বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে পর্ব-৩৮+৩৯

0
1156

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_৩৮
#Esrat_Ety

বেশ কিছুক্ষণ সামিন ওয়াশ রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। আলো তখনও কেঁদে যাচ্ছে। কোনো শান্তনা খুঁজে পাচ্ছে না সে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে পরেছে। সামিন এদিকে ওদিকে অসহায়ের মতো একবার তাকিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি খরচ করে দরজায় বেশ কয়েকবার ধা/ক্কা দিতেই সিটকিনি ভে/ঙে দরজা খুলে যায়। একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে সামিন ওয়াশ রুমের ভেতর পা রাখে। আলো ওয়াশ রুমের একপাশে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদছে। তার শরীর কাঁপছে। ভেজা চুল বেয়ে পানি পরছে। শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটিয়ে পরে আছে। সামিন এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে। আলোর দিকে খানিকটা ঝুকে তার আঁচল উঠিয়ে তার‌ গায়ে জড়িয়ে দেয়। ক্রন্দনরত আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,”চলো ওঠো।”

আলোর থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে সামিন কিছু সময় আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নিয়ে আলোকে তুলে নেয়। বিছানায় এনে আলোকে বসিয়ে দিয়ে সামিন আলোর মুখোমুখি বসে। আলোর কান্না থেমেছে। কেমন নির্জীব হয়ে বসে আছে এখন। সামিন খানিকটা ঝুকে আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,”সমস্যা কোথায়?”

আলো মুখটা সরিয়ে নেয়। সামিন কিছুক্ষণ আলোকে দেখে। কাঁদতে কাঁদতে নাকের ডগা লাল বানিয়ে ফেলেছে। সামিনের ইচ্ছে করছে হাত দিয়ে ঐ নাকের ডগা ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু অযাচিত আহ্লাদী স্পর্শ দিয়ে এই মেয়েটার গালাগাল খেতে সে ইচ্ছুক নয় এখন। হাজার হলেও সে এই শহরের মেয়র। তার একটা গাম্ভীর্য নিয়ে চলা উচিত, কথায় কথায় পুঁচকে বৌয়ের গালাগাল খাওয়া তার শোভা পায় না।‌

সামিন একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”ওয়াশ রুম কাঁদার যায়গা? এতো সুন্দর পরিপাটি রুম আমার। কত সুন্দর একটা টানা বারান্দা। কোথায় রুমের এসি অন করে এই নরম বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদবে,তা না! এসব রেখে ওয়াশ রুমে ঢুকে কাঁদছো কেনো? সত্যিই তোমার মাথার স্ক্রু খুলে কোথাও পরে গিয়েছে। ”

আলো দৃষ্টি বিছানার চাদরের ফুলকাটা নকশায় দিয়ে আছে। সামিন উঠে আলোর আলমারি থেকে একটা নতুন তোয়ালে বের করে আনে। আলোর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,”মাথা মুছে নাও। ঠান্ডা লেগে যাবে।”

আলো চুপ। সামিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মৃদু স্বরে বলে,”তুমি আমাকে দিয়ে বড্ড খাটাও। এটা ঠিক না আলো।”

কথাটা বলে সামিন নিজের হাতে আলোর চুল মুছিয়ে দিতে থাকে। আলো পাথরের মতো বসে আছে। সামিন কি করছে সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। চুল মুছিয়ে আলোর মাথায় তোয়ালেটা সুন্দর করে জরিয়ে দেয় সামিন।

সামিনের দরজার বাইরে এসে আতাউর আলম দাঁড়িয়ে পরে। মেয়ে জামাইয়ের ব্যক্তিগত রুমে সে আসতে ইচ্ছুক ছিলো না। ইশিতা আর রিতু জোর করে নিয়ে আসে তাকে। ঘরের ভেতরে সামিনের বৌয়ের সেবা করার দৃশ্য দেখে সবাই থতমত খেয়ে যায়। ইশিতা আর রিতু মুখ চাওয়াচাওয়ি করে দুজনে দুদিকে কে/টে পরে আতাউর আলমের পেছন থেকে। আতাউর আলম বোকার মতো কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে ঘুরে সিঁড়ির দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। পেছন থেকে সামিন বলে ওঠে,”আসুন।”

আতাউর আলম দাঁড়িয়ে পরে। সামিন ঘরের বাইরে এসে বলে,” আপনার মেয়ের আপনাকে প্রয়োজন।‌ তার কাছে থাকুন। আমি আপনাদের দুজনের খাবার উপরে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

সামিন চলে যায়। আতাউর আলম মাথা ঘুরিয়ে আলোকে দেখে তার কাছে যায়। আলো মাথা নিচু করে নিস্তেজ হয়ে বসেছিল। আতাউর আলম গিয়ে মেয়ের পাশে বসে। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে একটা হাত মেয়ের মাথায় রাখতেই আলো ঝাঁপিয়ে পরে তার বুকে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে আলো বাবার শার্ট খামচে ধরে। আতাউর আলম মেয়ের মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। আলো কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে,”আমি কুৎসিত হয়ে গিয়েছি আব্বু। কুৎসিত হয়ে গিয়েছি।”

নিচ তলার লিভিং রুমে মেহমান রা চলে এসেছে । মেহমান বলতে ফুয়াদ, জামিল এবং সামিনের দলের ছেলেরা। সবাই খাওয়া দাওয়া করছে। আজান আয়াত বোনের শ্বশুরবাড়িতে এই দ্বিতীয় বারের মতো এসেছে।‌ সামিনের সাথে জড়তা এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারা। মাথা নিচু করে রোস্ট থেকে মাংস খুটে খেতে ব্যস্ত তারা। সামিন দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের পাশেই একটা চেয়ার টেনে বসে। তারপর বলে ওঠে ,”বোনের শ্বশুরবাড়ি, বেশি বেশি খাবে শা’লারা।”

আজান আয়াত খেতে খেতে সামিনের দিকে তাকায়। দুলাভাই মজা করলে কেমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে হয় তারা জানে না।
সামিন বলে,”খাও।”

পাশ থেকে রনি বলে ওঠে,”হ্যা খাও। না খেলে আমি আছি তো। গলায় ছু/রি বসিয়ে দেবো।”

আয়াত বিষম খেয়ে কাশতে থাকে রনির কথায়। খাবার টেবিলে সবাই হেসে ফেলে। সামিন আয়াতের দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয়। পানি খেয়ে আয়াত ধাতস্থ হয়।

কিছুক্ষণ পরে সামিন পরিবেশ টা স্বাভাবিক করতে আজানকে বলে,”কলেজে উঠেছো। গার্লফ্রেন্ড হয়নি কোনো?”

আজান লজ্জা পেয়ে মাথা নাড়ায়। সামিন আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলে,”আর তোমার?”

আয়াত ও ভীষণ লজ্জা পায়। নিচু স্বরে বলে,”না।”

সামিন বলে,”কাউকে মনে ধরলে বলবে। প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে পেছনে ঘুরঘুর করতে হবে না। তুলে এনে বিয়ে পড়িয়ে দেবো‌।”

আজান আয়াত চুপ করে থাকে। ফুয়াদ আজান আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”হ্যা। ওই একটা কাজই তোমাদের দুলাভাই পারে। মেয়ে তুলে আনা।”

সামিন ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। ফুয়াদ গম্ভীর কন্ঠে বলে,”বাচ্চাদের ভালো পরামর্শ দিতে হয়। দুলাভাই তুই ওদের। ভাগ্যিস আলো নেই এখানে,নয়তো তোর বারোটা বাজিয়ে দিতো এসব শুনলে।”

সামিন অপরাধী গলায় বলে,”এখন মজাও করতে পারবো না? কি অদ্ভুত!”

