#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_৫৪
#Esrat_Ety
শান্ত ইশিতার দিকে তাকিয়ে আছে। বিরবির করে বলে ওঠে,”রূপকথার সাত চম্পা ভাই ঘুমিয়ে থাকে, আর তোমার চম্পা ভাইয়েরা রাত সাড়ে বারোটার সময়টাতেও জেগে আছে! কি বিপদ! এরা কি আর্লি টু বেড এ্যান্ড আর্লি টু রাইজ প্রবাদটা জানে না?”
ইশিতা শান্তর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়, তারপর উঠে গিয়ে দরজার সিটকিনি খোলে।
ইলহামের চিৎকার শুনে সামিন আর আলো একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। চিন্তিত ভঙ্গিতে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে ইলহামের ঘরের দিকে যায়। ঘরের দরজা খোলা, ইহান ভীত চোখে ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ, ইলহাম ওয়াশ রুম থেকে রিতুকে পাঁজাকোলা করে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়। পেটে হাত চেপে রিতু তীব্র আর্তনাদ করে যাচ্ছে। সামিন ইলহামের দিকে তাকায়,রিতুকে কোলে তুলে নেয়ায় ইলহামের শার্টে র’ক্ত লেগে গিয়েছে।
আলো হতভম্ব হয়ে ছুটে যায় রিতুর কাছে। কপাল কে’টে রক্ত ঝরছে রিতুর। পেটে তীব্র যন্ত্রনায় কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছে না সে।
সামিন গিয়ে ইহানকে আগে কোলে তুলে নেয়। ইলহাম উৎকণ্ঠা নিয়ে বলতে থাকে,”হঠাৎ কিভাবে পরে গেলো জানিনা। ওয়াশ রুমের দরজা ভেঙে বের করেছি।”
সামিন একপলক রিতুর দিকে তাকিয়ে ইলহামকে বলে,”সময় নেই, ওকে তোল। আমি গাড়ি বের করছি।”
ইলহাম গায়ের রক্তাক্ত শার্ট না পাল্টেই রিতুকে তুলে নেয়। সামিন ইহানকে আলোর কাছে দিয়ে গাড়ির চাবি নিতে ঘর থেকে বের হয়ে লিভিং রুমে আসতেই দাঁড়িয়ে পরে।
শান্ত আর ইশিতা তার সামনে দাঁড়িয়ে। শান্ত চোরের মতো মুখ করে রেখেছে। সামিন হতভম্ব হয়ে শান্তর দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো ইহানকে কোলে নিয়ে বের হয়ে দাঁড়িয়ে পরে। পরী কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলো। সামিন ঘুরে রাগী দৃষ্টিতে পরীর দিকে তাকায়। এ ধরনের বুদ্ধি যে এই মেয়েটার মাথা থেকে বের হতে পারে তা সে জানে। পরী ছুটে গিয়ে আলোর পেছনে আড়াল হয়ে দাঁড়ায়। ইশমাম কিছুক্ষণ সামিনের দৃষ্টি দেখে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,”আমি ডেকেছি শান্তকে ভাইয়া।”
সামিন ইশমামের দিকে তাকায়। আলো পাশ থেকে বলে ওঠে,”চলুন না, এখন এসব থাক, শিগগিরই গাড়ি বের করুন।”
সামিন দ্রুতপায়ে হেঁটে ঘরে ঢুকে গাড়ির চাবি আনে। এখন এতকিছু দেখার সময় নেই তার।
রিতুর অবস্থা আরো খারাপ হতে শুরু করেছে। অসহ্য যন্ত্রণায় গগন বিদারী চিৎকার দিয়ে যাচ্ছে। পেছনের সিটে বসে ইলহাম শক্ত করে রিতুকে ধরে রেখেছে।
আলো ইহানকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে সামিনের পাশের সিটে বসেছে।
শান্তিনীড়ের গেইট থেকে রাত সাড়ে বারোটায় দু’টো গাড়ি বের । পেছনের গাড়িতে রয়েছে ইশমাম,ইশিতা,শান্ত ও পরী।
ইশমাম ড্রাইভ করতে করতে মাথা ঘুরিয়ে শান্তকে বলে,”তোমাকে তোমার বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাই? কাল তো তোমার অফিস আছে।”
_তোমাদের বাড়ির এতো বড় বিপদে আমি বাসায় চলে যাবো? আমিও যাবো হসপিটাল। রিতু ভাবী আমাকে অনেক পছন্দ করতেন। আমিও করতাম। চলো সোজা হসপিটাল চলো।
দৃঢ় ভাবে বলে শান্ত।
ইশিতা মিনমিন করে বলে ওঠে,”ভাইয়া কি মনে করেছে কে জানে! আমি ভাইয়াকে মুখ দেখাবো কি করে? আসতে গেলে কেন তুমি? যত্তসব।”
শান্তকে ধমকে ইশিতা পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,”সবকিছুর মূলে তুই তাই না?”
