#বছর_দুয়েক_পর
#পর্ব_২৫
সারিকা হোসাইন
সিডনির তাপমাত্রা নেমে মাইনাস টেন ডিগ্রি সেলসিয়াস এ এসেছে।রাতের ঘনত্ব বাড়ার সাথে সাথে বাড়লো শীতের প্রকোপ।এক পর্যায়ে ঝরতে লাগলো তুষার।নিজের স্ত্রী পুত্রকে মোটা কম্বলে জড়িয়ে পরম শান্তিতে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমানোর প্রস্তুতি নিলো তিহান।আজকাল ঘুম নামক জিনিস টা সচরাচর চোখে ধরা দেয়না তার।চারপাশে বন্ধু স্বজন দের এতো এতো আহাজারি আর চোখে দেখে সহ্য করা যাচ্ছে না।ভিয়ান আর তাথৈ এর নির্মম ঘটনা পুরোটাই জানে সে।ছোট বোনটার মুমূর্ষু অবস্থা জেনেও দাঁতে দাঁত পিষে সবটা সহ্য করে গোপন রেখে গিয়েছে ভিয়ানের বেঁচে থাকবার কথা।মাঝে মধ্যে মেহেরিন এর সাথে কথার পর্যায়ে মুখ ফসকে বহু বার বেরিয়ে যেতে চেয়েছে ভিয়ানের কথা।কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়েছে তিহান।কিন্তু হঠাৎ তাথৈ এর কিডন্যাপ হবার ব্যপারটা কিছুতেই মানতে পারছে না সে।মেয়েটির কপালে বিধাতা এতো এতো দুঃখ লিখেছেন কেনো?আর ভিয়ান?সে কি জেনেছে তাথৈ এর নিখোঁজ হবার বিষয়ে?অবশ্যই জেনেছে।যেই ছেলে তাথৈ এর প্রত্যেকটা শ্বাসের হিসেব গুনে রাখে সে কি তার হারিয়ে যাবার খবর রাখবে না?নানান অসহনীয় ভাবনা ভাবতে ভাবতে ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে আদর ভালোবাসা বিনিময় করতে করতে কখন যে গভীর ঘুমে তলালো তার ঠাহরই করতে পারলো না সে।
কতক্ষন এভাবে ঘুমে মগ্ন রইলো সে জানেনা।কিন্তু ফোনের ভাইব্রেট শব্দে হকচকিয়ে ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসে পড়লো তিহান।বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে ঝটপট ফোনটা হাতে নিতেই ভিয়ানের নম্বর দেখে ভয়ে গলা শুকিয়ে উঠলো তিহানের।
অবচেতন মন ভীত হয়ে ভাবতে লাগলো
“এটা ভিয়ানের বাংলাদেশি নম্বর।তার মানে ভিয়ান ঢাকায়।এতো রাতে কি দুঃসংবাদ দিতে কল করেছে সে?ফুপির কিছু হলো?
ভয়ে দুচোখ ঝাপসা হয়ে এলো তিহানের।দূর দেশে থেকে আত্মীয় স্বজনের বেদনা জড়িত দুঃসংবাদ কেউ কি সেধে সেধে শুনতে চায়?তিহানের ভাবনার মাঝেই কেটে গেলো কল।পুনরায় দ্বিতীয় দফায় কল পেতেই ফোন পিক করে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেলো তিহান।হ্যালো বলার সাথে সাথেই ভিয়ানের কাঁপা উত্তেজিত গলার স্বর পাওয়া গেলো
“তাথৈ তোর ছেলের ছবিতে কি করে এলো তিহান?আর ওর গায়ে হসপিটালের ইউনিফর্ম কেনো?ও হুইল চেয়ারে বসে আছে কেনো?কি হয়েছে ওর?
ভিয়ানের এতো এতো মুণ্ডুহীন প্রশ্নে বিস্ময়ে হতবাক হলো তিহান।তার ছেলের সাথে তাথৈ থাকলে সে কি তাথৈকে নিজের বাড়িতে না এনে রাস্তায় ছেড়ে দেবে?আর এতো বড় কথা কাউকে না জানিয়ে গোপন করে বসে থাকবে নাকি সে?যেখানে প্রতিনিয়ত মেয়ের চিন্তায় তার আপন ফুপু নিজের জ্ঞান খোয়াচ্ছে।
তিহান লম্বা শ্বাস টেনে বলে উঠলো
“কি বলছিস এসব আবোল তাবোল কথা?
