বছর দুয়েক পর পর্ব-৩১+৩২

0
26

#বছর_দুয়েক_পর
#পর্ব_৩১
#সারিকা_হোসাইন

ঘড়ির কাঁটা বরাবর সাতের ঘরে পৌঁছুতেই হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো তাথৈ।আজকে বাইরে এতো টা হিমবাহ নেই।বাসায় সেন্ট্রাল হিটারের উষ্ণতায় তেমন শীতের অনুভূতি পাওয়া যাচ্ছে না।সাদা নরম তোয়ালে হাত মুখ মুছে তূর্ণার থেকে কিছু ফেস ক্রিম মুখে মেখে পোশাক যাচাইয়ে ব্যস্ত হলো তাথৈ।দীর্ঘদিন বাদে শখের মানুষটির সাথে ঘুরতে যাবে সে।আজকের রাতটা তার কাছে বেশ স্পেশাল।মানুষটির সামনে নিজেকে খুব করে মেলে ধরতে চাইলো সে।তাই বেছে বেছে প্রত্যেক টা ড্রেস হাতড়ে হতাশ হয়ে মুখ ভার করে বসে রইল ।যুৎসই কোনো ড্রেস ই তার চোখে লাগলো না।ঘুরতে যাবার জন্য কেমন ড্রেস চুজ করতে হবে এটাই ভেবে পেলো না সে।বিছানায় বসে ল্যাপটপে কাজ করতে করতে কাজের ফাঁকে তাথৈ এর পানে একবার নজর বুলালো ভিয়ান।মেয়েটির চোখে মুখে কিঞ্চিৎ নজর বুলিয়ে বুঝে ফেললো কি নিয়ে সে এতো পেরেশান।লম্বা শ্বাস ফেলে কোল থেকে ল্যাপটপ নামিয়ে ক্লোজেট এর পাল্লা খুলে নিজেই বের করে আনলো একটা উলের ভারী সুয়েটার,স্কাই ব্লু জিন্স আর একটা মাফলার।কাপড় গুলো তাথৈ এর পানে এগিয়ে বলে উঠলো

“ওখানে অনেক শীত,আর তাছাড়া আমরা হারবার ব্রিজ এ হাঁটবো।কমফোর্ট ড্রেস না পড়লে ঘুরে শান্তি পাবে না সোনামণি।

কথাটি বলে তাথৈ এর ফোলা ফোলা গাল টিপে ধরে আবারো বলে উঠলো

“তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।আমরা একটু আগে আগেই বের হবো।ওখানে গেলে তুমি আর আসতেই চাইবে না।তাই আগে গেলে বেশি টাইম স্পেন্ড করতে পারবে।

মানুষটিকে তাথৈ এর কাছে একটু বেশিই জ্ঞানী মনে হয়।যেকোনো বিষয় নিয়ে সে পজেসিভ।সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয়ে তার খেয়াল।এতো কিছু বুঝে কেনো এই লোকটা?আর সকল সমস্যার সমাধান তার কাছেই বা কিরে থাকে?

তাথৈকে তৈরি হতে বলে নিজেও তৈরি হতে চলে গেলো ভিয়ান।
ভিয়ান চলে যেতেই ঝটপট গায়ে পোশাক জড়ালো তাথৈ।এরপর চুলগুলো পনিটাইল স্টাইলে বেঁধে গলায় মাফলার ঝুলালো।মাঝখানে তূর্ণা এসে অল্প কমপ্যাক্ট পাউডার আর নুড লিপস্টিক এর টাচ দিলো।সেই সাথে অল্প কাজল আর আইলাইনার চোখের পাতায় টেনে সাজ কমপ্লিট করলো।আয়নায় নিজেকে একবার দেখে শো রেক থেকে বেবি পিংক রঙের এক জোড়া স্নিকার্স নিয়ে রুমের বাইরে বেরিয়ে এলো তাথৈ।দরজার সাইডে জুতা জোড়া রেখে ভিয়ানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো সে।
মিনিট পাচেক পর গলায় বাদামি রঙের মাফলার বাঁধতে বাঁধতে সিড়ি দিয়ে নেমে এলো ভিয়ান।
ডার্ক ব্রাউন লেয়ার্ড কাট চুল গুলো জেল দিয়ে সেট করে কপালের কাছে ফেলে রেখেছে ।ক্লিন শেভড চকচকে মুখশ্রী তার সৌন্দর্য বাড়িয়েছে কয়েক গুণ।গায়ে জড়ানো ব্ল্যাক ট্রেঞ্চ কোটে তাকে হলিউড এর সেলিব্রেটি ঠেকছে তাথৈ এর কাছে।মানুষটির পানে কিছুক্ষন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে ফাঁকা ঢোক গিললো তাথৈ।শো কেবিনেট এর ড্রয়ার থেকে গাড়ির চাবি নিতে নিতে ভরাট গলায় খোঁচা মেরে ভিয়ান বলে উঠলো

“আমাকে গিলে খাওয়া শেষ হলে বাইরে এসো।সময় চলে যাচ্ছে।

কথাটি বলেই ঠোঁট টিপে হাসি লুকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো ভিয়ান।লজ্জায় নিজের কপালে বার কয়েক চাপড় মেরে তাথৈ বলে উঠলো

“ছি কি লজ্জা!এভাবে উনাকে কেনো দেখলাম,?জীবনে কি আজই প্রথম দেখলাম তাকে?না জানি কতো ছ্যাবলা ভাবলো উনি আমাকে।ধ্যাৎ।আর ভাবলেই কি?আমার জিনিস আমি দেখেছি তাতে উনার কি?

