বড়োজা পর্ব-০৫

0
563

#বড়োজা
#Nadia_Afrin


দুপুরে খাওয়ার জন্য ছেলেকে নিয়ে পাউরুটি কিনতে গেছি দোকানে।মেয়েকে ঘরে রেখে এসেছি ঘুমন্ত অবস্থায়।দোকান কাছেই।
একটু আগে দেখা সেই মহিলাকে দেখলাম দোকান থেকে তেল কিনছে।
আমায় দেখে মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে লাগল।
সুযোগ পেয়ে আমি তাকে ডাকি।
বললাম,”আপা আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল।”

তিনি সাইটে দাড়ালেন।
আমিও সাইটে এসে বলি,”আপনাকে তো চিনিনা আমি আপা।একটু আগেই প্রথম দেখা হলো।
আপনি সম্ভবত আমায় বলেছিলেন আমি আপনার রোজগার নষ্ট করেছি।সেটা কীভাবে?”

মহিলাটি কর্কশ কন্ঠে বললেন,”সব জেনে নাটক করা হচ্ছে না?
আপনি জানতেন না ওখানে আমি কাজ করি দোকানের সবজি কাটার।
আপনি ইচ্ছে করে আমার কাজ কেড়ে নিয়েছেন।
গরীবের পেটে লাথি মারলে সৃষ্টিকর্তা পাপ দেয়।”

এবার বুঝলাম সবটা।
মহিলাটি কেন ক্ষেপে আছে আমার ওপর।
আমি তাকে আমার বিষয়ে সবটা বললাম সংক্ষিপ্ত আকারে।
খালার ব‍্যবহার ও প্রস্তাবটিও জানালাম।
আমি কেন অন‍্যের কাছে দোষী হয়ে থাকব দোষ না করেও!

সব শুনে তিনি বললেন,”আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল এমন।
নাহলে হঠাৎ করে এসে আপনি কেন একাজ করবেন বিনামুল্যে।
আপনার ঐ খালা আমায় বলেছে আপনি নাকি নিজ থেকে উনার দোকানের সব সবজি কেটে দেবেন তাও বিনা টাকায়।
খুব ভুল করেছেন এর বাড়ি এসে।মানুষ ভালোনা ইনি।টাকা থাকলেও মন নেই।রক্তচোষা আত্তা বলতে পারেন।শুধু পরের টা খাওয়ার লোভ।
এর আগেও এক ভাড়াটিয়া এসেছিল।
সাতদিনের বেশি টিকতে পারেনি।

আপনাকে যে ঘর ভাড়া দিয়েছে ওটা ঘর নাকি?
ওখানে এমনি বেড়া দিয়ে রেখেছে।শুকনো পাতা-লাকড়ি রাখে ঐখানে।
আপনার কথা শুনে মনে হলো খুব সমস্যায় পড়ে এসেছেন।ভাড়া যেহেতু অগ্রিম দিয়েছেন কষ্ট করে মাসটা পার করে যান।
আর কোনো কাজের যোগার করে এখান থেকে যতো দ্রুত সম্ভব চলে যান।
সাবধানে থাকবেন।আমায় ক্ষমা করে দিয়েন।ভুল বুঝেছি আপনাকে।”

মহিলা চলে গেল।
আমি ছেলে নিয়ে হাঁটছি আর ভাবছি,খালাকে শুধু স্বার্থপর ভেবেছিলাম।এখন দেখছি ইনি প্রচুর মিথ‍্যাবাদীও।
দেখি না কাল কী করে ইনি।
দুনিয়া উল্টে গেলেও কাল উনার দোকানের সবজি আমি কেটে দেব না।
যদি দিই ও,পারিশ্রমিক নেব।
এর সঙ্গে আর যাই হোক,বেশি ভাব জমানো যাবেনা।
কাজের জোগাড় করতে হবে দ্রুত।এই বাড়ি ছেড়ে অন‍্যত্র চলে যাব আমি।
দুপুর নাগাদ বের হবো কাজের সন্ধানে।

বাড়ি গেলাম।
মেয়ে গোসল করিয়ে ছেলেকে করালাম।নিজে করে মাথা মুছতে মুছতে দরজার কাছে বসেছি।
খালা এসে খাবারের বাটি চাইল।

আমি ঘর থেকে ধোয়া বাটি-প্লেট এনে দিলাম।
তিনি বাটির দিকে একবার তাকিয়ে বলল,”সব খেয়ে নিয়েছো?”

