বছর দুয়েক পর পর্ব-৪৬+৪৭

0
58

#বছর_দুয়েক_পর
#পর্ব_৪৬
#সারিকা_হোসাইন

_________
সময়ের লাগাম টেনে ধরবার সাধ্যি এই নশ্বর পৃথিবীতে কার আছে?সময় সেতো আপন নিয়মেই বয়ে যায় সকলের অলক্ষ্যে।ভিয়ান আর তাথৈ নিউইয়র্ক ফিরেছে আরো সপ্তাহ খানেক আগে।এয়ারপোর্ট এ কোনো সমস্যাই হয়নি তাদের।এর বিশেষ কারসাজি পুরোটাই ডেভিটের।মানুষের নকল হাতেও আসল বস্তুর জাদু।
এই পুরোটা সপ্তাহ নিজেদের বাড়িঘর গোছাতেই ব্যয় করেছে তাথৈ আর ভিয়ান সামলেছে নিজের অগোছালো বিজনেস আর অফিস।এদিকে অভীকের উপর যেনো দিনরাত স্টিম রোলার চলছে।পশ্চাৎদেশ ঠেকিয়ে কোনো জায়গায় একবিন্দু বসার ফুসরত নেই তার।সারা দিন রাত শুধু কাজ আর কাজ।লোক মারফত রেইনের খবর ও জানা হয়েছে।অবস্থা খুবই বেগতিক।যদিও জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু অবচেতনের ন্যয়।মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলতে পারে না।শুধু তাই নয় মাথায় সজোড়ে আঘাত পাবার কারনে মস্তিষ্ক থেকে সাময়িক সময়ের জন্য কয়েকটা মাস হারিয়ে গিয়েছে।এমনকি নিজের এক্সিডেন্ট কিভাবে সংঘটিত হয়েছে সেটাও সে মনে করতে পারছে না।আর মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করে কিছু ভাবতে গেলেই মাথার যন্ত্রনায় চিৎকার করে কাঁপিয়ে তুলছে পুরো হসপিটাল।পুরো ঘটনা শুনে ভিয়ান প্রথমে বেশ অনুতপ্ত হয়েছে।কিন্তু নিজের স্ত্রীকে জড়িয়ে অন্য পুরুষের নিষিদ্ধ বাসনা ভাবতেই মনে মনে বেশ খুশি হয়েছে।স্মৃতি নাই বা থাকুক।বেঁচে আছে সেই ঢের।

আজ শুক্রবার পবিত্র দিন।খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে নিলো তাথৈ।এরপর নিজেদের কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে কিচেনে এলো।ভিয়ান এখনো ঘুমুচ্ছে।দিন রাত প্রচন্ড ধকল যাচ্ছে মানুষটার।খুব সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে আর ফিরছে গভীর রাতে।এ,কদিন এখানে না থাকায় বিজনেসে প্রচুর লস হয়েছে।এতেও মানুষটির আফসোস নেই।সে তাথৈকে পেয়েই পৃথিবীর সর্ব শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ।
কিচেনে ঢুকে প্রথমেই তাথৈ সকালের ব্রেকফাস্ট বানানোর কাজে মন দিলো।আজকে তাদের ঘরে নতুন অতিথি আসবে।অতিথির জন্য বেশ রকমের আয়োজন করতে হবে তাথৈকে।হাতে একদম সময় নেই।আজ ভিয়ান বাড়িতেই থাকবে।সকালের খাবারের পাট চুকিয়ে দুপুরের রান্নার আয়োজন করতে হবে তাকে।সমস্ত কাজ গুছিয়ে ভিয়ানকে নিয়ে বেরুতে হবে মেন্টাল হসপিটাল এর উদ্দেশ্যে।সেখানে সকল ফর্মালিটিস পূরণ করতে পারলে তবেই মিলবে মেলিনার ছুটি।মনে মনে তাথৈ বেশ অস্থির হয়ে উঠছে থেকে থেকে।আদেও মানুষটিকে সে সামলাতে পারবে তো?নাকি কোনো বিপদ ঘটিয়ে ফেলবে?

তাওয়ায় রুটি ছেকতে ছেকতে তাথৈ মনে মনে বলে উঠলো

“সন্তান বদ্ধ উন্মাদ হলে কি মা ফেলে দেয়?নিশ্চয় পরম মমতায় বুকে জড়ায়।মা যদি সন্তানকে এতো করে আগলে নিতে পারে তবে আমরা কেনো মা কে আগলে নিতে পারবো না?ভিয়ান পাশে থাকলে আমি পুরো দুনিয়া জয় করতেও দুবার ভাববো না।আমাকে যে পারতেই হবে।

************
হসপিটালের বিছানায় স্থির হয়ে শুয়ে ছাদের উল্টো শুভ্র পিঠের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এরিক।তার দুই চোখের কার্নিশ গড়িয়ে নোনতা জলের ধারা ছুটেছে যেনো।থেকে থেকে নিকিতার সাথে কাটানো সকল মুহূর্ত গুলো হৃদয়ের অলিন্দে ঝড় তুলেছে।মেয়েটির রক্তাক্ত দেহ খানা চোখে ভাসতেই মুষড়ে উঠলো এরিকের কঠিন হৃদয়।অসহনীয় কষ্টে কন্ঠনালী ব্যাথায় বিষিয়ে উঠলো।

