বকুলতলা
৩৮.
কোলে ল্যাপটপ নিয়ে বিছানার মাঝখানটায় বসে আছে মাহাদ। মুখটা ক্ষীণ চিন্তায় জর্জরিত। অর্ণব মাতব্বর মানুষ। যদিও তার কীর্তিকলাপ সামনাসামনি আসার পর গ্রামের সবাই মিলে তার পদত্যাগ করতে চাইছে। করেও ফেলবে হয়তো। কিন্তু ততদিনে দেড়ি হয়ে যাবে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্ণব জেল থেকে বেরও হয়ে যেতে পারে। তাই একটা শক্ত প্রমাণ তৈরি করছে মাহাদ। কিছু ভিডিও-ও আছে তার কাছে। কাল রাতে ব্যাটাকে মা’রার সময় করেছিল। এই ভিডিও ভাইরাল হলে জেল থেকে বের হওয়ার পর লজ্জায় বাসা থেকে বের হতে পারবে না নিশ্চিত! আপাতত ভিডিওগুলো একেকটা চেক করে এডিট করায় ব্যস্ত সে।
হঠাৎ দরজায় খটখট আওয়াজ হলো। আস্তে না। ভীষণ জোড়ে। পরপরই ডাক শুনতে পেল, “আসমু, আব্বা?”
রশিদ সাহেবের খসখসে কণ্ঠস্বর। মাহাদ একপলক দরজার দিকে তাকালো। দরজা ভেড়ানোই আছে। চোখমুখ ক’ঠিন করে, কি-বোর্ডে লাগাতার হাত চালাতে চালাতে অনুমতি দিলো, “আসো।”
অনুমতি পেয়ে রশিদ সাহেব তৎক্ষণাৎ ভেতরে ঢুকে পরলেন। নিঃশব্দে ছেলের পাশে বসতে বসতে শুধালেন, “কি করোস?”
মাহাদ যারপরনাই বিরক্ত হলো। তীব্র বিরক্তিতে ভেতরটা তেঁতো হয়ে গেল যেন। কাঠকাঠ গলায় বললো, “কি বলতে এসেছ, বলে চলে যাও। এত ঘুরাচ্ছ, পেঁচাচ্ছ কেন?”
—“তোর কাছে কি একটা সিগারেট হইবো?”
—“তুমি এত রাতে আমার রুমে সিগারেট চাইতে আসছো?” আশ্চর্য হয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো মাহাদ।
রশিদ সাহেব এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘোরালেন। ইতস্তত করলেন খুব। কথাটা বলা উচিত কিনা! মাহাদ যদি রেগে যায়? অল্পক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ করে তারপর আস্তে করে প্রশ্ন করলেন, “তুই যেই মাইয়ারে পছন্দ করোস, মাইয়ার নাম কি? কেমন দেখতে? কইলে– বিয়ার প্রস্তাব পাঠাই?”
—“তোমাকে এসব কে বলেছে? নূপুর?”
—“হ। মাইয়াটারে বকিস না। প্রথমে কইবার চায় নাই। আমি জোড়াজোড়ি করার পর কইছে। অর দুষ নাই।”
মাহাদ তপ্ত নিশ্বাস ফেলল। রয়েসয়ে, সময় নিয়ে। উত্তর দিলো, “ঠিকাছে, ওকে কিছু বলবো না। তুমি এখন যাও। আমি ঘুমাবো।”
মুখ দিয়ে ‘ঘুমাবো’ উচ্চারণ করলেও, মাহাদের চোখে মুখে মোটেও ঘুমানোর তাড়া নেই। যত যাই হোক! এখন সে কিছুতেই ঘুমাবে না। তাকে তাড়াতেই মূলত এসব বলছে ছেলেটা। রশিদ সাহেব বুঝেন, জানেন। তবে ইচ্ছে করেই নড়লেন না সেখান থেকে। অনেকদিন ছেলেটার সাথে মন ভরে কথা বলা হয়না। তিনি বলতে চাইলেও মাহাদ সুযোগ দেয়না। ব্যাপারটা যে একজন বাবার জন্য কতটা ক’ষ্টের, রশিদ পদে পদে টের পান। তিনি অস্বীকার করবেন না, দোষ তারও আছে। কিন্তু এই দোষের মাশুল কি কোনোদিন ঘুচবে না? ছেলেটা কি একটু ভালো করে তাকাবে না তার দিকে? বয়স হয়েছে। আর তো কয়দিন! যেকোনো সময় পরপারের জন্য ডাক পরে যাবে।
—“তুই তো কিছু কইলি না। মাইয়ার নাম কি? প্রস্তাব কি পাঠামু?”