***
“আপনার ফোন বাজছে। ম্যানেজার ফোন দিচ্ছে।”

বিছানার দিকে তাকিয়ে রিতু বলে। ইলহাম ওয়াশ রুমে শেভ করছিলো,ওয়াশ রুমের দরজা খোলা, মাথা ঘুরিয়ে রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”রিসিভ করে কথা বলো। বলো ব্যস্ত আছি।”

রিতু অবাক হয়ে বলে,”আমি?”
_হ্যা। রিসিভ করো।

রিতু আমতা আমতা করে ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করে কথা বলে রেখে দেয়। আগে হলে ইলহাম তার ফোনে হাত দেওয়ার অপরাধে খুব বকে দিতো। এখন কি না তাকে দিয়ে অফিসের কল উঠাচ্ছে।

রিতু আলমারি থেকে ইলহামের একটা পাঞ্জাবি বিছানার উপর রেখে বলে,”সাদা পাঞ্জাবি বের করেছি। পরবেন?”

ইলহাম ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে আসে। রিতুর শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে নিয়ে বলে,”কেনো নয়।”

রিতু মুচকি হেসে চলে যেতে নেয়। ইলহাম শক্ত করে রিতুর হাত ধরে ফেলে,হ্যাচকা টান দিয়ে নিজের কাছে টেনে আনে। রিতু চ’ম’কে ওঠে। বিছানায় একপাশে বসে রিতুকে কোলের ওপর বসিয়ে তার ডান হাত টেনে নিজের কাঁধের ওপর রাখে। রিতু অস্ফুট স্বরে বলে,”কি করছেন।”

ইলহামের দিক থেকে কোন জবাব আসে না। সে তার স্ত্রীর ঘারে আদর মাখিয়ে দিতে ব্যস্ত। রিতু ছ’ট’ফ’ট করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায়। তার অস্বস্তি বুঝতে পেরে ইলহাম জরানো কন্ঠে বলে,”চুপ করে বসো। শুধু চু/মুই খাবো। ভ/য় পেয়ো না।”

রিতু চুপ করে থাকে। ইলহাম রিতুর ঘার থেকে মুখ উঠিয়ে রিতুর লাজুক মুখখানার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”কেমন আছে আমাদের ছোটো সোনা? তোমাকে কষ্ট দেয় আমার মতো?”

রিতু মাথা নাড়ায়। ইলহাম রিতুর গালে একটা চু/মু খায়, তারপর বলে,

_এইবার আমাকে একটা মেয়ে দেবে তুমি। আমি মেয়ে চাই।”

রিতু অস্ফুট স্বরে বলে,”আর যদি না দিতে পারি?”

ইলহাম সাথে সাথে বলে ওঠে,”তাহলে পরের বার দেবে।‌”

রিতু লজ্জা পেয়ে যায়। ইলহাম বলে,”পরের বার না হলে তার পরের বার। তার পরের বার না হলে তার পরের বার। মোটকথা হাল ছাড়া যাবে না।”

রিতু চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। ইলহাম মুগ্ধ চোখে এই নমনীয় মেয়েটির লাজুক মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এতো মুগ্ধতা সে আগে কেনো খুঁজে পেলো না?

***
সামিন হাত ধুয়ে উঠে পরে। আজান বলে,”ভাইয়া। আপুর জিনিসপত্র যা চেয়েছিলেন,সব এনেছি।”

সামিন বলে,”কোথায়?”

আজান আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেয়। সিঁড়ির কাছে একটা ট্রলি ব্যাগ রাখা।
ফুয়াদ সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”এগুলো কি?”

সামিন মৃদু হেসে বলে,”শশুর বাড়ি থেকে যৌ/তুক নিয়েছি।”

কথাটা বলে সামিন ব্যাগটা উঠিয়ে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে। তার ঘরের দরজার কাছে এসে সে একটা দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে পরে। আলো তার বাবার কোলে মাথা রেখে চুপচাপ শুয়ে আছে। আতাউর আলম তার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গল্প করছে। যেন বাবা তার ছোটো অবুঝ মেয়েকে রূপকথার গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে।

সামিন দৃশ্য টা দেখে এতোটাই মুগ্ধ হয়েছে যে মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসে,”বাহ! কি সুন্দর! আমাকেও যেন আল্লাহ কন্যাসন্তান দেয়।”

ভেতরে ঢুকে বাবা মেয়ের এতো সুন্দর মুহূর্ত সে নষ্ট করতে চায় না। তাই ট্রলি ব্যাগটা সে দরজার কাছে রেখেই চলে যায়।

***
হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে আলো। বাবা যতক্ষন ছিলো,মনটা ভীষণ শান্ত ছিলো। আতাউর আলম, আজান, আয়াত রাত নয়টার দিকে বাড়িতে চলে গিয়েছে। আবারো ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছে মন টা। খুব কান্না পাচ্ছে।

সামিন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে কিছু মুহূর্ত, ঘড়িতে সময় রাত এগারোটা প্রায়। সারাদিনের ধকল শেষে সেও বেশ ক্লান্ত । একটু ঘুম দরকার।
মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকে সে,”আল্লাহ ওই পাগল মেয়েটা যদি আজ আমার মেজাজ খারাপ করে দেয় তবুও যেন আমার রা/গ না ওঠে আজ। প্লিজ আল্লাহ,একটু সুবুদ্ধি দিও ঐ আছিয়াকে আর আমাকে দিও ধৈর্য্য।”
একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে সে। কয়েক পলক আলোকে দেখে নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার সিটকিনি তুলে দেয়। আলো মাথা তুলে তাকায় না।
সামিন ওয়াশ রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে গায়ের পাঞ্জাবিটা পালটে একটা টি শার্ট পরে নেয়। তারপর বেরিয়ে এসে পুনরায় আলোর দিকে তাকায় । একই ভাবে হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে গুটিয়ে বসে আছে। সামিন ভাবে, ঘুমিয়ে পরলো না তো! পরতেই পারে, এই মেয়ের সবকিছু অগোছালো।
আলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সামিন শব্দ করে ঘরের জানালার গ্লাস টেনে বন্ধ করে দেয়, বারান্দার দরজা ধপ করে লাগিয়ে দেয়। আলো ধীরে ধীরে মাথা তুলে সামিনের দিকে তাকায়। সামিন নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,”সরি।”

আলো কিছু বলে না। মাথা ঘুরিয়ে বিছানায় চোখ রাখে। ইশিতা আর পরী রাত নয়টার দিকে এসে বিছানার উপর কিছু ফুল আর ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। বিরক্তিতে আলো কপাল কুঁ’চ’কে রেখেছে। ইশিতা আপু কিভাবে এতো অবুঝের মতো কান্ড করতে পারে!

সামিন আলোর দৃষ্টি অনুসরণ করে বিছানার দিকে তাকায়। কয়েক মূহুর্ত তাকিয়ে থেকে মৃদু স্বরে বলে,”পরিস্কার করে দিচ্ছি।”

বাড়ির কাউকে না ডেকে সামিন ফুলগুলো সরিয়ে নেয় বিছানা থেকে, তারপর ঝুড়িতে ফেলে দিতে দিতে বিড়বিড় করে বলে,”আমিও আমার বৌয়ের কাছে অবহেলিত আর তোরাও, চিমটি।”

ঘুরে আবারও আলোর দিকে তাকায়। তারপর গিয়ে আলমারি খুলে একটা বক্স বের করে সেটার ভেতর থেকে আরেকটা ছোট বক্স বের করে এনে আলোর মুখোমুখি বসে। আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন হাতের ছোটো বক্সটা খুলতে খুলতে আলোর চোখের দিকে তাকায়। বক্সে সামিনের মায়ের সেই বালা দুটো।
আলো বালা দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে, এগুলো সে খুলে সামিনের হাতে দিয়ে গিয়েছিলো সেদিন। সামিন আলোর ডান হাত ধরে একটা বালা পরিয়ে দিয়ে অপর হাতেও আরেকটা বালা পরিয়ে দিয়ে বলে,”আমার চোখে দেখা সবথেকে বিশুদ্ধ একজন নারীর স্মৃতিচিহ্ন আমার চোখে দেখা আরেকজন বিশুদ্ধ নারীর হাতে পরিয়ে দিলাম।”

এ পর্যন্ত বলে একটু থেমে আবারও বলতে শুরু করে,”এই দু’টো কখনো খুলবে না হাত থেকে, অনুরোধ তোমার প্রতি।”

আলো কিছুক্ষণ হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে সামিনের হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নেয়। সামিন এক পলক আলোকে দেখে মজা করে বলে ওঠে,”কি ব্যাপার! অস্বাভাবিক চুপচাপ কেনো? রেঞ্জ দেখছি স্ক্রু বেশ ভালো করে টা/ইট দিয়ে গিয়েছে।”

আলো অবাক হয়ে বলে,”মানে? কিসের রেঞ্জ?”

