বড়ো আপা পর্ব-২৭+২৮

0
76

#বড়ো আপা
#পর্ব- ২৭
#শারমিন আঁচল নিপা

আনহারি আমার এ অবস্থা দেখে আমাকে জিজ্ঞেস করলো

“কী হয়েছে? এত অস্থির কেন? কথাই বা বলছো না কেন? আন্টি কী বলেছে?”

আমি কাঁদতেও পারছিলাম না। যতই হোক সে আমার বাবা। আপার লা/শটা দাফন দেওয়ার জন্য মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছে। আজ আমার বাবা কেন আত্ম/হ/ত্যা করবে সে হিসাবেই আমি মিলাতে পারছি না৷ আমার বুকে ভীষণ ব্যাথা হচ্ছে। ফ্যানের মতো আমার মাথাটাও ঘুরছে। তাই চোখ বন্ধ করে আনহারিকে উত্তর দিলাম

“বাবা আত্মহত্যা করেছে।”

আমার কথা শুনে আনহারির কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে সেটা আমার চোখ বন্ধ থাকায় বুঝতে পারছি না। তবে তার গলার সুর শুনে বুঝতে পারছি এতে সে ভীষণ অবাক হয়েছে। আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল

“ফিয়না আমার বাবা আমাকে মারতে চেয়েছিল বলে আমি তাকে শাস্তি দিয়েছি। মালিহা আমার মাকে ঠকিয়েছিল বলে আমি তাকেও শাস্তি দিয়েছি। সবাই জানে আমজাদ চৌধুরি আত্মহত্যা করেছে। তবে সত্যিটা কেবল আমি জানি। সে আত্মহত্যা করেনি। আমিই তাকে খু/ন করেছি। কিন্তু তোমার বাবাকে কে খু/ন করবে? বা তিনি হঠাৎ কেন আত্মহ/ত্যা করবেন? গভীর কোনো সংযোগ রয়েছে আমার মনে হয়।”

আমি আনহারির কথা শুনে চোখ দুটো বিস্মিত হয়ে খুললাম। বেশ অবাক গলায় বললাম

“আংকেলকে আপনি খু/ন করেছেন? কিন্তু কীভাবে? নিজের বাবাকে খু/ন করতে হাত কাঁপে নি? আপনি কী সত্যিই বলছেন নাকি মজা করছেন?”

“সত্যি বলছি। যে বাবা আমার জীবনের কথা একবারও না ভেবে আমাকে হ/ত্যা করতে চেয়েছিল সে বাবার প্রতি আমার কোনো মায়া হয় না ফিয়না। আমি বাবাকে ভালোবাসতাম এটা ঠিক। এখনও বাবাকে ভীষণ মিস করি। তবে কর্মের ফল সবাইকেই পেতে হবে। তাই বাবাও পেয়েছে। এতে আমার কোনো অনুশোচনা নেই।

আমি আগে থেকেই জানতাম বাবা আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছে। তবে সেটা আমি প্রকাশ করিনি। আমি কীভাবে বেঁচে গিয়েছিলাম সেটার কাহিনি অন্য একদিন বলব। আজকে শুধু আমজাদ চৌধুরির মৃ/ত্যু রহস্যের জট খুলে দিচ্ছি। আমি আসার পর থেকেই বাবার উপর নজরদারি রাখি। কারণ আমার বিশ্বাস ছিল বাবা এমন কোনো স্টেপ নিবে যেটা আমার জন্য হিতকর হবে না। খুব কৌশলে বাবার ভোকালে যে যন্ত্রটা লাগানো আছে, সেখানে হিডেন ক্যামেরা সংযুক্ত করে দেই। বাবার একটা সমস্যা ছিল বাবা কথা বললে আওয়াজ হত না। একটা যন্ত্রের মাধ্যমে বাবার কথা আওয়াজের মাধ্যমে বের করা হত। আমি সেদিন রাতে যখন দেখেছিলাম গাড়িটার ব্রেকের তার কাটা হচ্ছে তখন বুঝতে পেরেছিলাম এটা আমাকে মারার জন্যই প্ল্যান করা হয়েছে। কারণ সাদা গাড়িটা আমার ছিল। আর এটা দিয়েই আমি আগে যাতায়াত করতাম। বুঝতে পেরেছিলাম আমার প্রতি বাবার কোনো মায়া নেই। ঠিক তেমনি পূর্বে করা কাজের জন্যও তার মধ্যে কোনো পরিতাপ নেই। তখন আমি আর বাবা হয়ে গেলাম প্রতিদ্বন্দ্বী।

