বকুলতলা পর্ব-১৪+১৫

0
479

বকুলতলা

১৪.
নেতিয়ে পরা তরীর মাথা আলতো করে বুকে চেপে বসে আছে মাহাদ। অনেক্ষণ হলো, মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে। সিক্ত নেত্রজোড়া যেন তখনো তরতাজা। পাঁপড়িগুচ্ছে ভেঁজা ভেঁজা ভাব। বড্ড মলিন দেখাচ্ছে মুখটা। মাহাদ আরেকটু আগলে নেওয়ার চেষ্টা করলো। আশপাশে ক্ষীণ তাকালো। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। মেলা নিয়ে সবার হৈ-হুল্লোড় তখনো কমেনি। আকাশটাও সুবিধের না। মেঘ করছে খুব। কালো কালো মেঘ।
মাহাদ তরীর গালে আলতো করে হাত ছোঁয়ালো, “তরী? উঠো। এই মেয়ে, যাবে না বাসায়?”

তরী একটুখানি নড়লো যেন। খুব সামান্য। গালের মধ্যিখানে তখনো কাঁটা দাগের মতো শুকিয়ে যাওয়া অশ্রু লেগে আছে। আঙুলের চাপে সেই দাগ মুছতে চাইলো মাহাদ। উহু, হলো না। আরেকবার চেষ্টা করলো। এবারও না। তরী আবারও নড়েচড়ে উঠলো। চোখ মেললো। মাহাদকে এতটুকু কাছে দেখে চমকালো খুব। তৎক্ষণাৎ মাহাদের বুক শূণ্য করে বললো, “কয়টা বাজে?”
মোটরসাইকেল থেকে উঠে দাঁড়ালো মাহাদ,
—“৫টা ৬টা হবে। ঘড়ি দেখতে ইচ্ছে করছে না।”
অথচ তরী মেলা থেকে বের হয়েছিল ৪টার দিকে। এখন সন্ধ্যে প্রায়। এতক্ষণ ঘুমিয়েছে? এই রাস্তায়? লোকটা ডাকেনি কেন? তটস্থ ভঙ্গিতে রাস্তার মানুষগুলোর দিকে একবার চোখ বুলালো তরী। ফুটপাতের পথচারী, টং দোকানে বসে থাকা লোকগুলো কিংবা তাদের মতোই কিছু তরুণ-তরুণী একাধারে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। যেন তাদের আগ্রহের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু ওরাই। তরী লজ্জায় নতজানু হলো। পলক ঝাপটালো বেশ কয়েকবার। নিজ মনেই বিড়বিড়ালো, “আমি কি বেশি ঘুমিয়ে ফেলেছি?”

মাহাদ তখন কুঁচকানো দৃষ্টিতে পরখ করছিল তরীর হলদেটে মুখশ্রীর আনাচে কানাচে। অপ্রস্তুত তরীর নাকটা লাল হয়ে আছে। চোখ ফুলে একাকার। হালকা গলায় সে শুধালো, “কিছু খাবে তরী? পানি আনি? কেঁদেকেটে তো দূর্বল হয়ে গেছ।”
তরী মাথা নাড়ালো। খাবে না। মাহাদ আবার বললো,
—“বাদাম আনবো? বা অন্য কিছু?”
এবারও ডানে বামে মাথা নাড়ালো সে। আস্তে আস্তে চোখ তুলে তাকালো। চোখে চোখ রাখলো। ভেঁজা কণ্ঠে বললো, “আপনাকে আমার কিছু বলার আছে মাহাদ।”
—“শুনতে ইচ্ছে করছে না।”
—“কেন?”
মাহাদের শান্ত দৃষ্টি পাল্টালো। প্রচন্ড স্বাভাবিক দেখালো তা। ঢিমে যাওয়া স্বরে বললো, “আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, তুমি আমাকে কষ্ট দিবে তরী।”