মনে মনে কথাটি বলে পায়ে জুতো জোড়া গলিয়ে গুটি গুটি পায়ে পার্কিং লটে এসে দাড়ালো তাথৈ।গাড়ি স্টার্ট দিয়ে তাথৈকে গেটের কাছে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিলো ভিয়ান।

তাথৈ গেটের কাছে আসতেই দেখা মিললো সেক্রেটারি অভীক এর।বেচারা ক্লান্ত শরীরে বিবস মুখে গেট মাড়িয়ে বাংলোর দিকে যাচ্ছে।তাথৈকে দেখতে পেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো অভীক।নিজেকে ধাতস্থ করে সালাম প্রদশন করে বিনয়ের স্বরে শুধালো
“কোথাও যাচ্ছেন আপনারা ম্যাম,?

মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে মাথা দুলিয়ে সায় জানালো তাথৈ।তাথৈ এর উত্তর শুনে ঘরের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে তাথৈ ডেকে উঠলো

“মাছ কোথায় অভীক ভাইয়া?

তাথৈ এর প্রশ্নে পায়ের গতি থামলো অভীকের।পেছন ফিরে একবার তাথৈ এর পানে তাকালো এরপর কাঁধে ঝোলানো ফিশিং হুইল ব্যগের দিকে নজর বুলিয়ে নিচু স্বরে বলে উঠলো

“সকল মাছেরা অভিমান করে ডাক রিভার এ পাড়ি জমিয়েছে ম্যাম।তাই আজ শূন্য হাতে ফিরতে হলো।

তাথৈ বুঝলো অভীক কোনো মাছ পায়নি।তাই আর কথা না বাড়িয়ে অভীক কে যেতে দিলো।অভীক যেতেই ভিয়ান এসে হর্ণ বাজিয়ে গাড়ির দরজা খোলে নিজের পাশে তাথৈকে বসার নির্দেশ দিলো।স্মিত হেসে তাথৈ বসতেই পরম যত্নে সিটবেল্ট লাগিয়ে গলার মাফলার ঠিক করে দিয়ে শুধালো

“কটা মাছ পেয়েছে?

দুঃখী মুখে তাথৈ জানালো
“একটাও না।

ভিয়ান বাঁকা হেসে বলে উঠলো
“ও কোনো দিন ও একটা চুনো পুঁটিও ধরতে পারেনি।অযথাই সময় কাটাতে যায়।মাছ ধরায় এক্সপার্ট ছিলো তায়েফ।বাকেট ভর্তি মাছ উঠতো তার ছিপে।বিনা কারণে আমার জন্য প্রাণ হারালো বেচারা।শেষ কথাটাও বলতে পারিনি আমরা।

তায়েফ কে তাথৈ চিনতো।বেশ বিশ্বস্ত ছিলো ভিয়ানের।তাথৈএর সাথে তার দুবার দেখা হয়েছিলো মাত্র।ছেলেটা যথেষ্ট মিশুক ছিলো।তাথৈ ভেবে ছিলো ছেলেটি হয়তো আর ভিয়ানের আন্ডারে থাকে না।কিন্তু এই মাত্র ভিয়ানের মুখে তার প্রাণ হারানোর খবর শুনে বাক শূন্য হলো তাথৈ।বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ব্যাথিত কন্ঠে তাথৈ শুধালো

“উনি মা*-রা গেছেন?

তাথৈ এর প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরে পেলো ভিয়ান।নিজের চোখের গড়িয়ে পড়া জল দ্রুত হাতে মুছে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে ভিয়ান বলে উঠলো

“এসব বিষয়ে অন্যদিন কথা হবে তাথৈ।আর কিছু প্রশ্ন করো না।সময় এলে সব জানবে।জাস্ট আমাকে কিছুদিন সময় দাও।

আর কথা বাড়ালো না তাথৈ।শুধু ভিয়ানের বাহু চেপে ধরে বাইরের প্রকৃতিতে নজর বুলালো।

সাই সাই গতিতে গাড়ি চলছে স্মুথ রাস্তা ধরে।গাড়ি জুড়ে নিস্তব্ধতা।রাস্তার অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে হঠাৎই তাথৈ এর মনে পড়লো মাস ছয়েক আগের কথা।শপিংমলে সে ভিয়ান কে দেখে ছিলো স্বশরীরে।ভিয়ানকে চিৎকার করে ডাকার পরেও সে ফিরে পর্যন্ত তাকায়নি।তাথৈ ধরেই নিয়েছিলো সেটা ভিয়ান নয়।তাথৈ মনে মনে একবার ভাবলো সে ভিয়ানকে জিজ্ঞেস করবে ওটা সে ছিলো কি না।
সকল নিস্তব্ধতা ভেঙে গাড়ি অটোমোডে দিয়ে ভিয়ান তাথৈ এর মাথাটা তার কাঁধে ফেলে আদুরে গলায় শুধালো

“কি ভাবছো?

কিছুক্ষন চুপ থেকে তাথৈ শুধালো
“এর আগেও তোমাকে আমি দেখেছিলাম।ওটা কি তুমি ছিলে?

“কোথায় দেখেছিলে?

