বকুলতলা পর্ব-১৬+১৭

0
470

বকুলতলা

১৬.
বিকেলের তেজটা আজ কিছুটা কম। মেলায় সেলসগার্লের কাজ করতে তরীর ভালোই লাগছে। শপটাতে প্রায় সবাই-ই বন্ধুত্বপূর্ণ। মিলেমিশে কাজ এগিয়ে দেয়। তরী তো আগে কখনো এসব কাজ করেনি। ভুল হলে বুঝিয়ে দেয়। ফাঁকে ফাঁকে এসে গল্প করে যায়। তরী এমনিতেও কারো সাথে কথা বলেনা। অচেনা, চেনা সবার সাথেই মিশতে কেমন ভয় ভয় লাগে। বরাবরের মতোই সল্পভাষী হয়ে উত্তর দিলেও আশেপাশের মেয়েগুলো যেন আরও আগ্রহী হয়ে উঠে ওকে জানার জন্য, বুঝার জন্য। সময়টা খারাপ যাচ্ছে না। ভালোই চলছে, চলুক।
মাহাদ দুপুর থেকেই তরীর সাথে মেলায় বসে আছে। তরীর শপটার ঠিক সামনের ক্যাফেতেই বসে বসে নজর রাখছে সে। এ পর্যন্ত পাঁচ-ছটা কফি খাওয়া বোধহয় এমনিতেই শেষ! অথচ মুখশ্রী বড্ড শুকনো, ক্লান্ত। সকাল থেকে এ পর্যন্ত পেটে আবিজাবি ছাড়া যে কিছু পরেনি, বোঝা যাচ্ছে। তরী তবুও আশ্বস্ত হওয়ার জন্য ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো। মেসেজ অপশনে গিয়ে টাইপ করলো, “আপনি কি খেয়ে এসেছেন বাসা থেকে?”

মাহাদ কুঁচকানো চোখে শপটা পর্যবেক্ষণ করছিল। তার মতে মেলার সবচে’ ফালতু দোকান বোধহয় এটাই। কিসব রুলস, ফালতু নিয়ম-নীতি। তরী যেটাই পরে আসুক না কেন, গায়ের জামার ওপর আলাদা করে দোকানের লোগো লাগানো গেঞ্জি পরতেই হবে। কাজের বাহিরে কথা তো বলাই যাবে না! দেখা করাও নিষিদ্ধ। তারওপর ছেলে কাস্টমারগুলোর এত এত আদিখ্যেতা আর ভালো লাগছে না। বিরক্ত লাগছে। ভীষণ, ভীষণ বিরক্ত।
মাহাদ চোখমুখ কুঁচকে সঙ্গে সঙ্গেই লিখলো, “তুমি আর কতক্ষণ থাকবে এখানে?”
—“৫টা সাড়ে ৫টা পর্যন্ত। আপনি খেয়ে এসেছেন?”
—“তোমার সাথে খাবো। তোমাদের কি লাঞ্চের জন্য ছুটিটুটি দেয় না কিছু?”
তরী মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে কি-বোর্ডে হাত চালালো, “উহু। কাজের ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু খেতে পারি। তাছাড়া বেশি সময় তো এখানে থাকছি না। মাত্র চার ঘন্টা।”
প্রবল অসন্তুষ্টিতে মাহাদের মেজাজ আরেকটু বিগড়ালো। অনেক্ষণ ওপাশ থেকে কিছুই লিখে পাঠালো না সে। তরী ঠিকই টের পেল, তার মেজাজের তীক্ষ্ণটা। রেগে যাওয়া। লিখলো,
—“কিছু খেয়ে আসুন, যান। এখানে বসে থাকতে হবে না। কাজের খালা আসেনি আজকে?”
মাহাদ উত্তর দিলো, “মানা করে দিয়েছি আসতে। আর, খেতে ইচ্ছে করছে না। তোমার সাথে খাবো।”

তরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা রেখে দিলো। ভাবলো, আর কিছু লিখবে না। পরক্ষণেই ভুলোমনার মতো কাঁচের গ্লাস ভেদ করে আকস্মিক তাকালো মাহাদের দিকে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, লোকটা কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। হাতের ফোনের দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ। কপাল, ভ্রু, চোখ– সবকিছুতে বাজে ভাবে ভাঁজ ফেলে স্ক্রীনে দৃষ্টি ফেলে রেখেছে। শপে এখন মানুষজন কম। ব্যস্ততাও কম। আরেকবার চারপাশটা দেখে সে আবারও ফোন হাতে নিলো। মাহাদকে কঠিন থেকেও কঠিন বার্তা পাঠালো, “আপনি যদি এক্ষুণি কফি খাওয়া বাদ না দিন, তবে আমি আর আপনার সাথে কথা বলবো। এক্ষুণি খেতে যাবেন। এক্ষুণি মানে এক্ষুণি!”
ফোনটা এবার ব্যাগেই পুরে রাখলো তরী। মাহাদের ওদিকটায় ভুলেও তাকালো না। সে নিশ্চিত! লোকটা এখন মারাত্বক ধ্বং’সপূর্ণ চোখে চেয়ে আছে ওর দিকে। সেই চোখে চোখ রাখতে চায় না তরী। একদমই চায় না।

সেকেন্ড, মিনিট গড়ালো। একটা লম্বা মতো মেয়েকে শপের ভালো ভালো জিনিসগুলো বর্ণনা করে মাত্রই একটু চেয়ারে বসেছিল তরী। দেখতে সহজ মনে হলেও কাজটা কিন্তু ভীষণ কঠিন। কাস্টমারদের সাথে খুব বুঝেশুনে কথা বলতে হয়। কিছু কিছু জিনিসের ব্যবহার তো তরী নিজেও জানে না। অন্যজন থেকে শুনে হুবহু একাধারে কপি করে বলে দিয়ে এসেছে। লম্বা মেয়েটাও খুতখুতে কম না! এতগুলো জিনিস দেখে, এত এত ইনফরমেশন নিয়ে মাত্র দুটো জিনিস কিনেছে। তাও অনেক দরদাম করে। তরী হাঁপিয়ে উঠলো এটুকুতেই! আরও তো এক, দু ঘণ্টা বাকি!
হঠাৎ কাঁচের দরজা খুলে মাহাদ শপের ভেতর ঢুকলো। কোনোদিকে না তাকিয়ে ফুড আইটেমের দিকটায় গিয়ে থামলো সে। একটা মেয়ে কর্মী এগিয়ে এসে তখন বিনম্র কণ্ঠে জানতে চাইলো, “শুভ মধ্যাহ্ন স্যার। আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”

মাহাদ গম্ভীর চিত্তে বললো, “পটেটো চিপস, চানাচুর, পানির বোতল আর যা যা খেলে পেট ভরে যায়, সব দিন। সবগুলোই ডাবল করে দুটো প্যাকেটে দিবেন।”
মেয়ে কর্মীটি মাথা দুলিয়ে সায় দিলো। অল্পক্ষণ অপেক্ষার পর জিনিসগুলো নিয়ে ক্যাসকাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালো মাহাদ। প্যান্টের পকেট হাতড়ে মানিব্যাগ বের করলো। বিল মিটালো। পরপরই তরীর সামনাসামনি এসে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো, “কাজ শেষ হওয়ার আগে এসব শেষ হওয়া চাই। নাও।”

নিদারুণ গম্ভীর কণ্ঠ। রুক্ষ। তরী মানা করার জো পেল না। হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিলো প্যাকেটটা। মাহাদ আর দাঁড়ায়নি। তখনই দ্রুত পায়ে চলে যায়।
রুমা নামে এক সহকর্মী সাথে সাথে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, “ওই ছেলেটা কে তরী? তোমাকে এভাবে খাবার দিয়ে গেল। তোমার প্রেমিক বুঝি?”

রুমার চোখে মুখে জানার তীব্র উৎকণ্ঠা। তরী বিব্রতবোধ করলো। কৃত্রিম মুচকি হেসে জবাব দিলো, “নাহ্।”

জোরে জোরে বাতাস বইছে। তরী বিধস্তের ন্যায় ওড়না সামলালো। বারবার মাথার ঘোমটা পরে যাচ্ছে। বের হতেও বেগ পেতে হয়েছে খুব। এত এত ভীড়! মানুষে মানুষে ঠেলাঠেলির মতো অবস্থা! কোনোমতে রাস্তার কাছে পৌঁছাতেই দেখলো, মাহাদ আগে থেকেই মোটরসাইকেলের ওপর বসে আছে। সে লোকটার কাছাকাছি আসতেই কেমন সূক্ষ্ণস্বরে প্রশ্ন করলো, “প্যাকেটের সবকিছু খেয়েছিলে?”