আরো সপ্তাহ খানেক আগেই তার জ্ঞান ফিরেছে।জ্ঞান ফিরেই যে এমন ভয়াবহ সত্যের সম্মুখীন হতে হবে এটা যেনো সে ভাবতেই পারেনি।যাদের এতকাল সে আপন ভেবে ভালোবেসে এসেছে তারাই তার পিঠ পিছে ছুড়ি মেরে চলেছে সমান তালে।আর সেলিনা?সেতো এরিকের জন্মদাত্রী মা।সে কিভাবে এহেন নিগূঢ় সত্য গোপন রাখতে পারলো তার থেকে?তবে কি এখানে সেলিনার ও কোনো স্বার্থ জড়িত আছে?
ইকবাল কে এতো গুলো বছর কতো ঘৃণা করে এসেছে সে।অথচ ইকবাল তার মতোই ভুক্তভোগী মাত্র।আর ভিয়ান নাওয়াফ?সাইফ আজমীর সাথে হাত মিলিয়ে অসহায় তাথৈকে দিনের পর দিন সে নির্মম কষ্ট দিয়েছে।মাতৃতুল্য মেহেরিন কে পর্যন্ত করেছে অবজ্ঞা আর অত্যাচার।মানুষটি তাকে মায়ের আদরে বড় করেছে স্বার্থহীন।অথচ তাকে কোনো দিন ভালো স্বরে মা বলেই সম্বোধন করা হয়নি।শুধুমাত্র সাইফ আজমীর ইশারায় নেচেছে সে কারন বাবাকে সে পৃথিবীর বেস্ট বাবা মনে করতো।যাকে এরিক এতো এতো ভালোবাসলো সেই মানুষটাই তার অনাগত সন্তানের মা কে নৃশংস ভাবে দুনিয়া ছাড়া করলো?

“কি এমন দোষ করেছিলো নিকি?

হঠাৎই কারোর পায়ের শব্দ শুনে সজাগ হলো এরিক।দ্রুত চোখের জল মুছে মরার মতো পরে রইলো সে।এরপর অপেক্ষা করতে লাগলো আগত ব্যক্তির।কিন্তু নিজের সাথে হয়ে যাওয়া এতো এতো অন্যায় মনে জাগ্রত হতেই চোখ ফেটে জল গড়াতে চাইলো দ্বিগুণ হারে।কঠিন মনের অধিকারী এরিক নিজেকে আটকে ধরে সমস্ত পরিস্থিতি পাল্টে দেবার জন্য খিচে টান হয়ে শুয়ে রইলো।অল্প কিছু সময় গড়াতেই কক্ষে প্রবেশ করলেন সেলিনা।নিজের ব্যাগ পত্র সাইড কর্নারে রেখে ছেলের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি এরপর পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন

“কবে তুই এই দীর্ঘ ঘুম ছেড়ে উঠবি বাবা?আমাদের হাতে যে আর বেশি সময় নেই।ওই অসুরকে যে বধ করতে হবে তোকে।তুই এভাবে ঘুমিয়ে থাকলে কিভাবে হবে বলতো?

সেলিনার কথায় চোখ মেলে উঠতে চাইলো এরিক।কিন্তু পরবর্তীতে সাইফ আজমীর কথা মনে পড়তেই নিজেকে দমিয়ে নিলো।এরিক জানে সেলিনা চলে গেলেই সন্ধ্যার পর পর সাইফ আজমী আসবেন।তিনি এসেই প্রতিদিন নানান ক্ষোভ ঝাড়েন এরিকের উপর।ক্ষোভ ঝাড়তে ঝাড়তে নানান গোপনীয় কথা প্রকাশ করে ফেলেন।যে করেই হোক এরিক কে জানতেই হবে কি এমন অন্যায় করেছিলো নিকিতা যার জন্য তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে।

***********
গ্রেস মেন্টাল হস্পিটাল, নিউইয়র্ক।

চলছে ফেব্রুয়ারি মাসের সূচনা লগ্ন।ডিসেম্বর ,জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি এই তিন মাস ধরে শীতের মরসুম চলে নিউইয়র্ক এ।জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে শীত কিছুটা কম।সারা রাত ভারী শীত এবং ভোরের আলো ফুটলেই সোনালী মিষ্টি রোদ।সবসময় কেমন একটা আরাম আরাম অনুভূতি।

ভিয়ানকে নিয়ে তাথৈ যখন হাসপাতালে উপস্থিত হলো তখন ঘড়ির কাটা বরাবর এগারোর ঘরে।তাথৈকে নামিয়ে কার পার্কিং এরিয়ায় চলে গেলো ভিয়ান।হসপিটাল এর সবুজ মাঠে পা ফেলে লম্বা প্রাপ্তির শ্বাস টানলো তাথৈ।এই দেশ এই শহর সবটাই তার কাছে নতুন।এসেছে থেকে তার আর বাইরে যাওয়া হয়নি।আজই প্রথম বের হয়েছে সে।সিডনিতে বুকের মধ্যে সবসময় যেই ভয় জেঁকে বসে থাকতো সেটা এখন নেই।চেনা অপরিচিত নিউইয়র্ক হঠাৎই আপন ঠেকলো তাথৈ এর কাছে।এই শহরে তার ঘর আছে,স্বামী আছে ,শাশুড়ি আছে আর কি চাই?