বুকের ভেতরটা ভারী হলো কি? পাহাড় সমান কিছু ডেবে গেল? নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তরী বুঝলো, মাহাদ নামের লোকটা তাকে বিষণ্ণ, উদাসীন করে দিচ্ছে। সে কথা ঘুরাবার চেষ্টা করলো, “আপনি কি কোনো কারণে আপনার বাবার প্রতি রেগে আছেন, মাহাদ?”
—“কেন মনে হলো?” মোটরসাইকেল থেকে হেলমেট নিয়ে তা আবারও তরীকে পরিয়ে দিতে লাগলো মাহাদ৷ এবারও গলার দাগটা চোখে বিঁধলো। বাজে ভাবেই। তবে কোনোরুপ প্রশ্ন করলো না।
তরী মনে করিয়ে দেওয়ার মতো করে বললো, “ওইযে, কালকে? আপনার বাবা ফোন দিয়েছিল। কিন্তু আপনি ধরেননি।”
—“আমাকে দেখে মনে হয় আমি বাবার সঙ্গে রেগে আছি?”
জবাবে তরী মাথা দুলালো ঘনঘন। হেলমেট ভালো করে লাগিয়ে মাহাদ সরে দাঁড়ালো তখন। দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিঃশব্দে। একটুও ভণিতা না রেখে বললো, “আমি ছোটবেলা থেকে বাবার হাতে মাকে মার খেতে দেখেছি তরী। এজন্যই হয়তো বাবার প্রতি আমার ভালোবাসাটা প্রকাশ পায়না।”

কথাটা বুঝতে বেশ সময় নেয় তরী। ক্ষণে ক্ষণে থমকায়, চমকায়, অবাক হয়। অবাক হয় এজন্য, কেউ কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিল যে মানুষটা সবসময় তার ভালো খারাপ নিয়ে পরে থাকে, সে-ই ভালো নেই।

আজকেও প্রণয় হাসপাতাল থেকে দ্রুত ফিরেছে। তরী জানতো না। রুমের ঢোকার আগে লাইব্রেরী ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল অনেক্ষণ। দরজার ক্ষীণ ফাঁকফোঁকর দিয়ে দেখছিল অর্ধেক বইয়ের স্তুপ মাখা তাকগুলি। হঠাৎ পেছন থেকে প্রণয়ের রুক্ষ গলা শোনা গেল, “আমি কারো তাকানো জন্য আমার লাইব্রেরী ঘর বানাইনি।”
আচমকা ডাকে তরী ভয় পেয়ে যায়। হন্তদন্ত বুকটা ধরফর করে। রাগ হয় খুব। কিন্তু দোষটা যেহেতু তার, তাই কিছু বলার জো নেই।

—“আপনাকে আমার লাইব্রেরী থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম।” প্রণয় বললো। গম্ভীর চিত্তে।
তরী কোনো ধরণের অপরাধবোধ ছাড়াই বললো, “আমি কি আপনার লাইব্রেরীর কিছু করেছি? দরজাও তো ধরিনি।”
—“আপনি আমার জিনিসের আশেপাশেই না আসার চেষ্টা করুন তরী। আপনাকে ঠিক আমার পছন্দ না।”

তরীর সহ্য হলো না এই পছন্দ অপছন্দের কথাটা। তিন বছর ধরে শুনছে। এখানে এসেছিল একটু শান্তি মতো বাঁচতে। কটু কথাগুলো থেকে বাঁচতে। কই? পারলো নাতো।
কণ্ঠে দারুণ ঝাঁঝ থাকলেও কেমন করুণ সুরে আহাজারি করে উঠলো সে, “কেন পছন্দ না আপনার ভাইয়া? কি করেছি আমি? ধর্ষিতা বলে? ধর্ষিতা বলে আপনারা সবাই আমাকে অপছন্দ করেন? আমার সাথে একটু কথা বললে, একটু ছঁলে কি আপনাদের গায়ে ময়লা লেগে যাবে?”

এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড। সময় গড়ালো। প্রণয়ের থমথমে মুখটা বিদ্যুতের মতো চমকালো যেন। স্পষ্ট বিমূঢ়তায় হতভম্ব হলো। কাঁপা কাঁপা গলায় জানতে চাইলো, “তুমি– তুমি ধর্ষিতা?”
প্রশ্নটা ভীষণ আজব ঠেকলো তরীর কাছে। মনে প্রাণে অনুভূত হলো, প্রণয় অভিনয় করছে। তাচ্ছিল্য করছে তাকে।
প্রণয় নড়বড়ে গলায় আবার বললো, “তুমি কি আমার সাথে মজা করছো তরী?”
—“আপনার সঙ্গে মজা করার সম্পর্ক আদৌ আছে আমার?”

উত্তর দিতে প্রণয় সময় নেয়। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিঁজিয়ে বলে, “গলার দাগটা কি তবে অর্ণবের না?”
তরীর শক্ত গলা, “না।”

_______________

চলবে~

বকুলতলা

১৫.
আকাশের চাঁদের আলো ফিঁকে পরা। প্রণয় যেখানটায় বসেছে, সেখানে আলো আসছে একটু একটু। পাতার ফাঁকফোঁকর দিয়ে। মৃদুমন্দ বাতাসে তেরছা ভাবে উড়ছে বেহায়া চুলগুলি। মুখশ্রী দারুণ আনমনায় নিমজ্জিত। চোখের দৃষ্টি সরল, স্থির, অসুখে ভরা। প্রণয় একটু নড়েচড়ে উঠে দাঁড়ালো। ভালো লাগছে না। শরীর গরম হয়ে আসছে। জ্বর এসেছে কি? আসতেও পারে।
ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে বসার ঘর পরিষ্কার করছিল সালেহা। প্রণয়কে দেখে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “ভাইজান? ভাত বাড়মু এহন?”

প্রণয় সালেহার পানে তাকালো একপলক। তার পা চলছে না। পেটে ক্ষুধারা আন্দোলন করলেও মুখে রুচি নেই। হালকা কণ্ঠে সে উত্তর দিলো, “খাবো না কিছু।”
সালেহা আগ্রহী চোখে তাকালো। বুঝতে না পেরে শুধালো, “কি কইলেন? খাইতেন না?”
—“নাহ্। খেতে ইচ্ছে করছেন না। তুই খেয়েছিস?”
—“খাই নাই ভাইয়া।”
—“তরী খেয়েছে?”
সালেহা এবার একটু অবাকই হলো! প্রণয় তরীর কথা জিজ্ঞেস করছে? তাকে তো কোনোদিন নিজ মায়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেও দেখেনি সে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে এতক্ষণ কথা বলতেও দেখেনি কখনো। তাও আবার তার সাথে!
ব্যাপারগুলো কোনোমতে হজম করে সালেহা বললো, “আপায় খাইছে।”
—“আচ্ছা।”

প্রণয় আবার পা চালালো। একেবারে লাইব্রেবীর তাকগুলোর সামনে এসে থামকালো সে। পাঁচ নম্বর তাক থেকে আবারও উপন্যাসের বইটা নিলো। আস্তে ধীরে চেয়ারে গিয়ে বসলো। জানালার পাশটায়। বইয়ের ৮১ নম্বর পাতা খুলে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কিছু মুহুর্ত। গাঢ় কালো রঙের কলম নিয়ে ডান পাশের অল্পখানি জায়গায় কতগুলো দাগ দিয়ে লিখলো,

“আমার ভ্রম ভেঙ্গে গেল হঠাৎ করেই। আমি শুধু জানতাম মেয়েটার কালো অতীত আছে। অর্ণব নামের খুব কাছের কেউ ছিল। যে তাকে ছিন্নভিন্ন করেছে। বিবস্ত্র করে অত্যাচার করেছে। ওকে স্পর্শ করেছে। আমার ক্ষোভ ছিল মেয়েটার প্রতি, ওর পরিবারের প্রতি, আমার মায়ের প্রতি। অথচ আমি এখন জানলাম, আমার খুব অবহেলায় যতনহীন ফুলটা আগে থেকেই দুমড়েমুচড়ে গেছে। আমি জেনেছি অনেক পরে, অর্ধেকটুকু সত্য। হাহ্! ধিক্কার আমার প্রতি! আমি ওকে আগলে রাখতে পারিনি। মুর্খের মতো বসে রয়েছিলাম শুধু।
৩১ জুলাই, ২০২১”