আমি মালিহার সাথে আমারই এক ফ্রেন্ডকে আগে থেকেই পরিচিত হতে বলেছিলাম। এবং বলেছিলাম মালিহাকে টাকার লোভ দেখিয়ে হোটেলে নিতে। মালিহার অনেক টাকার নেশা ছিল। তাই মালিহাকে পটানো খুব বেশি কঠিন হলো না। আমার কথা মতো আমার ফ্রেন্ড তাই করল। তাকে নিয়ে একটা হোটেলে গেল প্রথম। তারপর মালিহাকে ইচ্ছা মতো নেশা করালো। একটু অন্তরঙ্গ হলো তার সাথে। একটা ভিডিও ধারণ করে বাবার নম্বরে মালিহার ফোন থেকেই ভিডিওটি পাঠাল। মালিহা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকায় তার ফোন কোথায় ছিল সে টের পায় নি। বাবার ফোনে সেটা আসার সাথে সাথে বাবা রেগে গেল।

আমি ঠিক তখন বাবার কাছে গেলাম। বাবার বুকে ছুরি ধরে বাবাকে চিঠিতে যা লেখা ছিল সব লিখতে বললাম। বাবার ভোকালে সমস্যা ছিল বলে গলার আওয়াজ বাইরে যায়নি। কারণ রাতে ঘুমানোর সময় বাবা যন্ত্রটা খুলে ঘুমান। নিজের প্রাণের মায়ার জন্যই বাবা চিঠিতে এসব লিখতে বাধ্য হলো। তারপর বাবার হাত থেকে গ্লাভস পড়ে চিঠিটা নিলাম। বাবাকে মদ্যপান করালাম। বাবা যখন একদম মাতাল হয়ে নিস্তেজ হলো। তখন আমি বাবার ফোন থেকে ট্রাক ড্রাইভারকে কল দিলাম। আমার বিশেষ একটা গুণ ছিল তা হলো কণ্ঠ নকল করতে পারি৷ এটা হিডেন গুণ থাকায় কেউ জানত না। আমি বাবার ফোন থেকে একজন ট্রাক ড্রাইভারকে কল দিলাম। তাকে বললাম গাড়িটা যেন গ্যারেজ থেকে নিয়ে যায়। সেরকম করেই আমাদের দারোয়ানকে কল দিয়ে বললাম ট্রাক ড্রাইভার আসলে যেন গাড়িটা দিয়ে দেয়। ব্যাস আমার কাজ শেষ।

তারপর মালিহাকে মেসেজ করলাম তার জন্য একটা সারপ্রাইজ গিফট আছে। সেটা যেন সে রিসিভ করে। যেহেতু মালিহা ছিল টাকার কাঙ্গাল। সেহেতু আমি নিশ্চিত ছিলাম এত দামী গাড়ি সে উপেক্ষা করতে পারবে না। ঠিক তাই হলো।

এদিকে বাবাকে আমি তার মাতাল হওয়ার সুযোগ নিয়ে মালিহার ভিডিও দেখিয়ে হিট করলাম। বাবা বাধ্য হয়ে উত্তেজিত হয়ে নিজের গলায় নিজেই দড়ি দিল। আত্মহত্যা বাবায় করেছিল তবে আমি শুধু পুশ করেছিলাম।

এদিকে ট্রাক ড্রাইভার গাড়িটা নিয়ে মালিহার বাসায় সামনে দিয়ে আসে। মালিহা নিজে সেটা রিসিভ করে। তখনও সে মাতাল ছিল। আমার ফ্রেন্ড তাকে মাতাল অবস্থায় তার বাসায় নামিয়ে দিয়ে সরাসরি এয়ারপোর্টে চলে যায়। কারণ সেদিন তার ফ্লাইট ছিল। সে দেশের বাইরেই থাকে। এখানে তেমন আসে না। কেবল আমার কথায় এসেছে আমার আর্জি পূরণ করার জন্য। ভীষণ ভালোবাসে তো আমাকে। ভালোবাসার মানুষের কথা উপেক্ষা করা যায় না। তাই সে ও পারে নি৷

পরদিন সকালে সে গাড়ি নিয়েই মালিহা বের হয়। আমি তো জানতাম গাড়ির ব্রেক কাটা। তবে মালিহা তো তা জানত না। ফলস্বরূপ তার মৃত্যু হলো রোড এক্সিডেন্টে।

যেহেতু একজন আত্মহত্যা করেছে আরেকজন রোড এক্সিডেন্ট সুতরাং এখানে কোনো প্রমাণ নেই আমি খুন করেছি। আর আমার ফ্রেন্ড তো দেশের বাইরে সুতরাং তারও কোনো অস্তিত্ব এ দেশে নেই।

জানো ফিয়না অপরাধীকে কখনও ছেড়ে দিতে নেই। বিশ্বাস ঘাতকতার বদলা কেবল খু/ন দিয়েই নিতে হয়।”

আনহারির কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। নিজের বাবার মৃত্যু কষ্টটা ডাইভার্ট হয়ে গেল এ কাহিনি শুনে। আমার মাথায় কেবল আমজাদ চৌধুরি আর মালিহা নাম দুটোই ঘুরছে। এত সহজ বিষয়টি কেউ বুঝতে পারল না। দুজন মানুষ খু/ন হলো অথচ দুজনের খু/নের জন্য খুনী দুজনেই দায়ী হলো। আর আনহারির পাকা অভিনয় দেখে কেউ প্রমাণ করতে পারবে না সে খুন করেছে। এত দক্ষ পরিকল্পনা কীভাবে সাজিয়েছে সে ভালো জানে। তবে বাবার খুনের সাথে আনহারির হাত নেই। এটা আনহারির কথা এবং ভাবভঙ্গি দেখে বুঝা যাচ্ছে। তবে বাবা কেন আত্মহত্যা করল। একদিন বাবায় বলেছিল আনহারির সাথে তার দেখা হয়েছিল আর আনহারি বলেছিল তার খুনের সাথে জড়িতে সবাইকে শাস্তি পেতে হবে। তাহলে আনহারিই কী বাবাকে খু/ন করেছে?

আমি আনহারিরকে জিজ্ঞেস করলাম,

“তোমার তো বাবার সাথে একবার রাস্তায় দেখা হয়েছিল। তুমি কেন বাবাকে এমন বললে?”

আনহারি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

“তোমাদের পরিবারের কেবল তোমার সাথেই আমার দেখা হয়েছে। অন্য কারও সাথে না। আর এমন ঘটনা তো ঘটেনি। তোমার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে।”

আনহারির কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। তাহলে বাবা কাকে দেখেছিল?

এদিকে জটলার স্বীকারোক্তিতে জানা যায় বড়ো আপাকে জটলা ডিভোর্সের আগে ধ/র্ষণ করেছিল। আর বড়ো আপা যখন সেটা তার শ্বাশুড়িকে জানিয়েছিল। সে বরং জটলার শাসন করেনি, করেছিল আপার শাসন। আপাকেই নষ্টা মেয়ে বলে উপাধি দিয়েছিল। এরপর আপার শ্বাশুড়ি দীপককে সবটা জানালে সে তার বোনের সুখের কথা চিন্তা করে তাকে জানায়নি। জটলাকে উত্তম মধ্যম দিয়ে বিষয়টা সেখানেই স্থগিত করেছিল। তবে বড়ো আপা বার বার চায়তো এর একটা বিহিত হোক। এক বাড়িতে নিজের ধর্ষকের সাথে থাকতে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। একদিকে এমন ঘটনা অন্যদিকে দীপকের পরকিয়া। সবমিলে দীপক তার রাস্তার কাটা সরাতে বড়ো আপার নামে দুর্নাম রটিয়ে দিল। আর সে জের ধরেই আপাকে ডিভোর্স দিল। আপা ডিভোর্সের পর সন্তান হওয়ার কথা দীপককেই দিয়েছিল। আর দীপক তখন বুঝিয়ে আপার সন্তানকে এবরশন করায়। কারণ আপা ভেবেছিল এ সন্তান দীপকের। তবে জটলা নিশ্চিত হয় এ সন্তান তার ছিল। কারণ দীপক বেশ কিছুদিন আগে জানতে পারে সে কখনও বাবা হতে পারবে না। দীপক আপাকে আশ্বস্ত করে আবার সব ঠিক করে নেবে। তবে সেটা ঠিক না করে দীপক হুট করে বিয়ে করে বসে। এরপর আপা কীভাবে আত্মহত্যা করে, কেন করে সেটা সে জানে না। আর পায়েসে কীভাবে পটাশিয়াম সায়ানইড মিশলো সেটা সত্যিই সে জানে না।

একদিনের স্বীকারোক্তিতে এতটুকুই উৎঘাটন করা গেছে। কাল আবার জিজ্ঞাসাবাদ করে বাকি তথ্য সংগ্রহ করা হবে।

এখন এটা নিশ্চিত হওয়া গেল সেদিন আমার বড়ো আপায় মা’রা গিয়েছিল। যে ধোঁয়াশা আমার ভেতর ছিল সেটা দূর হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম সে আনহারি হবে। তবে বাস্তবতা আমার ভাবনার বিপরীত পিঠ ছিল। আপার ভেতরে এত কষ্ট জমা ছিল অথচ কেউ বুঝে নি। আনহারির দিকে তাকিয়ে আছি আমি৷ যন্ত্রণা মানুষকে কতটা হিংস্র করে তুলে সেটা তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে।

কিন্তু বাবা কেন আত্মহত্যা করল? আর ঐদিন বাবা আনহারিকে না দেখলে কাকে দেখেছিল? আর পায়েসে কে পটাশিয়াম সায়ানাইড মিশিয়েছিল? আমি আনহারিকে আবার প্রশ্ন করি

“পায়েসে কী পটাশিয়াম সায়ানাইড তুমি মিশিয়েছিলে? আর মেশালেও কীভাবে? তুমি তো রান্না ঘরে যাও নি।”

আনহারি মুচকি হেসে জবাব দিল

“সব রহস্য বলে দিলে কী আর টুইস্ট থাকবে? একটু টুইস্ট থাকুক। যাইহোক আমি গাড়ির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তুমি তোমার বাবাকে দাফন করে আবার এসো। যা খরচ লাগে আমি দিব। আমাকে সেখানে গিয়ে সব আপডেট দিবে।”

আমি মাথা নাড়ালাম। এত মৃত্যু দেখতে দেখতে বাবার মৃত্যুটা আমাকে আর কাঁদাচ্ছে না। আমি সে সময়েই রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। ঢাকায় পৌছালাম রাতে। বাবাকে পুলিশ নামিয়ে নিয়ে গেছে তাদের হেফাজতে। ময়না তদন্ত করে লা/শ দিবে। মা হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে।।আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলল

“তোর বাবা যে এমন কাজ করেছে আমি বিশ্বাসেই করতে পারছি না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ফিয়না।”

আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম

“আচ্ছা মা বাবা কেন হঠাৎ আত্মহত্যা করবে? তার পেছনে কী কোনো কারণ আছে?”

মা আমার কথা শুনে চুপ হয়ে গেল। মায়ের কান্নাও হুট করে থেমে গেল। মনে হচ্ছে কিছু একটা মা লুকাচ্ছে। আমি মাকে এবার চেপে ধরলাম। এরপর মা যা বলল তা শুনে আমার ভীষণ দম বন্ধ লাগছে।

#বড়ো আপা
#পর্ব- ২৮
#শারমিন আঁচল নিপা

“ফিয়না তোর বাবা কাল থেকে খুব অস্থির ছিল। রাত তখন বারোটা। কাজ সেরে বাসায় আসে। খাবার দিলাম। না খেয়ে বসে আছে। কী যেন ভাবছে। আমি কয়েকবার জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে। সে কোনো উত্তর দিল না। চুপ করে অনেকক্ষণ বসে রইল। আমার কাছে মনে হলো শরীর খারাপ। তাই কাছে গিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম

” আপনার কি কিছু হয়েছে? হলে বলুন। শরীর খারাপ লাগছে? কাজের জায়গায় কি কোনো সমস্যা হয়েছে? টাকা পয়সা নিয়ে কি কোনো ঝামেলা হয়েছে?”

