#বকুলের_বাস্তবতা
#পর্বঃ৩
#লেখিকাঃদিশা_মনি
বকুল ও আনহা দুজনেই চুপচাপ খেতে বসে পড়েছিল। সেই দিনের পর আরো এক মাস পেরিয়ে গেছে। বকুল আজকাল আরো অনেক বেশি চুপসে গেছে। আতিকা বেগম আজ হঠাৎ করে খেতে বসে তার স্বামী আফজাল শেখের উদ্দ্যেশ্যে বলে ওঠেন,
“একটা কথা বলছি কিছু আবার মনে করো না।”
“মনে করার মতো না হলেই হয়।”
“তোমার মেয়ে, মানে বকুলের তো বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। তো এই বিষয়টা নিয়ে কিছু ভেবে দেখেছ? ”
“কি ভেবে দেখব আর?”
“মেয়ের কি বিয়ে দেবে না? আজীবন এমন ঘরের কোণে ফেলে রাখবে!”
“ভালো ভাবে কথা বললেই তো হয়। আমার মেয়ের চিন্তা আমি করে নেবো। তোমায় ভাবতে হবে না।”
“এসব বললেই তো আর হলো না। আমি এসব কথা শুনতে চাই না। এত দিন নিজের সতীনের মেয়েকে অনেক পেলে ছি কিন্তু আর না। এবার ওকে বিদায় করার ব্যবস্থা করো।”
“আমার মেয়েকে তো এভাবে যার তার গলাত ঝুলিয়ে দিতে পারব না। ভালো একটা পাত্র খুঁজতে হবে।”
“ভালো পাত্র? তোমার ঐ জারজ মেয়ের জন্য আর কত ভালো পাত্র চাও।”
“আতিকা! মুখ সামলে কথা বলো।”
“মুখ সামলানোর তো কিছু নেই। যা সত্যি তাই বলছি। যাইহোক, তোমার মেয়েকে নিয়ে তুমি ভাবো৷ আমাকে আমার মেয়েকে নিয়ে ভাবতে। আমার মেয়ে তো বয়সের থেকে বেশি বেড়ে উঠছে। আর দিন দিন যা সুন্দরী হয়ে উঠছে তাতে ওকে নিয়ে আমার অনেক চিন্তা হয়। কখন না আবার কোন দূর্ঘটনা ঘটে যায়। আর তাই, আমি ঠিক করেছি আনহাকে আর বেশিদিন ঘরে রাখব না। আগামী বছর আসতে আসতে ওকে বিয়ে দিয়ে দেব।”
“মানে? আনহার তো মাত্র ১৫ বছর বয়স। আর মাত্র ক্লাস নাইনে পড়ে। এখনই ওর বিয়ে কেন দেবে?”
“তো মেয়েকে কি পড়ালেখা করে জর্জ ব্যারিস্টার বানাবো নাকি?”
আফজাল শেখ বলেন,
“প্রতিটা মেয়ের নিজের পায়ে দাঁড়ানো প্রয়োজন যাতে করে তারা আত্মনির্ভরশীল হতে পারে।”
“হ্যাঁ, যাতে আত্মনির্ভরশীল হয়ে অন্য মেয়ের ঘর ভাঙতে পারে যেমন এই বকুলের মা আমার ঘর ভাঙতে চেয়েছিল।”
আফজাল শেখ রেগে বলেন,
“বুশরার নামে আমি আর কোন খারাপ কথা শুনতে চাই না।”
“সত্য কথা সবারই তেতো লাগে।”
“আমাকে নিয়ে যা বলার বলো আমি কিছু ভাবব না। কারণ দোষটা আমারই ছিল। ”
“মানে?”
আতিকা বেগম হতবাক হয়ে যান।
আফজাল শেখ বলেন,
“এতদিন আমি এই কথা গুলো কাউকে বলি নি। কিন্তু তুমি যেভাবে সবসময় বুশরাকে দোষারোপ করো তাতে আমি আর সত্যটা লুকাতে চাই না। আজ সব সত্যটা তোমাদের আমি জানাবো। এতদিন শুধু এই ভয়ে সত্যটা সামনে আনি নি যে এই সত্য সামনে এলে আমাকে সবাই বিশেষ করে আমার মেয়েরা ঘৃণা করবে। কিন্তু আজ সত্যটা আমায় বলতেই হবে৷ নাহলে নিজেই নিজের চোখে ছোট হয়ে যাব।”
বকুল উদগ্রীব হয়ে বলে,
“হ্যাঁ, সত্যটা বলুন আপনি। আমি জানি,আমার মা কোন ভুল করতে পারে না। তার মতো এত ভালো মনের এক নারী অন্যের সংসার ধ্বংস করতে পারে না।”
আফজাল শেখ বলতে শুরু করেন,
“আমার সাথে আতিকার বিয়ের টানা পাঁচ বছরেও আতিকা বাচ্চার মা হতে পারে নি। এজন্য আমার মা-বোন সবাই কথা শোনাতো আতিকার বিরুদ্ধে। যার ফলে আমিও একসময় আতিকার প্রতি বিতৃষ্ণা হয়ে পড়ি৷ ওর সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করি। এজন্য আজ করোজোরে তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি আতিকা।”
আতিকা বেগম আবেগপ্রবণ হয়ে যান।
আফজাল শেখ বলতে থাকেন,
“কিন্তু আমার এই বিতৃষ্ণা আরো বেড়ে যায় যখন আমাদের অফিসে নতুন এক কর্মচারী বুশরাকে দেখি। বুশরা ছিল ফুলের মতো নিষ্পাপ একটা মেয়ে। আর তেমনই ছিল ওর সৌন্দর্য। বুশরাকে প্রথম দেখায় আমার মনে ওর জন্য অনুভূতি তৈরি হয়। আমি ওর ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করি। কিন্তু বুশরা জানত আমি বিবাহিত তাই আমার থেকে দূরে দূরে থাকত। আমাকে এড়িয়ে চলত সবসময়।”
“এরপর?”
