#বছর_দুয়েক_পর
#সূচনা_পর্ব
#সারিকা_হোসাইন
নিজের মৃ/ত হবু স্বামী ভিভিয়ান নাওয়াফ কে চোখের সামনে দেখে ধপ করে শপিং মলের মেঝেতে বসে পড়লো তাথৈ।নিজের চোখ দুটোকে যেনো আজ বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে।মন মস্তিষ্ক আন্দোলন করে চিৎকার করে বারবার বলে উঠছে
“না না এ কিছুতেই হতে পারে না।আমার দৃষ্টি যা দেখছে সবটাই ভ্রম নয়তো ভিভিয়ান এর মত দেখতে অন্য কেউ।শুনেছি একই চেহারার সাত জন মানুষ এই গোল গাল পৃথিবীতে বসবাস করে।এ কিছুতেই ভিভিয়ান হতে পারে না ।”
তাথৈ এর অশান্ত মন আজ কিছুতেই যেনো কোনো বুঝ মানছে না।না চাইতেও টুপ টুপ করে উষ্ণ নোনতা জলের ফোয়ারা ছুটলো তাথৈ এর বড় বড় গভীর দুই নেত্র থেকে।যেই গভীর র/ক্তা/ক্ত ক্ষ/ত ধীরে ধীরে সেরে উঠছিলো সময়ের সাথে সাথে তা যেনো পুনরায় তরতাজা ভয়ানক হলো।কিছুক্ষণ আগের ফুরফুরে শ্বাস টা বুকের কাছে শক্ত করে আটকে গেলো।কথা বলার বোধ শক্তি হারিয়ে শরীর অসাড় হয়ে গেলো।অসহনীয় তোলপাড়ে বুকের ছাতি পর্যন্ত কালো ব্যাথায় মুষড়ে উঠলো।
“যেই মানুষটা বছর দুই আগেই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে ওপারে পাড়ি জমিয়েছে সে কি করে ফিরে আসতে পারে?আমি তো নিজ চোখে….
মস্তিষ্কের প্রতিটা নিউরনে নিউরনে জাগ্রত হলো মানুষটির সাথে কাটানো কতগুলো সুখময় দিন।সেই আনন্দঘন মুহূর্ত আর ভিয়ানের মমতা ভরা স্পর্শ গুলো চিন্তা করে দিকবিদিক ভুলে চিৎকার করে ডেকে উঠলো তাথৈ
“ভি ভি ভিয়ান”
তাথৈ এর চিৎকার পুরো শপিংমলের বদ্ধ দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুললো।যাদের কর্ণকুহরে এই চিৎকার বাড়ি খেলো প্রত্যেকেই থমকে দাঁড়ালো।শুধু দাঁড়ালো না ভিয়ান সম্বোধন করা যুবকটি।নিজের সহযোগী দুজন ব্যাক্তির সাথে হাসতে হাসতে নিজেদের ব্যাক্তিগত কথা সাড়তে সাড়তে লিফট বেয়ে উঠে গেলো টপ ফ্লোরে।নিজেদের ব্যাক্তিগত বিষয় ছাড়া জগতিক কোনো বিষয়েই যেনো তাদের খেয়াল নেই।
অথচ এদিকে গ্রাউন্ড ফ্লোরের মেঝেতে হাটু গেড়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো তাথৈ।
তাথৈ এর দুইজন ক্লোজ ফ্রেন্ডস মৌটুসী আর অর্ক তাথৈ এর সাথেই ছিলো।হঠাৎ তাথৈ পায়ের গতি রোধ করেছে এটা তারা বুঝতেই পারে নি।তারা নিজেদের মতো সামনে এগিয়ে গিয়েছিলো।হঠাৎ চিৎকারে পেছন ফিরে বিধ্বস্ত তাথৈ কে দেখে দৌড়ে এসে মেঝেতে বসে ডেকে উঠে দুজনে
“এই তাথৈ কি হয়েছে তোর?ক ক কোথায় ভিয়ান?