তরী মাথা নাড়ালো। খায়নি। মাহাদ ভ্রু বাঁকিয়ে আবার শুধালো, “কেন খাও নি?”
—“অতকিছু একসাথে খাওয়া যায় নাকি? পরে খাবো। আপনি খেয়েছেন কিছু?” হালকা কণ্ঠে শেষ প্রশ্নটা করলো তরী।
মাহাদ উত্তরে বললো, “তখন দুটো প্যাকেট নিয়েছিলাম না? একটা তোমার ছিল, আরেকটা আমার।”

আবহাওয়া হঠাৎ করেই ক্ষীণ গুমোটে ছেয়ে গেছে। আধো আধো রোদের ছোঁয়া পেতে মন্দ লাগছে না। সূর্যমামার দিকে একবার চেয়ে পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নিলো তরী। সে জানে, মাহাদ এখন তাকে তার সাথে মোটরসাইকেলে করে যেতে বলবে। কিন্তু তরী চাইছে না। বাসে করেই যাবে। ইদানিং লোকটার প্রতি সে একটু বেশিই নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে। প্রশ্রয় দিচ্ছে।
তরী আগেভাগেই বললো, “আমি কিন্তু আজকে আপনার সাথে যেতে পারবো না৷ বাসেই যাবো।”
জবাবে মাহাদ কিছুপলক চেয়ে ছিল। শান্ত, শীতল নেত্রে। দিরুক্তি করেনি। শুধু বলেছে, “আচ্ছা।”
জবাব শুনে তরী মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেও পরপরই তা এক নিমিষে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। চালাক মাহাদ মোটরসাইকেল থেকে চাবি পকেটে ঢুকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো, “চলো, একসাথে যাই।”

বাসে উঠেও তরী মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো। মাহাদকে কিচ্ছু বলেনি। বলেও লাভ আছে? এই লোক শুনবে আদৌ?
অভিমানীর অভিমান দেখে মাহাদ অদৃশ্য হাসলো। বললো, “তুমি রাগলে কার মতো লাগে, জানো?”
তরী জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছে। মাহাদের দিকে ফিরলো না। কথাও বললো না। মাহাদই বললো, “তুমি একদম আমার মায়ের মতো তরী। অল্প কিছুতেই রেগে বসো।”
তরী এবারও নিশ্চুপ। মুখশ্রী ক্ষীণ মলিন দেখালো। নিজে নিজে কি যেন ভাবলো সে। এক মুহুর্তের জন্য প্রচন্ড ভাবুক হয়ে উঠলো। তারপর নিভু নিভু স্বরে আচমকা জিজ্ঞেস করলো, “আপনার মায়ের কি হয়েছিল, মাহাদ?”

মাহাদ চমকালো না সেই প্রশ্নে। হাসলো একটু। নিঃশব্দে, খোলাখুলি ভাবে। স্বাভাবিক স্বরেই বললো, “আমি আমার সতেরো বছর বয়সে নিজের মাকে হারিয়েছি তরী। নূপুর তখন ছোট। বাবা এমনিতে ভালো হলেও জুয়া খেলা, নেশা করার অভ্যাস ছিল। পরকীয়াও করেছিল একসময়। রোজরাতে বাবার মার খাওয়া, পরকীয়ার মতো কঠিন সত্য, মা সহ্য করতে পারেনি আসলে। ব্রেনস্টোক করে ফেলেছিল।”

আশ্চর্য! কথাগুলো বলতে বলতে মাহাদ হাসছে। লোকটার কি খারাপ লাগছে না?
—“আপনি হাসছেন কিভাবে মাহাদ?” একরাশ বিহ্বলতা তরীর কণ্ঠ জিড়ে।
—“তাহলে? কাঁদতে বলছো?”
তরী উত্তর দিলো না। অবাক, বিমূঢ় চোখে চেয়ে থাকলো মাত্র। মাহাদ আবারও হাসলো। লহু কণ্ঠে বললো, “আমি কাঁদতে পারিনা তরী। কান্না আসেনা।”

