বকুলের বাস্তবতা পর্ব-০৯

0
249

#বকুলের_বাস্তবতা
#পর্ব_৯
#লেখক_দিগন্ত
আমার কথা শুনে সবাই প্রচণ্ড পরিমাণে অবাক হয়ে গেল।চাদনী ফুফু যে এরকম একটা কাজ করতে পারে সেটা বিশ্বাস করতে সবারই কষ্ট হচ্ছিল।দাদি বলল,
-“কি কও তুমি? আমার বেটি কেন এই কামডা করবে? নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হয়েছে?”

চাচাও বললেন,
-“হ্যাঁ বকুল আমি চাদনীকে চিনি।ও এমন কাজ করার মেয়ে নয়।”

চাচার কথাটা শুনে ময়না ম্যাডাম মলীন হাসলেন।হয়তো মনে মনে ভাবছেন, এখনো মেয়েটার প্রতি এত দরদ।আমি বুঝলাম এখনই সময় চাদনী ফুফুর আসল রূপ সবার সামনে আনার।কিন্তু তার আগেই চাদনী ফুফু নাটক করতে শুরু করলেন,
-“আমি কি ক্ষতি করেছি তোমার বকুল? কেন আমার নামে এতবড় মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছ? আমি তোমাকে ধা*ক্কা দেইনি।তোমরা বিশ্বাস করো আমায়।”

চাদনী ফুফুর কথা শুনে হাসি পেল খুব।আমি বলতে শুরু করলাম,
-“আমার জন্য আপনার অপকর্ম ধরা পড়ে যেত সেই কারণেই তো তুমি এমন করেছ।”

আবীর এতক্ষণে মুখ খুলল,
-“বকুল আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।তুমি বলো আসল ঘটনা কি।”

-“আচ্ছা তাহলে শোন।আজ দুপুরে যখন আমি ফুফুর সাথে রান্নাঘরে ছিলাম তখন তার কাছ থেকে শুনি আব্দুল চাচাকে তিনি ভালোবাসতেন কিন্তু কোন একটা শহরের মেয়ের জন্য সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়।আমি সবকিছু জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু তার আগেই দাদি চলে আসে।এর আগে ময়না ম্যাডাম আর চাচার যখন দেখা হয়েছিল তখনই আমি বুঝেছিলাম ওনারা পূর্ব পরিচিত।আমার কেন জানি সন্দেহ হয় যে ফুফু যেই শহরের মেয়ের কথা বলছিল সে হলো ময়না ম্যাডাম।সে যাইহোক এরপর আবার যখন ফুফুর সাথে এসব নিয়ে কথা বলি তখন জানতে পারি আব্দুল চাচা আর ময়না ম্যাডামের বিয়েও নাকি ঠিক হয়েছিল।কিন্তু বিয়ের দিন ময়না ম্যাডাম বিয়ে বাতিল করে দেন মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে যে আব্দুল চাচা তার সাথে প্রতারণা করছে।আব্দুল চাচার সাথে নাকি চাদনী ফুফুর সম্পর্ক আছে।এর কারণে নাকি পরে চাদনী ফুফুকেও অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।তার গায়ে কলংক লাগায় তার আর বিয়েও হয়নি।”

এসব কথা শুনে আব্দুল চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন,
-“হুম এসব তো ঠিকই জানো তুমি।কিন্তু চাদনী তোমায় পুকুরে ধা*ক্কা দেবে কেন? এর জন্য তো কোন লজিক খুঁজে পাচ্ছি না আমি।”

