন আমার পাশে থাকুক। তার সুস্থ জীবন চাওয়ার জন্য অসুস্থতা কোনো ইস্যু না হোক। আমার সকল প্রার্থনায় আমি তোমার সুস্থতা, সুখ-শান্তি, কামনা করি ভ্রমর। কখনও কোনো দুঃখ তোমায় স্পর্শ না করুক। কোনোদিন যেন নিজেকে তুমি একা না ভাবো। আমি যেন তোমার সব দুঃখ-কষ্ট দূর করে দিতে পারি। তোমার সাহস হতে পারি। দিনরাত আরও কত-শত প্রার্থনা করি জানো? জানো না।’
***
চলবে…