“যমুনা ফিউচার পার্কে ”

“হ্যা ছিলাম,তুমি চিৎকার করে ডেকেছো তাও শুনেছি।

“তবে ফিরে তাকাওনি কেনো?
ব্যাথাতুর গলায় অভিযোগ করলো তাথৈ।
তাথৈ এর কপালে উষ্ণ চুমু একে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ভিয়ান বললো
“এই তাথৈটা বড্ড অস্থির।কি করে অস্থিরতা কমাই বলো তো?

ভিয়ানের চোখে চোখ রেখে তাথৈ বলল
“আচ্ছা সরি।আর কোনো প্রশ্ন করবো না।

তাথৈএর সাথে আরো কিছু খুনসুটি করে গাড়ি চালানোতে মন দিলো ভিয়ান।
মিনিট চল্লিশের ড্রাইভ শেষে হারবার ব্রিজের অপেরা হাউজের পার্কিং এরিয়াতে গাড়ি পার্ক করে গাড়ি থেকে নেমে তাথৈ এর হাত চেপে ধরলো ভিয়ান।এরপর তাথৈকে আরেকটু কাছে টেনে আদুরে গলায় বলে উঠলো

“বেশি শীত লাগছে?

তাথৈ ভিয়ানের পানে তাকিয়ে মুচকি হেসে উত্তর করলো
“উহু।

দু কদম পা বাড়িয়ে ভিয়ান বললো
“হাঁটার এনার্জি আছে?আমরা কিন্তু ব্রিজের কিনার ধরে হাঁটবো।এখান থেকে নদীর সৌন্দর্য আর ব্রিজের সৌন্দর্য দুইই ভালোভাবে উপভোগ করতে পারবে তুমি।

“তোমার সাথে হাজার বছর বিরামহীন হাটতে পারবো আমি ভিয়ান নাওয়াফ।আমার একটুও ক্লান্তি লাগবে না।আর না কোনো এনার্জি লস হবে।

তাথৈ এর হাতের উল্টোপিঠে ঠোঁট ছুঁইয়ে চুল ঠিক করে দিতে দিতে ভিয়ান বলে উঠলো

“সেদিনের ছোট তাথৈ আজ দেখছি অনেক বড় হয়ে গেছে।এবার তো তাহলে বউ বানানোই যায় কি বলো?

ভিয়ানের দুস্টু কথায় লজ্জায় নাকের ডগা গোলাপি হলো তাথৈ এর।শীত জড়ানো কাঁপা কন্ঠে তাথৈ বলে উঠলো

“বউ হতে আমি এক বাক্যে রাজি আছি।

ব্রিজে উঠার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ভিয়ান শুধালো

“তবে দেরি কেনো?একা একা ঘুমুতে বেশ কষ্ট হয়।শীতের রাত গুলো আরো যন্ত্রণাদায়ক।আগে বলবে না তুমি এক বাক্যে রাজি?

ভিয়ানের শক্ত বাহুতে চাপড় মেরে অন্য দিকে মুখ লুকিয়ে তাথৈ বলে উঠে

“তুমি দিনে দিনে বেশ বদমাশ হয়েছো।তোমাকে সময় বুঝে উচিত শিক্ষা দেবো আমি।এখন দাঁত কেলিয়ে হাসছো পরে কাঁদিয়ে ছাড়বো।

তাথৈ এর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে হাস্কি কন্ঠে ভিয়ান বলে উঠলো
“শিক্ষা দাও আর যাই করো আদর করতে বাধা দিও না।তবে আত্মা ফেটে মরে যাবো।কসম।

“ওটাই করবো।

সিরিয়াস ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে ভিয়ান বলে উঠলো

“এই না না।একদম এই কাজ করা যাবেনা।এই কান ধরছি আর মজা করবো না তোমার সাথে।তবুও এমন সিরিয়াস বিষয় নিয়ে ভয় দেখিও না।এমন তুলতুলে বউকে আদর না করে বাঁচতে পারবো না আমি।এটা জুলুম হয়ে যাবে আমার জন্য।আর তুমি তো কঠিন হৃদয়ের মানবী নও তাইনা?

ভিয়ানের ভীত মুখের পানে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে তাথৈ।সুশ্রী সেই হাসিতে খেই হারিয়ে তাথৈকে কোলে তুলে গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ভিয়ান বলে উঠলো

“আগামী কাল ই বিয়ের বন্দোবস্ত করতে হবে।না হলে চারিদিক থেকে লস।জতো আগে হানিমুন করে বাচ্চা কাচ্চার ব্যবস্থা করা যায় ততোই ভালো।

********
অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখে ধরফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসলো মৌটুসী।হাপাতে হাপাতে বিছানা হাতড়ে বালিশের তল থেকে ফোন খানা বের করে সময় দেখে নিলো।রাত সাড়ে চারটা বাজে।স্বপ্নটির কথা পুনরায় মনে পড়তেই ধকধক করে লাফিয়ে উঠলো হৃদযন্ত্র খানা।রুমের লাইট জ্বালিয়ে বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে পানির বোতল নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে শুকনো গলাটা ভিজিয়ে বোতলের ক্যাপ লাগিয়ে মৌটুসী নিজেকে নিজেই শুধালো

“এ কেমন ভয়ানক স্বপ্ন?ইকবাল ভাই আমাকে কেনো চুমু খাবে?

