#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — উনচল্লিশ (১)
কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!
এক সপ্তাহ হলো, ‘কুঞ্জকানন’-এ এসেছে মাহদিয়া। দুঃখ কী তা বুঝার মতো সময়-সুযোগ কিছুই তার হয়নি। যেভাবে বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ তাকে প্রতিক্ষণে, প্রতিমুহূর্তে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে, তাতে দুঃখ জীবনে আসা অকল্পনীয় ও সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা ব্যতীত কিছু নয়। সুখের এই সময়টাকে জীবনে পেয়ে খোদার দরবারে শুকরিয়া জানাতে দেরী করেনি সে। পরবর্তী জীবনের জন্য দু’হাত ভরে সুখ চাইতেও ভুলেনি। তার জীবনের বাকি দিনগুলো যেন এখানেই হেসেখেলে কেটে যায়, সেটাও তার প্রার্থনায় রেখেছে। সুখের এই দিনের সবচেয়ে সুখকর ও কাঙ্ক্ষিত দিন আজ। দুটো মানুষের দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে। পনেরো বছর আগের সম্পর্ককে আজই নতুনভাবে চিরদিনের জন্য পাকাপোক্ত করার দিন। আজকের দিনটা সুখের না হয়ে পারে?
বিয়ে যেহেতু হবে, বউ সাজতে মানা কোথায়! কম সময়ের এই স্বল্প পরিসরের আয়োজনে বর-কনের সাজপোশাকও কেনা হয়েছে। ইভানা নিজ দায়িত্বে সবকিছু সামলেছে। বিয়ে পরানো হবে রাতে। বিকেলের এই সময়টায় রুমে বসে বসে মাহদিয়াকে মেহেদী পরাচ্ছিল ইভানা। নায়রা পাশে বসে একাধারে ফটোগ্রাফি করছিল। লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন পোজ না থাকলেও ফটোগ্রাফি হবে না, এটা মানতে পারছে না নায়রা ও শিহাব। দুটোতে কোমরবেঁধে ঝগড়া করছে আবার ছবিও তুলছে।
মেহেদী পরানোর ফাঁকেই ইভানার ফোন বেজে উঠছিল। চোখ ফিরিয়ে একবার শুধু দেখল, নাবহানের কল। তাতেই হয়ে গেল। তার হৃৎপিণ্ড তো ধড়াস করে উঠলই, শোনেনি এমন ভান করে ঝটপট ফোন সাইলেন্ট করে দিল। মাহদিয়া তার এই ভাবগতিক কিছুই বুঝল না। তবে ইভানার চুপচাপ ও গম্ভীর আচরণটা সে গত দু’দিন ধরে খেয়াল করছে দেখেই, এই সিচুয়েশনে চুপ থাকতে পারল না। মনের ভয় থেকেই জিজ্ঞেস করল,
-‘ভাইয়ার সাথে ঝগড়া হয়েছে, ভাবী?’
-‘না তো। ঝগড়া হবে কেন?’
-‘তাহলে কল রিসিভ করছ না, কেন?’
-‘এমনি। বলার মতো কিছু নেই আপাতত।’
বলার মতো কিছুই নেই? বললেই সে বিশ্বাস করে নিবে! তারও তো এমন মনে হতো। শাদাবের সাথে কথা বলতে গেলে মনে হতো, বলার মতো কিছু নেই। অথচ একবার বকবক শুরু হলে আর থামত না। ননস্টপ চলত। ইভানার মন-মেজাজের এই পরিবর্তনটা সহসাই মাহদিয়ার চোখে ধরা পড়ত না। যদি না, সে তাকে সকালে ওইভাবে কিচেনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখত। এরপর থেকেই মাহদিয়া বার বার ভেবে যাচ্ছে, কী এমন হয়েছে! হাসিখুশি মেয়েটা থেমে থেমে কাঁদছে। আবার নাবহানের সাথেও কথা বলতে চাইছে না। কৌতূহল সে মোটেও দমিয়ে রাখবে না। তাই সাহস নিয়ে বলল,
-‘সকালে কাঁদছিলে কেন? ভাইয়া বকেছে? এইজন্যই ফোন রিসিভ করছ না, না?’
বুকটা ধক করে কেঁপে উঠল ইভানার। তড়িঘড়ি দু’দিকে মাথা নেড়ে ‘না’ বুঝাল। অসহায় কণ্ঠে বলল,
-‘বিশ্বাস কোরো, কিছুই হয়নি।’
-‘তবে তোমার চোখে পানি দ্যাখলাম কেন? খালামনি কিছু বলেছেন? মা, ছোটোন, শাদাব এরা কেউ?’
-‘দূর বোকা। বকলেই কাঁদতে হবে, এত দুর্বল মনের মানুষ নই আমি। তখন তো পেয়াজ কাটতে গিয়ে চোখে পানি এসেছিল।’
-‘ভংচং কোরো না? আমাকে উল্টাপাল্টা বুঝাও? দাঁড়াও, গিয়ে মা’কে বলে আসি। কিছু একটা ঝামেলা তো নিশ্চয়ই হয়েছে। নয়তো অকারণ কাঁদবে কেন?’
বিছানা ছেড়ে ড্রয়িংরুমে যেতে পারল না মাহদিয়া, তার আগেই কলিংবেল বেজে উঠল। রেহনুমা দরজা খুলে দিতেই তুফানের মতো ঘরে ঢুকল নাবহান। অণুবীক্ষণযন্ত্রের মতো ঝকঝকা, ফকফকা চোখ দিয়ে শাদাবকে খুঁজল। পেয়েও গেল সামনে। সে আজাদ সাহেবের সাথে কিছু দরকারী কথাবার্তা সারছিল। তারমধ্যেই নাবহানের এমন অগ্নিমূর্তির ন্যায় রূপ ও হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসা দেখে বলল,
-‘কী হয়েছে ভাইয়া? তোমাকে এত অস্থির দ্যাখাচ্ছে কেন?’
বলতে দেরী, বকাটা খেতে দেরী নেই। নাবহান পুরনো অভ্যাসের মতো সোজা তার কলার টেনে ধরল। চোখ গরম করে বলল,
-‘তুই ব্যাংকে গিয়েছিলি কেন? যাওয়ার আগে আমার সাথে আলাপ করবি না? কত্তবড়ো সাহস। আমাকে না জানিয়ে দলিল ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। গতকাল থেকে ইভার কাছে এই একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইছি, উত্তর দিচ্ছে না। কতবার ব্যাংকে গিয়েছি, তাদের একটাই কথা। টাকা শোধ হয়ে গেছে। দলিলও পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ আমার সিগনেচার ছাড়া কী করে হলো এসব? সাক্ষী ছিলি তুই, এইজন্য কাজটা করার সাহস পেয়েছিস। আমি তোকে বলেছিলাম, লোন শোধ করার সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে? দলিল ছাড়িয়ে আনতে হবে? আমি তো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা দিয়ে দিতাম। তাহলে কেন এত পাকনামি করতে গেলি? দেই দুটো চ//ড়?’
হবু শ্বশুর ও মাহদিয়ার সামনে এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়ে লজ্জায় ডানহাতের একটা আঙুল দিয়ে কপাল চুলকে নিল শাদাব। নিচুস্বরে বলল,
-‘কী করব? ভাবী বলল, তুমি ওই চেকটা ছিঁড়ে ফেলেছ। এদিকে লোনের টাকা পরিশোধ করা দরকার। আবার খালামনি অসুস্থ। তাই আরকি মাথায় দু’চারটে পোকা এসে এমন একটা উদ্ভট বুদ্ধি দিল আর দৌড় দিলাম ব্যাংকে। একটানে কাজ খতম। টেনশন কমিয়ে দিয়েছি না?’
ইভানার হাতে দেয়া সেদিনের চেকটাই নাবহানের রাগের কারণ। এই কারণে সুযোগ খুঁজছিল, শাদাবকে সামনে পাওয়ার আর বকা দেয়ার। কিন্তু সময় ও সুযোগ কিছুই সে পাচ্ছিল না। আজও হয়তো পেত না। যদি না, আকদের উছিলায় এখানে সে আসত। গতকাল সে নিজেই ব্যাংকে গিয়েছিল, ঋণটা পরিশোধ করে দলিল ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য। মাঝখানে ক’দিন সাওদা করীম অসুস্থ থাকায় কয়েক মাসের কিস্তি আটকে গিয়েছিল। মোটা অংকের টাকা হওয়াতে একসাথে দেয়া খুব ঝামেলা হয়ে যাচ্ছিল। তাই সে প্রতিমুহূর্তে দুঃশ্চিন্তায় ছিল। তবে সেদিন ইভানা চেকটা হাতে দেয়ার পর, তার সমস্ত দুঃশ্চিন্তা রাগে পরিণত হয়ে যায়। গতকাল থেকে রেগে আছে। আজ আবার সাওদা করীমকে নিয়ে ডক্টরের কাছে গিয়েছিল বলেই, এখানে আসতে সামান্য দেরী হলো। সুযোগ পেয়ে শাদাবকে তো বকলই, কিন্তু সেই বকাটা শাদাব গায়ে মাখল না। উল্টে নিষ্পাপ এক হাসি ফিরত দিল। তাতেই রেগে ব্যোম হয়ে গেল নাবহান। বলল,
-‘টেনশন কমিয়েছিস? মোটেও সেটা নয়। খুব বেশি দায়িত্বশীল হয়ে যাচ্ছিস, এটাই বুঝাচ্ছিস।’
-‘তাতে ক্ষতি কী?’