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

বকুলতলা

১৭.
জ্বর শরীরে প্রণয় ওই লাইব্রেরী ঘরেই পরে রইলো সকাল পর্যন্ত। কেউ দেখতে আসেনি। খবর নিতে আসেনি। সালেহা অবশ্য একবার খেতে ডেকেছিল। প্রণয় সাড়া দেয়নি। ঘুম ভাঙ্গার পরপরই অলসতা কাটিয়ে ঢুলু ঢুলু পায়ে চলে গিয়েছিল নিজের ঘরে। অগোছালো, কুঁচকানো বিছানাতেই ছেড়ে দিয়েছিল অচল শরীরটা। দেহে যেন প্রাণ ফুরিয়ে গেছে। হাত, পা নাড়াতে কি কষ্ট! কি দারুণ অসারতা!
আয়েশা খাতুন যখন ছেলের জ্বর টের পেলেন, তখন বিকাল প্রায়। মূলত ছেলের হাসপাতালে না যাওয়ার কারন শুনতেই এসেছিলেন তিনি। পরক্ষণেই কপালে হাত ছোঁয়াতেই রীতিমতো আঁতকে উঠলেন। এত জ্বর! কখন হলো?
তাড়াহুড়ো করে প্রণয়ের মাথার কাছে বসলেন আয়েশা খাতুন। কপালে হাত ছুঁইয়ে আরেকবার দেহের তাপমাত্রা পরিমাপ করে নিলেন। কিঞ্চিৎ ক্ষিপ্ত স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “তুই আমাকে আগে জানাস নি কেন প্রণয়? এত জ্বর কখন এলো?”

প্রণয় উত্তর দিচ্ছে না। নিভু নিভু চোখে চেয়ে আছে মাত্র। চোখ জোড়াও জ্বালা করছে। মাথা ব্যথার যন্ত্রণায় সব কিছু কেমন ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে। আয়েশা খাতুন কণ্ঠ নমনীয় করে বললেন, “বেশি খারাপ লাগছে আব্বা? মাথায় জলপট্টি দিয়ে দেই?”
—“কষ্ট হয় আম্মু।”

কষ্ট, আবেগ, হিংসা, অহংকার– সব কিছু ঝাঁপিয়ে বিশাল কিছু ছিল কথাটায়। আয়েশা খাতুন এক মুহুর্তের জন্য থমকালেন। ছেলে তার এভাবে কখনো কথা বলে না। নিজেকে দমিয়ে রাখে। তবে আজ কি হলো? চুলের গভীরে হাত গলিয়ে তিনি ম্লান গলায় বললেন, “বেশি কষ্ট হচ্ছে? ডাক্তার ডাকি?”
—“আমিই তো ডাক্তার আম্মু। ডাক্তারকে ডাক্তার সুস্থ করতে পারে?”
—“কেন পারবে না? তোর ডাক্তার বন্ধুটাকে কল দেই? আসতে বলি?”

প্রণয় সেকথার জবাব দিলো না। চুপচাপ শুয়ে রইলো কিছু ক্ষণ, কিছু মুহুর্ত। তারপর কি যেন হলো। কি ভেবে ভ্রু কুঁচকে গেল। কপালে ভাঁজ পরলো হিং’স্র ভাবে। আচমকা মায়ের ডান হাত শক্ত করে ধরলো সে। এতই শক্ত যে, ফর্সা চামড়া তীক্ষ্ণ নখে বিঁধে ক্ষতবিক্ষত হলো। আয়েশা খাতুন সহ্য করতে পারলেন না। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে ধমকে উঠলেন, “কি করছিস প্রণয়? আমার হাত ছাড়! ব্যাথা পাচ্ছি আমি!”