“হ‍্যা।খাবার তো খেতেই দিয়েছিলেন।দেখতে নয়।”

খালা মুখ বাকিয়ে বললেন,”আমি ভেবেছিলাম তরকারিটা একটু রাখবে।রাতে ওটার সঙ্গে আর একটু ভরে দিয়ে দেব খেতে।”

আমি কিছু বলতে নেব এমন সময় তিনি বেরিয়ে গেলেন।
উনার যাওয়ার পানে কিছুপল তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
আমার অসহায়ত্ত্বের সুযোগ নিয়ে কতোই না যন্ত্রণা দিচ্ছে।
যখন শুনেছে কেউ নেই আমার,তখন থেকে একপ্রকার নির্যাতন শুরু হয়েছে।এতিমের দুঃখ কেউ বোঝেনা।
এখান থেকে সরে গেলেও দুঃখ আমার সইতেই হবে।এখানে এই খালাকে নিয়ে,কখনো বা হাজির হবে অন‍্য খালা।
সৃষ্টিকর্তা কেন যে আমায় রেখেছেন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে!মা-বাবা,স্বামী,পরিবার কাউকে পেলাম না।

বেলা তিনটার দিকে বের হলাম কাজের খোঁজে।
চেনাজানা দুটো ফ‍্যাক্টারি আছে।শুনেছি যে কাউকে কাজে নেয় সেখানে।
কোনো সার্টিফিকেট লাগেনা।কাজ টাও তেমন না।বিস্কুট-চানাচুর তৈরি হয়।
মাস শেষে বেতন ছয় হাজার।

ওখানে যাব ভাবছি।কথা বলে দেখি কী হয়।

ছেলেকে নিয়ে রিক্সা করে গেছি।হাঁটতে অনেক পথ।ছোট মেয়ে কোলে নিয়ে এতো হাঁটা যায়না।

রিক্সা থেকে নেমে ভারা মিটিয়ে অফিসের মাঝে ঢুকলাম।
ছেলেকে একটা বেঞ্চেতে বসিয়ে মেয়েকে কোলে দিলাম।
বলেছি এখান থেকে না নড়তে।

অফিসে খোঁজ নিয়ে ম‍্যানেজারের কাছে গেলাম।সব খুলে বললাম।
একটা কাজ দিতে বললাম।
সে বলল,সব শিফ্ট লোক ফুল।আপাতত নেওয়া যাবেনা।তবে হাজার বিশেষ টাকা হলে চাকরি নিইয়ে দেবে ওপর পদে।বেতন হবে নয় হাজার।

এই মূহুর্তে বিশ হাজার টাকা আমার কাছে কোটি টাকার সমান।কোথা থেকে জোগাড় করব?
অনুরোধ করলাম।
শুনল না।এক মহিলা ডেকে ভিখারি বলে দূরদূর করে তাড়িয়ে দিল।
ছেলেকে নিয়ে আবারো রিক্সাতে উঠলাম।
অন‍্য একটা ফ‍্যাক্টারিতে গেলাম।
সরাসরি ওখানকার বসের সঙ্গে কথা বলেছি।লোকটা অল্প বয়সি।

আমার সব শুনে আমার প্রতি করুণার স্বরে বলল,”ঠিক আছে কাজ হবে।কিন্তু নাইট ডিউটি করতে হবে।
বিকেল পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত।
কাজ সহজ।বসে বসে প্রোডাক্টে সিল মারা।
আপনি চাইলে আপনার মেয়েকে আনতে পারেন।ছেলেকে নয়।
ওতো মানুষ ভেতরে এ‍্যালাউ নেই।মেয়ে ছোট দেখে মেনে নিচ্ছি।”

আমি তাতেই রাজি হলাম।
বস আমার ফোন নাম্বার চাইলেন।কাজের বিষয়ে কথা বলবেন।
দিলাম নাম্বার।
কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বাড়ি এলাম।

ফিরতে ফিরতে সন্ধ‍্যা হয়েছে।
বাড়ির উঠোনে দাড়াতেই দেখলাম ঘরের দরজা খোলা।অন্ধকার ভেতরে।অথচ আমি বাতি জ্বালিয়ে গেছিলাম।
অন্ধকার ঘর রাখলে ইদুরে কাথা বালিশ কাটতে পারে।
তাহলে ঘরে কে ঢুকেছে?
মনে ভয় হচ্ছে ঘরে ঢুকতে।কেউ যদি থাকে ভেতরে।
খালাকে ডাকলাম কবার।
সে এলোনা।ছেলে বলছে,”চলো আম্মু ঘরে যাই।আমি পানি খাব।”