“আমি ভুল কিছুই বলছি না।নিনাদের ছবিটা দেখ তুই।ওখানে তাথৈকে দেখা যাচ্ছে।
ভিয়ান কে লাইনে রেখেই ওয়াইফাই অন করে তূর্ণার তোলা ছবিটিতে নজর বুলালো তিহান।নিমিষেই তিহানের চোখ দুটো বিস্ফারিত হলো।নিনাদের একটু দূরেই তাথৈকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ।কিন্তু তাথৈ অস্ট্রেলিয়া এলো কি করে?
তিহান ফোন কানে তুলে উত্তেজিত কন্ঠে শুধালো
“তাথৈ অস্ট্রেলিয়া এলো কি করে?
ভিয়ান পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলে উঠলো
“তুই এখনই ওই হসপিটালে যা।তাথৈকে আমার আজকেই চাই।ওকে কে কিডন্যাপ করেছে আমি তার নাম জানতে চাই।একবার তার দেখা পেলে জাস্ট পুঁতে দেবো।
তিহান ভিয়ানকে শান্ত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলে উঠলো
“বাইরে বরফ ঝরছে।রাস্তা পরিস্কার না হলে যেতে অসুবিধা হবে।আর সেন্ট্রাল হসপিটাল আমার বাসা থেকে পনেরো কিলোমিটার এর রাস্তা।তুই চিন্তা করিস না।রোড ক্লিয়ার হলেই আমি হসপিটাল এ পৌঁছে যাবো।দরকার পড়লে সিডনি পুলিশ স্টেশনে কেস ফাইল করবো আমি।তুই জাস্ট শান্ত হ।তাড়াহুড়ো করে কোনো স্টেপ নিতে গেলেই ঝামেলা হয়ে যাবে।প্রথমেই জানতে হবে কার রেফারেন্স এ হসপিটাল এ এডমিট হয়েছে সে।
তাথৈকে হারানোর কষ্টে বুক ভার হয়ে কান্না পেলো ভিয়ানের।পুরুষ মানুষ চাইলেই মেয়েদের মতো কাঁদতে পারেনা।কিন্তু তাথৈকে হুইল চেয়ারে হসপিটালের ড্রেস পরিহিত দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না ভিয়ান।কান্নায় গলা রোধ হয়ে যাচ্ছে বার বার তার।অধিক কষ্টে গলাটাও বিষিয়ে উঠেছে বেশ করে।তিহানের সাথে কথা বলতেই গলা ছিড়ে যাবার উপক্রম হচ্ছে তার।তবুও নিজের ব্যথা লুকিয়ে ধরা গলায় ভিয়ান বলে উঠলো
“প্লিজ রোড ক্লিয়ার হলেই চলে যাস।আমি অস্ট্রেলিয়া আসবো দুই একের মধ্যেই।আজকের কোনো এয়ার টিকেট নেই।টিকিট পেলেই চলে আসব।এখানে প্রতিমুহূর্তে দম বন্ধ লাগছে।তাথৈকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে না পারলে এবার বোধ হয় আমি মরেই যাবো রে।
ব্যবসায়িক সূত্রে ভিয়ান প্রায়ই অস্ট্রেলিয়া আসে।এক সময় এখানকার নাগরিক ছিলো সে।কিন্তু হঠাৎই কি কারনে এখান থেকে নিউইয়র্ক চলে গিয়েছে সে সবটাই তিহান অনুমান করেছে।কিন্তু দুঃখ প্রকাশ করে ভিয়ান কোনো দিন তাকে কোনো কাহিনী শোনায় নি।যতবার ব্যবসায়িক কাজে এখানে এসেছে ততোবার তিহানের সাথে সাক্ষাৎ করেছে ভিয়ান।তখনো মানুষটাকে তিহানের খুবই শক্ত সামর্থ্য মনে হয়েছে।কিন্তু আজ তিহানের মনে হচ্ছে ওই ভিয়ান আর এই ভিয়ানের মধ্যে হাজার গুণ ফারাক।এতো কোমল ভিয়ানকে সে কখনোই দেখেনি।আর কান্না নামক জিনিস তো তার কাছে ডুমুরের ফুল।তবে কি সবটাই নিজেকে ভালো দেখানোর মিথ্যে খোলস ছিলো?ভেতরটা কি পুরোটাই দগদগে জীবন্ত ক্ষততে ভরা?