প্রণয় শুনলো না। অবাধ্য হলো। ছাড়লো না হাত। চোখের সাদা অংশে লাল রঙ মিশিয়ে আধখোলা পাতায় তাকিয়ে রইলো। দেখে মনে হচ্ছে, সে বুঝি মাতাল। এক্ষুণি কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে। তবে না। প্রশ্নটা সে শান্ত স্বরেই করলো, “তরীকে কি ধর্ষণ করা হয়েছিল আম্মু?”

আয়েশা খাতুন মোটেও চমকালেন না। একদিন না একদিন প্রণয় সত্য জানতোই। সেই একদিন এখন হলে ক্ষতি কি? বললেন,
—“তুই জানলি কিভাবে?”
—“জেনেছি। তুমি আগে বলো নি কেন?”
—“বললে কি করতি? যতটুকু বলার ছিল, বলেছি।”

মনে বিতৃষ্ণা জাগলো। নিজ মাকে ভীষণ বিষাদ লাগলো প্রণয়ের। তেঁতো মুখটা বিচ্ছিরি ঝাঁঝে ভরে গেছে। আয়েশা খাতুনের হাত ছেড়ে তিরিক্ষি মেজাজে সে বললো, “এখান থেকে যাও আম্মু। ভালো লাগছে না।”
—“একটু পরে যাচ্ছি। তুই তো বোধহয় কিছু খাসনি। সালেহাকে ডেকে বলি স্যুপ আনতে? স্যুপ খাবি?”
—“তোমাকে এখনই যেতে বলেছি আম্মু!”
প্রণয়ের উঁচু গলা। আয়েশা খাতুন কষ্ট পেলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জোড়েসড়ে। বোঝানোর সুরে বললেন, “তখন পরিস্থিতি ভালো ছিল না প্রণয়। তুইও দেশে ছিলি না। তোকে বলে তোর পড়ালেখা নষ্ট করতে চাইনি।”

প্রণয় বুঝি বুঝলো? একদমই না। চোয়াল শক্ত করে রাখলো কঠিন থেকে কঠিন ভাবে। আয়েশা খাতুন আবার বললেন,
—“মেয়েটা আর ভালো নেই প্রণয়। তোর সাথে মানায় না। আমাদের স্টেটাসের সাথেও যায় না। অর্ণব নামের ছেলেটার সাথেও কত কাহিনী হলো! তুই মেয়েটার কথা আর ভাবিস নাতো।”

প্রণয় ভয়ংকর চোখে তাকালো এবার। কপালের নীল রগটা স্পষ্ট হলো। ফোঁসফোঁস শব্দে নিস্তব্ধতা কাটলো। ঝাঁঝালো স্বর শোনা গেল, “তুমি এক্ষুণি বেড়িয়ে যাবে আম্মু! এক্ষুণি!”

আয়েশা খাতুনের হাত জ্বালা করছে। ক্ষীণ রক্তে রঞ্জিত ছোট ছোট নখের দাগগুলো। গরম, গরম অনুভব হচ্ছে। তিনি একপলক প্রণয়ের দিকে তাকালেন। আরও একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেলেন।

বিকালটা সুন্দর। আসন্ন সন্ধ্যার কমলাটে মুহুর্ত। বাতাসের আনাগোনা নেই। তবুও উষ্ণতা ছুঁতে পারছে না। মোটরসাইকেলের পেছনের সীটে বসে তরী একমনে পাশে চেয়ে আছে। দেখছে, দুটো মেয়েকে। দুজন দুজনের বন্ধু হয়তো। আইসক্রিমের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে চকবার খাচ্ছে। মাঝে মাঝে একে অন্যজনকে খাইয়ে দিচ্ছে। মজা করছে, হাসছে, দুষ্টুমী করছে। তরীর নেত্রজোড়া ঘোলাটে হলো। কেউ একজনকে মনে পরলো হঠাৎ করেই। মনে পরলো, সেইদিনের কথা। রুপালী চলে যাওয়ার পরের আর্তনাদটা। বুকে কামড়ের তীক্ষ্ণটা অনুভব করতে পারছিল তরী। শরীর যন্ত্রণায় কাঁপছিল। হাহাকার করছিল ভেতরটা। গলায় জোড় ছিল না। চোখ উলটে গিয়েছিল। সেই উল্টানো চোখেই আশপাশ দেখার চেষ্টা করছিল তরী। খুঁজছিল কাউকে, সাহায্যের জন্য। পেট সূক্ষ্ণ অথচ বিশাল ভাবে মোচড় দিতেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো। কাঁদলো হু হু করে। চেঁচিয়ে বারবার ডাকতে লাগলো, “রুপালী? দারোয়ান চাচা? আমাকে বাঁচান কেউ। আমি বাঁচতে চাই। প্লিজ আমি বাঁচতে চাই।”