পরী চুপ করে থাকে। ইশমাম ইশিতাকে বলে ওঠে,”এখন এসব কথা বলার সময়? মেজো ভাবীর জন্য প্রে কর। ভাইয়াকে ম্যানেজ করা যাবে। তোরা কোনো অন্যায় করিসনি।”
***
“বাচ্চা ইমিডিয়েটলি বের করতে হবে, নয়তো একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে। মা ও বাচ্চা দুজনের লাইফ রিস্ক।”
ইলহাম ডক্টরের দিকে তাকিয়ে আছে। আ’তঙ্কিত লাগছে তাকে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”কিন্তু এখনও যে সময় হয়নি!”
_কিচ্ছু করার নেই ইলহাম মির্জা, দূর্ঘটনার জন্য প্রি-টার্ম লেবার পে’ইন উঠেছে। আমাদের হাতে সময় কম। সি-সেকশন ছাড়া উপায় নেই। আপনি মানসিক ভাবে প্রস্তুত হন। বন্ডে সই করতে হবে!
ইলহাম চ’ম’কে ওঠে। চাঁপা স্বরে চেঁ’চি’য়ে বলে ওঠে,”বন্ডে সই করতে হবে মানে?”
_মানে বললাম তো, রিস্কি। শুধু উপরওয়ালাকে ডাকুন।
ইহান অবাক চোখে সবার মুখের দিকে তাকায়। তার অবুঝ মনে হাজারটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, কিন্তু সে বুঝতে পারছে না কে তার প্রশ্ন গুলোর উত্তর দেবে, শেষমেশ সে তার বড় বাবার কাছে গিয়ে তার হাত ধরে। সামিন ইহানের মুখের দিকে তাকায়। ইহানের চোখ দু’টো ছলছল করছে, কান্নামিশ্রিত কন্ঠে সে বলে ওঠে,”মাম্মার কি হয়েছে বড় বাবা?”
সামিন কোনো জবাব দেয়না। শুধু আদুরে মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো এসে ইহানকে কোলে তুলে নিয়ে বলে ওঠে,”মাম্মা পায়ে ব্যাথা পেয়েছে বাবা। ডক্টর আন্টি ব্যা’ন্ডেজ করার জন্য নিয়ে গিয়েছে।”
কাঁপা কাঁপা হাতে ইলহাম বন্ডে সই করে দেয়। হঠাৎ করে তার বুকটা মো’চড় দিয়ে উঠলো যেন। এতটা উতলা নিজেকে কখনও মনে হয়নি। রিতুর কি দেখা উচিত না ইলহামের এই অবস্থা? একটু হলেও তো খুশি হতো সে। তৃপ্ত হতো সে!