-“কারণ আমি ওনার সত্যটা জেনে গিয়েছিলাম।তখন চাদনী ফুফুর কথা শুনে আমার মনে হয় তার কথায় জড়তা আছে।তার কান্নাটাও অনেকটা অভিনয় মনে হয়।মোটকথা আমি বুঝে যাই তিনি কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছেন।তাছাড়া আমি ময়না ম্যাডামকেও চিনি।উনি যথেষ্ট স্পষ্টবাদী মানুষ।তাই উনি নিশ্চয়ই অকারণে কাউকে দোষারোপ করবেন না।তাই আমি এরপর ময়না ম্যাডামকে ফোন করি।তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে একসময় অতীতের ব্যাপারে জানতে চাই।তিনি যদিও প্রথমে বলতে চাইছিলেন না কিন্তু পরে আমার জোরাজুরিতে বলে দেন।আপনাদের বিয়ের দিন চাদনী ফুফু আর আপনাকে একসাথে বিছানায় দেখেছেন উনি।এই নিয়েই উনি সন্দেহ করেন।”

আব্দুল চাচা তখন বলে ওঠেন,
-“সেদিন ওটা একটা দূর্ঘটনা ছিল।চাদনী দৌড়ে আমার ঘরে এসে টাল সামলাতে না পেরে আমার সাথে ধা*ক্কা খায়।যার কারণে আমরা দুজনেই বিছানায় পড়ে যাই।”

-“না চাচা সেদিন কোন দূর্ঘটনা ছিলনা।চাদনী ফুফু ইচ্ছে করে করেছিলেন ময়না ম্যাডামকে দেখানোর জন্য।কারণ উনি আপনাকে ভালোবাসতেন।”

-“তুমি এটা কিভাবে জানলে?”

-“এটা আমি প্রথমে অনুমান করেছিলাম।আমার সাথে ময়না ম্যাডামকে কথা বলতে শুনে নেন চাদনী ফুফু।তখন তার মনে ভয় জাগে যে আমি সবকিছু জানতে পারি।তাছাড়া আমার উপর তার রাগও হয়েছিল বোধহয়।তাই যখন আমি পুকুরের পাশে গিয়ে দাঁড়াই তখন উনি আমায় ধা*ক্কা দেন।উনি হয়তো ভেবেছিলেন আমি ওনাকে দেখতে পাইনি কিন্তু ওনার হাতের এই চুড়িটা আমার নজরে এসেছিল।আমি তখনই বুঝতে পারি যে আমার ধারণাই ঠিক।সবকিছু চাদনী ফুফুর প্ল্যান।”

আমার কথাগুলো শুনে এখানকার পরিস্থিতি মুহুর্তেই থমথমে হয়ে যায়।সবাই চাদনী ফুফুর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকায়।

দাদি তার গালে জোরে থা*প্পর মে*রে বলে,
-“তুই যে এত নিচ কাজ করবি এইডা আমি ভাবতেও পারি নাই।আমার তো সেদিনই সন্দেহ করা উচিৎ ছিল যেদিন শুনলাম তুই নিজেই নিজের বান্ধবীদের দিয়া পাত্রপক্ষকে নিজের সম্পর্কে সব কথা বলে দিতি যাতে তোর বিয়া না হয়।কেন করলি তুই এমন?”

চাদনী ফুফু কেঁদে ফেলে।কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-“কি করবো বলো আম্মু? আমি তো এই জীবনে শুধু একজনকেই ভালোবেসেছি, আব্দুল ভাইকে।তাকে পাওয়ার জন্য তো এতকিছু করেছি।নিজের চরিত্রে দাগ লাগাতেও দুবার ভাবিনি।এতকিছু করেও তো তাকে পেলাম না।সারাজীবন আমাকে বোনের চোখেই দেখলেন উনি।তবুও আমি অপেক্ষায় ছিলাম একদিন উনি আমায় আপন করে নেবেন।তাই আমি সব পাত্রপক্ষকে আমার বান্ধবীদের দ্বারা নিজের সম্পর্কে খা*রাপ কথা বলিয়ে নিতাম।বকুল যা বলেছে সব সত্য।বকুলের উপর আমার খুব রাগ হয়েছিল আমার যখন ও এসব বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিল।তাই নিজের রাগ মেটাতে আমি ওকে ধা-ক্কা দেই।আমি প্রথমে জানতাম না ও সাঁতার কা*টতে পারে না।যখন বুঝতে পারি তখন আমার অনেক অনুশোচনা হয়।তাইতো আবীরকে বলি যে, পুকুর থেকে কারো চিৎকারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।তাইনা আবীর আমি বলিনি?”