অথচ ওপাশ নিঃশব্দ। কেউ আসলো না। ভয়ংকর হায়নাগুলো বিশ্রী শব্দ করতে লাগলো শুধু। বিশ্রী হাসলো। কালো লোকটা মুখ এগিয়ে আনলো দ্রুত ভাবে। চুমু খেতে চাইলো তরীর কান্নায় ভেঙ্গে পরা ঠোঁটে। তরী চাচ্ছিল না। সরে যেতে চাইছিল বারবার। অসহ্য রাগে হঠাৎ করেই ফুঁসে উঠে বড় বড় নখগুলো দিয়ে খামচে ধরলো লোকটা বাম চোখ। লোকটা ব্যথা পেয়ে সরলো অনেকটা। ব্যাথাতুর আওয়াজে গড়ালো সবুজ, সতেজ ঘাসে। তরী কিন্তু সুযোগটা কাজে লাগাতে পারতো। পেরেও যেত যদিনা অনিক নামে লোকটার বন্ধু ওকে ধরে না ফেলতো। নরম গালে লোকটার খড়খড়ে হাতের লাগাতার থাপ্পড়ে তরী নেতিয়ে পরেছিল। হাত মুচড়ে ধরায় ব্যথায় শব্দও করতে পারছিল না। কাঁদছিল মাত্র। অল্প অল্প করে। তার পালাতে চাওয়াটাও ছিল যেন মারাত্বক অপরাধ! কষ্টটা বোধহয় এজন্যই একটু বেশিই দিয়েছিল লোকগুলো।

—“তরী, তুমি কি আইসক্রিম খেতে চাচ্ছো?”
তরীর সম্বিৎ ফিরলো। আইসক্রিমের ছোট্ট গাড়িটা থেকে চোখ সরিয়ে মাহাদের দিকে তাকালো। ছেলেটা বাদাম হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আবারও একই প্রশ্ন করতেই তরী লহু স্বরে বললো, “খাবো না। বাসায় যাবো।”
—“সত্যি খাবে না?”
উত্তরে ডানে বামে মাথা দুলালো সে। মাহাদের কেন যেন বিশ্বাস হয়ে গেল। মেয়েটার বাচনভঙ্গি বলে দিচ্ছে, সে মিথ্যা বলছে না। এক কদন এগিয়ে মাহাদ মোটরসাইকেলে ধপ করে বসে পরলো। খানিকটা তরীর পাশ ঘেঁষে। ঠাট্টার সুরে বললো, “ওহে নৌকা রমনী, আপনার কি বেশি মন খারাপ? আমার সাথে কি টিএসসিতে ঘুরতে যেতে চান?”
তরী অবাক কণ্ঠে বললো, “সেতো অনেক দূরে। যাবো কিভাবে?”

মাহাদ কয়েকটা বাদাম নিয়ে খোসা ছাড়ালো। তরীর হাতে দিয়ে বললো, “আপনি রাজী কি-না বলুন। নিয়ে যাচ্ছি।”
তরী একটু ভেবে বললো, “নাহ্। যাবো না। আপনি সকাল থেকে ভালো কিছু খাননি। হাবিজাবিতে কি পেট ভরে? বাসায় জলদি গিয়ে জলদি জলদি ভাত খেতে বসে যাবেন।”
মাহাদ শুনলো। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো কেমন।
—“তুমি এত মিথ্যা করা বলো তরী!”
—“এখন কি মিথ্যা বললাম?”
বিমূঢ়তা স্পষ্ট তরীর মুখশ্রী জুড়ে। মাহাদ শুষ্ক কণ্ঠে আওড়ালো, “এইযে, তুমি আমায় ভালোবাসো না।”

__________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
বানান ভুল থাকতে পারে। দুঃখীত।