এদিক ওদিক অসহায়ের মতো তাকিয়ে বিরবির করে ইলহাম বলে ওঠে,”শুধু আমার বাচ্চার জন্য নয় রিতু। তোমার জন্যও আমি কষ্ট পাচ্ছি। সত্যিই পাচ্ছি।”
রিতুকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাইরে ওয়েটিং রুমে সবাই দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। শুধু আলো ঘুমন্ত ইহানকে বুকের সাথে আগলে নিয়ে বসে আছে। ইলহাম করিডোরের এমাথা থেকে ওমাথা পায়চারি করছে।
সামিন মাথা ঘুরিয়ে শান্তর দিকে তাকায়। শান্ত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু সময় পরে সামিন বলে ওঠে,”তুমি গেলেই পারতে। কাল অফিস আছে।”
_ভাবীর একটা ভালো খবর শুনে যাবো ভাইয়া।
নিচু স্বরে বলে শান্ত।
অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়। অপারেশন থিয়েটার থেকে একজন ডক্টর বের হয়। ইলহাম তার দিকে এগিয়ে যায়, ডক্টর মাস্ক খুলে ইলহামের দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বলে,”আপনার ছেলেকে ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে রাখা হচ্ছে, প্রিম্যাচিউর বেবী তো, তবে চিন্তা করবেন না বত্রিশ সপ্তাহেই আপনার ছেলে বেশ হাট্টা কাট্টা। আপনার ওয়াইফের স্টি’চিং চলছে। জ্ঞান নেই তার। যাস্ট প্রে ফর হার ।”
মা ও বাচ্চাকে দু’টো আলাদা কেবিনে শিফট করা হয়েছে অবজারভেশনের জন্য। নার্স ব্যতীত অন্য কেউই ঢুকতে পারবে না আপাতত। ইলহাম কিছুক্ষণ পর পর একবার রিতুর কেবিনের সামনে গিয়ে দরজার কাচ দিয়ে উঁকি মেরে রিতুকে দেখছে, একবার নিজের ছেলের কাছে যাচ্ছে।
ইহান তার বড়মার বুকের সাথে লেপ্টে ঘুমিয়ে আছে।
কিছু সময় পরে সামিন ইশমামের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”এখানে এতো লোক থাকার দরকার নেই এখন। আমি, ইলহাম আর তোর বড়ভাবী থাকবো। তুই ইহান আর বাকিদের নিয়ে বাড়িতে যা। ”
_কিন্তু ভাইয়া,ভাবীর অবস্থা….
_ফোনে জানাবো তোদের। সকালে চলে আসবি। এখন যা, সবার থাকার প্রয়োজন নেই। এটা হসপিটাল।
ইশিতা যেতে চাচ্ছিলো না শুরুতেই । সামিন সবাইকে জোর করতে থাকে।
শান্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সামিন তার দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার বাসা তো এখান থেকে অনেকটা দূরে। তুমি বরং আমাদের বাড়িতে যাও।”
শান্ত মাথা তুলে সামিনের দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সাথে বলে,”না ভাইয়া। আমি আমার বাসায় যাচ্ছি।”
রিতুর কেবিনের দরজার বাইরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ইলহাম। সামিন এক পলক ইলহামকে দেখে আলোর পাশে গিয়ে বসে পরে। আলো মাথা তুলে সামিনের দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বলে,”এই মুহূর্তে একটা শাশুড়ি মায়ের অভাব বোধ করছি খুব। সব কিছুর প্রে’শার আমার উপর দিয়ে যাবে এখন।”
সামিন হেসে ফেলে। আলোর ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে ওঠে,”এই হাত দুটো একেবারে আমার মায়ের হাতের মতো জানো? গোলগাল, সুন্দর।”
আলো কোনো জবাব না দিয়ে ইলহামের দিকে তাকায়। একবার নিজের ছেলের কাছে যাচ্ছে, একবার এসে স্ত্রীকে দেখছে। ইলহামকে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ত একজন পুরুষ মনে হচ্ছে।
মাথা ঘুরিয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”রিতু যদি ইলহামের এই দরদ টুকু দেখতো তবে খুব স্বস্তি পেতো।”
সামিন বলে,”একেবারেই ঠিক বলেছো।”
আলো চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই আবার বলে ওঠে,”আমাদের বিবাহিত জীবনের বেশিরভাগ রাতই আমরা হসপিটালে কাটি’য়েছি মেয়র সাহেব। ”
সামিন হেসে ফেলে, প্রসঙ্গটা সরিয়ে বলে ওঠে,”আমি ভাবছি অন্য কথা। চোখের সামনে ছোটো ভাই গুলো একটা একটা করে বাবা হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যর্থ পুরুষ মনে হচ্ছে। ধি’ক্কার জানাই নিজেকে।”
আলো মাথা নিচু করে ফেলে। একটা বাচ্চার জন্য লোকটার কত পাগলামি! কত ছটফটানি! কত উন্মাদনা!