গায়ের জামা খানা টেনে ঠিকঠাক করে একবার চারপাশে নজর বুলালো তাথৈ।বিশাল বড় দৈত্যের ন্যয় এক হসপিটাল।লোকজনের সমাগম খুব একটা নেই বললেই চলে।মানসিক ভারসাম্য হীন মানুষের হাসপাতাল অথচ কতো শান্ত আর তকতকে পরিচ্ছন্ন।চারপাশে হাজারো ফুল ফল গাছের সমাহার।যদিও পত্রহীন বৃক্ষ গুলো মুহূর্তে মুহূর্তে তাদের রিক্ততা জানান দিচ্ছে।মার্চ এলেই তারা নতুন কিশলয় এ পূর্ণ হবে।তবে শীতকালীন ফুলে পরিপূর্ণ হসপিটাল এর চারিধার।তাথৈ গুছানো হাসপাতাল টাকে ভালোভাবে পরখ করতেই ভিয়ান এসে হাত চেপে ধরে অল্প করে বললো

“ভেতরে চলো।

বাধ্য অনুগতের ন্যয় ভিয়ানের পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে লাগলো তাথৈ।সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় উঠতেই বিকট চিৎকারে কান ঝালাপালা হলো দুজনের।তাথৈ কিছুটা অস্বস্তি প্রকাশ করলেও ভিয়ান শক্ত হয়ে রইলো।হঠাৎই তাথৈ খেয়াল করলো ভিয়ানের চোখ মুখ কেমন যেনো হয়ে উঠেছে।অস্পষ্ট স্বরে তাথৈ ভিয়ান কে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো

“মা চিৎকার করছে?

ভিয়ান অসহায়ের ন্যয় তাথৈ এর পানে তাকিয়ে রইলো শুধু।মুখ ফুটে সব বলতে হলো না তাথৈকে।যা বুঝার তাথৈ তা বুঝে নিলো।মুহূর্তেই আহত হয়ে একজন নার্স গাল চেপে ধরে বেরিয়ে এলো।শক্ত কিছু দিয়ে তার গালে আঘাত করা হয়েছে।নার্স বের হতেই ভিয়ানের সাথে তার দেখা হয়ে গেলো।ভিয়ানকে পেয়ে নার্স নিজের ব্যথা ভুলে সুন্দর স্বরে বলে উঠলো

“মিস্টার নাওয়াফ ,শী বিকেইম হাইপার আগেইন।প্লিজ ডোন্ট গো ইন নাও।

নার্স এর সাথে ভিয়ান কথা বলতে বলতেই তাথৈ সেই কক্ষে ঢুকে পরলো।ভেতরে এলোমেলো মেলিনা।নিউইয়র্ক এসে মেলিনার ছবি দেখেছে তাথৈ।ছবির সাথে বাস্তব মেলিনার শূন্য শতাংশ মিল পর্যন্ত নেই।চোখ মুখ হলদেটে ফ্যাকাশে।সারা গায়ে আঘাতের চিহ্ন।হয়তো নিজেকে নিজেই আঘাত করেছে।কক্ষের মেঝেতে ছড়িয়ে পরে রয়েছে বিভিন্ন খাবার,ওষুধ আরো হাবিজাবি জিনিস।গায়ের কাপড় টাও যেনো তার শরীরে জ্বালা সৃষ্টি করেছে।চোখের মণি দুটোও ঝাপসা।সেখানে কোনো আশার আলো নেই।মানুষটার জন্য তাথৈ এর বেশ কষ্ট হলো।পরিস্থিতি বেসামাল তবুও ভীতিহীন হয়ে তাথৈ ডেকে উঠলো

“মাম্মা!

প্রথম ডাকেই ফিরে তাকালো মেলিনা।এরপর কিছুক্ষন নীরব থেকে হাতে থাকা স্টিলের মগ ছুড়ে মারলো তাথৈ এর দিকে।ঘটনা বোঝার আগেই সেই মগ কপালে লেগে কেটে গিয়ে রক্তের ধারা ছুটলো।আকস্মিক ব্যথায় ককিয়ে না উঠে ঠোঁট চেপে চোখ কুঁচকে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলো তাথৈ।এদিকে সেই মগ টাইলসে ঝনঝন শব্দের উৎপত্তি করলো।শব্দের উৎস ধরে নার্স আর ভিয়ান দুজনেই ভেতরে প্রবেশ করলো।রক্তাক্ত তাথৈকে দেখে ভিয়ান নিজের বাক হারালো যেনো।দৌড়ে তাথৈকে চেপে ধরে নিজের পকেটের রুমাল দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে ধরে আসা উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠলো

“বাহিরে চলো,ডক্টর এসে মম কে ঘুমের ইনজেকশন দেবে।আমরা অন্যদিন আসবো।

ভিয়ানকে থামিয়ে দিয়ে তাথৈ শক্ত গলায় বলে উঠলো

“উনি আজ এই মুহূর্তে আমাদের সাথে বাড়ি ফিরবে।

তাথৈ এর কথায় নার্স বলে উঠলো

“ইউ ক্যান্ট কন্ট্রোল হার।

নার্সকে থামিয়ে জোর কন্ঠে তাথৈ উত্তর দিলো

“আই ক্যান।

ভিয়ান আর নার্সকে তোয়াক্কা না করেই আরেকটু এগিয়ে গেলো তাথৈ।এদিকে অপরিচিত মানুষ দেখে মেলিনা কিছুটা অপ্রস্তুত হলো।তার চোখে মুখে কোথাও একটা অপরাধ বোধের ছায়া স্পষ্ট হলো।কিন্তু পুনরায় তাথৈ কে আঘাত করার জন্য মেলিনা হাতের কাছে কিছু খুঁজতে লাগলো।মুহূর্তেই তাথৈ মেলিনার বাহু চেপে ধরে পুনরায় আবেগ মাখা স্বরে ডেকে উঠলো

“মাম্মা !