*******
সাইফ আজমীর সামনে ক্রুর চাহনি নিক্ষেপ করে দাঁড়িয়ে আছে মেহেরিন।ভোর হতেই ইকবাল তাকে কনফার্ম করেছে তাথৈ অস্ট্রেলিয়া।মেয়ের একটা খুজ আপাতত পাওয়া গিয়েছে এটা ভেবেই কিছুটা হালকা হলেন মেহেরিন।কিন্তু সাইফ আজমিকে তো জবাবদিহিতা করা থেকে বাদ রেখে শান্তিতে থাকতে পারবেন না তিনি।আজকাল মেহেরিন কিছুতেই যেনো ভয় পান না।সাইফ আজমিকে তার কাছে নরকের কীট মনে হয়।যাকে দেখলে ভয় নয় ঘৃণা আসে শুধু মনের গভীরে থেকে।তাথৈ নিখোঁজ হবার পর থেকে মেহেরিনের মুখোমুখি হবার ভয়ে সাইফ আজমী নিজের ঘর ফেলে বাইরে বাইরে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে।কিন্তু নিজের বাড়ি ছেড়ে বাইরে কতোদিন থাকা যায়?বিষয়টা যে এতো দ্রুত ঘটে যাবে তাও ভাবেন নি সাইফ আজমী।এখন মেহেরিন যদি আবার সেই একই বিষয়ে জবাবদিহিতা শুরু করে তবে কি উত্তর দেবে সে?মেহেরিনের চাহনি পরখ করে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের উৎপত্তি হলো সাইফ আজমীর।গলার টাই এর নট ঢিলে করতে করতে শুধালো
“এভাবে কি দেখছো?আর এটা কি ধরনের চাহনি?
“আমার মেয়েটাকে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে খুব খারাপ করেছো তোমরা।তাথৈ অস্ট্রেলিয়া রয়েছে সেই প্রমান আছে আমার কাছে।সেই প্রমান দিয়ে পুনরায় তোমাদের বাপ ছেলের নামে কেইস ফাইল করবো আমি।তুমি দেখেছো এই কদিনে মেয়েটার জন্য নিজের কি হাল করেছি আমি।অথচ আমাকে শান্তনা না দিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছো তুমি।তুমি কি আদৌ কখনো কোনোদিন আমায় ভালো বেসে ছিলে সাইফ?
মেহেরিনের এসব সুচালো আঘাতের ন্যয় প্রশ্নে অপ্রস্তুত হলেন সাইফ আজমী।এই মেহেরিন হঠাৎ এমন ফনা তুলবে এটা সাইফ আজমী কল্পনাতেও আনতে পারেন না।সেদিনের সেই অবলা মেহেরিন কবে কবে এতো ভয়ানক হলো?
“কি হলো জবাব দিচ্ছ না কেনো?আমার মেয়ে হসপিটাল এ ভর্তি।এই ছবি দেখিয়ে থানায় নারী পাচার এর মামলা করবো আমি তোমার নামে।আর এটাও মিডিয়া ডেকে এনে বলবো তুমি ওর বাবা নও।চাচা হয়ে ভাতিজিকে বিদেশে বেঁচে দিয়েছো শুধুমাত্র সম্পত্তির লোভে।
মেহেরিনের কথায় নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে রেখে ধমকে উঠলেন সাইফ আজমী
“মুখ সামলে কথা বলো মেহেরিন।অনেক বাড় বেড়েছে তাই না?এক দম পাখা গুলো ছেঁটে দেবো।
“তুমি আমার একটা লোম ও আর সোজা করতে পারবে না পাখা ছাটা তো দূর।
তাচ্ছিল্য হেসে সাইফ আজমী শুধালো
“কার ইন্ধনে এসব করছো তুমি?
“আমার…..