জ্ঞান ফিরতেই স্বামীর মুখটা দেখতে পেয়ে রিতু আবেশে আবারও দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে। ইহানের জন্মের সময়টার কথা মনে পরে যায় তার, তার শশুর,শাশুড়ি, ভাসুর,ননদ সবাই ছিলো তার পাশে। ছিলোনা শুধু এই লোকটা। আজ এই মানুষটা দু’চোখে দরদ নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কি প্রমাণ করতে চাইছে? রিতু খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেউ তার কাছে?
ইলহাম রিতুর দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। পুনরায় চোখ মেলে রিতু অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”ছেলেকে দেখেছেন?”
_হ্যা। দূর থেকে। ছুঁতে পারিনি, কোলে নিতে পারিনি।
রিতু চুপচাপ ইলহামকে দেখতে থাকে। ইলহাম একটা চেয়ার টেনে বসে রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”রিতুদের আত্মসম্মান থাকে না বলেছিলে। রিতুরা যে এতোটা স্ট্রং তা তো বলোনি।”
রিতু ইলহামের কথার জবাব না দিয়ে বলে,”দুঃখিত। আপনাকে মেয়ে দিতে পারিনি।”
ইলহাম হেসে রিতু্র মাথায় বুলিয়ে দিয়ে বলে,”পরের বার।”
রিতু ম্লান হাসে। ইলহাম রিতুর মাথা থেকে হাতটা সরিয়ে নিতে যায় তখনই রিতু বলে ওঠে,”হাত টা সরিয়ে নেবেন না। কিছুক্ষণের জন্য থাক। জীবনে কখনই মাথায় হাত বুলিয়ে দেননি আমার। এর অনুভূতি আমার জানা ছিলো না। কেমন প্রশান্ত লাগছে নিজেকে ইলহাম মির্জা।”
“কি দেখছেন?”
সামিন আলোর কন্ঠ পেয়ে ঘুরে তাকায়। রিতুর কেবিনের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সে। আলো এগিয়ে গিয়ে বলে,”ভাই আর ভাইয়ের বৌয়ের ব্যাক্তিগত মুহুর্তে নাক গলানো অভদ্রতা মেয়র সাহেব। চলুন।”
সামিন হেসে ফেলে। তারপর বলে,”জানি, তবে বোনের আনন্দ দেখে আনন্দিত হবার অধিকার আমার আছে।”
***
ঘুম থেকে উঠে ইহান নিজেকে ফুপির পাশে শুয়ে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করলো। তাকে মাম্মার কাছে যেতে দেওয়া হয়নি দেখে অভিমানে ছোট্টো মনটা ভরে গেলো। বিছানা থেকে নেমে উচ্চশব্দে কাঁদতে শুরু করলো সে। ইশিতা ঘুম থেকে ধরফরিয়ে উঠে বসে, পরী একটু বাইরে গিয়েছিলো, দৌড়ে ইহানের কাছে আসে। ইহানের গালে হাত বুলিয়ে বলে,”কাঁদছো কেনো ইহান?”