_রেঞ্জ। তোমার বাবা, আমার শশুর। তাকে এনেছিলাম তোমার স্ক্রু টা/ইট দিতে। সে তার কাজ ঠিকমত করেছে দেখছি।

আলো অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে সামিনের কথায় পাত্তা না দিয়ে। সামিন বলতে থাকে,”মন খারাপ করে থাকবে দেখে বাবাকে, ভাইদের এনে দিলাম, একটা ধন্যবাদ তো পেতেই পারি।”

“ধন্যবাদ ”
আলো কপাল কুঁ’চ’কে কাটকাট বলে।

সামিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”এভাবে দিলে? একটা চ/ড় মেরে দিতে এর বদলে নাহয়!”

আলো গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”মন পেতে এসব করছেন?”

সামিন ম্লান হাসে, তারপর বলে,”না, মন চুরি করতে এসব করছি। চুরি করতে না পারলে ডাকাতি করবো।”

_হ্যা, ওই একটা জিনিসই আপনি ভালো পারেন। লুটতরাজ।
কাট কাট বলে ওঠে আলো।

ব্যস,এই কথাটাই সামিনের মেজাজ খারাপ করে দিতে যথেষ্ট। কিন্তু সামিন হাত মুঠি করে চোখ বন্ধ করে ফেলে,বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে বিড়বিড় করে নিজেকে নিজে বলতে থাকে,”ক/ন্ট্রোল সামিন ইয়াসার মির্জা ক/ন্ট্রোল! প্লিজ রা/গ উঠাস না।”

আলো অবাক হয়ে সামিনকে দেখে বলে,”বিড়বিড় করে কি বলছেন! কাকে গালাগাল দিচ্ছেন?”

_গালাগাল? ওসব তো তুমি ভালো জানো।

আলো চুপ হয়ে যায়। সামিন আলোকে দেখতে থাকে। কমলা রঙের শাড়িটা কত সুন্দর লাগছে মেয়েটির গায়ে। শাড়িটার সৌন্দর্য মেয়েটিকে সুন্দর করে তুলেছে নাকি মেয়েটির সৌন্দর্য শাড়িটার গাঁয়ে ছেয়ে গিয়েছে বুঝতে পারছে না সামিন। আলো কপাল কুঁ’চ’কে সামিনের দিকে তাকাতেই সামিন চোখ সরিয়ে নেয়। আলো দৃঢ় ভাবে বলে,”সুযোগ চেয়েছেন, সুযোগ দিয়েছি। আগে নিজেকে প্রমাণ করে দেখান। মনে রাখবেন, স্ত্রীর মন পাওয়ার আগে তার শরীর কা/মনা করা পুরুষদের আমি ঘৃ/ণা করি।”

সামিন কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে যে তার স্ত্রীর শুধুমাত্র শরীর কা/মনা করে না, তার যে তার স্ত্রীর মনটাও পেতে হবে এই কথাটা এখনো ঐ অবুঝ মেয়েটা বুঝলো না। এতো যু/দ্ধ তবে কেন করলো সামিন? শরীর তো বহু আগেই পেতে পারতো। কিভাবে মুখের ওপর কাট কাট বলে দিলো ঐ অভদ্রমহিলা। সামিন কি তাকে ছুঁ/য়ে ফেলতো নাকি আজ? খুবই অ’ভ’দ্র এই মহিলা। মুখে কোনো লাগাম নেই!

আলো বলতে থাকে,”বুঝতে পেরেছেন?”

সামিন কিছু না বলে মাথা নাড়ায়। তারপর নিচু স্বরে বলে,”জ্বী।”

_তাহলে নিজেও সময় নিন এবং আমাকেও সময় দিন।

আলো কথা গুলো বলে শেষ করার আগেই সামিন বলে ওঠে,”সিম্পল কথা, সিম্পল ভাবে বলো,ধ/মকে কেনো বলছো।”

আলো চুপ করে থাকে। সামিন এদিক ওদিক তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে,”বলছিলাম, আমি কি ডিভানে শোবো মানে…”

আলো রা/গী চোখে তাকিয়ে আছে। সামিন একটা ঢোক গিলে ফেলে, তারপর কাঁচুমাচু মুখ করে বলে,”দুমাস ডিভানে শুয়ে শুয়ে মেরুদন্ড বাঁকা হয়ে গিয়েছে আমার!”

আলো সামিনের দিকে কিছুক্ষণ কপাল কুঁ’চ’কে তাকিয়ে থাকে। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে, বিছানার মাঝামাঝি দু’টো কোলবালিশ দিয়ে বিছানা ভাগ করে নিন।

“অনেক উদার তুমি আছিয়া”
বিড়বিড় করে বলে সামিন বাধ্য ছেলের মতো আলমারি থেকে বিশাল সাইজের দুটো কোলবালিশ বের করে এনে বিছানার মাঝখান টাতে রাখে। তারপর আলোকে বলে,”তুমি কোন পাশটা নিতে চাও।”

আলো বিছানার দিকে তাকিয়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ। যেন সে বুঝে উঠতে পারছে না তার কোন পাশটা নেওয়া উচিত। সামিন বলে,”তাড়াতাড়ি বলো, আমার ঘুম পাচ্ছে। ”

আলো ডানপাশটা দেখিয়ে বলে,”আমি এই পাশে থাকবো।”

“ওকে”
উত্তর দিয়ে সামিন অপর পাশে গিয়ে টান টান হয়ে শুয়ে পরে। আলো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আলমারি থেকে একটা নরমাল সুতি শাড়ি বের করে ওয়াশ রুমে ঢোকে। শাড়িটা পাল্টানোর সময় তার কানে হাসির শব্দ পৌঁছায়, ঘরের ভেতর সামিন হাসছে। অদ্ভুত! এতো বিশ্রীভাবে রা/ক্ষসের মতো ঘর কাঁপিয়ে হাসছে কেন!

শরীরে শাড়ির আঁচল জরিয়ে সে বেরিয়ে আসে। সামিন গা দুলিয়ে হাসছে। মনে হচ্ছে বিছানাটাও কাঁপছে।

আলো কৌতুহলী হয়ে তাকে দেখছে। সামিনের হাতে কিছু একটা আছে। সেটার দিকে তাকিয়ে বারবার পাগলের মতো হাসছে। আলো তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে। স্বভাবে বদ হলেও লোকটার হাসি সুন্দর, হাসলে মনে হয় যেন কত মাসুম একটা লোক, কত সহজ সরল একটা লোক!
সামিন আলোকে দেখতে পেয়ে আরো জোরে জোরে হাসতে থাকে। আলোর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ধ/মকের সুরে বলে,”রা/ক্ষসের মতো হাসছেন কেনো?”

সামিন বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে তার হাতের ছবির অ্যালবাম টা আলোর দিকে তুলে ধরে।

ওটা আলোর ছোটোবেলার ছবির অ্যালবাম। আলো তার ছোটো বেলার ছবি দেখে লজ্জায় কুঁ/কড়ে যায়। একটা ছবিতে তার নাক বেয়ে সর্দি পারছিলো। আরেকটা ছবিতে আলোর বেল মাথা। আতাউর আলম মজা করে ছবি দুটো তুলে রেখেছিলো।

সামিন আবারো হাসতে থাকে। আলোর লজ্জা রা/গে পরিনত হয়। রেগেমেগে বলে,”কোথায় পেয়েছেন এগুলো?”