কান্না অবনত তাথৈ মাথা নিচু রেখেই আঙ্গুলি নির্দেশ করে স্কেলেটর এর দিকে।সেই আঙ্গুলি অনুসরণ করে সামনে তাকায় মৌটুসী আর অর্ক।কিন্তু সামনে ভিয়ান কেনো ভিয়ানের মতো দেখতে পর্যন্ত কেউ নেই।আশেপাশের মানুষ গুলো অবাক চোখে ভ্রু কুঁচকে তাথৈ এর দিকে তাকিয়ে আছে।কেউ কেউ আবার ঠোঁট টিপে টিপে হাসছে।কেউ কেউ আবার তামাশা মনে করে পা চালানো শুরু করে দিয়েছে।অর্ক চারপাশে নজর বুলিয়ে তাথৈ কে জোর করে টেনে তুলে শপিং মলের বাইরে বেরিয়ে এলো।নিজের পা দুটো আজ তাথৈ এর সাথ দিলো না।মৌটুসী আর অর্ক শীর্ন দেহের ছোট তাথৈ কে এক প্রকার হাওয়ায় ভাসিয়েই বাইরে নিয়ে এলো।এরপর পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে দ্রুত পানির বোতল নিয়ে তাথৈ এর দিকে ক্যাপ খুলে এগিয়ে দিলো অর্ক।
মেয়েটি পানি গেলার অবস্থাতেও নেই।চোখ দুটো যেনো শ্রাবনের ধারা।ঝলমলে কাঁধ পর্যন্ত কাটা চুল গুলো পুরো মুখে লেপ্টে আছে।ফর্সা ধবধবে মুখটা মুহূর্তেই কঠিন মলিনতায় ছেয়ে গিয়েছে।চোখ দুটো ফুলে টসটসে হয়ে উঠেছে।নাকের সরু ডগা আর গাল রক্তিম আভায় ছেয়ে আছে।
নিজের ব্যাগ থেকে একটা ইলাস্টিক বের করে তাথৈ এর চুলগুলো আটকে দিলো মৌটুসী।ভ্যাপসা গরমে শরীর প্যাচপ্যাচে হয়ে রয়েছে।মৌটুসী তাথৈ এর সামনে পানির বোতল ধরে অল্প পানি খাওয়াতে সক্ষম হলো।পরিস্থিতি কিছুটা ধীর হলেই আদুরে স্বরে মৌটুসী শুধালো
“কোথায় ভিয়ান ভাইয়া?
মৌটুসীর প্রশ্নে ছোট দুই হাতের উল্টোপিঠে চোখের জল মুছলো তাথৈ।এরপর ফাকা শুকনো ঢোক গিলে সিক্ত দুর্বল ক্লান্ত কন্ঠে উত্তর দিলো
“ওটা ভিয়ান নয়।ভিয়ান হলে আমাকে এভাবে ফেলে চলে যেতে পারতো না।ভিয়ান তো আমাকে নিঃস্ব করে ওই দূর আকাশে চলে গিয়েছে।আমি ভুল দেখেছি।”
অর্ক চোখের ইশারায় মৌটুসী কে আর কথা না বাড়াতে অনুরোধ জানালো।চতুর মৌটুসী পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে বলে উঠলো
“আজ অনেক গরম চল বাড়ি ফেরা যাক।এখানে কেমন দম বন্ধ লাগছে”
মৌটুসীর সাড়া পেতেই অর্ক বলে উঠলো
“তোরা বস আমি গাড়ি নিয়ে আসছি”
***********
তপ্ত কাক ডাকা দুপুর পেরিয়ে পড়ন্ত বিকেলের হাতছানি।সূর্যের প্রখর তেজ কমে গিয়ে কিছুটা নমনীয় হয়ে এসেছে।থেকে থেকেই দুই একটা কাক অদূরে কা কা করে চলছে।ঢাকা শহরের নিত্যদিনের চিত্র এসব।গাছপালা বিহীন শহরে সুমধুর পাখির ডাক চাইলেই পাওয়া যাবে নাকি?এখানে দাঁড় কাক ই শেষ ভরসা।
বিকেলের চা নাস্তার আয়োজন করছেন মেহেরিন চৌধুরী।বাসার হেল্পিং হ্যান্ড চারু সব কিছু কাটাকাটি করে গুছিয়ে দিচ্ছে।মেহেরিন চৌধুরী চুলায় কড়াই বসিয়ে তেল ঢালছেন এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো।কলিং বেলের শব্দে মেহেরিন কিছুটা থেমে চারুকে বলে উঠলেন
“দেখতো চারু এই অসময়ে কে এলো?
