বড়ো আপা পর্ব-০১

0
127

#বড়ো আপা
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১

বড়ো আপার যখন ডিভোর্স হয় তখন সে একদম কাঁদেনি। মনে হয়েছিল বুকে পাথর চেপে আছে। তার চোখে এক ফুটা জল ছিল না। বড়ো আপার ডিভোর্সের মূল কারণ ছিল স্বামীর পরকিয়া। তবে সেটা ফোকাস না হয়ে মূল কারণ দাঁড়িয়েছিল বড়ো আপার পরকিয়া। তারা অবশ্য বড়ো আপার পরকিয়া প্রমাণ করতে পারেনি। তবুও এ দোষের জন্য বড়ো আপার ডিভোর্স হয়। ডিভোর্সের মূল কারণ এটায় লেখা হয়েছিল। আপার বিয়ের দুই বছর হয়েছিল সবে। বাচ্চা হয়নি। এটাও ছিল ডিভোর্সের আরেকটি দোষ। যদিও বাচ্চা দেওয়ার মালিক আল্লাহ। তবে এ সমাজ মনে করে বাচ্চা দেওয়ার মালিক মেয়েরা।

সবমিলে বড়ো আপার ডিভোর্স হয়ে যায়। বড়ো আপা অনেক সুন্দরী ছিল। কলেজ সেরা ছাত্রীও ছিল। এস এস সি, এইচ এস সি তে গোল্ডেনও পেয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে চান্স পেয়ে ভর্তিও হয়েছিল। এর মধ্যে বড়ো আপাকে দেখতে আসে। আমার বড়ো আপার প্রাক্তন স্বামী অনেক বড়ো ব্যবসায়ী। টাকা পয়সার অভাব ছিল না। ঢাকায় ১২ টি বাড়ি ছিল। গাড়ি ছিল অনেক। এখানেও জমিদারের মতো বাড়ি আছে তাদের আর সেখানেই থাকে তারা। সব মিলে ভাইয়াদের অবস্থা ছিল বিশাল।

আপার জন্য যখন বিয়ের প্রপোজাল আসে তখন আব্বা আর না করতে পারে নাই। আমাদের মতো গরীব মানুষের কাছে এমন প্রস্তাব অনেক বিশাল ব্যাপার ছিল। তবে এ বিয়েতে আপা রাজি ছিল না। আপার ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা শেষ করে বিসিএস দিবে। তবে পরিবারের চাপে পড়ে রাজি হতে হয়েছে। আপার শ্বশুড়বাড়ি কথা দিয়েছিল আপাকে পড়াবে। তবে সে কথা তারা রাখে নি। তাদের ধারণা হলো মেয়ে পড়াশোনায় ভালো। যদি পড়াশোনা করে ডিগ্রি নিয়ে চাকুরী করে তাহলে তাদের জাত যাবে। কারণ তাদের বংশের মেয়েরা কখনও বাইরে গিয়ে কাজ করে না। আবার ভাববেন না তারা অনেক দ্বীনি, বরং এটা উনাদের রিতী। ঘরের বউ শিক্ষিত হোক তারা চায় না। আপার জামাই তেমন শিক্ষিত ছিল না। টেনেটুনে এস এস সি পাস করেছে কিনা সন্দেহ। তবে টাকার নিকট সকল অযোগ্যতায় যেন হার মানল। তাই বিয়ের পর হাজার পায়ে ধরার পরও আপাকে তার জামাই ও পড়তে দিল না। সত্যি বলতে সে নিজেই তো পড়ার মর্ম বুঝে না। তাহলে পড়াবে কীভাবে।

আপার বিয়ে হয়েছিল অনেক ধুমধাম করে। বিয়ের দিন থেকেই আপার ননাশ আপাকে দেখতে পারত না। আপার নানাশের চেহারা গঠনে তেমন সুন্দরী ছিল না। তাই আপাকে বেশ হিংসা করত। আপার সংসারে শ্বাশুড়ি, স্বামী আর ননাসের জামাই ছাড়া কেউ ছিল না। ননাসের জামাই ঘর জামাই থাকত।

সব মিলে আমরা ভেবেছিলাম আপার সংসার টাকা পয়সা সুখ শান্তিতে ভরে উঠবে। তবে সেটা আর হয়ে উঠেনি। আপা আবার মুখের উপর সত্য কথা বলে দিত৷ সেজন্য বিয়ের তিনমাসের মাথায় আপা বেয়াদব উপাধি পেয়ে বসে। প্রতিবাদ করতে করতে একটা সমসয় আপাও ক্লান্ত হয়ে যায়। এরপর মুখ বুজে সব সহ্য করে নিত। সহ্যের এক পর্যায়ে এই চরম সিদ্ধান্ত নেয়।