_আনিয়েছি তোমার ভাইদের দিয়ে। তোমার সব প্রয়োজনীয়,প্রিয়, গোপনীয় জিনিস। সবকিছু এখন আমার হেফাজতে।

অ্যালবামের আরেকটা পাতা উলটে আবারো হাসতে শুরু করে সামিন । এই ছবিতে আলো মুরগির ঠ্যাং চিবুচ্ছিলো। ভ/য়ংকর পর্যায়ের কুশ্রী একটা ছবি।
সামিন বুকে হাত দিয়ে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে বুকে ব্যাথা হয়ে গেলো।
আলো তে/ড়ে যায়,”দিন ওটা। দিন বলছি।”

সামিন অ্যালবামটা পিছনে সরিয়ে হাসতে হাসতে বলে,”দেবো না।”

_ইয়াসার মির্জা ওটা আমার পার্সোনাল জিনিস।
ধমকের সুরে বলে ওঠে আলো।

_এটা আমার পার্সোনাল বৌয়ের পার্সোনাল জিনিস।
ঠান্ডা গলায় বলে সামিন।

আলো থা/বা মে/রে নিতে যায় অ্যালবাম টা। সামিন দিতে নারাজ। একপ্রকার হাতা/হাতি লেগে যায় দুজনের মধ্যে। একসময় আলো কিছুটা সফল হয় অ্যালবামটা নিজের দিকে টেনে নিতে কিন্তু তৎক্ষণাৎ সামিন হ্যাচকা টা/ন মা/রতেই অ্যালবাম সহ আলো পরে যায় সামিনের গায়ে। হুট করে আলো পরে যাওয়ায় সামিন টাল সামলাতে না পেরে নিজেও পরে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় সামিনের চোখ দুটো রসগোল্লা সাইজের মতো বড় বড় হয়ে যায়। আলোর মাথা তার বুকে ঠেকে গিয়েছে। চুলের খোঁপা খুলে সামিনের মুখের ওপর ছড়িয়ে আছে।
ধীরে ধীরে হাত দিয়ে আলোর চুল গুলো সরিয়ে দেয়। আলো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। কানে সামিনের হৃদস্পন্দন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে উঠে বসে ছবির অ্যালবাম আকরে ধরে মাথা নিচু করে বসে থাকে আলো। সামিন ধীরে ধীরে উঠে বসে আলোর নিচু করে রাখা মুখটার দিকে একপলক তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আলোকে আর অস্বস্তিতে ফেলতে চায় না তাই সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে হন হন করে বারান্দার দরজা খুলে সেখানে চলে যায়।
বিছানার ওপর আলো কিছুক্ষণ থ/ম মেরে বসে ছিলো। ধীরে ধীরে সেও উঠে দাঁড়ায়। অ্যালবামটা আলমারিতে তুলে রেখে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে গায়ে চাদর টেনে।

দীর্ঘক্ষণ বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। একটু আগের ঘটনা মনে করে এখন মুচকি মুচকি হাসছে। সৃষ্টিকর্তা তার প্রতি বরাবরই সদয়। বৌ না চাইতেও বুকে এসে পরে। আহা কি কপাল তার!

একা একা কিছুক্ষণ হেসে নিয়ে আবারো চেহারায় গাম্ভীর্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে সামিন, তারপর ঘরের ভেতরে গিয়ে বারান্দার দরজা লাগিয়ে দেয়। ঘুরে বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে আলো ওদিকে ফিরে শুয়ে আছে। সম্ভবত ঘুমিয়ে গিয়েছে। সামিনও ধীরে ধীরে নিজের যায়গায় শুয়ে পরে। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে আবারও উঠে বসে। আশ্চর্য জনক ভাবে এই ঘরে ঢোকার আগে চোখে গোটা রাজ্যের ঘুম ছিলো। এখন সেই ঘুম নেই। বুকে কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তার আছিয়া তার বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। মাঝখানে দুটো কোলবালিশ একটার উপর আরেকটা সাজিয়ে রাখা। এই দুটো মাঝখান থেকে সরতে কতটা সময় নেবে কে জানে! তবে সামিন ইয়াসার মির্জা তার ধৈর্যের চূড়ান্ত পরিক্ষা দিতে প্রস্তুত। তার জীবনে আপাতত একটাই স্বস্তির ব্যাপার, আছিয়া তাকে তার মন জিতে নেওয়ার নমিনেশন দিয়ে দিয়েছে। এখন তাকে জিততেই হবে মন জয় করার নির্বাচন! কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়াই নির্বাচন, তবুও জেতাটা সহজ নয়। এমন ভাবে সে জিততে চায় আছিয়াকে যে আছিয়া যেন নিজে এসে তাকে জয়ী ঘোষণা করে জয়ের মালা পরিয়ে দেয় তাকে।

সামিন কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মৃদু হাসে। আবারও তার কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে পরে যায়। কতটা নাস্তানাবুদ হয়েছে ওই মেয়েটা। চেহারা টা দেখার মতো ছিলো! মাথা ঘুরিয়ে আলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”আজকের জন্য অতটুকু যথেষ্ট আছিয়া। আমি কৃতজ্ঞ তোমার প্রতি!”

চলমান…….

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_৩৯
#Esrat_Ety

“কলিং বেল টিপে চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামিন। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে দেয় আলো। সামিন মুখে চ কারন্ত শব্দ করে বলে,”বড্ড কেয়ার/লেস তুমি। স্বামীর বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে আর তুমি স্টার জলসা নিয়ে ব্যস্ত। এতো করে কলিং বেল টিপছি দরজা খোলার নামই নেই!”

আলো সামিনের থেকেও বিরক্ত হয়ে বলে,”ফালতু কথা বলবেন না। কে স্টার জলসা নিয়ে পরে আছে? আমার জীবন টা কি স্টার জলসার সিরিয়ালের থেকে কম কিছু? জীবন টা বরবাদ হয়ে গিয়েছে আমার আপনার মেয়েদের কে সামলাতে গিয়ে।”

সামিন আলোকে সরিয়ে দিয়ে বলে,”সরো তুমি সামনে থেকে। কই দেখি আমার প্রিন্সেস রা কোথায়!”

দূর থেকে ছোট ছোট দুজন পরীর মতো নয় বরং দুটো পরীই দৌড়ে এসে তাদের বাবাকে আঁকড়ে ধরে।
দু’জনের চোখে পানি ছলছল করছে। ঠোঁট উল্টিয়ে রেখেছে। সামিনের মাথায় রা/গ উঠে যায়, উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”ও মা। আমার মায়েরা কাঁদছে কেন? কে কি বলেছে ওদের? কার এতো বড় সাহস!”

আলো পাত্তা না দেওয়ার মতো করে বলে,”আমি। আমার এতো বড় সাহস।”

_তুমি? তোমার সাহস কি করে হয়? কি করেছো ওদের?

_মে/রেছি। ঠাস ঠাস করে। দুই গালে দুটো। দুটোর গালে মোট চারটা।
কাট কাট বলে আলো।

সামিন চোখ রাঙিয়ে বলে,”সাহস কি করে হয় তোমার! কোন সাহসে এমন কাজ করলে?”

_যে সাহসে আপনাকে চ/ড় মেরেছিলাম একদিন।

সামিন তার মেয়েদের আগলে নিয়ে তাদের চু/মু দিতে থাকে। তারপর আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”কি করেছিলো ওরা? কেন মেরেছো?”

_একজন আরেকজনের চুল ছিড়ছিলো টেনে, থুতু দিচ্ছিলো।

সামিন তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,”এসব তো তোমার থেকেই পেয়েছে। এখন আমি তোমার দুই গালে দুটো দেই?”

আলো ভেংচি কেটে কপাল কুঁ’চ’কে চলে যায়। সামিন বিড়বিড় করে বলে,”বেয়া/দব মহিলা। স্বামীকে একটু মান দিতে চায় না।”

বাচ্চাদের কোল থেকে নামিয়ে আলোর দিকে এগিয়ে যায় সামিন। কপাল কুঁচকে আলো টেবিলে খাবার বাড়ছিলো। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মৃদু স্বরে সামিন বলে,”রা/গ করলে?”

_না। ছাড়ুন আমায়। বাচ্চাদের সামনে স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার হু/মকি দিচ্ছেন। খারাপ লোক।

সামিন আলোকে ঘুরিয়ে নেয়। দুই গালে হাত রেখে বলে,”কখন তোমাকে মা/রার কথা বললাম?”
_এই মাত্রই তো বললেন। বলেছেন আমার দুই গালে দুটো দেবেন।

সামিন হাসে, তারপর বলে,”দুই গালে দুটো দেবো বলেছি। কি দেবো তা তো বলিনি।”

আলো সরু চোখে তাকিয়ে বলে,”কি দেবেন?”

