বড়োজা পর্ব-০২

0
889

#বড়োজা
#Nadia_Afrin


আমার ছয় বছরের ছেলেটা বোনকে বুকে চেপে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে।
পেছনের কুকুরগুলো তাদের ধাওয়া করেছে।
আমি দৌড়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলাম।

আমায় দেখে কুকুরগুলো উল্টো পথে চলে গেল।ছেলে ভয়ে কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না।
জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে।
মেয়েটা গগনবিদারী চিৎকার করছে।নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে আমার।
মেয়েকে কোলে নিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলি,”শান্ত হও বাবা।আম্মু চলে এসেছে।আর কোনো ভয় নেই তোমার।
কুকুর গুলো কী তোমায় কামড়েছে?
ধাওয়া কেন করল তোমাদের?”

“আমি জানিনা আম্মু।
আমি তো আপুকে নিয়ে বসেই ছিলাম,হঠাৎ কোথা থেকে কুকুর গুলো এসে আমাদের দিকে তেড়ে আসে।
আমি ভয় পেয়ে আপুকে নিয়ে দৌড়েছি।
আমার কোথাও লাগেনি।
তুমি আর আমাদের রেখে যেও না কেমন!
আমার ভীষণ ভয় করছে।”

আমি ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বললাম,”আর ভয় নেই।আম্মু আছে তো।
চলো আমরা নতুন বাড়ি যাই।আজ থেকে আমরা নতুন বাড়ি থাকব।”

ছেলেকে নিয়ে সেই বাড়ির কাছে গেলাম।
গিয়ে দেখি বাড়িওয়ালা দরজাতেই দাড়িয়ে আছে।
আমাদের দেখে এগিয়ে এলো সে।মেয়েকে কোলে নিয়ে বলল,”বাহ ভারী মিষ্টি মেয়ে তো তোমার!
এমন চান্দের টুকরা ছেলে,মিষ্টি মেয়েকে কীভাবে ছেড়ে দিল তোমার স্বামী!”

আমি জবাব দিলাম না কোনো।উত্তর দেওয়ার মতো কোনো কথাও নেই।

বৃষ্টির বেগ বাড়ছে ক্রমাগত।
সময় নষ্ট না করে বাড়িওয়ালা খালার থেকে একটি ঝাটা চেয়ে এনে ঘরটা পরিষ্কার করতে লাগলাম।
কী যে বিশ্রি গন্ধ!ঝাড় দিতে দিতে দু-বার বমিও করেছি।
কোনো মতে ঘরখান পরিষ্কার করে ভাবতে লাগলাম,এই মাটির মেঝেতে দুটো ছেলে-মেয়ে নিয়ে শুই কীভাবে?
ভাঙা বেড়ার ফাক গলিয়ে বৃষ্টির পানি ছিটছে ঘরে।
অল্প সময়ের মাঝেই হয়ত ঘরটা কাঁদা কাঁদা হয়ে যাবে।
আমার এমতাবস্থায় বাড়িওয়ালা খালার হয়ত মায়া হলো কিছুটা।
তার রান্নাঘর থেকে দুটো প্লাষ্টিকের চট মতো এনে দিল।
ঘরের এককোণে সেগুলো বিছিয়ে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে বসলাম।
খালার দিকে কৃতজ্ঞতা স্বরুপ তাকিয়ে বললাম,”আপনায় ভীষণ ধন‍্যবাদ খালা।এই বিপদের সময় আপনি আমায় সাহায্য করলেন।”

সে পান চিবিয়ে বলল,”তা করলাম ঠিক আছে।
বস্তা দুটো তুমি রেখে দিতে পার।দুটোর দাম হিসেবে আমায় বিশটাকা দিও।”
তোমার ছেলের খিদে পেয়েছে নিশ্চয়।
সাথে তো কিছুই নেই তোমাদের।দোকান ও সব বন্ধ।
আমার ঘরে একটা রুটি আছে।দিয়ে যাই খেয়ে নাও।ওটার দাম দিতে হবে না সমস্যা নেই।”

তিনি চলে গেলেন রুটি আনতে।
আমি শুধু ঝিম ধরে বসে রইলাম।ভাবার মতো বিষয়টিও খুঁজে পাচ্ছিনা।

খালা একটাই রুটি আনলো সত্যি করে।তাও সেই রুটি প্রচন্ড শক্ত ও পিপড়ে ধরা।না জানি কতোদিন ঘরে রেখেছিল।

রুটি দিয়ে চলে গেলেন তিনি।
ছেলে কামড় দিয়ে রুটির এক টুকরোও ভাঙতে পারল না।
আমার দিকে ফ‍্যালফ‍্যাল করে তাকিয়ে রইল।
বলল,”এটা আমি খাব না আম্মু।তুমি না দুপুরে বাড়িতে চিকেন রান্না করলে রাতে খাওয়ার জন্য।
আমি চিকেন খাব।
আমায় বাড়ি নিয়ে চলো।চিকেন খেয়ে আবার এখানে আসব।”

আমি কিছুটা কড়া গলায় বললাম,”ঐ বাড়ি আর আমাদের নয়।ওখানকার খাবার উঠে গেছে আমাদের ভাগ্য থেকে।
আমি পানি এনে দিচ্ছি।তুমি ফোনের টর্চটা বাইরে ধরে থাকবে।”

মেয়েকে শুইয়ে দিয়ে বৃষ্টিতে ভিঝেই টিউবওয়েলের কাছে গেলাম।রুটির বাটিটি নিয়ে গেলাম পানি আনতে।
এতো শক্ত টিউবওয়েল যে বলে বোঝানো যাবেনা।
যতো চাপছি নোংরা পানি বের হচ্ছে।সম্ভবত অনেকদিন ব‍্যবহার করা হয়নি এটি।
প্রায় আধঘন্টা টিউবওয়েল চেপে স্বচ্ছ পানি বের করলাম।
পেটের একদিক ব‍্যাথা করছে রীতিমতো।

ছেলেকে সেই পানি দিয়ে রুটি টুকরো করে ভিজিয়ে খাইয়ে দিলাম।খেতে চায়না বেচারা।
তবুও খেল পেটের দায়ে।

এবার ঘুমোনোর পালা।
ছেলে বলছে,”কোথায় ঘুমাব আমি?বালিশ নেই।বেড নেই।কোথায় ঘুমাব?”

আমি সামান্য হেসে বলি,”মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাও।বালিশ লাগবেনা।”

অবুঝ ছেলে আমার তাই করল।
রাত বাড়তে লাগল। বৃষ্টি বাড়ছে।সেই সঙ্গে প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস।
শরীর আমার কেঁপে কেঁপে উঠছে।
এক সাইটের প্লাষ্টিক কাগজের বেড়া উড়ে যাচ্ছে বাতাসে।বিদ‍্যুৎ চমকাচ্ছে সেই সঙ্গে।
ওদিকে জঙ্গল।বাজের আলোয় স্পষ্ট জঙ্গল দেখা যাচ্ছে।মনে হচ্ছে এই বুঝি কোনো হিংস্র জন্তু ঘরে ঝাপিয়ে পড়ে।
দোয়া-দরুধ যা পারি পরছি।
ছেলে শীতে আমার বুকের মাঝে ঢুকে পড়ছে যেন।মেয়েটাকে বুকে চেপে বসে আছি।
হাত-পা নিজেরই অবশ লাগছে।

সারারাত কেঁদেছি আমি।
কোথায় দুতলা বাড়ি ছিল আমাদের।ছেলে-মেয়ের আলাদা বেড।কতো সৌখিনতা ও সুন্দর জীবন ছিল।
আজ কীনা সেই ছেলে-মেয়ে দুটোই শীতে কাঁপছে।পোলাও,মাংসের বিপরীতে অন‍্যের দেওয়া শুকনো রুটি।
মা হয়ে এত দুঃখ আর সহ‍্য হচ্ছেনা আমার।
কিছু একটা ব‍্যবস্থা করতেই হবে আমায়।

ভোররাতে দু-চোখ একটু লেগেছে আমার।
সকালে খালার ডাকে ঘুম ভাঙে।
পা নিয়ে আর উঠে দাড়াতে পারছি না আমি।ব‍্যাথায় ছিড়ে যাচ্ছে।একটানা সারারাত বসে থেকেছি।
তবুও উঠলাম কষ্ট করে।খালা বলল,”বিশটাকাটা নিতে এলাম।
আমার আবার একটু বাজারে যেতে হবে।”

মনে মনে বলি,আমার এই বিশটাকার জন্য আপনার বাজার আটকে থাকবে!
পার্স থেকে একশত টাকার একটি নোট বের করে দিয়ে বললাম,”বিশটাকা আপনি রাখুন।
আর আমার ছেলেটার জন্য একটা পাউরুটি এনেদেবেন।”

তিনি টাকা নিয়ে চলে গেল।

ছেলেকে টিউবওয়েলের কাছে নিয়ে বললাম মুখ ধুয়ে নাও।আজ আমরা বাড়ি যাব।

ছেলে আমার মহা খুশি।
আসলে বাড়ি যাব আমার কাগজপত্র গুলো নিতে।
যদিও খুব একটা আশা ভরসা নেই।তবুও চেষ্টা করতে চাই।
সামান্য এস.এস.সি সার্টিফিকেট দিয়ে কী কিছু সম্ভব?
হাল ছাড়া যাবেনা না।চেষ্টা করলে ক্ষতি কী?

খালা পাউরুটি এনে দিলেন।বাকি টাকা আমার হাতে দিলেন।
আলিফ অর্থাৎ আমার ছেলেকে পাউরুটি খাইয়ে মেয়েকে ফিডিং করিয়ে রওনা হলাম।
ব‍্যাথা পা নিয়ে হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল।তবুও গেলাম হেঁটে হেঁটেই।

বাড়ি গিয়ে দেখলাম পরিবেশ অন‍্যরকম।
আকাশের পরণে লাল টকটকে পাঞ্জাবী।ক্লিন সেভ করেছে।চুল স্টাইল করে কাঁটা।গায়ে কড়া পারফিউম।
শাশুড়ির পরণেও নতুন শাড়ি।বড়োজার হাতা কাঁটা ব্লাউজ,জর্জেট শাড়ি।মুখে ভারী মেকআপ।
জায়ের তিন ছেলে মেয়ে।বড়োমেয়েটার বয়স বারো।সেই মেয়েটিরও প্রচুর সাজ।হাঁটাচলা,কথাবার্তা দেখলে মনে হয় কলেজে পড়ে।এতো স্টাইল।

আমি দরজার কাছে দাড়াতেই আকাশ তেড়ে এলো।
ছেলে দৌড়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,”দেখ বাবা আমরা চলে এসেছি।তুমি কী আমাদের মিস করেছ?”

আকাশ পশুর মতো আমার ছেলেটাকে দূরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল।
ছেলে আমার কিছু বলল না।এমন ব‍্যবহার সে আগেও পেয়েছে বাবার থেকে ।আমি বলতাম,বাবার মন খারাপ তাই এমন করছে।মন ভালো হলে তোমায় আদর করবে।

ছেলে এবারেও তাই ভাবলো।
দৌড়ে ঘরে চলে গেল আমাদের।

শাশুড়িমা এগিয়ে এসে বলল,”এইনা বললে কাবিনের টাকা নেবে না।ঠিক ভিক্ষুকের মতো চলে এসেছ হাত পাততে।”

বড়োজা তার মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলল,”মা রশ্মি কখান হাড় এনে কুকুরটার মুখে ছুড়ে মার তো।”

আমি চেচিয়ে বললাম,”কুকুর তো আপনি।
আপনার স্বভাবটাও কুকুরের মতো।আমি এখানে টাকা নিতে আসিনি।আমার কিছু কাগজপত্র রয়ে গেছে এখানে সেগুলো নিতে এসেছি।”

আকাশ বিশ্রি ভাষায় বলল,”কেন রে?নতুন নাগর ধরতে যাবি নাকি?
তোর কাগজ নেওয়াচ্ছি আমি।”

ঘর থেকে একটি ফাইল আনে সে।এটাতেই রয়েছিল সব।
আমার চোখের সামনে সব পেপার্সগুলো আগুন লাগিয়ে দেয়।
বাধা দিতে গেলে বড়োজা থাপ্পড় বসায় আমার গালে।তার মেয়ে রশ্মি আমার চুল ধরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।
মেয়ে কোলে আমার।কোনোমতে বাঁচি।

আমি পুলিশের কাছে যাওয়ার কথা বলি।আকাশ হাসতে হাসতে বলে,”যাবি যা।ছেলে-মেয়ে দুটোকেই হারাবি।বলব তুই নোংরা।নাগর নিয়ে ভেগেছিলি।
আমার দুজন মামা পুলিশ।কেস কীভাবে ঘুরিয়ে দিতে হয় তা তারা জানে।
আর খানায় গিয়ে কেস লড়তে টাকা লাগে।টাকা আছে তোর কাছে?
তোর মুখের কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।তোর বিপক্ষে আমি একশ জন দাড় করাব।দেখি তুই পারিস কী করে!
ছেলে-মেয়ে দুটোই কেড়ে নেব আমি।
এর কদিন পর শুনবি ছেলে পানিতে ডুবে মরেছে,মেয়ে হারিয়ে গেছে।”

“তোর লজ্জা হয়না?
নিজ সন্তানকে হত‍্যা করতে চাস।”

“কিসের সন্তানরে?সন্তান সন্তান করে আমার ভবিষ্যৎ নষ্ট করব নাকি?
জীবনে কোনো ইনজয়ই করতে পারিনি এইসব ঝামেলা পালতে গিয়ে।
অথচ আমার জীবনে এখনো কতোকিছু বাকি।
আমি এসবের কথা চিন্তা করে আমার সুখ বিসর্জন দিতে পারব না।
এখন আমার ওড়ার সময়।মহল্লার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে আমার বউ হবে।আমার হবু শশুর আমাদের হানিমুনের জন্য কানাডার টিকেট ও করে দিয়েছে।
ইনজয় করব সুন্দরী বউ নিয়ে।সারা জীবন বসে যাওয়ার জ‍্যাকপট পেয়ে গেছি আমি।
আমার শশুর আমার মুখ দেখে আইফোন দিয়েছে।
বিয়েটা হবে সবচেয়ে বড়ো সেন্টারে।কত নামিদামি লোক আসবে জানিস?
তোর সঙ্গে থাকলে এসব পেতাম?সারাজীবন গাধার খাটুনি খেটে তোদের পালতে হতো আমার।জীবনে শখ-আল্লাদ ছিল না।
এবার আমি সব পাব।”

“তোর মতো কাপুরুষের শেষ পরিণতি যেন ভয়ংকর হয়।
আমি তন্নি ফিরব অবশ্যই।তোর চেয়ে তিনগুণ ধনী হয়েই ফিরব।
এই এতিমের ভাগ্য সে নিজেই এবার পরিবর্তন করবে।
যেই মরিচিকার পেছনে তুই ছুটছিস তা তোকে ধ্বংস করে দিবে।
আজ আমি এতিম বলে আমায় রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিলি না?একদিন সময় আসবে,এই এতিমের পায়ে পড়বি তুই।
আবর্জনা বলে যেই সন্তানদের মেরে তাড়িয়ে দিলি,সেই সন্তানের জন্য হাহাকার করবি তুই।
জীবনে অর্থ পাবি,কিন্তু সুখ-শান্তি পাবিনা তুই।”

আকাশ বলে,”টাকা থাকলে সুখ আপনাআপনি আসবে।”

শাশুড়িমায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,”ছোট থেকে মায়ের আদর পাইনি।আপনাকে মা বলে মেনেছি।বড়ো বউমার টাকার কাছে আজ আপনারা আমায় ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিলেন।
এ পথ থেকে উঠব আমি অবশ্যই।ভাববেন না মরে যাব।আপনাদের চূড়ান্ত পরিণতি দেখতে আমাকে থাকতেই হবে বেঁচে।দেখবেন,শেষকালে এই নাতী-নাতনি একমাত্র অবলম্বন না হয়।
যেদিন আমার সময় আসবে,একই ভাবে আকাশকে ছুড়ে ফেলব আমি।”

ওদিকে আমার ছেলেটা নিজের বাড়ির টেবিল মনে করে একগ্লাস জুস হাতে নিয়েছে সবে।
আকাশ ধেয়ে যেয়ে ছেলের হাত থেকে ছো মেরে গ্লাস কেড়ে নেয়।
বাচ্চার হাত ধরে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়।
মাটিতে পড়ে হাটু ছিলে কান্না করতে লাগে আমার ছেলে।
আমার সইতে না পেরে একটি ইটের টুকরো উঠিয়ে আকাশকে নিক্ষেপ করি।
আকাশের হাতে লাগে তা।
শাশুড়িমা চিৎকার করতে লাগে।
আমি নাকি তার বাড়ি এসে তাদের মারধর করছি।

প্রতিবেশিরা এগিয়ে আসে।
আমার হাতে আরেকটি ইট ছিল তখন।
বড়োজা তার আটবছরের ছেলে ও মেয়েকে হাতে আচড় কেঁটে রক্ত বের করে বলে,আমি নাকি তার ছেলে-মেয়েকে মেরে রক্তাক্ত করেছি।
ওদের বাড়ির দলিল পুড়িয়ে দিয়েছি।আকাশকে ইট মেরেছি।শাশুড়ির চুল ধরেছি।এসব করেছি কাবিনের টাকার জন্য।তারা নাকি কালই আমায় টাকা দিত।আমি আজ চাইতে এসে তাদের মেরেছি।

কজন মহিলাতো বিশ্বাস করেই নিল সবটা।

আমায় বের করে দেওয়ার পর তারা এলাকাতে ছড়িয়েছে আমি ঝগড়া করে প্রেমিকের সঙ্গে চলে গেছি।
বাচ্চা দেখে প্রেমিকও আমায় তাড়িয়ে দিয়েছে।
আমার দেওয়া দুঃখ নাকি সইতে না পেরে আকাশকে আজই জোর করে বিয়ে দিচ্ছে আমার বড়োজার বোনের সঙ্গে।
মহিলাগুলো ওদের কথাই বিশ্বাস করেছে।কেননা আমার শাশুড়ি শুরু থেকেই আমার নামে নিন্দা করত,মিথ‍্যে বলত তাদের কাছে।
এদিকে আমি তেমন বাড়ি থেকে বের হতাম না আর তাদের সাথে কথাও বলতে দিত না আকাশ তাই সত‍্য কখনো সামনে আসেনি।

আমায় নিয়ে ছি-ছিৎকার শুরু হলো।
খুনি,ডাকাত থেকে শুরু করে যা তা বলতে লাগল আমায়।
দু-তিনজন আবার আমার পক্ষেই বলছে।
বলেই বা লাভ কী?

আমাদের বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া এক ভাবির বাড়ি।
ভীষণ ভালো তিনি।নামাজি,পর্দাওয়ালি একজন নারী।
আমার সঙ্গে তারই একটু আধটু কথা হতো।
সে জানত আমার অবস্থা সম্পর্কে।

তিনি আমায় পাশে দাড়ায়।
ছেলেকে উঠিয়ে কোলে নেয়।
আমাকে নিয়ে তার বাড়ির আঙিনায় নিয়ে যায়।

একটা চেয়ারে বসিয়ে বলে,”তন্নি তুমি চলে যাওয়ার পর তোমার শাশুড়ি কেঁদে কেটে সবাইকে মিথ‍্যা রটিয়েছে।
তুমি নাকি পরপুরুষের সঙ্গে বহুবার ধরা পরেছ।এবং তোমার মেয়েও নাকি আকাশের সন্তান না।
আরো অনেক কথা হয়েছে।
তোমার শোকে নাকি আকাশ ভাই মরতে যাচ্ছিল।সে তোমাকে ভীষণ ভালোবাসত।তুমি তাকে ঠকিয়েছ।
তোমার বড়োজা তখন জনদরদী সেজে বলেছে,তার অবিবাহিত বোনের সঙ্গে আকাশ ভাইয়ের বিয়ে দিয়ে আকাশ ভাইয়ের সম্মান বাঁচাবে।
আসলে এগুলো সবই মিথ‍্যা।আকাশ ভাইয়ের সঙ্গে তার বোনের বিয়ে দিতেই এতো কিছু করেছে সে।
তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভাঙন সেই ই ধরিয়েছে।
যা হওয়ার হয়েছে।তোমায় ঘুরে দাড়াতে হবে বোন।
আমি চাইলেই আমার কাছে রাখতে পারব না তোমাদের।
আমিও একজনের সংসারে অধিনস্ত।তাদের মত ছাড়া কিছু করা সম্ভব নয়।
তবে তোমায় একটা সাহায্য করব।”

তিনি তিনটি ব‍্যাগ এনে আমার হাতে দিয়ে বললেন,”এগুলোতে তোমার আর বাচ্চাদের পোশাক আছে।আকাশ ভাইয়ের মা সব ফেলে দিয়েছে যাতে নতুন বউ এলে কোনো সমস্যা না হয়।
আমি সব তুলে এনে গুছিয়ে রেখেছি।
তাড়াহুড়োর মাঝে ওরা হাজার দশেক টাকাও ফেলে দিয়েছিল না দেখে।
সম্ভবত এই টাকাটা তোমার গোছানো।তোমার মেয়ের জামার ভাজে ছিল তাই তারা দেখেনি।
আমি টাকা গুলো সহ সবকিছু দিয়েছি এই ব‍্যাগে।সঙ্গে কিছু হাড়ি-পাতিল ও দিয়েছি।তোমার এই কঠিন সময়ে এসব কাজে লাগবে।
শূন্য হাতে তাড়িয়েছে তোমায়।
পূর্ণ হাতে ফিরবে।এই এলাকাতে আর কখনো এসো না তুমি।
কজন ছেলেকে লেলিয়ে দিয়েছে ওরা তোমার পিছে।তোমায় এখানে দেখা মাত্র যেন সর্বনাশ করে।
আমি আড়াল থেকে একথা শুনেছি।কিন্তু প্রমাণ নেই কাছে,ছেলেগুলোকেও চিনিনা।তাই কিছু করতে পারলাম না।
তুমি চলে যাও দ্রুত।
কেউ দেখলে আবার ঝামেলা করতে পারে।
খাবার আছে ব‍্যাগে।আর কিছু ঔষধ।ছেলেকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেও।”

আমি একহাতে ভাবীকে জড়িয়ে ধরি।সে একটা রিক্সা ডেকে আমাদের উঠিয়ে দেয়।

আকাশ আমার চোখের সামনে দিয়ে বিয়ে করতে চলে যায়।
কী হাসি তার মুখে।ছেলে নিয়ে রিক্সাতে বসে এ দৃশ্য দেখি আমি।
ছেলে বাবা বাবা বলে পিছু ডাকে কতোবার।
আকাশ ফিরেও তাকায় না।

অভিমানে ছেলে আমার বলে,”বাবা বাজে বাবা।
আমি আর কোনোদিন বাবার কাছে যাব না।
এই বাড়িতেও আর আসব না।চিকেন ও আর খাবনা।
আমি তোমার সঙ্গে ঐ নোংরা ঘরেই থাকব আম্মু।”

ছেলেকে নিয়ে বাড়ি এলাম।
রিক্সাওয়ালা ব‍্যাগগুলো নামিয়ে দিল।আমি ভাড়া দিতে চাইলাম।তিনি নিল না।
বলল,”তোমার কাছে টাকা নিয়ে নিজের বিবেকের কাছে ছোট হতে পারব না মা।
আমি তোমার বাবার বয়সি।
সাহায্য না করতে পারি,ভালো তো চাইতে পারি।
তোমার জন্য দোয়া রইল মা।
ঐ ধনীদের মুখের ওপর জবাব দিতে হবে তোমায়।”

একথা বলে তিনি চলে গেলেন।
ব‍্যাগ নিয়ে ঘরে রেখে মেয়েকে ছেলের কোলে দিয়ে মুখে একটু পানির ঝাপটা দিলাম।ঝড় বয়ে গেছে আমার মনের ওপর দিকে।
শাড়ির আচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ঘরে আসছি এমন সময় দেখলাম,খালা আমার ব‍্যাগপত্র সব খুলে খুলে দেখছে।
ব‍্যাগ থেকে টাকা বের করে গুণছে।

আমি ভীষণ অবাক হলাম।আমার টাকা সে গুনছে কেন?

আমায় দেখতেই টাকাগুলো ব‍্যাগে রেখে বলল,”এতোগুলো জিনিস কোথায় পেলে?
গেছিলে তো স্বামীর বাড়ি থেকে কাগজপত্র আনতে।
এতোটাকা,নতুন কাপড় কই থেকে পেলে?তোমার স্বামী তো তোমাদের খালিহাতে বের করে দিয়েছে।এগুলো নিশ্চয় তারা দেয়নি।দিলে কালই দিত।তাহলে এগুলো পেলে কই?
চুরি টুরি করে আনলে নাকি?”

চলবে।