হঠাৎ ভয়ানক মোটা গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠে চমকে উঠলো সাইফ আজমী।পিছন ফিরে মেইন ফটকে তাকাতেই ছয় ফিট তিন ইঞ্চি উচ্চতার মানুষটিকে দেখে পায়ের ভর ছেড়ে দিয়ে সিঁড়ি তে ধপ করে বসে পড়লো সাইফ আজমী।বিস্ফারিত চোখ দুটো আজ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেনো।মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে হিংস্র ঠান্ডা মাথার সাইফ আজমীর।গলাটা সাহারা মরুভূমির মতো খটখটে হয়ে উঠলো নিমিষেই।ঠোঁট জোড়াও যেনো প্যারালাইজড মানুষের মতো অবশ হয়ে উঠলো।জড়িয়ে যাওয়া ভীত কন্ঠে সাইফ আজমী শুধালো
“ভি ভি ভি ভিয়ান তুমি?
লম্বা লম্বা পা ফেলে সাইফ আজমীর পানে এগিয়ে এসে নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো ভিয়ান।সেটা দেখেও ভয়ে কুঁকড়ে গেলো সাইফ আজমী।অবজ্ঞা জনক হেসে ভিয়ান বলে উঠলো
“নাটক বন্ধ করে উঠে দাঁড়ান চাচা শ্বশুর।এখনো অনেক কিছু দেখবার বাকি আছে।এখনই পায়ের ভার ছেড়ে দিলে বাকি খেলা উপভোগ করবেন কিভাবে?আর তা ছাড়া নিজের ছেলের লাশ কাঁধে নিতে হবে তো নাকি?
ছেলের লাশের কথা শুনে লাফিয়ে উঠে সাইফ আজমী ভিয়ানের শার্টের কলার চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলো
“কি করেছিস আমার ছেলেকে তুই,?
শক্ত ঝটকায় নিজের কলার ছাড়িয়ে ভিয়ান বলে উঠলো
“তোরা আমার সাথে যা করতে চেয়েছিলি।
দাঁতে দাঁত পিষে কথাটি বলে ফোন থেকে এরিকের রক্তাক্ত ছবিটা বের করে সাইফ আজমীর সামনে মেলে ধরলো ভিয়ান।একমাত্র ছেলেকে এমন বিভৎস রূপে দেখে চিৎকার করে সাইফ আজমী বলে উঠলো তোকে পুলিশে দেবো আমি।সাইফ আজমীর কথায় হো হো করে হেসে উঠলো ভিয়ান।এরপর রসিকতা মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো
“তার আগে তাথৈএর বাবা মাকে হত্যার দায়ে সকল প্রমান সমেত ফাঁসিতে ঝোলাবো আমি তোকে।বাঁচতে চাইলে আমার কবল থেকে পালিয়ে দেখা।এবার আর কোনো পথ খোলা রাখিনি।যেই দিকে যাবি ওই দিকেই আমাকে দেখতে পাবি।আর এমন রূপ দেখাবো বলেই তো দুটো বছর কষ্ট বুকে চেপে লুকিয়ে থাকলাম।
টেল মি হাও ইজ মাই সেকেন্ড কামব্যাক?আরেন্ট ইউ হ্যাপি টু সি মি?