সামিন কয়েক পলক আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”দেখাচ্ছি।”

কথাটি বলেই সামিন ঠোঁ/ট বাড়িয়ে দেয়। আলো লজ্জা পেয়ে মুখ ঢেকে ফেলে।

ঝনঝন আওয়াজে সামিন চোখের পাতা মেলে তাকায়। চোখে রাজ্যের ঘুম। শব্দটা কানের ভেতরে যন্ত্রনার সৃষ্টি করছে। কিছু মুহূর্ত সময় নিয়ে সে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিলো তবে! বিরক্তিতে সামিন মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। তখনও ঝনঝন শব্দ হচ্ছিলো। এতো সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলো সামিন, মাঝ পথে ভেঙে গেলো, চু/মুটাও দিতে পারলো না। বিরক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। দেখে আলো আলমারির কাছে দাঁড়িয়ে মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে।

সামিন ঘুম ঘুম কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে বলে,”এতো সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। তোমার কোনো অধিকার নেই এভাবে অন্যের স্বপ্ন
ভা/ঙার। ভাঙচুর করছিলে কেনো?”

আলো সামিনের দিকে একপলক তাকিয়ে ঝুঁকে নিচে পরে থাকা স্টিলের বক্সটা হাতে তুলে নেয়।

সামিন বলতে থাকে,”কি হলো? কি করছো?”

আলো হাতের বক্সটার দিকে তাকিয়ে বলে,”এটা কি?”

_ওটার মধ্যে তোমার গয়না।

আলো বক্সটার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন বিরক্ত হয়ে বসে থাকে। আড়চোখে আলোকে দেখে বিড়বিড় করে বলে,”আমার সুখ দেখতে পারে না এই ভদ্রমহিলা!”

আলো সামিনের দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলে,”বিড়বিড় করে কি বলছেন?”

_তোমাকে গালাগাল দিচ্ছি। এতো সুন্দর একটা স্বপ্ন ভেঙে দিলে তাই।

বক্সটা আলমারিতে তুলে রেখে গম্ভীর কন্ঠে আলো বলে ওঠে,”তা কি এমন স্বপ্ন দেখছিলেন আপনি যে সেটা ভেঙে যাওয়াতে আমাকে এতো কথা শোনাচ্ছেন?”

গা থেকে চাদর সরিয়ে মেঝেতে পা রাখে সামিন। হাই তুলে ওয়াশ রুমের দিকে যেতে যেতে বলে,” বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড কা/প জিতেছে। ট্রফির গায়ে অধিনায়ক চু/মু খেতে যাচ্ছিলো। এটাই দেখেছি। তুমি
চু/মুটা আর খেতে দিলে না তাকে। কত অমানবিক তুমি। ভালো কিছু তোমার সহ্য হয়না।”

কথাটা বলে সামিন হেলে দুলে ওয়াশ রুমে ঢোকে। আলো চুপচাপ কপাল কুঁ’চ’কে দাঁড়িয়ে থাকে। কি আজব এই লোক। বাংলাদেশ সেদিন ম্যা/চ হেরে বাড়ি ফিরেছে। আর সে এখনো ওয়ার্ল্ড কাপের স্বপ্ন দেখছে!

“ভাবী আসবো?”
ফুলির মা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
আলো ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,” এসো।”
ফুলির মা আলোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে বলে,”আপনি তো গোসল করেননি। গোসল করে নিচে আসেন ভাবী। মেজো ভাবী আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। তার বাপের বাড়ি থেকে লোক এসেছে। আপনাকে দেখবে।”

আলো তৎক্ষণাৎ বলে,”চলো। আমি ফ্রেশ হয়েছি।”

ফুলির মা অবাক হয়ে বলে,”গোসল করবেন না?”

আলো বিরক্ত হয়ে বলে,”গোসল করানোর জন্য উঠে পরে লেগেছো কেন সকাল সকাল?”
পরক্ষনেই ফুলির মায়ের কথার অর্থ ধরতে পেরে আলো তে/তে ওঠে,”চলো নিচে চলো। বেশি কথা বলবে না।”

ফুলির মা মুখ অন্ধকার করে চলে যায়। বড় ভাইজান এ কোন মেয়েকে এনেছে সেই ভালো জানে। এই মেয়ের কোনো কান্ডজ্ঞান নেই।

***
নিচ তলার লিভিং রুমে রিতুর বাবা মোফাজ্জল করিম বসে আছে। সে একটা কাজে শহরে এসেছিলো। তাই মেয়ের বাড়িতে এসেছে। আলো নিচে নেমে লিভিং রুমের দিকে এগিয়ে যায়,রিতু উঠে দাঁড়িয়ে আলোকে বলে,”ভাবী আমার বাবা।”
আলো মুখ হাসি হাসি করে বিনয়ী ভঙ্গিতে সালাম দেয় । মোফাজ্জল করিম সালামের জবাব দিয়ে আলোকে বলে,”মা বসো‌!”

আলো “জ্বি” বলে বসে পরে। মোফাজ্জল করিম বলে,”তোমাকে রিতুর মায়ের দেখার খুব শখ ছিলো মা। ইয়াসার বাবার জন্য কত প্রস্তাব দেখেছি আমাদের এলাকায়। ইয়াসার বাবাকে রাজি করাতে পারিনি কখনোই। তাই রিতুর মা খুবই আগ্রহী ইয়াসারের বৌ দেখার জন্য। কিন্তু কপাল, বরাবরের অসুস্থতা তার। তাই আসতে পারেনি। কখনো আসবেও না।”

আলো চুপ করে থেকে বলে,”বাড়িতে গিয়ে রিতুকে ভিডিও কল দিবেন। আমি ওনার সাথে কথা বলবো চাচা।”

মোফাজ্জল করিম খুশি হয়। বড়লোকের বৌ, ভেবেছিলো কথাবার্তায় অহংকারী হবে। আলোকে যথেষ্ট বিনয়ী মনে হচ্ছে। সে তার পাশ থেকে একটা প্যাকেট উঠিয়ে আলোর দিকে ধরে বলে,”তোমার জন্য একটা শাড়ি এনেছি মা। গরীব মানুষ তো,স্বর্ন উপহার দেবার সামর্থ তো নেই।”

আলো কিছুটা অস্বস্তিতে পরে যায়, মুহুর্তেই কাটিয়ে নিয়ে বলে,”আমি খুব খুশি হয়েছি চাচা। আমি শাড়ি খুব পছন্দ করি।”

খাবার টেবিলে মোফাজ্জল করিমকে নিজের হাতে পরিবেশন করে খাওয়ায় আলো। রিতু যথেষ্ট স্বস্তি পাচ্ছে আলোর এমন স্বাভাবিক আচরণে। এখন ভাইয়াকে পুরোপুরি মেনে নিলেই হয়। রিতু তাহলে অনেক বড় চিন্তা থেকে মুক্তি পাবে।

সামিন এখনো নিচে নামেনি। শেভ করে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিছানায় মটকা মে’রে পরে ছিলো। আজ নতুন হাইস্কুল নির্মাণের প্রকল্প সংক্রান্ত ঝামেলা সামলাতে হবে। অথচ শরীরটা অলস হয়ে পরে আছে। নিচে নাস্তা করতে পর্যন্ত যায়নি। আলো সেই কখন নিচে গিয়েছে। এখনো ফেরেনি। নিশ্চয়ই এখনো খাচ্ছে। অনেক খায় এই মেয়ে। কিন্তু এর ওজন এতো কম কেন! খাবার গুলো কোথায় যায়!

কিছুক্ষণ বসে থেকে সামিন বারান্দায় চলে যায়। বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করে অলসতা কাটাবে সে।

ঘরে ঢুকে আলো হাতের শাড়ির প্যাকেট টা আলমারিতে তুলে রাখতে যাবে তখনি পেছন থেকে রিতু বলে ওঠে,”ভাবী।”

আলো ঘুরে তাকায়‌। রিতু এগিয়ে গিয়ে বলে,”একটা আবদার করবো?”

আলো অবাক হয়ে বলে,”কি আবদার?”

_যদি কিছু মনে না করো,বাবা যে শাড়িটা তোমাকে দিয়েছে সেটা একটু পরবে? বাবা দেখে গেলে খুব আনন্দিত হতো। শাড়িটার দাম পনেরো শ টাকা। বাবা আসলে হীনমন্যতায় ভুগছে এতো কমদামি শাড়ি দিয়ে। কি বলো তো, মাকে সপ্তাহে যে ইনজেকশন টা দিতে হয় তার দামই পনেরো শত টাকা।

আলো কিছুক্ষণ রিতুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,”তুমি গিয়ে চাচার সাথে গল্প করো। আমি শাড়িটা পরে আসছি।”

রিতু কৃতজ্ঞ চোখে আলোকে দেখে চলে যায়। আলো এদিক ওদিক তাকিয়ে শাড়িটা বের করে ওয়াশ রুমে ঢোকে।

সকালের রোদ পেয়ে সামিনের অলসতা কেটে যায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বাগানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দোতলার বারান্দা থেকে পোনা চাচাকে ডেকে বাগানের ফুল গাছে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বলে ঘরে চলে যায়। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে দরজা ভেজিয়ে রাখা। আছিয়া এখনো ফেরেনি।
” নিজেই খাচ্ছে, স্বামী নাস্তা করুক বা না করুক তাতে তার কি! সুযোগ দিয়েছে এটাই তো অনেক। জগৎ উদ্ধার করে দিয়েছে মহারানী!”

বিড়বিড় করে বলে সামিন আলমারি থেকে নতুন একটা পাঞ্জাবি বের করে ওয়াশ-রুমে দিকে এগিয়ে যায়। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সে স্তম্ভিত হয়ে যায়। আলো তার দিকে বোকার মত তাকিয়ে আছে। সামিন ও কয়েক মুহূর্ত বোকার মতো তাকিয়ে থেকে বেরিয়ে আসে।

শাড়ির আঁচল ঠিক করে আলো রেগে/মেগে বেরিয়ে এসে সামিনকে বলে,”কমন সেন্স নেই কোনো?”

_তুমি দরজায় সিটকিনি লাগিয়ে নিতে পারোনি ? সিটকিনি কেনো থাকে দরজায়?

আলো ক্ষে/পে যায়,”সিটকিনি টা যে কাল লা/থি মে/রে ভেঙে ফেলেছিলেন সেটা ঠিক করেছিলেন? দরজা ঠিকভাবে লাগানো যাচ্ছে না।”

সামিন থতমত খায়। তাই তো। সেটা তো ঠিক করাই হয়নি। তারপর আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”সিটকিনির ব্যাপারে মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলে না? আমি এই শহরের মেয়র। একটা মাথায় কত কিছু মনে রাখবো?”
আলো বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে বলে,”নিজের ভুলের দোষ আমার ঘারে দেবেন না। সকালে ওয়াশ রুমে গিয়ে দেখেন নি সিটকিনি তে সমস্যা?”
_তখন তো ঠিক ছিলো।
_ছিলো না,আলগা হয়ে যাচ্ছিলো।

_হয়েছে। নাউ স্টপ। চেঁচিয়ে কথা বলো না, সবাইকে জানিয়ে দিও না আমি তোমাকে শাড়ি চেঞ্জ করার সময় দেখে নিয়েছি।

আলোর গায়ে আগুন ধরে যায় কথাটি শুনে। আলোর অগ্নি/মুর্তি দেখে সামিন ভয় পেয়ে বলে,”কিছু দেখিনি আমি। কিছুনা। আমি বলতে চাইছি চেঁচিয়ে এসব বললে মানুষ অমন ভাববে। প্লিজ রাগ করো না।”

_আপনি সাংঘাতিক লোক। আপনাকে যদু মধু ভাবলে ভুল হবে।
আলো ঠান্ডা গলায় বলে।

সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো বলতে থাকে,”আপনার আচরণ দেখে মনেই হয়না আপনার বয়স বত্রিশ বছর।”

_কেন? কি আচরণ করি আমি?

আলো কিছু না বলে চলে যেতে নিলে সামিন খপ করে আলোর হাত টেনে ধরে। আলো সামিনের মুখের দিকে তাকায়। সামিন বলতে থাকে,”শুধু আমাকেই দোষী করবে তুমি। তোমার যায়গায় আজ আমি ওয়াশ রুমে থাকলে, তুমি যদি এক্সিডেন্টলি ওভাবে ঢুকে যেতে তাহলে তো বলতে আমি ইচ্ছে করে ওয়াশ রুমের দরজা খোলা রেখেছি যাতে তুমি আমার সবকিছু দেখে যাও।”

আলো সামিনের কথায় হতভম্ব হয়ে যায়। সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”তোমার স্বভাবের ভুলটা ধরিয়ে দিলাম আছিয়া। শুধু অন্যের দোষ টাই দেখো তুমি। যাই হোক, আজ সত্যিই আমার ভুল ছিলো,ওয়াশ রুমে ঢোকার আগে নক করে বলা উচিত ছিলো,”শুনছেন কেউ কি ওয়াশ রুমে আছেন?”
নাটকীয় ভঙ্গিতে কথা গুলো বলে সামিন‌।

আলো কিছু বলতে নেয়। সামিন আলোকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পাঞ্জাবি হাতে ওয়াশ রুমে ঢোকে। আলো চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মোফাজ্জল করিমের কাছে যায়।

***
নাস্তা সেরে কিছুক্ষণ মোফাজ্জল করিমের সাথে কথা বলে সামিন রুমের দিকে পা বাড়ায়। বাইরে যাওয়ার আগে একটু বৌয়ের মুখ দেখবে না? কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ঝগড়া লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে ঝগড়া করতে চায় না।

ঘরে ঢুকে চুপচাপ নিজের টেবিলের কাছে গিয়ে ল্যাপটপ বের করে কিছুক্ষণ কিছু একটা দেখে।
আলো বিছানায় চুপচাপ বসে ছিলো।‌ সামিন আড়চোখে বেশ কয়েকবার আলোকে দেখে। তারপর আয়নার সামনে গিয়ে গায়ে পারফিউম মাখতে থাকে। কিছুক্ষণ পর সামিনকে অবাক করে দিয়ে আলো বলে ওঠে,”সরি।”

সামিন অবাক, অবাক এবং অবাক হয়ে যায় আলোর মুখে সরি শব্দটা শুনে। সে অবাক চোখে আলোর দিকে তাকায়। আলো নিচু স্বরে বলে,”তখন ওভাবে আপনাকে ব্লেইম করা ঠিক হয়নি। দোষ আসলে কারো ছিলো না।”

সামিন আনন্দিত হয়ে যায় তার ঝগড়ুটে বৌয়ের এমন নমনীয় রুপ দেখে। কিন্তু সে কন্ঠ গম্ভীর রেখে বলে,”ইটস্ ওকে।”

আলো চুপচাপ বসে থাকে। কথা আগে বাড়াতে সামিন গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,”তোমার বইয়ের লিস্ট টা দিও। আনিয়ে দেবো। সেমিস্টার ড্র/প দেওয়ার তো কোনো মানে হয় না। সবাই বলবে সামিন ইয়াসার মির্জার বৌ ফেলু, আদুভাইয়ের ছোটো বোন আদুরি আপা, এটা কিভাবে মানা যায়।”

আলো চুপচাপ। সামিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”এভাবে গুটিয়ে নেয়া টা তো কোনো সমাধান না আলো। দূর্ঘটনা সবার সাথে হয়। তাই বলে বারবার হতেই থাকবে এমন তো কোনো কথা নেই তাই না?”

আলো নিশ্চুপ। সামিন কয়েক মুহূর্ত আলোকে দেখে তার মুখোমুখি বসে। তারপর মৃদু স্বরে বলে,” লাইফে নেগেটিভ ঘটনা ঘটতেই থাকবে আলো, জীবনের একটা অংশ সেসব। আমরা এড়িয়ে যেতে পারবো না , না আমাদের সেই ক্ষমতা আছে। যেটা আমাদের ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে সেটা হলো ঐ সকল নেগেটিভ জিনিসগুলোর মধ্যে থেকে পজিটিভ কিছু বের করে নিজেকে স্বস্তি দিয়ে লাইফটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।”

আলো সামিনের দিকে মুখ তুলে তাকায়, অস্ফুট স্বরে বলে,”এ/সি/ড এ্যা/টাকের মধ্যে কি পজিটিভ ছিলো?”

_পজিটিভ ছিলো না। ভাবতে হবে। এ/সি/ড তোমার মুখে পরেনি। গায়ে লেগেছে মাত্র‌ । এটাই পজিটিভ কিছু।

_ঠিক যেমন সেদিন আমার বিয়ে হয়েছিল, রে/ই/প তো হয়নি, তেমন পজিটিভ কিছু?

সামিনের মাথায় প্রচন্ড রা/গ উঠে গেলেও সে চেহারায় তা প্রকাশ করে না । ম্লান হেসে আলোর একটা গালে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলে,”না কেউ আমার লাইফে শ/ত্রু হিসেবে এসে আমার জীবন টা আলোকিত করে দিয়েছে তেমন পজিটিভ কিছু।”

আলো চুপ করে থাকে। সামিন গাল থেকে হাত সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

আলো বসে বসে ভাবে, এই মাত্র সে সামিনের মেজাজ খারাপ করে দেওয়ার মতো একটা কথা বলে ফেলেছে, এই লোকটা কোনো রিয়াক্ট করলো না কেন!

ডক্টর রুবি ফোনটা রিসিভ করে বলে,”হ্যা সামিন বলো।”

_আন্টি সেদিন সাই/ক্রিয়া/টিস্টের কথা বলেছিলেন ওনার কাছে একটা এ্যাপয়েনমেন্ট চাই। কাইন্ডলি ব্যবস্থা করবেন?

_কেন নয়। তবে বলো তো কি হয়েছে?

_তেমন কিছু না আন্টি,আপনি যেরকম বলেছিলেন তেমন আচরণ করছে। গুটিয়ে থাকছে।

_সময় দাও ওকে, হয়তো সেরে উঠবে।

_না আপনি এপয়েনমেন্টের ব্যবস্থা করুন। আর হ্যা, আমি আলোকে নিয়ে ওনার বাসায় যেতে চাই, চেম্বারে নয়।

_কেন?

_আমার বৌ যদি জানতে পারে তাকে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছি আমি তাহলে আমার নতুন সংসারে আগুন লেগে যাবে। ঐ মেয়েকে আপনি চেনেন না আন্টি। খুব আত্ম অহংকারী। সাইজে অতটুকু হলে কি হবে ওর আকাশ ছোঁয়া আত্মসম্মান।

রুবি হাসতে থাকে সামিনের কথায়। তারপর বলে,”ঠিকাছে। তেমনটাই হবে। আর ভালো কথা, সিঙ্গাপুরের ডক্টরদের সাথে কথা হয়েছে। তারা বলছে যত তাড়াতাড়ি যেতে পারো ততোই ভালো। আলোর পাসপোর্ট করা আছে?”

_বলতে পারছি না আন্টি।

_আচ্ছা ব্যাবস্থা করো। আমাকে তোমাদের সুবিধা মতো জানিও, আমি আবার কথা বলবো।

***
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে আলো ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। মাত্র গোসল সেরেছে সে, ভেজা চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে রেখেছে। গায়ে একটা হালকা গোলাপী রঙের শাড়ি। ইশিতা খেতে খেতে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”আমি এখন বুঝতে পারছি ভাবী, ভাইয়া কেনো তোমার জন্য পাগল হয়েছে।”

আলো কিছু না বলে চুপচাপ বসে পরে চেয়ার টেনে। ইশিতা বলতে থাকে,”এতো সুন্দরী হয়েও তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিলো না? বেশ অবাক লাগে।”

আলোর চোখ মুখ ফ্যা/কাশে হয়ে যায়। সে প্রসঙ্গ পাল্টাতে রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”খাবে না তুমি?”

রিতু মাথা না’ড়ি’য়ে বলে,”ভাইয়া আসুক। আমি ভাইয়ার সাথে খাবো।”

আলো অবাক হয়ে বলে,”প্রেগ/ন্যান্ট তুমি! বেলা আড়াইটার কাছাকাছি। এখনো বসে আছো?”

_ভাইয়া একা একা খেতে পারেন না।

_তাই বলে প্রেগ/ন্যান্ট অবস্থায় অনিয়ম?

“তুমি তো প্রেগ/ন্যান্ট না। তুমি অপেক্ষা করো। ভাইয়া আসলে খাও ভাবী।”

ইশিতা খেতে খেতে বলে। আলো ইশিতার দিকে তাকিয়ে থাকে, ইশিতা হাত ধুয়ে উঠে পরে, আলোর দিকে না তাকিয়ে বলতে থাকে, “সকাল থেকে কিছু খাইনি। তাই আমি জলদি জলদি খেয়ে নিলাম। নয়তো আমি অপেক্ষা করতাম। এখন তোমরা দুই ভাবী মিলে ডিসাইড করো কে অপেক্ষা করবে। দেখো সাফ সাফ বলে দিলাম,একজনকে অপেক্ষা করতেই হবে।”

আলো ইশিতার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে দোতলায় চলে যায়। রিতু ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,”এতে কাজ হবে? স্বামীর পাশে বসে খেলেই কি স্বামীর প্রতি ভালোবাসা জন্মায়?”

_নাহ,অভ্যাস জন্মায়। অভ্যাস থেকে কখনো কখনো ভালোবাসা জন্মায়।

ইশিতা কথাটি বলে দোতলায় চলে যায়। রিতু বসে খেতে থাকে।

***
অতি সতর্কতার সাথে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে সামিন। ঐ মেয়েটার অন্যকে যেভাবে দোষারোপ করার স্বভাব আবার কি না বলে বসে,”এভাবে হুরমুর করে ডা/কাতের মতো ঘরে ঢুকছেন কেন? কি লু/ট করতে চান?”

ঘরে ঢুকে আড়চোখে একপলক আলোর দিকে তাকিয়ে সামিন ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে হাত ঘড়ি খুলে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখে দেয়। আলোর সাথে কথা বলার বাহানা খুঁজতে থাকে সে। একমনে একটা বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে আলো।‌ কিছুক্ষণ উ’শ’খু’শ করে বলে ওঠে,”সিটকিনি ঠিক করে দিয়েছে মিস্ত্রী?”

“হ্যা!”
তৎক্ষণাৎ এক শব্দে জবাব দিয়ে দেয় আলো। সামিন এখন কি বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। মেয়েটা নিজে থেকে দুটো কথা বলে না, যেটুকু বলে তা সামিনের হৃদয় পো’ড়া’তে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সামিন আবারও বলে,”আবার সিটকিনিতে ঝামেলা হলে বলবে!”

আলো অবাক হয়ে বই থেকে মুখ তুলে সামিনের দিকে তাকায়,”সিটকিনি নিয়ে পরেছেন কেন?”

সামিন থতমত খেয়ে যায়। আলো বই সরিয়ে রেখে বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে,”হাত মুখ ধুয়ে আসুন।”

_কোথায় আসবো?

_নিচে, খাবার টেবিলে!

_হ্যা তো? তাতে তোমার কি? আমার ইচ্ছা মতো আমি যাবো।

আলো চুপ করে সামিনকে কিছু সময় দেখে বলে,”ধেরে খোকা বানিয়ে রেখেছে না আপনাকে আপনার মা? একা একা খেতে পারেন না, ঢং! ”

_তোমাকে দেখতে কে বলেছে। তুমি তোমার মতো খাও দাও আরাম করো।

_আপনার বোনের হুকুম। কাউকে না কাউকে অপেক্ষা করতে হবে। রিতুকে প্রেগ/ন্যান্ট অবস্থায় কিভাবে অপেক্ষা করতে দিই।

সামিন আলোর দিকে এগিয়ে এসে আলোকে ভালো করে দেখে, তারপর নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,”বাবা! এতো ভালো হলে কবে!”

আলো কপাল কুঁ’চ’কে বলে,”বাজে না বকে খেতে আসুন।”

কথাটি বলে আলো ঘুরে দাড়াতেই সামিন খপ করে আলোর হাত ধরে ফেলে। আলো সেদিকে তাকায়। সামিন আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,”আমি কেউ পাশে না থাকলে খেতে পারি না। খেয়ে দেয়ে আমার পাশে বসে থাকবে। আমার জন্য না খেয়ে অপেক্ষা করার দরকার নেই।”

কিছুক্ষণ দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো ধীরে ধীরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নিচে চলে যায়। সামিন তার পিছু পিছু যায়।

***
কতক্ষন ঘুমিয়েছে তা সে জানে না। অনিচ্ছাকৃত ভাবে ভাতঘুম হয়ে গিয়েছে আজ। বিকেলে ঘুমিয়ে উঠলে কম-সে-কম একঘন্টা তার লেগে যায় এটা বুঝতে যে এখন সকাল নাকি রাত। মাথার মধ্যে অদৃশ্য কোনো পোকা ভো ভো করে। বিছানা থেকে নেমে ওয়াশ রুমে ঢুকে চোখে মুখে পানি দিয়ে ঘর থেকে বের হয়। ইয়াসার মির্জা কোথাও বেরিয়েছে। ঘর থেকে বেরিয়ে দোতলার লিভিং রুমে দাড়িয়ে পরে আলো। ইশিতা,রিতু, সিতারা, ফুলির মা লিভিং রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে কিছু একটা দেখছে। আলো এগিয়ে যায় ওদের কাছে।

“কি হয়েছে আপু?”
ইশিতা আলোর ডাকে পিছু ফিরে তাকায়। আলো এগিয়ে যায়। শান্তিনীড়ের পশ্চিম পাশের বাগানে লোকজন জড়ো হয়েছে। গোল করে কিছু চেয়ার পাতা। তার একটাতে বসে আছে সামিন ইয়াসার মির্জা। তার পাশে কিছু মুরব্বি শ্রেনির লোক। প্রচুর লোকজন জড়ো হয়েছে। দুজন অল্পবয়সী ছেলে মেয়ে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

আলো ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,”কি হচ্ছে এখানে?”

_ সালিশ বৈঠক।

আলো অবাক হয়ে যায়,”কিসের সালিশ?”

_ঐ ছেলে মেয়ে দুটোকে দেখছো? ওরা স্বামী স্ত্রী। ওই মেয়েটা নিয়মিত স্বামীর হাতে মা’র খায়। অথচ ওদের প্রেমের বিয়ে।

_তাহলে ডি’ভোর্স নিয়ে নিক। এখানে মেয়রের কাছে কি? মেয়র কি ডি’ভোর্স লইয়ার?

ইশিতা আলোর দিকে তাকায়। তারপর বলে,”মেয়ে তার স্বামীকে ছাড়বেও না।”

আলো অবাক হয়ে যায়। ইশিতা বলতে থাকে,”ওদের দুজনের বাবা মা এসেছে ভাইয়ার কাছে একটা বিহিত করে দেওয়ার জন্য।”

_তোমার ভাইয়া কি বিহিত করবে?

_দেখোই না।

আলো তী’ক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে। সামিন গলা উঁচু করে ছেলেটাকে ধ’ম’কে যাচ্ছে। মিইয়ে গিয়েছে ছেলেটা।

“এতো কথা কেন বলছেন, অমন স্বামীর কান মলে দিন লোকের সামনে, ল’জ্জা দেওয়া দরকার উজবুকটাকে।”

আলো কথা টা বলে শেষ করতে পারে না, ইশিতা আলোর মুখ চেপে ধরে।
সামিন সহ সালিশে থাকা প্রত্যেকটা লোক অবাক হয়ে দোতলার বারান্দার দিকে তাকায়। ইশিতা আলোকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে যায়।

সালিশে উপস্থিত থাকা মুরব্বিরা সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”বৌমা তো তোমাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।”

***
“অমন স্বামী বলতে তুমি কি বোঝাতে চেয়েছো?”

সামিনের কথায় ঘুরে তাকায় আলো। তারপর নিচু স্বরে বলে,”সালিশে কি বিচার হয়েছে?”

_মা’রতে উঠেছিলাম। বৌ এসে বাংলা সিনেমার লক্ষী বৌয়ের মতো স্বামীকে রক্ষা করেছে। শেষ বারের মতো মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে দু’জনকে।

আলো চুপ করে থাকে। সামিন বলে,”বললে না তো,অমন স্বামী বলতে কি বুঝিয়েছিলে তখন?”

_খা’রাপ স্বামী!
আলো অস্ফুট স্বরে বলে ।

সামিন আলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,”খারাপ স্বামীদের কান মলে দেওয়া উচিত , আর খারাপ বৌদের কি করা উচিত?”

আলো চোখ তুলে তাকায়। সামিন আরেকটু এগিয়ে এসে বলে,”বলো কি করা উচিত খারাপ বৌদের সাথে?”

আলো চুপ করে থেকে সামিনকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় সামিনের কথার জবাব না দিয়ে।

সামিন একা একা কিছুক্ষণ হেসে বিড়বিড় করে বলে,”খারাপ বৌদের শা’স্তি দেওয়া উচিত। ভালোবাসার শা’স্তি!”

***
পিঠের কিছু কিছু স্থানে ঘা পুরোপুরি শুকিয়ে যায়নি। একটা মলম হাতে আলো দাঁড়িয়ে আছে। একা একা মলমটা লাগানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
আচমকা সামিন ঘরে ঢুকতে আলো ঘুরে দাঁড়ায়। তার পুরো মুখ অস্বস্তিতে ছেয়ে গিয়েছে। সামিন একপলক আলো আর তার হাতের মলম টা দেখে নিচু গলায় প্রশ্ন করে,”কাউকে ডেকে দেবো?”

_হু। ইশিতা আপুকে।
অস্ফুট স্বরে বলে আলো।

সামিন ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে ইশিতাকে পাঠিয়ে দেয়।

ইশিতা আলোর ঘরে এসে বলে,”ডেকেছিলে ভাবী?”

_হু, মলমটা পিঠে লাগিয়ে দাও।
ইশিতা এগিয়ে যায়। মলম লাগিয়ে দিতে দিতে হুট করে বলে বসে,”ভাইয়াকে বললেই তো পারতে। সে লাগিয়ে দিতো।”

আলো কপাল কুঁ’চ’কে ইশিতার দিকে তাকায়। ইশিতা হাসতে হাসতে বলে,”রাগলে তোমাকে আরো আরো বেশি সুন্দর লাগে ভাবী। এখন ভাইয়ার সামনে যেও না। ভাইয়া আরো পাগল হয়ে যাবে।”

ইশিতা হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায়। আলো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বারান্দায় চলে যায়।

সামিন ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকিয়ে আলোকে দেখতে না পেয়ে আলমারির কাছে যায়। আলমারি থেকে কোলবালিশ বের করে এনে বিছানার মাঝখানটাতে রাখতে রাখতে বিরবির করে কোলবালিশ দুটোকে উদ্দেশ্য করে বলে,”স্বামী স্ত্রীর মাঝে তৃতীয় পক্ষ হয়ে ঢুকতে তোদের লজ্জা করে না?”

আলো বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে সামিনের কান্ড দেখে অবাক হয়। বলে,”কাকে কি বলছেন?”

সামিন থতমত খেয়ে বলে,”নিজেকে।”

আলো কিছু না বলে বিছানায় শুতে যাবে অমনি সামিন বলে,”তোমার পা/স/পো/র্ট আনিয়ে রেখেছি নিজের কাছে।”

আলো তার দিকে তাকিয়ে বলে,”কেনো? কোন কাজে?”

_সা/র্জা/রির জন্য সিঙ্গাপুর যাবো আমরা। তোমার ওখানে সা/র্জারি হবে।

আলো চুপ করে থাকে। সামিন বলে,”তোমার শরীরের ক্ষ/ত ভ্যানিশ হয়ে যাবে। খুব শিগগিরই।”

_আর মনের ক্ষ/ত?
প্রশ্নটি করে আলো তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে।

সামিন কিছুক্ষণ পরে বলে,”মনের ক্ষ/ত? তার দায়িত্ব আমি নিলাম। দেখি কি করা যায়, ভাবতে দাও, সামিন ইয়াসার মির্জাকে সময় দাও আছিয়া।”।

চলমান…..