চারু উঠতে নিলে মেহেরিন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন
‘তুই বস।আমিই যাচ্ছি।
গায়ের শাড়ি ঠিক করে দ্রুত পদে দরজার দিকে এগুতেই পুনরায় বেল বেজে উঠলো।
“যাই যাই।একদম কারোর সহ্য হয়না”
কিছুটা বিরক্তি ফুটিয়ে দরজা খুলতেই মেয়ের বিধ্বস্ত মুখশ্রী দেখে কেঁপে উঠলেন মেহেরিন চৌধুরী।
তাথৈ আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে এলোমেলো পায়ে জীর্ণ মানুষের ন্যায় হেলেদুলে সিঁড়ি বেয়ে নিজের কক্ষের দিকে হাঁটা দিলো।
মেয়ের যাবার পানে তাকিয়ে চিন্তিত মুখে অর্ক কে মিসেস মেহেরিন শুধালেন
“ওর কি হয়েছে বাবা?তোমরা না কিছুক্ষণ আগেই বাইরে গেলে?এতো দ্রুত ফিরে এলে যে?
অর্ক চারপাশে নজর বুলিয়ে ব্যাথিত কন্ঠে বলে উঠলো
“হঠাৎই শপিং মলে ভিয়ানের নাম ধরে চিৎকার করছিলো আন্টি।বহু কষ্টে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে এসেছি।একটু খেয়াল রাখবেন।আমি যাই তাহলে”
অর্ককে বিদায় জানানোর ভাষা হারালেন মেহেরিন চৌধুরী।চোখের সামনে মেয়েটা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে অথচ মা হয়ে প্রতিনিয়ত এই দৃশ্য হজম করে যেতে হচ্ছে।
তপ্ত শ্বাস ফেলে তাথৈ এর কক্ষের পানে এগুতে এগুতে মেহেরিন চৌধুরী বলে উঠলেন
“কোন পাপের শাস্তি আমার ছোট পুতুলের মতো মেয়েটাকে দিচ্ছ মাবুদ?এই টুকুন বাচ্চা মেয়ের অপরাধ কোথায়?
******
কক্ষের ভারী দরজা সামান্য ভিড়িয়ে ভিয়ানের একটা ছবি বুকে জড়িয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে তাথৈ।দৃষ্টি ভেদ করে মোটা মোটা অশ্রু কণা সমানে ভাসিয়ে দিচ্ছে বিছানার মোটা চাদর।বারবার কানের কাছে ভেসে উঠছে সেদিনের সেই কন্ঠস্বর
‘ভিয়ান বেঁচে নেই।গাড়ি এক্সিডেন্ট এ ম/র্মা/ন্তিক মৃ/ত্যু হয়েছে।এমনকি চেহারা পর্যন্ত চেনার কোনো উপায় নেই।”
এমন সংবাদ নিজ কানে কোনো দিন শুনতে হবে তাথৈ যেনো স্বপ্নেও ভাবেনি।ভিয়ানের পুরো শরীর বিভৎস ছিলো।লা/শ শনাক্ত করাও কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিলো সেদিন।হাতে থাকা ন্যাভি ফোর্সের বাদামি ফিতার র/ক্তা/ক্ত ভাঙা ঘড়ি দেখে তাথৈ নিশ্চিত হয়েছিলো ওটা ভিয়ান।কারন ঘড়িটা দুদিন আগে সে ই ভিয়ানকে গিফট করেছিলো।ভিয়ানের আঠাশ তম জন্মদিন উপলক্ষে।
অনুভূতি হীন কলের পুতুলের ন্যায় বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তাথৈ।এরপর ধীরপদে হেটে নিজের রিডিং টেবিলের সামনে এসে দাড়ালো।টেবিলের উপর সযত্নে রাখা কাঠের কারুকাজ খচিত কালো রঙের একটি ছোট বাক্স হাতড়ে একে একে বের করে আনলো ভিয়ানের ব্যবহার্য কিছু শেষ চিহ্ন।সেদিনের সেই র/ক্তা/ক্ত ভাঙা ঘড়ি।কিছু ক্যান্ডি চকলেট আর একটা রুমাল।প্রত্যেকটা জিনিসে র/ক্তে/র দাগ স্পষ্ট।কিন্তু সময়ের সাথে সাথে লালচে র/ক্ত ফিকে রঙ ধারণ করেছে।জিনিস গুলোর উপর হাত বুলিয়ে কান্না জড়িত চুমু খেলো তাথৈ।এরপর সেই বাক্স টা বুকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো
“আমি আজো আপনাকে ভুলতে পারিনি ভিভিয়ান।আপনি আমার পুরো অস্তিত্বে মিশে আছেন।আপনাকে ভুলে গেলে আমাকেই যে আমার ভুলে যেতে হবে।আপনার শেষ স্মৃতি আকড়ে ধরেই আমি সারাটা জীবন বেঁচে থাকবো।এই পাড়ে না হোক ওপাড়ে ঠিক আপনাকে হাসিল করবো আমি”
#চলবে