********
নিজের সেবায় নিয়োজিত নার্স কে এক প্রকার ডেসপারেট হয়ে রেইনের থেকে বাঁচার তাগিদে তাথৈ কেঁদে কেঁদে বলে উঠলো
‘মিস্টার রেইন ইজ এ ব্যাড গাই,হি কিডন্যাপড মি।প্লিজ সেভ মি ফ্রম হিম।
হঠাৎ তাথৈ এর এহেন ডেসপারেট আচরণে নার্স ভীত হলো।সে রিপোর্টস চেক করে দেখেছে পেশেন্ট এর ডিপ্রেশনের রোগ রয়েছে।তাই নার্স আপাতত তাথৈকে শান্তনা দিয়ে ডক্টর পিটারের কেবিনে দৌড়ে চলে গেলেন।এদিকে রেইন এসেছে ডক্টর এর চেম্বারে তাথৈকে দ্রুত রিলিজ এর ব্যপারে কথা বলতে।পিটার আর রেইন নিজেদের কথা সাড়ছে এমন মুহূর্তে নার্স হন্তদন্ত হয়ে এসে জানালো তাথৈ পাগলামো করছে আর এসব আবোল তাবোল বকছে।ধরা পড়ার ভয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে হাত মুঠিবদ্ধ হয়ে এলো রেইনের।চতুর রেইন হঠাৎই মিথ্যে কান্নার অভিনয় করে বলে উঠলো
“প্লিজ আমার স্ত্রীকে রিলিজ দিয়ে দিন।ও হাইপার হয়ে গিয়েছে।নিজের বাড়ি ছাড়া ওকে হ্যান্ডেল করা যাবে না।বাসায় ওর পরিচিত মানুষজন দেখলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবে।
ডক্টর পিটার তাথৈকে এই মুহূর্তে ছাড়তে নারাজ হলেন।কিন্তু রেইন নাছোড়বান্দা।এসব টাকা ওয়ালা মানুষদের ট্রাস্ট থেকেই হসপিটাল গুলো চলে।তাই রেইনকে সমীহ না করেও উপায় নেই।শেষমেষ কিছুটা নাখোশ হয়েই তাথৈকে রিলিজ দিলেন ডক্টর।
এদিকে পুরো হসপিটাল জুড়ে তাথৈ এর ছবি দেখিয়ে তাথৈকে খুঁজে চলেছে তিহান।পনেরো তলা বিশিষ্ট হসপিটাল টির এই মাথা থেকে সেই মাথা উদ্ভ্রান্তের ন্যয় দৌড়ে চলেছে সে।অবশেষে রিশিপশনে গিয়ে অনেক হাত জোড় করে তাথৈ এর খবর পেলো রেইন।কিন্তু তাথৈ এর নামের সাথে মিসেস আমির নাম দেখে জ্ঞান শূন্য হলো তিহান।আরো নির্বোধ হলো যখন দেখলো তাকে রিলিজ দেয়া হয়েছে।এমনকি তাথৈকে নিয়ে হসপিটাল থেকে চলে গিয়েছে তার পরিবার
খবরটি পাওয়া মাত্র দৌড়ে হসপিটাল ফ্রন্ট এরিয়ায় এলো তিহান।এরপর চারপাশে খুঁজতে লাগলো যদি আল্লাহ সহায় হয় এই আশায়।
এদিকে জোর জবরদস্তি করে গাড়িতে তুলে দরজা আটকে দেয়া হলো তাথৈ কে।কিন্তু হঠাৎই তাথৈ এর নজর আটকালো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এলোমেলো তিহানের উপর।দ্রুত জানালার গ্লাস নামিয়ে তাথৈ ডেকে উঠলো
“তিহান ভাইয়া আমাকে বাঁচাও।
মুহূর্তেই চোখাচোখি হলো তাথৈ আর তিহানের।তিহান দৌড়ে আসার আগেই কেউ তাথৈ এর মুখ চেপে ধরে গাড়ির কালো গ্লাস খানা লাগিয়ে দিলো এবং সাই সাই গতিতে হসপিটাল ত্যাগ করলো।ব্যথিত তিহান ছলছল চোখে গাড়ির পানে তাকিয়ে রইলো।কিন্তু গাড়ির নম্বর প্লেট নোট করতে ভুললো না।
চলবে…..
#বছর_দুয়েক_পর
#পর্ব_২৬
সারিকা হোসাইন
ফজরের আজান পরেছে আরো ঘন্টা খানেক আগে।মেঘলা আকাশে লাল সূর্যটা সেভাবে আলো বিলাতে পারছে না।ছোট ছোট পাখির কিচিরমিচির শব্দে উদ্বেলিত হয়েছে চারপাশ।সারা রাত ছিটে ছিটে বৃষ্টির কারণে গাছের সবুজ পাতা গুলো ঝকঝকে রূপ ধারণ করেছে সেই সাথে তাদের গায়ে লেপ্টে থাকা বিন্দু বিন্দু জল অনন্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে।ফজরের নামাজ আজ ভিয়ান নিজ কক্ষেই আদায় করেছে।বেলকনিতে পাতা রকিং চেয়ারে দুলতে দুলতে হাতে থাকা মোবাইলের স্ক্রিনে একবার নজর বুলালো ভিয়ান।ঘড়িতে সকাল ছয়’টা বেজে কুড়ি মিনিট।দুই চোখ বন্ধ করে পুনরায় রকিং চেয়ারে গা হেলিয়ে সময়ের অংক কষতে লাগলো ব্যথিত পুরুষটি।বাংলাদেশের সময় অনুযায়ী এখন সিডনিতে প্রায় সাড়ে এগারোটার মতো বাজে।রাস্তা ক্লিন হলেই তিহানের হসপিটালে যাবার কথা।একই বিষয় নিয়ে বার বার মানুষকে বিরক্ত করার মতো ছেলে ভিয়ান নয়।কিন্তু বিষয়টা যেখানে নিজের জীবনের সব চাইতে কাছের মানুষ টাকে নিয়ে তখন না চাইতেও মানুষের কাছে অনুনয় করতেই হয়।
“তিহান কি হসপিটালে পৌঁছাতে পেরেছে?এতো দেরি কেনো হচ্ছে তাহলে?এখনো কি রাস্তা ক্লিন হয়নি?