বাধ‍্য হয়ে নিজে একাই ঘরের দিকে গেলাম।হাতে একটা লাঠি নিয়েছি।
ঘরে ঢুকে প্রথমে লাইট জ্বালাই।
দেখলাম কেউ নেই ঘরে।সব ঠিক।

ছেলেকে পানি খাইয়ে নিজেও খেলাম।
একটুর জন্য প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছিল আমার ভয়ে।
খালা খাবার নিয়ে এলো এমন সময়।
বলল,”ডেকেছিলে তন্নি?আসতে পারিনি শুয়ে ছিলাম।
এইনাও তোমাদের খাবার।
না বলে কোথায় গেছিলে?
রাতে ভাত রান্না করব চাল ধোয়ার জন্য তোমায় ডাকলাম পেলাম না।
এসে দেখলাম ঘরে বাতি দিয়ে কোথায় যেন চলে গেছ বাচ্চা নিয়ে।
আমি তো ভাবলাম চলে গেছ কোথাও।তোমার সব জিনিসগুলো নিয়ে নিতেও চাইলাম।তা চলে এসেছ।
ভালোই করেছ।”

“চলে গেলে আপনায় বলেই যাব খালা।
আমার সবকিছু নিয়েই যাব।ফেলে যাব না কিছু।
তাই একবেলা না দেখলে এটা ভেবে সব নিতে আসবেন না।জিনিস আমার।কোথায় নিয়ে কী করব সেটা আমার ব‍্যাপার।
আপনি লাইট বন্ধ করেছেন কেন ঘরের?
বিনা অনুমতিতে ঘরেও ঢুকেছেন।”

খালা বড়ো বড়ো চোখ করে বলল,”ও বাবা ও
বাবা।আমার ঘর,আমি আসতে পারব না?
কী এমন ধন-দৌলত রেখেছ ঘরে?যে আসতে পারব না।”

“ঘর সারার সময় এ কথা কোথায় ছিল খালা?
সারার সময় বললেন আমার বাড়ি তোমার ঘর।
সারা শেষে এখন আপনার হয়ে গেল?”

“এই শোনো মেয়ে,আমি ওকথা বলতে চাইনি।
লাইট জ্বালিয়ে গেছিলে তাই বন্ধ করতে এসেছিলাম।অপচয় করো কেন মেয়ে?বিল দিতে টাকা লাগেনা?

“আমার প্রয়োজনে আমি লাইট জ্বালিয়েছিলাম।
অগ্রিম বিল দিয়েছি,লাইট কিনেছি।তো চালাবোও ইচ্ছে মতো।
অপচয় আমি করিনি।সন্ধ‍্যায় লাইট সবাই দেয়।
আমার ঘরে কোনো জানালা নেই।অন্ধকারে ছোট মেয়ে নিয়ে থাকব কী করে?
এজন্য বিলও বেশি দিয়েছি।
এরপরও এতো কথা হওয়ার কথা তো নয়।
অপচয়ের কথা যদি বলেন সেটা আপনিই করেন।
সারাদিন রাত চব্বিশ ঘন্টা লাইট জ্বালিয়ে রাখেন।
আপনাদের বাথরুমের আলো আমার উঠোন থেকে দেখা যায়।প্রয়োজন ব‍্যাতিত সারা রাত লাইট জ্বালিয়ে রাখেন।
এগুলো কী অপচয় নয় খালা?”

“আমার ঘর, আমার কারেন্ট।আমি কখন কোনটা জ্বালাবো আমার ব‍্যাপার।
তুমি বলার কে?
তোমায় কইফিয়ত দিতে হবে নাকি?”

“না।আপনি জ্বালালে সব ঠিক আমি জ্বালালেই ভুল,অপচয়?
টাকা দিয়ে থাকি এখানে।ফ্রিতে নই।সুতরাং এসব বলতে পারেন না।”

এবার দেখলাম খালা চুপ।
আমার কথা ঠিক হজম হয়নি তার।এমনটা আশাও করেনি হয়ত।
অপরাধ সইতে সইতে মুখের জবান আমার আপনাআপনিই খুলে গেছে।

খালা খাবারটা দিয়ে চলে গেলেন।
আমি ঘরে এলাম।
ঢাকনা খুলে দেখি সেই আলু-বেগুনের ঝোল আর ভাত।
এ কেমন নির্দয় মানুষ?
বাচ্চা ছেলেটাকেও এক টুকরো মাছ দিল না?
রান্না করেছে আট পিছ মাছ।বড়ো বড়ো পিছ।
তিন বেলা তাদের খেয়েও দু-টুকরো থাকবে।ওখান থেকে আমার আলিফকে না হয় একটা দিত।
আস্ত না দিক ভেঙে এক টুকরো দিত।ছোট ছেলে আমার,কতোই না জানি খেত।
ও বাড়ি থাকতে মাছ খেতে চাইত না।জোর করে খাওয়াতাম।
এখানে এসে পাচ্ছেই না।কী কপাল!