বিরবিড়িয়ে কথাটি বলে লজ্জায় আরক্ত হলো মেয়েটি।ইকবাল কে সে প্রথম দেখেছিল বছর চারেক আগে ভিয়ানের সাথে।মানুষটি যথেষ্ট মার্জিত এবং সুদর্শন।কথা বার্তায় ও বেশ নমনীয়।চোখ দুটো যেনো গভীর সমুদ্র।একবার ডুবলে আর রক্ষে নেই।যেকোনো মেয়ের হৃদয়ে কাপন তুলতে ইকবালের মোটা ভরাট স্বরটাই যথেষ্ট।পুলিশের ইউনিফর্ম এ স্বপ্নের নায়ক লাগতো তাকে মৌটুসীর কাছে।সামনে পড়লেই সবসময় কেমন একটা বুক ঢিপঢিপে অনুভূতি হয়।অজানা লজ্জা আর ভয় এসে ভর করে বুকের মধ্যখানে।ওতো বড়লোকের ছেলে তার অবশ্যই বড়লোক গার্লফ্রেন্ড বা বাকদত্তা আছে।ওই মুভিতে নাটকে যা হয় আর কি।তার কাছে মৌটুসীর মতো সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ের ভালো লাগার দাম থোরাই আছে?সেই ভয়ে মৌটুসী কখনো ইকবালের প্রতি তার যেই অনুভূতি তা কখনো কারো সামনে প্রকাশ করেনি।তাথৈ অবশ্য বেশ কয়েকবার তার হাবভাব দেখে কিছুটা আন্দাজ করে প্রশ্নবান ছুড়েছিলো।অত্যান্ত সুকৌশলে সবটা এড়িয়ে গিয়েছে মৌটুসী।মৌটুসী মনে করে সে বামন আর ইকবাল চাঁদ।এজন্য ইকবাল কে জড়িয়ে এধরনের কল্পনা সে ভুলেও কখনো করে নি।তবে এই স্বপ্নের মানে কি?

আরো নানাবিধ ভাবনা ভাবতে ভাবতে ফজরের আজান পড়লো চারপাশে।বিছানা ছেড়ে উঠে স্বপ্নের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো মৌটুসী।এসব আজাইরা ভাবনার চাইতে নামাজ পড়াকেই উত্তম বলে মনে হলো তার কাছে।

এদিকে মৌটুসীর ভাবনায় দিন রাত সমান তালে গড়াচ্ছে ইকবালের।কোনো ভাবেই তার সময় কাটতে চায়না।ইকবালের বাবা ইমরুল মাহমুদ ছেলের বউ দেখার জন্য হাপিত্তেশ শুরু করেছে।ইদানিং নাকি তার ঘনঘন হার্ট এট্যাক হতে চাচ্ছে ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তায়।ইকবালের মা সেলিনা বেগম ও কম যান না।দিনে তিনবার করে বিয়ে না করতে পারার খোঁটা দিয়ে কান মাথা খেয়ে নিচ্ছে।অথচ যার বিয়ে তার খবর নেই।নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে শেষমেষ কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো ইকবাল।
মৌটুসীর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে সে।দরকার পড়লে বাবার বিজনেস দেখাশোনার কাজ আজ থেকেই শুরু করবে সে।তবুও মৌটুসী কে তার পেতেই হবে।মন যখন কোনো নারীর প্রতি আসক্ত হয়ে তখন তাকে ফেরানো দুষ্কর।ইকবালের ও হয়েছে সেই দশা।

“তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে মনে জায়গা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না মৌটুসী ।যদি তোমার বাবা রাজি না হয় আমার কাছে তোমাকে বিয়ে দিতে তবে তোমাকে তুলে এনে নিজের বউ বানাবো আমি।অনেক হয়েছে চোর পুলিশ খেলা।এবার সামনা সামনি কথা হোক।তোমাকে আমার বউ হতেই হবে মৌটুসী রহমান।না হলে মাটির তলে চালান করে দিতে দুবার ভাববো না।

#চলবে…..

#বছর_দুয়েক_পর
#পর্ব_৩২
#সারিকা_হোসাইন

বহু বছর পর বাধন হারা মুক্ত পাখির ন্যায় চৌধুরী বাড়ির দুয়ার খুলে লম্বা শ্বাস টেনে লাগেজ সমেত বেরিয়ে এলো মেহেরিন।আজ থেকে সে মুক্ত,ভীতিহীন।আজকে তার কাছে মনে হচ্ছে সে যেনো সেদিনের সেই তেইশ বছরের মেহেরিন।যার কোনো পিছুটান নেই নেই কোনো জবাবদিহিতার ভয়।সাইফ আজমিকে চূড়ান্ত উপহারটাই দিতে পেরেছে সে এতো কাল কারা দন্ড ভোগের পর।কিন্তু বেঘোরে তার জীবনের যে অর্ধেক চলে গেলো তার দায় কে নেবে?লম্বা লম্বা পা ফেলে প্রকান্ড স্টিলের গেট টার কাছে এসে পেছন ফিরে পুনরায় বাড়িটির দিকে নজর পাতলো মেহেরিন।মুহূর্তেই চিকচিকে হলো চক্ষু মণিদ্বয়।তাচ্ছিল্য হেসে মেহেরিন বেদনার্ত কন্ঠে বলে উঠলো

“বাহিরে কতই না জৌলুস অথচ ভেতরে?চিতার আগুন ও কম পরে যাবে।ভাগ্গিস শেষ দম টা এখানে ফেলতে হয়নি।রূহ কি তবে শান্তি পেতো?