-‘এতটাও বড়ো হয়ে যাসনি এখনও।’
-‘তুমি আমাকে এখনও ছোটো ও অবুঝ বাচ্চা ভাবছ? আমি এখন আর ছোটো নেই ভাইয়া। দায়িত্ব নেয়ার মতো পর্যাপ্ত বয়স আমার হয়েছে।’
-‘আমার কাছে তুই সবসময়ই ছোটো ছিলি, আছিস, থাকবি। যখন খুশি তখন আমি তোকে মা//র//ব। বকব। কথা শোনাব। আবার আদরও করব। তুই কোনো তর্ক করবি না। শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনবি, গিলবি, হজম করবি। ব্যস।’
হাসিমুখে কলার থেকে নাবহানের হাত ছাড়িয়ে নিল শাদাব। দুটোহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ধীরকণ্ঠে বলল,
-‘এই দুটো হাতে তুমি আমাকে এতদূরে আসতে সাহায্য করেছ। যদি পাশে না থাকতে, কোথায় থাকতাম আজ আমি! মাথা গোঁজার ঠাঁই কোথায় পেতাম! তুমি-ই আমাকে শিখিয়েছ, কীভাবে দায়িত্বশীল হতে হয়। তুমি-ই আমাকে শিখিয়েছ, কীভাবে মানুষ হতে হয়। কীভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়। যে আমাকে নিজ হাতে স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, আজ তার বিপদে পাশে থাকব না? দায়িত্ব থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াব?’
নাবহান কিছু বলতে পারল না, শক্ত করে শাদাবকে জড়িয়ে ধরল। মাহদিয়া এবার দু’জনার সামনে এসে সামান্য কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল,
-‘ভাইয়া…।’
নাবহান স্বাভাবিক হয়ে মাহদিয়ার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল,
-‘কেমন আছো, বোন?’
-‘আলহামদুলিল্লাহ্! খুব ভালো আছি। তবে, দ্বিতীয়জন বোধহয় ভালো নেই।’
দ্বিতীয়জন কে প্রথমে না বুঝলেও মাহদিয়ার চোখের ইশারায় বুঝে গেল নাবহান। কেন ভালো নেই, মনে প্রশ্ন জাগল। তখনই তার মনে হলো, দুটোদিন ধরে ইভানা তার সাথে ঠিকঠাক কথা বলছে না। কিছু জিজ্ঞেস করলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে। শাদাবকে বকার তালে ওই দিকটাই মিস করে যাচ্ছিল সে। মনের ভেতর অকারণ এক ভয়ের জন্ম নিল। মেয়েটা এইভাবে কাঁদে না। জিজ্ঞেস করলে কোনো কারণও জানাচ্ছে না। অথচ একাধারে কেঁদেই যাচ্ছে। অতি সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে রেখে বলল,
-‘কী হয়েছে?’
-‘সেটা তো আমার প্রশ্ন ভাইয়া। খুব বেশি বকাঝকা করেছেন নিশ্চয়ই, নয়তো যখন-তখন এইভাবে কেউ কেন কাঁদবে!’
-‘আমাকে কি পা//গ//ল মনে হয় তোমার? ও’কে বকব! আমি-ই তো দু’দিন ধরে জানতে চাইছি, কিছুই বলছে না। ফোন কানের কাছে ধরে রেখে চুপ করে থাকে। ঘ্যানঘ্যান করলেও উত্তর দেয় না। কোথায় এখন? আমি যে এসেছি, দ্যাখেনি, না? ওয়েট…।’
মাহদিয়া হাতের ইশারায় রুমের ভেতরটা দেখালেই নাবহান দ্রুতপায়ে রুমে প্রবেশ করল। দূর থেকেই দাঁড়িয়ে দেখল, তার অর্ধাঙ্গিনীর কাজ। এখন অবশ্য তার চেহারা বেশ স্বাভাবিক। নায়রা ও শিহাবের সাথে সদ্যতোলা ছবিগুলো দেখছে। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
-‘তোরা একটু বাইরে যা তো। তোর ভাবীর সাথে দরকারী কথা আছে।’
ঘাড় নাড়িয়ে দু’জনই বাধ্য ছেলেমেয়ে সেজে বিদ্যুতের গতিতে দৌড়াল। নাবহান দরজা আটকে এক’পা, দু’পা এগোতে এগোতে বলল,
-‘এক সপ্তাহ ধরে এখানে আছো মানছি। দেখাসাক্ষাৎ হয়নি সেটাও মেনে নিয়েছি। ফোনে কেন ঠিকমতো কথা বলছ না? কিছু সমস্যা হলে বলা যায় না? বেহুদা কান্নাকাটি করার কী দরকার?’
ইভানা একটা শব্দও উচ্চারণ করল না। নাবহানকে উপেক্ষা করে ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে একটা রিপোর্ট বের করে আনল। সেটা নাবহানের হাতের সামনে বাড়িয়ে রেখে বলল,
-‘আমাদের বিয়ের কত বছর হলো?’
আচমকা এমন প্রশ্নে একটু থমকাল নাবহান। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
-‘আট বছরেরও বেশি।’
-‘আট বছর। অর্ধযুগেরও বেশি সময়। এতগুলো বছরে তুমি আমার ওপর বিরক্ত হয়ে গেছ না?’
এবার সত্যি সত্যিই ঘাবড়ে গেল নাবহান। রিপোর্ট না দেখে ইভানার হাত ধরে তাকে বিছানায় বসাল। দু’হাতের আঁজলায় মায়াবী মুখখানি সামান্য উপরে তুলে কাতর গলায় বলল,
-‘কী বলছ এসব? আমার কোনো আচরণে এমনকিছু প্রকাশ করেছি কোনোদিন? কখনও কোনো অভিযোগ করেছি আমি? সম্পর্ক নিয়ে, তোমাকে নিয়ে, কোনো খারাপ কথা উচ্চারণ করেছি?’
-‘তোমার অভিযোগ করা উচিত ছিল।’
-‘দোষত্রুটি থাকলে মানুষ অভিযোগ করার সুযোগ পায়। সেরকম কিছু তো হয়নি। তবে কেন শুধু শুধু অভিযোগ করব? এত বছরে এই চিনলে, তুমি আমায়?’
দু’চোখ বন্ধ করে চোখের পানি ছেড়ে দিল ইভানা। এই মানুষটার এত ভালোমানুষি আচরণের কারণেই দুঃখ তাকে ছুঁতে পারে না। অথচ দীর্ঘ বছরের এই সংসারে দু’জনের ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়ে, তৃতীয়জন আসেনি। এই নিয়ে দুঃখের শেষ ছিল না ইভানার। প্রতিদিন, প্রতি মোনাজাতে সে চাইত, সম্পর্কের পরিপূর্ণ সুখ দিতে তার কোল জুড়ে কেউ আসুক। কিন্তু তার সব প্রার্থনা বিফলে যেত। প্রতিমাসের নির্দিষ্ট একটা তারিখে এসে সব অপেক্ষা ভেঙে চুরমার হয়ে যেত। ডাক্তার দেখানোর পরও কোনো সমস্যা খুঁজে পায়নি। দু’জনই ফিট, স্ট্রং, সুস্থ। তবুও দীর্ঘ বছরের দাম্পত্য জীবন নিয়ে সে সুখী হলেও, সন্তানের শূণ্যতা তার নারীজন্মকে বৃথা করে দিচ্ছিল। সবসময় তার মনে হতো, একজীবনে মা হওয়ার মতো পবিত্র ও স্বচ্ছ-সুন্দর এই সুখকে সে কোনোদিন ছুঁয়ে দেখবে না। তার কান্নারত মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যেতে লাগল নাবহানের। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,
-‘কী হয়েছে বলবে তো? কেন এত কাঁদছ? শরীর খারাপ লাগছে? ডাক্তারের কাছে যাবে? চুপ করে থেকো না, ইভা। বোলো।’
ইভানা সে-ই একইভাবে জবাব দিল,
-‘কিছু বলতে পারলে তো, বলতামই তাই না? বলার মতো কিছু নেই আমার।’
-‘তাহলে এই কান্নার কী মানে?’