ভাতগুলো কোনো রকম মেখে মা-ছেলেতে মিলে খেলাম।
খেয়ে শুয়ে পরলাম।
কিন্তু ঘুম আসছেনা চোখে।এপাশ-ওপাশ করলাম বারবার।
চোখে অজস্র স্মৃতি ভেসে উঠল।

‘তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি।মা-বাবা মারা যাওয়ার পর ফুফুই মানুষ করেছেন আমায়।
সকলের অনাদারে বড়ো হয়েছি।ফুফুর তিন সন্তান। দু ছেলে,এক মেয়ে।
সকলেই আমার বড়ো।বিয়েও করেছে,বাচ্চাও আছে।
আমার আদরের ওরা,কিন্তু ওদের আমি চোখের বিষ।সবসময় কটুক্তি করত আমায়।ছোট বেলায় মার ও খেয়েছি প্রচুর।কারণে-অকারণে গালে মুখে চড়-থাপ্পর দিত।আনন্দের ছলে গায়ে গরম পানিও ছুড়ে মারত।
আমি কাঁদতাম ওরা হাসত।মজা পেত আমার কান্না দেখে।
একদিন কী করেছিল জানেন?
কনকনে শিতের রাতে আমার গায়ে পুকুরের ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়েছিল।সেসময় আমার বয়স সবে সাত।
ঠান্ডায় কেমন জানি হয়ে গেছিলাম আমি।নাক নিয়ে রক্ত চলে এসেছিল।জ্বরে ভুগেছি তিন রাত।
শিতের মাঝরাতে আমায় ঘর থেকে বের করে দিত।বলত আমার গা থেকে নাকি গন্ধ আসে।আমরা ভাই-বোনেরা এক ঘরে ঘুমাতাম।বড়োভাইয়েরা খাটে,আপা আর আমি নিচে।সবাই খুব বেশি বড়ো না তখন।
আপা বারান্দায় বের করে দিত আমায়।
ঐ শিতের রাতে গায়ে একটা চাদর নিয়ে ঘরের দোয়ারে বসে থাকতাম ঝিম মেরে।ঘরে ঢুকতে চাইলেও দিত না।
সময় এমনও হয়েছে,রান্নাঘরে শুয়েছি।
রাত-বিরাতে আপা আমায় জঙ্গলে পাঠাতো আম কুড়াতে।সাপেও কেটেছিল একবার।
মরিনি তবুও।জান শক্ত আমার।
প্রচুর মার,গাল খেয়েছি।
ফুফু বড়োভাই,আপাকে শাসন করতে এলে ফুফা তাকেই গাল-মন্দ করত।
আমাকে তারা ঝামেলা হিসেবেই নিয়েছিল।
মাত্র আটবছর থেকে আমি সংসারের কাজ করতাম।
বড়ো ভাই-বোনদের কাপড় ধুয়ে দিতাম,জুতো পরিষ্কার করতাম।ওদের এটো খাবার খেয়ে বড়ো হয়েছি।মাঝেমধ‍্যে অবশ‍্য ফুফু লুকিয়ে খাওয়াতেন আমায়।
সবশেষে স্কুলে যেতাম আমি।খালি পায়ে,ব‍্যাগ ছাড়া,বই হাতে।
জানেন,কড়া রোদের দিনে পিচঢালা রাস্তা দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে পায়ে ফোসকা পড়েছে কতোবার।
রাতে চুপিচুপি কাঁদতাম।শব্দ হলে বড়ো ভাই পিঠে লাথি বসাত।বড়ো আপা হাত মুচড়ে দিত।তাই ভয়ে চুপ থাকতাম।
এক ঈদে আমি ফুফুর কাছে বায়না ধরি আমায় একটি নতুন ব‍্যাগ কিনে দিতে।
মানুষ ঈদে চায় নতুন জামা,জুতা।আমি চেয়েছি স্কুল ব‍্যাগ।
খালি হাতে বই নিতে কষ্ট হতো।বৃষ্টির দিনে বই ভিজে ছিড়ে যেত।
আমি পড়তে খুব ভালোবাসতাম।বই ছিল আমার প্রাণ।প্রতিদিন পড়া শেষে বই জড়িয়ে শুয়ে থাকতাম।মা মা অনুভব হতো।
বাচ্চা মন তখন।