প্রণয়ের আঙুল থমকালো। এতটুকু লিখে আর লিখতে ইচ্ছে হলো না। বই বন্ধ করে কলমটা অযত্নে ফেলে রাখলো টেবিলের একপাশে। দেহের উত্তাপ ক্রমশ বাড়ছে। চোখে কি ভীষণ ক্লান্তি! শক্তি হ্রাস পাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। শা শা বাতাসের আনাগোনায় প্রচন্ড আরামে ঘুম চলে আসছে। প্রণয় চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিলো। মাথা উলটো দিক করে ঝুঁকালো। ঘুমিয়ে গেল ওভাবেই। কেউ দেখলো না। কেউ দেখলো না অসুস্থ তাকে।

তরীর বয়স তখন কত? সদ্য আঠারো পেরুনো যুবতী। নতুন নতুন কলেজে উঠেছে। ক্লাস করছে। বাসা থেকে ভরপুর স্বাধীনতা। যেখানে ইচ্ছে যেতে পারছে, ঘুরছে, আড্ডা দিচ্ছে। কখনো বা রেস্তোরাঁয় ভরপেট খাওয়া দাওয়া চলছে। আনন্দের কি কমতি আছে তার? কিংবা ছিল?
তরীর বন্ধুদের সংখ্যা ছিল অনেক। রবি, শিমু, রুপালী, সবুজ, সুমন, ত্রিধা, প্রাণ, ইরা– সবকটা তরীর জান পরাণ। কলেজ শেষে একজোট হয়ে দুষ্টোমী ছিল যেন ওদের নিত্যদিনের সঙ্গী।
সেদিন বোধহয় এমনই একটা মজাদার দিন ছিল। ক্লাস দুটো করার পরই রুপালী ‘ক্লাস আর করবো না’ বলে আন্দোলন শুরু করে দিয়েছিল। বাকি সবাইও সেই আন্দোলনের সহযোগী হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। মাঝখান দিয়ে শিমু বিজ্ঞদের মতো বললো, “দেখ, চতুর্থ ক্লাসটা কিন্তু অনেক জরুরি! না করলে একেবারে জীবন শেষ!”
রবি তখন ভেঙ্গিয়ে বললো, “আইছে একেবারে জীবন শেষ! সোজাসোজু বলে দেয় না, ওই লম্বু স্যাররে তোর পছন্দ। এত কাহিনী করিস কেন?”
সবুজ খুব বিরক্ত ধাঁচের ছেলে। সব কিছুতেই তার বিরক্ত ঘটিত সমস্যা। এবারও খেঁকখেঁক করে শিমুকে জোড় করে টেনে ধরে বললো, “পরে দেহিস ওই লম্বুরে। শীতকাল, সময় কম। এই যে ন্যাকামি কইরা দেড়ি করলি? পরে কিন্তু আমার খাওয়া নিয়া দেড়ি দেড়ি চিল্লাইতে পারবি না।”