ডিভোর্সের পর আপা আমাদের বাসায় চলে আসে। সারাদিন আপা মনমরা হয়ে থাকত। এ সময়ও আপাকে বারবার মা বলত আরেকটু মানিয়ে নিলে তো এমন টা হত না। আপার উপর যে অন্যায় হয়েছে এটা তাদের মনে হত না। বরং আপা এখন আমাদের সাথে থেকে অন্যায় করছে এটাই বুঝিয়ে দেয় বারবার। দিনদিন আপার মনমরা হয়ে যাওয়াটা বাড়তে লাগল। কারও সাথে কথা বলত না। ঠিক মতো খেত না। আপাকে সবসময় ক্লান্ত দেখাত। কাঁদত ও না। মনে হত ভেতর থেকে একটা মরে যাওয়া লাশ ঘুরঘুর করছে। চুল আঁচরাত না। ঠিকমতো গোসল করত না। অনিয়ম যেন আপাকে ঘিরে ধরেছিল। আপার অবস্থা দেখে আমার ভীষণ মায়া হত। নিজের মায়ের আচরণ বদলে যেতে দেখেছি আপার ক্ষেত্রে। যে মা বিয়ের আগে আপাকে নিয়ে সুনাম করত। একটা কাজ করতে দিত না। সবসময় ভালোটা খেতে দিত। সেই মায়েই যত উচ্ছিষ্ট খাবার আছে সব আপাকে দিত। নানান ধরণের কথা বলে জিবীত লা/শটাকে কষ্ট দিত। আমাকেও মা বারণ করে দিয়েছিল আপার সাথে বেশি কথা বলতে। এতে নাকি আমার বিয়ের সমস্যা হবে। ভাই নেই আমাদের। দুটো বোন নিয়েই আমাদের সংসার। দুই বোন হওয়াতে বাবা বেশ বেজার ছিল, তবে মা খুশি ছিল। বাবা খুব একটা ভালো না বাসলেও মা বাসত। কিন্তু এখন তো চোখের সামনে দেখছি সময় মাকেও স্বার্থপর করে তুলেছে।

আপার চোখের নীচে কালি পড়ে গেছে। মুখটা চুপসে গেছে। চুলগুলোতে কেমন জানি খরা পড়ে গেছে। সব মিলে আপাকে দেখে ভীষণ খারাপ লাগত।

ডিভোর্সের তিনমাসের মাথায় আপার স্বামী বিবাহ করে। যে মেয়ের সাথে পরকিয়া ছিল সে মেয়েকে। সে থেকে আপা আরও বিষন্ন হয়ে পড়ে। আপার বিষন্নতা লক্ষ্য করার মতো।

সেদিন ছিল ইদের দিন, ৮ জুলাই। ডিভোর্সের পর এটাই আপার প্রথম ইদ ছিল। আমি বয়সে ছোটো ছিলাম। মেহেদী পরা নিয়ে বারবার আপার পেছন ঘুরছিলাম। একটা সময় বাধ্য হয়েই আপা আমাকে মেহেদী দিতে লাগলেন। সেদিন আপা দুটো কথা বলেছিল

“জীবনে কাউকে মন দিয়ে ভালোবাসবি না। আর পড়াশোনাটা মন দিয়ে করবি। একটা সময় নিজের বাবা মা ও পর হয়ে যায়। তোর কষ্ট কেবল তোকেই বুঝতে হবে। যখন সহ্য করতে করতে হেরে যাবি তখন নিজেকে শেষ করে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।”

আপার কথার মানে সেদিন বুঝিনি। আজকে ১২ বছর বুঝতে পারছি। সেদিন ইদের দিনটা ছিল আমার জন্য বিষাদময়। এরপর প্রতিটা ইদের দিন আমার জন্য বিষাদময়। সবাই আপাকে ভুলে গেলেও আমি পারিনি।

ইদের দিন সকালে চিৎকার চেঁচামেচিতে সবার ঘুম ভাঙ্গে। বাবা আর মা আপার শ্বশুড় বাড়ির দিকে ছুটতে থাকে। আমি পেছন পেছন গেলাম। আপার শ্বশুড় বাড়ির পেছনে বড়ো জাম গাছ ছিল। সেখানে আপা ঝুলতেছে। তার নাক মুখ দিয়ে লালা আর রক্ত বের হয়ে একাকার।

পুলিশ এসে আপাকে নামায়। এরপর ময়না তদন্ত করা হয় আপার। সেদিন একটা সত্য সবার সামনে আসে। আর সেখান থেকে কাহিনির একটা জটিল মোর নেয়।

শারমিন নিপা