-‘কী করব? ভাবতে গেলেই তো কেঁদে ভাসাচ্ছি। কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। সারাক্ষণ মনে হচ্ছে, এবার বুঝি আমি মরেই যাব।’
আঁৎকে উঠল নাবহান। বিস্ফোরিত চোখে তাকাল। কী বলে এই মেয়ে! কী এমন রোগ হয়ে গেল, একেবারে মরার প্রশ্ন আসছে? রিপোর্ট দেখার সাহস হলো না তার। থম মেরে বসে রইল কিছুক্ষণ। ভয়ে তার কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে ততক্ষণে। এমনটা যদি হয়, সে বাঁচবে কী নিয়ে! ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে কিছু বলতে গেল নাবহান, ইভানা তাকে সেই সুযোগ দিল না। আলগোছে তার একটা হাত টেনে নিয়ে নিজের পেটের কাছে রাখল। সেকেন্ড, মিনিট পেরিয়ে গেল। জল টলমল চোখ নিয়ে ইভানা বলল,
-‘আমি তো আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, পরিপূর্ণ সুখ অনুভব করা আমার কপালে নেই। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে নিজের মধ্যে একটা পরিবর্তন খেয়াল করছিলাম। বার বার মনে হচ্ছিল, ইট’স নরমাল। এমনি হচ্ছে এসব। কিন্তু দু’দিন আগে সন্দেহবশতই টেস্ট করাতে গেলাম। অবশেষে, রিপোর্ট পজেটিভ। আমি কিছু বলতে পারছি না। জানি না, কীভাবে এই অনুভূতি প্রকাশ করতে হয়। যতবার তোমাকে বলতে চাই, ততবারই কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে যাচ্ছি।’
কাঙ্ক্ষিত কোনোকিছু যদি এইভাবে চলে আসে, সুখ হয়ে যায় ভাষায় অপ্রকাশ্য। নাবহানের অনুভূতিটাও ঠিক একইরকম। সে শুধু অর্ধাঙ্গিনীর উদরে হাত রেখে উপলব্ধি করতে চাইছে, তার সন্তানকে। তাদের ভালোবাসার অংশকে। এই সুখটা যে অন্যসব সুখের চেয়ে আলাদা ও ভীষণরকম দামী আর আবেগের, সেটা বুঝতে গিয়ে নিজেও কেঁদে ফেলল। আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে একাধারে ভালোবাসার পরশে ভরিয়ে দিল প্রিয়তমার কান্নামাখা মুখ। যত্ন করে আগলে নিল বুকে। দৃঢ়কণ্ঠে বলল,
-‘আমি খুব ভালো বাবা হব দ্যাখো। খুব ভালো বাবা হব।’
***
আজ সত্যিই সুখের দিন। খুশির দিন। আনন্দের দিন। এক সুখের মধ্যে আরও একটা সুখের বার্তা যেন ‘কুঞ্জকানন’-কে অন্য এক রঙে রাঙিয়ে দিল। সবার মুখে শুধু হাসি আর আনন্দ। এত আনন্দ আগে এখানে ছিল না। আজই সবাই প্রাণ খুলে হাসছে। পরিচিত আত্মীয়স্বজনরা সবাই উপস্থিত। মাহদিয়ার বাবা ও চাচাও উপস্থিত। যেহেতু মেয়ে বিয়ে দিবেন, পরিবারের সদস্য না থাকলে হবে কী করে। শুধু উপস্থিত নেই, হায়দার সাহেব ও নূরুন্ নাহার। শাদাব বার বার ফোন করার পরও হায়দার সাহেব ব্যস্ততা দেখিয়ে আসেননি। কীসের ব্যস্ততা কিছুই তিনি বলেননি, শুধু বলেছেন আসতে পারছেন না। গোষ্ঠীশুদ্ধ লোকজন না থাকলে যে বিয়ে হবে না তা নয়। নির্দিষ্ট সাক্ষী ও দুই পরিবারের হাতেগোনা কয়েকজন থাকলেই বিয়ের কাজ কমপ্লিট হয়ে যায়।
শমসের কাজীকে ডেকে আনিয়েছেন সায়রা করীম। যেহেতু আগের বিয়েতে তিনি-ই উপস্থিত ছিলেন। তাই এবারও বৃদ্ধ মানুষটাকে একটু কষ্টে ফেলতে বাধ্য হলেন। কাজী সাহেব দু’জনকে একসাথে দেখে প্রথমে অবাক হলেও পরবর্তীতে খুশি-ই হয়েছেন। কারণ দু’জনেই পবিত্র সম্পর্কটাকে মূল্যায়ন করতে প্রস্তুত। কেউ পালিয়ে বেড়াচ্ছে না। সাহস নিয়ে সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিয়ে আজকের এই আয়োজনের মনস্থির করেছে। কাবিননামা লেখার পর নির্দিষ্ট দেনমোহরও ধার্য করা হয়। নগদ দেনমোহর দেয়ার প্রস্তাবটা সহজেই গ্রহণ করে নেয় শাদাব। ইভানা ও নায়রা দু’জনে মাহদিয়াকে নিয়ে আসে সামনে। একেবারে পুতুল পুতুল সাজ। শুধু মাথার সাজটাই ভিন্ন। গোল্ডেন কারুকার্যের গাউন পরে মাথার অংশ ঢেকে রাখার জন্য সেফটিপিনের সাহায্যে ঢিলেঢালা করে হিজাব পরিয়ে দিয়েছে ইভানা। বলেছে,
-‘আজ এতটুকুই মানিয়ে নাও। রিসেপশনে গর্জিয়াস সাজ নিও।’
মাহদিয়া কিছু বলেনি। সাজগোছ নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। দুঃখ নেই। আফসোস নেই। তার সব আফসোস তার চুল নিয়ে, শখের চুলের ডিজাইন ও সব সৌন্দর্য হারিয়ে যাওয়া নিয়ে। দুরুদুরু বুকে যখন সে সবার সামনে উপস্থিত হলো, একজোড়া বিশ্বস্ত চোখ তাকে নির্ভরতা দেয়ার সাথে সাথে সমস্ত ভয়, দ্বিধা দূর হয়ে গেল তার। মাহদিয়ার আগমনের পরপরই এ্যাজিন নেয়ার প্রস্তুতি নিলেন কাজী সাহেব। দেনমোহর ও কাবিননামা পড়ে শোনালেন। ‘কবুল’ বলে সম্পর্কটাকে গ্রহণ করে নেয়ার জন্য তার স্পষ্ট স্বীকারোক্তির অপেক্ষায় রইলেন। এই দিনটার জন্যই যে এত বছরের অপেক্ষা দু’জনার। অবশেষে এক হতে যাচ্ছে তারা। চিরদিনের জন্য। আনন্দে, সুখে, হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠল মাহদিয়ার। হাত-পা, শরীর-মন অসাড় হয়ে এলো। মনের ভয়ভীতি দূর করে, সাহস ও মনের জোর সঞ্চয় করার জন্য নিজের বাবার দিকে তাকাল। অস্ফুটস্বরে ডাকল,
-‘বাবা…।’
আজাদ সাহেব মেয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পারলেন। এমন একটা দিনে মা পাশে নেই। আর মা’কে পাবেও না। ওই নারী আদৌ কোনোদিন অনুতপ্ত হবে কি-না সন্দেহ। মেয়েকে শান্ত করতে, তার ভয় দূর করতে, মেয়ের মাথায় হাত রেখে ভরসা দিয়ে বললেন,
-‘আর কীসের অপেক্ষা, মা? এইতো সঠিক সিদ্ধান্ত। ভয়ের কিচ্ছু নেই। শাদাব কোনোদিন তোমার অমর্যাদা করবে না।’
মাহদিয়া এটা জানে। বিশ্বাস করে। সে তো মায়ের জন্য ছটফট করছে। এইমুহূর্তে মা কেন নেই? মায়ের কথা মনে হলেই দুঃখ বেড়ে যায় তার। ভারাক্রান্ত মন নিয়েই জানতে চাইল,
-‘মা ফোন করেননি? একবারও জানতে চাননি আমার কথা? আজকের দিনেও…।’
-‘তার কথা বাদ দাও এখন। নিজেদের কথা ভাবো। কাজী সাহেব অপেক্ষা করছেন মা। শুভ কাজে এত দেরী করতে হয় না।’
এই সুখের দিনে, বাবা-মা দু’জনে পাশে থাকলে সুখ আরও দ্বিগুণ মাত্রা ছড়াত নিশ্চয়ই। কিন্তু কী আর করা। ভাগ্য তার সহায় নয়। সেদিন মা কাছে ছিলেন তো বাবা ছিলেন না। আজ বাবা কাছে আছেন তো মা কাছে নেই। দুঃখ বুঝি তার পিছু ছাড়ছে না। তবুও সবকিছু সহজ ও সুন্দর মনে করে, আজকের এই মুহূর্তটাকে আপন করে নিল। ‘আলহামদুলিল্লাহ্ কবুল’-এর মাধ্যমে সম্পর্কটাকে চিরদিনের জন্য পবিত্র বাঁধনে বেঁধে দিল। কাঁপা কাঁপা হাতে রেজিস্ট্রিপেপারে সিগনেচার করে দিল। সেদিনও নাম লিখতে গিয়ে হাত ঠকঠক করে কাঁপছিল। আজও কাঁপল। এই কাঁপা-কাঁপিকে পাত্তা দিল না মাহদিয়া। সম্পর্কের মধ্যে থাকা সবটুকু দূরত্বকে শেষ করে দিল। পুরো সময়জুড়ে মাহদিয়ার ভয়মিশ্রিত মুখবয়ব দেখছিল শাদাব। ভাবছিল, পবিত্র সম্পর্কটাকে বিশ্বাসের সাথে বাঁচিয়ে রাখার কথা। সে নিজেও যখন ‘কবুল’ বলে সিগনেচার করল, তার স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠল, চঞ্চল সেই ভ্রমরের সেদিনের সেই মায়াভরা হাসি। ছোটো ছোটো হাত দিয়ে সেদিন নাম লিখতে লিখতে বলছিল,
-‘নাম লিখলে বিয়ে হয়ে যায় বুঝি?’
তার কাছে সেদিনের সব ঘটনা পুতুলখেলার মতোই ছিল। আর আজ সত্য, সুন্দর, পবিত্র এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে দু’জনার মাঝে। এই সম্পর্কটা যেন ভেঙে না যায়, সেজন্য মনে মনে অন্তহীন প্রার্থনায় ডুবে আছে দু’জন। এ্যাজিন নেয়ার কাজকর্ম শেষ হলে আজাদ সাহেব নিজ হাতে মেয়ের একটা হাত শাদাবের হাতে তুলে দিলেন। সবটুকু ব্যথাবেদনা আগলে অশ্রুভরা কণ্ঠে বললেন,
-‘আজ নিজে স্ব-শরীরে উপস্থিত থেকে চিরদিনের জন্য আমার মেয়েটাকে তোমার হাতে তুলে দিলাম বাবা। তুমি তার অমর্যাদা কোরো না। অতীতের কালো অধ্যায়ের জন্য তাকে কোনোপ্রকার শা//স্তি দিও না। যদি কোনোদিন মনে হয়, আমার মেয়েটা তোমার কাছে বোঝা হয়ে যাচ্ছে, বাড়তি ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে, সেদিন তাকে নির্দ্বিধায় আমার কাছে পাঠিয়ে দিও। তবুও তাকে চ//ড়-লা//তি মা//রার মতো ঘৃণিত পর্যায়ে যেও না।’
মাহদিয়ার হাতটা তখনও একহাতে আঁকড়ে ধরল শাদাব। অন্যহাতে আজাদ সাহেবকে জড়িয়ে ধরে আবেগঘন কণ্ঠে বলল,
-‘আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আংকেল, কোনোদিন এমন পরিস্থিতিকে আমাদের জীবনে আসতে দিব না। আপনার মেয়ে আমার কাছে কতটা সুখে থাকবে তার নিশ্চয়তা এখনই দিতে পারছি না। তবে কোনোদিন আমার দ্বারা কোনো অন্যায়-অবিচার হবে না। আপনি শুধু দোয়া করুন। আমি আমৃত্যু আমার সব দায়িত্ব-কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পালন করে যাব, ইনশা’আল্লাহ।’
-‘আমি জানি বাবা। তোমাকে বিশ্বাস করি, ভরসাও করি। এজন্যই মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিতে পেরেছি। মেয়ে যেহেতু দিয়েছি, আর আংকেল নয়। আজ থেকে তুমি আমাকে ‘বাবা’ ডাকলেই খুশি হব।’
নতজানু হয়ে শাদাব বলল,
-‘চেষ্টা করব।’
বিয়ের সমস্ত ঝুটঝামেলা শেষে, রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর মেহমানরা বিদায় নিলেন। থেকে গেল শুধু নায়রা। নাবহান তো আর একদিনও ইভানাকে এখানে রাখবে না। সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখা বউ তার। সাতদিনে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। প্রাণ যায় যায় অবস্থা ছিল। আর একদিনও সম্ভব না। তাই মা ও বউকে সঙ্গে নিয়ে বিদায় হয়েছে সে। যাওয়ার আগে ছোট্ট একটা গিফট রেখে গেছে মাহদিয়ার জন্য। বলেছে,
-‘এটা তোমার জন্য। ‘কুঞ্জকানন’-এ আগমনী মুহূর্ত। এই নীড়ই তোমার শেষ ঠিকানা হোক। এখানেই তুমি সুখে থাকো, ভালো থাকো, আনন্দে থাকো।’
গিফটটা এখনও হাতে নিয়ে বসে আছে মাহদিয়া। ‘কুঞ্জকানন’-এ আগামনী মুহূর্ত কথাটা মনে হতেই উপরের রংচঙা পেপার খুলে বড়ো সাইজের একটা ফটোফ্রেম পেল সে। সেটা যে, এই ঘরে পা রাখার প্রথম দৃশ্য, তা দেখেই চমকাল। ইভানা এমন একটা কাণ্ড করবে ভাবেনি সে। এত চমৎকার একটা উপহার পেয়ে খুশিতে সেটা বুকের কাছে আগলে ধরল মাহদিয়া। গিফট অনেক পেয়েছে। কিন্তু এটা ভীষণ দামী তার কাছে। সে বারংবার এটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। একসময় নায়রা দেয়ালে একটা পেরেক আটকে দিয়ে বড়ো সাইজের ফটোফ্রেমটা সেখানে ঝুলিয়ে রাখল। বলল,
-‘ভাবী বলেছে, এটাকে এখানেই রাখতে। ভীষণ সুন্দর মানিয়েছে, না? দ্যাখতে ভালো লাগছে। একদম কিউট কিউট ভাব।’
শিহাব পাশে থেকে খোঁচা দিয়ে বলল,
-‘কিউট কিউট না ছাঁই, একদম তিতা করলার জুসের মতো লাগছে। তাই না, দিয়াপি? থুক্কু ভাবী।’
সম্বোধনটা যে মাহদিয়াকে করল, বুঝতে দেরী হলো না মাহদিয়ার। কথাটা মনোঃপুত হলেও করলার জুসের কথা শোনা মাত্রই মেজাজ গরম হয়ে গেল তার। এমন দিনে রাগ-অভিমান করবে না ভেবেও রেগে গেল। রাগী চোখে শিহাবের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘করলার জুস খাওয়ার খুব শখ না? দাঁড়াও…।’
মাহদিয়া ছুট দেয়ার আগেই শিহাব পালাল। ড্রয়িংরুমের এদিক-ওদিক লাফঝাঁপ দিয়ে মাহদিয়াকে নাজেহাল করে দিল। বেচারী মাহদিয়া, দুর্বল শরীর নিয়েও তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু কোনোভাবেই ধরতে ও ছুঁতে পারল না। একটা সময় ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল,
-‘তুমি ভীষণ ফাজিল আছো!’
ক্লান্ত মাহদিয়া সোফায় বসে পড়ল। সায়রা করীমকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘দ্যাখেছ, তোমার ছেলে দিনদিন কত পাজি হচ্ছে?’
সায়রা করীম হেসে বললেন,
-‘শাসন করে দাও, তাহলেই হবে।’
শাদাব রুমে গিয়েছিল, পরনের পোশাকটা পালটাতে। যেই না মাত্র উপরের ব্লেজার খুলে হ্যাঙ্গারে রাখল, অমনি নূরুন্ নাহারের ফোন এলো। ব্যস, একটা ফোনই যথেষ্ট। এরপর বুক ধড়ফড় ভাব নিয়ে কয়েক মিনিটে শুধু সে, ক্রেডিট কার্ড, মোবাইল, পকেটে ঢুকিয়ে গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে দৌড়ে ড্রয়িংরুমে এসে বলল,
-‘ছোটোন, এসো আমার সাথে।’
এত রাতে কোথায় যাবে, কেন যাবে, কিছুই বলার মতো অবস্থায় রইল না শাদাব। তার শুধু মনে হলো, এক্ষুণি রওনা দিতে হবে। শাদাবের এমন চিন্তিত চেহারা দেখে অবাক হলেন সায়রা করীম। বললেন,
-‘এখন কোথায় যাচ্ছিস? এত রাতে? যেখানে যাওয়ার সকালে যা। আজ একটা শুভদিন…। এক্ষুণি, এইভাবে ও’কে একা ফেলে চলে যাবি?’
এইমুহূর্তে মন খারাপ কিংবা শুভদিন, এইটুকু নিয়ে ভাববার সময় নেই শাদাবের। তার মাথায় শুধু নূরুন্ নাহারের কথাগুলো বাজছে। যেতে হবে মানে, যেতে হবে। দেরী হলেই বিপদ। সায়রা করীমকে কিছু জানানোর মতো সাহস পেল না। শুধু মাহদিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে তার গালে হাত রেখে মৃদুস্বরে বলল,
-‘অপেক্ষা করতে পারবে না?’
আবারও অপেক্ষা। তাদের অপেক্ষা বুঝি ফুরোবার নয়। মনে কোনোপ্রকার ভয়কে জায়গা দিল না মাহদিয়া। জড়ানো গলায় বলল,
-‘কতক্ষণ?’
-‘যতক্ষণ না আমরা ফিরছি, ততক্ষণ।’
-‘সেটা কি একঘণ্টা, দুইঘণ্টা, না-কি তারচেয়েও বেশি?’