ফুফু বহু কষ্টে লুকিয়ে,বাচিয়ে আমায় একটা ব‍্যাগ কিনে দেয় সেবার।
খুশি মনে প্রথমবার ব‍্যাগ নিয়ে স্কুলে গেছি।
বাড়ি এসে দেখি হুলস্থুল কান্ড।
ফুফুকে ফুফা ব‍্যাগ কেনার অপরাধে মারছে ভীষণ।
বড়োভাই আমার ব‍্যাগ নিয়ে বই সমেত পুরিয়ে দেয়।
আমি চিৎকার করেছিলাম প্রচুর।বই খাতা সব পুরেছে ব‍্যাগ কেনার অপরাধে।
স্কুলে গিয়েও মার খেয়েছি।অন‍্যের বই দেখে পরতাম স্কুলে। বাড়ি ফিরে কাঁদতাম।
এভাবেই বড়ো হয়েছি আমি।
ক্লাস সিক্স পর্যন্ত বড়োভাইয়েরা মেরেছে প্রায় প্রায়।এরপর আর মারেনি।গায়ে হাত দেওয়া দৃষ্টিকটু দেখায় তাই।
তবে আপার অত‍্যাচার ছিল ঠিকই।একবার জ্বর শরীরে রান্না পুড়িয়ে ফেলেছিলাম।আপা সেদিন আমায় জুতো দিয়ে গালে-পিঠে মেরে ফুলিয়ে দিয়েছিল।
তখন আমি ক্লাস এইটে।
মরতে ভীষণ ভয় পেতাম আমি।তাই কিছু করতে পারিনি।
এইটের পরিক্ষার আগে আপার বিয়ে হয়ে যায়।ভেবেছিলাম বেঁচে গেলাম।
কিন্তু তা হলো না।বড়ো ভাই বিয়ে করে একমাস পরেই।
ভীষণ সুন্দরী ভাবি।আমি ভাবির সঙ্গে মিলে মিশে থাকতে চাইতাম।পারিনি।সে আমায় সহ‍্যই করতে পারত না।
সব কাজ করাত।ফুফু কিছু বললে ফুফুর সঙ্গে ঝগড়া হতো।
ভাবির বাষী কাপড় পর্যন্ত আমায় দিয়ে ধুইয়েছে।
আমাদের বাড়ি ছিল অজপাড়া গায়ে।
বড়ো একটি জমির ভেতর আমাদের বাড়ি।আশেপাশে কেউ নেই।ফুফা চাষ করত সেসব জমিতে।
তখন আইন-কানুন এতো উন্নতি ছিল না।
এসব বুঝতামও না।
আপনারা হয়ত ভাবছেন আমার মা-বাবার কী কিচ্ছু ছিল না?
ছিল।একটা বাড়ি,দুটো গরু।
বাবা-মা মারা যাওয়ার পর সব কাকারা নিয়ে নিয়েছে।
গরু দুটো দিয়েছিল আমার ফুফুকে।
ফুফা পেলে পুষে বিক্রি করে ঘর দিয়েছিল।সে ঘরেতেও জায়গা হয়নি আমার।
এরপর আমার ফুফু মারা যায়।অত‍্যাচার বেড়ে দ্বিগুণ।
একপর্যায়ে টাকার জন্য ছোটভাই আমায় বিক্রি পর্যন্ত করে দিতে চেয়েছিল।
আমি বাধা দিয়েছিলাম।
সে বছর এস এস সি দিয়েছি আমি।উঠতি বয়স।বিয়ে আসত,তবে বুড়ো বউ মরা বেশি।ভাইয়েরা ওসব লোকের সঙ্গেই বিয়ে দিতে চাইত।
আমাদের এলাকায় ঘুরতে এসেছিল আকাশ ও তার বন্ধুরা।গ্রাম‍্য পরিবেশ উপভোগ করতে এসেছিল।
আমার সঙ্গে তার পরিচয় তখনই।
আকাশের বন্ধুর মামার বাড়ি ঐ গ্রামেই।ওরা ঐ বাড়িতে উঠেছিল।
আমি তখন ও বাড়ির এক ছোট মেয়েকে প্রাইভেট পড়াই।
সেখানেই দেখা আকাশের সঙ্গে।
আমায় প্রথম দেখাতেই তার ভালো লাগে।
তিনদিন সেখানে ছিল তারা।
আমি যখনই পড়াতে যেতাম আকাশ অন‍্যঘর থেকে জানালার ফাঁক দিয়ে আমায় দেখত।
হাসত।আমারও ভালো লাগত তাকে।
রঙিন বয়স তখন।
যাওয়ার দিন আকাশ আমায় প্রপোজ করে।
আমিও হ‍্যা বলে দেই।আকাশ একটা ছোট ফোন গিফ্ট করে গেছিলো আমায়।
সেই ফোন দিয়েই কথা হতো দুজনের।
একে-ওপরের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ি খুব।
বাড়িতে বড়োভাই সব জানতে পেরে আমায় মারে ভীষণ।
বিয়ে ঠিক করে একটা লোকের সঙ্গে।সেই লোকের দুই বউ।
আমি আকাশকে জানাই।
ও পাগলের মতো হয়ে যায় একথা শুনে।বাড়িতে জানায়।
তারা মানতে নারাজ।গরীব,এতিম,গ্রামের মেয়ে,কম শিক্ষিত বউ তারা নেবে না।
আকাশ সবার বিরুদ্ধে গিয়ে আমায় পালিয়ে নিয়ে বিয়ে করে সেদিনই।

আমার কল্পনার সুতো ছেড়ে খালার তীব্র ডাকে।
জোরে জোরে দরজায় আঘাত করছে সে।
উঠে বসে ফোন হাতে নিয়ে দেখি রাত বারোটা বাজে।
এতোরাতে আমায় কেন ডাকছে খালা?
তাও এভাবে,”

বাইরে আসলাম দ্রুত।ভেবেছি কেউ অসুস্থ হয়েছে হয়ত।
কিন্তু এসে দেখি খালা দিব্বি দাড়িয়ে আছে হাতে ছোট মাছ নিয়ে।

বলল,”এতো সময় লাগে উঠতে?কখন থেকে ডাকছি?গলা বসে গেল আমার।
চলো আমার বাড়ি তাড়াতাড়ি।
মাছ কাটতে হবে।তোমার আঙ্কেল অনেক ছোট মাছ এনেছে।স্বস্তায় পেয়েছে তাই বেশি করে এনেছে।
কেটে বেছে দেবে চলো।”

আমি চোখ কোচলে বললাম,”আমি কেন এতো রাতে মাছ কাটতে যাব খালা?
এটা কী মাছ কাটার সময়?
আঙ্কেল এনেছে তো আপনি কাটেন।”

“খাবে তা কাটবেনা?এ মাছ কাল রান্না হবে।না কাটলে কাল রান্না বন্ধ।উপস দিয়ে থাকতে পারবে?
দোকানের কাজ নয় না করলে।বাড়ির রান্নার কাজ গুলো তো করবে।মাছ বাড়িতে খাওয়ার।তোমার সঙ্গে তো আমার এমনই কথা হয়েছিল।
এখন এসব কেন বলছ তাহলে?”

আমি পরলাম মহা ঝামেলায়।
উপায় না পেয়ে বললাম,”ঠিক আছে।আপনি তাহলে মাছ আর একটা বটি দিয়ে যান।
আমি ঘরের দরজায় কাগজ বিছিয়ে কাটি।
আপনার বাড়ি যেতে পারব না বাচ্চা রেখে।
এতো রাতে বাচ্চা একা রেখে গেলে ওরা ভয় পাবে।কান্না করবে।”

“ওটিতো হচ্ছেনা।আমার বাড়ি গিয়ে কাটতে হবে।
এখানে কাটলে যদি রেখে দাও লুকিয়ে।”

“আমায় কী রাক্ষস মনে হয় আপনার?কাঁচা মাছ রেখে খাব নাকি?
রান্নার কিছু আছে আমার?
সামান্য মাছ নিয়ে ছোটলোকি করা আমার স্বভাব নয়।”

খালা মুখ বাকিয়ে বলল,”তুমি তো বেশ চোপা করো তন্নি।
সামান্য মাছই তো কাটতে বলেছি।একটা রাত বাচ্চা এখানে রেখে গেলে বাঘ-ভাল্লুক খেয়ে নেবে নাকি?
আমরা বাচ্চা পালিনি?
দু-দিনের বাচ্চা রেখে রাত-বিরাতে ধানের কাজ করতাম বাইরে।”

আমিও প্রতিউত্তরে বললাম,”সে যুগ আর এই যুগ এক নয়।
তখনকার সঙ্গে এখন মেলাতে আসবেন না দয়া করে।
আমি আমার বাচ্চা অনিরাপদে রেখে যেতে পারব না ব‍্যাস।
তেমন হলে কাল আমি আলাদা খাব।”

খালাকে দেখলাম এবার চিন্তিত হলো।
কন্ঠ নরম করে বলল,”ঠিক আছে।তুমি এখানেই মাছ কেটে নাও।আমি দাড়িয়ে থাকব।”

সামান্য মাছ নিয়ে কারো মনে এতো সংশয় থাকতে পারে জানা ছিল না।

কী আর করার।কাটতে তো হবেই।
চুলে খোপা করে বসে পরলাম কাটতে।বেশ অনেকগুলো মাছ।খালাও হাত লাগালে তাড়াতাড়ি হতো।
আমি কিছু বলার আগেই সে বলল,”এতো রাতে মাছ কাটলে আমার হাত কেটে পড়ে যাবে।
এখন কী আর সেই বয়স,সেই শক্তি,সেই চোখ আছে?
তুমি বাবা বয়স কম।চোখ ভালো।দেখতে পাও।
এজন্য তোমায় দিয়েছি কাটতে।
আমার পেটের মেয়ে হলে তাকেই বলতাম।
তোমায় মেয়ে মনে করি তাই আবদার-বায়না করি।
তুমি বাপু আমায় শুধু ভুল বোঝ।
কথায় কথায় তর্ক করো।রাগ দেখায়।মা হলে এমন করতে?”

মনে মনে বলি,আমার মা হলে মেয়ের দুঃখটাও বুঝত।
খাবারে কষ্ট দিত না।খাই বলে অন‍্যায় আবদার করত না।
মায়ের জায়গা কেউ নিতে পারেনা।
বলতে পারে সবাই।কিন্তু কাজে পারেনা।

ঘুমে আমার চোখ ঢুলুমুলু।
ছোট ছোট মাছ।এতো রাতে বাজার দিয়ে আসার সময় কমে পেয়েছে নিশ্চয়।এজন‍্য কিনে এনেছে।
এই মাছ কাটা একপ্রকার অত‍্যাচার।
কোমর ধরে আসছে আমার।পা ঝিম ঝিম করছে।
হাতের তিনখানে কেটেও গেছে।

টানা এক ঘন্টা বসে মাছ কেটেছি।
মেয়ের কান্না শুনলাম।
ঘুম ভেঙে গেছে।তড়িঘড়ি নোংরা,উচ্ছিষ্ট অংশ পলি ব‍্যাগে গোছালাম।
মাছ কাটা শেষ।এগুলো ফেলে দিতে হবে।এতো রাতে ফেলা ঠিক হবে না।
ফেলতে গেলেও বাড়ির বাইরে গিয়ে দূরে ফেলতে হবে।নাহলে গন্ধ বের হবে।
এই মহিলা যা মানুষ,তাতে আমাকেই ফেলতে বলবে।মাছ যে কাটলো না,উচ্ছিষ্ট ফেলে নাকি!
এদিকে বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার।ভয় করে আমার।
তাই ভাবলাম সকালে ফেলব।

খালাকে বললাম,”মাছের উচ্ছিষ্ট সকালে ফেলে দেবনি।একটা ব‍্যাগেতে রেখে দেই।এতো রাতে ফেলা ঠিক হবেনা।”

খালা হুড়মুড়িয়ে উঠে দাড়াল।ফোনের লাইট জ্বালিয়ে বলল,”পলি খোলো।আমি একবার চেক করে নেই।যদি মাছ কিছু রেখে দাও।”

প্রচন্ড বিরক্ত হলাম আমি।
ধপ করে পলিটি নিচে রাখলাম।মহিলা একটা কাঠি এনে খুটিয়ে খুটিয়ে,নেড়ে চেড়ে সব দেখতে লাগল।
ইচ্ছে হচ্ছিল এই নোংরা গুলোই এর মুখে পুরে দেই।

বললাম,”এক কাজ করেন খালা।মাছের সঙ্গে নোংরা গুলোও নিয়ে যান।ফ্রিজে রেখে দেবেন।সকালে বেছে নিজে ফেলে দেবেন।”

তিনি ভ্রু কুচকালেন।
আমি মাটি থেকে পলি সমেত নোংরা উঠিয়ে ব‍্যাগে রেখে বাড়ির এক কোণে রাখলাম।হাতে সময় নেই আমার।মেয়ে কাঁদছে।খাওয়াতে হবে।
খালাকে বললাম,”মাছ কেটে দিয়েছি।নোংরা ফেলে দিয়েছি।বেছে কেটে হাড়িতে মাছ রেখেছি।আপনি শুধু একটু ধুয়ে নেবেন।
আমার মেয়ে কাঁদছে ক্ষিদেতে।”