আর দাঁড়ালো না মেহেরিন দুই হাতে গেট ঠেলে লাগেজ টেনে বাইরে বের হতেই বৃদ্ধ রহমান কে বিষাদি মুখে নজরে এলো।তাকে দেখে স্মিত শুকনো হেসে মেহেরিন বললো

“আজীবনের জন্য চলে যাচ্ছি রহমান ভাই।খুব জ্বলিয়েছি আপনাকে,আজ থেকে আপনি মুক্ত।

বৃদ্ধ রহমান ব্যাথিত কন্ঠে জবাব দিলো
“আপনাকে কি গ্রামে রেখে আসবো ম্যাডাম?

দ্রুত মাথা নাড়িয়ে খসে পরা চোখের জলকে মুছে মেহেরিন বলে উঠলো
“বড়লোকের বর্ম গায়ে জড়িয়ে নিজের অস্তিত্বই ভুলে যেতে বসেছিলাম রহমান ভাই।কঠিন বর্ম টা আজ খুলে ফেলেছি।আমি যে গাঁয়ের মেয়ে।এসব আভিজাত্য আমার শ্বাস আটকে দেয়।অনেক দিন ধুলোবালি গায়ে মাখিনা।প্রকৃতির কোমল হাওয়া আমায় ছোয় না।আমি আবার আমার আগের রূপে ফিরতে চাই।বাস গাড়িতে চলতে আমার খুব ভালো লাগে।আসছি,ভালো থাকবেন।

বৃদ্ধ রহমান কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে এলোমেলো পায়ে হেটে চললো মেহেরিন।তার কি বুক ভেঙে কান্না পাচ্ছে?কিন্তু কেনো?এই বাড়ির একটা খড়কুটোর প্রতিও কখনো তার মায়া জন্মেনি।তবে এই ব্যথা কিসের?অকারণে অর্ধেক জীবন ফুরানোর ব্যথায়?নাকি অপ্রাপ্তিতে?

বাস স্ট্যান্ডে এসে ওয়েটিং চেয়ারে বসে আছে মেহেরিন।কাঙ্খিত গাড়ির টিকেট ইতোমধ্যে কাটা হয়ে গেছে তার।গাড়ি ছাড়তে আরো মিনিট বিশেক দেরি হবে।সময়ের অপেক্ষায় প্রহর গুনতেই পরিচিত গলায় কেউ ডেকে উঠলো
“মেহু!

কন্ঠটা কানে বাজতেই ধীর গতিতে উঠে দাঁড়ালো মেহেরিন।চশমার ফ্রেমের আড়ালের উপচে উঠা ঝাপসা চোখের জল কোনো মতে রোধ করে ভাঙা গলায় অল্প অল্প করে বললো

“এই শহর ছেড়ে চির দিনের জন্য চলে যাচ্ছি সাজিদ।আর কখনো আমাদের দেখা হবে না।ইচ্ছে করেই তোমাকে বলিনি।পাছে ব্যাথা পাবে ।তাও ঠিক জেনে গেলে।

শুকনো নিষ্প্রাণ হেসে সাজিদ বলে উঠলো
“তোমার সফর সঙ্গী হতে চাই আমি মেহু।তুমি সঠিক রাস্তা চিনবে না।তুমি যে বড্ড ভুলো মনা।আমাকে ছাড়া একা গ্রামে ফিরতেই পারবে না তুমি।

এদিক সেদিক তাকিয়ে নিজেকে বৃথা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে মেহেরিন বলে উঠলো

“আমি আর আগের মেহেরিন নেই সাজিদ।দেখছো না বুড়ি হয়ে গেছি।

সাজিদ মাহমুদ আবেগী গলায় বললেন
“আমার কাছে তুমি এখনো ষোড়শী।আমি কখনো তোমাকে মহিলা রূপে দেখিনা।তুমি আজীবন আমার কাছে চপলা চঞ্চলা ষোড়শী মেহেরিন হয়েই থাকবে।

কথা শেষ হবার আগেই গাড়ির হেলপার সকলকে নিজ নিজ সিটে বসার জন্য অনুরোধ করলো কারন গাড়ি ছাড়তে আর পাঁচ মিনিট বাকি আছে।সাজিদ দ্রুত মেহেরিনের লাগেজ টা বক্স এ দিয়ে বলে উঠলো

“দ্রুত উঠে বসো গাড়িতে।না হলে হুড়োহুড়ি তে পরবে তখন পায়ে ব্যাথা পাবে।

কথাটি বলেই সাজিদ গাড়িতে উঠে হাত বাড়ালো মেহেরিনের জন্য।মানুষের তাড়াহুড়োয় আর সাজিদের বাড়ানো হাতের ইশারায় ইতস্তত করে মেহেরিন নিজের হাতটা বাড়ালো।ধীরে ধীরে চিকন গড়নের মেহেরিন কে গাড়িতে টেনে তুলে প্রশস্ত হেসে সাজিদ বলে উঠলো
“আমি জানি তুমি দুটো সিট নিয়েছো।তোমার পাশে অন্য কোনো পুরুষ বসে সেই ভয়ে।তোমাকে আমি না চিনলে আর কে চিনবে বলো তো মেহু?

নিজের সিটে বসতে বসতে মেহেরিন অল্প হেসে শুধালো
“খবর পেলে কি করে?