-‘বলতে পারছি না।’
-‘যাচ্ছ কোথায়, সেটা অন্তত বলে যাও।’
বলতে গিয়েও সাহস দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারল না শাদাব। থেমে থেমে বলল,
-‘তোমাকে সাথে নিতাম। কিন্তু তুমি অসুস্থ। ভয় পেও না। খুব তাড়াতাড়ি চলে আসব।’
শাদাব ভাইয়ের হাত ধরে, মায়ের বিস্মিত চোখের সামনে দাঁড়াল। অপরাধীর ন্যায় মাথানিচু করে বলল,
-‘আজকের ভুলটা ক্ষমা করে দিও, মা।’
***
চলবে…
#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — উনচল্লিশ (২)
কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!
একজন মানুষের উপর মনের ভেতর যত রাগ-ক্ষোভ, ঘৃণা থাকুক না কেন, অপরাধী জঘন্য অপরাধ করলেও, তার সামান্য অসুস্থতার খবরে যদি ভুক্তভুগীর হৃদয় কেঁপে উঠে, অনুশোচনা, অপরাধবোধ জন্ম নেয়, তখন শত চাইলেও ব্যক্তি নিজের মধ্যে ঘৃণাকে আগলে রাখতে পারে না। বিবেক, মনুষ্যত্ব তাকে প্রতিক্ষণে তাড়া করে বেড়ায়। সমস্ত ঘৃণার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে, একটুকরো শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ও দায়িত্ব-কর্তব্য। একজন সন্তান সেই দায়-দায়িত্ব কোনোদিন উপেক্ষা করতে পারে না। না চাইতেও বিবেক তাকে বাধ্য করে, অসুস্থ রোগীর টানে ছুটে যেতে। যখন নূরুন্ নাহার ফোন করে বললেন, কায়ছার সাহেবের অবস্থা দু’দিন ধরে খুব খারাপ। স্থানীয় শহরে তাকে পর্যাপ্ত ট্রিটমেন্ট দেয়ার পরও কোনো পরিবর্তন হয়নি, উলটে শরীর-স্বাস্থ্যের অবস্থা উন্নতির বদলে আরও অবনতির দিকে এগোচ্ছে। শ্রীমঙ্গল শহরের ডাক্তারেরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য, সিলেটের একটা স্বনামধন্য হসপিটালে রেফার করে দিয়েছে। তখনই তার মনে হয়েছে, ওই মুহূর্তের দায়িত্ব-কর্তব্যটুকু সে চাইলেও অবহেলা করতে পারবে না। মানুষটা অপরাধী হলেও সন্তান হিসেবে তার কিছু দায়িত্ব আছে। একজন ডাক্তার হিসেবেও তাকে ওখানে উপস্থিত হতে হবে।
এতক্ষণ শিহাব একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। শুধু ভাইয়ের চিন্তিত মুখ ও তার স্পীডে ড্রাইভ করা দেখে গেছে। একটানে গাড়ি যখন হসপিটালের সামনে এসে থামল, তখন মধ্যরাত হয়েছে মাত্র। চারপাশে মানুষের ছোটাছুটি আর ব্যস্ততা দেখে বুঝার উপায় নেই, রাত এত গভীর হয়েছে। সবকিছু দিনের আলোর মতোই ঝকঝকে। অনবরত রোগীদের আগমন ঘটছে। কেউ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। কেউ অ্যাম্বুলেন্সকে আপন করে নিয়েছে। কেউ’বা প্রিয়জনদের সুস্থতার অপেক্ষায় ছটফট করে সময় গুনছে। এত ছোটাছুটির মাঝেও শাদাব তার আদরের ভাইয়ের হাত ধরে দ্রুতই সিঁড়ি টপকে উপরে উঠছিল। শিহাব আতঙ্কিত চেহারায় এবার জানতে চাইল,
-‘কে অসুস্থ ভাইয়া? এতরাতে আমরা হসপিটালে কার জন্য এলাম? মাকেও কিছু বোলোনি তুমি। ভয় হচ্ছে তো আমার।’
দুর্ঘটনার কথা মাকে জানানোর সাহস হয়নি, কিন্তু পরিস্থিতি বুঝে শিহাবকে সঙ্গে নিয়ে আসতে বাধ্য হলো শাদাব। সে জানে, শিহাব ভয় পাবে। তবুও কিছু করার নেই। কিছু কিছু সময় জীবনে এত কঠিনসব মুহূর্ত সামনে এসে দাঁড়ায়, শত চেষ্টায়ও তা উপেক্ষা করা যায় না। আর যদি সেখানে মিশে থাকে, একচিলতে দায়িত্ব-কর্তব্য তবে তো কোনো কথাই থাকে না। নিরুপায় শাদাব অবুঝ বাচ্চাটাকে সাহস দিয়ে বলল,
-‘ভয়কে মনে প্রশ্রয় দিও না। সামনে যদি কোনো বিপদ আসে, সাহসের সাথে সেটার মোকাবেলা করতে শিখো। হয়তো আজ এখানে তোমাকে নিয়ে আসাটা জরুরী ছিল, তাই এসেছি। যা কিছু হয়ে যাক, একদম ঘাবড়াবে না। সবসময় এইটুকু মনে রেখো, ভাগ্যের ওপর আমাদের কোনো হাত নেই। সবকিছু সৃষ্টিকর্তার পূর্বকল্পিত।’
পরিস্থিতি কঠিন হোক কি সহজ, শাদাব পাশে থাকলে যেকোনো ভয়ানক মুহূর্ত সে কাটিয়ে উঠতে পারবে। উপরনিচ মাথা ঝাঁকিয়ে দ্রুতপায়েই হসপিটালের মূল অংশে চলে আসলো তারা। করিডোরের একপাশে হায়দার সাহেবকে চিন্তিত মনে বসে থাকতে দেখে তড়িঘড়ি পা চালিয়ে ভদ্রলোকের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো। বুক ধড়ফড় ভাবটা তখনও কাটিয়ে উঠতে পারল না শাদাব। সমস্ত উৎকণ্ঠা, ভয়কে গলার কাছে আটকে নিয়ে বলল,
-‘এখানে আসবে আমাকে একবার জানাবে না? আমি কতবার তোমার কাছে জানতে চেয়েছি, ব্যস্ততাটা কীসের! বলা যাচ্ছিল না, বাবা অসুস্থ?’
মুখ দেখে শাদাবের মনের অবস্থা বুঝার উপায় নেই। তবে সে যে ভয় পাচ্ছে, প্রচণ্ড ঘাবড়েছে, সেটা তার কণ্ঠস্বরই বলে দিচ্ছে। হায়দার সাহেব একপলক দুই ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-‘জানিয়ে কী করতাম? তুই আসতি? তোর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন ওটা! ওইভাবে ফেলে আসা যায়? তাছাড়া, তোরা তো এখনও ভাইজানের ওপর রেগে আছিস। বললেই কি আর বিশ্বাস করতি?’
-‘বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসছে কেন? একটা মানুষ অসুস্থ, সেটা জানানো কি খুব বড়ো অপরাধ? হ্যাঁ তাঁর ওপর আমরা রেগে আছি। ক্ষমা করাটা কঠিন। তাইবলে হাত-পা গুটিয়ে দায়িত্ব অবহেলা করাটা কি সহজ? চাইলেও পারা যায়? শত্রুর বিপদেও মানুষ এগিয়ে আসে, মানবতা ও মনুষ্যত্বের খাতিরে!’
হায়দার সাহেব ম্লানমুখে বললেন,
-‘এখন মনে হচ্ছে, ভাইজান তোর দায়িত্ব? এত বছর মনে হয়নি?’
নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চোখ বন্ধ করে দেয়ালে ভর দিয়ে বেশ খানিকটা সময় কপালে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইল শাদাব। ধীরেধীরে বলল,
-‘তুমি হয়তো ভুলে গিয়েছ, নাহার খালার মাধ্যমে বাড়ির সব খোঁজ আমি রাখতাম। উনি অন্যায় করেছেন, তাই শাস্তি পেয়েছেন। চাইলেও সব অন্যায়কে ধামাচাপা দিয়ে ক্ষমার মাধ্যমে মিটমাট করে নেয়া যায় না। একজন নারীর মনের অবস্থা যদি তুমি বুঝতে, তবে তুমিও হয়তো ক্ষমার দিকটা এত সহজ ব্যাখ্যায় বিচার করতে পারতে না। বাদ দিই এসব। এখন এসব নিয়ে আলোচনা করার সময় নয়। ডক্টর কী বলেছেন, সেটা বোলো।’
হায়দার সাহেব একটু একটু করে সবকথা বলতে শুরু করলেন। শুরুটা কীভাবে হয়েছিল। খাবার খেতে বসে যখন তিনি বিষম খেলেন দুর্ঘটনা তখনই ঘটে। এমনিতেও কায়ছার সাহেবের শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল। হুটহাট এই বিষম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। এরপর একটু একটু করে ব্লাডপ্রেশার মাত্রাতিরিক্ত ছাড়িয়ে গেল। সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল তাঁর। মুহূর্তের হাত-পা অবশ হয়ে এসেছিল। হায়দার সাহেব দেরী না করে তড়িঘড়ি তাকে কাছাকাছি হসপিটালে নিয়ে অ্যাডমিট করান। সেখানে যা ট্রিটমেন্ট ও টেস্ট হয়, তাতে ডাক্তার জানায় ওনার শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা জটিল থেকেও জটিলতর হচ্ছে। দু’দিনের চিকিৎসায় কোনো উন্নতি হয়নি দেখেই এখানে রেফার করতে বাধ্য হয়েছেন।
এরপর একজন ডক্টর ও দু’জন নার্স তাড়াহুড়ো করে বাইরে আসতেই শাদাব নিজেই এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইল,
-‘স্যার, ঘণ্টাখানেক আগে এমদাদ কায়ছার নামে একজন রোগী আপনার তত্বাবধানে এখানে এসে অ্যাডমিট হয়েছেন, ওনার বর্তমান অবস্থা ঠিক কী?’