—“তোমাকে এতকিছু চিন্তা করতে হবে না আব্বা। আমারটা আমি দেখে নিবো।”
—“এইডা কি রকম কথা মাহাদ? আমি তোর বাপ লাগি। এইটুকু তো আমিই করুম।”
—“অনেক কিছু করেছো আব্বা। না চাইতেও অনেক কিছু করে ফেলেছো। আর প্রয়োজন নেই। তুমি শুধু আমাকে একটু একা ছেড়ে দাও। তোমার এই আহ্লাদীপনা আমার আর ভাল্লাগছে না।”
না চাইতেও গলা উঁচিয়ে কথাগুলো বলে ফেললো মাহাদ। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেল নিমিষেই।
রশিদ সাহেব কষ্ট পেলেন। ভীষণ কষ্ট। বলতে চাইলেন,
—“আমারে কি ক্ষমা করন যায় না? আমি তো আমার ভুল স্বীকার করছি।”
—“তোমার ছেলে উদার মনমানসিকতার হলে অবশ্যই করতো। কিন্তু যতই হোক, তোমার মতো মানুষের র’ক্তই আমার শরীরে বইছে। তোমার মতোই আমার ঠিক সব বিষয়ে দয়ামায়া আসে না। সেখানে তো তুমি আমার মাকেই মে’রে ফেলে ক্ষমা চাইছো!”
—“তোর মা যে এভাবে মই’রা যাইবো, আমি বুঝতে পারি নাই মাহাদ। আগে জানলে…”
কথা শেষ করতে দিলো না মাহাদ। সশব্দে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলো।
—“আগে জানলেও তুমি এমনই করতা আব্বা। আম্মার জন্য তোমার কোনো কালেই দয়ামায়া ছিল না। আমার আম্মা তো কালা ছিল! তাই এমন করছিলা, তাই না?”
—“তুই ভুল ভাবতাছোস বাপ।”
মাহাদ কেমন অধৈর্য হয়ে উঠলো,
—“তুমি চলে যাও আব্বা। তোমার সাথে এরচেয়ে ভালো ব্যবহার আমি করতে পারবো না। যাও, প্লিজ!”
একরাশ য’ন্ত্র’ণা চেপে রশিদ সাহেব উঠে চলে গেলেন। হঠাৎ উপলব্ধি করলেন, বড় বেশিই অন্যায় করে ফেলেছেন তিনি। এর কি আসলেই ক্ষমা নেই?
–
দিনটা বৃহস্পতিবার। তরীর সাথে মাহাদেরও ঢাকায় যাওয়ার কথা আজকে। মূলত তরী আজকে যাবে বলেই লোকটা অফিস থেকে তিনটা দিন ছুটি বাড়িয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু কই? বাস তো ছেড়ে দেবে এখন। মাহাদের তো কোনো খোঁজখবরই পাওয়া যাচ্ছে না। বাসা থেকে আসার আগে কলও করেছিল অনেকবার। ধরেনি। ক্রমশই তরীর মন খারাপ হয়ে এলো। বারবার জানালা গলিয়ে বাহিরের দিকে তাকাচ্ছে সে। বাবা পাশে বিধায় কলও করতে পারছে না।
দেখতে দেখতে ড্রাইভার বাসে উঠে বসলো। বরকত সাহেব তরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বিদায় জানালেন। তরীর মন তখনো হাঁসফাঁস করছে। লোকটা গেল কই? বাস ছেড়ে দিতেই তরী বেদিশা হয়ে উঠলো। ফোন বের করে আরও একটার মাহাদকে কল করার আগেই কোত্থেকে যেন মাহাদ এসে উদয় হলো। তরীর পাশে ধপ করে বসে নিশ্বাস ফেললো দুবার। হাতের চিপস, কোমল পানীয়র পলিথিনটা এগিয়ে দিয়ে বললো, “নাও।”
তরী একবার তাকালো শুধু। নিলো না। চরম অভিমান নিয়ে শুধালো, “এতক্ষণ কোথায় ছিলেন আপনি?”
—“বাসেই।”
—“মিথ্যা বলছেন কেন?”