এবার কিছুটা শান্ত হলো মেলিনা।মেলিনার গায়ের কাপড় ঠিক করতে করতে তাথৈ শীতল কন্ঠে শুধালো

“বাড়ি ফিরবে না?ভিয়ান যে কাঁদে তোমার জন্য!

মেলিনা তাথৈ এর প্রশ্নে অবাক মিশ্রিত হেসে শুধায়

“ভি ভি ভি ভিয়ান?

তাথৈ অল্প মাথা দুলায়।মেলিনা পুনরায় বলে উঠে

“লিটল ভিয়ান?

তাথৈ আবার মাথা দুলায়।

মেলিনা ফট করে বলে উঠে

“উইল ইউ টেইক মি টু মাই সান?

তাথৈ ধরা গলায় বলে উঠে

“ইয়েস, আ ই উইল।

মেলিনা অস্পষ্ট বাংলায় প্রসন্ন হেসে তাড়া দেখিয়ে বলে উঠলো

“তাহলে চলো আর দেরি কেনো?এখানে আমার অনেক কষ্ট হয়।সবসময় দম বন্ধ লাগে।
এরপর নার্স কে আঙ্গুল উঁচিয়ে নির্দেশ করে ছোট বাচ্চার ন্যয় মেলিনা ঠোঁট ভেঙে বলে উঠলো

“ওরা আমাকে কষ্ট দেয়।

তাথৈ মেলিনার গালে চোখে মুখে হাত বুলিয়ে আদুরে স্বরে বলে উঠলো

“আর কেউ তোমাকে কষ্ট দেবে না মাম্মা।বাড়ি চলো।

***********
মকবুল হোসেনের বসার কক্ষে মাথা নিচু করে বসে আছে সাজিদ আর মেহেরিন।মকবুল শেখ জরুরি তলবে সাজিদ কে ডেকেছেন।কেনো ডেকেছেন সাজিদের তা অজানা।কিন্তু মেহেরিন সবটাই জানেন।বৃদ্ধের গম্ভীর মখশ্রী দেখে সাজিদ কিছুটা অপ্রস্তুত হলো।এরপর অল্প মাথা তুলে ধীর গলায় বললো

“কেনো ডেকেছেন আংকেল?

এবার একটু নড়েচড়ে উঠলেন মকবুল শেখ।আরো কিছুক্ষন স্তব্ধ থেকে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন

“আমি আজ পর্যন্ত আমার মেয়ের জামাই এর সাথে বসে একটা কথা পর্যন্ত বলতে পারিনি সাজিদ ।অথচ আমার স্বপ্ন ছিলো বাকি জীবনের কিছু অংশ মেয়ের সংসারে কাটিয়ে দেবো।মেয়েটা আমার খুব আদরের।সাইফ আজমী যখন ওকে তুলে নিয়ে বিয়ে করলো তখন খুব কষ্ট পেয়ে ছিলাম আমি।কারন মেয়ের বিয়ে ক্যারিয়ার নিয়ে যা স্বপ্ন দেখেছিলাম সব নিমিষেই শেষ হয়ে ছিলো।এরিকের আগমনে আমি সব ভুলে ওই বাড়িতে পা দিলাম ।কিন্তু বিনিময়ে কি পেয়েছিলাম জানো?চূড়ান্ত অপমান।মেহেরিন খুব ভালো গরুর ঝাল ভুনা করতে পারে।ছাব্বিষটি বছর সেই গরুর গোশত আমার মুখে পড়েনি।কারন এই ছাব্বিষটি বছর আমার মেয়ের বাড়িতে যাবার কোনো অধিকার আমার ছিল না।চোখের জলে আমার মেয়ের পাতের ভাত নোনতা হয়েছে কিন্তু তা মুছিয়ে নেবার জন্য বাবাকে বা ভাই ভাবীকে কাউকে কাছে পায়নি আমার এই মেয়ে।

কথা গুলো বলতে বলতে বৃদ্ধের গলা ধরে এলো।তিহানের মা একটু পানি এগিয়ে বলে উঠলেন

“পানি টুকু খেয়ে নিন বাবা।নয়তো কাশি উঠবে আপনার।

বাধ্য শিশুর ন্যয় তিহানের মায়ের থেকে পানি নিয়ে অল্প গলা ভিজালেন মকবুল শেখ।এরপর কিছুক্ষন নীরব থেকে আবার বলতে লাগলেন

“আমি জানতাম এরিক মেহেরিনের সন্তান নয়।তবুও আমি সেসব গায়ে মাখিনি।মেয়ের জামাই এর একের পর এক অপকর্ম দেখে গিয়েছি নীরবে।কিন্তু মেয়ের জন্য কিছুই করতে পারিনি।আমি শুধু অসহায় এর ন্যয় উপর ওয়ালার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।আমি আমার মেয়ের জীবনের বন্দি দশার মুক্তি চেয়েছিলাম।দেরিতে হলেও বিধাতা আমার দোয়া কবুল করেছেন।এই অনেক।আমার বয়স হয়েছে দুদিন পর কবরে যেতে হবে ।কিন্তু মেয়েটাকে এভাবে অগোছালো রেখে পৃথিবী ছেড়ে ওপারে গিয়ে কি জবাব দেবো আল্লাহর কাছে বলোতো?

এবার আর শক্ত থাকতে পারলেন না মকবুল।মেহেরিন এর হাত টেনে নিয়ে হুহু করে কেঁদে বলে উঠলেন

“মা রে তোকে সুখে দেখে শান্তিতে মরতে চাই।বাবা হিসেবে বেশি কিছু তো চাইনি।শুধু চেয়েছি তুই ভালো থাক।এটা কি আমার অন্যায়?যদি অন্যায় হয় তবে এই বুড়ো মানুষটার ভুল জেনে ক্ষমা করিস ।

মকবুল কি বোঝাতে চাইছেন মেহেরিন তা বুঝলো।কিন্তু এমন একটা বয়সে এসে বিয়ে করা আদেও কি সম্ভব?সমাজের মানুষ ই বা কি বলবে?আর নতুন করে সংসার গোছানোর তাকত কি এখন আর আছে?

মকবুল হোসেন মেহেরিনের হাত ছেড়ে সাজিদের মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না ভেজা কন্ঠে শুধালো

“আমার মেয়েকে গ্রহণ করবে বাবা?তোমাদের সাথে কিছুটা দিন কাটিয়ে মরতে চাই।

সাজিদ মাথা নিচু রেখে বলে উঠলো

“করবো আংকেল।আপনি সকল ব্যবস্থা করুন।আমার কোন আপত্তি নেই।

#চলবে…..

#বছর_দুয়েক_পর
#পর্ব_৪৭
#সারিকা_হোসাইন

__________
হলুদ বিকেলের গৌধুলি আভা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র।ধীরে ধীরে নমনীয় হচ্ছে দিনের মৃদু উত্তাপ।কমে আসছে মানুষের কর্মব্যাস্ততা।অদূরের বিশাল রাস্তা থেকে গাড়ির কর্কশ ধ্বনী খুব একটা পাওয়া যাচ্ছে না এখন।বিশাল হসপিটাল টিতেও নেমে এসেছে রাজ্যের নিস্তব্ধতা।

সেলিনা বিদায় নিয়েছে আরো আধ ঘন্টা আগে।সাইফ আজমী এখনো এরিক কে দেখতে আসেন নি।যেকোনো মুহূর্তেই ভদ্রলোক দাঁত মুখ খেচাতে খেচাতে চলে আসবেন।এভাবে জ্ঞান হীন হয়ে শুয়ে থাকতে এরিকের মোটেও ভালো লাগছে না।চারপাশে ফিনাইলের বিশ্ৰী গন্ধে পেট গুলিয়ে উঠে তার।স্যালাইন দিয়ে শরীরে পুশ করা সামান্য খাবার তার উদর ভরায় না।মেহেরিনের হাতের ঝাল আলুভর্তা আর ছোট মাছের চচ্চড়ি দিয়ে এক প্লেট ভাত খেতে পারলে তৃপ্তি পাওয়া যেতো।

এতো কিছুর মাঝে হঠাৎই এরিকের মন ভার হলো।মেহেরিন একবারো তাকে দেখতে আসেনি।হাজার হলেও ছেলে তো।এতই কি ঘৃণা জন্মেছে তার এরিকের উপর?চোখের দেখাটা পর্যন্ত দেখতে এলো না?নিজের পূর্ব কৃতকর্ম মনে পড়তেই দুচোখ ঝাপসা হলো তার।তাথৈ এর মায়াবী মুখশ্রী মনে পড়তেই হৃদয়ে কামড় দিলো।মেয়েটি কি অবস্থায় দিন পার করছে কে জানে?বাকি সকল মেয়েদের মতোই কি রেইন তাকে ট্রিট করছে নাকি সত্যিই ভালোবেসে বিয়ে করতে চাইছে?

আপন মনে নানান ভাবনা ভেবে হতাশা মিশ্রিত কন্ঠে এরিক বলে উঠলো

“যে করেই হোক তাথৈকে ভিয়ানের হাতে তুলে দিতে হবে আমার।সকল পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার এটাই উপযুক্ত পুণ্য।আর মম?হ্যা আমাকে মমের পা ধরে ক্ষমা চাইতে হবে।যেই ভুল আমি করেছি এতোগুলো বছর তার ক্ষমা প্রার্থনা না করলে পাপ মোচন হবে কি করে?

হঠাৎই পরিচিত কন্ঠের কাশির শব্দে চোখ বুঝে মরার মতো পরে রইলো এরিক।সাইফ আজমী এসেছে।এতদিন এরিক ভাবতো সাইফ আজমী তার সেবা যত্ন দেখভাল করতে আসেন।কিন্তু এতোদিন পর এরিকের চোখ খুলেছে।সাইফ আজমী মোটেও তাকে দেখতে আসেন না।উনি আসেন নিজের মাকসদ পূরণের জন্য।এরিক কে দুনিয়া ছাড়া করার বড্ড তাড়া দেখাচ্ছেন তিনি এবার।কিন্তু প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেও যেনো মানুষটি ব্যার্থ।সাইফ আজমীর ব্যার্থতায় এরিক তাচ্ছিল্য হাসে।

“কোনো বাবা কি পারে তার জন্ম দেয়া সন্তানকে আকাশের ঠিকানায় পাঠাতে?পৃথিবীতে কি সত্যিই খারাপ বাবা আছে?

সাইফ আজমী কেবিনে ঢুকতেই একজন নার্স তার সাথে এলো।নার্স তার হাতের রিপোর্টস গুলো পড়ে সাইফ আজমীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো

“পেশেন্ট এর হেলথ কন্ডিশন আগের তুলনায় ভালো।ডক্টর মেহমুদ ফয়েজ আশা করছেন খুব শীঘ্রই তার চেতনা ফিরবে।

আরো কিছু কথা বলে নার্স বিদায় নিলো।নার্স বিদায় নিতেই সাইফ আজমী তেজী স্বরে বলে উঠলো

“হেলথ কন্ডিশন ভালোর গল্প শুনতে আসি না আমি এখানে।আমি শুনতে আসি ওর মৃত্যুর খবর।সালা বাস্টার্ড ।ওদের মা ছেলে আমার জীবন নরক বানিয়ে ছেড়েছে।অন্যের সন্তানকে আর কতোদিন নিজের ছেলের পরিচয় দিয়ে বেড়াবো?ধূর্ত সেলিনা তোকে ঠিক দেখে নেবো আমি।কিন্তু তার আগে তোর ছেলেকে।

কথাগুলো বলে এরিকের বেডের কাছে এগিয়ে গেলেন সাইফ আজমী।এরপর পাশে থাকা চেয়ার টেনে বসে এরিকের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠলেন

“তোর মা খুব সুনিপুন এক গেম খেলেছে আমার সাথে জানিস?সেই গেম শেষ করতে পচিশটি বছর লেগে গিয়েছে আমার।কিন্তু যখন পুরো সত্য জেনেছি তখন করার আর কিছুই ছিলো না আমার হাতে।আমি যে কোনো দিন বাবা হতে পারবো না এটা আমি শুরু থেকেই জানতাম।কিন্তু তোর মা আমার সকল সত্য কে মিথ্যা প্রমান করে আমাকে ভুলিয়ে ছেড়েছে।আর তোর প্রেমিকা নিকি সে আরেক চতুর মেয়ে।আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা হাতানোর স্বপ্ন দেখে ছিলো।একবার দিলাম,দুবার দিলাম আর কতবার দেয়া যায় বল?সাইফ আজমীর টাকা হজম করা কি এতোই সহজ?ও প্রথম অপরাধ করেছে আমার কেবিনে আড়ি পেতে ভিয়ান নাওয়াফ কে হত্যার কারন জেনে।দেখ আজ ভিয়ান নাওয়াফ ঠিকই বেঁচে আছে কিন্তু নিকিতা রহমান আকাশের তারা হয়ে গেলো।ইশ কতো কষ্ট।চোখে সওয়া যায়না একদম ।

কথা গুলো বলতে বলতে হিংস্র হয়ে উঠলো সাইফ আজমী।এরিকের চুলের গোছা টেনে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে সাইফ আজমী বলে উঠলেন

“তোর মায়ের রূপে দিওয়ানা হয়ে জোর জবরদস্তি করে দুদিন শুয়েছিলাম।তাতেই নাকি সে তোকে পেটে ধরেছে।বাবা হবার আনন্দে সব ভুলে স্ত্রীর স্বীকৃতি দিতে চাইলাম সে মানলো না।মানবে কি করে তার যে ঘর সংসার ছিলো এটা তো জানতামই না।আরেক জনের সন্তান আমার কাধে চাপিয়ে দিব্বি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে।তোদের মা ছেলের কারনে আজ মেহেরিন আমার হাত ছাড়া।ভালোবেসে বিয়ে করলাম কিন্তু আজীবন দূরে দূরে থাকলাম।আজ মেহেরিন অন্য কাউকে বিয়ের স্বপ্ন দেখছে।আমার জীবন নরক করে মা ছেলে সুখে থাকবি তা কি করে হয়?অনেক বেঁচেছিস।এবার মর।

কথা গুলো বলেই এরিকের অক্সিজেন মাস্ক খুলে হনহন করে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন সাইফ আজমী।তার অনেক কাজ।সেলিনাকেও চূড়ান্ত শিক্ষা দিবেন তিনি আজ রাতে।এরপর বাকি রইলো সাজিদ আর মেহেরিন।তিনি কাউকে সুখে থাকতে দিবেন না।যেখানে তিনিই কখনো সুখী হতে পারেন নি সেখানে অন্যের সুখ কিভাবে সহ্য করবে সে?

**********

আজ দুদিন ধরে মেলিনাকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে এসেছে ভিয়ান।বাড়িতে আসার পরপরই তার আচরণ অনেকটাই পাল্টেছে।এখন আর হুটহাট হাইপার হচ্ছেন না তিনি।তাথৈ বেশ কৌশলেই বাগে আনতে পেরেছে তাকে।নিয়ম মাফিক তিন বেলার খাবার আর মেডিসিন সবটাই নিচ্ছেন।কিন্তু মাঝে মাঝেই নিজেকে নিজে আঘাত করছেন আর ভিয়ানের বাবা আর ছোট ভিয়ানের জন্য কাঁদছেন।হসপিটাল থেকে একজন ডক্টর তাকে দেখতে এসেছেন আজ।তাকে কয়েক মুহূর্ত অভজার্ভ করে ভিয়ান কে নিয়ে বসার ঘরে চলে গেলেন তিনি।ভদ্রলোক ডক্টর পূর্বের রিপোর্টস গুলো দেখে বলে উঠলেন

“দেখুন মিস্টার ভিয়ান মিসেস মেলিনাকে আগের চাইতে যথেষ্ট ম্যাচিউর মনে হচ্ছে আমার কাছে।আমি আগেই আপনাকে বলেছিলাম উনাকে নিজেদের কাছে রাখতে।কারন একজন পেশেন্টের কাছে পরিবার সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট মেডিসিন।কিন্তু তখন আপনি একা ছিলেন এজন্য সাহস পাননি।কিন্তু আপনার স্ত্রী খুবই ধৈর্য্য শীল মানুষ।আমার মনে হচ্ছে আপনারা দুজন মিলে চেষ্টা করে উনাকে একটু হলেও ভালো রাখতে পারবেন।যদিও এতো বড় মানুষ কে ছোট বাচ্চার মতো টেক কেয়ার করা যায়না।কিন্তু কি করবেন বলুন?মা তো তাই না?

মাঝবয়সী ব্রিটিশ ডক্টরের থেকে কথা গুলো শুনে কিছুক্ষন নীরব রইলো ভিয়ান।এরপর এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলো

“আমরা পারবো ডক্টর।মা কে ভালো রাখার জন্য যা যা করা প্রয়োজন আমরা তার কিচ্ছুটি বাদ রাখবো না।

ডক্টর হেনরি ভিয়ানের কথায় ভরসা পেলেন।হাতে থাকা হাত ঘড়িতে সময় পরখ করে তাড়া দেখিয়ে বলে উঠলেন

“আজ তবে আসি।নেক্সট কন্সাল্টেনিং এ আবার দেখা হবে।

ভিয়ান ডক্টর কে এগিয়ে দিয়ে মেলিনার ঘরে ফিরে এলো।তাথৈ এর সাথে তার বেশ সখ্যতা হয়েছে।এই সখ্যতা বেশিক্ষন টিকবে না ভিয়ান জানে।তবুও চোখের শান্তি মেলে এই টুকু দৃশ্যেই।

তাথৈ আর মেলিনার আলাপের মধ্যে ভিয়ান ঢুকে আহত স্বরে বলে উঠলো

“উইল ইউ হাগ মি ওয়ান্স মম?

ভিয়ানের কথা শুনে সামনে ফিরে তাকালো মেলিনা।এরপর কি যেনো ভাবলো।তাথৈ ভিয়ানের ছলছল চোখের পানে তাকিয়ে মনে মনে বলে উঠলো

“এবারো বুঝি মানুষটা ভাঙা হৃদয় নিয়ে এই ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে।

কিন্তু তাথৈকে ভুল প্রমাণ করে মেলিনা নিজের দুই হাত মেলে ধরে মাথা দিয়ে ভিয়ান কে বুকে আসার আহ্বান জানালো।মেলিনার আহ্বান পেতেই ছোট অবুঝ শিশুর ন্যয় লাফিয়ে মেলিনাকে জাপ্টে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ভিয়ান।

“বুকটা যে হাহাকার করছিলো মম এতগুলো বছর।আজ যে একটু শান্তি পেলাম।তুমি কি সত্যিই আমাকে ভুলে গিয়েছো?আমি ভিয়ান।তোমার লিটল ভিয়ান।কবে তুমি আমাকে স্বেচ্ছায় এভাবে বুকে টেনে নেবে?আমি যে আর শক্ত থাকতে পারছি না মম।বুকটা যে ভেঙে যায় অসহনীয় যন্ত্রনায়।

মেলিনা ভিয়ানের মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে উঠলো

“পাপা এলে সব ঠিক হয়ে যাবে।হুম?ডোন্ট ক্রাই।

ভিয়ান আর কোনো কথা বলে না।মেলিনার কাঁধে থুতনি রেখে মায়ের গন্ধ আর ভালোবাসা শুষে নিতে চোখ বন্ধ করে পরে থাকে।ঊনত্রিশ বছরের আদর কি এক দিনেই শেষ হবে?

***********
নিজের মৃত স্বামীর ছবি বুকে জড়িয়ে কেঁদে বুক ভাষাচ্ছেন সেলিনা।মনে তার হাজারো ব্যথা।যেই ব্যথার খবর না কেউ জেনেছে না জানতে চেয়েছে।
প্রেম করে বিয়ে করে ছিলেন সেলিনা আর ইমদাদ।ইমদাদ পেশায় ছিলেন একজন কার ড্রাইভার।ভালোবাসার ছোট সংসার খুব ভালোই চলছিলো।বিয়ের মাস ছয় না যেতেই এক্সিডেন্ট এ ইমদাদ তার দুটো পা হারায়।এদিকে সেলিনার তিন কুলে কেউ ছিলো না।ইমদাদ অসুস্থ হলে সেলিনার সংসারে চুলায় হাঁড়ি চড়ানো বন্ধ হলো।শূন্য উদরে কতদিন চলা যায়?খিদের তাড়না সইতে না পেরে পরিচিত এক আত্মীয়ের মাধ্যমে সাইফ আজমীর অফিসে অল্প বেতনের চাকরি নেন সেলিনা।লেখাপড়া জানা সেলিনা নিজেকে যথেষ্ট সেফ রেখে চাকরি আর সংসার দুই ই সামলাতো।হঠাতই একদিন সাইফ আজমীর নজর পড়ে যায় সেলিনার উপর।প্রথমে সেলিনা বুঝেও না বুঝার ভান করতো।এদিকে সাইফ আজমী নিজের নোংরা বাসনার ইঙ্গিত দিতে লাগলো।চাকরি ছাড়লে পঙ্গু স্বামী নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে ভেবে সেলিনা মাটি কামড়ে সাইফ আজমীর অফিসেই পরে রইলো।হঠাৎ একদিন সেলিনা সাধারণ ডেস্ক অপারেটর থেকে সাইফ আজমীর পি এ হয়ে গেলো।অফিসে এটা নিয়ে শুরু হলো গুঞ্জন।না চাইতেও সেলিনার নামের সাথে জুড়ে গেলো দেহ ব্যাবসায়ী শব্দটি।লজ্জায় ঘৃণায় সেলিনা অফিসে আসা বন্ধ করলো।এদিকে ফোনে চলতে লাগলো সাইফ আজমীর হুমকির পর হুমকি।এক পর্যায়ে সেলিনাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিলেন সাইফ আজমী।সেলিনা মরে গেলে ইমদাদ এর কি হবে এটা ভেবে আবার কাজে যোগদান করলেন সেলিনা।একদিন অফিসের কালচারাল পার্টিতে মদ্যপ সাইফ আজমী টেনে হিচড়ে সেলিনাকে নিয়ে নিজের কেবিনে চলে গেলেন।সেলিনার চিৎকার আর আকুতি মাইকের জোড় গানের শব্দে কারো কানে গেলো না।নিজের লালসা মিটিয়ে সেলিনাকে ছুড়ে ফেলে বেরিয়ে এলেন সাইফ আজমী।এরপর সুযোগ পেলেই সেদিনের ঘটনা ফাঁস করে দেবার ভয় দেখিয়ে সেলিনাকে নিজের ভোগ্যবস্তু করলেন সাইফ আজমী।কিন্তু ততদিনে ইমদাদ এর সন্তান সেলিনার পেটে।
এরিক যখন সাত মাসের পেটে হঠাতই ইমদাদ পেট ব্যথা আর রক্ত বমি শুরু করেন।হসপিটালে নিয়ে গেলে ডক্টর প্রাথমিক চিকিৎসা দিলেও অবস্থার কোনো উন্নতি হয়না।এক পর্যায়ে খিঁচুনি আরম্ভ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ইমদাদ।ভালোবাসার স্বামী বিয়োগ অপরদিকে অনাগত সন্তান সেই সাথে দিনের পর দিন নিজের সম্ভ্রম হানি।সব মিলিয়ে দিশাহীন হয়ে উঠেন সেলিনা।শেষ পর্যন্ত নিজের ছেলের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য সেলিনা মিথ্যের আশ্রয় নেন।সাইফ আজমিকে চেপে ধরে মিথ্যে অভিনয় করে জানায় তার গর্ভের সন্তান সাইফ আজমীর।সন্তানহীন সাইফ আজমী খুশিতে গদগদ হয়ে সেলিনাকে ঘরে তুলতে চান।কিন্তু মেহেরিনের সংসার ভাঙতে চাননি সেলিনা।সাইফ আজমিকে প্রত্যাখ্যান করে সেলিনা রূপ বদলান।সাইফ আজমির পাপ কর্মের প্রমান জোগাড় করে একের পর এক ব্ল্যাকমেইল করে নিজেকে সাইফ আজমীর নোংরা হাত থেকে বাঁচানোর পথ খুজেঁন।এভাবেই একদিন সেলিনা সাইফ আজমীর থেকেও চৌকশ খেলোয়াড় এ পরিণত হয়।কিন্তু নিজের সর্বস্ব খুইয়ে দেন।একমাত্র ছেলের প্রেমিকা নিকিতা কে গুলি করে হত্যা করেন সাইফ আজমী।সেলিনা এটা জেনেও চুপ ছিলেন কারন নিজের ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে চাননি তিনি।কিন্তু তার এখন মনে হচ্ছে সাইফ আজমী সমস্ত সত্যি জেনে গিয়েছেন।এরিক তার সন্তান নয় এটাও জেনে গিয়েছে সাইফ আজমী।সাইফ আজমীর ভাব ভঙ্গিমা কিচ্ছুটি স্বাভাবিক ঠেকছে না সেলিনার কাছে।সুযোগ পেলেই এরিক বা তার উপর আক্রমণাত্মক হামলা করবেন সাইফ আজমী এটা খুব ভালোই টের পেয়েছেন সেলিনা।সাইফ আজমী কিছু করার আগেই মরন কামড় দেবে সেলিনা।নিজের হাতের সমস্ত প্রমান নিয়ে আদালতে যাবে সে।এবার সাইফ আজমীর পাপের সাম্রাজ্য গুঁড়িয়ে দেবেন তিনি।অনেক চুপ থাকা হয়েছে আর নয়।

সেলিনার ভাবনার সুতো ছিড়লো আকস্মিক কলিং বেলের শব্দে।হাতের ছবি খানা ঠিক জায়গায় রেখে উঠে দাঁড়াতেই ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলো।পুনরায় ঠক ঠক করে কড়া নাড়ার শব্দ হলো প্রধান দরজায়।দিয়াশলাই আর মোম খুঁজতে খুঁজতে সেলিনা উচ্চ আওয়াজে শুধালো

“কে ওখানে?

#চলবে…..