শাদাবকে দেখেই ডা. ইলহাম চমকালেন। শাদাব তার ছাত্র। একসময় মেডিকেলে তার ক্লাসও তিনি নিয়েছেন। অনেক বছর পর শাদাবকে এখানে দেখে তিনি অবাক হয়েই বললেন,
-‘তুমি এখানে? পেশেন্ট কী হয় তোমার?’
-‘উনি আমার বাবা।’
-‘ওনার অবস্থা খুব ক্রিটিকাল শাদাব। নিঃশ্বাস চলছে না ঠিকঠাক। কয়েকটা টেস্ট করিয়েছি। রিপোর্ট দেখে নিশ্চিত হতে পারব ঠিক কেন এরকম হচ্ছে। যদিও ওনার শ্বাসকষ্টের সমস্যার জন্য অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখলে ‘লাইফ সাপোর্ট’-এ রেখে দিতে হবে। তুমি চাইলে আগের সবগুলো রিপোর্ট দেখতে পারো।’
একজন নার্সের কাছে থাকা আগের ডাক্তারের বেশ কয়েকটা রিপোর্ট শাদাবের হাতে তুলে দিলেন তিনি। ভালোমতো দেখতে বললেন। সবগুলো রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে যা বুঝল, তাতে একটা বিষয়ে সে নিশ্চিত হলো, তিনি একদিনে অসুস্থ হোননি। আগে থেকেই বিভিন্ন রোগে ভুগতে ভুগতে এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছেন। আলসেমি করে ট্রিটমেন্ট করাতেন না। শ্বাসকষ্টের এই সমস্যা তাকে বহু বছর ধরেই ভোগাচ্ছিল। তিনি বেশিক্ষণ শুয়ে থাকলেই হুটহাট শ্বাসকষ্ট শুরু হতো। এটা ছোটোবেলা থেকেই দেখে আসছে শাদাব। তবে ওসব সামান্য ঠাণ্ডা ও ছোটোখাটো রোগ ভেবে নিয়মিত ডাক্তারের শরণাপন্ন হোননি। কেউ-ই ভাবেনি, সাধারণ এক শ্বাসকষ্ট কায়ছার সাহেবকে আজ এই অবধি নিয়ে আসবে।
***
শ্বাস-প্রশ্বাসে যেন কোনো অসুবিধা না হয়, এই কারণে সব ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে কায়ছার সাহেবের নিঃশ্বাস নেয়াটাকে সহজ করে দিয়েছেন ডাক্তার। তাতেও কতটা কাজ হচ্ছে বুঝা যাচ্ছে না। নিঃশ্বাস নেয়ার সময় বেশ গভীরভাবে বুকের ওটানামা হচ্ছে। এতে বেশ স্পষ্ট তাঁর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। শিহাবকে সঙ্গে নিয়েই কেবিনের ভেতরটায় প্রবেশ করল শাদাব। একটা সুস্থ মানুষকে এইভাবে শুয়ে থাকতে দেখে তার প্রচণ্ড খারাপ লাগল। পাশে দাঁড়িয়ে দেখল, তিনি শূণ্যে তাকিয়ে আছেন ঠিকই তবে চোখের কোণ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ছে। রক্তের টান, আত্মার টান, সম্পর্কের টান, কোনোকিছুকেই আজ আর উপেক্ষা করার শক্তি হলো না শাদাবের। মনের অতল গহ্বর থেকে অসুস্থ মানুষটার প্রতি প্রার্থনা বেরিয়ে এলো। খানিকটা ঝুঁকে নিজ হাতে চোখের পানি মুছে দিয়ে বহুবছর পর ভাঙাগলায় উচ্চারণ করল,
-‘বাবা…।’
কায়ছার সাহেব পাশ ফিরে তাকালেন। দুটো সন্তানকে একসাথে দেখে অসুস্থ শরীরের তৃষ্ণা যেন বেড়ে গেল তাঁর। চোখের ভেতর ভরে উঠল স্বচ্ছ, টলটলে পানিতে। ঘাড় কাত করে ফিরতেই সে পানি ক্রমান্বয়ে তার মুখবয়বে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি যে অসুস্থ এটা ভুলে গেলেন। সহসাই শোয়া থেকে উঠে বসতে চাইলেন। শাদাব বাঁধা দিয়ে বলল,
-‘খুব কষ্ট হচ্ছে না? একদম চিন্তা কোরো না। এখানে ট্রিটমেন্ট না হলে ঢাকায় যাব। খুব তাড়াতাড়ি তুমি…সুস্থ হয়ে যাবে, দ্যাখো।’
কথা বলতে বলতে কখন যে শাদাব নিজেও কেঁদে ফেলল, খেয়ালই হলো না তার। কীভাবে ট্রিটমেন্ট হবে, কত তাড়াতাড়ি তাঁকে সুস্থ করে এখান থেকে নিয়ে যাবে, সেই দুঃশ্চিন্তা থেকেই সিদ্ধান্ত নিল, এক্ষুণি ডাক্তারের সাথে আলাপ করে, রিপোর্ট চেক করে, হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করে রাতের মধ্যেই তাঁকে ঢাকার নামীদামী হসপিটালে অ্যাডমিট করিয়ে সব রকমের চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। সুস্থসবল মানুষের হুট করে এভাবে নেতিয়ে যাওয়াটা তাকে অশান্ত করে তুলছিল। রিপোর্ট কী এলো, সেটা জেনেই বাকিকাজ এগোবে। এই কারণেই কেবিনের বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে পা ফেলল, অমনি হাতে টান পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, কায়ছার সাহেব তার একটা হাত ধরে চোখের ইশারায় কাছে ডাকছেন। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো তাই মুখ দিয়ে আওয়াজ করতে পারছেন না। ইশারাই ভরসা। ইঙ্গিত বুঝতে পেরে আবারও মাথা ঝুঁকিয়ে ধীরস্থিরভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-‘শিহাব আছে তো এখানে। আমি ডাক্তারের সাথে আলাপ করে আসি?’
কায়ছার সাহেব দু’দিকে মাথা নাড়লেন। হাতের ইশারায় অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিতে বললেন। শাদাব ঘাবড়ে গিয়ে বলল,
-‘এটা থাকুক। খোলার প্রয়োজন নেই।’
কায়ছার সাহেব অধৈর্য্য হয়ে পড়লেন। আঙুল দিয়ে শিহাবকে দেখালেন। কয়েক’পা দূরেই দাঁড়িয়েছিল শিহাব। বুঝতে পারছিল না কী করবে! ভয়ে হৃৎপিণ্ড কাঁপছে তার। কাছে যেতেও ভয় লাগছে, দূরে থাকতেও ভয় লাগছে। কোনোভাবেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না, তার কী করা উচিত। এজন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। কায়ছার সাহেবের ইশারা বুঝতে পেরে শিহাবকে কাছে এনে দাঁড় করাল শাদাব। তিনি এবারও অধৈর্য, অক্সিজেন মাস্ক খোলার জন্য। শাদাব বাঁধা দিলেও শুনলেন না। শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে একহাতে শিহাবকে ধরলেন। কাছে টানতে চাইলেন। কিন্তু যন্ত্রপাতি আর অক্সিজেন মাস্কের জন্য তা-ও অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। একসময় শিহাব নিজেই কাছে গেল। বেডের এককোণে বসে হাতে, মাথায় হাত বুলাল। কোনোদিন বাবার আদর, ভালোবাসা না পেলেও আজ কেন যেন তার অবুঝ মন বাবার আদর পাওয়ার জন্য ডুকরে কেঁদে উঠল। নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে গেল। অতিরিক্ত কান্নার কারণে ‘বাবা’ বলে ডাকতেও পারছে না। এদিকে কায়ছার সাহেব ছটফট করছেন। হয়তো ওনার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, এটা বুঝতে পেরে কয়েক মিনিটে সিদ্ধান্ত নিল ‘লাইফ সাপোর্ট’-এ রাখবে। ডাক্তারের সাথে আলাপ করার জন্যই শিহাবকে বসিয়ে রেখে একছুটে বাইরে আসলো।
শাদাব সরে যাওয়ার পরই দুর্বল হাতে অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেললেন কায়ছার সাহেব। শিহাব বাঁধা দিলেও শুনলেন না। দুটো হাতে শিহাবের আদুরে মুখখানি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলেন। কপালে চুমু খেয়ে অনেক কষ্টে উচ্চারণ করলেন,
-‘তুমি.. আমার.. সন্তান। আমার..। অনেক.. কষ্ট.. দিয়েছি.. তোমাকে.. আমি। তোমার.. মা’কেও.. অনেক.. অপমান.. করেছি..। ক্ষমার.. অযোগ্য.. অপরাধ.. করেছি.. আমি..। যদি পারো, আমাকে.. ক্ষমা.. করে.. দিও.. তোমরা..।’
শিহাব কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে বলল,
-‘কিচ্ছু হবে না আপনার। আপনি ঠিক হয়ে যাবেন। সুস্থ হয়ে যাবেন। ভাইয়া, এক্ষুণি ডাক্তার নিয়ে আসবে। একটু শুয়ে থাকুন। শান্ত থাকুন। বেশি কথা বলবেন না। আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে।’
অবুঝ হলেও ওই মুহূর্তে কায়ছার সাহেবের অক্সিজেন মাস্ক যে খুব বেশি দরকার এটা বুঝতে পারল শিহাব। হাত দিয়ে নিজেই সেটা মুখে লাগানোর চেষ্টা করল। কায়ছার সাহেব বাঁধা দিয়ে বললেন,
-‘তুমি.. তো.. আমার.. সন্তান.. তাই.. না..? একবার.. ‘বাবা’ বলে.. ডাকবে.. আমাকে..?’
