বড়োজা পর্ব-১৬ (প্রথম অংশ)

0
220

বড়োজা
Nadia_Afrin

১৬ (প্রথম অংশ)
বাড়ি ফিরে দেখি আজও একই অবস্থা।
ছেলে বসে কাঁদছে।এবার বেশ বিরক্ত হলাম আমি।
সারাদিন কাজ করে এসে বাড়িতে যে একটু রেস্ট নেব সেই উপায় নেই।
ছেলে বলে, ওর মুড়ি চানাচুর সব চুড়ি হয়ে গেছে।
বস্তির কিছু বাচ্চারা চুরি করেছে।
চাচিও বলে একই কথা।
বিষয়টি বেশ খারাপ লাগে আমার।
সত‍্যি বলতে এখানকার পরিবেশটা খুব বেশি সুবিধার নয়।
ছেলে-পুলেদের ভাষার ঠিক নেই।
মা-বাবার সঙ্গে কেমন তুই তুকারি করে,গা*লমন্দ করে।
ছোট বাচ্চারাও দেখি সিগারেট খায়।নোংরা কথা বলে।
এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ছেলে মানুষ করা দূষ্কর।
ইদানীং আমার ছেলেও অতিরিক্ত জেদি হয়েছে।আগে এমন ছিলনা।
আমার কথা শুনতে চায়না।চিৎকার করে।

না জানি কী আছে আমার কপালে!
সন্তান নিয়েই আমার জীবন।সেই সন্তান মানুষ না করতে পারলে কোনো মূল্যই থাকবেনা।
এখান থেকে যেতেও পারছি না।
একা একটা মেয়ে মানুষ কোথায় যাই আমি?
না আছে তেমন অর্থবিত্ত!

ধীরে ধীরে পার হচ্ছিলো সময়।
তবে আমার কোনো পরিবর্তন নেই।উন্নতির থেকে অবনতিই হয়েছে।
রাশেদ স‍্যারের আমার প্রতি দরধ বাড়তে বাড়তে ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে।
না পারছি সহ‍্য করতে,না পারছি বলতে।
কাজটা ছাড়লে কী করে খাবো আমি?
রাত বিরাতে কল দেয়।কাজে গেলে অযথাই ডাকাডাকি করেন।
ফ‍্যাক্টারির প্রতিটি মানুষ আমায় নিয়ে কানাঘুষা করে।
স‍্যারকে বুঝিয়েছিলাম আমি।
তিনি বোঝার বদলে আমায় প্রপোজ করে।সে নাকি আমায় ছাড়া বাঁচবেনা।
মৃত্যু কী এতোই সহজ?
এতো আবেগী কথা আমার ভালো লাগেনা।
এসব আবেগ পার করেছি সেই কবেই।

লতা আপাকে আমার সমস্যার কথা বলেছিলাম।
স‍্যারের বিষয়ে আমার একটুও ভালোলাগা নেই।
লতা আপা মজা করে বলে,”ভালোই তো।মেনে নাও।অফিসের ম‍্যাডাম হবে।
ঐ বদমাশের জন্য কতোদিন একা থাকবে?
চলার পথে কাউকে প্রয়োজন হয়।ছেলে মেয়ে দুটোর গতি হতো।”

মজা করে বলা আপার কথাটি আমার কেন যেন কানে বেজেছিল বারবার।
একা কী সত‍্যিই বাঁচা যায়না এই বৃহত্তম পৃথিবীতে?
কতো মানুষের ভিরে আমার নিজের একটা মানুষ নেই।
এটা কী আমার চরম ব‍্যর্থতা?

পরদিন ফ‍্যাক্টারি গিয়েছি।
স‍্যার কাজ শেষে আমায় আলাদা ডাকেন।
সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেন।
বলেন,”তোমার ভবিষ্যৎ আমি উজ্জ্বল করে দেব তন্নি।প্রথম দেখাতেই তোমায় আমি ভালোবেসে ফেলেছি।
আমায় বিয়ে করো।
পৃথিবীতে কেউ একা নেই।সঙ্গি ছাড়া জীবনের মূল্য নেই।”

আমি কোনো জবাব না দিয়ে চলে এসেছিলাম সেদিন।

সত‍্যি বলতে পুরো দুনিয়া একদিকে আর আমি একা একদিকে।

দুদিন পরের কথা,বাজারে গিয়েছি সবজি নিতে।
দেখা হলো সেই সবজি ওয়ালা ভাইয়ের সঙ্গে।
আমায় দেখেই এড়িয়ে গেল তিনি।
ভ‍্যান নিয়ে উল্টো পথে যায়।
আমি চিনতে পেরে ডাক দেই।সামনে গিয়ে দাড়াই।
লোকটা চারপাশে তাকাচ্ছে।ভীষণ ঘামছে।ভয় পেয়ে আছে।

আমি বলি,”ভালো আছেন ভাই?”

