#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — আটত্রিশ (১)
কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!
‘কুঞ্জকানন’-এর প্রবেশদ্বারে পৌঁছাতেই অদ্ভুত সুখানন্দে অভিভূত মাহদিয়া নতুন নীড়ে পদার্পণের এই বিস্ময়কর মুহূর্তকে মন থেকে উপলব্ধি করার জন্য গেটের কাছেই গাড়ি থামাতে বাধ্য করল। শাদাব বুঝল না, এখানেই কেন গাড়ি থামাতে হবে। একেবারে ঘরের কাছে গেলেই তো হয়। কিন্তু মাহদিয়া নাছোড়বান্দা। এখানেই থামাতে হবে। বাধ্য হয়ে মূল ফটকের সামনেই ব্রেক কষল শাদাব। সঙ্গে সঙ্গেই ডোর খুলে বাইরে বের হয়ে ডানা ঝাপটানোর জন্য চঞ্চল ভ্রমরের ছোটাছুটি শুরু হলো। তড়িঘড়ি করে ছুটে এসে তার চঞ্চলতাকে থামিয়ে দিল শাদাব। এক’পা এগোনোর আগেই হাত ধরে আটকে রেখে বলল,
-‘দৌড় দিচ্ছ কেন? মাথা ঘুরাবে তো। যদি পড়ে যাও কী হবে, জানো না?’
মাহদিয়া শুনল না। শাদাবের হাত ধরে সাহস নিয়ে আরও দু’পা এগোলো। বলল,
-‘তুমি হাতটা ধরো শুধু। আমি নিজের পায়ে হেঁটে হেঁটে ভেতরে যাব।’
-‘কেন? আমি নিয়ে গেলে অসুবিধা কী?’
-‘মোটেও কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু আমি চাই, এই ঘরে তোমার হাতে হাত রেখে প্রবেশ করতে, কোলে চড়ে নয়।’
-‘তুমি অসুস্থ ভ্রমর। অসুস্থ মানুষ অন্য একজনের সাহায্য নিতেই পারে। এতে দোষের কিছু নেই।’
-‘দোষ-গুণ ওসব বুঝি না। আমি শুধু চাই, প্রথম প্রবেশটা বিশ্বস্ত হাতকে আঁকড়ে ধরার মাধ্যমেই হোক।’
পিছন থেকে ইভানা ওদের খুঁনসুটি দেখে মুচকি হাসছিল। যখন একে-অপরের হাতটা শক্ত করে ধরে ‘কুঞ্জকানন’-এর ভেতরে প্রবেশ করে ফুলেভরা রাস্তার মাঝখান দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনই দূর থেকে একটা সুখকর মুহূর্ত ফ্রেমবন্দী করার জন্য ফোনের ব্যাক ক্যামেরা অন করে ‘দিয়া’ বলে ডাক দিতেই ওই মুহূর্তে কয়েক সেকেন্ডের জন্য পিছনে তাকিয়েছিল মাহদিয়া। তাতেই কাজ হলো, ফট করে তার হাসিমাখা মুখের একটা চমৎকার ছবি তুলে ফেলল ইভানা। সেটা আবার নাবহানের হোয়াটসঅ্যাপে সেন্ড করে, ম্যাসেজে কিছু একটা লিখে দিয়ে, শিহাবকে ছবিটা দেখিয়ে বলল,
-‘ঘরের প্রাণকে এইভাবেই সম্মান ও ভরসার সাথে ঘরে তুলতে হয়। শিখে রাখো। তোমার বউকেও এইভাবে তুলতে হবে।’
শিহাব ভাবুক নয়নে তাকাল। ‘ঠিকই বলেছ’ বলে দৌড়ের ওপর বাগানের তাজা তাজা ফুল থেকে ছোটো-বড়ো একগুচ্ছ ফুল হাতে তুলে নিয়ে ভাইয়ের পিছনে দৌড় দিল। ঘর ছেড়ে তখন বাইরে আসলো সায়রা করীমের ‘হেল্পিং হ্যান্ড’ রেহনুমা। ইভানার সাথে কাজে হাত লাগাতে সবগুলো ব্যাগপত্র থেকে যতটা পারল, নিজেই আনল। বাকিগুলো ইভানা নিল। সায়রা করীম ভেতরে প্রবেশ করতে করতে দু’জনের জন্য একগাদা প্রার্থনা করলেন। তিনি প্রার্থনায় একটা কথাতেই জোর দিলেন বেশি। বার বার রিপিট করলেন,
-‘আমৃত্যু ওরা এই ঘরটাতেই হেসেখেলে বাঁচুক। ওদের সম্পর্কটা দীর্ঘস্থায়ী হোক, খোদা। জীবনে যত ঝড়তুফান আসুক, সবকিছুতে ওরা একে-অপরের ভরসা হয়ে উঠুক। আমার মতো আর কোনো নারী কোনোদিন বিশ্বাস হারানোর যন্ত্রণায় ছটফট না করুক।’
ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করে মাহদিয়াকে সোফায় বসিয়ে রাখল শাদাব। বোতল থেকে পানি ঢেলে একগ্লাস পানি বাড়িয়ে দিল। ক্লান্তি দূর করতে পানিতে চুমুক দিয়ে নতুন ঘর, নতুন অনুভূতি ও নতুন সুখটাকে উপভোগ করতে লাগল মাহদিয়া। গ্লাস রাখা মাত্রই হুড়মুড়িয়ে তার সামনে দাঁড়াল শিহাব। হাতে থাকা ফুলগুলো বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-‘হেই প্রিটি ওমেন, দিস ইজ ফোর য়্যু! ওয়েলকাম টু আওয়ার, কুঞ্জকানন।’
আনন্দে আত্মহারা মাহদিয়া একটু চমকাল। আদুরে বাচ্চার হাত থেকে দু’হাতে ফুলের গুচ্ছটা নিজের হাতে নিয়ে নাক টেনে সুগন্ধিতে ভরপুর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। বলল,
-‘শুধু ফুল আর কিছু নেই?’
-‘আর কী লাগবে? দেয়ার মতো আর তো কিছু নেই আমার কাছে! কী দেই বলো তো?’
-‘যাহ্, সুপারম্যানকে দিয়ে এত্তবড়ো ভুল! মানা গেল না ভাই। একদমই মানা গেল না।’
-‘কী ভুল হলো সেটা তো বলো? না বললে বুঝব কী করে?’
হাত বাড়িয়ে মাহদিয়া তাকে কাছে ডেকে আনল। ফিসফিস করব বলল,
-‘বাড়িতে অতিথি আসলে মিষ্টি খাইয়ে আপ্যায়ন করাতে হয়। সুপারম্যান সেটা কী করে ভুলে গেল?’
শিহাব মাথা চুলকাল। মুচকি হেসে বলল,
-‘তুমি তো স্পেশাল, তাই স্পেশাল মানুষকে আমি কমন ওয়ে’তে ওয়েলকাম করি না। একটু স্পেশালভাবেই করি।’
-‘তাই? তোমার স্পেশাল ওয়ে’টা কী রকম, একটু দ্যাখাও।’
-‘একটু অপেক্ষা কোরো, আসছি।’
ঝটপট পা ফেলে রান্নাঘরে ছুটে গেল শিহাব। ফ্রিজ খুলে কয়েক ধরনের দই-মিষ্টি দেখেও সেসবে হাত লাগাল না। মাহদিয়াকে জ্বালানোর জন্য এবং আজকের মুহূর্তটাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই দই-মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন বাদ দিয়ে সে নিজের ইচ্ছেমতো একটা ঝামেলাযুক্ত কাজ করতে বসল। ওদিকে মাহদিয়া অধৈর্য্য হয়ে ডাক দিল,
-‘ছোটোন, কোথায় পালিয়েছ? ‘স্পেশাল ওয়ে’ আনতে গিয়ে হাওয়া হয়ে গেলে দ্যাখছি।’
শিহাব রান্নাঘর থেকে গলা ফাটিয়ে বলল,
-‘হাওয়া হইনি দিয়াপি। একটু অপেক্ষা করতে বলেছি তো তোমায়। এত অধৈর্য্য কেন তুমি?’