নানাবিধ ভাবনা ভাবতে ভাবতে চোখ দুটোতে জ্বালা ধরে গেলো মানুষটির।অব্যক্ত বেদনায় ছটফট করে উঠলো হৃদয়।কোনো ভাবেই যেনো নিজের যন্ত্রনা গুলোর উপশম করা যাচ্ছে না।উপায় না পেয়ে চট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে কক্ষের বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়লো।এরপর মোবাইল খানা ঘেঁটে বের করে আনলো নিজেদের সুখ ময় মুহূর্তের কিছু স্থির চিত্র।প্রত্যেকটি চিত্রে তাথৈকে বেশ হাসিখুশি লাগছে।ভিয়ানকে কাছে পেয়ে কতই না খুশির ঝিলিক তার চোখে মুখে!
হঠাৎই একটা ছবিতে দৃষ্টি আটকালো ভিয়ানের।নিজের শক্ত মাসেলে ছোট ছোট দাঁতের কামড়ের একটা মার্ক।যেটা দগদগে লাল বর্ণ ধারণ করেছে।চিন্হটা তাথৈ এর দেয়া কামড়ের।তার অনেক শখ হলো হঠাৎই ভিয়ানকে কামড়ে দেবার।প্রিয়তমার শখ পূরণে প্রেমিক পুরুষ শুধালো
“আমাকে সত্যি কামড়ানোর খায়েশ হয়েছে তোমার?
ছোট তাথৈ মাথা উপর নিচ করে জানালো
“হু”
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ভিয়ান শুধালো
“কিন্তু কেনো?
“দাঁত শির শির করছে ”
“আচ্ছা,কোথায় কামড়াতে চাও?
প্রশ্ন শুনে ভাবুক হয়ে সারা শরীরে নজর বুলিয়ে বাইসেপ মাসেলটাই নজরে পড়লো অপরিপক্ক কিশোরীর।।তর্জনী আঙ্গুল নির্দেশ করে ফোলা মাসেলটায় গুঁতো দিয়ে বলে উঠলো
“এখানে।
প্রেমিকার এহেন পাগলামি তে প্রশস্ত হেসে হাত বাড়িয়ে ভিয়ান বলে উঠলো
“আস্তে দিও,আবার মাংস ছিড়ে এনো না।
ঘাড় কাত করে সায় জানিয়ে হালুম বলে হাতটি টেনে বসিয়ে দিলো এক কামড়।প্রথমে অল্প দাঁত বসালেও ধীরে ধীরে প্রচন্ড শক্তি নিয়ে কামড়ে ধরলো তাথৈ।তীব্র ব্যথাটা দাঁত চেপে সহ্য করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে শক্ত হয়ে বসে রইলো ভিয়ান।
কিছুসময় অতিবাহিত হতেই ছেড়ে দিলো হাত ।ব্যথায় অল্প জল খেলা করলো ভিয়ানের চোখের মনিতে।সোজা হয়ে উঠে বসে অনুশোচনা হীন শক্ত কন্ঠে তাথৈ বলে উঠলো
“আপনার উপর আমি মোহর লাগিয়ে দিলাম।আপনি শুধু আমার।আর কেউ স্থান পাবেনা আপনার জীবনে।যদি কেউ স্থান নিতে চায় তবে তাকেও এভাবে কামড়ে দেবো আমি।মনে থাকবে?