“তাথৈ এর হবু বর ফোন করেছিলো।রহমান এর থেকে সে শুনেছে তোমার ডিভোর্স এর কথা।আরেকটু দেরি হলেই তোমাকে মিস করতাম।বিধাতা আজ এতটা নিষ্ঠুর হন নি আমার উপর।

চোখের চশমা খানা নরম আচলে পরিস্কার করতে করতে মেহেরিন জিজ্ঞেস করলেন
“বিধাতা তো তোমার জীবন পুরোটাই বিফলে ফেললো।বিয়ে করছো না কেনো?

“তোমার জায়গা কাউকে দিতে পারব না তাই।এখন তো বুড়ো হয়ে গেছি এখন আর বিয়ে টিয়ে নিয়ে ভাবিনা।যে কটা দিন বেঁচে আছি তোমাকে ভালোবেসেই কাটিয়ে দিতে চাই।ভালোবাসা খুব সুন্দর অনুভূতি মেহু।

নিজের ভাগ্যের উপর অবজ্ঞা হেসে মেহেরিন বললেন
“পরের স্ত্রীকে ভালোবাসা গুনাহের কাজ নয়কি?

“যখন তোমাকে ভালোবেসেছিলাম তখন তুমি কারো স্ত্রী ছিলে না মেহু।আর যার নামের সিল মোহর হৃদয়ে বসে যায় সেই মোহর কি কখনো তোলা যায়?

আর কথা বাড়ালো না মেহেরিন।চোখ বুজে সিটে মাথা হেলিয়ে ক্লান্ত কন্ঠে বলে উঠলো
“বহু বছর ঘুমাই না সাজিদ।আজ নিশ্চিন্তে ঘুমাবো।পাহারা দিও ….

সাজিদ প্রশস্ত হেসে বলে উঠলো
“তুমি ঘুমাও মেহু।আমার দায়িত্ব পালনে এক মুহূর্ত কার্পণ্য করবো না আমি।

**********
মুখোমুখি বসে আছে ইকবাল আর তার বাবা।ভদ্রলোক ছেলের মতিগতি কিচ্ছুটি ঠাহর করতে পারছেন না।যেই ছেলেকে ডাইনিং টেবিলেও কখনো দেখা যায়না সে আজ বাপের কক্ষে এসে হানা দিয়েছে তাও আবার সকাল ন’টায়।অবশ্যই বিশাল ক্যাচাল করেছে।ছেলের পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে ভারিক্কি গলায় ইমরুল মাহমুদ শুধালেন
“আজ সূর্য কোন দিকে উঠেছে আব্বু?

বাবার কথায় খুক খুক করে কেশে ইকবাল ইতিউতি তাকিয়ে বলে উঠলো
“তোমার শরীরটা ইদানিং ভালো যাচ্ছে না তাই ভাবলাম ব্যাবসার হাল টা ধরি।তুমি চাইলে আমি আজ থেকেই অফিসে জয়েন করতে পারি আব্বু।ছেলে হিসেবে তোমার প্রতি আমার একটা দায়িত্ব কর্তব্য আছে তাই না বলো?

ইকবালের কথা শুনে ইমরুল মাহমুদ চোখ বড় বড় করে সহধর্মিনী সেলিনা কে ডেকে উঠলেন।
“সেলি এই সেলি শিগগির এদিকে এসো।বিশাল কেলেঙ্কারি হয়েছে।

স্বামীর ডাকে সেলিনা বেগম কাজ ফেলে দৌড়ে এসে ঝনঝন গলায় খেমটা মেরে শুধালেন
“হয়েছে কি এমন ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেনো?
মাঝবয়সী ইমরুল গলা খাকরি দিয়ে হাতে থাকা ক্র্যাচ দিয়ে ইকবাল কে গুঁতো দিয়ে বলে উঠলো
“ওকে ভুতে ধরেছে,সকাল বেলা কি সব আবোল তাবোল বকছে।আমার ভয় করছে।

বাবার মুখে এহেন টিটকারি শুনে ইকবাল মাথা নিচুকরে বসে রইলো।টিটকারি করবেই বা না কেন?ইমরুল মাহমুদ এর এক পায়ে একটু সমস্যা আছে।ব্যাবসায় সংক্রান্ত দৌড় ঝাঁপ করতে তার বেশ কষ্ট হয়।ভদ্রলোক ছেলেকে বহু অনুনয় বিনয় করেছে শুধুমাত্র নিজের সবকিছু বুঝে নিতে।কিন্তু এক রোখা ইকবাল এসব পারবে না এক বাক্যে বলে দিয়েছে।লোকটা ব্যাথিত মনে একা একা ব্যাবসায়ীক দিক গুলো সামলেছেন।বিশ্বস্ত সেক্রেটারি রুহুল আমিন না থাকলে ব্যাবসায় বহু আগেই লাটে উঠতো।তখন বাপের বিপদ দেখেনি আজ নিজের বিপদে স্বার্থান্বেষী মানুষের মতো ব্যাবসা দেখভাল করার দায়িত্ব বুঝে নিতে চাচ্ছে।তাই ইকবাল ঠিক করেছে তার বাবা তাকে শত অপমান করলেও সে আজ কোনো প্রতিউত্তর করবে না।অনেক লাফাঙ্গাগিরি হয়েছে তার এই জীবনে।এবার একটু স্থান পেতে স্থির হওয়া দরকার।

ইকবাল কে ভুল প্রমাণ করে ইমরুল মাহমুদ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় শুধালেন

“মেয়ের বাড়ির ঠিকানা দাও।আব্বু সব ঠিক করে দেবো ।

বাবার মমতায় চোখ বেয়ে জল গড়াতে চাইলো ইকবালের।কিন্তু কঠিন পুরুষ ইকবাল নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রেখে অবাক কন্ঠে শুধালো
“তুমি কি করে জানলে আমার মেয়ে পছন্দ আছে?