টাকা পয়সার কথা বলতেই তোর বাবা কেঁদে উঠল। তোর বাবার কান্না দেখে ভাবলাম হয়তো টাকা পয়সার সমস্যা চলছে। জিনিস পত্রের যে দাম আয়ের চেয়ে ব্যায় বেশি। তাই আশ্বাস দিয়ে বললাম

“তুমি চিন্তা করো না। ফিয়নার চাকুরি হয়েছে। সে তো আয় করবে এখন। তার আয় দিয়েই আমরা ভালো করে চলতে পারব। বেতনও ভালো পাবে। এত চিন্তা করে শরীর খারাপ করার দরকার নেই। ”

আমি এসব বলার পরও তোর বাবা বারবার কাঁদতেছে। আমি বুঝতে পারছি না এত কেন কাঁদছে সে। বেশ কিছুক্ষণ কেঁদে তার দুটো হাত দিয়ে আমার দুটো হাত চেপে ধরে বলল

“অনন্যার মা আজকে একটা কথা বলব তুমি শুনার পর কষ্ট নিও না। আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও।”

আমি ভাবলাম হয়তো তোর বাবা কোনো মেয়ের পাল্লায় পড়েছে, তাই এমন বলছে। সেজন্য একটু অভিমানী সুরেই বললাম

“আমাকে রেখে কি তুমি অন্য কোনো মেয়ের কাছে গিয়েছো?”

সে আমার কথার প্রতি উত্তরে বলল

“এমন করলে আমি কষ্ট পেতাম না। অনন্যার মা অনন্যার খু/নে আমি জড়িত ছিলাম। অনন্যার অপরাধীদের শাস্তি না দিয়ে বরং তাদের আরও সুযোগ করে দিয়েছিলাম।”

তোর বাবার কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বাবা কী করে মেয়ের খু/ন করতে পারে সেটাই আমি বুঝতে পারছিলাম না। অনন্যার প্রতি আমাদের অনেক ক্ষোভ ছিল। তবুও যতই হোক আমরা তার বাবা, মা। তাকে লালন পালন করেছি। একটা মায়ার বাঁধন তো আছে। কুকুর পাললেও তার প্রতি মায়া জন্মায় অনন্যা তো মেয়ে ছিল। এটা আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। একদম নির্বাক হয়ে পড়ি।

তোর বাবা কাঁদতে কাঁদতেই বলল

“অনন্যা সন্তানসম্ভ্যাবা ছিল। দীপকের সন্তান অনন্যার পেটে ছিল। আমাকে সে বলেছিল দীপকের কাছে যেন নিয়ে যাই। ভাঙা সংসারটা হয়তো সন্তানের সেতু ধরেই জোড়া লাগতে পারে। তাই আমি অনন্যাকে নিয়ে দীপকের কাছে গিয়েছিলাম। দীপক আমাদের বলল সে সব ঠিক করে নেবে। তবে একটা শর্ত অনন্যার বাচ্চাটাকে নষ্ট করতে হবে। কারণ সব ঠিক করার পর এ বাচ্চার উপর সবাই আঙ্গুল তুলবে। যেহেতু অনন্যার পরকিয়া আছে এমন কিছু রটেছে। অনন্যা একদম চাচ্ছিল না বাচ্চাটা নষ্ট হোক। আমিই তাকে জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। যতই হোক মেয়ের সংসার ঠিক করতে হবে তো। ডিভোর্সি মেয়েকে কে বিয়ে করবে। এদেশে একটা ডিভোর্সি ছেলে কুমারী মেয়ে বিয়ে করলেও একটা ডিভোর্সি মেয়ে তা পারে না। সমাজ খুব বাজে চোখে তাদের দেখে। আমি তো দীপকের দাবার চাল বুঝিনি। সে আমাদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিল।

বাচ্চা নষ্ট করার পর বেশ কয়েকবার আমি দীপকের কাছে যাই। কিন্তু দীপক সাফ সাফ জানিয়ে দেই সে আর অনন্যাকে মেনে নিবে না। কার না কার বাচ্চা পেটে বাজিয়ে আমরা নাকি তাকে ফাঁসাতে চাচ্ছি। বিষয়গুলো আমি অনন্যাকে গোপন রাখতে বলেছিলাম। কারণ এটা যদি আবার রটে তাহলে আর অনন্যাকে চাইলেও বিয়ে দিতে পারব না। তাকে বিয়ে দেওয়া আরও কঠিনতর হয়ে যাবে।