তাথৈ এর মাথায় হাত বুলিয়ে ছোট বিনুনি টেনে ধরে ভিয়ান বলে উঠলো
“এ জীবনে আর কারো স্থান নেই তাথৈ।তোমার নাম টাই আমার জন্য মোহর স্বরূপ।তোমাকে না দেখেও শুধু তোমার নাম জপেই কাটিয়ে দিতে পারবো আমি হাজার বছর।
নিজের চিন্তার জগৎ থেকে ফিরে পুনরায় সেই দাগে নজর বুলালো ভিয়ান।এরপর বিড়বিড় করে আওড়ালো
“এমন কেনো মনে হচ্ছে যে এই দাগ অন্য কারো হাতেও দেখেছি?কিন্তু কোথায়?
চোখ বন্ধ করে মস্তিষ্কে জোরে সোরে চাপ প্রয়োগ করতেই চোখের সামনে চকচকে হয়ে ভেসে উঠলো আয়াজ আমিরের ধবাধবে ফর্সা হাত খানা।মুহূর্তেই পরিস্কার হয়ে গেলো সব কিছু।চিন্তার জগৎ থেকে বের হবার আগেই বেজে উঠলো ফোন খানা।ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলতেই হাঁপানো কন্ঠে তিহান বলে উঠলো
“তাথৈকে হসপিটাল থেকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।ও আমাকে দেখে চিৎকার করে ডেকে উঠেছিলো।কেউ একজন ওর মুখে চেপে ধরে রেখেছে।আমি গাড়ির নম্বর নোট করেছি।আমি পুলিশ স্টেশনে যাচ্ছি কেস ফাইল করতে।তুই এখানে তাড়াতাড়ি আয়।
পুরো ঘটনা শুনে নিজের রাগ গিলে খেয়ে ভিয়ান বললো
“কেইস ফাইল করিসনা।আমি জানি ও কার কাছে আছে।
তিহান হতবাক হয়ে শুধালো
“কার কাছে?
“আয়াজ আমিরের কাছে।।
আয়াজ আমির কে তা তিহান জানেনা।বিশেষ করে কোনো ব্যক্তিকে চেনাও তার কাজ নয়।কিন্তু হঠাৎই রিশিপশনে মেয়েটির বলা কথাটা বেশ করে ধাক্কা খেলো তিহানের মস্তিষ্কে।ভীত কন্ঠে তিহান বলে উঠলো
“হসপিটাল ফর্মে তাথৈ এর নামের পাশে মিসেস আমির লিখা ছিলো।
ভিয়ান নিজের সমস্ত খেই হারিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে তেজী কন্ঠে বলে উঠলো
“হুয়াট?
“হ্যা আমি সত্যিই বলছি।তুই তাড়াতাড়ি আয়।আমার কিচ্ছুটি ভালো লাগছে না।তাথৈ কি অবস্থায় আছে আমি জানিনা।কিন্তু ওকে দেখার পর থেকে আমার সব এলোমেলো লাগছে।
*******
জোর করে ধরে এনে তাথৈকে পুনরায় আটকে দেয়া হলো।কিন্তু এবারের কামরাটা বদ্ধ নয়।খোলামেলা বেলকনি আর বড় বড় জানালা সমেত।বাড়িটি রেইনের নিজস্ব।এখানেই সে সব সময় থাকে।নিজের বাংলো ছেড়ে এখানেই তাথৈকে রাখা বুদ্ধি মানের কাজ বলে মনে করছে সে।পুরো বাড়ি লোকজন আর সার্ভেন্ট দিয়ে ঠাসানো।এবার নিশ্চয়ই তাথৈ বোর হবে না।দেয়ালে বিশাল এক টিভিও রয়েছে।চাইলেই শত শত চ্যানেল টিপে মনোরঞ্জন করতে পারবে।হাতের কাছে সব আছে।চাইলেই যা খুশি তাই পাবে।একটা মানুষের ভালো ভাবে বাঁচার জন্য আর কি চাই ?