শিহাব বোকার মতো তাকিয়ে থেকে কেঁদে গাল ভাসাল। কায়ছার সাহেব জোরেজোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে শিহাবের হাত শক্ত করে ধরে বললেন,
-‘একবার.. ডাকো.. ‘বাবা।’ আমাকে.. সব.. অপরাধ.. থেকে.. মুক্তি.. দাও..।’
উদ্ভ্রান্ত শিহাব কোনো দিশা খুঁজে পেল না। কান্নামাখা স্বরে প্রথমবারের মতো উচ্চারণ করল,
-‘বা..বা।’
কায়ছার সাহেবের চোখ থেকে তখনও পানি ঝরছে। শিহাব একাধারে তা মুছে দিতে লাগল। এই একটা ডাকের সাথে কত আবেগ, কত ভালোবাসা, কত অনুভূতি লুকিয়ে ছিল, বুঝতে পারল না সে। তবে মনে শান্তি পেল। কপালে চুমু খেয়ে বলল,
-‘আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন বা..বা। খুব শীঘ্রই বাড়ি ফিরবেন।’
কায়ছার সাহেব তার মাথায় হাত বুলালেন। হাত-পা এরমধ্যেই অবশ হয়ে এসেছে। শেষ কয়েকবার বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিলেন তিনি। তড়িঘড়ি অক্সিজেন মাস্ক তার মুখে বসাল শিহাব। আবারও কয়েকফোঁটা চোখের পানি ফেললেন কায়ছার সাহেব। তৃপ্তিভরে সন্তানকে দেখলেন। তারপরই তলিয়ে গেলেন গভীরঘুমে। সমস্ত অপরাধ, ভুলচুক ও পাপের অবসান ঘটিয়ে এক নিমিষেই মৃত্যুকে আপন করে নিলেন। (ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন।)
ডাক্তারকে সাথে নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করল শাদাব। শিহাব তখনও কায়ছার সাহেবের মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। ভাইকে দেখে হাসিমুখে বলল,
-‘বাবার আর কষ্ট হচ্ছে না ভাইয়া। দ্যাখো, কত শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। এখন আর জাগানোর দরকার নেই। সকালে কথা বলব, ঠিক আছে?’
দু’জনেই কায়ছার সাহেবের কাছে এসে দাঁড়ালেন। অক্সিজেন মাস্ক চেক করে দেখলেন, নিঃশ্বাসের কোনো নড়চড়ই নেই। পালস্ চেক করলেন। সবকিছু স্তব্ধ দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাক্তার বললেন,
-‘ওনার ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছিল। এত দ্রুত যে থেমে যাবে, বুঝিনি। আ’ম অ্যাক্সট্রিমলি স্যরি শাদাব।’
শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল শাদাব। ভাইকে কী বলবে? তার বাবা চিরদিনের মতো ঘুমিয়েছেন? এই ঘুম আর কোনোদিন ভাঙবে না! মুখফুটে কিছুই বলতে পারল না। পিছন পিছন কেবিনে এসেছিলেন হায়দার সাহেব। এই দৃশ্য দেখে তিনি তার নীরব থাকতে পারলেন না। স্বজন হারানোর দুঃখে বোবাকান্নায় ভেঙে পড়লেন। কায়ছার সাহেবের সামনে এগিয়ে মুখের অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলল শাদাব। ব্যাডশিট দিয়ে সম্পূর্ণ মুখ ঢেকে দিল। শিহাব চমকে গেল। বলল,
-‘এভাবে ঢেকে রাখলে কেন?’
দু’হাতে ভাইকে জড়িয়ে ধরল শাদাব। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
-‘বাবা আর নেই, ছোটোন। চলে গেছেন ওপারে। আর কোনোদিনও আসবেন না। আমরা চাইলেও আমাদের বাবাকে আর কাছে পাব না।’
শিহাব বিশ্বাস করতে পারল না। অবিশ্বাস্য চোখে কায়ছার সাহেবের নিথর দেহ দেখে বলল,
-‘এক্ষুণি তো কথা বলেছিলেন আমার সাথে। আমি ভাবলাম ঘুমাচ্ছেন। তাই বিরক্ত করলাম না।’
সব ঘুম যে, ভোরে হলেই ভাঙবে তা নয়! কিছু কিছু ঘুম, চিরনিদ্রাও হয়। এই নিদ্রা বছরের পর বছর ধরে চলে। যুগের পর যুগ ধরে চলে। পৃথিবী ঘুরে। সূর্য উঠে, সূর্য ডুবে। দিন যায়, রাত আসে। সময় ক্রমান্বয়ে সামনের দিকে এগোয়। তবুও এই চিরনিদ্রিত মানুষ আর জাগে না। ফিরে আসে না। শত ডাক, শত আকুতি, শত আহাজারি শোনার পরও, ঘুমন্ত মানুষ জেগে উঠতে পারে না। তাদের বাবা যে এমনই এক ঘুমে বিভোর হয়ে আছেন, সেটা মাত্রই বুঝল শিহাব। শুধু হতবাক হয়ে তাকাল। কখন যে শরীর হাল ছেড়ে দিল, বুঝতে পারল না। অজ্ঞান হয়ে ভাইয়ের হাতের ফাঁকে ঢলে পড়ল।
***
সন্তান হিসেবে বাবার মৃত্যুর পরবর্তী কাজগুলো সামাল দেয়ার দায়িত্ব আছে শাদাবের। সেই দায়িত্বটুকু পালন করার জন্য ভোররাতেই কায়ছার সাহেবের মৃতদেহ নিয়ে ‘সুখনীড়’-এ পা রেখেছে সে। চারিদিকে অ্যানাউন্সমেন্ট ছড়িয়ে দিয়েছে। মসজিদের ইমাম সাহেবকে দিয়ে মৃতদেহকে গোসল দিয়েছে। মৃতদেহটাতে কাফনের কাপড় পরিয়ে খাটিয়ায় তুলে কবরস্থানে নিয়ে গেছে। খাটিয়া যখন কাঁধে তুলছিল, তখনও সে ভাবেনি, এইভাবেও কাউকে ক্ষমা করে দেয়া যায়। সবশেষে আজাদ সাহেব, সে ও হায়দার সাহেব মিলে মৃতদেহটাকে সাড়ে তিন হাত গভীর ওই অন্ধকার ঘরে রেখে দিয়েছে। দুই ভাই মিলে বাবার কবরে মাটি দিয়েছে। তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেললেও কয়েক মিনিট পরে আবার স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল শিহাব। নিজেকে শক্ত রেখে, ভাইয়ের সাথে বাকি কাজে হাত লাগিয়েছে।
জানাযার নামাজ শেষে সবাই চলে যাওয়ার পর শিহাব মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে বসে রইল। আসর গড়িয়ে গিয়ে মাগরিবের সময় হয়ে এলো। শিহাব ওভাবেই ওখানে পড়ে থাকল। বাবা যদি জীবনে আসলেন-ই, তবে এত অল্প সময়ের জন্য কেন এলেন? কেন আরও কিছুদিন সে বাবাকে কাছে পেল না? কেন বাবা বলে ডাকতে পারল না? কেন বাবার আদরটুকু পেল না? সামান্য এক ভুল কতকিছু থেকে বঞ্চিত করে দিল তাকে। শাদাব ভাইকে ঘরে ফিরিয়ে নিতে বলল,
-‘এখন ফিরে যাই আমরা। আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবে? মা অপেক্ষা করছেন তো।’
কান্না মুছে সোজা হয়ে বসল শিহাব। তারজন্য মা অনেক কষ্ট পেয়েছেন। ঘরবাড়ি ছেড়ে, অন্যের বাড়িতে থেকেছেন। এসবের জন্য তার বাবা দায়ী হলেও, আজ বাবাকে ঘিরে মনে কোনো ক্ষোভ নেই তার। নিষ্পলক চোখে কবরের দিকে তাকিয়ে মাটিতে হাত বুলিয়ে বলল,
-‘ওনার ওপর আমার কোনো রাগ-ঘৃণা নেই। আমি ওনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তুমি করেছ?’
শাদাব মাথা নেড়ে বলল,
-‘মৃত মানুষের ওপর কোনোপ্রকার রাগ-ঘৃণা বাঁচিয়ে রাখা ঠিক না। ক্ষমা করে দিতে হয়। ভুল যত ভারী হোক, এইমুহূর্তে ক্ষমাটাই একমাত্র সমাধান। আল্লাহ্ ওনাকে জান্নাতবাসী করুন, ওনার সমস্ত অপরাধকে ক্ষমা করুন, আমরা শুধু এইটুকু দোয়া চাইতে পারি।’
জানাযা শেষে বাড়ি গিয়েছিলেন হায়দার সাহেব। ফিরে এলেন হাতে একটা দলিল নিয়ে। সেটা শাদাবের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
-‘তোদের হক্বটা এখানেই রাখা আছে। নিয়ে যেতে পারিস।’
শাদাব নিসংকোচে বলল,
-‘এটা কোনো এতিমকে দান করে দিও। নয়তো তোমার নিজের কাছে রেখে দাও। এসবের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই।’
-‘তারপরও, এটা তোদের অধিকার। ভাইজান আগেই এটা তৈরী করে রেখেছিলেন।’
-‘অধিকার থাকলেই দখল করতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই।’
দলিল ছুঁয়েও দেখল না শাদাব। দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। ধরনীর বুকে আঁধার নামছে। তাদেরকে ফিরতে হবে। সায়রা করীমের কী অবস্থা কে জানে! সে শিহাবকে নিয়েই উঠে দাঁড়াল। শেষ একবার মোনাজাত করল। মোনাজাত শেষে হায়দার সাহেবকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘তোমার আর নাহার খালার জন্য ‘কুঞ্জকানন’-এর দরজা সবসময়ই খোলা থাকল। যখন খুশি যেও। না গেলেও রাগ করব না। ধরে নিব, আপনজন বলতে মা ছাড়া আর কেউ নেই আমাদের।’
***
বাড়ি ফিরে সায়রা করীমকে সিজদাহ্তে পেল শাদাব। কোনোপ্রকার শব্দ করল না। চুপচাপ ফ্লোরে বসল। শিহাব গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল, তাই তাকে রুমে রেখে মায়ের কাছে এসে বসল। সায়রা করীমের পরনের শাড়ির দিকে নজর যাচ্ছে বার বার। জীবনের সব রং হারিয়ে যাওয়ার পর, সাদা শাড়ি পরনে জড়ালেও আজকের এই দৃশ্য দেখে কলিজা কেঁপে উঠল। হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে নামাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রইল। বেশ খানিকটা সময় পর সালাম ফিরিয়ে, লম্বা মোনাজাত শেষ করলেন তিনি। শাদাবকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে বললেন,
-‘কিছু বলবি?’
যথেষ্ট শান্ত, স্পষ্ট, মোলায়েম স্বর। বহু বছর ধরে কাঁদতে থাকা মন, এবার নিজেকে সামনে নিয়েছে বোধহয়। সে মায়ের হাত ধরে নিজের গালে চেপে রেখে বলল,
-‘আ’ম স্যরি মা। গতকাল রাতে…।’
-‘আমি জানি। নাহার ফোন করে বলেছিল আমাকে।’
-‘শিহাবকে নিয়ে যাওয়াতে রাগ কোরোনি তো তুমি?’
-‘রাগ করব কেন? তুই তো অবুঝ নোস্। জেনে-বুঝে ভুল কোনো কাজ করবি না, এটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে? আমি কষ্ট পাইনি, রাগও করিনি। ভাগ্যের লিখন বলে মেনে নিয়েছি।’
-‘আমার মনে হয়েছিল, ওইরকম একটা সিচুয়েশনে ছোটোনকে নিয়ে যাওয়া জরুরী। তাই কোনোকিছু না ভেবে…। আমাকে ক্ষমা করে দাও, মা।’
সায়রা করীম স্নেহের পরশে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-‘ক্ষমা চাইতে হবে কেন? তোর যা করণীয়, তুই সেটা করেছিস। তোর জায়গায় আমি থাকলেও, হয়তো এটাই করতাম। এখন যা। হাতমুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে বোস। আমি ছোটোনকে একনজর দ্যাখে আসি।’
নিজের রুমে প্রবেশ করেই চমকে গেল শাদাব। ইভানা যেভাবে রুমটা কাঁচাফুলে সাজিয়েছিল, সেভাবেই আছে। এখন অবধি কেউ যে এই রুমে পা রাখেনি, এটা নিশ্চিত। বিয়ে করা বউকে ওইভাবে অপেক্ষায় ফেলে, অন্য এক দায়িত্ব-কর্তব্যের টানে চলে গিয়েছিল। সে জানত না, তার ফিরে আসা এইভাবে হবে! এত দেরী করে হবে! সমস্ত দায়-দায়িত্ব পালন করে তবেই ফিরতে হয়েছে। লম্বা পা ফেলে যখন গেস্টরুমে পা রাখল, তখন আরও বেশি অবাক হলো। নায়রা একাধারে মাহদিয়ার মাথা, কপাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে আর মাহদিয়া, বড়ো মামা হারানোর দুঃখে তখনও কাঁদছে। সে যেতে পারেনি, এই একটা আফসোসই তাকে শেষ করে দিচ্ছিল। নায়রা তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করছিল। শাদাবকে রুমে প্রবেশ করতে দেখে নায়রা বলল,
-‘দ্যাখো অবস্থা। সামলাতেই পারছি না। কতবার বললাম, রুমে গিয়ে ঘুমাও। এখন থেকে ওখানেই তোমার সবকিছু। যাবে না বলে জেদ ধরে বসে থাকল। এরপর আংকেল মারা যাওয়ার খবর শোনে নদীনালা ভাসিয়ে সেই যে কান্নাকাটি শুরু করেছে, আর থামছেই না।’
নায়রার কথা শোনেই, নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল মাহদিয়া। দ্রুতহাতে চোখের পানি মুছে নিল। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত যুবককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
-‘ছোটোন কোথায়?’
-‘ঘুমোচ্ছে।’
-‘তোমারও তো ঘুম দরকার। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও আগে।’
কে, কাকে, সামলাবে? এরচেয়ে নিজেরা, নিজেরাই নিজেদের সামলে নেয়াটা বোধহয় ভালো। এইটুকু বুঝে, মাহদিয়া শান্ত করে ফেলেছে নিজেকে। রুম ছেড়ে বাইরে এসে টেবিলে খাবার সাজিয়েছে। যদিও দুর্বল শরীর নিয়ে কিছু করতে পারছিল না। তবুও রেহনুমার সাথে কাজে হাত লাগাতে ভালোই লাগছিল তার। শিহাবের ঘুম ভাঙল না আর। শাদাবও ভাইকে ডাকল না। যা পরিস্থিতি গিয়েছে, লম্বা ঘুম না হলে এটা আবার তার মনের মধ্যে প্রভাব ফেলতে পারে। এরচেয়ে ঘুমাক, এটাই সবচেয়ে স্বস্তির বিষয়।
থমথমে এই পরিবেশে খাবারটাও গলা দিয়ে নামছে না শাদাবের। অদ্ভুত শূণ্যতা আঁকড়ে ধরেছে তাকে। পনেরো বছর আগে যখন ‘সুখনীড়’ ছেড়ে চলে আসে, তখনও ভাবেনি, আবার ওইখানে পা ফেলে, বাবা নামক মানুষটাকে চিরদিনের জন্য বিদায় দিতে হবে। দু’হাতে তাকে কবরে শোয়াতে হবে! খেতে বসেও কায়ছার সাহেবের ছটফটানি, তার ঘুমন্ত মুখ, কিছু কষ্টকর মুহূর্ত বার বার এসে পীড়া দিতে লাগল তাকে। মন উপলব্ধি করল, সন্তান হিসেবে সে ব্যর্থ। আসলেই ব্যর্থ। এই ব্যর্থতা অস্বীকার করার উপায় নেই তার। নয়তো জীবন তাকে এত কঠিন সময়ের মুখোমুখি কেন দাঁড় করাল? সে যে ব্যর্থ, এটা বুঝাতেই তো! বিড়বিড়িয়ে খোদার দরবারে কত আরজি যে পেশ করল, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
***
চলবে…