অনন্যা বারবার আমার কাছে এসে বলত

” বাবা চলেন আরও একবার গ্রামের লোকজন নিয়ে বসি।”

তবে আমার সাহসে কুলায়নি। কারণ ঘুরে ফিরে দোষ অনন্যারেই হত। সমাজের নিয়মটাই যে এমন।

অন্যনার যেদিন মৃত্যু হয়, আমি সেদিন শেফালিদের বাড়িতে ধান উঠিয়ে সকাল ৪ টা ৩০ টায় বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিই। সারারাত ধান তুলে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ি। হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি ফিরছি। তখনও আলো ফুটে নি। দীপকদের জাম গাছের তলা দিয়েই আসতে নিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে চোখে পড়ে আনজুমানের স্বামী আর তাদের বাড়ির দারোয়ান কাউকে গাছে ঝুলাচ্ছে। লাশটা গাছের ডালে দড়ি দিয়ে উপরে তুলছে। আলো ফুটেনি তাই বুঝতে পারিনি কার লাশ।

লাশ ঝুলানোর পর লাশটাকে ডালেই ঠেক দেওয়া হয়েছিল। আমি সেখানে পৌঁছাতেই আনজুমানের স্বামী চমকে গেল। আধো আধো আলোতে লাশটাকে দেখে আমি জোরে চিৎকার দিতে নিলাম। কারণ অনন্যা
ছিল। আমি চিৎকার দেওয়ার আগেই আনজুমানের স্বামী আমার মুখ চেপে ধরল। আমার দিকে তেড়ে এসে বলল

“যা হবার হয়ে গেছে। চায়লেও এ মেয়ে বিয়ে দিতে পারতেন না। ঘরের মরা হয়ে থাকত। দুটো অপশন দিচ্ছি হয় এখন আপনাকে প্রাণে মারব নাহয় পাঁচ লাখ টাকা দিব একদম মুখ বন্ধ রাখবেন। ভুলে যাবেন না আপনার আরও একটা মেয়ে বিয়ে দেওয়া বাকি। এ মেয়ের জন্য আরেক মেয়ের জীবন নষ্ট করবেন না।”

আমার যে তখন কী হলো জানি না। ফিয়নার কথা চিন্তা করে আর পাঁচ লাখ টাকার লোভে পড়ে আমি রাজি হয়ে যাই। সবটা চেপে যাই। নিজের মনকে বুঝ দেই যা হওয়ার তো হয়ে গেছে। আর এটা নিয়ে দৌড়ে লাভ কী। অনন্যাকে তো পাব না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামে হই হই শুরু হলো। অনন্যার ঝুলে যাওয়ার খবর পৌঁছে গেল পুলিশের কাছে। তারা অনন্যাকে নিয়ে যায়। এরপর তো সবটা জানই তুমি। সেদিন যদি আমি লোভ না করতাম তাহলে অনন্যার খু/নীরা আজকে এত আয়েশ করতে পারত না। এত মজায় থাকত না। আমার লোভের জন্য আমার মেয়ের খু/নীরা শাস্তি পায়নি।

তোর বাবার কথা শুনে আমার শরীর জ্বলতে লাগল। আমি মা যাই করিনা কেন নিজের সন্তানের খু/নীকে কখনও ক্ষমা করতাম না। দশ মাস অনন্যাকে পেটে ধরেছি আমি। নাড়ির টান বলেও একটা কথা আছে ফিয়না। তোর বাবার কথা শুনে আমি উত্তেজিত হয়ে তোর বাবাকে বলতে লাগলাম

“আমার মেয়ের সাথে এত বড়ো অন্যায় কী করে করলে তুমি? একটা বার ও অনন্যার আত্মার কথা চিন্তা করলে না?
ওর আত্মা কী শান্তি পেল বলো?”