বদ্ধ কক্ষে বিছানায় মুখ গুজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো তাথৈ।তিহান কে দেখে তার মনে বাঁচার একটা আশা ফুটে উঠে ছিলো।কিন্তু তাকে এভাবে নির্মম ভাবে ছিনিয়ে নেবে এই হিংস্র লোক তাথৈ এটা ভাবতেই পারছে না।জীবনের এসব বেরঙ মুহুর্ত গুলো তাথৈকে বিতৃষ্ণায় ভরিয়ে দিলো।বারবার মন চাচ্ছে এই জীবন থেকে চূড়ান্ত ভাবে মুক্তি নেয়া যাক।কিন্তু কোথাও একটা অজানা আশা তাকে সান্ত্বনার বুলি শোনায়
“বেঁচে থাক সামনে সোনালী সুন্দর দিনের আগমন হবে।
কিন্তু কবে আসবে সেই দিন?
মেয়েটির অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি কিছুতেই ধৈর্যে কুলাচ্ছে না রেইন এর।সে নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু মেয়েটি বার বার তার ধৈর্য পরীক্ষা নিচ্ছে।এভাবে ঘুমানো সিংহ কে জ্বালাতন করলে সিংহ কতক্ষন ঘুমাতে পারবে?নাকের পাটা ফুলিয়ে ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে নিজের এসিস্ট্যান্ট আর্থার কে বলে উঠলো
“ফাইন্ড আউট হু ইজ তিহান!আই হ্যাভ টু শাট হিজ মাউথ।
আর্থার বিচক্ষণ এর ভাব ধরে উত্তর জানালো
“ডোন্ট ওয়ারী স্যার।আ উইল ফাইন্ড হিম।
*******
টানা দুই দিনের চেষ্টায় সিডনি ফ্লাইটের টিকিট এরেঞ্জ করতে পেরেছে ভিয়ান,আজ রাতেই তার ফ্লাইট ।ইকবাল জেদ করেছিলো সেও যাবে।কিন্তু ভিসা লাগতে সময়ের ব্যাপার তাই সে যেতে পারেনি।এদিকে এরিকের অবস্থা বেহাল।শ্বাস তো নিচ্ছে কিন্তু জ্ঞান এখনো ফিরেনি।ডক্টরদের ধারনা সে কোমায় চলে গেছে।মেহেরিনের কাছে এই খবর জানালে তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।জন্মদাত্রী মা না হোক পেলে পুষে বড় তো করেছে।এই জবাব ও মেহেরিন দিয়েছেন সুনিপুণ ভাবে।
“আমি আমার সবটা দিয়ে ওকে বড় করেছি আর সে বরাবরই তার বাবার মতো উপহার হিসেবে অপমান আর ধিক্কার রিটার্ন দিয়েছে।ও আমার মেয়েকে কিডন্যাপ করে যেই কষ্ট শেষ বারের মতোন আমাকে দিয়েছে তার কোনো ক্ষমা হয়না।আর তাছাড়া বাপের সাথে মিলে ভিয়ান কে যেই ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে ওরা সম্পত্তির লোভে এর পর ওদের প্রতি আমার আর কোনো মায়া মমতা থাকে না।শুধু এরিক কেনো সাইফ আজমী ও যদি আমার সামনে তড়পাতে তড়পাতে মারা যায় তখনও আমার এক বিন্দু কষ্ট হবে না।ওরা আমাকে পাথরে পরিণত করেছে ।সন্তানহীন বন্ধ্যা মানুষ করেছেন বিধাতা আমাকে।মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে এতোদিন বেঁচে ছিলাম আমি।আজ আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন ই কেড়ে নিয়েছে তারা।
নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে এয়ারপোর্ট এর উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করার প্রস্তুতি নিলো ভিয়ান সেই সাথে বলে উঠলো
“অনেক লুকোচুরি হয়েছে।যেই ভয়ানক কষ্টের ভয়ে ভীত হয়ে এতো এতো দূরত্ব,হৃদয়াহত আর হতাশা সেই কষ্ট যদি লুকোচুরি খেলেও পেতে হয় তবে তার অবসান করাই শ্রেয়।সমস্ত ভুল আমার।তাথৈকে ক্ষতবিক্ষত করে আমি তার উপর জুলুম করেছি।যেহেতু ক্ষত আমি তৈরি করেছি মলম আমিই লাগবো।আমি আসছি তাথৈ।এবার আর কোনো পিছুটান নেই,কিছু হারাবার ভয় ও নেই।
চলবে….