“কারন বিপদে না পড়লে বিড়াল গাছে উঠে না।

লাজুক হাসি দিয়ে ইকবাল বলে উঠলো
“লজ্জা লাগছে আব্বু।

ছেলের শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে ইমরুল মাহমুদ বলে উঠলেন

“ধুর ব্যাটা এতো লজ্জা পেলে চলে?কবে বিয়ে করতে চাও শুধু সেটা বলো।

ইকবাল ধীর কন্ঠে বললো
“ওরা যদি মেয়ে না দেয় আব্বু?

ছেলের বাহুতে চাপড় মেরে ইমরুল মাহমুদ বলে উঠলেন
“মেয়ে দেবে না মানে?মেয়ের মাকেও দেবে।তুমি তাহলে আজ অফিসে চলে যাও।রুহুল আমিন কে সব বলে দেবো আমি।তোমার আম্মির কাছে মেয়ের ঠিকানা দিয়ে যেও।ঘটক লাগাবো আজই।আমার আব্বুকে মেয়ে দেবে না কোন ব্যাটা দেখি তো?

বাবার ভরসায় ইকবাল মনে মনে বেশ খুশি হলো।এরপর কথা বার্তার পর্ব চুকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আবেগী গলায় বলল

“অনেক দিন তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরো না আব্বু।

ক্রাচে ভর দিয়ে ইমরুল মাহমুদ দাঁড়িয়ে অভিমানী স্বরে বললেন

“তুমি তো অনেক বড় হয়ে গেছো।আলাদা বাসায় থাকো।আব্বুর জন্য তোমার ভান্ডারে সময় আছে?

ইকবাল অপরাধী হয়ে নিজের বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে বলে উঠলো
“আজ থেকে তোমাদের সাথেই থাকবো আব্বু।আমি এতদিন অবুঝ ছিলাম,।আমাকে মাফ করে দাও।

ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে ইমরুল মাহমুদ বলেন
“বাবা মায়ের কাছে সন্তানের কোনো ভুল নেই।তুমি ছোট মানুষ।ওসব আমি কিছুই মনে রাখেনি।যাও অফিসে যাও।

আর কথা না বাড়িয়ে বাবার থেকে বিদায় নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এলো ইকবাল।বুকের উপর বসে থাকা পাথরটা আজ যেনো পুরোটা নেমে গেছে।বুকটা অনেক হালকা লাগছে তার।আজ প্রথম ইকবালের কাছে মনে হলো সৃষ্টিকর্তা পিতামাতা কে উত্তম নেয়ামত হিসেবে দান করেছে পৃথিবীতে।আদর্শ পিতামাতার হীন পৃথিবী সত্যিই নরক তুল্য।

*********
ভিয়ানকে জড়িয়ে বেশ সময় ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে তাথৈ।মেহেরিনের চলে যাবার খবর ভিয়ান দুপুরেই জানিয়েছে তাকে।একে একে সব হারিয়ে নিরুপায় এর ন্যায় তাথৈ শুধালো
“আমার কি তবে কিছুই অবশিষ্ট রইলো না?আল্লাহ আমাকে এতো কেনো কষ্ট দেয়?আমি তবে উনার কাছে খুব নিকৃষ্ট?

তাথৈ এর প্রশ্নের উত্তর ভিয়ানের কাছে নেই।একের পর এক দুর্ঘটনা যুক্ত সংবাদ মেয়েটি শুনেই যাচ্ছে।আর এসবের পেছনের মূল হোতা সাইফ আজমী।সে যেই অন্যায় আর পাপ করেছে এর জন্য তাকে দুনিয়াবী সাজা হিসেবে মৃত্যু দিলেও কম পরে যাবে।তাথৈ এর মাথায় হাত বুলিয়ে ভিয়ান শান্ত কন্ঠে বললো

“উনি মুক্তি পেয়েছে তাথৈ।একজন মানুষ হিসেবে এই মুক্তি উনি ডিজার্ভ করে।সাইফ আজমীর কাছে উনি কি আদেও ভালো ছিলেন?উনার নিজেরও তো বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বাঁচতে ইচ্ছে হয়।

অবুঝের ন্যয় তাথৈ বলে উঠলো
“আমি কাকে মা ডাকবো এখন?ওই বাড়িতে আম্মুকে ছাড়া কিভাবে থাকবো আমি?

“তুমি কি ওই বাড়িতে ফিরতে চাও?সাইফ আজমী আর এরিকের কাছে ফিরে যেতে চাও তুমি তাথৈ?

বেদনা ভরা কন্ঠে প্রশ্নটি শুধিয়ে তাথৈ এর পানে শক্ত নজর বুলালো ভিয়ান।
হুহু করে চোখের জল ছেড়ে তাথৈ বলে উঠলো

“ভিসা পাসপোর্ট হীন এভাবে কতদিন ই বা তুমি আমায় রাখতে পারবে?স্বেচ্ছায় না গেলেও বাধ্য হয়েই আমাকে ফিরতে হবে।আর থাকার স্থান বলতে ওই নরক তুল্য বাড়িই।আম্মু ছাড়া কে আগলে নেবে আমাকে?

তাথৈকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ভিয়ান ভয় মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো
“তুমি কোথাও যাবে না তাথৈ।আমি আর তোমাকে একা ছাড়বো না।অনেক হয়েছে!আর কোনো কষ্ট তোমাকে আমি পেতে দেবো না।দরকার পড়লে তোমাকে আমি এখানেই লুকিয়ে রেখে দেবো।আর ফিরতে যদি হয়ই তুমি তোমার নানা বাড়িতে ফিরবে।ওখানে আন্টি তোমাকে কখনোই ফেলবে না।নিজের মেয়ে না হও।মাতৃ মমতায় বড় তো করেছেন উনি তোমাকে।!

নিজের ভাগ্যের উপর তাচ্ছিল্য হেসে তাথৈ শুধালো
“আমার নিজের নানা বাড়ি কোথায়?

ভিয়ান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো
“আন্টি আশ্রমে বড় হয়ে ছিলেন।তোমার নিজের কোনো নানা নানী নেই।ইভেন আন্টি কোন কাস্টের এটাও অজানা।আংকেল ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন উনাকে।বিয়ের দেড় বছরের মাথায় তোমার জন্ম হয়।আর তোমার যখন বয়স প্রায় দু বছর তখন কার এক্সিডেন্ট এ উনাদের মৃত্যু হয়।

“বাবা মায়ের সাথে আমারও তো থাকার কথা।তবে আমি বাঁচলাম কি করে?

“কারন তোমার বাবা তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মেহেরিন আন্টির কাছে তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলো।

“তার মানে আমার বাবা জানতো কে তাকে মারতে চায়?তাহলে আম্মুকে বাঁচাল না কেনো?

“কারন তারা বুঝতেই পারেনি ওইদিন ই তাদের জীবনের শেষ দিন।তোমাকে তো রিস্ক ফ্রি থাকার জন্য দূরে দূরে রাখা হতো।যদি উনারা জানতো ওইদিন তাদের মৃত্যু হবে তবে তারা হয়তো বাড়ির বাইরে পা ই ফেলতো না।

“কে সেই নৃশংস খুনি?

“যে আমাকেও শেষ করতে চেয়ে ছিলো।

অবিশ্বাস্য কন্ঠে সজল চোখে ভেজা কন্ঠে তাথৈ গুঙ্গিয়ে শুধালো

“আব্বু?

ভিয়ান তাথৈকে আগলে নিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে জবাব দিলো

“ইয়েস।সে জানতো আংকেল তোমার নামে সমস্ত সম্পত্তি উইল করে দিয়েছে।নয়তো তোমাকে ও শেষ করতে দুবার ভাবত না।তোমার বাবা মা কে বোকা বানাতে সে অপশন দিয়েছিলো হয় পুরো প্রোপার্টি তার নামে লিখে দিতে হবে নয়তো সে তোমাকে যে কোনো উপায়ে মেরে ফেলবে।মেহেরিন আন্টি ছিলো প্রতিবাদী টাইপ মানুষ।তোমার বাবা মায়ের মনে হয়েছিলো তার কাছে তুমি সেফ থাকবে।এজন্য তারা কোথাও গেলে তোমাকে সাথে নিতো না।যেদিন আংকেল আন্টি মারা যান ওইদিন তোমাকে ও সাথে নিয়ে ছিলো।কিন্তু কি মনে করে যেন রহমান আংকেল এর গাড়ি দিয়ে তোমাকে আন্টির কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়।রহমান আঙ্কেল বাড়ি ফেরার কিছুক্ষন পরই খবর আসে তাদের গাড়িকে ট্রাক চাপা দিয়েছে।ব্যাস নিভে যায় দুটো তাজা প্রাণ।ঘটনা স্থলে তোমার বাবা মায়ের সাথে ট্রাক ড্রাইভার নিজেও মারা যায়।এজন্য কোনো তদন্ত করে সঠিক কাহিনী জানা যায়নি।

“তবে তুমি জানলে কি করে?

“সাইফ আজমী খুব উল্লাস নিয়ে এরিকের সাথে এসব গল্প করছিলো।আমার সাথে তোমাকে বিয়ে দেবার একটাই কারন ছিলো উনার।তুমি অস্ট্রেলিয়া চলে এলে তোমার বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ উনি খেয়াল খুশি মতো ইউজ করতে পারবেন ।বাট যখন আমি রুখে দাঁড়ালাম তখনই আমাকে শেষ করার প্ল্যান করলো।সকল প্রমান আছে আমার কাছে।কিন্তু এসব আমি কাউকে দেখাবো না।উনার শাস্তি অন্য উপায়ে হবে।বাপ ছেলের খেলায় কে বাঁচে কে মরে এটাই দেখার পালা এবার।

নিজের চোখের জল মুছে শক্ত কন্ঠে তাথৈ বলে উঠলো

“সাইফ আজমীর বিভৎস লাশ দেখতে চাই আমি।

ভিয়ান বাঁকা হেসে তাথৈ এর চোখের গড়িয়ে পড়া জল মুছতে মুছতে বলে
“এজ ইউ উইশ……

#চলবে……