কী কাণ্ড! সে নিজে অকাজ করছে। সময় নষ্ট করছে। আবার অন্যকে অধৈর্য্য বলে কথাও শোনাচ্ছে। মাহদিয়া হাত উলটে শাদাবকে বলল,
-‘যাও না, গিয়ে দ্যাখো, কী করছে! এতক্ষণ লাগে?’
শাদাব নিজের অপারগতা দেখিয়ে, আলসেমি ভঙ্গিতে হাত-পা গুটিয়ে সোফায় বসে বলল,
-‘স্যরি। তোমাদের মধ্যে আমি প্রবেশ করছি না। বরং অপেক্ষা করি, ওর স্পেশাল ওয়ে’টা কী, সেটা দ্যাখার জন্য।’
সায়রা করীম ও ইভানা ঘরে আসার পর সবগুলো ব্যাগপত্র গেস্টরুমে শিফট করে, রুম সাজাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল ইভানা। সায়রা করীম নিজেও ক্লান্তি দূর করতে ওদের পাশে বসলেন। পানি পান করলেন। ঠিক তখনই একগ্লাস সবুজ পানি নিয়ে সবার সামনে উপস্থিত হলো শিহাব। হাসিমাখা মুখে গ্লাসটা বাড়িয়ে দিল মাহদিয়ার দিকে। বলল,
-‘স্পেশাল মানুষের জন্য, স্পেশাল জুস। খেয়ে দ্যাখো তো, কেমন মিষ্টি!’
শিহাবের কথা শোনেই গ্লাসের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখল মাহদিয়া। রংচং দেখে বুঝতে পারল না, এটা ঠিক কীসের পানি। এটা যে জুসই, তা নিশ্চিত করতে একটা চামচ দিয়ে নেড়েচেড়ে গুটে দিল শিহাব। নিজ হাতে মাহদিয়ার ঠোঁটের সামনে গ্লাস ধরে রেখে বলল,
-‘নাও, খেয়ে দ্যাখো। আমি এরচেয়েও আরও মিষ্টি জুস বানাতে পারি। এক গ্লাস খেয়ে যদি তৃপ্তি পাও, আরও এক গ্লাস দিব। পাক্কা প্রমিস…।’
মাহদিয়া এবার সন্দিহান চোখে তাকাল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিহাবের ঠেলাঠেলিতে গ্লাস থেকে অল্প জুস তার মুখে ঢুকে গেল। তাতেই পেটের ভেতরের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসার জোগাড় হলো মাহদিয়ার। হড়বড়িয়ে সবটুকু জুস বাইরে ছেড়ে দিল। শিহাবকে সামনে পেয়ে তার চুলগুলো টেনে ধরে বলল,
-‘অসভ্য, এটা মিষ্টি! কী জঘন্য স্বাদ এটার। কী মিশিয়েছ এতে?’
টেনেহিঁচড়ে নিজের চুল থেকে মাহদিয়ার হাত ছাড়িয়ে নিল শিহাব। বলল,
-‘জঘন্য হবে কেন? মিষ্টি কি খুব বেশি হয়ে গেল? আরেক গ্লাস আনি?’
-‘একদম না। এমন জঘন্য স্বাদের জুস খাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।’
-‘বারে, বললেই হলো? স্পেশাল মানুষ তুমি। তোমাকে স্পেশাল জুস না খাওয়ালে চলে? দাঁড়াও, আরেক গ্লাস নিয়ে আসি। তুমি এটা শেষ করে ফেলো তাড়াতাড়ি।’
শিহাব উঠে যেতে চাইলেই মাহদিয়া তাকে ধরেবেঁধে আটকাল। সে বুঝে গিয়েছে, জুসটা কীসের ছিল! জোরপূর্বক তাকে পাশে বসিয়ে বলল,
-‘ভুল করেও না ছোটোন। তুমি আমাকে মিষ্টি জুসের বদলে তিতা জুস খাইয়েছ। তোমার বউকেও আমি এইভাবেই বরণ করব দ্যাখো।’
-‘এ্যাহ্! আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বুঝি দ্যাখব?’
-‘না না। শুধু দ্যাখবে না। ওই একই গ্লাসের জুস তুমিও খাবে।’
-‘মোটেও না। আমি ওমন তিতা জুস নিজেও খাব না, কাউকে খাওয়াবও না।’
-‘কেন? কেন খাওয়াবে না? আমাকে যদি খাওয়াতে পারো, তাকেও খাওয়াবে। নিজের বেলা ছাড় দিবে কেন শুনি?’
-‘তুমি হচ্ছ ঘরের প্রাণ। আমাদের ‘কুঞ্জকানন’-এর সবচেয়ে স্পেশাল মানুষ। তাই তোমার জন্য স্পেশাল স্বাদের এই মিষ্টি মিষ্টি করলার জুস।’
-‘করলার জুস আবার মিষ্টি হয়, ফাজিল। আমার মুখের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছ। তোমাকেই গেলাব এখন।’
মাহদিয়া গ্লাস হাতে নিতে গেলেই, ‘ইন্না-লিল্লাহ্’ পড়ে মুহূর্তেই ড্রয়িংরুম ক্রস করল শিহাব। পিছনে শোনা গেল এক মিষ্টি গলার আওয়াজে দুষ্টু কিছু কথাবার্তা। সে দূর থেকেই ভেংচি কাটল। মাহদিয়া চোখ পাকিয়ে রাগী মেজাজে বলল,
-‘পালিয়ে আর যাবে কই? আবার তো আসবেই। যখন আসবে, তখনই মিষ্টি মিষ্টি করলার জুস খাওয়াব। কী অবস্থা করেছে আমার মুখের। দূর, জিহ্বার সব স্বাদ নষ্ট করে দিল এই ছেলে।’
শিহাব দূরে গেলেও কথাগুলো শুনল। সে-ও পালটা তীর ছুঁড়ে বলল,
-‘আমার ঠ্যাকা পড়েছে আর তোমার সামনে যেতে।’
-‘না এসে কোথায় যাবে শুনি? রুম ছেড়ে তো বের হবেই একবার! খেতে আসবে না? তখন ধরব। এক গ্লাস তিতা করলার জুস ঠেসেঠুসে খাওয়াব।’
-‘আমার কড়ে আঙুলও ছুঁতে পারবে না তুমি।’
মাহদিয়া মোটেও দমে যাওয়ার পাত্রী নয়। সে শিহাবকে খানিকটা জ্বালাতে-রাগাতে বলল,
-‘তাই না? খুব কনফিডেন্ট! আসো একবার সামনে। তোমার মাথার চুলগুলো আর রাখব না। একেবারে টাক বানিয়ে দেব। বউও খুঁজে পাবে না। বিয়েও হবে না। সারাজীবন আইবুড়ো থাকবে।’
-‘থাকি, তাতে তোমার কী! তুমি কেন আমার বিয়ে না হওয়ার দুঃখে হা-হুতাশ করবে?’