যে যাওয়ার সে তো গেলই, বাকিদের টেনে হিঁচড়ে একটা পার্কে নিয়ে গেল সবাই। বিশাল পার্ক! গ্রামে সহজে এমন পার্ক পাওয়া যায় না। বড়োসড়ো সবুজ দুর্বাঘাসের দুটো মাঠ, জঙ্গলের মতো অনেকগুলো গাছ আর কয়েকটা রডের বেঞ্চি। কাঁচা মাটির তৈরি রাস্তাও আছে। তরীরা বসলো মাঠের একপাশে। সবুজ, সুমন, রবি আগে থেকেই রেস্তোরাঁ থেকে খাবার নিয়ে এসেছিল। সবুজ সবার আগে আগেই গপাগপ খাচ্ছিল সব। সে একটু ভোজন রসিক কি-না! বলা বারণ, সবাই সে বিকালে একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছিল। হাঁটার আর জো নেই। ঘাসের ওপর শুয়ে বসে বিশ্রাম নিতে নিতে সন্ধ্যা প্রায়। হাসি-ঠাট্টার মাঝে সময়ের খেয়ালই ছিল না কারো। মাগরিবের আযান দিতেই টনক নড়লো। ব্যস্ততা ঘিরে ধরলো বাসায় যাওয়ার। কিন্তু বেঁকে বসলো রুপালী। মলিন কণ্ঠে বললো, “আমার না বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। তোরা যা।”

শিমু ভ্রু কুঁচকে বললো, “ওমা, যাবো মানে? তুই যাবি না? সন্ধ্যা হয়ে গেছে আবাল! একা একা এখানে কি ঘাস কাটবি?”
শিমুর কথায় তেমন একটা পাত্তা দিলো না ও। আচমকা তরীর হাত ধরে অনুরোধী কণ্ঠে বললো, “তুই থাক না আমার সাথে দোস্ত। আমরা একটু পরেই চলে যাবো। ওরা যাক এখন।”

মারাত্বক দ্বিধা নিয়ে তাকালো তরী৷ হাঁসফাঁস করলো। দিরুক্তি করতে চাইলেই গলায় জোড় দিয়ে রুপালী বললো, “থাক না বোন। তুই তো জানিস, আমার বাবা-মায়ের মাঝে ঝামেলা লেগেই তাকে। বাসার পরিবেশ আজকাল আরও খারাপ হয়ে গেছে। যেতেও ইচ্ছে করে না। এখানে একটু বসলে ভালো লাগবে। তাছাড়া তোর তো বাসা যাওয়া নিয়ে প্রবলেম নেই।”

তরী আর মানা করলো না। রুপালীর সম্বন্ধে সে অনেক কিছুই জানে। বাবা, মায়ের ঝাগড়াঝাটি দেখেই বড়ো হয়েছে মেয়েটা। তরীর মায়া হলো। সে রাজী হয়ে গেল থাকতে। রবি বললো, “তাইলে আমিও থাকি। আমারও তেমন কাজ নাই বাসায়।”
সঙ্গে সঙ্গে রুপালীর প্রতিবাদ, “নাহ্, নাহ্! তোর থাকতে হবে না। তুইও যা সবার সাথে। তরী থাকলেই হবে। ওর সাথে আমার কিছু ইম্পোর্টেন্ট কথাও আছে।”
রবি সন্দিহান চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললো, “আচ্ছা।”

সবাই চলে গেল। ঘড়ির কাটা এক এক করে সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা পেরুলো। পার্কে থাকার সময়সীমাও শেষ প্রায়। অথচ রুপালী কিছু বলছে না। ভীতু চেহারায় এদিক ওদিক তাকাচ্ছে মাত্র। চিন্তিত মুখখানা শুকিয়ে কাঠ!
এরমধ্যেই দারোয়ান এসে সবাইকে পার্ক থেকে বের হওয়ার জন্য তাগাদা দেওয়া শুরু করে দিয়েছে। তা দেখে তরীও আগ বাড়িয়ে উঠতে নিলে রুপালী বাঁধা দেয়, “তুই উঠছিস কেন? আমাদের কি উঠতে বলেছে?”
—“কিন্তু সবাই যে চলে যাচ্ছে?”
—“আরও কিছুক্ষণ থাকি। দারোয়ান চাচা তো আমাদের কিছু বলছে না।”