আমার এ কথা শুনার পর তোর বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলল

“আমার মেয়ের আত্মা শান্তি পায়নি বলেই এত বছর পর সে ফিরে এসে আমাকে ধরেছে অনন্যার মা। আমি আর এ জীবন রাখব না অনন্যার মা। অনন্যা এসে আমার কাছে এসবের জাবাব চায়। আমি যেখানে যাই সেখানেই অনন্যা এসে আমাকে কথা শুনায়।”

এ কথা শুনার পর আমি ভেবেছিলাম তোর বাবা হয়তো নিজের মেয়ের শোকে এমন করছে। আমিও নিয়তি মেনে নিয়ে তোর বাবাকে বুঝ দিলাম

“যা হয়েছে ভুলে যাও। অনন্যাকে নিয়ে বেশি চিন্তা করছো তাই এমনটা হচ্ছে। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। আল্লাহ ক্ষমা করে দিলেও আমি হয়তো পারব না। আর তারা তো তোমাকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিল। সেটা কী করেছিলে? সে টাকা হজম করতে পেরেছো।”

তোর বাবা হুহু করে কেঁদে দিয়ে বলল

“সে পাঁচ লাখ টাকা তারা দেয় নি। মেয়ের লাশ নিয়ে নিয়ে ঘুরেছি। কেউ দাফন করার জায়গা পর্যন্ত দেয়নি। পাঁচলাখ টাকার জন্য গিয়েছিলাম তারা বলেছে আমি যদি বলি তারা খুন করেছে তাহলে তারাও বলবে এতে আমি জড়িত। আমার কথা রেকর্ড করে রেখেছিল তারা। সবমিলিয়ে আমি আর টাকা পাইনি। লোভ আমার সব কেড়ে নিছে। এরপর ফিয়নার কথা ভেবে এটা নিয়ে আর বাড়বাড়ি করিনি।”

“আজ এত বছর পর এসব সামনে এনে তোমার লাভ হলো কী? আমার চোখে তোমাকে অপরাধী বানালে। আর কখনও তোমার দিকে তাকিয়ে আমি হাসি মুখে কথা বলতে পারব কিনা জানি না। গোপন যেহেতু ছিল গোপনেই রাখতে।”

“না রে অনন্যার মা। আমার মেয়ে আমার পিছু নিয়েছে তাই গোপন রাখতে চাইলেও পারতাম না। সব ফাঁস হয়ে যেত। আমি নিজেই নিজেকে শেষ করে শাস্তি দিব।”

এসব বলে কাঁদতে লাগল তোর বাবা। আমি আর কথা বাড়াইনি। রুমে গিয়ে বসে আমিও কাঁদতে লাগলাম। কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে গেলাম। সকাল বেলা কারও স্পর্শ অনুভব করলাম পায়ে। চোখ খুলতেই দেখলাম অনন্যা।।আমি চোখ খুলতেই সে চোখের পলকে রুম থেকে বের হয়ে গেল।।আমি তার পিছু নিয়ে বের হতে গিয়ে তোর বাবার ঝুলন্ত লাশটা চোখে পড়ে। এরপর তো পুলিশ আসে৷ লাশ নিয়ে যায়। আমার মনে হচ্ছে শুধু অনন্যার আত্মা এসে তার প্রতিশোধ নিয়ে গেল।

আমি মায়ের কথা শুনে ভাবতে লাগলাম সেটা আসলেই অনন্যার আত্মা ছিল নাকি অন্য কেউ? আনহারির এখানে আসা সম্ভব না। কারণ আনহারি কুঁড়গাও ছিল। কুঁড়গাওয়ের দূরত্ব ঢাকা থেকে অনেক। তাই চায়লেও সে আসতে পারবে না। তবে সে মেয়েটি আসলেই কী মায়ের মতিভ্রম ছিল নাকি অন্য কিছু?

মাথাটা বিগড়ে যাচ্ছে আমার। এর মধ্যেই আনহারির কল আসলো। আমি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে তার কল ধরলাম। সে সাথে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পেলাম। বিগড়ে যাওয়া মাথাটা আরও বিগরে গেল।

কপি করলে নাম সহ করতে হবে। আর পেইজে পোস্ট করার তিন ঘন্টা পর করতে হবে। এ রুলস মেইনটেইন না করলে আমি এর জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিব।

শারমিন নিপা
শারমিন আক্তার