উনি জবাব দেয়,”আমায় সঙ্গে দয়া করে কথা বলবেন না।
কেউ দেখলে আমায় মে*রে ফেলবে।
আপনার জন‍্য পাড়াতে গিয়ে সবজি বেচা বন্ধ হয়েছে আমার।
গরীবের পেটে লাথি মেরেছেন।
আপনাকে বোনের নজরে দেখেছি।
সেই আপনি আমায় ফাঁসিয়েছেন।আমি নাকি আপনার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক করেছি।
একথা ভাবলেও আমার ঘৃণা লাগে।
আপনার জন্য পাড়ার লোকে আমায় মে*রে তাড়িয়ে দিয়েছে।
মুখ দেখাতে পারিনা আমি।
স্ত্রী সন্তানের কাছে ছোট হয়েছি।
সব দোষ আপনার।কখনোই ভালো হবেনা আপনার।”

আমি কিছু বলব তার আগেই উনি ভ‍্যানে উঠে টান দেয় জোরে।
আমি ঠায় দাড়িয়ে থাকি।
চোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়ছে।অপরাধ না করেও দোষী আমি।
এতো অভিশাপের বোঝা রাখি কোথায় আমি?
সৃষ্টিকর্তা কেন কোনো প্রতিদান দিচ্ছেনা আমায়?
অন্তত ঐ অপরাধীদের একটা শাস্তি হোক।
নিজ চোখে দেখি আমি।

আমার ভাবনা শেষ হয়নি তার আগেই চোখে পড়ে এক দৃশ্য।
আমার বড়ো ভাসুর মানে বড়োজার স্বামী যাচ্ছে একটা দুবছরের বাচ্চা কোলে নিয়ে।
পাশেই একটা বোরখা পড়া মহিলা।
রিক্সাতে ছিল ওরা।
আমি একটু আড়ালে দাড়াই।
একটু দূরেই একটা ফ্ল‍্যাটের সামনে রিক্সা থামে।
ভাসুর বাচ্চা নিয়ে নামে।
পকেট থেকে টাকা বের করছে।
মহিলা ভাসুরের কাধ ধরে নামছে রিক্সা থেকে।
কোলের বাচ্চাটা আধো আধো বুলিতে বলছে,”বাব্বাহ,বাব্বাহ।”

আমি চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে শুধু দেখছি এ দৃশ্য।
ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির মাঝে প্রবেশ করে তারা।
আমিও যাই পিছু পিছু।
তবে আমি পৌঁছনোর আগেই ওরা লিফ্টে উঠে যায়।
গেটে একজন দাড়োয়ান চাচা বসে ছিলেন।
তাকে জিজ্ঞেস করি,”চাচা এই মাত্র যে দুজন পুরুষ-মহিলা ও একটা বাচ্চা কোলে গেল।উনারা কে?”

চাচা বলেন,”ওহ ওরা!
ওরা তো স্বামী-স্ত্রী।লোকটা প্রবাসী।বছর বাদে আসে।
মেয়েটা এখানে থাকে বাচ্চা নিয়ে।
চারবছর হলো মনে হয় বিয়ে হয়েছে।
তুমি কী ওদের চেনো মা?
কিছু বলবে?”

চাচার কথা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়েছি।
বড়োজার আচল ধরে ঘোরা স্বামী আরেকটি বিয়ে করেছে।বাচ্চাও আছে।
অধীক চুপ মানুষের মনে প‍্যাচ থাকে।
গুণী লোকের কথা এটি।

আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বলি,”না চাচা।
এমনিই একটু কৌতূহল জাগলো,তাই জানতে চেয়েছি।
আপনি আবার উনাদের বলবেন না কিছু।
কী না কী মনে করে!”

ওখান থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি আসছিলাম।
ভাবছিলাম ভাসুরের ব‍্যাপারে।
এই মানুষটা ছিল বড়োজার হাতের পুতুল।
যেভাবে নাচিয়েছে সেভাবেই নেচেছে।
অতি স্ত্রী ভক্ত ছিল।
কতো দেখেছি,স্ত্রীর পা টিপে দিতে ।বউ টিভি দেখে।সে পা টেপে।
বউয়ের জন্য রান্না পর্যন্ত করেছে।
সকালে উঠে দেখতাম বউয়ের কাপড় ধুয়ে দেয়,ঘর মুছে দেয়।
আমার মনে হতো ইনি কেমন পুরুষ!

একবারতো রান্না খারাপ হওয়াতে ভাসুরকে থাপ্পড় মেরেছিল বড়োজা।
সেদিন ভাসুর গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে ছিল ক‍্যাবলা কান্তের মতো।
বউ কিনে রেখেছিল তাকে।
স্বামী হিসেবে নয়,কাজের লোক করে পেলেছে।
এজন্যই হয়ত নতুন সংসার গড়েছে লোকটা।

আমি বাড়ি পৌঁছে কাজে লেগে যাই।
তটিনী ফোন করেছে কয়েকবার।
আমি ধরিনি।
আমার সঙ্গে কথা বললে ওর সমস্যা সৃষ্টি হবে সংসারে।

এর মাঝে ফোন আসে বসের।
প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে কল রিসিভ করেছি।
স‍্যার বলেন,”একটা রেস্টুরেন্টের ঠিকানা দিচ্ছি।ওখানে চলে আসুন।
সব মিটমাট করে নিতে চাই।খোলাখুলি কথা বলতে চাই।আপনি সরাসরি উত্তর দিয়ে দেবেন আমায়।
এভাবে ঘোরানোর কোনো মানেই হয়না।লোকে আমাদের নিয়ে মন্দ কথা বলছে।
আমার কর্মক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।”

একবার ভাবি যাবনা।পরক্ষণে ভাবি,গিয়েই দেখি।যদি সব ফয়সালা হয়ে যায়।
দিনকে দিন ঝামেলা বাড়ছে।
এ লোকের জন্য আমার সম্মানে আঘাত হানতে পারে।

বুঝিয়ে সুঝিয়ে সব মিট করে নেব।
প্রয়োজনে এমাস পার হলে আমি কাজ বাদ দিয়ে দেব।
তবুও আর কোনো রিস্ক নিতে চাইনা।

ঘড়ি বাধা সময় আধঘন্টা থাকবো সেখানে।এর মাঝে যা কথা হওয়ার হবে।
মেয়েকে খাইয়ে ঘুম পারিয়ে চাচির ঘরে রেখে গেছি।
ছেলে নিয়ে বেড়িয়েছি।
ইচ্ছে ছিল লতা আপাকে সঙ্গে নেওয়ার।কিন্তু তিনি কাজে।চাচিও দোকানে ব‍্যস্ত।
একা একা কোথাও যেতেও ভয় লাগে।

হেঁটেই গিয়েছি।খুব বেশি দূরে নয় রেস্টুরেন্টটি।
ভেতরে যেই না আমি প্রবেশ করেছি স‍্যার চেয়ার ছেড়ে ফুল হাতে হাসিমুখে দাড়িয়েছে।
পেছন পেছন যখন ছেলে ঢুকেছে ওমনি তার মুখ ব‍্যাজার।
ধপ করে চেয়ারে বসে পড়েছে।
আর কোনো কথা,হাসি নেই।

আমি গিয়ে সামনের ফাঁকা চেয়ারে বসি।ছেলেও বসে।
স‍্যার দেখছি চুপ।
কিছুক্ষণ পার হয়ে যায়।তবুও সে কথা বলেনা।
শুধু মুখটা থমথমে করে এদিক-সেদিক তাকায়।

বিরক্ত হয়ে আমি নিজেই বলি,”আপনি কী কিছু বলেবেন স‍্যার?
বসে থাকতে ডেকে আনেননি নিশ্চয়।
একটু তাড়াতাড়ি বলুন।
আমার মেয়ে বাড়ি আছে।রেখে এসেছি।”

স‍্যার ওমনি ফট করে বলে,”তোহ ছেলেকেও রেখে আসতেন।
শুধু শুধু বাচ্চা টেনে আনার কী দরকার?
কোলের টাকে রেখে এসেছেন,বড়োটাকে আনার কী দরকার ছিল?
ও কী একা থাকতে পারতো না?”

“মানে আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?”

স‍্যার দেখলাম একটু নত হলো এবার।
মিথ‍্যা হাসার চেষ্টা করে বলল,”না মানে বাচ্চাটার কথা ভেবেই বললাম।
ছোট মানুষ,শুধু শুধু এখানে টেনে আনার কী দরকার ছিল?
এখানে তো ওর কোনো কাজ নেই।বসে বসে বোর হবে।
এর চেয়ে ভালো ছিল বন্ধুদের সঙ্গে খেলতো।
এছাড়াও বড়োদের বিষয়ে বাচ্চার সামনে কথা বলতে নেই।”

“আমাদের ভেতর এমন কোনো সম্পর্ক নেই বা এমন কোনো কথা নেই যা শুনলে আমার বাচ্চার ওপর খারাপ প্রভাব পড়বে।
আমি আমার সন্তান নিয়ে আসতেই পারি।
এখানে অখুশি হওয়ার কিছু নেই।
একজন মাকে ডাকলে বাচ্চা আসবেই।এটা স্বাভাবিক।
আপনি কী বলতে ডেকেছেন বলুন।
আমার সময় কম।খেটে খাওয়া মানুষ আমি।প্রতিটি মিনিটের দাম আছে আমার কাছে।”

স‍্যার হয়ত এমন কথা আশা করেন নি আমার থেকে।
কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন।
নিজেকে সামলাতে উঠে দাড়ালেন।
হেঁটে গিয়ে কফির অর্ডার করলেন।
এরপর বসলেন।
ফুলের তোড়াটি এগিয়ে দিয়ে বললেন,”এটা আপনার জন্য মিস তন্নি।”

ছেলে আমার এতো ফুল দেখে একটু ছুতে নিল।
স‍্যার সরিয়ে নেয় তোড়া।
চোখ পাকিয়ে বলে,”এটা তোমার মায়ের জন্য।তোমার জন্য নয়।”

আলিফ মুখ ঘোমড়া করে হাত সরায়।

এনার ব‍্যবহার দেখে অবাক হই।আগে থেকেই এমন কিছু আন্দাজ করেছিলাম।
যতো প্রেম আমার জন্য,আমার বাচ্চাদের জন্য সামান্য করুণাও নেই এনার মনে।

আমি ফুলটি না নিয়ে বলি,”পাশেই রাখুন।ফুল দিয়ে আবেগ দেখানোর বয়স বা সময় কোনোটাই আমাদের নেই।
কাজের কথা বলুন।”

“এতো তাড়া কিসের মিস তন্নি?
সবে এলেন।একটু চা-কফি খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিন।”

আমি জবাব দেইনা কোনো।

স‍্যার আবারো বলেন,”ঐ সেদিনের বিষয়ে কথা বলতে চাই আমি।
ঐদিন কোনো উত্তর দেননি।
আজ তো দেবেন।
কতোদিন আর ঝুলিয়ে রাখবেন আমায়?”

“আমি কোনোভাবেই আপনাকে ঝুলিয়ে রাখিনি।
আমাদের মাঝে এমন কোনো সম্পর্ক ও নেই।
আমি আপনাকে আগেও বলেছি, এবারও বলছি।
নিজের জীবন নিয়ে ব‍্যস্ত থাকুন।
আমায় নিয়ে এসব বাজে চিন্তা না করে নিজের কাজ ও ভবিষ্যৎ এর দিকে খেয়াল রাখুন।
আমি ডিভোর্সি।
দুই সন্তানের জননী আমি।সবকিছু আমার জন্য এতো সহজ নয়।”

“সহজ করে নিতে হবে মিস তন্নি।
কঠিন বস্তুকে সহজ করাই মানুষের কাজ।
আপনি ডিভোর্সি এটা দোষের কিছু নয়।
বেবিও নর্মাল।ভুল বসত বেবি হয়ে যেতেই পারে।
তাই বলে আপনার জীবন থেমে থাকবে?
আপনি ইচ্ছে করে নিজের নামের সঙ্গে ডিভোর্সি তকমা লাগান নি।তাহলে সমস্যা কোথায়?
কেউ কী জীবনকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয়না?
একা বাঁচা যায়?
কতোকাল আপনি একা থাকবেন?
আপনার পাশে একজনকে দরকার।
যিনি আপনায় ভরসা দেবেন।সুখ-দুঃখের সঙ্গী হবে।
বিপদে পাশে থাকবে।যার জন‍্য,যার পরিচয়ে বাঁচবেন আপনি।”

আমি কিছুপল চুপ থেকে বলি,”বলাটা খুব সহজ স‍্যার।করাটা খুবই কঠিন।
আমায় মেনে নেবে আপনার পরিবার-পরিজন?
ভালো নজরে দেখবে আমাদের?
সন্তান সমেত রাখতে পারবেন আমায়?
আপনার বাড়ির লোক মানবে এটা?”

উনি এবার কাশতে শুরু করে।
আমি মুচকি হেসে পানি এগিয়ে দেই।
স‍্যার পানি খায়।
ফোন বের করে পকেট থেকে।
হ‍্যালো হ‍্যালো করতে করতে বাইরে যায়।
যাওয়ার সময় বলে যায়,কফিটা খেয়ে নেবেন।
আজ আমার কাজ আছে তাই চলে যাচ্ছি।

আমার ভীষণ হাসি পায়।
কফিটা খাইনা আমি।ওয়েটার দিতে এলে অন‍্যকাউকে দিয়ে দিতে বলি।

ছেলের হাত ধরে বাইরে আসি।
আমি জানতাম এমনটাই হবে।
আমার সন্তানদের দায়িত্ব নেওয়ার কথা শুনে ইনি পালাবেন।
এটাই হয়।
পরের বোঝা কেউ টানতে চায়না।
আমার সন্তানদের আমাকেই দেখতে হবে।
রাশেদের মতো কিছু লোকেরা আসবে, ভালোবাসার কথা বলবে।নিজের করে নিতে চাইবে।
দায়িত্বের প্রসঙ্গ যখন উঠবে,তখনই পালাবে।
এটাই চলে আসছে।কতো শুনেছি।আজ দেখলাম।
এক নিমিষেই সব ভালোবাসা শেষ।
আশা করি স‍্যার আর বিরক্ত করবেন না আমায়।
এমনিতেও মনোস্থির করেছি,এই কাজ আর করবোনা।
কী থেকে কী হয়ে যায় বলা যায়না।
মাস শেষের বাকি আছে আর কটা দিন।কষ্ট করে সব হজম করে এতোদিন কাজ করলামই যেহেতু,মাসটা পার করেই বাদ দেব।
নাহয় আর বেতন পাবোনা।
হাতে আমার একশো টাকা মাত্র।
সেই হাজার টাকা ভেঙে খেয়ে শেষ।
যাতায়াত ভাড়ার টাকা পর্যন্ত নেই আর।
কষ্ট করে রোদে পুড়ে হেটে হেটে যাই কাজে।
অন‍্য একটা কাজ খুঁজতেও টাকার ব‍্যাপার।হালকা খরচ পাতি তো হবেই।
তাই এই টাকাটা আমার ভীষণ প্রয়োজন।

পরদিন ফ‍্যাক্টারি গেছি।
কাজ করেছি।লাঞ্চ টাইমেও একই অবস্থা।স‍্যার আমার পিছু পিছু ঘোরে।
মানুষটা বড্ড হ‍্যাংলা।

আমি একটা চেয়ারে বসে একহাতে মেয়েকে ধরে অন‍্যহাতে পানি খাচ্ছি বোতলে।
মেয়ে নড়াচড়া করছে।
ঠিক মতো পানি খেতে পারছিলাম না।স‍্যার এসে বোতলটা ধরে।
পানি খাওয়ার মাঝপথে আমি।
বাধ‍্য হয়ে তার হাতেই পানি খাই।

স‍্যার বলেন,”আপনার জন্য একটা সুখবর আছে তন্নি।
আমি আপনার সব সমস্যার সমাধান বের করে ফেলেছি।
এখন থেকে আপনার জীবনের সকল সমস্যা দূর হয়ে যাবে।আপনার মনে আর কোনো দ্বিধাদন্ড থাকবেনা।নিশ্চিন্তে বাকি জীবন কাঁটাতে পারবেন আপনি।
সকল মুশকিল আসান হয়ে যাবে।
আপনি চলুন আমার সঙ্গে।সোজা সেখানে নিয়ে গিয়ে আপনাকে সারপ্রাইজ করবো।এমন গিফ্ট আপনাকে কেউ দেবেনা।”

উনার এতো আগ্রহ ও কথা শুনে আমি ভাবলাম হয়ত আমার জন্য অন‍্য কোনো কাজের ব‍্যবস্থা করে দিয়েছে।
আমার জন্য উনার সমস্যাও হচ্ছিলো বটে।
এটা করলে ভালোই হবে।লোকের কথার হাত থেকেও বাঁচলাম,আবার একটা কাজও পেলাম।
এবার আমি নিজের মতো করে চলতে পারবো।
কোনো দূশ্চিন্তা থাকবেনা স‍্যারকে নিয়ে।

“কিন্তু এখন কীভাবে যাবো?
অফিস টাইম চলছে যে।”

স‍্যার বলেন,”সমস‍্যা নেই।আপনাকে ছুটি দিলাম আজ।
আপনি বাইরে গিয়ে একটা রিক্সা ডেকে উঠে বসুন।
আমি আসছি গাড়ি নিয়ে।”

স‍্যার চলে যায়।আমিও যাই।

রিক্সা ডেকে বসি।স‍্যার গাড়ি নিয়ে আসে। রিক্সা ওয়ালাকে ফলো করতে বলে।
অনেকটা পথ পাড়ি দেই।
ইনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমায়?
কোনো ক্ষতি করতে চাচ্ছে না তোহ?
মেইন রাস্তাতে ভয় নেই।কোনো নির্জন জায়গায় নিয়ে যেতে চাইলে যাবোনা।
এ রিক্সা করেই বাড়ি ফিরে কাজ বাদ দিয়ে দেব।

কিন্তু না।ইনি আমায় নিয়ে গেল একটা এতিম খানায়।
রিক্সা থেকে নামতে বলে।ভাড়া উনিই দেয়।আমি দিতে চেয়েছি।স‍্যার নেয়নি।

ভেতরে প্রবেশ করে আমায় নিয়ে।
চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখছি আমি।এখানে কী কাজ থাকতে পারে?
এখানে কেন নিয়ে এসেছে?

আমায় রেখে স‍্যার একটা মহিলার সঙ্গে কী যেন কথা বলে।
এরপর আমায় ডাকে।
কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,”আপনাকে মেয়ের বা ছেলের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে বলবেন আপনি ওদের খালা বা মামি।মা-বাবা বেঁচে নেই।
মা বাবা বেঁচে আছে জানলে নাও নিতে পারে।”

আমি কিচ্ছু বুঝলাম না স‍্যারের কথা।
কাকে কী নিতে বলছে?

স‍েই মহিলার কাছে গেছি।
স‍্যার বলেন,”ইনিই এই বাচ্চা মেয়েটাকে আর একটা ছয় বছরের ছেলেকে এখানে রাখতে চায়।একেবারে দিয়ে দিতে চায় এতিম খানায়।
বাচ্চার মা-বাবা কেউ নেই।”

আমার পায়ের তল থেকে যেন মাটি সরে আসে।
চিৎকার করে বলি,”কী বলছেন পাগলের মতো?
এসব কথার মানে কী?
ওরা আমার সন্তান।
আমি ওদের মা।আমি কেন আমার বাচ্চাদের এতিম খানায় দেব?”

স‍্যার আমায় একটু দূরে টেনে নিয়ে বলেন,”চিৎকার করবেন না প্লিজ।
আপনার ভালোর জন্যই বললাম।আপনিই তো বলেছিলেন ছেলে-মেয়ের জন্য নতুন জীবন শুরু করতে পারবেন না।তাই এই ব‍্যবস্থা করেছি অনেক ভেবে চিন্তে।
আমার পরিবার আপনাকে মেনে নেবে তবে বাচ্চাদের নয়।আমিও ঝামেলা চাইনা।
ওরা আমাদের ব‍্যক্তিগত জীবনে বিরক্ত করবে।
এরচেয়ে বরং ওদের এতিম খানায় দিয়ে আমি আর আপনি বিয়ে করে নেই।দুজন সুখে থাকবো।”

আমি সহ‍্য করতে না পেরে স‍্যারের গালে থাপ্পড় দিয়ে বেরিয়ে যাই সেখান থেকে।

(এটার আরেক অংশ আসবে ।পর্ব পরিপূর্ণ হয়নি।লিখতে পারিনি।দুঃখিত।)