বোকা তরী মেনে নিলো প্রাণ প্রিয় বান্ধবীর কথা। এতটাই বোকা ছিল যে, রুপালীর তার জন্য বয়ে আনা কালবৈশাখীর ঝড়টাও টের পেল না। আবার পেলোও তখন, যখন হাতের সময় ফুরিয়ে গেছে। পার্ক লোকজনহীন শূণ্যতায় ভুগছে। ভয়ে ভয়ে বান্ধবীর হাতটা ভরসা ভেবে ধরলো তরী। বললো, “আর কত থাকবি রুপালী? সবাই চলে গেছে। একা আমরাই আছি। চল, উঠ।”
রুপালী বরাবরের মতোই হাত কঁচলাতে কঁচলাতে বললো, “আরেকটু বয়। চলে যাবো এক্ষুণি।”

সময় গড়ালো। অন্ধকারে ঢাকা আকাশের সাদা মেঘগুলো কালো-ধূসর হয়ে গেল। ঘনিয়ে আসা ক্ষণে তরী অস্পষ্ট দেখতে পেল, তার সর্বনাশকে। পাড়ার বখাটে। আলফাজ আর তার বন্ধু অনিক। তারা কেমন তরহীন ভাবে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে।
তটস্থ তরী রুপালীর হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো তৎক্ষণাৎ। শক্ত করলো বাঁধন। ভয়ে কেঁপে উঠা কণ্ঠে বললো, “এই শয়’তানগুলো আমাদের খোঁজ পেল কিভাবে? তোকে বলেছিলাম তাড়াতাড়ি চলে যেতে। এখন কি করবো আমরা? কিভাবে পালাবো?”

রুপালী নির্বিকার। শান্ত চোখে চেয়ে আছে মাত্র। চোখ টলমল। তরী ভাবলো, মেয়েটা বোধহয় ভয়ে কাঁদছে। সে আশ্বস্ত করলো, “কাঁদিস না। আমি আছি না? তোর ব্যাগ থেকে মরিচ পানি বের কর। আজ এদের চোখই নষ্ট করে দিবো।”
তারপর একটু থেমে বললো, “আমি মরিচ পানি ছুঁড়ে মারলে তুই জোড়ে জোড়ে চিল্লিয়ে মানুষ ডাকিস, ঠিকাছে?”
রুপালী তখনো নির্বিকার, স্বাভাবিক। অল্পক্ষণ চেয়ে থেকে কেমন করে যেন জানতে চাইলো, “তুই এত বোকা কেন তরী?”

তরী তখনো রুপালীকে চিনলো না। আলফাজ, অনিক কাছাকাছি আসতেই হাতের শক্ত বাঁধন ডিঙ্গিয়ে তরী থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো রুপালী। একটু একটু করে পেছাতে লাগলো। মাঠ থেকে তারটা সহ তরীর ব্যাগটাও উঠিয়ে নিলো। কি ভীষণ খারাপ লাগা নিয়ে বললো, “আমাকে ক্ষমা করে দিস দোস্ত। আমি আলফাজকে ভালোবাসি। ওকে আমার সব দিয়েছি। কিন্তু ও বলছে, তোকে পেলেই ও আমাকে বিয়ে করবে। আমরা পালিয়ে যাবো। এ গ্রাম ছেড়ে, আমার টক্সিক বাবা-মাকে ছেড়ে। সুখে থাকবো। আমার সুখের জন্য এটুকু সহ্য কর, প্লিজ।”

তরীর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো যন্ত্রণায়। কানে বাজলো নর’পিশা’চগুলোর খড়খড়ে হাসির আওয়াজ। অনুভব হলো শরীরের প্রত্যেকটা স্থানে বিশ্রী, বাজে হাতের স্পর্শ। তরী একটা শব্দও করলো না। কাঁদলো না। চিৎকার করলো না। অবাক, হতভম্ব হয়ে দেখলো, মুহুর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়া মেয়েটাকে। আদৌ কি তরীই শুধু বোকা? একদম না। তার থেকে চরম বোকা তো ছিল রুপালী! আহারে! অবুজ মেয়েটা! সুখের সন্ধানে সুখটাই পেল না!

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা