#বকুলের_বাস্তবতা
#পর্বঃ৪(শেষ)
#লেখিকাঃদিশা_মনি
বকুল তার সৎমা আতিকা বেগম ও সৎ বোন আনহার হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। অতঃপর এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ালো৷ সব সত্য জানার পর তাদের কারোরই আর ঐ বাড়িতে থাকার উচিৎ হয় নি। এজন্য সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে এসেছে। আফজাল শেখ অনেক চেষ্টা করেও তাদের আর আটকাতে পারে নি। তবে বাইরে চলে আসতে পারলেও সমস্যার সমধান এখনো হয়ে ওঠে নি। কারণ এখন কোথাও যাবে,কোথায় থাকবে সেটা জানে না।
আতিকা বেগম অনেক ভেবে বলেন,
“চল, আমরা সবাই গিয়ে আমার বাবার বাড়িতে উঠি।”
সহসা বকুল বলে ওঠে,
“নাহ, ওখানে আমি যাব না..”
“কেন?”
বকুল মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। কথা তার গলায় আটকে যায়। আনহা বুঝতে পারে নিশ্চয়ই কোন বড় সমস্যা। তাই সে আতিকা বেগমকে চোখ দিয়ে ইশারা করে আশ্বস্ত করে এবং বকুলকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বলে,
“আপু,আমায় সবটা বলো। আমি অনেক দিন থেকেই তোমার মধ্যে একটা চাপা কষ্ট লক্ষ্য করছি। সত্যি করে বলো তো, তুমি ঠিক কি কারণে যেতে চাইছ না!”
বকুল অশ্রুসিক্ত চোখে বলে,
“আসলে,,তোমার মনে আছে একদিন আমার স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হয়েছিল সেদিন তোমার মামাত ভাই আশরাফ আমায় অন্য একটা গ্রামে নিয়ে গেছিল। আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হবার…তবে সৌভাগ্যবশত সেই সময় দুজন মহিলা চলে আসায় ও আমায় ওভাবেই রেখে পালায়৷ এরপর আমিও ওনাদের সাহায্যে গ্রামে ফেরত আসি। ওনাদের অনেক অনুরোধ করে সত্যটা লুকিয়ে রাখতে বাধ্য করি। আর না নিজের কাউকে সত্যটা বলি।”
বকুলের কথাগুলো শুনে আনহার চোখ দুটো জলে ভরে যায়। সে বকুলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আপু, তুমি এত কষ্ট সহ্য করেছ, আর আমাদের কাউকে কিছু বলোনি? আমি তোমার বোন, তুমি আমায় এত বড় কথা লুকিয়ে রেখেছিলে? তুমি এত ভয় পেলে কীভাবে হবে? আমি তো বলেছিলাম, আমি তোমার পাশে আছি, সবসময় থাকব।”
বকুল কান্না চেপে বলে,
“আমি তোমাকে ঝামেলায় ফেলতে চাইনি, আনহা। তুমি তো জানো, আমার জন্যই এ বাড়িতে কত কিছু ঘটেছে। আমি আর কারো জীবনে ঝড় তুলতে চাই না।”
আনহা বকুলের কথায় তীব্র প্রতিবাদ করে বলে,
“আপু, তুমি কেন নিজেকে দোষ দাও? দোষ তো ওই নোংরা লোকটার, যে তোমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করার সাহস করেছে। আমি আশরাফকে ছাড়ব না। এবার ওকে এমন শিক্ষা দেব যে ও আর কখনো কোনো মেয়ের দিকে তাকাতে সাহস পাবে না।”
বকুল তাড়াতাড়ি আনহার হাত ধরে বলে,
“না, আনহা, তুমি কিছু করিও না। এমনিতেই অনেক ঝামেলা হয়েছে। আমি আর কোনো ঝঞ্ঝাট চাই না। আমি শুধু চাই, আমরা একটু শান্তিতে থাকি।”
আতিকা বেগম কিছুক্ষণ দূর থেকে দুই বোনের কথা শুনছিলেন। তিনি এগিয়ে এসে বলেন,
“বকুল, তুই আমায় সব বল। আমি এতদিন তোর সঙ্গে অনেক অন্যায় করেছি, কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি তুই কতটা কষ্ট পেয়েছিস। আমার ভাইপো যদি তোর সঙ্গে এমন কিছু করার চেষ্টা করে থাকে, আমি নিজে ওর শাস্তি নিশ্চিত করব।”
বকুল প্রথমে কিছু বলতে চায় না, কিন্তু আনহার উৎসাহে এবং আতিকা বেগমের অনুরোধে অবশেষে সব খুলে বলে। তার কথা শুনে আতিকা বেগমের মুখ ক্রোধে লাল হয়ে যায়। তিনি বলেন,
“আমি এতদিন আমার ভাইপোর উপর অন্ধ ভরসা করেছি, আর সে এই সুযোগ নিয়ে এমন কুকর্ম করেছে? আমি আজই আমার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলব। যাকে এবার নিজের ছেলেকে উচিৎ শিক্ষা দেয়।”
আনহা বলে,
“আম্মু, শুধু বের করে দিলে হবে না। ওকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। এমন লোক সমাজে থাকলে আরো মেয়েরা বিপদে পড়বে।”
আতিকা বেগম মাথা নেড়ে বলেন,
“তুই ঠিক বলেছিস, আনহা। আমি নিজে থানায় যাব। বকুল, তুই আমার সঙ্গে চল। আমরা একসঙ্গে ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ করব।”
বকুল ভয় পেয়ে বলে,
“না, আম্মু, আমি পারব না। লোকে কী বলবে? আমারই নামে দোষ চাপবে। আমি আর এসব পারব না।”
আতিকা বেগম বকুলের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
“তুই ভয় পাস না, মা। আমি তোর পাশে আছি। তুই যা সত্যি, তাই বলবি। কেউ তোর নামে দোষ দিলে আমি তাদের মুখ বন্ধ করব। তুই আমার মেয়ে, আর আমি তোর জন্য সব করব।”
এই প্রথম বকুল আতিকা বেগমের মুখে ‘মা’ সম্বোধন শুনে কেঁপে ওঠে। তার চোখে জল চলে আসে। সে আতিকা বেগমকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। আনহাও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তিনজনে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ নীরবে কাঁদে। এই কান্না যেন তাদের মধ্যে সব ভুল বোঝাবুঝি ধুয়ে দেয়।
।পরদিন সকালে আতিকা বেগম, বকুল ও আনহা একসঙ্গে থানায় যায়। তারা আশরাফের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে। পুলিশ তদন্ত শুরু করে, এবং আশরাফকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ঘটনা পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে বকুলের সাহসের প্রশংসা করে, আবার কেউ কেউ তার নামে কটু কথা বলে। কিন্তু বকুল এবার আর ভয় পায় না। আনহা ও আতিকা বেগমের সমর্থন তাকে নতুন শক্তি দিয়েছে। এই ঘটনার পর আতিকা বেগম সিদ্ধান্ত নেন, তিনি বকুল ও আনহাকে নিয়ে শহরে চলে যাবেন। তিনি বলেন,
“এই গ্রামে আমাদের আর কিছু রাখার নেই। আমরা নতুন করে শুরু করব। বকুল, তুই পড়াশোনা চালিয়ে যাবি। আর আনহা, তুইও। আমি চাই, তোরা দুজনেই নিজেদের পায়ে দাঁড়াস।”
কিছুদিন পর,
শহরে এসে তারা একটি ছোট্ট ভাড়া বাসায় ওঠে। আতিকা বেগম একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করেন। বকুলও সিদ্ধান্ত নেয়, সে পড়াশোনার পাশাপাশি গার্মেন্টসে কাজ করবে। আনহা তখনও স্কুলে পড়ে, তাই সে পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়। বকুল দিনের বেলায় গার্মেন্টসে কাজ করে, আর রাতে পড়াশোনা করে। তার লক্ষ্য একদিন নিজের পায়ে দাঁড়ানো, এমন একজন মানুষ হওয়া, যে কখনো কারো উপর নির্ভর করবে না। গার্মেন্টসে কাজ করতে গিয়ে সেখানে তার সঙ্গে পরিচয় হয় ফাতেমার সঙ্গে। ফাতেমা একজন সুপারভাইজার, যিনি নিজেও একসময় কঠিন জীবন পার করেছেন। তিনি বকুলের পরিশ্রম ও একাগ্রতা দেখে মুগ্ধ হন। একদিন ফাতেমা বকুলকে ডেকে বলেন,
“তুমি শুধু কাজ করে যাও না, বকুল। তুমি যদি চাও, আমি তোমাকে আরো বড় দায়িত্বের জন্য প্রস্তুত করতে পারি। তুমি পড়াশোনা চালিয়ে যাও, আমি তোমাকে সাহায্য করব।”
ফাতেমার কথায় বকুলের মনে নতুন আশার আলো জ্বলে ওঠে। সে আরো কঠোর পরিশ্রম শুরু করে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, সে কাজ আর পড়াশোনার মধ্যে ভারসাম্য রাখে। ফাতেমা তাকে গার্মেন্টসের ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়। বকুলের মধ্যে এক অদম্য ইচ্ছাশক্তি কাজ করে। সে বুঝতে পারে, তার জীবনের প্রতিটি কষ্ট তাকে আরো শক্তিশালী করেছে। এদিকে আনহাও পড়াশোনায় ভালো ফলাফল করতে থাকে। সে বকুলের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পায়। একদিন আনহা বকুলকে বলে,
“আপু, তুমি যেভাবে সবকিছু সামলে নিচ্ছ, আমি তোমার মতো হতে চাই। আমি পড়াশোনা করে একদিন ডাক্তার হব।”
বকুল হেসে বলে,
“তুমি যা চাও, তাই হবে, আনহা। আমি জানি, তুমি পারবে।”
কয়েক বছর পর,
বকুল গার্মেন্টসে সুপারভাইজার পদে উন্নীত হয়। তার পরিশ্রম ও নিষ্ঠা তাকে এই অবস্থানে নিয়ে আসে। সে তার পড়াশোনাও শেষ করে এবং একটি ডিগ্রি অর্জন করে। আনহা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়। আতিকা বেগম তার দুই মেয়ের সাফল্য দেখে গর্বিত বোধ করেন। তিনি বকুলকে বলেন,
“তুই আমার জীবনে আলো এনেছিস, বকুল। আমি তোর কাছে ক্ষমা চাই, যে তোর সঙ্গে আমি এত অন্যায় করেছি। তুই আমাকে ক্ষমা করেছিস, তাই আমার জীবনটা এত সুন্দর হয়েছে।”
বকুল হেসে বলে,
“আম্মু, তুমি আর আমি একে অপরকে ক্ষমা করেছি। এখন আমরা একসঙ্গে এগিয়ে যাব। আমার মা যে স্বপ্ন দেখতেন, আমি সেই স্বপ্ন পূরণ করব। আমি নিজের পায়ে দাঁড়াব, আর অন্য মেয়েদেরও নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করব।”
বকুল তার কথা রাখে। সে গার্মেন্টসে কাজ করা অন্য মেয়েদের জন্য একটি ছোট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলে, যেখানে তাদের কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা ও দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ দেওয়া হয়। তার এই উদ্যোগ অনেক নারীর জীবনে পরিবর্তন আনে। বকুলের জীবন, যা একসময় অন্ধকারে ডুবে ছিল, এখন আলোর পথে এগিয়ে চলেছে। তার কষ্টের দিনগুলো তাকে শক্তিশালী করেছে, আর সেই শক্তি দিয়ে সে অন্যদের জীবনেও আলো ছড়াচ্ছে। বাস্তবতা তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে আর তার এই বাস্তবতার আলো ছড়িয়ে পড়ুক চারিদিকে ❤️
সমাপ্ত ✨