“কাটলে বাছলে তুমি।ধুয়েও দিয়ে যাও।এখন এই মাছ ধুতে আমি হাত ময়লা করব নাকি?
মেয়ে কাঁদছে তো কী হয়েছে।কাঁদলে বাচ্চার ব্রেন ভালো হয়।
কান্নার সঙ্গে সঙ্গে খাবার দিলে অহংকারী হবে।অভাব বুঝবেনা।মেয়ে মানুষের একটু ধৈর্য্য ধরতে হয়।মায়ের শেখাতে হয়।”

“আমার দু-মাসের মেয়েকে কান্না করাব?
ক্ষিদে পেলে খাবার না দিয়ে অভাব বোঝাবো?
এইটুকু বাচ্চাকে ধৈর্য্য শেখাব?
মাথা খারাপ নাকি আপনার!”

খালা আমার রাগান্বিত চেহারা দেখে ভয় পেল হয়ত।মাছের হাড়ি নিয়ে সুরসুর করে চলে গেল।

(আজকের পর্বে প্রতিবাদ,অতীত সবই দিয়েছি কিন্তু।রিয়েক্ট বেশি চাই।টার্গেট 7k)

ই-বুক,,,আমার তিনমাস বয়সি মেয়েটাকে মেঝেতে শোয়ালেন।দুইহাত দিয়ে গলা চেপে ধরলেন।
আমি পাগলের মতো করতে লাগলাম।

আমার ছোট্ট মেয়েটার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো।
কান্না ও করতে পারছিল না।
মা হয়ে কীভাবে আরেক মায়ের কোল খালি
করছে এই মহিলা।
আমি চেচাতে চেষ্টা করলাম।কিন্তু পারলাম না।মুখ যে বাধা আমার।ছটফটাতে লাগলাম।
ছোট্ট শিশুটার ফর্সা মুখশ্রি লাল টকটকে হয়ে গেল

ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা গুলো বারবার নাড়াচ্ছিলো।
একসময় নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেল চারপাশ।
অবচেতন হয়ে পড়ে গেলাম আমি।

বৃষ্টির পানির ফোটায় জ্ঞান ফিরলো আমার।এভাবে য়কতোক্ষণ ছিলাম জানিনা।মরা মেয়ে সহ আমাকে এখানে ফেলে রেখে গেছে অমানুষিক গুলো।
চোখ মেলতেই দেখি ধুধু অন্ধকার মাঠের মধ্যে পড়ে আছি আমি।পাশেই আমার মৃত মেয়ে পড়ে আছে।
মেয়েকে জড়িয়ে ধরলাম।

হাসতে হাসতে পাগল হয়ে যাচ্ছে রাজিয়া।
আজ যেন তার খুব সুখের দিন।
নিজ হাতে মেয়েকে দাফন করলো।
বৃষ্টিতে ঘুরে ঘুরে ভিজতে লাগলো।

এরপর সকাল হলো।এলাকা বাসি রাজিয়াকে পাগল অবস্থায় পেলো।বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করতেই মাতোয়ারা বেগম বললো,’মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে নিজের হাতেই নিজের বাচ্চাকে মেরে কবর দিয়েছে রাজিয়া।
গ্রাম বাসীরা আক্ষেপ করলো।
রাতারাতি সুস্থ মেয়েটার এ কী হয়ে গেল।
বিষয়টি নিয়ে তেমন মাথা ঘামালেন না কেউই।নিজের খেয়ে কে ই বা পরের মোষ তাড়াবে।

সাতদিন পর বাড়ি ফিরলো রায়হান।
পাগলী রাজিয়া এতোদিন শুধু মেয়ের কবরের কাছেই ছিল।পাশের বাড়ির সেই ভাবী সময় করে খাইয়ে দিয়ে যেতো তাকে।
মাতোয়ারা বেগম বা তার বাড়ির কেউ খোঁজ ও নিতো না রাজিয়ার।

রায়হান এসে উঠোনে দাড়াতেই কোথা থেকে যেন ছুটে এলো রাজিয়া।
স্বামীকে জড়িয়ে ধরতেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো তাকে।
গায়ের পোশাক হাত দিয়ে ঝাড়তে লাগলো।
রাজিয়া তার নিজের পোশাকের দিকে তাকালো।
এতো নোংরা,গন্ধ যুক্ত পোশাক দেখেই হয়ত রায়হান সরিয়ে দিচ্ছে তাকে।
সামান্য হাসলো রাজিয়া।
দৌড়ে কলপারে গেলো।রায়হান রাজিয়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।মাতোয়ারা বেগম ছেলেকে ঘরে নিয়ে গেল।

চলবে।