#বড়োজা
#Nadia_Afrin
২৪
পরদিন সকালের কথা,,,,
লতা আপা এসে দরজায় কড়া নারে।
আমি সবে বিছানা থেকে নামছি তখন।দ্রুতই দরজা খুলি।
আপা হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করে বলেন,”খবর পেয়েছি বেলা এগারোটায় বিচার বসছে অফিস মাঠে।
আমি আজ কাজে যাব না।
যে বাড়ি কাজ করি ঐ বাড়ির আপার ছেলে উকিল।উনার সঙ্গে তোমার বিষয় নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি।যদি কোনো সাহায্য পাই।
তুমি ফোন কাছে রেখো।কল দিলে কথা বলবে।যা হয়েছে সব খুলে বলবে তাকে।”
আমি ‘জ্বী’ বলে বাইরে আসি।আপা চলে গেলেন।
রান্না করতে হবে কিন্তু হাত উঠছেনা আমার।
চাচি আমার অবস্থা দেখে নিজের ঘর থেকে ভাত এনে ছেলেকে খাইয়ে আমায় দিল কিছুটা।
খেতে চাইলাম না।জোর করলেন চাচি।সবে জ্বর থেকে উঠেছি।এটুকু না খেলে শক্তি পাবো না।বাধ্য হয়ে খেলাম।
বেলা দশটা নাগাদ কল এলো আমার ফোনে।দৌড়ে ঘরে গিয়ে নাম্বার না দেখেই রিসিভ করি কল।
কন্ঠ শুনে বুঝি রাশেদ স্যার।
তিনি বলেন,”আপনি ঠিক আছেন তো তন্নি?কোনো চিন্তা করবেন না আমি আপনার পাশে আছি।আমি আপনার পক্ষেই কথা বলবো।
আপনার কোনো ভয় নেই।”
উনার কথা গুলো শুনেই কল কেটে দেই আমি।রাগে গা জ্বলে আমার।
লতা আপা আর কল করেনা।
তিনি আসেন এগারোটা বাজার মিনিট দশেক আগে।
বলল,”যার কাছে গিয়েছিলাম তাকে পাইনি।ফোনে কথা বলে এসেছি।
চলো আমরা বিচারে যাই।যা হবে দেখা যাবে।”
আমার ভয় হচ্ছিলো ভীষণ।আপা সাহস দেয়।
ছেলেকে রেখে যাই চাচির কাছে।মেয়েকেও রাখি তার কাছে।উনিও যেতে চেয়েছিল।
বয়স্ক মানুষ,যেয়ে লাভ কী!
তাই আর নেই নি।
রিক্সাতে বসি।আমি ভীষণ ঘামছিলাম।আপা সাহস দেয় প্রচুর।
আমি আপাকে বলি,”আপা আমার মনে হচ্ছে এখানে কোনো ষড়যন্ত্র আছে।না’হলে আমি যে ওখানে যাচ্ছি ওরা জানলো কী করে?
একটু বুঝেশুনে কথা বলতে হবে আমাদের।”
“মনে সাহস রাখো তন্নি।
যা বলবে সরাসরি বললে।ঘাবড়ে গেলে চলবে না।শক্ত থাকতে হবে তোমায়।”
ওখানে গিয়ে পৌঁছে দেখি অনেক মানুষের ভির।আমি ওরনা দিয়ে মুখ পেচিয়ে নিচে নামি।আমায় দেখা মাত্রই শুরু হলো গুঞ্জন।
আপা সরাসরি আমার হাত ধরে সকলের মাঝে নিয়ে গেল।
অনেকেই আছে দেখলাম।রাশেদ স্যার এককোণে দাড়িয়ে আছে।
বিচার কার্যক্রম শুরু হলো।একে একে সবাই আমার বিপক্ষে সাক্ষী দিচ্ছে।সব দোষ যেন আমার।স্যারের নামে তেমন কোনো কথাই উঠছেনা।
এবার আমাদের প্রশ্ন করা হলো।যা ঘটেছে সবটা বর্ণনা দিলাম আমি।
প্রত্যেকে আমার কথার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলো।আমি নাকি সব মিথ্যা বলছি।
লতা আপা বলেন,”ও সত্য কথাই বলছে।ওর কথা ও কাজ পরিষ্কার।কিন্তু এখানে যা ঘটেছে তা পরিষ্কার নয়।
সম্পর্ক থাকলেও স্যার আর তন্নির মাঝে ছিল।উনারা এখানে দেখা করতে এলেও বাকিরা জেনেছে কী করে?
খবর পেলো কোথা থেকে?
তন্নি নিশ্চয় পাড়ায় পাড়ায় রটিয়ে আসবেনা নিজের দূর্নাম।
অর্থাৎ যা হয়েছে রাশেদ স্যারের ওখান থেকেই হয়েছে।”
স্যারকে প্রশ্ন করা হয় এবার।
উনি মিনমিনে স্বরে বলে,”আমি ফোনে কথা বলেছিলাম অফিসেই।হয়ত তখনই কেউ শুনে পিছু নিয়েছিল।”
“এটা সম্ভব?
অফিসের বস কোথায় কথা বলবে,কার সঙ্গে দেখা করবে সেসব কর্মচারী নজরে রাখবে?পিছু নিয়ে চলেও আসবে?
এতোই স্বস্তা সবকিছু?”
স্যারকে দেখলাম এবার চুপ।
উপস্থিত সকলে এবার স্যারের মুখপানে উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে।
স্যারকে সবাই মিলে চেপে ধরতেই তিনি বলেন এক জঘন্যতম কথা।
আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় যেন।
উনি বলেন,”আসলে আমায় তন্নি আসতে বলেছিল।তন্নির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল।কাল আমরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার কথা ছিল।তাই তন্নি ওর বাচ্চা সহ এসেছিল দেখা করতে।
যেহেতু বিয়ে করার কথা,তাই আমি আমার অফিসের কজনকে বিয়ের সাক্ষী দেওয়ার জন্য সবটা জানিয়েছিলাম।ওরাই হয়ত ছড়িয়েছে বিষয়টা।
কিন্তু বিশ্বাস করুন,তন্নির কোনো দোষ নেই।ও বা আমি জানতামনা এমনটা হবে।
হলে কখনোই ওখানে দেখা করতে আসতাম না।”
স্যারের কথা শেষ হতে না হতে উপস্থিত সকলে আমার দিকে তেড়ে আসে।
স্যার আসে দৌড়ে।সবার সামনে দাড়ায়।আমায় রক্ষা করার মিথ্যা নাটক করে।
ব্যাথিত কন্ঠে বলে,”প্লিজ ওকে কেউ কিছু বলবেন না।আমরা একে-অপরকে ভালোবাসি।
আমাদের কোনো দোষ নেই।”
রাগে জ্বলে ওঠে আমার গা।
উনাকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই আমি।
চিৎকার করে বলি,”জা*নো*য়া*র কোথাকার!
মিথ্যা বলিস কোন সাহসে।তোর সঙ্গে আমার কিসের সম্পর্ক?চরিত্রহীন একটা লোক।
অসভ্য পুরুষ মানুষ।তোকে জুতো পেটা করা উচিৎ।”
স্যার তেড়ে আসতে নিলে সবাই তাকে আটকে দেয়।
তিনিও উচু গলায় বলেন,”কাজটা ঠিক করলেনা তন্নি।আমি তোমায় বাঁচাতে চেয়েছিলাম ভালোবাসি বলেই।নিজে মা*র পর্যন্ত খেতে চেয়েছি তোমার জন্য।
সেই তুমিই কিনা লোক সমাজে আমায় অস্বীকার করে যা তা বললে।
আমার ভালোবাসার কোনো দাম নেই তোমার কাছে।ভালোবেসে ঘর বাধতে চেয়েছিলাম তোমায় নিয়ে।
আমার সম্মান নিয়ে খেলা করলে তুমি।এবার আমিও আর তোমায় নিয়ে ভাববো না।”
আমি উত্তেজিত হয়ে পড়ি।প্রচন্ড চিৎকার করি।লতা আপা আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলেন,”কোনো প্রমাণ আছে এসবের?
একটা মেয়ের নামে কোন সাহসে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছেন আপনি?”
“অবশ্যই প্রমাণ আছে।আমার অফিসের প্রতিটি লোক সাক্ষী।তন্নি আমার কাছ থেকে আলাদা সুবিধা পেয়েছে।লোকে একটা খাবার পেলে সে পেয়েছে দুটো।
কোনো সম্পর্কই না থাকলে এতোকিছু সম্ভব?
এছাড়াও উনি আমার সঙ্গে কতো জায়গায় ঘুরতে গেছে।আমরা বিয়ের পরিকল্পনা করেছিলাম বেশ আগেই।সেজন্য এক এতিমখানায় অব্দি গিয়েছিলাম ওর বাচ্চাদের রাখতে।কিন্তু তন্নি রাজি হয়নি বিধায় ভালোবাসার জন্য ওর বাচ্চাসহই মেনে নিয়েছিলাম আমি।আপনারা বিশ্বাস না করেন সেই এতিমখানার মহিলাকে ডাকুন।তিনিই বলুক তন্নি আমার সঙ্গে গিয়েছিল কিনা।
এছাড়াও আমরা রেস্টুরেন্টে দেখা করেছি,ওর বাড়ির পাশে দেখা করেছি।অনেকে আমাদের দেখেছেও।বিষয়টি ছড়িয়ে যাচ্ছিলো বলেই কিন্তু আমরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
এখন এতো মানুষ দেখে তন্নি পল্টি মারছে।
যদি ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কই থেকে না থাকে,শুধু মাত্র আমার কথায় কেন ভরসন্ধ্যায় নির্জনে দেখা করতে আসে?
এছাড়াও আমার ফোন চেক করুন।অসংখ্য কল লিষ্ট আমাদের।
প্রতিনিয়ত কথা হয়েছে আমাদের।সাধারণ একজন কর্মচারীর সঙ্গে মানুষ এতো কথা বলে?
অন্যদের জিজ্ঞেস করুন তাদের সঙ্গে আমার এত কথা হয় কিনা।রাত-বিরাতে যখন সময় পেয়েছি কথা বলেছি।সম্পর্ক না থাকলে কথাই বা বলেছে কেন?দেখাই বা করলো কেন?
আজ সকালেও কথা হয়েছে আমাদের।
বিশ্বাস না করলে উনারই ফোন চেক করুন।
ভালো না বাসলে কেন আমি উনার দোষ নিজের কাধে নেব?ডেকেছিল তো উনি আমায়?শুরুতেই এ কথা বলে কিন্তু আমি কাটিয়ে যেতে পারতাম।কিন্তু আমি তা না করে ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছি।”
আমি চিৎকার করে ‘সব মিথ্যা সব মিথ্যা’ বলতে লাগলাম।
কেউ শুনছেনা আমার কথা।
বিচারের লোকেরা বলছে, সত্যিই তো।ছেলেটার কথায় যুক্তি আছে।
লতা আপা কিছু বলতে চেয়েও পারছেনা।
সবাই মিলে মিথ্যা সাক্ষী দিচ্ছে আবারো।কেউ কেউ বলছে আমাদের অপ্রস্তুত অবস্থায় ও নাকি দেখেছে।
আরো কতো কী!
সম্পূর্ণ দোষটা এলো আমার ঘারে।
আমিই টাকার লোভে রাশেদের সঙ্গে সম্পর্ক করেছি।এবার ঝামেলা হওয়ায় প্রতারণা করেছি ভালোবাসার নাম করে।
আমি অর্থলোভী।চিটার,চরিত্রহীন একটা মেয়ে।
এটাই আমার ব্যবসা।সম্পর্ক করে অর্থ লুটি।ধনী ছেলেদের ফাঁসাই।
এবার আর বিয়ে নয়।গালে কালি মাখবে আমার।
লতা আপা প্রতিবাদ করে।কোর্টে যেতে চায়।
এই বিচার মানবেনা বলে জানায়।
আমায় নিয়ে টেনে বেড়িয়ে আসতে লাগে।
আমি অনুভূতি হীন মৃত মানুষের মতো শুধু টানাটানি সহ্য করছি।
কোথা থেকে দুটো মহিলা এসে আমার গায়ে কাঁদা ছুড়ে মারে।
গলায় ও পেটে আসে লাগে।প্রচন্ড ঝামেলা তৈরি হয়।মা*রা*মা*রির পর্যায় হয়।যে যার মতো পালিয়ে যেতে লাগে।
সুযোগ পেয়ে আপা আমায় ছো দিয়ে রিক্সায় উঠিয়ে দেয়।
রাস্তা দিয়ে যাই,আর যে দেখে সেই বলে দুশ্চরিত্রা।
বাড়ি পৌঁছি ওমন ভাবেই।
বস্তিতে ঢুকেই জ্ঞান হারাই।
পানি ঢালে কজনে।পুরো বিষয় ছড়িয়ে গেছে।আমায় নিয়ে বিচার হয়েছে এটা সবাই জেনে গেছে।যারা বাচ্চা পড়াতো তারা এসে বলে,”এর কাছে আর ছেলে-মেয়ে পড়াবো না।ইনি নিজেই নোংরামো করে বেড়ায়।আমাদের বাচ্চাদেরও তাই শেখাবে।”
সবই শুনি আমি।আমার নামে চারপাশে ছি-ছিৎকার হচ্ছে।
আলিফ দৌড়ে আসে কাছে।
আমায় ধাক্কিয়ে বলে,”আম্মু ওরা কী বলছে?তুমি নাকি ধরা পড়েছো।সবাই বলছে তোর মা ধরা পড়েছে।তুমি কী চুরি করতে গিয়েছিলে আম্মু?
তোমার গায়ে কাঁদা কেন?লোকে তোমায় ধরে কী মে*রে*ছে কালকের মতো?”
ছেলের কথার কোনো জবাবই দিতে পারিনা আমি।
লতা আপা ছেলেকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দেয়।
আমায় পানি ঢালে।মহিলারা মিলে ঘেরাও করে সেখানেই গোসল করিয়ে দেওয়া হয়।
কাপড় বদলে আপা আমায় ঘরে নিয়ে আসে।
বিছানায় বসিয়ে পানি খেতে বলে।
আমি খাইনা।কাঁদছিও না।নিশ্চুপ বসে আছি।
আপা কাঁদতে বলে।শরীর ধরে ঝাকায়।
বাধ্য হয়ে থাপ্পড় পর্যন্ত বসায় গালে।তবুও কাঁদিনা আমি।শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি।
বস্তির মাঝে আমায় নিয়ে নানান কথা হচ্ছে।বেশিরভাগ আমার বিপরীতে কথা বলছে।
আমায় ভালো ভেবেছিল।আমি আসলে ভীষণ বাজে।
আগের সম্পর্কের জের ধরেও দোষ দেয় আমারই।
আমার জন্যই নাকি আমার সংসার ভেঙেছে।
আমি খারাপ।
প্রতিটি কথাই কানে আসে আমার।ঘরের সামনে দিয়েই বলছে এসব।কানে তো আসবেই।প্রতিবাদ করিনা আমি।
মনে মনে সৃষ্টি কর্তাকে শুধু ডাকছি আমার কিছু হয়ে যেতে।অথবা মাটি ফাঁক হোক।আমি ঢুকে যাই।ছেলে-মেয়ে কারো চিন্তাই আর নেই আমার মনে।
জানেন,লোকে আমার মৃত মা-বাবা নিয়ে পর্যন্ত বাজে কথা বলছে।যারা তাদের দেখেও নি কোনোদিন তারাই বলছে আমার মা নাকি নোংরা কাজ করতো।এজন্য আমি এমন হয়েছি।
অথচ আমার মা ছিলেন হাফেজা।বাবাও ভীষণ ধার্মিক।
সন্তান হিসেবে ইচ্ছে ছিল মৃত মা-বাবার নাম উজ্জ্বল করবো।আজ কিনা আমার জন্যেই আমার নিরাপরাদ মা-বাবাকে লোকে এতো বাজে কথা বলছে।
লতা আপার মেয়ে ঘরে আসে।এসে তার মাকে বলে,”মা আলিফের মায়ের কী হয়েছে?
বাইরে সবাই বলছে ওর মা বাজে মহিলা।ওর মায়ের সঙ্গে যেন আমরা আর না মিশি।তাহলে নাকি আমরাও খারাপ হয়ে যাব।
উনি কী করেছে মা?খারাপ কেন হলো?”
আমি মেয়েটাকে কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে বলি,”আসলেই আমি ভীষণ বাজে মা।তোমরা আমার থেকে দূরে দূরে থাকবে।
কেমন?”
আপা বলেন,”তুমিও না বাচ্চা হলে তন্নি।বাচ্চাদের কথায় কান দিতে আছে?”
আপা তার মেয়েকেও ধমকে সরিয়ে দেয়।
আমি বলি,”কজনকে থামাবেন আপা?কজনকে ধমকাবেন?
চামড়ার মুখ ঠেকানো যায়না আপা।”
“সে তোমার ভাবতে হবেনা।একগ্লাস পানি খাও।পানি খেলে মাথা ঠান্ডা থাকে।”
আমার হাতে গ্লাস ধরিয়ে দেয় তিনি।
কাঁচের গ্লাস।পানি হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখি আমি।গ্লাসে নিজের মুখ দেখা যায়।কেমন বিশ্রি একটা চেহারা।
ঘৃণা লাগে আমার।
পানির গ্লাসটা চেপে ধরে নিজের মাথাতেই আঘাত করি।
আমার এমন কান্ডে সবাই হতভম্ব।কেউ আশা করেনি এমনটা।গ্লাস ফেটে যায়।কাঁচ ছড়িয়ে পড়ে।
আমি আবারো সেটা দিয়ে মাথায় আঘাত করতে নিলে আপা আর চাচি ও একজন মহিলা মিলে আটকে দেয়।এবার আঘাত করলে কাঁচ বিধে পড়তো মাথায়।হয়তো আর বাঁচতাম না।এটাই আমি চাই।
শব্দে মেয়ে আর ছেলে সে কি কান্না ভয়ে!
লতা আপা গ্লাস কেড়ে নিয়ে ফেলে দেয় বাইরে।মাথা ঝেড়ে দেয়।দু জায়গায় কেটে গেছে।র*ক্ত গড়িয়ে পড়ছে চুলের ভেতর দিয়ে।
চাচি দ্রুতই মলম এনে লাগিয়ে দেয়।
কিন্তু আমি কোনো ব্যাথাই পাচ্ছিনা।আঘাতটাকে অনুভবই করতে পারছিনা।
আপা বোঝায়,”ছেলে-মেয়ে আছে।ওরা ভয় পাচ্ছে।পাগলামো করোনা।
ধৈর্য্য ধরো।”
ধৈর্য্য কথা শুনে হাসি আমি।এই মূহুর্তে এই কথাটা ভীষণ হাস্যকর লাগছে আমার কাছে।
এরই মাঝে এলো বেশ কিছু লোক ও মহিলা।সঙ্গে অফিসের অনেকে।
প্রচন্ড চ্যাঁচামেচির শব্দ।
বস্তির লোক সব জড়ো হয়েছে।বস্তির মাঝে সবাই আমার বিরোধীতা করতে এসেছে।
আমায় এই এলাকা ছাড়া করতে এসেছে।লতা আপা আমায় ও চাচিকে ভেতরে বসিয়ে রেখে বাইরে আসে।
সবাই মিছিল করছে রীতিমতো।আমায় তারা সরিয়েই ছাড়বে।
আমি সমাজের কীট।এখানে থাকলে আরো ছেলের জীবন নষ্ট করবো।স্যার নাকি আমার জন্য মরতে গেছে।
লতা আপা বলেন,”তন্নি কী মরতে বলেছিল আপনাদের স্যারকে?”
সবাই বলে,ওর জন্যই তো এমন হলো।ও প্রতারণা না করলে বেচারা এমন ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিত না।
স্যার নাকি হাসপাতালে ভর্তি।
আপা বলেন,তন্নি আর ওখানে যাবেনা।উনার আশেপাশেও যাবেনা।
ওরা বলে,তা হবে না।ঐ মেয়েকে এই এলাকা ছাড়া করতে হবে।আজ একটা ছেলের জীবন নিয়ে খেলেছে।কাল আরেকজনের সঙ্গে এমন করবে।
ওকে এলাকা ছাড়া করলে একটা উপযুক্ত শিক্ষা পাবে।সারাজীবন মনে রাখবে।
আপা বলেন,এভাবে বললেই হয় নাকি?এটা আমাদের বস্তি।আমরা ওকে রাখবো।
তখন হলো আরেক ঝামেলা।
বস্তিটা যেহেতু একটা এলাকার মাঝেই তাই এলাকার সকল ব্যাক্তিবর্গ বলল,যদি তন্নিকে এখান থেকে না সরানো হয় আমরা বস্তি উৎখাত করবো।
প্রয়োজনে পুলিশ সহ গুন্ডা লেলিয়ে দেব
এবার দেখলাম ভয়ে পিছিয়ে গেল সকলেই।টাকা ওয়ালা মানুষ এরা।বস্তির গরিব মানুষেরা এদের সঙ্গে পারবেনা।
সঙ্গে কম শিক্ষিত দিন এনে খাওয়া মানুষ এরা।ঝামেলা বোঝেনা।
তবুও কজনকে দেখলাম আইনের সহায়তা নেওয়ার কথা বলল।
ওমনি এক লোক তাদের ডেকে বলছে,”পরের জন্য বেশি ঝামেলা করতে যেও না।এমন কাঁদায় ফেলবো যে উঠতে পারবেনা।
কেস করবে,লড়বে টাকা আছে?উকিল খরচ তোমার আছে নাকি তোমাদের তন্নির আছে?
পুটি মাছ তোমরা।শুধু শুধু বোয়াল মাছের চোখে ধরা পড়ে লাভ আছে?
এরচেয়ে যেমন শান্তিতে আছো তেমন থাকো।”
ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে লাগে সকলে।নিজের খেয়ে কে ই বা পরের মোষ তাড়ায়?
তাও এই বস্তির মানুষ গুলো আমার জন্য দুটো কথা বলেছে।
লতা আপা ছাড়ছেনা হাল।তিনি তর্ক করছে।
এক সাহেবি বেশে লোক এগিয়ে এসে বলল,”তোমার স্বামী আমার ভাড়ার রিক্সা চালায় না?রিক্সা চালকের বউ হয়ে এতো বড়ো বড়ো কথা বলছো?
স্বামীর রিক্সাটা চলে গেলে কী করবে?কী দিয়ে চালাবে সংসার?
পেটে পাথর বেধে থাকতে হবে।না খেয়ে থাকলে তন্নি এসে খাবার দেবেনা।নিজের চিন্তা নিজে করো।ঝামেলায় জড়িয়ে বিপদ ডেকে এনোনা।বড়ো মাথারা জড়িয়ে আছে এখানে।তোমাদের বস্তির মানুষের চোপা পেরে উঠবেনা কখনোই।
এক ব্যাগ টাকা ছড়ালে সবার মুখ বন্ধ হবে।
সুতরাং সরে দাড়াও।আমাদের কাজ আমাদের করতে দাও।”
লতা আপার স্বামীকে দেখলাম দূরে দাড়িয়ে ইশারা করছে চুপ করতে।
পরিস্থিতি হাতের নাগালে যেতে দেখে চাচি বেড়িয়ে এসে হাত জোর করলো সবার সামনে।বলল,”দয়া করে মেয়েটাকে মুক্তি দিন।যা হওয়ার হয়েছে।ও শাস্তি পেয়েছে।এবার তো অন্তত রেহাই দিন।মেয়েটা এতিম।কেউ নেই আমরা ছাড়া।
দুধের বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাবে মেয়েটা?
একটু দয়া করুন আপনারা।”
এক লোক বলেন,”এসব পাপ করার আগে ভাবা উচিৎ ছিল।এখন পাপ যেহেতু করেছে শাস্তি পেয়েছে আরো পাবে।
চূড়ান্ত শাস্তি হবে ওর।
আপনার বেশি দরধ হলে আপনাকে সহ তাড়ানো হবে।
আপনার দোকান ঘরটা কিন্তু আমার জায়গার ওপর।
গরিব বলে ছাড় দিয়ে রেখেছি।বেশি ক্যাচাল করলে দোকান উঠিয়ে দেব কিন্তু। ভিক্ষা করেও ভাত পাবেন না তখন।”
চাচি চুপ গেল।
এরই মাঝে আসে খালা।তিনিও অনুরোধ করে বলে,”মেয়েটা বড্ড ভালো।আপনারা ওকে ছেড়ে দিন।ওর সঙ্গে এতোবড়ো অন্যায় করবেন না।”
একজন মহিলা বলেন,”এই এলো আরেক চামচা।এ এসেছে নীতির কথা বলতে।যার নিজের নীতিই ঠিক নেই।”
লতা আপাকে আর চাচিকে সবাই যা তা বলতে লাগলো।আমার খারাপ কাজের সঙ্গে নাকি তারাও যুক্ত।
এবার আর চুপ থাকলাম না আমি।মেয়েকে কোলে উঠিয়ে বের হলাম ঘর থেকে।
চাচি দৌড়ে এসে বলে,”তুমি কেন বের হলে তন্নি?ঘরে যাও।আমরা দেখছি তো।”
আমি জবাব দিলাম না কোনো।সোজা হাঁটলাম।
ছেলের হাত ধরলাম।
লোকে প্রচন্ড চিৎকার শুরু করলো।আমায় বাজে কথা বলল।একেক জনের একের কথা।
আমি প্রতিবাদ করলাম না তাতেও।
রাস্তার দিকে হাঁটা ধরলাম।
লতা আপা আর চাচিও আমার পিছু পিছু আসতে লাগলো।আমায় ডাকছে ভীষণ।কিন্তু শুনছিনা আমি।
কজন ছেলে আমায় নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগে।ঢিল ছুড়ে মারে গায়ে।পিঠে লাগে ভীষণ।
ছেলের গায়ে লাগে দুটো।ছেলে ব্যাথায় আর্তনাদ করে ওঠে।
তবুও হাঁটি আমি।মেইন রাস্তায় আসি।কজন মহিলা আমায় দেখে ফিসফিস করে বলে,”দেখ এটা সেই তন্নি।অফিসের স্যারের সঙ্গে নষ্টামি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে।
মেয়েটা একেবারেই লজ্জাছাড়া।নাহলে দেখ এখনো রাস্তা দিয়ে হাঁটছে।আমি হলে কখন গলায় দ*ড়ি দিতাম।
এই মেয়ে বাচ্চা দুটোর জীবনও নষ্ট করছে।কলঙ্কের দাগ একবার গায়ে লাগলে সারাজীবন থাকে।বাচ্চা দুটো যখন বড়ো হবে মায়ের জন্য লোকসমাজে মুখ দেখাতে পারবেনা।
সবাই বলবে নষ্টা মহিলার ছেলে-মেয়ে।
পুরো ভবিষ্যৎ শেষ বাচ্চাগুলোর।”
আমি তাকালাম তাদের দিকে।তারা আমার তাকানো দেখেই চলে গেল।
ছেলের দিকেও তাকাই একবার।ফ্যালফ্যাল করে বাচ্চাটা চেয়ে আছে আমার দিকে।
একটা রিক্সা পেলাম সামনে।তাতেই উঠে বসি।
লতা আপা আর চাচি দৌড়ে আসতে লাগে।আমি রিক্সা ওয়ালাকে রিক্সা ছাড়তে বলি।
রিক্সা চলতে শুরু করে।চাচি ও আপা আমায় ডাকে চিৎকার করে।থামতে বলে।আমি থামিনা।
পেছন থেকে আপা উচ্চস্বরে বলে,”তোমায় ফিরতে হবে তন্নি।যোগ্য সম্মান নিয়ে ফিরবে। যারা আজ তোমায় পাথর ছুড়ে তাড়িয়ে দিল,তারাই যেন তোমায় ফুল দিয়ে বরণ করে।
কিছু পাপির কথার জবাব দিতে হবে তোমায়।কাজ দিয়ে দেবে সেই জবাব।
যে কলঙ্কের বোঝা কাধে নিয়ে আজ বস্তি ছাড়লে সেই কলঙ্কই যেন তোমার জীবনে সম্মানের রাস্তা তৈরি করে দেয়।
আমরা তোমার অপেক্ষায় থাকবো তন্নি।”
আপার কথাগুলো আমার কানে ঝনঝন করে বাজে যেন।
রাস্তা দিয়ে যতো যাই লোকে আমায় হাত দিয়ে ইশারা করে করে বাজে কথা বলে।
কেউ বলে,’এমন মেয়ে আমার ঘরে হলে নিজ হাতে খু*ন করতাম।
‘জন্মের সময় এর মা-বাবা ভুল করেছে গলায় লবণ না দিয়ে।তখন মরে গেলে অন্তত আজ এই করুণ পরিণতি হতোনা।
‘এই মেয়ে শুধু নিজের না।বাচ্চার জীবন ও নষ্ট করেছে।ওর জন্য ওর বাচ্চারা ভালোভাবে বাঁচতে পারবেনা কোনোদিন।মাথা তুলে দাড়াতে পারবেনা।
আমি শুধু হাসি সামান্য।
কিচ্ছু বলার নেই।
রিক্সা চলে।চালক জিজ্ঞেস করে কোথায় যাবেন?
আমি বলি সামনে।
আরো সামনে যাই।
চালক আবারো সুধায় কোথায় যাবেন।
আমি বলি,আরো সামনে।
অনেকটা পথ পারি দেই আমরা।ছেলে চুপচাপ বসে আছে পাশে।
এক পর্যায়ে রিক্সা চালক বিরক্ত ও ক্লান্ত হয়ে রিক্সা থামায়।
এতো দূর এসেছি যে উনার বাড়ি যেতে লস হয়ে যাবে।কোনো যাত্রী পাবেনা ওখানকার।
তিনি চোখ গরম করে বলেন,”পাগল নাকি আপনি?কোথায় যাবেন বলেন না কেন?
শুধু সামনে সামনে করেন।আর কতো সামনে যাব?আপনাকে সামনে নিতে গিয়ে আমার পুরো গাড়ির চার্জ প্রায় শেষ।এবার বাড়ি পৌঁছাতে পারলে হয়।আপনার কোনো ধারণা আছে কতোদূর এসেছি?
আপনাকে রিক্সাতে তোলাই ভুল হয়েছে আমার।
এবার জরিমানা দিন।যাওয়া আসা দুটোর ভাড়াই দিতে হবে আপনায়।
দিন চারশ টাকা।
আমি কিছুক্ষণ উনার দিকে তাকিয়ে থেকে ওরনার প্যাচ খুললাম।
ভেতরে দুইশত টাকা মাত্র।এটাও তটিনী দিয়েছিল ছেলেকে।
এই টাকাটাই বারিয়ে দিলাম তার নিকট।
লোকে মহা রাগান্বিত।পুরো টাকা না নিয়ে কিছুতেই যেতে দেবেনা আমায়।
বাধ্য হয়ে নিজের ফোনটা বের করলাম সিমটা খুলে ছুড়ে পুকুরে ফেলে দিয়ে ফোনটা তাকে দেই।
তিনি এপিঠ-ওপিঠ করে বলেন,”ভালো ফোনই দেখছি।বিক্রি করলে চার-পাঁচশ হয়ে যাবে।
ঠিক আছে এবার আপনি যান।”
উনি মনের সুখে গান গাইতে গাইতে চলে যায়।
আমি তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলি।
স্বার্থছাড়া এ দুনিয়ায় কেউ চলেনা।
ছেলের হাত ধরে হাঁটা ধরি।অনেকটা হাঁটি।ছেলে পায়ের ব্যাথায় ঝুকে ঝুকে হাঁটছে।বারবার প্রশ্ন করছে কোথায় যাচ্ছি কেন যাচ্ছি।
সন্ধ্যা হয়ে আসে প্রায়।মেয়েও কাঁদছে।
আমার চোখ ভারি হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। মৃত্যু যেন অতি নিকটে।
কিন্তু না।দায়িত্ব পালন না করে মরবোনা আমি।
আরো হাঁটলাম।একপর্যায়ে ছেলেকে টেনে টেনে নিয়ে হাঁটলাম।
পায়ে ফোসকা পড়ে গেছে মা-ছেলে দুজনেরই।এর মাঝে আমার খালি পা।
অদূরে একটা অনাথআশ্রম বা এতিমখানা দেখলাম।
মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফোটে আমার।
পা চালিয়ে সেদিকেই গেলাম।ছেলেকে বললাম দ্রুত হাঁটো।বাড়ি পেয়েছি।
আশায় আশায় ছেলেও যথাসাধ্য জোরে হাঁটে।
ওখানে প্রবেশ করি আমি।খুবই শুনশান।মাত্র কজন মানুষ বসে আসে।বড়ো-ছোট ছেলে-মেয়েরা খাচ্ছে,পড়ছে।আমার ছেলে ক্লান্ত হয়ে মেঝেতে বসে পড়ে।
আমায় দেখে এক মহিলা এগিয়ে আসে।পরিচয় দিয়ে বলেন,”আমি পারভীন।এই এতিমখানা সহকারি পদে আছি।
আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?”
“আমার দুটো ছেলে-মেয়ে আছে।আপনাদের এখানে রাখবেন?
আমার না কোনো যাওয়ার জায়গা নেই।
আপনারা নিয়ে নিন ওদের।আমি চলে যাব।কোনো দাবি নিয়ে আসবোনা।
ওরা এতিম।”
মহিলাটি হয়ত একটু অবাকই হলো আমার কথায়।
বলল,”আপনিতো বেঁচে আছেন।তাহলে ওরা কীভাবে এতিম হয়?আর বাবা কোথায় ওদের?”
“ওদের বাবা বিয়ে করেছে ওদের ঠকিয়ে।বাবা থেকেও নেই।
আমিও থাকবোনা।
আপনি ওদের রাখলে আমি নিশ্চিন্তে চোখ বুজবো।আমি এই দায়িত্ব পালনের জন্য বেঁচে আছি।ওদের কারো হাতে তুলে দিয়ে আত্মহত্যা করবো আমি।
আমি ভীষণ ক্লান্ত।আমি এবার মুক্তি চাই।”
মহিলাটি বিষ্ময়ে চোখ দুটো বড়ো বড়ো করলেন।
আমি মেয়েকে কোনোমতে তার হাতে তুলে বাইরে ছুট লাগালাম।
মহিলা চিৎকার করে বলে,”উনাকে ধরো কেউ।উনি ঠিক নেই।”
সবাই পিছু নেয় আমার।পারভীন মহিলাটিও মেয়েকে কার যেন কোলে দিয়ে ছুটে আসে।
রাস্তা দিয়ে একটা বড়ো ট্রাক আসছিল।
অন্ধকারের মাঝে আমি সেই ট্রাকের সামনে দাড়াই।
ড্রাইভার হঠাৎ আমায় দেখে ব্রেক করতে চেয়েও পারেনা।হর্ণ দেয়।
অনেকটা কাছে চলে আসে ট্রাকটি।
মনে মনে ছেলে-মেয়ের ছবি ভেসে ওঠে চোখে।
সৃষ্টিকর্তার নাম নেই।
যেই না ট্রাকটির সঙ্গে আমার লাগতে যাবে তার আগেই কেউ হাত ধরে জোরে টান দেয়।
দূরে ছিটকে পড়ি আমি।জ্ঞান হারাই সঙ্গে সঙ্গেই।
এরপর কী হয়েছে কিচ্ছু জানিনা।প্রায় মাঝরাতে জ্ঞান ফেরে আমার।গায়ে প্রচন্ড জ্বর।পাশেই দেখি সেই পারভীন নামের মহিলা ও আমার ছেলে বসে আছে।
আমায় তাকাতে দেখেই মহিলাটি প্রচুর বকে আমায়।তিনিই বাঁচিয়েছে আমায়।
কী হয়েছে জানতে চায়।
আমি কাঁদতে কাঁদতে সবটা বলি তাকে।
সব শুনে তিনি নিজেও চুপ।চোখ দিয়ে পানি টলমল করছে।
উঠে দাড়িয়ে আমার পিঠে হাত রেখে বলে,”সত্যিই অনেক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে তোমার সঙ্গে।
তোমায় বলার মতো ভাষা নেই।তবুও বলবো ধৈর্য্য ধরো।এপার তো তোমার এমনিই নেই।ওপারও বিসর্জন দিও না।
সব ভুলে যাওয়া যদিও সম্ভব নয়।তবুও বলছি আজ থেকে সব ভুলে যাও।
জীবনকে সুযোগ না কাজে লাগাও।
আজ থেকে তুমি এখানে থাকবে।তোমার কোনো অতীত নেই।তোমার আছে শুধু একটা ভবিষ্যৎ।যা তোমার ছেলে-মেয়ে ও নিজেকে ঘিরে।
অতীতের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করো আজই।
তুমি এখানে থাকবে আমার বোন হয়ে।
আমি তোমার বড়ো আপা।
আমার সহকারি হয়ে থাকবে।কাজ করবে,খাবে,ঘুমোবে ব্যাস।
বাকি যা করার ধীরে সুস্থে করবে।
তুমি কী রাজি আছো?”
আমি কৃতজ্ঞতা ভরা দৃষ্টিতে তাকাই তার দিকে।
এতিমখানার প্রতিটি মানুষের সঙ্গে আমি পরিচিত হই।
ওখানকার বাচ্চারা আমার সঙ্গে বেশ ভাব জমায়।
খুবই মিশুক ছেলে-মেয়ে।
বড়ো অনেক মেয়েরা আছে সেখানে।
তারা আমার বিষয়ে জেনে আমায় সাহস দেয়।
তন্নি’মা বলে ডাকে আমায়।
আমি তাদের কাছে অনুরোধ করি আমি গোসল করতে চাই।মূলত অতীত জেড়ে ফেলতে চাই শরীর থেকে।নিজেকে খুবই নোংরা লাগছে আমার।পবিত্র হতে চাই।
উনারা রাজিও হয়।
আমার শরীর ভীষণ দূর্বল ও আঘাতপ্রাপ্ত ছিল।তাই পারভীন আপা নিজ দায়িত্ব আমায় গোসল করিয়ে দেন।
পুরোনো কাপড় সহ কানের একটা দুল ও চুলের ক্লিপ খুলে ফেলে দেই।শুধু ফেলে দেইনা,আগুনে পুড়িয়ে দেই।উনাদের দেওয়া পোশাক পড়ি আমি।
রাতের খাবারে সবাই আমায় নিয়ে যায়।
খেতে চাইনা আমি।
সকলে এক লোকমা করে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়।কতো যত্ন করে আমায়।চুল শুকিয়ে গেলে তেল দিয়ে দেয় মাথাতে।
বেণী করে দেয়।মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
ছোট বাচ্চার মতো যত্ন করে ঘুম পারিয়ে দেয়।
আমার ছেলেকেও ভীষণ যত্ন করে ওরা।
মনে ভরসা পাই এবার হয়ত সত্যিই আমার জীবনের নতুন কোনো মোড় আসবে।
(এই এতিমখানা থেকেই শুরু হবে তন্নির সুখ ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পালা।)
চলবে।