আবীর রাগী দৃষ্টিতে চাদনী ফুফুর দিকে তাকায়।চাদনী ফুফু তার গুরুজন না হলে আজ বুঝি তার গায়ে হাতই তুলে দিত।আবীর ফুফুকে কড়া ভাষায় বলল,
-“তুমি যেসব অন্যায় করেছ তার কোন ক্ষমা হয়না।তুমি চাচা আর আন্টিকে আলাদা করেছ।আজ যদি একটু দেরি হতো তাহলে তো বকুল মারাও যেতে পার‍ত।না আমি এটা মানব না আমি আজই পুলিশ কেইস করব তোমার বিরুদ্ধে।”

চাদনী ফুফু কাদতে লাগলেন।আব্দুল চাচার পায়ে পড়লেন,আমার কাছেও ক্ষমা চাইলেন।দাদি যদিওবা মুখে বলছিল যে ফুফুকে শাস্তি দেওয়া হোক কিন্তু তিনিও যে কষ্ট পাচ্ছেন ফুফুর জন্য সেটা বোঝা যাচ্ছে।

এসব দেখে আব্দুল চাচা বললেন,
-“যা হওয়ার হয়ে গেছে এখন আর এসব বলে লাভ নেই।চাদনীকে আমরা কেউই কখনো ক্ষমা করবোনা।কিন্তু আমার মনে হয়না ওকে পুলিশে দেওয়া উচিৎ।এতে আমাদের পরিবার নিয়েই সবাই খারাপ কথা বলবে।”

চাচার কথায় যুক্তি আছে।আমিও তাতে সায় দিলাম।তিনি বললেন,
-“কিন্তু তার মানে এই নয় যে চাদনীকে কোন শাস্তি পেতে হবে না।আমি চাদনীর জন্য উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করছি।আর সেই শাস্তিটা হচ্ছে বিয়ে।আমি খুব শীঘ্রই চাদনীর বিয়ের ব্যবস্থা করছি।আর আমি নিজেও এবার ময়নাকে বিয়ে করবো।”

চাচার কথা শুনে ময়না ম্যাডামের চোখে জল চলে এলো।তিনি এগিয়ে এসে ক্ষমা চেয়ে বলল,
-“আমাকে ক্ষমা করে দিও আব্দুল।আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম।তোমাকে খুব ভালোবাসতাম তো তাই সেদিন তোমাকে ঐভাবে অন্য কারো সাথে দেখে সেটা মেনে নিতে পারিনি।তাইতো আমি সবকিছু ছেড়ে বিদেশে চলে গিয়েছিলাম নিজের কষ্ট ভুলতে।কিন্তু কখনো তোমার যায়গা কাউকে দিতে পারিনি।এখনো আমি তোমাকে ঠিক আগের মতোই ভালোবাসি।তাইতো এত বছর বিদেশে ডাক্তারি করার পর আবার দেশে ফিরে এসেছি।”

-“হয়েছে হয়েছে আর নাটক করতে হবে না।তুমি আমায় এই ১০ বছর এত কষ্ট দিয়ে এখন ক্ষমা চাইছ।এত সহজে তোমায় ক্ষমা করব না।আমাকে ছেড়ে যাওয়ার, কষ্ট দেওয়ার ফল তোমাকেও পেতে হবে।”

ওনাদের এসব দুষ্টুমিষ্টি কাণ্ডকারখানা দেখতে ভালোই লাগছিল।আমি একবার আবীরের দিকে তাকালাম।আবীর আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।একে অপরের চোখের মধ্যেই হারিয়ে যাই দুজনে।
(চলবে)