—“মিথ্যা বলছি না তরী। পেছনের দিকে ছিলাম।”
—“কেন? আপনার সীট কি পেছনে?”
—“নাহ্। এটাই আমার সীট।”
তরী রেগে গেল কারণ ছাড়াই, “তাহলে সামনে আসছিলেন না কেন? ইচ্ছে করে লুকিয়ে ছিলেন, তাই না? ইচ্ছে করে আমাকে জ্বা’লাচ্ছিলেন? এত খারাপ কেন আপনি? বেয়াদব লোক!”
সাথে সাথে বড় বড় চোখে তাকালো মাহাদ। তরী মুখ কঠিন করে অন্যদিকে চেয়ে আছে। প্রচন্ড অভিমানে মনে মনে কথা না বলার পণ নিয়েছে হয়তো। মাহাদ তাকিয়েই রইলো। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই হেসে ফেললো শরীর দুলিয়ে, সশব্দে। আদুরে কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “বেশি রাগ করেছো?”
তরীর উত্তর নেই। মাহাদের হাসিটা আরেকটু প্রশস্ত হলো। মন ভরে উঠলো, আচমকা এই অভিমানী তরীকে দেখে। শক্ত খোলস ডিঙ্গিয়ে তার তরী বুঝি এমনই? মেয়েটাকে টেনে এনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মাহাদ। তরী মানা করেনি। চুপচাপ আছে। মাহাদ লহু স্বরে কেমন প্রশান্তি নিয়ে বললো, “তুমি অভিমান করতে শিখে গেছো তরী। আমাকে বকতে শিখে গেছো।”
তরী তবুও কিছু বলছে না। মাহাদ তাকে প্রাণভরে কিছুক্ষণ বুকে জড়িয়ে রাখলো। তারপর হঠাৎ কিছু মনে পরতেই পকেট থেকে ফোন বের করলো সে। গ্যালারিতে ঢুকলো। একটা ভিডিও প্লে করে তরীর সামনে ধরে বললো, “দেখো।”
ভিডিওটার নিজস্ব কোনো শব্দ নেই। হলেও হয়তো সাউন্ড কমিয়ে রাখা। ঘোলা ঘোলা, আবছা ভাবে অর্ণবকে দেখা যাচ্ছে। গায়ে শার্ট নেই। প্যান্ট নেই। গ্রামের খোলা রাস্তায় ওভাবেই দৌঁড়াচ্ছে সে। তরী তৎক্ষণাৎ চোখ বুজে ফেললো। ক্ষীণ গলায় আ’র্তনাদ করে উঠলো, “এসব কি? কি দেখাচ্ছেন আমাকে?”
—“বিনোদন। বিনোদনটা কালকে সবাই দেখবে।”
—“ছিঃ!”
মাহাদের কপালে দৃঢ় ভাঁজ পরলো। গাঢ় গাম্ভীর্য নিয়ে বললো, “তোমার কি ওই ছেলের জন্য দয়া হচ্ছে তরী?”
—“নাহ্।”
—“তাহলে ছি; বললে কেন?”
—“বলেছি এমনি। আপনি চুপ থাকুন।”
—“না। আগে বলো, শুনি।”
—“আপনি চুপ থাকুন মাহাদ।”
মাহাদ চুপ থাকলো না। একপশলা বৃষ্টির মতো ঝরেই চললো। ঝরাপাতার মতো মিইয়ে যাচ্ছিল তরী। কোথাও একটা সুখ খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ-ই যেন সেটা পেয়ে গিয়েছিল। সেসময় মাহাদ কানের কাছে ফিসফিস করে বলছিল, “আমি ভেবেছিলাম, আমি কখনো তোমাকে জড়িয়ে ধরতে পারবো না। ভেবেছিলাম, তোমাকে ছুঁয়ে দেখা আমার আর হবে না। চুমু খেয়ে তোমার লজ্জারাঙা মুখ দেখা হবে না। ফুটপাতে হাতে হাত রেখে হাঁটা হবে না। তোমাকে ভীষণ জ্বা’লিয়ে অতি’ষ্ঠ করা হবে না। ভেবে ভেবে কষ্টে গুমড়ে গিয়েছিলাম অনেকবার। আমি এখন সেসবের উশুল নিচ্ছি মেয়ে। সারাজীবন নিবো। মাহাদ আয়মান কখনো উশুল নিতে পিছপা হয়না।”
_______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা