বড়োজা পর্ব-০৩

0
946

#বড়োজা
#Nadia_Afrin


বাড়িওয়ালা খালা আমার অবর্তমানে আমার ব‍্যাগ দেখছে,আমার টাকা গুণছে।আবার আমাকেই বলছে চুরি করে এনেছি কিনা!
বিষয়টি আমার কেমন যেন লাগল।

এগিয়ে এসে জবাব দিলাম,”চুরি কেন করব খালা?এগুলো আমার আর আমার বাচ্চাদের জামাকাপড়।
আমার স্বামী নতুন বিয়ে করছে,তাই ফেলে দিয়েছিল সব।
এক প্রতিবেশি ভাবী উঠিয়ে রেখেছিল।
আর টাকাগুলো আমার নিজের জমানোর।
আমি হাঁস,মুরগি,কবুতর পালন করতাম।সেগুলোর ডিম বিক্রি এই টাকা গুলো জমিয়েছিলাম।”

খালা আর কিছু বলল না।
উঠে দাড়িয়ে কী যেন ভাবলেন।এরপর বললেন,”তুমি হয়ত জানো না আমার দুই ছেলে বিদেশ থাকে।
তুমি এলে ঝড়-বৃষ্টির রাতে,নেটওয়ার্ক সমস্যা ছিল তাই ছেলেদের জানাতে পারিনি বিষয়টি।
আজ বললাম,ছেলেরা আমায় প্রচুর বকাবকি করছে।বলছে পুরো মাসের ভারা এ‍্যাডভান্স না নিয়ে কেন ভারা দিয়েছি তোমায়।
শহর দিয়ে নাকি দু-তিন মাসের ভারা আগে নিয়ে
নেয়।
আমি আবার ওতো নিষ্ঠুর মানুষ না।
তোমার খারাপ সময় চলছে তাই মায়া হয় ভীষণ।
তিনশ টাকা দিয়েছ বাকি চারশ দাও এখন।আমার আবার সবজি কিনতে হবে।”

এর কথা শুনে আমার একমন বলেই উঠল,যেই না ঘর তার আবার এ‍্যাডভান্স।

পরক্ষণে নিজের মনকে বোঝালাম,ঘর যেমনি হোক,এটাই বর্তমানে আমার ঠিকানা।
আমার বিপদে সাহায্য করেছেন তিনি।
আমায় আশ্রয় দিয়েছে।তাই ছোট করা উচিৎ নয়।

একটা হাজার টাকার নোট হাতে দিয়ে বললাম,”এখান থেকে রেখে দিন।বাকি ছয়শত টাকা ফিরিয়ে দিয়ে যাবেন।”

তিনি টাকাটা ঘুরে ফিরে দেখল।
এরপর বলল,”আচ্ছা তন্নি তুমি কী লাইট নেবে একটা ঘরের?
ছোট ছেলে-মেয়েকে নিয়ে থাকবে,লাইট একটা প্রয়োজন।
আমিই লাইট দেব।লাইন করা আছে কারেন্টের।
শুধু লাইট এনে লাগিয়ে দিলেই হবে।
বিল হিসেবে তুমি আমায় মাসে পাঁচশ দিও।
এইখান থেকে তো ছয়শ ফেরত পাবে।আমি বরং পুরো টাকাটাই নিয়ে নেই।পাঁচশ কারেন্ট বিল,একশ লাইট কেনার টাকা।
তোমার উপকারই হবে।ভেবে দেখতে পার।”

“এই মূহুর্তে আমি ভীষণ অভাবের মাঝে আছি খালা।
ঐ একহাজার টাকা আমার কাছে লাখ টাকার সমান।একদিনে হাজার টাকা খরচ করার মতো পরিস্থিতি নেই।
আর সামান্য একটা লাইটে পাঁচশ টাকা কারেন্টবিল কখনোই হয়না।
১৫০/২০০ হলে তাও হয়।
আমি আপনাকে ২০০ টাকার বেশি দিতে পারব না।লাইটের জন্য একশ দেব সমস্যা নেই।
এতে যদি হয় তোহ দিন।নাহলে অন্ধকারেই থাকব ছেলে-মেয়েদের নিয়ে।
জীবন আমার এমনিতেই অন্ধকারে ছেয়ে গেছে।একটা বাতি দিয়ে কী আর জীবনের আলো ফিরে পাব!”

তিনি আবারো বললেন,”ঠিক আছে।ওতো কথা বলতে হবেনা।
দুইশ টাকাই দিও।মাঝে মধ্যে পঞ্চাশ,একশ বেশি দিও।
তুমি বাবা খুব হিসেবে।আর একটু কিপটে স্বভাবেরও।এতো হিসেব করে জীবন চলে নাকি!”

আমি আর জবাব দিলাম না কোনো।

খালা চলে গেল।
ফেরত টাকা একটা বাচ্চাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিল।

ছেলের ক্ষিদে পেয়েছে।সেই কোন সকাল একটা পাউরুটি খেয়েছে।
বাবার কাছে গিয়েও খেয়েছে।তবে সেটা মার।

আমার কাছে খাবার চাইল।
ব‍্যাগে ভাবী কিছু খাবার দিয়ে দিয়েছিল।মুরগির মাংস আর ভাত।
মাংস দেখে ছেলে আর খাবেনা।
মাংসভাত খেতেই বাবার কাছে গিয়েছিল,বাবা মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে।
এখন যদি আবার এখানে এসে মারে বাবা।

আমি ছেলেকে বুকে নিয়ে বলি,”কেউ মারবেনা ।
আম্মু বেঁচে থাকতে আর কেউ কিছু বলবেনা।
তুমি নিশ্চিন্তে খাও।”

ছেলেকে খাইয়ে দিয়ে বাকিটা বাটিতেই রেখে দিলাম।রাতে আবার খাওয়াব বলে।
বিকেল হলো।
খালা দৌড়ে এলো আমার ঘরে।হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,”পাঁচশ টাকা ধার দাও তো তন্নি।খুব দরকার আমার।কিস্তির টাকা শর্ট।
পরে দিয়ে দেব তোমায়।”

আমি ভেবে পেলাম না কী বলব।প্রথমবার ধার চাইতে এসেছে।না দিলেও কেমন যেন দেখায়।

দিলাম টাকাটা।

সন্ধ‍্যা হলো।মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘরের এককোণে বসে রইলাম।ছেলে খেলছে ঘরেতেই।

‘কী ছিল আমার জীবন,আর কী হয়ে গেল!
ছোট থেকে মা-বাবার ভালোবাসা পাইনি।বাবা মারা গেছেন আমার জন্মের দু-মাস আগেই।
মা জন্ম দিতে গিয়ে।সেই থেকে লোকে আমায় অপয়া বলেই জানে।
কিন্তু এখানে আমার কী দোষ?
জন্ম, মৃত্যু কী মানুষের হাতে থাকে?
লোকে দোষ দেয় আমাকে।অথচ লোকে বোঝেনা আমিও যে মা-বাবা হারালাম।
তারা থাকলে হয়ত আমার জীবনে এতো করুণ পরিণত হতো না।
আসলেই এতিমের কোনো মূল্য নেই এ সমাজে।
আমার কপালই পেল আমার বাচ্চা দুটো।বাবা থেকেও নেই।রাজপ্রাসাদে বড়ো হওয়া বাচ্চা দুটো আজ ভাঙা ঘরে দুঃখ,কষ্টে দিন পার করে।
সময় মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায়,তা বোঝা বড়ো দায়।

আমার ভাবনার সুতো ছিড়ে মেয়ের কান্নার আওয়াজ।
ক্ষিদেতে কাঁদছে বেচারা।

খাওয়াতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না।খাবার না পেয়ে মেয়ে আরো দ্বিগুণ চিৎকার করছে।
কাল থেকে না খেয়ে আমি।সকালে এক টুকরো পাউরুটি মুখে দিয়েছিলাম শুধু ছেলের থেকে।
আমি না খেলে আমার বাচ্চাটাও অভুক্ত থাকবে।এদিকে আমার কোনো ক্ষিদে নেই।ক্ষিদেরা যেন মরে গেছে।

মনকে স্থির করলাম।
ঐ পাষণ্ডের জন্য নিজেকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই।
খেতে হবে আমার,মেয়ের জন্য হলেও খেতে হবে।

খাবারের বাটি খুলে ছেলেকে নিয়ে বসলাম।ওকে আগে খাইয়ে দিয়ে অবশিষ্ট একটু খাবার থেকে নিজেও কয়েক লোকমা খেলাম।

এরপর শুয়ে পরলাম।মেয়েকে খাইয়ে শান্ত করলাম।
ছোট কম্বল বিছিয়ে বাচ্চাদুটোকে রাখলাম।
আমি খালি চটের ওপর।

মাঝরাতে ছেলের প্রচন্ড চিৎকারে ঘুম ভাঙল।
লাইট জ্বালানোই ছিল।খালা লাইট লাগিয়ে দিয়েছিল।

দেখি,ঘরের এক কোণে একটা কুকুর শুয়ে আছে।
ছেলের চিৎকারে আমি সহ কুকুর দুটোই জেগে গেছে।
কুকুরটা চিৎকার করে ডাকছে।ছেলে ভয়ে আমায় জড়িয়ে ধরল।
চারপাশে তাকিয়ে যা বুঝলাম,ভাঙা দরজা ভেদ করে এসেছে কুকুরটা।এটা হয়ত তারই আশ্রয়স্থল ছিল আগে।বেচারার ও দোষ নেই।

আমি খালি হাতে কুকুর তাড়াতে চাইলাম।
ভয় পেয়ে কুকুরটি দিকদিশাহীন হয়ে এদিক-সেদিক ছুটতে লাগল।
কখনো মাথার ওপর দিয়ে লাফ দিচ্ছে,কখনো ধেয়ে আসছে।
কী বিভীষিকাময় রাত,বলে বোঝানো যাবেনা।
ভয়ে আমি নিজেই শেষ।ছেলে-মেয়েদের বুকে চেপে কাঁদতে আরম্ভ করলাম।
কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
একসময় আমার কান্না দেখে কুকুরটি থামল।
প্রাণী হলেও মায়া আছে হয়ত।আবারো শুয়ে পরে আগের স্থানে।
এবার আর আমি কুকুর তাড়ানোর চিন্তা করলাম না।মনে ভয়ের জাগরণ হয়েছে।
ছেলে কাঁপছে রীতিমতো।আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,”আম্মু কুকুরটা কামড়ে দেবে না তো?”

আমি ভীত গলায় বলি,”চুপচাপ শুয়ে পড়ো।ওকে বিরক্ত করোনা।ওকে কিছু না বললে ও আমাদের ক্ষতি করবেনা।”

বাকিরাত নির্ঘুম কাঁটালাম মা-ছেলে।
ছেলে একটু পরপর উকি দিয়ে দেখে কুকুরটা গেছে কিনা,তাকিয়ে আছে কিনা।

ভয়ে আমি নিজেও তটস্থ ছিলাম সারাটারাত।বাচ্চা দুটোকে নিয়ে একা ঘরে।তারমাঝে আবার এই কুকুর!

ভোরের আগ দিয়ে কুকুরটি চলে গেল নিজ থেকেই।ছেলে আমার তখন ঘুমায়।
আমায় ছাড়ে না তবুও।ভয় আটকে গেছে ভেতরে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছেলের গা কেঁপে জ্বর এলো।
ছেলে ঘুমের ঘোরে বলে,”আম্মু বাবার কাছে যাব।চিকেন খাব।ভালো বিছানায় থাকব।
কুকুর আমায় খেয়ে নেবে।”

ছেলের কথা শুনে আকাশের প্রতি আমার চরম ঘৃণা অনুভব হলো।
সে নিজে হয়ত ভালো খাবার খাচ্ছে,নরম বিছানায় ঘুমাচ্ছে।
অথচ ওর ছেলে দু-বেলা খাবারও পাচ্ছেনা।কুকুরের সাথে এক ঘরে ঘুমোচ্ছে।খালি মেঝেকে পাতলা চটে শুয়ে ছেলের মাথার একপাশে ফুলেও গেছে হালকা।

ওদিকে মেয়েটাও কাঁদছে।মেয়েকে কোলে নিয়ে হাঁটলে ছেলে কাঁদছে।
আবার মেয়েকে নিচে রেখে ছেলেকে নিলে মেয়ে চিৎকার করছে।
নিজের চুল নিজে ছিড়তে ইচ্ছে করছে আমার।
পাগল পাগল লাগছে।দু-রাত হলো তেমন ঘুম হয়নি আমার।মাথাটা ব‍্যাথায় ছিড়ে যাচ্ছে।
এরই মাঝে উদয় হলো খালা।
আমায় দেখে বলল,”সে কী তন্নি!রাতে ঘুমোওনি?তোমার ঘর থেকে কাল চেচামেচির আওয়াজ পেয়েছি।তোমাদের মা-ছেলের কান্না শুনলাম।
কী হয়েছিল?”

‘কেমন মানুষ এরা?কান্না শুনেও একটাবার এগিয়ে এলোনা।

আমি বলি,”খালা এঘরে এভাবে থাকা যাবেনা।
রাতে ঘরে কুকুর ঢুকে পড়েছিল।ছেলেটা খুব ভয় পেয়েছে।ভয়ে জ্বর চলে এসেছে।
দরজা এবং পেছনের বেড়াটি মেরামত প্রয়োজন।ঝড়-বাতাসের দিনে প্লাষ্টিক কাগজ উড়ে যায়।পেছনের জঙ্গল দেখা যায়।সাপ-পোকামাকড় ঘরে চলে আসতে পারে।
আপনি একটা ব‍্যবস্থা করে দিন।বাড়ি আপনার।”

তিনি অবাক স্বরে বলল,”ওমা সে কী!
বাড়ি আমার হলেও ঘর তো তোমার।ঘরের সব দায়িত্ব ও তোমার।তুমিই এখানে থাকবে।তাই সারার দায়িত্ব ও তোমার।
টাকা আছেই তো তোমার কাছে।ওগুলো দিয়ে সারিয়ে নাও।
আমি বাপু কোনো টাকা খরচ করতে পারব না।
নাহলে এমনি থাকতে হবে।আর তা না হলে অন‍্য কোথাও দেখতে পার।কিন্তু এ‍্যাডভ‍্যান্সের টাকা,কারেন্টের টাকা আমি দিতে পারব না।ওগুলো খরচ হয়ে গেছে।”

মনে মনে ভাবলাম,এর সঙ্গে ঝামেলা করে লাভ নেই।এই মূহুর্তে অন্য কোথাও যাব কী করে?ছেলেটারও জ্বর খুব।
এরচেয়ে ভালো আমি নিজেই হালকা-পাতলা সারিয়ে নেই।থাকব তো আমিই।
না সারলে ছেলে-মেয়ে নিয়ে বিপদ হয়ে যাবে।

বললাম,”ঠিক আছে।আপনি তাহলে আমার বাচ্চা দুটোকে রাখবেন।
আমি বাজারে গিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনে আনব।
আগে ছেলেকে জ্বরের ঔষধ খাইয়ে দিয়ে যাই।”

তিনি রাজি হলেন।
আমি ছেলেকে পাউরুটি কিনে খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে বাজারে গেলাম।

আকাশকে দেখলাম নতুন বউ নিয়ে শপিং করছে বড়ো মল থেকে।
আমি বাইরে ফুটপাতে তখন পুরোনো কাথা,কম্বল দেখছি।

তার পাশের মেয়েটিকে আমি চিনি।আমার বড়োজার ছোট বোন।নাম রিঙ্কি।
দামী শাড়ি কিনছে তারা।মেয়েটি পড়েছে জিন্স-টপ।
আকাশকে যেন চেনাই যাচ্ছেনা।মুখে হাসি,চেহারায় চকচকে ভাব।দু-বাচ্চার বাবা তাকে মনেই হচ্ছেনা।
বউ নিয়ে এদিক-সেদিক ঘুরে ড্রেস কিনছে নিত‍্য নতুন।
বুকের মাঝে চাপা কষ্ট অনুভব করলাম।
সরে এলাম সেখান থেকে।

আকাশ আমায় দেখল।
বউ নিয়ে শপিংমলের বাইরে এলো সে।রিঙ্কি মেয়েটা আমায় চেনে।
অপমান করতে আকাশকে বলল,” খুচরো টাকা থাকলে দাও তো আকাশ। ভিখারীকে দান করি।”

আকাশ বলে,”আহ শোনা,হাতে কেন দান করবে।মুখে ছুড়ে দাও।”

রিঙ্কি আমার দিকে এগিয়ে আসে টাকা নিয়ে।
শেষ সিড়িতে পা রাখতেই পা পিচলে পড়ে যায় ধপাস করে।
আশেপাশের লোকেরা সব উচ্চস্বরে হাসতে লাগে।
বেচারা রিঙ্কি অপমানে মুখটা ছোট করল।
আমি তার সামনে দাড়িয়ে বললাম,”ওপরে একজন আছেন রিঙ্কি। যিনি সব দেখেন।
অন‍্যের জন্য গর্ত খুড়লে নিজেকেই সেই গর্তে পড়তে হয়।”

রিঙ্কি রাগে চোয়াল শক্ত করল।
আমি পাত্তা দিলাম না।হনহন করে হেঁটে নিজ গন্তব্যে চলে গেলাম।

এক পুরোনো তোষক চোখে পরে আমার।
মনে মনে ভাবি,চটের ওপর বাচ্চা দুটো নিয়ে থাকলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।নিচে মাটির মেঝে থেকে ঠান্ডা ওঠে প্রচুর।
একটা খাট বা চকি কিনতে গেলে হাত পুরো খালি হয়ে যাবে।
এরচেয়ে বরং একটা তোষক নেই কমের মধ্যে।
চটের ওপর পেড়ে বাচ্চা দুটো নিয়ে থাকলে ঠান্ডা কম লাগবে।

যেই ভাবা সেই কাজ।
দোকানটিতে গেলাম।মালপত্র তেমন নেই।শুধু একটা তোষক,দুটো কাথা,মোটা একটি কম্বল আর কিছু প্লাষ্টিকের মোটা চট।
প্রত‍্যেকটি ভীষণ নোংরা,ধুলো-বালি জমা,ইদুরে কাঁটা,পোকায় ধরা।
হয়ত অনেকদিন ফেলে রেখেছিল।

আমি বললাম,”ভাই এই তোষক টা বিক্রি করবেন?”

দোকানদার আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকাল।
ঝটপট জবাব দিল,”না।এসব ছেড়া-ফাঁটা আর কে নেবে।
দোকান ছেড়ে দেব আজ।তাই গোডাউন খালি করছি।এগুলো অনেক আগেকার,বিক্রি হয়নি।
দেখে বুঝছেন না অবস্থা কী!
ফকির-টকির পেলে দিয়ে দেব সব।”

আমি আমতা আমতা করে বলি,”কিছু মনে না করলে এগুলো আমায় দিতে পারেন।টাকা দিয়ে কম-বেশি করে কিনে নেব আমি।
আসলে আমি খুব বিপদের মাঝে আছি।”

তিনি কিছুক্ষণ ভেবে বলল,”ঠিক আছে।দেখে নিন কোন গুলো নেবেন।
দোকানের ভেতর ঢুকুন।”

আমি তাই করলাম।তোষক,দুটি কাথা,কম্বলটা,চটগুলো,দুটো বালিশ সবই নিতে চাইলাম।
অবশিষ্ট ছিল শুধু একটি মশারি।তাহলেই হবে সম্পূর্ণ দোকান খালি।

দাম জিঙ্গেস করলাম এবার।
তিনি বললেন,”দেখ বোন এগুলো তো আমি দান করে দিতাম।তুমি নিতে চাইলে তাই দিলাম।
তুমি মশারি সহ সব নিয়ে যাও।পাঁচশ টাকা আমায় দিতে পার,আমার যাওয়ার ভাড়া হয়ে যাবে।”

আমি কৃতজ্ঞতা স্বরুপ তার দিকে তাকালাম।
এতোগুলো জিনিস হিসেবে দাম তেমন চায়নি।
টাকা দিয়ে সব জিনিস গুলো একটা ভ‍্যানে ওঠালাম।
পাশেই একটি বিরিয়ানির দোকান দেখলাম।
ছেলে আমার ভীষণ পছন্দ করে বিরিয়ানি।শুকনো পাউরুটি কিনে আর জ্বরের বাচ্চাকে কতোক্ষণ খাওয়াব।
রান্নার সব কাল কিনব টুকিটাকি করে।আজ এগুলোই সব সারিয়ে নেই।

তাই দু-প‍্যাকেট বিরিয়ানি নিলাম সঙ্গে।
ভ‍্যানে উঠলাম।
যাওয়ার পথে কিছু টিন কিনলাম।

বাড়ি ফিরে খালাকে ডেকে ধরাধরি করে সব নামিয়ে নিলাম।
খালা বলল,”থাকবে যেহেতু টয়লেটটাও সারিয়ে নাও।বৃষ্টির দিনে সমস্যা হবে।”

আমি রাজি হই।
তিনি আমায় নিয়ে এক লোকের বাড়ি গেল।বাশের তৈরী পুরোনো বেড়া ও বাশ বিক্রি করে সে।
বেছে বেছে কখান বেড়া ও বাশ কিনে আনলাম ভালো দেখে।
যেতে যেতে বললাম,”মিস্ত্রি ডাকার টাকা নেই আমার কাছে।
আপনি সারিয়ে তো দিলেন না।হাতে হাতে ধরে দেবেন।দুজন মিলে কাজ গুলো করব।
সামান্য কাজই তো।”

সে দুটো ছেলে ডেকে আনলেন।অল্প বয়সের দুটো ছেলে।
ওদের বাবা মিস্ত্রি,কাজ ওরাও জানে।
নিজেদের বাড়ি থেকেই সরঞ্জাম এনে আমার কাজ গুলো করে দিল।
হাতে হাতে ধরেছি আমি আর খালা।
এর মাঝে আমি বাইরে থেকে মাটি উঠিয়ে ঘরটায় মাটির প্রলেপ দিয়েছি।কোণা দিয়ে মাটির ঢিবি মতো দিয়েছি।
ধুল ঝেড়েছি।

আমার আনা সেই তোষক,কম্বল গুলো রোদে দিলাম।
খালা বলল,”এই ছেড়া কাঁথা টাকা দিয়ে কেন আনতে গেলে?এসব কী করবে?ব‍‍্যবহার না করলে আমায় দিয়ে দাও।কেটে রান্নাঘরের পাপস বানাই।”

“ব‍্যবহার না করলে কী আর টাকা দিয়ে কিনে আনি খালা?সবই আমার লাগবে।”

“কিন্তু এই পুরোনো কম্বল কেন এনেছ?কেমন নোংরা দেখতে।
শীত তো পড়েনি এখনো।শুধু শুধু টাকা নষ্ট করছ।”

আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম,”শীত পড়তে আর কতো দেরি!মাস খানেক পর থেকে ঠান্ডা পড়তে শুরু করবে।
পুরাতন হোক সমস্যা নেই।নতুন ব‍্যবহার করার সামর্থ্য আমার নেই।”

তিনি আর কিছু বললেন না।
আমি কাঁথা সহ চট গুলো ধুয়ে দিলাম।আলগা ময়লা সব উঠে গেছে।
কাঁথাটার ছেড়া অংশ সেলাই করলাম ভেজা অবস্থাতেই।
কম্বল আর তোষক রোদে দিলাম।
কড়া করে রোদে শুকালাম।এর মাঝে মাঝে ঝেড়ে পরিষ্কার করেছি।
ভেজা কাপর দিয়ে ওপরে মুছেছি।এপিঠ-ওপিঠ করে শুকিয়েছি।

ছেলে গুলোর কাজ ততক্ষণে শেষ।
টিন দিয়ে একপাশ আটকে দিয়েছে।দরজাটার ভাঙা অংশ মেরামত করে দিয়েছে।
টয়লেটের চারপাশে বাশের বেড়া আর বাশ দিয়ে ঢেকে দিয়েছে।
আমি আর আমার ছেলেটাও সাহায্য করেছি ওদের।খালাও হাত লাগিয়েছে।

খালি হাতে ওদের বিদায় দিতে চাইলাম না।
দুজনকে তিনশ টাকা দিয়ে বললাম,”এর বেশি আপাতত আমার সামর্থ্য নেই বাবা।
পরে কোনো দিন দেব।তোমাদের মন খুলে দোয়া করলাম।জীবনে অনেক বড়ো হও।”

ছেলে গুলো টাকা পেয়ে ভীষণ খুশি।বয়স কম কিনা!

আমি টিউবওয়েলটা পরিষ্কার করলাম ঘসে মেজে।পানি খাব এখান থেকে,অপরিষ্কার রাখা যায়না।
ছেলে এলো মেয়েকে কোলে নিয়ে।এতোক্ষণ ওর কোলেই ছিল মেয়ে।মাঝে আমি নিয়ে খাইয়ে দিয়েছি।

ছেলে বলছে,”ক্ষিদে পেয়েছে আম্মু।’

কপালে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বর কমে গেছে।ঘর থেকে বিরিয়ানির প‍্যাটেক বের করে আনলাম।
কোথা থেকে যেন খালা দৌড়ে এলো।
এক প‍্যাকেট বিরিয়ানি ছো মেরে হাত থেকে নিয়ে বলল,”এই দোকানের বিরিয়ানি আমার খুব পছন্দের।কিনে খাই প্রায়ই।
দুটো প‍্যাকেট এনেছ দেখছি।
তোমার ছেলে আর কতো খাবে।মা-ছেলে মিলে একটা খাও।এটা আমি নিয়ে যাই।নাহলে নষ্ট করবে তোমরা।”

খাবার জিনিস নিয়ে নিষেধ করা কেমন দেখায়!
তাই আর নিষেধ করতে পারিনি।
বিরিয়ানি নিয়ে তিনি চলে গেলেন।
ভেবেছিলাম একটা এখন খেয়ে বাকি একটা রাতে খাব ছেলে নিয়ে।

প‍্যাকেট খুলে ছেলেকে খাইয়ে দিলাম।
চারবার খেয়ে বাচ্চাটা বলল,”আর খাবনা।বাবাও তো বিরিয়ানি পছন্দ করে।বাবাকে ছাড়া খেলে বাবা রাগ করবে।
এটুকু তুমি রেখে দাও।বাবাকে ফোন দিয়ে আসতে বলবে।এসে খেয়ে যাবে।
এখন আমি ঘুমাব।বাবা এলে আমায় ডাকবে।একসঙ্গে খেয়ে নেব।”

ছেলের কথা শুনে আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরলো।

এরপর খালা যা করল,,,,

এমন ধাচের আরো একটি গল্প পরতে পারেন আমার ই-বুক ক্রয়ের মাধ্যমে।
কিছু অংশ,,,বিয়ের দশ বছর পর স্বামীর বাড়ির চৌকাটের সামনে এসে দাড়ালাম আমি।
বিশাল বাড়িটির ভেতর থেকে গুনগুনিয়ে কান্নার রোল ভেসে আসছে।
আমি ঠায় দাড়িয়ে রইলাম বাড়িটির সদর দরজায়।
ভেতরে ঢুকতে জড়োতা অনুভব হচ্ছে।

৩০-৩২ বয়সি এক নারী এগিয়ে এলো আমার নিকট।পরণে তাহার হাতা কাটা ব্লাউজ সহিত দামী পাতলা শাড়ি।
উম্মুক্ত হাত-পিঠ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

এগিয়ে এসে আমায় আলগা হাতে জড়িয়ে ধরে সে।
নাকে ভেসে আসে কড়া পার্ফিউমের ঘ্রাণ।

আমায় ছেড়ে গদগদ হয়ে তিনি বলেন,”ওহ মিস অনন‍্যা।আমি ভাবতেও পারিনি আপনি সয়ং নিজে আসবেন আমার কেসটি হ‍্যান্ডেল করতে!
ভীষণই খুশি হয়েছি আমি।আসুন ভেতরে আসুন প্লিজ।”

চলবে।