“এরপর একদিন হঠাৎ করে আমি জানতে পারি বুশরার পরিবারে ওর অসুস্থ মা আছে। মা ছাড়া ওর আর কেউ নেই। ওর মায়ের চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার দরকার ছিল। বুশরা অনেক কষ্ট করেও সেই টাকা জোগাড় করতে পারে নি৷ এই সুযোগ টার সদ্ব্যবহার করি আমি। বুশরাকে টাকার অফার দেই। কিন্তু ও আমার ফিরিয়ে দেয়। নিজেই যথাসাধ্য করে কিন্তু টাকা জোগড় করতে পারে না। এক সময় বাস্তবতার কাছে হেরে আমার সাহায্য চায়। আমি এই সুযোগের ফায়দা তুলে বুশরা বলি আমি সব টাকা দিব কিন্তু তার বিনিময়ে বুশরাকেও আমায় কিছু দিতে হবে..আর সেটা হলো ওর শরীর।”
কথাটা শোনাতে উপস্থিত সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। আতিকা বেগম যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারেন না। স্বামীর প্রতি এমনিতেই তার ঘৃণা ছিল কিন্তু আজ যেন সেই ঘৃণা দ্বিগুণ হলো।
আফজাল শেখ বলতে লাগলেন,
“বুশরা তো শুরুতে রাজি হয় নি। আমায় অনেক চড় থাপ্পড়ও মেরেছিল। তারপর ওর মাকে মৃত্যুশয্যায় দেখে অবশেষে আর নিজেকে আটকে রাখতে না পেরে আমার শর্তে রাজি হয়েছে। আর আমি এই সুযোগ ব্যবহার করে টানা ৫/৬ দিন ওর সাথে..”
বকুল সহসা উঠে দাঁড়ায়। ঘৃণার সাথে তাকিয়ে বলে,
“ছি! আপনি এত নীচ!”
“এই ঘটনার পর বুশরা জানতে পারে ও প্রেগন্যান্ট। আর এই অবস্থাতে ও চাইছিল বাচ্চাটা নষ্ট করতে। কিন্তু আমি যে বাচ্চার জন্য উদগ্রীব ছিলাম সে এটা হতে দেই নি। নিজের বাচ্চা পাওয়ার লোভে বুশরাকে জোর করি এই বাচ্চাটা রাখতে। ওকে বিয়ে করারও প্রতিশ্রুতি দেই৷ কিন্তু বুশরা তো বুশরাই। ও কারো সংসার ভাঙতে চাইত না। আর তাই বকুলের জন্মের পরই ওকে নিয়ে দূরে চলে যায়। আমি ওকে অনেক খুঁজেও পাই নি। তারপর এদিকে আতিকাও প্রেগন্যান্ট হলো, আনহা দুনিয়ায় এলো। আমি বুশরাকে ভুলে গেলাম। এরপর ঠিক ৭ বছর পর বুশরা আমার সামনে এসে দাড়ালো নিজের ক্যান্সারের কথা জানালো আমায়। আর শুধু একটাই অনুরোধ করে বলল, ওর মৃত্যুর পর ওর বাচ্চার দায়িত্ব নেয়ার কেউ নেই তাই আমি যেন বকুলের দায়িত্ব নেই। নিজের অপরাধবোধ আর দায়িত্ব আমি এড়াতে পারি নি। তাই বকুলের দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নেই। এর কিছুদিন পরই বুশরা মারা যায়।”
সমস্ত ঘটনা শুনে বকুল কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“শুধুমাত্র আপনার জন্য আমার মাকে জীবনে এতো সাফার করতে হয়েছে। আমি ঘৃণা করি আপনাকে। মরে গেলেও আমি আপনাকে ক্ষমা করবো না।”
বলেই বকুল কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নেয়। আনহাও বলে,
“আমার তো এটা ভাবতেও ঘৃণা লাগছে আমি তোমার মতো এত ঘৃণ্য একজন ব্যক্তির মেয়ে। তোমার জন্য বুশরা আন্টি এত কষ্ট পেয়েছে, বকুল আপুকেও ছোট থেকে এত কষ্ট পেতে হয়েছে। আই জাস্ট হেট ইউ আব্বু।”
বলে আনহাও চলে যায়। এদিকে আতিকা বেগম বলেন,
“এতদিন আমি ভাবতাম আমার থেকে দুঃখী এই পৃথিবীতে কেউ নেই। আর বুশরা আমার সব সুখ কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু আজ সব সত্যটা জেনে আমার নিজের থেকে বেশি বুশরার জন্য খারাপ লাগছে৷ ঐ মেয়েটা তো পরিস্থিতির স্বীকার অথচ আমি ওর উপর রাগ থেকে ঐ বেচারি বকুলের উপর কতই না অত্যাচার করেছি। আজ সবথেকে বেশি রাগ আমার নিজের উপর হচ্ছে যে কেন বকুলের উপর আমি এত অন্যায় করলাম। আমার তো উচিৎ ছিল বটি দিয়ে আপনার গলা কে/টে দেয়া। তাহলে একটা ভালো কাজ করতাম।”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