-‘দশটা না, পাঁচটা না, তুমি আমার একটা মাত্র দেবর। তোমার বউ খুঁজে আনার দায়িত্ব তো আমার কাঁধেই পড়বে। বউ যদি খোঁজ নিয়ে দ্যাখে বরের মাথার সব চুল পড়ে গিয়ে টাক গঁজিয়েছে, তখন তো সবাই তোমাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করবে। ওসব কি আমার ভালো লাগবে, বোলো? এজন্যই তো আগে থেকে তোমাকে সাবধান করতে গিয়ে আমার হা-হুতাশ বেড়ে যাচ্ছে।’
বাক্যটা শেষ করেই উপর্যুপরি হাসিতে বেসামাল অবস্থা হলো মাহদিয়ার। শিহাব দূর থেকেই ক্ষ্যাপাটে দৃষ্টিতে মাহদিয়াকে দেখছে, আবার রাগে ফোঁসফোঁস করছে। মাহদিয়া হাসি থামাতেই পারছে না। শিহাবের এই রাগী, গম্ভীর চেহারা দেখে তার এত বেশি হাসি পাচ্ছে, সে একাধারে খিলখিল স্বর তুলে হাসছে তো হাসছেই। এত হাসছে, এত প্রাণোচ্ছল দেখাচ্ছে তাকে, যেন কতদিন পর মেঘলা আকাশে রোদ এসে হাতছানি দিল হঠাৎ করে। শিহাবের রাগ তখনও পড়ল না। দূর থেকেই বলল,
-‘খোঁচাচ্ছ না? আমিও দ্যাখব। দিন আমারও আসবে।’
-‘টাকমাথা আইবুড়ো মানুষ আবার কী খেল দ্যাখাবে?’
বিরক্ত হয়ে শিহাব চলেই গেল। মাহদিয়া হাসি থামাল না। শিহাবের হেরে যাওয়া পানসে মুখ দেখে তার হাসি আরও দ্বিগুণ হয়ে গেল। শিহাবকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
-‘হেই ছোটোন, তুমি কি রেগে গেলে? অতিরিক্ত রাগ হেরে যাওয়ার লক্ষ্মণ কিন্তু।’
শিহাব সাড়া দিল না। মাহদিয়ারও হাসি থামল না। অনেকদিন পর তাকে এইভাবে হাসতে দেখে নির্ভার মন নিয়ে সেই হাসিতেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল শাদাব। সাতদিন! সাতটে দিন মেয়েটা হাসেনি। একবারের জন্যও না। আর আজ। প্রাণখুলে হাসছে। এত স্নিগ্ধ, নির্মল, ঝরঝরে হাসি দেখে এতদিনের জমানো সব দুঃশ্চিন্তা দূর হতে লাগল তার। মাহদিয়াকে এখানে নিয়ে আসা ভুল হয়নি। শিহাব যতক্ষণ তার সামনে থাকবে, মেয়েটা এইভাবেই হাসবে। একটুখানি হাসি-ই তাকে মানসিক ট্রমা থেকে অনেকখানি স্বস্তি দিবে। শান্তি দিবে। কিছুক্ষণ সেই হাসিতে আকণ্ঠ ডুবে থাকল শাদাব। মাহদিয়া তাকাল। চোখে চোখ পড়ল। দীর্ঘক্ষণ, দীর্ঘমুহূর্ত এইভাবেই চোখে চোখে তাকিয়ে শব্দহীন ভালোবাসার অতলে তলিয়ে গেল দু’জনেই। একটা সময় দৃষ্টির গভীরতা বাড়িয়ে মায়ের অগোচরে শাদাব তার কানের পাশটায় ঠোঁট নামিয়ে কণ্ঠে হাজারও মাদকতা, মুগ্ধতা জড়িয়ে ফিসফিস আওয়াজ তুলে বলল,
-‘যখন তোমাকে কাঁদতে দ্যাখি, কষ্ট পেতে দ্যাখি, আমার দুনিয়াটা থমকে যায় ভ্রমর। নিঃশ্বাসটাও ভারী হয়ে যায়। অদৃশ্য এক যন্ত্রণা ঘিরে ধরে আমাকে। হৃৎস্পন্দন তার গতি থামিয়ে দেয়। অথচ তুমি হাসলে ঠিক তার বিপরীত হয়। অদ্ভুত সুখ অনুভব হয়। মনে হয়, এই দেহে প্রাণ আছে। তুমি নিশ্চিত থাকো, আমি যতদিন বাঁচব একফোঁটা কষ্টও তোমায় স্পর্শ করতে পারবে না। আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা আর ভালোবাসা দিয়ে তোমার দুঃখেভরা আঁচল সুখে ভরিয়ে তুলব, ইন-শা-আল্লাহ্!’
***
খাবার টেবিলে শিহাবকে আজ আর দেখা গেল না। কোন ফাঁকে যে সবার আগে সে পেটে খাবার ঢুকিয়েছে, সেটা কেউ দেখেনি। তবে ইভানা দেখেছিল। সবাই বসার আগেই সে উরাধুরা, তালে-বেতালে খাচ্ছিল আর পানি গিলছিল। এত তাড়াহুড়ো করে কখনও শিহাবকে খেতে দেখেনি সে। তাই খানিকটা অবাকই হয়েছিল। বলেছিল,
-‘আরেহ্, এইভাবে তাড়াহুড়ো করছ কেন? ধীরেসুস্থে খাও। মাছের কাঁটা গলায় আটকে যাবে তো।’
ভাতের নলা গিলতে গিলতে কোনোমতে জবাব দিয়েছিল,
-‘কাঁটা আটকাবে না ভাবী। একটু দেরী হলে আমি-ই আটকে যাব। তখন আর মাছের কাঁটা না, তিতা করলার জুস খেতে হবে।’
-‘কেন?’
তখনকার ঘটনা, তার লজ্জা, হেরে যাওয়া ও দৌড় দিয়ে পালিয়ে যাওয়া সবটাই ফিসফিসিয়ে বলে গেল শিহাব। এরপর খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে দৌড়ে চলে গেল রুমে। বলে গেল,
-‘আমি ঘুমালাম। সকালে কথা হবে। শুভরাত্রি।’
শিহাবের এই কাণ্ডকারখানা মনে হতেই একা একা হাসল ইভানা। খাবার সাজিয়ে সবাইকে ডাক দিল। মাহদিয়া একা আসতে পারবে না দেখে, নিজেই এগিয়ে গেল, তাকে আনতে। শাদাব হসপিটালে। কয়েকদিন না থাকায়, ফিরতেই বেশ কয়েকটা জরুরী কল এসেছে, এরপর আর দেরী করেনি। সন্ধ্যা হতেই সেদিকে ছুট দিয়েছে সে। বলেছে, একটু তাড়াতাড়ি ফিরবে। বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে আবারও দাঁড়িয়ে পড়ল ইভানা। ডানহাতে কপাল টিপল। মাথা চেপে ধরল। দূর থেকেই ডাকল,
-‘দিয়া, খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। খেতে এসো।’
পরক্ষণেই মনে হলো, মেয়েটা একা আসতে পারবে না। নিজের দুরাবস্থার কথা ভুলে গিয়ে ধীরপায়েই রুম অবধি গিয়ে দেখল, মাহদিয়া চোখ বন্ধ রেখে আধশোয়া হয়ে আছে। অসুস্থ মেয়েটা একা থাকবে দেখে, আগামীর কয়েকটা দিন সে-ও এখানেই থাকবে। নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বিয়ে হয়ে গেলে তারপরই তাকে শাদাবের রুমের দখলদারি দেয়া হবে। ইভানার থাকার কথা শোনে, নাবহান প্রথমে একটু গাইগুই করেছিল, পরবর্তীতে শাদাবের অনুরোধ ও মাহদিয়ার সুস্থতা-অসুস্থতার কথা ভেবে রাজি হয়েছে।
ইভানা কাছে গিয়ে হাতের ওপর হাত রাখতেই চোখ মেলে তাকাল মাহদিয়া। হাসিমুখে জানতে চাইল,
-‘শাদাব ফিরেছে?’
-‘কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবে। তুমি এসো। খাওয়া শেষ করে, ঔষধ খেতে হবে। তোমার পর্যাপ্ত ঘুমও দরকার।’
দ্বিরুক্তি করার সাহস পেল না মাহদিয়া। ধীরস্থিরভাবেই উঠে দাঁড়াল। খাওয়ার আগের ঔষধগুলো খেয়ে, ইভানার হাত ধরেই গুটিকয়েক পা ফেলে ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে দেখল, সায়রা করীম বসে বসে অপেক্ষা করছেন। সে এগোতেই বললেন,
-‘বোসো এখানে।’
মাহদিয়া হেসে বলল,
-‘হাতটা ধুয়ে আসি?’
-‘লাগবে না। তুমি বোসো। আমি খাইয়ে দেই। ইভা, তুমিও বোসো মা।’
দ্বিতীয়বার টু’শব্দ করার আগেই তাকে ধরেবেঁধে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিলেন সায়রা করীম। ইভানাও একটা ফাঁকা চেয়ারে বসল। পরিচ্ছন্ন হাতে প্লেটে খাবার তুলে যত্ন ও ভালোবাসার সাথে এক-এক করে দু’জনের মুখেই খাবার তুলে দিলেন তিনি। আবেগে আপ্লূত মাহদিয়া এমন অনাকাঙ্ক্ষিত সুখে কেঁদেই ফেলল। খাবার খাওয়ার মাঝেই কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেল তার। সায়রা করীম চোখ রাঙিয়ে শাসনের স্বরে বললেন,
-‘আজব! মা খাইয়ে দিলে চুপচাপ খেতে হয়। এইভাবে গাল ভাসিয়ে কাঁদতে হয় না-কি? ইভাকে দ্যাখো, কেমন বাধ্য মেয়ের মতো খাচ্ছে। ও কী কাঁদছে?’
হাত উলটে কান্না মুছে ফেলল মাহদিয়া। মা’কে বড্ড বেশি মনে পড়ছে তার। কী করবে? কাঁদবে না? জন্মদাত্রী মায়ের আদর-ভালোবাসা ভুলবে কী করে? জীবন একটাই। ওই একটাই জীবনে মা তো একজনই। মায়ের কি তাকে মনে পড়ে না? সে একাই কি মায়ের জন্য কাঁদছে? ভেতরটা ভেঙে চুরচুর হয়ে যাচ্ছে তার। গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইছে না। তবুও জোরপূর্বক মুখে হাসি ধরে রেখে খাবার খেল। একদম বাধ্য মেয়ে হয়ে! নয়তো শাদাব এসে যদি শোনে, খেতে গিয়ে কেঁদে গাল ভাসিয়েছে, ছেলেটা দুঃখ পাবে। তার এত ধৈর্য্য, এত চেষ্টাকে বিফলে দিয়ে দেব? এতটাও পাষাণ হতে পারল না মাহদিয়া। মনকে মানিয়ে নিল এইভেবে যে, জীবন থেকে এক মা হারিয়ে গেলেও আরেক মায়ের সান্নিধ্য সে পেয়েছে। এই মায়ের মায়া-মমতায় বেঁচে থাকলেই ছোট্ট এই জীবনের না পাওয়া বেদনাগুলো মুছে যাবে। কান্না থামিয়ে বলল,
-‘তুমি এত আদর করে খাইয়ে দিচ্ছ, না চাইলেও যে কেউ গাল ভাসিয়ে কাঁদবে।’
ইভানা তার কান্নামাখা মুখের কথা শোনে বলল,
-‘এখুনি এত কাঁদছ কেন? বিয়ের দিনের জন্য কিছু কান্না জমিয়ে রেখো।’
-‘ওইদিন আমি মোটেও কাঁদব না, দ্যাখো।’
-‘তাই বুঝি? দ্যাখব, সব কান্না কোথায় আটকে রাখো! ওই একটা দিনই মেয়েরা হাউমাউ করে কাঁদে।’
-‘হ্যাঁ, কেঁদে পুরো শহরকে জানিয়ে দিই, আমার বিয়ে হচ্ছে। ঢং। বলছি তো আমি কাঁদব না। আমি তোমার মতো ছিঁচকাদুনে নই।’
-‘ওরে আল্লাহ্! কী বলে? গাল ভাসিয়ে কেঁদেকেটে আমার দেবরটাকে দিশেহারা করে, এখন বলে সে না-কি ছিঁচুকাদুনে নয়। তুমি বললে আর আমি বিশ্বাস করে নিলাম! হ্যহ্…।’
মাহদিয়া গাল ফুলিয়ে চোখদুটো বড়ো বড়ো করে বলল,
-‘ভাবী, একদম পঁচাবে না। খুব খারাপ হবে, খুব।’
দু’জনার দুষ্টুমিষ্টি ঝগড়ার মাঝখানেই সায়রা করীম পূণরায় ভাত মেখে ইভানার মুখে তুলে দিতেই সে হাত দিয়ে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
-‘আর খাব না খালামনি। শরীর খারাপ লাগছে।’
সায়রা করীম ভয় পেয়ে গেলেন। বললেন,
-‘কেন? এত তাড়াতাড়ি পেট ভরে গেল? খুব বেশি খারাপ লাগছে? নাবহানকে আসতে বলব?’
-‘হ্যাঁ বোলো, তাড়াতাড়ি বোলো, এরপর এসে কাঁধে করে তুলে নিয়ে যাক। ও তো সুযোগ খুঁজছে। ধরেবেঁধে নিয়ে যেতে পারলেই ওর শান্তি।’
ইভানার বলার ধরণে হেসে ফেললেন সায়রা করীম। বললেন,
-‘খুব বেশি খারাপ লাগলে বোলো, মা। লুকিয়ে গেলে তোমারই ক্ষতি।’
-‘ওসব এত সিরিয়াস কিছু না। হুট করে লম্বা জার্নি করেছি, এইজন্যই গা ম্যাজম্যাজ করছে। একটু অশান্তিও লাগছে। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না। কোনো কাজে মন বসাতেও পারছি না।’
ইভানা উঠে গিয়ে রেহনুমার সাথে রান্নাঘরে কাজে হাত লাগাল। আবারও মনে হলো, সে খানিকটা টলছে। অথচ এরকম আগে কখনও হয়নি। হওয়ার কথা না। এভাবে হুটহাট শরীর খারাপ হয় না তার। মুড সুইংও হয় না। কিন্তু আজ, সবকিছু কেমন অন্যরকম। কোথাও শান্তি পাচ্ছে না। মনের অশান্তি দূর করতে, নাবহানের কণ্ঠস্বর শোনা জরুরী মনে হলো। হয়তো এই দূরত্বটাই তাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। কী অদ্ভুত এক টান! কী অদ্ভুত এক মায়া! পবিত্র সম্পর্কে এত কীসের টান? কোথা থেকে উড়ে আসে এসব? কে এনে দেয়?
***
চলবে…
#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — আটত্রিশ (২)
কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!
ঘুমোতে গিয়ে আজ আর ঘুম আসছে না মাহদিয়ার। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে একটু অসুবিধা হচ্ছে। বালিশে মাথা রেখে জোরজবরদস্তি করেও চোখে ঘুম টেনে আনা যাচ্ছে না। অথচ রোজ ঔষধ খাওয়ার পরপরই রাজ্যের আলসেমি ভর করে শরীরে। একটু উষ্ণতা পেলেই ঘুমের দেশে হারিয়ে যায়। এই ক’দিন হসপিটালে থাকলেও সাত রাতের ওই সময়টুকু শাদাবের বুকেই ঘুমিয়েছে সে। ছেলেটা নির্ঘুম রাত কাটিয়ে শুধু তাকে পাহারা দিয়েছে। মাঝরাতে ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়েছে। পর্যাপ্ত যত্ন নিয়েছে। সকাল হলে আবার রুটিনমাফিক খাওয়া-দাওয়ার দিকটাও কত যত্নশীলতার সাথে সামলে গিয়েছে। কোথাও, কোনোকিছুরই ফাঁক পড়তে দেয়নি। যখন যা প্রয়োজন হয়েছে, হাত বাড়ানোর আগেই পেয়ে গেছে। আজই একটু অনিয়ম হচ্ছে। এই সাতদিন বিশ্বস্ত জায়গা পেয়ে নির্ভয়ে ঘুমোতে পেরেছে। রাত হয়েছে অনেক, অথচ শাদাব এখনও ফিরেনি। এজন্য একটুবেশি-ই ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ইভানা ঘুমিয়েছে সবে। এতক্ষণ নাবহানের সাথে গুজুরগুজুর-ফুসুরফুসুর করে, কয়েক মিনিট হলো ফোন কানে লাগিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে বেচারী। মাহদিয়া তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। হাতের ফাঁক থেকে ফোন টেনে এনে, সেন্টার টেবিলের উপর রেখে দিল। প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য, মন ভালো হওয়ার একটা টনিক বোধহয়। নয়তো আধঘণ্টা আগে যে মেয়ে মনে অশান্তি বলে অস্থির হয়ে ঘরের এ-মাথা ও-মাথা পায়চারী করল, আধঘণ্টার মধ্যেই সেই মেয়ে এত গাঢ়ঘুমে হারিয়ে গেল!
তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখেই ধীরেধীরে রুমের বাইরে আসলো মাহদিয়া। সায়রা করীম টেলিভিশন দেখছেন। শিহাব হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছে। তার নড়চড় আর পাওয়া যাচ্ছে না। করলার জুস খাবে, সে-ই ভয়ে আর সামনেই আসেনি। সে গুটি গুটি পা ফেলে যখন সোফায় বসল, সায়রা করীম বললেন,
-‘ঘুম আসছে না?’
মুখখানি বাংলার পাঁচ বানিয়ে মাহদিয়া জবাব দিল,
-‘না। একেবারেই আসছে না। শুধু এপাশ-ওপাশ করছি।’
-‘ঘুমের ঔষধ খেয়েছ। কিছুক্ষণ পর চোখে অন্ধকার দ্যাখবে। না ঘুমোলে তোমারই শরীর দুর্বল হবে।’
-‘কিন্তু ঘুম আসছে না তো, আন্টি।’
সায়রা করীম কোলের কাছে নরম একটা কোশন নিলেন। মাহদিয়াকে সেখানে মাথা রাখতে ইশারা করলেন। আশকারা পেয়ে সে-ও নরম কোশনে মাথা রেখে কোলের কাছে পা লম্বা করে শুয়ে পড়ল। তিনি তার কপালে হাত ছোঁয়ালেন। ধীরস্থিরভাবে হাত বুলিয়ে বললেন,
-‘আর আন্টি ডেকো না। বাকিজীবন যেহেতু মা-ই ডাকবে, আগে থেকে অভ্যাস করে নাও।’
মাহদিয়া খানিকটা নড়েচড়ে দু’হাতে সায়রা করীমের কোমর পেঁচিয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল। মায়ের স্নেহ-মমতার পরশে কখন যে তার চোখে ঘুম এলো, টেরই পেল না সে। তবে সায়রা করীম আর উঠতে পারলেন না। ওভাবেই বসে রইলেন। একাধারে কপালে, হাতে, পিঠে, মায়া-মমতার স্পর্শ দিয়ে গেলেন। মায়েদের কাছে সোনার কাঠি, রূপোর কাঠি নামক একটা অদৃশ্য ম্যাজিক থাকে। ছোঁয়া মাত্রই সব অশান্তি দূর হয়ে যায়। ঘুম না আসা চোখেও ঘুম চলে আসে।
কলিংবেল বাজতেই রেহনুমা দরজা খুলে দিল। শাদাব এসে এই দৃশ্য দেখে চমকে গেলেও তার মায়ের ঠোঁট উলটানো দেখে হেসে ফেলল। সামনে এগিয়ে বলল,
-‘আজ তোমাকে বালিশ বানিয়েছে?’
-‘হ্যাঁ! কী আর করা! ঘুমোতে পারছেই না। অথচ আমার কাছে এসে কয়েক মিনিটেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তুই ও’কে একটু বিছানায় শুইয়ে দে বাপ। কোমর ধরে গেছে আমার। কতক্ষণ ধরে এক জায়গায় বসে আছি।’
মাহদিয়ার মনোঃকষ্ট ও ঘুম না হওয়ার কারণ বুঝতে পারল শাদাব। হাতের অ্যাপ্রোন-ব্যাগ রেখে, দু’হাতের সাহায্যে মাহদিয়াকে কোলে তুলে নিল। মনে মনে হাসলও। জেগে থাকলে কোলে উঠতে চাইত না বোধহয়। হয়তো বলত, ‘তুমি হাত ধরো। আমি হেঁটে হেঁটে রুমে গিয়ে ঘুমাব।’ ঘুমিয়ে আছে বলেই কিচ্ছু টের পাচ্ছে না। এই ঘুম আর সকালের আগে ভাঙবেও না। সে রুমের দিকে এগোনোর মাঝেই সায়রা করীম বললেন,
-‘ঝটপট ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি খাবার সাজাই।’
খুব সাবধানে ঘুমন্ত মাহদিয়াকে বিছানায় রাখল শাদাব। কোনোপ্রকার শব্দও করল না। ঘুম যেন না ভাঙে, সেভাবেই সাবধানতা অবলম্বন করে শরীরের ওপর একটা নকশিকাঁথা টেনে দিল। গায়ের ওপর কাঁথার উপস্থিতি পেয়ে হাত দিয়ে সেটা নিজের সাথে পুরোটাই পেঁচিয়ে নিল মাহদিয়া। গুটিসুটি মেরে পড়ে রইল। কয়েক মিনিট পাশে বসে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিল শাদাব। একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে উল্টোপিঠে অধর ছুঁইয়ে মনে মনে বলল,
-‘আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। তারপরই সব অপেক্ষার অবসান ঘটবে ভ্রমর। নির্ভয়ে ঘুমানোর জন্য শুধু আমার বুকটাই পাবে তা নয়, আমার গোটা অস্তিত্বকে সারাজীবনের জন্য তোমার কাছে গচ্ছিত রেখে দেব আমি। তখন যেভাবে খুশি, যেমন খুশি, থেকো। শুধু নিজেকে সুস্থ রেখো, হাসিখুশি রেখো।’
দু’জনকে গভীরঘুমে রেখে শিহাবের রুমে একটা চক্কর দিল শাদাব। সে-ও ওই দু’জনের মতোই ঘুমে বিভোর। ছোট্ট করে ভাইয়ের কপালে একটা চুমু খেল। রুম চেক করে, বাতি নিভিয়ে দরজা সামান্য আটকে দিল। তার জীবনের সুন্দরতম দিন ছিল আজ। সুন্দরতম রাতও আজ। আপনজন সবাই কাছে। চোখের সামনে। বাকিটা জীবন যদি এভাবেই নির্ঝঞ্ঝাটভাবে কেটে যায়, তবে সুখ জীবনে ধরা দিতে বাধ্য। আপন মানুষজন কাছে থাকা মানেই, সুখ। ওই মানুষগুলোর মুখের হাসি ও সুস্থতা মানেই, সুখ। এই সুখটা সারাজীবন তাকে ছুঁয়ে থাকুক, মনে মনে এমন এক স্বচ্ছ প্রার্থনা করল শাদাব।
***
খাবার টেবিলে শাদাবকে অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকতে দেখে খানিকটা বিচলিত হয়ে পড়লেন সায়রা করীম। সে রেগে আছে না-কি কোনোকিছু নিয়ে চিন্তিত, তা ঠিকঠাক বুঝা না গেলেও ভেতরে ভেতরে কিছু একটা দ্বন্দের সম্মুখীন হয়েছে, এটা স্পষ্ট। এতদিন ধরে ছেলেকে দেখছেন, চিনছেন, বুঝছেন। তার ভেতরে কখন কী চলে, একমাত্র তিনি-ই ভালো বুঝতে পারেন। প্লেটে ভাত-তরকারি তুলে দিয়ে নিজেও পাশের চেয়ারটায় বসলেন। বললেন,
-‘কোনোকিছু নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ভুগছিস, টোটোন?’
অস্ফুটস্বরে ‘হ্যাঁ’ উচ্চারণ করল শাদাব। দিনের ঘটনাটাই থাকে বার বার বেখেয়ালি করে দিচ্ছে। কায়ছার সাহেবের আরচণ ঠিক কীরূপ প্রভাব ফেলছে শিহাবের ওপর, এটা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। কয়েক ঘণ্টা ধরে শিহাব তার দিয়াপির মাঝেই মজে আছে। তাই হয়তো কায়ছার সাহেবের কথাবার্তা ও তাঁকে ‘বাবা’ ডাকার অনুরোধ করা, ‘সুখনীড়’-এ ফিরে যাওয়ার আবদার শোনানো, এসব ভাবনাকে সে মনে ঠাঁই দিচ্ছে না। কিন্তু শাদাব সহজেই এগুলো মন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না। একটা মানুষ সত্যিই কি অনুতপ্ত? তাকে কি ক্ষমা করা উচিত? শত হলেও জন্মদাতা যে! ক্ষমা হয়তো করতে পারবে না, কিন্তু অস্বীকারও তো করতে পারছে না। কী করা উচিত তার? সামান্য আওয়াজ করেও আবারও চুপ হয়ে গেল শাদাব। খাবারে মনোযোগ দিল। সায়রা করীম ছেলেকে গভীরদৃষ্টিতে পরখ করে বললেন,
-‘কী হয়েছে? দিয়াকে নিয়ে ভাবছিস?’
-‘না মা। ছোটোনকে নিয়ে।’
খাবার চিবোতে চিবোতে জবাব দিল শাদাব। সায়রা করীম প্রচণ্ড অবাক হয়ে বললেন,
-‘ও’কে নিয়ে আবার কী দুঃশ্চিন্তা? ও তো ভালো আছে, সুস্থ আছে।’
নিজেকে শান্ত রেখে ঠাণ্ডা মাথায় বলল,
-‘তখন ওই ভদ্রলোক শপিংমলের সামনে ছোটোনকে আটকেছিলেন।’
মুখে হাত চেপে ধরলেন সায়রা করীম। তার আদরের বাচ্চা। খারাপ কিছু করেননি তো? ভয় দানা বাঁধল মনে। ভীতিগ্রস্ত মন নিয়েই বললেন,
-‘কেন?’
-‘ক্ষমা চাওয়ার জন্য আর ও’কে ‘সুখনীড়’-এ ফিরিয়ে নেয়ার জন্য।’
সায়রা করীম দীর্ঘশ্বাসের সাথে বললেন,
-‘এতদিন পর পিতৃত্বে টান পড়েছে! এই টান সেদিন কোথায় ছিল! ছোটোন তাঁকে ভয় পায়নি তো?’
-‘একদমই পায়নি। উলটে মানিয়ে নিয়ে শক্ত একটা জবাবও দিয়ে এসেছে।’
শিহাবের সমস্ত কথা মায়ের সামনে তুলে ধরল শাদাব। সায়রা করীম নিশ্চিন্ত হলেন। হেসে বললেন,
-‘তাহলে এত দুঃশ্চিন্তা করছিস কেন তুই?’
-‘তোমার কী মনে হয় মা, ওই মানুষটাকে ক্ষমা করে দেয়া উচিত?’
এত বছরের দুঃখকে বুকে পুষে রেখে দিন কাটিয়ে আজ যদি ক্ষমা করে দিতেই হয়, তবে এতদিনের যন্ত্রণাদায়ক মুহূর্ত ও কষ্টের দাম রইল কোথায়! তিনি অনুতপ্ত বলেই কি তাঁকে ক্ষমা করে দিতে হবে? এতে কি আগের দিনগুলো ফেরত আসবে? সমস্ত গায়ে যত লাঞ্চনা, ধিক্কার, চড়-লাতি আর অবিশ্বাসের থাপ্পড় পড়েছে, সেসব মুছে ফেলা যাবে? বুকের ভেতর আস্তো একটা মন, যা ক্ষতবিক্ষত হয়ে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে, সেই মনটাকে কি আর ফেরত পাবেন? ভাঙা মন কি কভু জোড়া লাগবে? বাবা-মায়ের কাছ থেকে যতসব নিন্দেমন্দ ও খোঁচা শোনে দিন অতিবাহিত হয়েছে, সেসব কি মুছে ফেলতে পারবেন? সম্ভব না। কোনোদিনও সম্ভব না। সন্তানেরা তাঁকে ক্ষমা করে দিলেও, তিনি কোনোদিন ক্ষমা করবেন না। কখনও ওই জালিমের কাছে নিজের আত্মসম্মানকে ছোটো হতে দিবেন না। নিজের ভেতরের সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণাকে মনের এক কোণায় পুষে রেখে বললেন,
-‘ক্ষমা হয়তো মহৎ গুণ হতে পারে! ক্ষমা একটা সম্পর্কের মধ্যে থাকা সমস্ত দ্বন্দ ও দূরত্বকে দূর করে দিতে পারে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাউকে কোনোদিন ক্ষমা করতে নেই। হ্যাঁ, ব্যক্তি অনুতপ্ত হলে ক্ষমা করাই যায়। কিন্তু ওই ব্যক্তিকে ক্ষমা করা উচিত না, যে সম্পর্কের মূল্য দিতে জানে না। যে স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের আসল সংজ্ঞা জানে না, বুঝে না, তাদের মূল্যায়ন করে না, তাঁকে ক্ষমা করে আমি আমার বিবেককে অপরাধী করতে পারব না টোটোন।’
মায়ের কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে, এটা ফেলে দেয়ার মতো দুঃসাহস শাদাবের নেই। সে শিহাবকে নিয়েই চিন্তিত। তাই বলল,
-‘ধরো, একটা সময় যদি ছোটোন ওনার কাছে ফিরে যেতে চায়, রক্তের টানে, আদরের লোভে। তখন কী করবে মা? ওর অবুঝ মনেও তো এখন বাবার আদর-ভালোবাসা পাওয়ার লোভ জন্মাতে পারে।’
এটা নিয়ে সায়রা করীম নিজেও অনেক ভেবেছেন। কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পাননি। শুধু ভেবে গেছেন, যে সন্তানের জন্য তিনি সর্বস্ব ত্যাগ করে দীর্ঘবছরের একাকীত্বকে লালন করে দিন অতিবাহিত করলেন, সেই সন্তান তাকে যদি কোনোদিন ত্যাগ করে, তখন কী করবেন! এই ভয়ে তিনি কখনও চাননি, ওই অবিশ্বাসের শহরে আর ফিরে যেতে। কিন্তু মাহদিয়ার ফিরে আসাতেই সব এলোমেলো হয়ে গেল। লুকোনোর কিংবা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় আর রইল না। সবকিছু জেনেও গেল শিহাব। শাদাবের চিন্তাভাবনা ভুল নয়, ফেলে দেয়ার মতোও নয়, আবার ক্ষমা করে ফিরে যাবেন, এতটাও নিচু মানসিকতার নোন তিনি। কিন্তু শিহাব! তাকে কীভাবে সামলাবেন? বাচ্চাটা এই সত্যি জেনে-বুঝে কতদিন আর চুপ থাকবে! ভয়ে শরীর বেয়ে শীতল বাতাস বয়ে গেল তাঁর। সমস্ত লোপকূপ দাঁড়িয়ে গেল। তিনি ভারাক্রান্ত মনে জবাব দিলেন,
-‘গেলে যাবে। কী আর করব! ধরেবেঁধে আটকে রেখে ‘মেন্টালি টর্চার’ করতে পারব না।’
কতটা কষ্ট দমিয়ে রেখে এই কথাটা সায়রা করীম উচ্চারণ করলেন, সেটা বুঝতে পেরেই চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে শ্বাস টানল শাদাব। একহাতে মা’কে জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘ওর মনে কী চলছে আমি জানি না মা! মানিয়ে নিতে পারলে তো ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু যদি কোনোদিন ওই মানুষটাকে ‘বাবা’ ডেকে ফিরে যেতে চায়, সেটা কীভাবেই-বা মেনে নিব! কীভাবে আটকাব?’
-‘কতকিছুই তো মেনে নিতে হয়। মানিয়ে নিতে হয়। তাইবলে কি জীবনটাকে থামিয়ে রাখা যায়? জোর করে আটকানোর কোনো দরকার নেই। রক্তে টান পড়লে যদি কোনোদিন চলে যেতে চায়, যাবে।’
***
এক কাপ কফি হাতে নিয়ে নিজের রুমের জানালার পাশে দাঁড়াল শাদাব। আজ তার সুখ ও শান্তির দিন হলেও, কিছু কারণে মন সুখকর মুহূর্তটাকে ঠিকঠাকমতো উপভোগ করতে পারছে না। বার বার হায়দার সাহেব ও নূরুন্ নাহারের কথা কানে বাজছে। বিকেল থেকে এ পর্যন্ত অনেকবারই দু’জনে কল করেছেন। কায়ছার সাহেব মরিয়া হয়ে উঠেছেন, একবার শিহাবের সাথে কথা বলার জন্য। অথচ শাদাব চাইছে না, এরকমটা হোক। সায়রা করীমের মনোভাবেও নিশ্চিত, তিনি চান না আদরের সন্তান কোল ত্যাগ করুক। যার জন্য এতকিছু সে-ই যদি মায়ের মন না বুঝে, ফিরে যাওয়ার বায়না ধরে, তখন নিজেকে কীভাবে মানাবেন তিনি? শাদাব নিজেই বা কী করে ওই দৃশ্য হজম করবে? মুখফুটে যদি বলে ক্ষমা করে দিয়েছে, তবে যে মিথ্যে বলা হবে। মন থেকে ক্ষমা না আসলে, মুখে হাজার বার বলেও ক্ষমা পরিপূর্ণ হয় না। সে তো মন থেকে ক্ষমা করতেই পারছে না। পারবেও না। যতবার ‘সুখনীড়’ ও কায়ছার সাহেবের কথা মনে হয়, ততবারই পুরনো দৃশ্যগুলো কাঁটা হয়ে বুকে বিঁধে। অসহ্যকর এক যন্ত্রণা দিয়ে তাকে পুরোটাই তছনছ করে দেয়। ভেঙে যাওয়া বিশ্বাস যেমন সহজে জোড়া লাগে না, ভেঙে যাওয়া নীড়ও তেমনই পূণরায় সাজানো যায় না। জোড়াতালি দিয়ে নীড় গড়ে তুললেও, ছোটোখাটো একটা বজ্রপাত সেই নীড়কে আবারও ভেঙে গুড়িয়ে দিতে সক্ষম। এজন্য শাদাব চায় না, একই আঘাতে বার বার তার মায়ের মন ক্ষত-বিক্ষত হোক।
মনের অশান্তি দূর করতেই মূলত অন্ধকার, মেঘেভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল শাদাব। ফাঁকে ফাঁকে কফিতেও চুমুক দিল। সে শান্তিতে থাকুক, এটা বোধহয় প্রকৃতিও চায় না। না নিজের সৌন্দর্য প্রকাশ করছে, আর না জ্যোৎস্নায় ভাসাচ্ছে। কেমন থমথমে একটা রূপ নিয়ে রাত্রিকে করে দিয়েছে আরও বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন। তবে এই অন্ধকারটাও ভালো লাগছে শাদাবের। দীর্ঘশ্বাসকে দূরে ঠেলে দেয়া যাচ্ছে। তার সমস্ত মন খারাপকে আরও বহুগুণ মন খারাপে পরিণত করতে, ধুমধাম শব্দে বেজে উঠল ফোন। স্ক্রিনে হায়দার সাহেবের নম্বর ভাসছে। রিসিভ করা মানেই কায়ছার সাহেবের পাগলামি শোনা। ভালো লাগে না এসব আর। একটু স্বস্তি ও শান্তির দরকার। অথচ সেই সুযোগ নেই। কল এড়িয়ে যাওয়ারও উপায় নেই। বাধ্য হয়েই রিসিভ করে বলল,
-‘আবার কী সমস্যা হলো?’
শাদাবের মন-মেজাজ যে ভালো নেই, সেটা হায়দার সাহেবও বুঝলেন। কিন্তু তিনি তো নিরুপায় হয়েই ফোন করেছেন। কত বুঝালেন, কত নীতিবাক্য শোনালেন, তা-ও কাজ হচ্ছে না। কায়ছার সাহেব অধৈর্য্য, উন্মাদ। শুধু একবার শিহাবকে ছোঁয়ার জন্য, তার মুখ থেকে ‘বাবা’ ডাক শোনার জন্য দিশেহারা। তাইতো সমস্ত ভুলচুক পিছনে ফেলেই ভাতিজার কাছে আবদার রাখতেই ফোন করলেন। শাদাবের এমন নিষ্প্রাণ গলার আওয়াজ শোনে ব্যথিত কণ্ঠে বললেন,
-‘আমি বুঝতে পারছি টোটোন, তোর মনে প্রেশার যাচ্ছে। আমার কী করণীয় বল তো? দিন থেকে একটা নাটক শুরু করেছে। এখনও চলছে। টেপ রেকর্ডারের মতো বাজছে তো বাজছেই। তার একটাই কথা, ‘শিহাবকে যেভাবে পারো এনে দাও কেউ। আমি একবার আমার ছেলেটার কাছে ক্ষমা চাইব। নয়তো মরেও শান্তি পাব না।’ এরপর আর কী বুঝানোর থাকে তুই বল?’
-‘চাচ্চু, পনেরো বছর! দিনরাত শুধু ওই মানুষটার জন্য ছটফট করেছি। প্রতিমুহূর্তে মনে হোতো, কেন সেসব ভুল হলো না। কোন সন্তান চায়, বাবা-মায়ের থেকে দূরে সরে থাকতে? তিনি নিজেই আমাদের এমন একটা পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করিয়েছেন, যেখান থেকে পিছনে ফেরার কোনো পথ খোলা নেই আর।’
-‘আমি সব জানি বাবা। বুঝি। কিন্তু ভাইজানকে বুঝাব কী করে? এত করে বোঝাচ্ছি, তা-ও মানাতে পারছি না। নাহারের সাথে তর্কাতর্কি করছেন। আমাকে তো রাখছেন-ই না। নিজেকেও কষ্ট দিচ্ছেন।’
-‘ওনাকে বোলো, ড্রামাটা যেন বন্ধ করেন। এসব আর নেয়া যাচ্ছে না।’
হায়দার সাহেব কিছুটা রয়েসয়ে বললেন,
-‘একবারের জন্য কি ছোটোনকে নিয়ে আসতে পারিস না?’
-‘চাচ্চু, কী বলছ তুমি? এত বছর পর পুরনো ক্ষতকে আবারও জাগিয়ে তুলব? মা সইতে পারবেন এসব? যে নিষ্পাপ প্রাণকে পৃথিবীর মুখ দ্যাখানোর জন্য, গায়ে অপমানের বোঝা নিয়ে দীর্ঘজীবনের সুখ-সাধনার বিনিময়ে পাওয়া ‘সুখনীড়’ তিনি ত্যাগ করে এসেছিলেন, সেখানে আবারও সেই ছোট্ট প্রাণকে পাঠাবেন, তা-ও ওই মানুষটারই বুকে! সম্ভব এটা? এমন অহেতুক আবদার তুমি আমাকে শোনাতে এসো না চাচ্চু। রাখতে পারব না তোমার কোনো কথা। প্লিজ…।’
-‘একবার ভেবে দ্যাখ্, টোটোন। জন্মদাতা যে! অস্বীকার করার উপায় আছে?’
-‘অস্বীকার করতে পারব না দ্যাখেই আজও বাবার জায়গায় ওনার নামটাই ব্যবহার করি। নাম ব্যবহার করা মানে এই না যে, ওনাকে আমরা ফিরে পেতে চাই। আমাদের জীবনে ওনার কোনো প্রয়োজন আর নেই। এটা ওনাকে বুঝতে হবে।’
-‘কিন্তু ভাইজান তো শেষ বয়সে তাই না? একবার যদি ছোটোনকে কাছে পান, হয়তো অপরাধবোধ থেকে কিছুটা মুক্তি পেতেন।’
-‘অপরাধের বোঝা বাড়াতে বাড়াতে এখন যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, তখন পিতৃত্বের দাবী নিয়ে সামনে আসতে চাইছেন! সন্তানকে সন্তান বলে আদর করে বুকে টেনে নিতে চাইছেন! অথচ ওই সন্তানকেই তিনি একদিন অস্বীকার করেছিলেন। মে//রে ফেলতে চেয়েছিলেন। তা-ও কি-না বাইরের একজন মানুষের কথায়!’
-‘মানুষ মাত্রই ভুল হয়, টোটোন। ভুলের জন্য মানুষ অনুতপ্ত হয়। ক্ষমাও চায়। ভাইজানের অবস্থাও সেরকম। একবার তো তোরা তাঁকে ক্ষমা করে দে।’
হায়দার সাহেবের এমনসব কথায় অবাকই হলো শাদাব। একেই বুঝি বলে রক্তের টান। আজ রক্ত কষ্ট পাচ্ছে দেখেই ভাইয়ের হয়ে ওকালতি করতে এসেছেন তিনি। তবে সে এসব কথায় গলে গেল না মোটেও। ত্যাড়াব্যাকা করে বলল,
-‘ক্ষমা! আচ্ছা। দিলাম ক্ষমা করে। এরপর কী? ‘সুখনীড়’-এ যেতে হবে? বাবা-মা, দুই-ভাই মিলে হাসিখুশির সাথে দিন কাটাব ওখানে? পুরনো সবকিছু ভুলে গিয়ে হৈ-হুল্লোড়ে মজে থাকব সারাদিন? বাবা-বাবা বলে ডেকে ওনাকে মাথায় তুলে রাখব? স্যরি চাচ্চু। তুমি ভুল জায়গায় আবদার পেশ করেছ। দুনিয়া যদি ভেসে যায় যাক, তবুও আমি আমার মা’কে দ্বিতীয়বার অপমানিত হতে দিব না। যেই স্থান তাঁকে লা//তি মে//রে তাড়িয়েছে, সেখানে তাঁকে আবারও পাঠিয়ে, মায়ের এতদিনের কষ্ট ও চোখের পানিকে মিথ্যে করে দিতে পারব না। সবকিছু ক্ষমা দিয়ে শেষ হয় না, চাচ্চু। হয় না। তুমি সামলাও তোমার ভাইকে। মানিয়ে নিতে বোলো। আমরাও মানিয়ে নিয়েছি। ভালো আছি। ভালো থাকবও। পনেরো বছর যখন বাবার ছায়া-ভালোবাসার প্রয়োজন পড়েনি, আগামীতেও পড়বে না। উনিও সন্তান ও ‘বাবা’ ডাক না শোনে দিন কাটিয়ে দিতে পারবেন। এটা কঠিন কিছু না। সিম্পল একটা ব্যাপার। বুঝাও তাঁকে।’
কথা শেষ করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করল শাদাব। কেন যেন কায়ছার সাহেবের এই নাটকটা তার হজম হচ্ছে না। এসব শুনলে সায়রা করীম মনে আঘাত পাবেন। ভাঙা সংসার জোড়া তো লাগবেই না, উল্টে শিহাবকে হারানোর যন্ত্রণায় আবারও তার মা’কে দিনরাত চোখের পানি ফেলতে হবে। জেনে-বুঝে কী করে এমন দিনকে জীবনে পূণরায় টেনে আনবে সে? কীভাবে পারবে, মা’কে কষ্ট দিতে? এই কঠিন সমস্যার যে কী সমাধান, ভেবে পেল না শাদাব। উপায়ন্তর না পেয়ে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বিড়বিড় করল,
-‘আর কত ধৈর্যের পরীক্ষা নিবে খোদা! আর কত সহ্য করতে হবে! নিয়তি কেন আমাদেরকেই বার বার কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখে ঠেলে দিচ্ছে? উনি আমাদের বাবা সেটা আমরা জানি, মানিও। কিন্তু গ্রহণ করার মতো সুযোগ যে আর নেই। এই কঠিন সময়টাকে ফেইস করার মতো পর্যাপ্ত ধৈর্য্যশক্তি আমাকে দাও করুণাময়। একটা সহজ-সুন্দর পথ অন্তত দ্যাখাও। আর যদি তা না মিলে, তবে সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও।’
***
চলবে।