_আমি মাম্মার কাছে যাবো, পাপা কোথায়? বড় বাবা কোথায়? কাঁদতে কাঁদতে জানতে চায় ইহান।
ইশিতা ইহানকে আগলে নিয়ে বলে,”একটু পরে তোমাকে নিয়ে যাবো আমরা সোনা। তুমি জানো তোমার একটা ছোট ভাই হয়েছে। খুব সুন্দর একটা ছোট ভাই।”
ইহানের ছোটো ভাইয়ের কথা শুনে অভিমান হয় খুব। ছোটো ভাই হলে মাম্মা পাপারা তাকেই আদর করে শুধু,তাদের ক্লাসের রাফি বলেছে। রেগে মেগে ইহান ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়।
ইহানের পিছু পিছু ছুটে আসছিলো পরী।
হঠাৎ সামনে ইশমামকে দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পরে। একটুর জন্যে ইশমামের সাথে ধাক্কা লাগেনি তার। ইশমাম কিছু সময় পরীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলে ওঠে,”আজ গায়ে পরলে না যে! ”
পরী কি বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। এভাবে বলার কি আছে! পরী কি ইচ্ছে করে গায়ে পরে? নিজের দোষ কখনো দেখে না! পরীও তো বলতে পারে সবসময় সে-ই পরীর রাস্তায় এসে পরে ঠেলাগাড়ির মতো।”
পরীর নীরবতা দেখে ইশমাম হেসে ফেলে।
মাথা তুলে ইশমামকে একপলক দেখে ইহানকে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে যেতে থাকে পরী। ইশমাম দাঁড়িয়ে পরীকে দেখতে থাকে। কিছুটা দূরে গিয়ে পরী পিছু ফিরে তাকায়। ইশমামের দিকে অনর্থক দৃষ্টি দিয়ে সামনে পা বাড়াতেই দরজার কপাটে সজোরে মাথায় বারি খায় ।
ইশমাম চোখ বড় বড় করে ফেলে, তারপর পরীর দিকে এগিয়ে যাবে তার আগেই কপালে হাত চেপে ধরে পরী আড়াল হয়ে যায়। রা’গে তার ইচ্ছে করছে মাথায় আরেকটা বারি দিতে। সবসময় তার সাথেই এমনটা হবে কেন!
ইশমাম দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ হাসতে থাকে দীর্ঘসময় ধরে।
***
ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দে ইশমাম ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে ফোনটা হাতে নেয়। ফিহা নামের মেয়েটি ফোন দিচ্ছে তাকে। নাম্বারটা তার ফোনে সেইভ করে দিয়েছিল ইশিতা। এর আগে ভাইয়ার চাপে পরে দুবার কথা হয়েছিলো মেয়েটির সাথে। টুকটাক সৌজন্য আলাপ হয়েছিল শুধুমাত্র। এখন এতো রাতে মেয়েটির ফোন দেখে সে অনেকটাই অবাক হয়েছে। ফোনটা রিসিভ করতে গিয়েও করে না সে। এখন একটুও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
মির্জা বাড়ির নতুন সদস্যের নাম রাখা হয়েছে “ইরফান”। তাকে ঘিরেই মির্জা বাড়ির লোকের যত আহ্লাদ,যত আনন্দ। সবাই তাকে পেয়ে অসম্ভব খুশি, মুখ ভার করে থাকে শুধু একজন। তার নাম ইহান। মুখ ভার করে স্কুলে যায়, স্কুল থেকে ফিরে মুখ ভার করে বড় মা আর বড় বাবার ঘরে বসে থাকে। মাম্মা পাপার রুমে সে যাবে না, ওখানে ভাইকে বেশি আদর করা হয়। তারও ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে ভাইকে আদর করে দিতে, কিন্তু তার কোলে ভাইকে দেওয়া হয়না । তাই সে যাবে না।
আলোর কাছে আজকের দিনটা সবচেয়ে ব্যস্ততম দিন। আজ ফুলির মা এবং সিতারা দু’জনেই ছুটিতে আছে। ইশিতা আর শান্তর রিসিপশনের তোড়জোড় চলছে বাড়িতে। হাতে রাজ্যের কাজ। ইরফানের বয়স এক মাস হয়েছে, রিতু তাকে নিয়ে চূড়ান্ত ব্যস্ত। বাড়ির সব ব্যাপার এবং ইহানকে আলোই দেখে। অবশ্যি তার মেয়র সাহেব সবসময় চেষ্টা করে তার কাঁধ থেকে কিছু দায়িত্ব সরিয়ে নিজের কাঁধে নেয়ার, কিন্তু সামনে এমপি ইলেকশন নিয়ে সেও ভীষণ ব্যস্ত। দুপুরে প্রায়শই খেতে আসে না সামিন। একেবারে রাত করে বাড়িতে ফেরে এবং নিয়ম করে বৌয়ের ঝাড়ি খে’য়ে ঘুমিয়ে যায়। আবার ঘুম থেকে উঠে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। আলো একদিন হু’মকিই দিয়ে বসে,” এমন করলে আমি কিন্তু বাপের বাড়ি চলে যাবো মেয়র সাহেব।”
সামিন হেসে বলে,”লাভ কি? রাত বারোটায় তো ঠিকই দরজা খুলে স্বামীকে ঘরে ঢোকাবে। শুধু শুধু কষ্ট করে ও বাড়িতে কেনো যাবে! রাগ করতে হলে এ বাড়িতে বসেও দিব্যি রাগ করা যায়।”
আলো শাড়িগুলো আলমারিতে তুলে রাখতে রাখতে আনমনে হেসে ফেলে কথা গুলো ভেবে। আলমারিতে আরো নতুন ছয়টা শাড়ি যোগ হয়েছে। চারটার রং কমলা। কি অদ্ভুত একটা লোক। প্রত্যেক মাসে কিছু নির্দিষ্ট দিনে একটা করে শাড়ি নিয়ে এসে আলোর হাতে দেয়। যখনই তাকে জিজ্ঞেস করা হয় আজ কেন শাড়ি দিলেন? গম্ভীর কন্ঠে ভাষণ দেওয়ার মতো করে বলবে,”আজ অমুক দিন, এই দিনে বৌকে একটা শাড়ী কিনে না দিলে স্বামীত্বের অপমান হয়।”
গত শুক্রবার একটা শাড়ি এনে একই ভাবে হাতে তুলে দিয়েছিল মেয়র সাহেব। আলো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,”আজ কেন? আজ তো শোক দিবস।”
সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”সেটাই। আজ শোক দিবস। শাড়ির রং এজন্যই কালো। শোক দিবসে বৌকে কালো রঙের শাড়ি দিতে হয়।”
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ওঠে,”আপনাদের পলি*টিশিয়ানদের সবকিছু জুড়েই দেখছি বঙ্গবন্ধু ও দেশ। একজন বাসর ঘরে বৌকে বঙ্গবন্ধুর গান শোনায়। আর তাদের লিডার শোক দিবসে বৌকে কালো রঙের শাড়ি উপহার দেয়।”
আলো উচ্চশব্দে হেসে ফেলে সেদিনের কথা মনে করে। ইহান বিছানায় বসে ড্রয়িং করছিলো, মাথা তুলে বড়মার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”তুমি হাসছো কেনো বড় মা?”
আলো কিছু বলতে যাবে তখনই সামিন হনহন করে ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে পরে। আলো অবাক হয়ে যায় অসময়ে সামিনকে এভাবে বাড়িতে দেখে । সামিনের দৃষ্টি দেখে ঘা’বড়ে গিয়ে বলে,”কি হলো? বাইরে ঝামেলা করে এলেন নাকি? আবার কোন মেয়েকে তুলে আনলেন? না মানে এর আগেও তো ইলেকশনে জিততে মেয়ে তুলে এনেছিলেন। তাই বললাম। এমনিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। একা হাতে সংসার টা সামলাতে বেশ হিমশিম খাচ্ছি। দু একজন সঙ্গী থাকলে বেশ হতো। ”
শেষের কথাটা বলে আলো হাসছে।
সামিন আলোর দিকে তাকায়। বিরক্ত কন্ঠে বলে ওঠে,”ফিহা মেয়েটি বয়’ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়েছে।”
আলো স্তব্ধ হয়ে যায়। সামিন বলে,”বয়ফ্রেন্ড আছে! পরিবারের মতে বিয়ে করতে ইচ্ছুক নয় সেটা আগে বললে কি হতো? আজ ওদের বিয়ের কথা পাকা করতে চাচ্ছিলাম। কি একটা কান্ড ঘটে যেতো তবে!”
আলো সামিনের পাশে বসে বলে,”ভালোই তো হয়েছে, বিয়ের দিন পালিয়ে গেলে ব্যাপারটা বিশ্রী লাগতো।”
সামিন আলোর দিকে তাকায়,বলে “আমি ভাবছি অন্য কথা। আমার ভাইয়ের কপালে কি বৌ নেই? কি অদ্ভুত। সব মেয়েরই বয়ফ্রেন্ড আছে। কোন মেয়েকে বিশ্বাস করে ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেই! বিয়ের দু’দিন পরে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে পালিয়ে গেলে?”
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর আমতা আমতা করে বলে ওঠে,”আমি একটা কথা বলবো?”
_বলো।
_পরীকে কেমন লাগে? কত সুন্দরী,ডাক্তারি পড়ছে, ভদ্র, আমরা চিনি, ওকে জানি, ওকে ইশমামের পাশে মানায়?
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”আচ্ছা থাক বাদ দিন। আমি এমনিই বললাম। বাদ দিন !”
সামিন বলে ওঠে,”গ্রেট! গ্রেট আছিয়া! এমনটা তো কখনও মাথায় আসেনি আমার! দারুন ব্যাপার হবে। খুব মানাবে! একশো বার মানাবে! হাজার বার মানাবে! ”
আলো অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সামিনকে খুবই উচ্ছসিত লাগছে।
সামিন বলতে থাকে,”এক মুহুর্তও দেরী করবো না আমি, একমুহুর্তও না। এক্ষুনি পোনা চাচার সাথে আলাপ করবো আমি!”
_আগে ওদের দুজনের সাথে আলাপ করে নিন।
অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে আলো।
সামিন আলোর দিকে তাকায়। আলো বলতে থাকে,”দু’জনের সাথে আগে আলাদা আলাদা হয়ে কথা বলে দেখুন। দুজনের থেকে মতামত নিন। তারপর কথাবার্তা আগান। হুট করে কিছু করা ঠিক হবে না।”
সামিন আলোর দিকে তাকায়,কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে ওঠে,”তোমাকে অনেক বুঝদার এবং সংসারী লাগছে, একেবারে হোসনে আরা শান্তির মতো। এসো আমি একটা থ্যাংক ইউ দেই তোমাকে।”
আলো মাথা ঘুরিয়ে ইহানের দিকে তাকিয়ে সামিনের দিকে তাকায়, চোখ পাকিয়ে বলে,”কি এগুলো? ইহান রয়েছে!”
সামিন অবাক হওয়ার ভান করে বলে,”কি? আমি কিছু খারাপ বলেছি? আমি বলেছি থ্যাংক ইউ দিতে চাই! সরাসরি চু’মুর কথা তো বলিনি।”
আলো কান চেপে ধরে চাঁপা স্বরে চেঁ’চি’য়ে বলে ওঠে,”চুপ করুন। মুখে কি কিছু্ই আটকায় না আপনার?”
_না, তোমার মুখে যেমন গালাগাল আটকায় না। তেমন।
_বাচ্চার সামনে যতসব উল্টো পাল্টা কথাবার্তা!
সামিন আলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে ওঠে,”তো এটাই তো উচিত। ওদের শেখাতে হবে না বৌকে কিভাবে ভালোবাসতে হয়?”
আলো শাড়ির আঁচল কাঁধে তুলে দ্রুতপায়ে হেঁটে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। এই লোকটা একবার শুরু হলে সহজে চুপ করে না,তারই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিত।”
সামিন পেছন থেকে আলোকে কিছুক্ষণ ডাকে। তারপর হেসে আপন মনে বলে ওঠে,”আশ্চর্য! সচেতনতা মূলক কথাবার্তা বললে জনগণ এভাবে ক্ষে’পে যায় কেন! নারীর প্রতি সহিংসতা নয়, নারীকে ভালোবাসার বিভিন্ন টেকনিক শেখাতে হবে এই প্রজন্মকে। এই প্রজন্মকে ভালো ভালো শিক্ষা না দিলে এরা দেশ এগিয়ে নিয়ে যাবে কি করে! স্মার্ট বাংলাদেশ কিভাবে হবে তাহলে! ”
চলমান…..